কলকাতার মানুষজনেরা এইসবের হুজ্জোতির খবর রাখে না। তাদের মন ভুলোবার হরেক চিজ আছে। এইরকম ঝামেলাওয়ালা জায়গায় দুদিনের ছুটি কাটাতেও কেউ আসে না, যতই জাগ্রত তীর্থস্থান হোক না কেন! এটা একেবারেই সীমান্ত-এলাকা, কাঁটা তারের এ পাশে লাল নিশান ওড়া ভ্রামরী দেবীর মন্দির, খুব জাগ্রত জ্যান্ত তীর্থ, ওপাশে সবুজ মাথাওয়ালা গম্বুজ, সোনা পীরের থান। মানত রাখলে নাকি কেউ খালি হাতে ফেরে না। দুপাশেই যতদূর চোখ যায় সবুজ খেত, যার বুক চিরে দৌড়ে চলে গেছে মানুষ সমান কাঁটাতার। ছুঁচলো কাঁটা, খুব শক্ত তার, আর দবেজ। সেই ছুটন্ত তারের লাইন বরাবর রাতবিরেতে বুটজুতোর মসমস, সন্দেহ জাগলেই ঘন ঘন হুইসিলের আওয়াজ। তবে তাতে কী আর কিছু বন্ধ থাকে! যার যা করার সে তাই করে যায়, কাজের মতো কাজকাম চলে, নদীর মতো নদী বহে যায়। শুধু মাঝেমধ্যে কাঁটাতারের এপাশে ওপাশে আচমকা দুম শব্দের সঙ্গে লাশ পড়ে। চাপা আর্তনাদ, দৌড়োদৌড়ির শব্দ। তারপর সব চুপচাপ। ... ...
‘আমি কক্ষনো অন্য কারুর জন্য কাঁদি নি জানো। যতবারই কেঁদেছি তা কেবল নিজের জন্য, নিজের না পাওয়া, ক্ষোভ, দুঃখ থেকে চোখে জল এসেছে। বাবা মা মারা যাওয়ার পরেও না, দাদা বৌদি সম্পর্ক কেটে চলে যাওয়ার পরেও না।‘ প্রায় একদমে বলে ফেলে একটু থমকে যায় ও, আঁচল ঘুরিয়ে এনে মুখটা মোছে। মাঝারি হাইটের গাঁট্টাগোট্টা মেয়েটির নাম দেওয়া যাক ‘আমি’। ... ... ‘তুমি যেমন অন্যের জন্যে কাঁদো নি কখনো আমার ঠিক তার উলটো। আমি নিজের লোকদের জন্য মাসের পর মাস কেঁদেছি, পাড়ার লোক যাদের রোজ দেখি তাদের কারুর কিছু হলেও কেঁদেছি। এমনকি কাগজে, টিভিতে কোথাও আগুন লেগে, জলে ডুবে, বিল্ডিং ভেঙে, ঝড়ে বন্যায় মানুষ মারা যাবার খবরেও হাউ হাউ করে কেঁদেছি। সেই থেকেই আমার নাম হয়ে গেছে খোলাকল। ... ... লম্বা চওড়া খেলোয়াড়ি ধরণের চেহারার মেয়েটির নাম দেওয়া যাক ‘তুমি’। ... ... সে মুখে একটা মিচকে হাসি ঝুলিয়ে চুপচাপ দেখছিল এদের। আমি বা তুমি কেউ কোন কথা বলছে না দেখে আস্তে করে গলা খাঁকারি দিল। ... ...
“বেলুন ছাড়া মানে?” অন্য কিছু খেলনা টেলনা দিয়ে ডাকে নাকি কচি মেয়েগুলোকে? মুখ দিয়ে অবশ্য এত কথা বেরল না। ঘেন্নায় মুখটা তেঁতো তেঁতো লাগে মল্লিকার। অনিমা এবারে একটু বিরক্তিতে ঝাঁঝি দিয়ে উঠল। শ্লেষে মুখ বেঁকিয়ে বলল, “নেকি নাকি রে এটা! বেলুন মানে কনডুম তাও জানো না? ওগুলোর তো মাসকে হয়নি না, তাই কনডুম ছাড়াই দে দনাদন।” শরীরে ঢেউ তুলে দুলে দুলে হাসে। মল্লিকা এবার অনিমার দিকে পিছন ফিরে বসল, গোটা গা জ্বলছে ওর রাগে। মনে হচ্ছে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দেয় অনিমার গালে। অনিমা নিজেও তো একটা মেয়েই। কিন্তু এখন ওর চোখে মুখে যেন রেপিস্টের তৃপ্তি। খুব মজা পাচ্ছে। মল্লিকার চোখ মুখ দেখে ওর রাগ হয়েছে বুঝতে পারে অনিমা। একটু সরে বসে তুতলে বলে, "পয়সা দেয়, পয়সা দেয় তো কাজ করিয়ে। অনেক সময় বাপমায়ে মেয়েগুলোকে ভিড়িয়ে দিয়ে ভালোই মাল্লু বুঝে নেয়। আমাদের মত গায়ে খেটে আর ক’টাকাই বা হয়?" এবার রাগের থেকেও বেশি ঘেন্না করে মল্লিকার। অনিমার মনটাই হয়তো এরকমই। দয়ামায়াহীন। না হলে ওই ছোট ছোট মেয়েগুলোর যন্ত্রণা নিয়ে অমন মজা করতে পারে? মজাও কি বলা যায় একে নাকি মনের রোগ? ... ...
এগারোটার সময় মৌলিকের অফিসের শেষ ডিনার পাওয়া যায়। তারপর শুধু এককোণে কফি, কেক, স্যান্ডউইচ ইত্যাদির কাউন্টারে একজন বসে বাকি রাত ঝিমোয় আর খুচরো প্যাকেটের চানাচুর, মধু মেশানো ওট বার উগরে দেওয়া ভেন্ডিং যন্ত্রগুলোতে সারারাত কাঁচের ভেতর নীল আলো জ্বলে থাকে। কিউ আর স্ক্যান করে টাকা দিলেই প্যাঁচানো স্প্রিং ধাক্কা মেরে কাঙ্খিত প্যাকেটকে নীচে ফেলে দেয়। রাতে কাজ করা বাধ্যতামূলক নয় অথচ রাতে একজন থাকলে ভালো হয়, সমুদ্রের ওপার থেকে বারো ঘণ্টা এগিয়ে থাকা দেশ থেকে ভেসে আসা এমনই অনুরোধ। এই শিফটে কেউ রাজি হলে প্রতি রাতে অতিরিক্ত টাকা, বিনামূল্যে খাবার এবং যাওয়া আসার গাড়ি পাওয়া যায়। রাত দশটা থেকে ভোর ছটা এই শিফটটাকে দিনের বেলা অফিসের বাকি সবাই বলে গোরস্থানের সময়। ... ...
“বহনোঁ অওর ভাইয়োঁ...আজ আমরা যে বিষয় শিখবো – সে বিষয় প্রত্যেক লেডিস ও জেন্টসের পক্ষে অত্যন্ত জরুরী শিক্ষণীয় বিষয়। পরন্তু আমাদের দেশে যে শিক্ষাবেওস্থা আছে, তাতে এই শিক্ষা আমাদের দেওয়া হয় না। আমাদের দেশের বাচ্চারা পচ্চিমদেশের অনুকরণ করে যে শিক্ষা লাভ করে, তাতে তারা যে শুধু ভোগময় জীবনের প্রতি লালচি হয় তাই নয়, বরং পাপের দিকে নিরন্তর দৌড়তে থাকে। তারা কদাপি মনমে শান্তি পায় না, দিনরাত পয়সা, প্রমোশন, আলিসান ফ্ল্যাট, লেটেস্ট মডেলের দামি গাড়ি, বছরে একবার ফোরেন টুরের স্বপ্ন দেখতে দেখতে, অন্দরসে খোকলা হয়ে যায়, পরেসান হতে থাকে। বাড়তে থাকে স্ট্রেস – মান্সিক চাপ। মেরেকো আকসর পুছা যাতা হ্যায়, বাবা, ইস সে ক্যায়সে মিলেগি ছুটকারা? কেয়া মুক্তি কি কোই ভি উপায় নেহি হ্যায়? আমি বলি, কিঁউ নেহি, বেটা, অবশ্য উপায় হ্যায়। .." ... ...
সেদিন লম্বু রতন ছাড়া ঘটনার সাক্ষী ছিলাম আমি, সনাতন, মদন আর অনন্ত। ওরা চারজন ব্যাকবেঞ্চার। আমি ব্যাকবেঞ্চার নই তবুও মনটা খারাপ হয়ে যায়। পাক্কা পঁয়তাল্লিশ দিন ছুটি। কতদিন দেখা হবেনা নিয়ম করে! রতন এক পকেট থেকে বিড়ির প্যাকেট আর খালি দেশলাই কাঠি বের করে। অন্য প্যাকেট থেকে বেরিয়ে আসে খালি দেশলাই খোল। খোল আর কাঠি একসাথে রাখলে খড়খড় শব্দ হয়। তাই এমন বন্দোবস্ত। আমরা স্কুল থেকে একটু দূরে একটা মাঠে বসে বিড়ি ধরাই। আজ দেরি করে বাড়ি ফিরব সবাই। রতন ঠোঁট দুটো আলতো ফাঁক করে রিং ছাড়ে। পাক খেতে খেতে ধোঁয়ার টায়ার আকাশের দিকে উড়ে যায়। আমরাও চেষ্টা করি কিন্তু রিং হয়না। ... ...
এক ঝিমধরা চৈত্রের আধবিকেলে ভুরুদুটো কুঁচকে ও মুখটা গোমড়া করে মহারাজ ছনেন্দ্রনাথ ওরফে ছেনু একলা ছাদে উঠে বসেছিলেন আর মাঝেমাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে কি জানি কি ভাবছিলেন। হাওয়ায় এখনো গরম তেমন নেই, সূর্যটা ঝাপসা মেঘে ঢাকা কিন্তু চারদিকে একটা গুমোট ভাব চেপে বসেছে। এমনি সময় কাঁধে কেউ একটা হাত এসে হাত রাখায় মহারাজ পিছন ফিরে তাকালেন, এ হল তাঁর পেয়ারের কোটাল বেনারসিপ্রসাদ যাকে তিনি আদর করে বেনা বলে ডাকেন। -কি হল বাবু, একলা ছাদে এসে বসে আছো, যাও যাও খেলোগে যাও। -আমার আর ভাল্লাগে না। -ভাল্লাগেনা? কেন কি হয়েছে? ... ...
- 'মাস্টার, সালা বদ রক্তে ভরে গেল শরীলটা, চুলকানি খুব, সাদা পুঁজ জমে রোজ, গেলে দিয়ে সুখ পাই খুব...কিরিম টিরিম দে কিছু ...' বিদিগুচ্ছিরি মার্কা হাসে। রাগ করি না আজকাল, দিয়ে দিই, দিলেও লাভ হয় না। এর আগে হাজারবার দিয়েছি, নিওষ্পরিন, মারকিউড়োক্রম সব। মাখেই না ... কেউ বলে মাস্টারের দরদ বেশি, কেউ আবার ওর বুকের ছেঁড়া বোতামে আমার চোখের দোষ খোঁজে। আমি গান্ডু সারাজীবন, চোখে কাফের, আমি কি খুঁজি ... কি যে খুঁজি ...কে জানে? ... ...
সুশান্তর লাইন ছিল এগারো জনের পরে। বারো নম্বর। ও সবজি শেষ হয়ে যাচ্ছে কিনা মাঝে মধ্যে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করছিলো আর সবজিওয়ালার সাথে রিপিট করছিলো “আপনার পঁচাশি আর এককেজি কাঁচা আম... একশো পাঁচ”। আর শেষে একটা করে “..হুঁ” মনে হচ্ছিলো পবিত্র মন্ত্রপাঠ চলছে। ‘হর পাপং হর ক্লেশং হর শোকং হরাসুখম্ | হর রোগং হর ক্ষোভং হর মারীং হরপ্রিয়ে।‘ ওদিকে ইলেকট্রনিক ওয়েট মেশিনের সামনে ‘পুরোহিত’, এদিকে সুশান্ত। হাতে শুধু ছেঁড়া ফুলের বদলে ছেঁড়া ব্যাগ। ছুঁড়ে না দ্যায়। ... ...
অহনা হাঁটতে আরম্ভ করে দিল। সে হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ের খাঁজে চলে গেল। দু পাহাড় যেখানে জোড় খেয়েছে আর দুটো দেশ তৈরি হয়েছে গাছেদের। হ্যাঁ, গাছেদের আর বৃষ্টিদের। সেখানে প্রপাতের শব্দ শোনা যাচ্ছে। সেইখানে অহনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখব বলে বলে ভাবছি আর দেখি সে অন্য একজনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাঁটা দিয়েছে। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। অনেকটা পাহাড় দেখার মত এক দূরত্ব। মনে হয় কাছে কিন্তু দূরত্বটা বেশ। যত কাছে যাওয়া যায় ততো দূরত্বটা থেকে যেতে থাকে, থেকে যেতে থাক – দূরত্বটা শেষ হয় না। বোঝা যায় না পাহাড়টা দূরে, বোঝা যায় না পাহাড়টা কাছে এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি হয়। সে রকমই হচ্ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম না জোরে কথা বলব না আস্তে কথা বলব। তাই দেখতে লাগলাম। প্রথমে গাছেদের এ ওর পাশে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। তারা ফুল দেয় না আর দিলেও দেখাতে চায় না যে ফুল দিয়েছে। ছোট ছোট গাছ না কিন্তু তাদের ছোট ছোট লাগে। পাশে একটা বড়ো গাছ ছিল। সেই গাছ দেখে আশ্বস্ত হয়েছি, সেখানে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম গাছ কথা কইছে আর আওয়াজ হচ্ছে কথাদের। ... ...
পাখিদা-কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দুই নম্বর রামমোহন কলোনির একমাত্র ছাতিম গাছ জানায় পাশের জামগাছটিকে। বাতাসে নড়ে ওঠে গাছেদের কানের পাতা। ডালে আলোড়ন, ফিসফিস। পাড়ার গলি-রাস্তার মাঝ বরাবর শুয়ে থাকা কালিচরণের অভ্যেস। সাইকেল, বাইকের হর্নে তার কিছুমাত্র আসে যায় না। তাকে সম্ভ্রমে পাশ কাটিয়ে বাকিদের যেতে হয়। লম্বাটে সরুপানা মুখটায় চোখদুটো আধবোজা। ‘মাধবীবিতান’ বাড়ির ঘোষালদাদু রেডিয়োয় খেয়াল শোনার সময় যে ভাবে কেদারায় শুয়ে চোখ বুজে আরামে তন্দ্রা আনে। কালিচরণের লটপটে কান সজাগ। খবরটা শুনেই গা ঝাড়া দিয়ে ‘মনমঞ্জরী’ বাড়ির প্রশস্ত পাঁচিলে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ভুক করে একটা শব্দে পঞ্চাননকে ডাকে, এ পঞ্চা! ... ...
বৃদ্ধা এক গাল হেসে, এক অদ্ভুত অকুন্ঠ এবং তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন, আমার তখন ২ বছর বয়েস যখন আমার বাবা ওকে নিয়ে আসে এই বাড়িতে। আমি ওকে কোনোদিন পছন্দ করতাম না। ও আসার পর থেকেই বাড়িতে নানা অশান্তি শুরু হয়। ওর যখন ৬ বছর বয়েস তখন থেকেই ওকে আমার বাবা প্রায়ই ওপরের একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে সন্ধ্যে বেলা দরজা বন্ধ করে দিত। ও চিৎকার করলে ওর মুখ বেঁধে দিত। আমিও তখন ছোট। তেমন কিছু বুঝতাম না। কিন্তু ওর চিৎকার করলে আমার ভালো লাগতো। আমার যখন ৯ বছর বয়েস তখন আমার মা মারা যায়। বাবা আবার বিয়ে করে। সেই বছরই। আর সেই বছরই, ওর তখন নয় কি দশ হবে, ও আমাদের বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়।" একটা অদ্ভুত নিষ্ঠুর হাসির রেখা ফুটে ওঠে বৃদ্ধার মুখে, চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে। ... ...
তা এই বাড়ির কোনকিছুই ওর নিজস্ব মনে হয় না, হয়ও নি কোনোদিন। আর শুধু বাড়ির কেন, এই পৃথিবীতে কোথায়ও কি ওর নিজস্ব কিছু আছে আদৌ! চাকরিটা বাবার জন্য শুরু করতে হয়েছিল, বিয়ের পরেও ছাড়তে পারে নি রমেনের জন্য। দাদার জন্যই লাইব্রেরীর চাকরি করেও পূর্বাঞ্চল সাংস্কৃতিক সঙ্ঘের হয়ে গণসঙ্গীত গেয়ে নাটক করে বেড়াতে পেরেছে। সেইটুকুই ছিল ওর নিজের আনন্দে বাঁচা। বাবা মায়ের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়াতো দাদা। সেই দাদাটাও অমন করে চলে গিয়ে পম্পাকে একেবারে শূন্য করে দিয়ে গেল। সেই যে ওর বুকের মধ্যে একটা আস্ত মরুভূমি ঢুকে গেল, সে কেবলই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে একটু একটু করে প্রাণরস শুষে নিয়ে ওকে এমন তব্দাধরা কাঠের পুতুল বানিয়ে দিল। ফুলশয্যার রাত থেকে রমেন হিসহিস করে বলত ‘দ্রৌপদী! দ্রৌপদী এসছে আমার ঘাড়ে!’ পম্পাকে ব্যবহার করত ঠিক বাথরুমের মত। ওই করেই দুই ছেলে হল দেড় বছরের তফাতে। ... ...
প্যারিস, ১৮০৬ সালের দ্বিতীয়ার্ধ। বিখ্যাত ফরাসি গণিতজ্ঞ এড্রিয়ান-মারি লেজানড্রার (Adrien-Marie Legendre) বাড়িতে তাঁর সাথে দেখা করতে এলেন অপরিচিত এক ব্যক্তি। লেজানড্রার হাতে একটা বই ধরিয়ে দিয়ে আগন্তুক বললেন, ‘বইটা যদি একবার পড়ে দ্যাখেন’। খানিক অবাক হয়ে লেজানড্রা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি বই এটা?’ সসংকোচে আগন্তুক জানালেন, ‘আজ্ঞে, কাল্পনিক সংখ্যার (Imaginary number) উপর ... আমার নিজের কিছু মতামত’। ‘কাল্পনিক সংখ্যা!’ হালকা চমক লাগে লেজানড্রার। ‘বলে কি লোকটা! ... ...
"দিম্মা, ও দিম্মা! শোনো না, আমাদের না একটা লেখাকে ব্যাখ্যা করতে বলেছে, তুমি আমায় একটু সাহায্য করবে? ও দিম্মা!" মণিমালা দেবী আকস্মিক এই ডাকে পেছন ফিরতেই দেখলেন, মিমি তার গলা জড়িয়ে খাটের উপর বসে! এখনো তার গালে অতীতের কথা চিন্তা করার প্রমাণ দৃশ্যমান। "এ বাবা, দিম্মা! তুমি কাঁদছো?" "না, দিদিভাই! ও এমনি। তুমি বলো কী বলছিলে!" "দিম্মা আমাদের স্কুলে না একটা লেখাকে ব্যাখ্যা করতে বলেছে! তুমি আমায় একটু বলে দেবে?" ... ...
প্রথম প্রথম পরীক্ষা শেষে ঘটনাটা ঘটলেও, এক সময় এর ফ্রিকোয়েন্সি বাড়ল। এমনকি সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতেও মামার সাথে ঘুমোতে যাবার আবদার থাকতো মোরসালিনের! তবে লিটন নামের এই যুবকটি কিন্তু তার আপন মামা ছিল না। মায়ের এত দূর সম্পর্কের ভাই ছিল যে, মোরসালিন মনে রাখত পারত না ক্রমটা। লিটন মামা একটা বইয়ের দোকনে চাকরি করত, আর থাকত পুরনো ঢাকার একটি স্যাঁতসেতে মেসে, যার দোতলায় উঠতে উঠতে পিচ-কালো নোনা-ধরা দেয়াল, কড়িবর্গায় রাজত্ব করা ধুলোর পুরু আস্তর, আর পলেস্তরা খসে শ্যাওলা গজানো ইটের কংকালে উঁকি মারা অবশ্য দ্রষ্টব্য ছিল যে কোন পরিদর্শকের জন্য। এছাড়া রয়েছে কাঁথা বালিশের ম্যাড়মেড়ে বাসী গন্ধ। একটা পুরনো দিনের এলিয়ে পড়া আলনা, আর হাঁটু-ভাঙা রঙ-উঠা চৌকির তলা চেপে ধরা একটা ফেটে পড়া বিরস-বিবর্ণ ট্রাঙ্ক। সব মিলিয়ে দমবন্ধ অবস্থা! ... ...
মিষ্টির ক্ষেত্রে বঙ্গ ও কলিঙ্গদেশ বাকি উপমহাদেশের তুলনায় আলাদা। এই দুই জাতি ছাড়া ভারতের আর কেউ বড়ো একটা (বা আদপেই) মিঠাইতে ছানার ব্যবহার করে না। আমাদের জিভে সঞ্চারিত রসের ওপর যদি ঐকান্তিক বিশ্বাস রাখা যায় তাহলে মানব সভ্যতার ইতিহাসের অনেক সত্য আপনি উন্মোচিত হতে পারে। কারণ রসনা এমন এক জায়গা যেখানে আমি আপনি সম্পূর্ণ নগ্ন। এই শিল্প আস্বাদনের ক্ষেত্রে কোন ভন্ডামি চলে না। আপনি লুচি, আলুর দম আর রসগোল্লা খেয়ে খাঁটি বাঙালিয়ানার ঢেঁকুর তুলবেন ভাবলেন – তা হবে না। আপনার বাঙালিয়ানার উদগারের সামনে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াবে পর্তুগীজ আর ওলন্দাজরা। রসগোল্লা আবিষ্কার নিয়ে এই যে উড়িষ্যা আর পশ্চিমবঙ্গের এত লড়াই ঝগড়া – অথচ তার মূল উপাদান এসেছে ইউরোপের ভিয়ান থেকে। খাঁটি দেশজ কালচার হিসেবে আর যারাই দাবী তুলুক, বাংলার অত্যন্ত গর্বের মিষ্টি চর্চা সেই অঙ্গীকার করতে পারে না। কারণ মিষ্টিতে বাঙালি তার স্বাতন্ত্র্যের জন্যে ইউরোপের কাছে ঋণী। (বাকি রেনেসাঁস থেকে কমিউনিজম – ভিনদেশী না বাঙালি বলেই সম্ভব তা বিদ্বজ্জনেরা বলবেন।) ... ...
ওই পুরোনো খবরটাতেই জানতে পারি মাণিক্যপুরে থাকতো দুরকম মানুষ, আঁখি আর নয়ন| প্রথমে সবাই বেশ মিলে মিশেই থাকতো, তারপর তাদের ধর্ম আলাদা হলো, এলো বিচ্ছেদরেখা | সেকি বাইরের মানুষের জন্য? কে জানে? আঁখি চা চাষ করে, নয়ন ধান। আঁখি ভেড়া পোষে, নয়ন গরু। আঁখি গাঁজা খায় তো নয়ন তামাক| রাত্রে নিজেদের বানানো নেশাটুকু খেয়ে আঁখি নাচ গান করে, নয়নও | আর তাদের মধ্যে লড়াই চলতেই থাকে| সীমানা নিয়ে লড়াই, ধর্ম নিয়ে লড়াই,চাষের জমি, জল, মাণিক্যপুরে নতুন কি হবে সব কিছু নিয়ে লড়াই| ... ...
একদিন খাবার টেবিলে আলাপ হল পেটার এবং ডাগমারের সঙ্গে, তারা হামবুর্গ থেকে এসেছে। এমনি ছুটিতে কতজনের সঙ্গেই তো পরিচয় হয় কিন্তু এরা একটু অন্য রকম। ডিনারে পেটার আসে স্যুট পরে, ডাগমার ককটেল ড্রেসে। পরে দেখা গেলো বিচেও তারা রীতিমত ব্রানডেড পোশাক পরে। যুদ্ধের পরে ইয়েন্সের বাবা মা প্রায় এক বস্ত্রে লাইপজিগ থেকে মিউনিক আসেন, অনেক কষ্টে সৃষ্টে একমাত্র ছেলেকে পালন পোষণ করেছেন। ইয়েন্স আঠার বছর বয়েসে ব্যাঙ্কে শিক্ষানবিশি (আউসবিলদুং), তারপর ব্যাঙ্কে কাজ। ইয়েন্স কাজের বাইরে কদাচিৎ স্যুট পরে -মনে প্রশ্ন জাগল এখানে এই ক্রোয়েশিয়ার রেসরটে পেটার স্যুট পরে কেন? আনেলিজে লক্ষ্য করেছে তাদের কথা বার্তার স্টাইল উঁচু মাপের, কেতা দুরুস্ত। সকলকে আপনি বলে, করমর্দন করার কালে ঠিকমত মাথাটি ঝুঁকিয়ে দেয়। ... ...
জানলাটার কাঠের ফ্রেমটা এবড়ো-খেবড়ো, কোনওকালে রং চড়েছিল তার গায়ে, আজ রং-চটা। ফ্রেমের সঙ্গে লাগানো কাচটাও নোংরা। খুবই নোংরা। গভীর কালচে ছোপ ধরেছে। জানলার একটা পাল্লা খোলা। অন্য পাল্লাটা আঁটা। খোলা যায় না। বন্ধ পাল্লার কাচের উপর এসে বসেছে একটা উজ্জ্বল হলুদ রঙের বোলতা। তার থেকে খানিকটা নীচে অনেকক্ষণ ধরেই বসে আছে একটা প্রজাপতি। ধূসর রংয়ের একটা বড় ছিটে। আর দুয়ের থেকে প্রায় সমদূরত্বে উড়ে এসে বসল একটা চকচকে সবুজ স্বচ্ছ-ডানার ফড়িং। নীলি সকৌতূহলে এই রঙ্গিন ত্রিভুজ দেখছিল। কান ছিল রেহানার কথার দিকে। রেহানা এসেছে ঘরের পাশের দিকটা দিয়ে। রেহানা আর নীলির মাঝখানে জানলার ওপারের একফালি ঘাসের জঙ্গল। তারপর সার দিয়ে রাংচিতার ঝোপ। সেই ঝোপের মধ্যে দাঁড়িয়ে কথা বলছে রেহানা। ইস্কুলের গল্প। ... ...