কলকাতার ধোঁয়া, ধুলো, শব্দ-ব্রহ্ম ও ব্যস্ততা থেকে বাঁচতে দক্ষিণ শহরতলির এক নিরালা অঞ্চলে নতুন ফ্ল্যাট নেয় ত্রিদিব ও বন্যা। কিন্তু তাদের নিরুপদ্রব জীবনে নেমে আসে এক নতুন উপদ্রব। তাদের শান্তি ও স্বস্তি ক্রমশ দূরে সরে যেতে থাকে। অস্থির ত্রিদিব ভেবে পায়না কী করবে? গুরুচণ্ডা৯তে পূর্বপ্রকাশিত শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য্যর লেখা ছোট গল্প 'আউশভিত্স' এর শ্রুতি কাহিনী বা অডিও স্টোরি প্রকাশ পেল ইউটিউবে স্টোরিওয়ালাস প্রোডাকশনস-এর হাত ধরে। ... ...
—না কিছু করতে পারবে না ওরা। বাড়ি গিয়েই আমার ফেসবুকে পোস্ট করব প্রমাণটা। সবাই দেখবে, জানবে। তখন ওরা বাধ্য হবে আমাদের, মানুষদের গণিতের সৃজনশীলতাকে স্বীকৃতি দিতে। উচ্চকোটির গণিত যে শুধু ওরাই একচেটিয়া পারে সেই ভুল ভাঙবে। এবং সাথে সাথে সমস্ত গণিতের দরজা আমাদের জন্যও খুলে দেবে। ন্যায্য অধিকার হিসেবেই দিতে বাধ্য হবে। —এইটা তোমার মহান প্ল্যান? —এইটাই আমার মহান প্ল্যান। ... ...
বৃষ্টির তেজ প্রচণ্ড রকমের বেড়ে গেছে এই কয়েক মিনিটে। ঝোড়ো হাওয়ার সাথে শিরশিরে শব্দ, হুড়মুড় করে নেমে এসেছে হারুর ছাদে। বুকটা ক্ষণে ক্ষণেই কেঁপে উঠছে, একটু ভয় ভয়ও লাগছে বটে, কিন্তু ছাদ থেকে হারু কিছুতেই নামবে না আজকে। ওর সব স্বপ্ন, ছেলেবেলায় অঙ্ক খাতার পিছনে সুপারহিরোদের ছবি, ব্যাটম্যানের স্কার্ফ, এক এক করে নষ্ট হয়ে যাবে। বেলগাছের ডালে ঝুলে থাকা বাবার মুখটাও অস্পষ্ট হয়ে যেতে পারে। এই সুযোগ। চোখ বন্ধ করে ঝড়ের মধ্যে শরীরটা ভাসিয়ে দিলেই কেল্লাফতে। একজোড়া ডানা ঠিক খুঁজে নেবে হারুকে। সে ভিজছে, অনবরত ভিজবে অসময়ের বৃষ্টিতে। মায়ের থেকে লুকোনো কান্না, ওষুধের দোকানে ধার, অপমান, চড়া সুদে ফিরিয়ে দেওয়ার পালা। আর তারপর ম্যাজিক! ... ...
সূর্যের আদর গায়ে মেখে, পাখির মতো দুহাত প্রসারিত করে দাঁড়ালাম। আমার শরীরে খোদিত শব্দগুলোকে স্বাধীন করে দিলাম। প্রত্যেকটা শব্দ আমার শরীর থেকে প্রজাপতির মতন পাখনা মেলে উড়ে চলল। উড়তে উড়তে তারা ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত উপত্যকায়। কেউ বসল কৃষকের হালে, কেউ বসল কুমোরের চাকায়, কেউ বসল শ্রমিকের কবজিতে, কেউ গেল ছাত্র-ছাত্রীর পাঠ্যপুস্তকের উপর। কেউ বসল দোকানদারের তুলাদণ্ডে। কেউ আবার ভিক্ষুকের ভিক্ষাভাণ্ডে, কেউ উড়তে উড়তে গিয়ে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন প্যাড গিয়ে বসল। কেউ আবার উকিলের কালো কোটে, কেউ শিক্ষকের চশমাতে, কেউ প্রবেশ করল কবি-লেখকদের হৃদয়ে। কিছু শব্দ মায়েদের মুখ থেকে শুনল তাদের গর্ভজাত সন্তানরা। কিছু শব্দ নারীর ঠোঁটে অবয়ব ধারণ করল। ... ...
বয়ঃসন্ধির সকালে যখন মাথা ভরতি ভ্যাপসা গন্ধ নিয়ে ম্যামের খোলা পিঠ থেকে অন্যায়ের দৃষ্টি আকর্ষণে এসে থামত তখন তারা ডেকে উঠত। হয়তো পুরুষ চড়ুইটা। সঙ্গমহীনতার বিষাদে৷ ঘরবন্দি ভালোবাসা ছুঁয়ে দেখতে চাইত। পুরুষত্বকে বলিয়ান করতে চাইত। হিমালয়ে শীর্ষে তার পুরুষত্বকে রাখতে চাইত। যেখানে তার কামনার সবকটা রং ছুঁয়া যাবে। রঙধনুতে হেঁটে যাবে সংস্কারে আটকে পড়া সঙ্গিনীর নিশ্বাস পুঁজি করে। পরস্পরের রঙের আদানপ্রদান হবে তারাদের মাজারে। খসে পড়া তারা বয়সি মফস্বলে স্পর্শ এঁকে যাবে কামনার উৎকৃষ্ট সময়ে। যে সময় এখনও বার বার ফিরে আসে। ফিরে যায় কাঙ্ক্ষিত শৈশবের আটকে থাকা ভূগোলে। রাত নেমে আসে, বাড়ি ফিরে একটি নিঃসঙ্গ চড়ুই। ... ...
ফোনটা হাতে নিয়ে বসার ঘরে বসে ফেসবুক, খবরের সাইট খোলে রুখু। আসামের ডিটেনশান ক্যাম্পে আটক মহিলাদের নিয়ে একটা প্রতিবেদন। পাহারাদার, কর্তাব্যক্তিদের ধর্ষণ তো সাধারণ ব্যপার সেখানে। পড়তে পড়তে রুখুর হাত পা অবশ হয়ে আসে, পশ্চিমবঙ্গেও রাজারহাট আর বনগাঁয় ডিটেনশান সেন্টারের জন্য জমি নেওয়া হচ্ছে। আচ্ছা রুখুকে ধরলে তো ভিনরাজ্য থেকে ধরে আনতে হবে। তাহলে সেখানকার জেলেই রাখবে? আর সুমুকে ধরলে? মা’কে কে দেখবে তখন? ... ...
ভোরের দিকে শীতবোধে সোমনাথের ঘুমটা ভেঙে গেল। পায়ের কাছের চাদর টেনেও শীতটা কমছে না। নিজের গলায়-কপালে হাত দিয়ে দেখল, গা বেশ গরম। নাক দিয়ে জল গড়াচ্ছে। হয়তো গত সন্ধ্যার ঠান্ডা জলের ঝাপ্টাটা বসে গেছে। কিন্তু বুকটায় চাপ ধরে আছে। দম আটকে আসছে। উঠে বসে জোরে শ্বাস নিতে গিয়ে কাশি উঠল। অন্য সময় হলে গা করত না সোমনাথ। ঝড়-বাদলের দিনে, তাপমাত্রা ওঠানামার মধ্যে এমন তো হয়েই থাকে। তার উপর সিগারেট-বিড়ি খায়। ফুসফুস এমনিতেই কমজোরি। গ্যাস-অম্বল নিত্যসঙ্গী। তার উপর চিংড়ি খেয়েছে। কিন্ত এখন খুব ভয় পেয়ে গেল সোমনাথ। এসব কীসের লক্ষণ? তবে কি দত্তদার ঘরে খাবার পৌঁছোনোর ভালোমানুষিটাই কাল হল? ওদের মুখে তো মাস্ক ছিল না। ঘরে এসে হাত ধুতে ভুলে গিয়েছিল কি? মনে পড়ছে না। ভয়টা বাড়ছে। ... ...
শূন্যতা আসলে নিষ্ক্রিয়তার উপলব্ধি। সক্রিয় জীবনযাপনে নির্দিষ্ট একটা লক্ষ্য লাগে। ধরা যাক, যে লোকটা মাউন্ট এভারেস্টে উঠছে, খাড়া বরফের উল্লম্ব দেওয়ালে চেপে গেঁথে নিচ্ছে স্নো বুট, সে জানে এখানে তার অক্সিজেন সীমিত, মেপে পা ফেলতে হয়, বেঁচে থাকার সম্ভাবনাই মাত্র পঞ্চাশ শতাংশ। এখানে তাকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে একটা তুমুল এভালান্স, এখানে এমনকী তার মৃত্যুর পরে তাকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এই এতসব ঝুঁকি তাকে এমন একটা জিগীষা দিয়েছে, যা তাকে পৃথিবীর উচ্চতমে নিয়ে যেতে পারে। হ্যাঁ, তার মৃত্যু আশঙ্কা বেশী, কিন্তু ওই ঝুঁকি আছে বলে তার জীবন সুন্দর। এমনকী, এই আরোহীর মৃত্যুও, আহা, কত দুঃসাহসিক-লিরিক্যাল। ... ...
জীবনে এতো রহস্য কেন এটা নিয়ে আমি ভেবেছি। আমার এই লেখাগুলি হয়ত সেইসব রহস্য কিনারা করার এক চেষ্টা। আমি একসময় খুবই যুক্তি দিয়ে চিন্তা করতাম। সেইসময়ে, বা তার কিছু পরে রফিকুন্নবীর সাথে আমার দেখা। এরপর থেকে রহস্য নিয়ে আমার ভাবনা চিন্তার অনেক বদল হয়েছে। রফিকুন্নবী বলেন, কী মিয়া এইসব কী কও! মিস্ট্রি থাকব না? তাইলে থাকলো কী! মিস্ট্রি ইজ দি ইন্ট্রিগ্রাল পার্ট, ইন্ট্রিগ্রাল বুঝো তো, মানেই হইল ধরো মূল একটা জিনিস, অব লাইফ। তাই মিস্ট্রি কখনো সলভ হয় না। আমি বললাম, সলভ হয় তো। অনেক হয়। শার্লক হোমসীয় কার্যকলাপ হয় তো। রফিকুন্নবী তখন বিরক্তির সাথে আমার কথা উড়িয়ে দেন। বলেন, ধুর মিয়া! মিস্ট্রি কখনো সলভ হয় না, একটা গেলে ঐ জায়গায় আরেকটা আসে। সলভ দিয়া মিস্ট্রি বিষয়ে ভাবা হইল একটা ফান্ডামেন্টাল মিসটেক। ভাববা রিপ্লেসমেন্ট দিয়া। মানে ঐ রহস্য সইরা কোনটা আসলো। ... ...
রহিমা খালা এক বাসাতে থেকে কাজ করার কথা বলল। ফুলবানু অনেক ভেবেচিন্তে রাজি হলো। খুব বড়োলোকের বাসা। থাকা-খাওয়া ওখানেই। মাসে বেতন পাঁচ হাজার টাকা। একসাথে এত টাকা ফুলবানু কল্পনাও করতে পারে না। তবে প্রথম মাসের বেতন থেকে দু’হাজার টাকা খালাকে দিতে হবে। সকাল থেকে রাত অবধি কাজ করতে হয়। সমস্যা বাধল রান্না করা নিয়ে। তার হাতের রান্না ও-বাড়ির কেউ মুখে তুলতে পারে না। পারবেই বা কেমন করে? সে কি বড়োলোকের খাওয়ার মতো রান্না করেছে কোনোদিন? নাকি খেয়েছে কোনোদিন? সমস্যা আরও আছে। এ বাড়িতে রান্না, তরকারি গরম করা, ঘর মোছা, কাপড় কাচা সবই হয় মেশিনে। ওগুলোতে হাত দিতে বড়ো ভয় করে ফুলবানুর। সে রান্না করেছে ক্বচিৎ-কদাচিৎ। ইটের চুলা বানিয়ে ভাত আর সবজি রান্না করেছে বটে; তবে সেই রান্না কি এ বাড়ির মানুষ মুখে তুলতে পারে? খালাম্মা জানিয়ে দিলেন, এ মাস গেলে বেতন দিয়েই বিদায় করে দিবেন। ও-বাড়িতে একটাই ছেলে। ভার্সিটিতে পড়ে। বড়ো ছেলে বিয়ের পরে বউ নিয়ে এই ঢাকা শহরেই থাকে। বউ এর সাথে মায়ের বনিবনা না হওয়ায় বড়ো ছেলে পৃথক বাসা নিয়েছে। ... ...
পরদিন সকালে বাইসনের পাল এড়িয়ে ঘাসের ওপর হাঁটি, কয়েক মাইল যাবার পরে একটা বড় হ্রদ পড়ল, তার পাড় ধরে দক্ষিণদিকে আরো মাইল দশেক হাঁটলাম। অবশেষে একটা বড় খামার দেখা গেল। অন্তত তিন শ একরের খামার, সয়াবিন চাষ হচ্ছে। চাষ-জমির শেষে কিছু সারি দিয়ে দেবদারু গাছ। সেটা পার হয়ে খামার বাড়ির শস্য রাখার উঁচু সাইলো ঘর, গোলাঘর, শস্য নিয়ে কাজ করার কয়েকটা ট্র্যাক্টর ও কম্বাইন। পাশে একটা দোতলা কাঠের বাড়ি। সেই বাড়ির সামনে যখন আমরা দাঁড়িয়ে তখন সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমে, আমাদের লম্বা ছায়া পড়ে বাড়ির দরজায়। আমরা ইতস্তত করি, এখানে জীবিত কি কেউ আছে? পৃথিবী নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। এই বাড়ির ভেতর রয়েছে হয়ত মৃতদেহ। যে রোগে তারা মরেছে সেই রোগ কি ছোঁয়াচে নয়? আমরা একটা কাপড় মুখে বেঁধে নিই। হঠাৎ দুটো কুকুর দৌড়ে আসে, শেপার্ড, কিন্তু তারা ঘেউ ঘেউ করে না, দাঁত খিঁচায় না, লেজ নাড়ায়, এমন যেন এই খামার বাড়ির প্রতি তাদের কোনো দায়িত্ব নেই। ... ...
যথারীতি রঙ্কির পেট ব্যথা চাগাড় দিয়েছে। দৌড়ে গিয়ে টিনের দরজা বন্ধ করেছে, কিন্তু এমন পেট মোচড়ানো যে শেকল তুলে দিতে পারেনি। কিন্তু আমাশার যেমন হয়, মোচড়াবে, কিন্তু একবারে ক্লিয়ার হবেনা, রঙ্কি কোঁথ পেড়েই যাচ্ছে ,পেড়েই যাচ্ছে, পেট আর পরিষ্কার হয় না। শেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ যখন এসে উপস্থিত হল,অমনি রঙ্কি গোল গোল চোখে দ্যাখে একজোড়া কালো হাত নিচের টিন কাত করে বড় গামলায় উবুড় করছে। ভয়ে রঙ্কি চিৎকার করতে যাবে। দ্যাখে ওপর দিকে মুখ করে হাসছে তিলোয়া, চুলে অব্দি হলুদ হলুদ কী সব, কিন্তু দাঁতগুলো সাদা ঝকঝকে। ... ...
লোকটা হাত নেড়ে বলে, বাতাস না, বাতাস না—ওসব হল গুহ্য কথা—বুঝলেন কিনা! কানের পাশ দিয়ে ফিসফিস করে বয় আর বলে যায়, সাবধান, সাবধান! লোকটা চোয়াল শক্ত করে বলে, হোমে দুটি ছেলে থাকে না? মাজু আর কেল্টু? হারামির হাড় একটা! এই তো সেদিন এদিকের পরিচিত পাগল, নিত্যকে পিটিয়ে মেরে দিল—কেউ কিছু করল না, জানল না, বুঝল না—মেরে খালের জলে ভাসিয়ে দিল দেহ—গুহ্যকথা, গুহ্যকথা! ... ...
টাকলা অফিসার লাঠিটা নাচাতে নাচাতে রামকথা শুনছে। রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছছে। তার মানে বুঝছে। রামের কথকতার তোড় বেড়ে যায়। ও এবার মহল্লার নেতাদের সমান হয়ে উঠছে। ও বোঝাতে থাকেঃ এখন তো লোকতন্ত্রের জমানা। ভোটের সময় নিয়ম করে দলবেঁধে দেশে ফেরে ওরা। সরকার মাই-বাপ, সে তো ওরা জানে পরদাদার কাল থেকে। সত্ত্বাধারীদের সঙ্গে মানিয়ে চলাই ওদের অস্তিত্বের শর্ত। বিনিময়ে সরকার ওদের বিপদে-আপদে শরণ দেবে, এটাই প্রত্যাশা। তাছাড়া ও তো এটাও শুনেছে প্রধানমন্ত্রীও উঁচু জাতির নয়। গরীব চায়েওয়ালা ছিলেন। তপস্যার জোরে উপরে উঠে এসেছেন। তবে ওদের ভোট না পেলে তাঁর তপস্যা সফল হত কি? ... ...
বিরান ঘাটে সেই সময় নজর পড়লো ত্রপার ওপর। বুকের কাছে কয়েকটা বই, একটা লম্বা খাতা জড়ো করে দাড়িয়ে আছে। স্কুল ড্রেস পরণে ছিলো না। তাই অনুমান করা গেলো যে, কলেজ ছাত্রী। একবার ভেবেছিলাম, কথা শুরু করা যাক। কিন্তু সেটা বড্ড বেশী সিনেমাটিক হয়ে যেতো। তাই চুপ করে রইলাম। কথাটা শুরু হলো দূর্ঘটনাচক্রে। দূর্ঘটনা আমিই ঘটলাম। ... ...
সবকিছু শেষ হয়ে আসছে শ্যামলী জানে। সুবিমলের মাথার ভেতরের ঐ আলোআঁধারি জগত একদিন ওকে গিলে নেবে; আর ফিরতে দেবে না এই ক্ষয়াটে শহরের বাস্তবতায়। সুবিমল টের পায় সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বাসে উঠতে গিয়ে পা টলে যায়। ভুল রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আধঘন্টা পরে বুঝতে পারে ঠিকানা ভুলে গেছে। মাঝে মাঝে মাথার ভেতরটা ছিঁড়ে যায় যন্ত্রণায়। কোনোকিছুতে মন বসাতে পারে না। গভীর রাতে কী যেন অজানা ভয়ে জেগে উঠে শুনতে পায় সারা ঘরময় খুকির খেলনাগুলো, বাঁকুড়ার ঘোড়াগুলি ঠকঠক শব্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ধীরে ধীরে একলা হয়ে যাচ্ছে ও। ... ...
শেষটায় খকখক কাশত। দুদিন গায়ে জ্বর ছিল। কোত্থেকে একটা ছেঁড়া কানি খুঁজে মুখে বেঁধে রাখত। ঝুপড়ির বাসিন্দারা সব জেনে গিয়েছে গত তিন হপ্তাভর ঢিভি দেখে দেখে। কেউ কাজে যায় না। সরকার নাকি কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। কাজে বেরোলে মরণ। ঘরে সেই মরণ ঢুকে পড়বে চুপিসাড়ে। সবকে থেকে থেকে কামড়াবে। বুঢ্ঢা সারাদিন সারারাত নর্দমার ওপরে বসে থাকত। গত পরশু ভোরে উল্টে পড়ে শুয়ে ছিল ওখানেই। খাবার নাই। আধপেটা খেতে পেলে ভাগ্যি। এক বাটি খেচড়ি। ব্যস। শরীরে সাড় ছিল না। হাসপাতাল থেকে কিম্ভূত জামা পরা লোকজন এসে তুলে নিয়ে গেছে গাড়িতে। সে গাড়ি দেখবার মতো। চকচকে। কাচ ঢাকা। উঁই উঁই সাইরেন। আহা বুঢ্ঢার গতি হল বটে। ঝুপড়ির অধিবাসীগণ কপালে জোড়াহাত ঠেকিয়ে রাম রাম হরি হরি স্মরণ করেছিল। ... ...
ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে, আর বাউন্ডুলে ফ্রান্স গেলেও ঘুরেই বেড়ায়। আমারও তাই দশা। ছুটিছাটা পেলেই প্যারিসের লং ডিসটেন্স বাস ডিপো থেকে কোনো একটা বসে উঠে অজানা জায়গায় যাই। কদিন আরামে নিজের সাথে কাটিয়ে আবার ফিরে আসি। এবারে ভাবলুম, ট্রেন ব্যবহার করি। বাসওয়ালাগুলোও বোধয় এতো দিনে চিনে গেছে আমাকে। তাছাড়া ট্রেনের ভাড়া বাসের থেকে বেশ কম শুনেছি। আমার তখন সম্বল বলতে ফ্রান্স সরকারের দেওয়া কটা ইউরো আর এক বাংলাদেশী মাইয়ারে বাংলা পড়াইয়া যা কিছু পাই, তাই। তার অর্ধেক তো চলে যায় ওরই বাপের রেস্তোরাঁতে ইলিশ ভাত, মাংস ভাত খেতে। কত আর পাউরুটি চিবোবো। বইটি হস্তগত করে, একটা ছোট ব্যাগ নিয়ে দুগ্গা দুগ্গা বলে বেরিয়ে পড়লুম। দেখি চোখ কোন দিকে যায়, আমিও সেই দিকগামী হবো। তবে দুগ্গার কৃপাকে এইভাবে abuse করলে মাও যে আর বেশিদিন রক্ষে করবেননে সেটা বুঝি। কোথায় যাচ্ছি ঠিক করার একটা দারুণ উপায় মাথায় এলো। ট্রেন স্টেশনে মানচিত্র দেখে যে অজানা নামটা বেশ সুন্দর লাগলো, সেটার একটা টিকেট কেটে উঠে বসলাম। ... ...
বাড়ি কোথায়? অচিন্ত্য জল ঢকঢক করে খেয়ে গৌরের দিকে তাকায়। আঁজ্ঞে কাছেই, মাঠেমাঠে হেটি গেলি সাত মাইল, পুরন্দরপুর, থানা মগরাহাট। হেটে আসা হয় ? হ্যহ। বর্ষাকালে একটু অসুবিধে হবে। গৌর মিদ্যের মুখে যেন হাসি ধরে না। ... ...
অনিমেষ সচরাচর রেলস্টেশনে নেমে হেঁটে আসে। গোপাল বহুদূর থেকে ওর গন্ধ পেয়ে ডেকে উঠত। সেই ডাক শুনে ভৌ ভৌ করে দৌড়োদৌড়ি করত গলির কুকুর, তারপর বড় রাস্তার কুকুররা ডেকে উঠত -মেক্সিকান ওয়েভের মত কুকুরের ডাক পৌঁছত অনিমেষের কানে। গলি টুকু প্রায় দৌড়ে ঢুকত বাড়িতে। গোপাল দু পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে মুখ চাটত অনিমেষের। লিপি ততক্ষণে ভাত বসিয়েছে। আজ পাড়া নিশ্চূপ, গলি শুনশান -শুধু আলোর তলায় লিপি একলা দাঁড়িয়ে । লিপির দাঁড়ানোর ভঙ্গী, ওর কান মুখ ঢাকা শাল, ওর দীর্ঘ ছায়া, মাথার ওপর ঝাঁক বেঁধে আসা মশা অনিমেষকে যেন সমস্ত বলে দিল এক মুহূর্তে। এমনকি অনিমেষ যেন লিপির হাতের হাতের ছেঁড়া শিকলিও দেখতে পেল যাতে গোপালের বকলশ ঝুলে রয়েছে। হাতের ব্যাগ নামিয়ে রেখে অনিমেষ বলল- -'কখন? কষ্ট পেয়েছিল?' -'ঘরে চলো'। লিপি বলেছিল শুধু। ... ...