এ তল্লাটে কে না জানে, আজুদের বাড়ির পাশের ঢিবির উত্তর পশ্চিম কোণে চালা পড়ো পড়ো ভিটেয় ঘাপটি মেরে বাস-করা আকালু আসলে এক ভয়ানক গুনিন। যতো গরু ছাগল মরা বাচ্চা বিয়োয়, যতো মেয়েছেলের অসময়ে গর্ভজল খসে, সবের পেছনে ঐ আকালু শালা। ওর নজর পড়লে ফলন্ত লাউ কুমড়ো অব্দি বিলাই কুত্তার শুকনো নাদির মতো খটখটে হয়ে যায়। আবার ভ্যান চালানো ছেড়ে দিয়ে কেউ যদি বিপুল বিষয়আশয়ের মালিক বনে যায় রাতারাতি, ঠিক জানবে তার পেছনে রয়েছে আকালুর দেওয়া মাদুলি আর কবচের কেরামতি। ... ...
প্রতি সন্ধেবেলা যখনই অফিসফেরতা বাসটা ঠাকুরপুকুর ছাড়িয়ে ডানদিকে বাঁক নেয় ত্রিদিবের আজকাল পেটের ভেতর হামাগুড়ি দিয়ে ভয় পাকিয়ে উঠতে থাকে। তার মনে হয় কলকাতার সভ্যতা থেকে এবার সে আদিম অন্ধকারের রাজ্যে প্রবেশ করছে। তার নতুন কেনা ফ্ল্যাট হাঁসপুকুর ছাড়িয়ে এক অনন্ত নিঃসীম মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে নিঃঝুম হয়ে। চারদিকে ঘাপটি মেরে থাকা অন্ধকার লাফিয়ে পড়তে চায় সুযোগ পেলেই। সেই অন্ধকারকে টর্চের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা করে দিয়ে দুই পাশের মজা পুকুরের মধ্যেকার সরু রাস্তা দিয়ে পাঁক কাদা আর সাপখোপ এড়িয়ে সন্তপর্ণে মেন গেটের দিকে এগিয়ে যেতে হয় । এই নতুন ফ্ল্যাটের পেছনেই লুকিয়ে রয়েছে গণ্ডগ্রাম। মরা ঝোপ, বুনো জংগল, ক্ষেতের জমিতে সিমেন্ট ফেলে তার ওপর মাথা তুলছে প্লাস্টিক কারখানা, খোলা মাঠের এখানে ওখানে শ্বেতীর মতন জমাট বেঁধে টুকরো টুকরো বাড়িঘর, কলাবন, অবৈধ খাটাল। কলকাতার দিকে কিছুটা এগোলে ঠাকুরপুকুর বাজার। কিন্তু এইদিকটায় বড়ই নির্জন। সন্ধ্যে হয়ে গেলে শুধু টিমটিম করে মোবাইল রিচার্জের দোকান, চায়ের গুমটি অথবা ম্যাড়ম্যাড়ে মুদীর দোকানের আলো জ্বলে। মাঝে মাঝে রাস্তা কাঁপিয়ে বাস বা ট্রেকার চলে যায় গুম গুম করে। এই ধু ধু প্রকৃতির মধ্যে রিয়েল এস্টেট বানাবার কথা সমাদ্দার ছাড়া আর কেউ ভাবতেই পারত না। ... ...
সকাল সকাল দুজন উঠোনে শুয়ে। এক বৃদ্ধ, এক কিশোরী। পুবদিক থেকে এক টুকরো এবড়ো-খেবড়ো বাঁজা জমি বিপুল উৎসাহে উঁকি দিয়ে দেখতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু এক গাঁ মানুষের কাঁধ ছাড়িয়ে মাথা তুলতে পারেনি। অবশ্য নতুন করে দেখার কী বা আছে তার? দেখা ছাড়া তার জীবনে আছেই বা কী? বর্ষা যায়, শরৎ যায়, তার শরীরে কেউ লাঙল দেয় না। আগাছা বুকে নিয়ে সারা দিনমান সে হাউ হাউ চেয়ে থাকে দূরের ধানক্ষেত সর্ষে ক্ষেতের দিকে। ক্রমশ গরু-বাছুর ফিরে গেলে তার বুক মাড়িয়ে সন্ধ্যা হেঁটে যায়। কাঁটা উঁচিয়ে রাত্রির বাড়ি ফেরা দেখে একমাত্র বামন খেজুর গাছটা। তারপর সেও ঘুমিয়ে পড়ে। মাঠ জেগে থাকে। সারারাত দেখে আর শোনে। পাশের বাড়িতে সবুজ কপাটওয়ালা দরজা বন্ধ করে রাত ফিসফিস করে। ... ...
স্পিডে যেতে যেতে হঠাৎ খেয়াল করে, পরের সিগনালের চৌমাথার বেশ একটু আগে ওই বাসটা সাইড নিচ্ছে। আরে আরে, এখানে স্টপ নেই তো, বাস দাঁড়াচ্ছে কেন? স্পিড কমিয়ে ব্রেকটা ছোঁয় গিরীশ। ওদিকে বাসে উঠেই শীতল টের পায়, দু’পায়ের ফাঁকে গরম স্রোত নেমে আসছে কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে। ‘আরে আরে মুতনা হ্যায় তো টয়লেট কিঁউ নেহি গ্যয়ে? বদতমিজ আওরত তু ঝল্লি হ্যায় কা?’ কন্ডাকটারের কর্কশ চিৎকারে সারা বাসের লোক ঘুরে ওকে দেখতে থাকে। কয়েকজন হেসে ওঠে, এক মহিলা এসে পিঠে খোঁচা মেরে বাস থেকে নেমে যেতে বলে। বাসের বেশিরভাগ লোক সায় দিয়ে গলা মেলায়। বাস ততক্ষণে পরের সিগনালে। কে যেন জলের বোতল খুলে জল ছুঁড়ে দেয় গায়ে, বাসের মধ্যে হুরডা পার্টি শুরু হয়ে যায়। হেল্পার দুই থাবড়া মেরে বাস থামিয়ে ওকে হাত ধরে টেনে নামিয়ে দেয়। ওকে নামিয়ে দিয়ে হোঃ হোঃ করে হাসতে হাসতে বাসটা চলে যায়। ... ...
মা তিনদিন পর সত্যি সত্যি চলে গেল, কিন্তু শ্মশান থেকে ফিরে আগুন ছুঁয়ে বাথরুমে স্নান করতে করতেই বুঝলাম, বুড়ি কোথাও যায়নি। প্রথমেই নাকের পাশটা সুড়সুড় করছিল বলে একটু ঘষে দিলাম। তারপরই আয়নায় তাকিয়ে দেখি, সেখানে এক খয়েরি আঁচিলের জন্ম হয়েছে। ঠিক যেমনটি মায়ের ছিল। এখনো ছোট, কিন্তু ঠিক জানি, এটা তত বড়ই হবে, যত বড় মায়েরটা ছিল। কান্না পেয়ে গেল। ওমা! দেখি, যেমন ভাবে মায়ের ঠোঁট তিরতির নড়ত কান্না চাপার সময়, অবিকল সেই ভঙ্গিতে আমার ঠোঁট নড়ছে। তাজ্জব হয়ে গেলাম, আমার তো কান্না পাবারই কথা নয়, আমি তো রাবার ক্লথের ওপর গু-মুতের তীব্র গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে মা-কে আর আয়াকে বেদম ধমকাতাম আর রোজ চাইতাম বুড়ি এবার আমায় রেহাই দিক! শুধু আঁচিল বা একরকম ভাবে কান্নার দমক সামলানো নয়, এরপর থেকে অবাক হয়ে দেখলাম আমার প্রতিটা ব্যাপারে মা ঢুকে পড়ছে। ... ...
ক্রিস্টাল হার্বাল ক্লিনিকে গিয়ে বলতে, গোটা ছয়েক ওষুধ লিখে দিল । সে ওষুধ আবার ওদের কাছ থেকেই কিনতে হয় । বিল হল চব্বিশ টাকা । সব ক্যানসেল করে একটা ট্যাবলেটের শিশি নিয়ে এলাম । রাত্তিরে দুটো বড়ি, ঘুমোবার আগে । সে কী কেলো বড়দা! কিছুতেই কিছু হয়না । ইংরিজির বদলে গড়িয়াহাট থেকে দুটো বাংলা সিডি আনা করালাম । মাতৃভাষায় যদি কিছু উপকার হয় । তাও হল না । ব্যবসাটা কোনওক্রমে করতে হয় তাই করা । লেখা ফেখা মাথায় উঠেছে । পুরো বনবনাইটিস । শেষে বড়দা, আপনার এই দোকানের উল্টোদিকে ওষুধ পাওয়া গেল । আপনার দোকান, যা কিনা আমায় ভাড়ায় দেওয়া - টিপটপ মিটশপ । প্রথম দিনেই বুঝেছিলাম দোকানটার আয়পয় ভালো । কিন্তু চার-চারটে বছর বসছি, এতদিনে একবারও এ বিষয়টা চোখে পড়েনি কেন কে জানে ! ফারুখ যখন রোজ দোকান বন্ধ করে, এই সাড়ে ন’টা নাগাদ, রাস্তার উল্টো ফুটে ম্যাক্সিমিনি বুটিকের মামনিরা তাদের ম্যানিকুইনগুলোকে জামা ছাড়ায় । রোগা রোগা ম্যানিকুইন, তাদের চ্যাপ্টানো নিতম্ব, বুকের কাছে সামান্য ঢিবি । ... ...
বাইরে ডাক্তার ও সুঁইকুমারীর সমবেত গগনভেদী আর্ত্তনাদ, লোকজনের হৈচৈ,পাড়াতুতো কুকুরবাহিনীর উচ্চস্বরে প্রতিবাদ - এতসবের মধ্যেও চেম্বারে ঢুকে প্রথমেই নজরে পড়ল ডাক্তারবাবুর ফোনটি( ততক্ষণে আমরা নিজেদের মধ্যে ফিরে এসেচি, এ দরজা ভেঙে ঢোকার ক্ষমতা গরুর হবে না)। অকম্পিত হাতে ফোন তুলে দৃঢ়স্বরে বাড়ীতে বলে দিলাম বাচ্চাদের ক্যারাটে ক্লাশ থেকে নিয়ে আসতে। কর্ত্তা যথারীতি সামান্য প্রতিবাদ করছিলেন, তোমরা কোথায় আছ? আমি তো ঠিক চিনি না ক্যারাটে ম্যাডামের বাড়ী (পড়ুন - টিভিতে ম্যাচ চলছে) এইসব। তার উত্তরে আরও দৃঢ়স্বরে জানিয়ে দিলাম যে আমাদের গরু তাড়া করেছে, এ জীবনে বাড়ী ফেরা হবে কিনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই। ফিরতে না পারলে সবুজ ব্যাগে ব্যাংকের পাশবই ও টাকা রাখা আছে (সেই সেলফোন, এটিএম কার্ডবিহীন সময়ে ব্যাংকের বইয়ের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল)। ... ...
অকস্মাৎ গুম গুম গুম শব্দে অমোঘ পাহাড় কাঁপিয়া উঠিল। চমকিত বিশাখ দুই পদ পিছাইয়া আসিলেন। হেরিলেন বজ্রপ্রস্তর নির্মিত বেদী সহ জ্বলমণির বিশাল প্রস্তর মূর্তি মৃত্তিকায় প্রোথিত হইতেছে। স্থাণুবৎ মহারাজ দেখিলেন মণি মাণিক্য খচিত দেবগৃহ অতলে চলিয়া যাইতেছে। অপরূপ কারুকার্যখচিত স্তম্ভ, বংশ পরম্পরায় নিপুণ শিল্পীদের সাধনার ফল। নিমেষে নিমেষে মন্দির ভূমিতে গহ্বর সৃষ্ট হইতেছে, যেন নরক ভৈরবীর আদিগন্ত মুখ ব্যাদান। এক এক গ্রাসে বিলুপ্ত করিতেছে নাটমন্দির, দেবশিখর, উপচার গৃহ, বৃন্দবাদনের প্রাঙ্গন। সুদূর পর্বত শিখর হইতে প্রস্রবিনী শঙ্খশুভ্রা নির্মল জলধারা,যা একদিন ধৌত করিত মহাদেবতার চরণ দুটি ,সহসা শুকাইয়া গেলো। পুণ্য দির্ঘীকার পূত সলিল ফোয়ারার ন্যায় ঊর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত হইলো। দগ্ধ হইলো মন্দির উদ্যানের পুষ্পবীথি। অবশেষে মন্দিরের শীর্ষ কলসও বিলীন হইলো। ... ...
বাঘটা সুবিধা দিচ্ছে না। এখন জায়গায় দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ডান দিকে তাকাচ্ছে। এখনও গুলি পিছলে যাবার ভয় আছে। আব্দুল ওহাব আবার নিজের পজিশন বদলানোর কথা ভেবে বাদ দিয়ে দেয়। আজকে না পারলে কালকে হবে। কিন্তু উল্টাপাল্টা গুলি করে খামাখা একটা নিশ্চিত শিকার হাতছাড়া করা ঠিক না। এখনও যা বেলা আছে তাতে কাজ শেষ করে বড়ো নদীর ওই পাড়ে খালের ভেতরে দাঁড়ানো মহাজনের ট্রলারে দাঁত-নখ দিয়ে চামড়ার ঠিকানা বলে বেলাবেলিই বাড়ি ফিরতে পারবে। অবশ্য বড়ো নদীতে ফরেস্টারদের সামনা সামনি পড়ে যাবার ভয় আছে। গুলির শব্দ শুনলে টহল বোট নিয়ে তারা হয়ত এদিকে চলে আসতে পারে। সেক্ষেত্রে অবশ্য আব্দুল ওহাবেরও উত্তর মুখস্থ করা আছে। তাকে যদি জিজ্ঞেস করে সে কোনো গুলির আওয়াজ শুনেছে কি না। সে নির্দ্বিধায় উত্তর দেবে- আপনাগের বন্দুকের একটা দেওড় ছাড়া তো আর কিছু শুনিনি ... ...
ঘন জঙ্গলের মধ্যে বজ্রযোগিনীর মন্দির থেকে তখনো কাঁসরঘন্টার আওয়াজ ভেসে আসছিল বাতাসে। দিগন্তজোড়া গাছগাছালির মধ্যেকার ফাঁকফোকর দিয়ে অতি অল্প যেটুকু দৃশ্যগোচর হয়, তাতে কেবলমাত্র মন্দিরের আকৃতি টুকুই বোঝা যায়। সন্ধ্যার অন্ধকারে নাটমন্দিরের জ্বলন্ত প্রদীপমালায় কিছু দুর্বোধ্য অক্ষরের আভাস পাওয়া যায়। সন্ধ্যারতির সময় কিছু ভক্তসমাগম হয়, নারী পুরুষ, বালক, বালিকা সকলেই আসে, ভক্তিভরে অঞ্জলিপ্রদান করে তারা যে যার ঘরে ফিরে যায়। তারপরে শুরু হয় দেবদাসীদের পিশাচিনী নৃত্য। মন্দিরের অনতিদূরে মৃতদেহ সৎকার করতে আসা আত্মীয় পরিজন রা অতি সম্ভ্রমে দূর থেকে এই ডাকিনী নৃত্য দর্শন করে। কখনো বা মৃতদেহ সৎকার সম্পুর্ণ না করেই পালিয়েও যায়। কিছুক্ষন আগেই যে এই সব দেবদাসীরা স্বাভাবিক ভাবে ভক্তবৃন্দের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলো তা বিশ্বাস করাই দুষ্কর হয়ে ওঠে। তাদের দু এক প্রহর আগেও দেখলে মনে হতে পারে তারা আপন আপন গৃহস্থী সামলাতেই ব্যাস্ত। তারা সকলেই কৃশকায়, পরনের লালপেড়ে সাদা শাড়িটি রাঢ় বঙ্গের রীতি অনুসারে পরা। নদীমাতৃক বঙ্গভূমিতে শাঁখ ঝিনুক ইত্যাদির অভাব নেই তাই তাদের আভরণেও শঙ্খের প্রাধান্য। কদাচিৎ বিশেষ তিথিতে পোড়ামাটির গয়নায় সর্বাঙ্গ ঢেকে এই যুবতীরা একসাথে শ্মশানের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীবক্ষে নগ্নিকা নৃত্য করে। কিছু নিজ অভিজ্ঞতা কিছু জনরব আর বাকীটা কল্পনার পাঁচমিশেল-- এই সবে মিলে এই বজ্রযোগিনীর মন্দিরটি চূড়ান্ত রহস্যজালের সৃষ্টি করে সাধারণ গ্রামবাসীর কাছে ... ...
রঙের খেলা, কথার মেলা ওদের কলমে, পেনসিলে। লেখার মুন্সীয়ানা হার মানাবে যে কোনও চন্ডালকে, আমাদের সাধ্যি কি তাতে কলম চালাই? আমরা শুধু লাইন টেনে দিতে পারি, আর পারি সব্বাইকে পড়ে শোনাতে। ... ...
তখনই সবাই জানতে পারে যে, এই দু’মুখো যন্ত্রটি আদতে ফরেনের মাল। সাগরবালার শ্বশুর অর্থাৎ অজাত ফরেনের বাবা ফরেন শব্দটির ধ্বনিমাধুর্যে বিমোহিত হয়ে পড়ে। খেতে নিড়ানি দিতে দিতে, পিঠের দাদ চুলকোতে গিয়ে, এমন কী রাতে বিছানায় তার বউ মালতীকে সোহাগ করার সময় ফলুই বর্মন ‘ফরেন’ শব্দের মায়ায় আচ্ছন্ন হয়। শব্দটি নিয়ে সে মুখের ভেতরে এধার ওধার করে। তখন ধানের গোছ, দাদনিসৃত রস ও মালতীর শরীরের উষ্ণতা পার হয়ে সে নতুন এক রকম সুখ টের পাচ্ছিল। মালতী সন্তানসম্ভবা সে ঠিক করে ব্যাটাছুয়া যদি জন্মায়, তবে তার নাম হবে ফরেন বর্মন। বিশেষত তার নিজের নাম ফলুই হওয়ায় ‘ফ’-এর বংশানুক্রমিক ধারাবাহিকতা বজায় থাকে। এ-ও ঠাকুরের এক লীলা। ... ...
তা এই বাড়ির কোনকিছুই ওর নিজস্ব মনে হয় না, হয়ও নি কোনোদিন। আর শুধু বাড়ির কেন, এই পৃথিবীতে কোথায়ও কি ওর নিজস্ব কিছু আছে আদৌ! চাকরিটা বাবার জন্য শুরু করতে হয়েছিল, বিয়ের পরেও ছাড়তে পারে নি রমেনের জন্য। দাদার জন্যই লাইব্রেরীর চাকরি করেও পূর্বাঞ্চল সাংস্কৃতিক সঙ্ঘের হয়ে গণসঙ্গীত গেয়ে নাটক করে বেড়াতে পেরেছে। সেইটুকুই ছিল ওর নিজের আনন্দে বাঁচা। বাবা মায়ের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়াতো দাদা। সেই দাদাটাও অমন করে চলে গিয়ে পম্পাকে একেবারে শূন্য করে দিয়ে গেল। সেই যে ওর বুকের মধ্যে একটা আস্ত মরুভূমি ঢুকে গেল, সে কেবলই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে একটু একটু করে প্রাণরস শুষে নিয়ে ওকে এমন তব্দাধরা কাঠের পুতুল বানিয়ে দিল। ফুলশয্যার রাত থেকে রমেন হিসহিস করে বলত ‘দ্রৌপদী! দ্রৌপদী এসছে আমার ঘাড়ে!’ পম্পাকে ব্যবহার করত ঠিক বাথরুমের মত। ওই করেই দুই ছেলে হল দেড় বছরের তফাতে। ... ...
এক ঝিমধরা চৈত্রের আধবিকেলে ভুরুদুটো কুঁচকে ও মুখটা গোমড়া করে মহারাজ ছনেন্দ্রনাথ ওরফে ছেনু একলা ছাদে উঠে বসেছিলেন আর মাঝেমাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে কি জানি কি ভাবছিলেন। হাওয়ায় এখনো গরম তেমন নেই, সূর্যটা ঝাপসা মেঘে ঢাকা কিন্তু চারদিকে একটা গুমোট ভাব চেপে বসেছে। এমনি সময় কাঁধে কেউ একটা হাত এসে হাত রাখায় মহারাজ পিছন ফিরে তাকালেন, এ হল তাঁর পেয়ারের কোটাল বেনারসিপ্রসাদ যাকে তিনি আদর করে বেনা বলে ডাকেন। -কি হল বাবু, একলা ছাদে এসে বসে আছো, যাও যাও খেলোগে যাও। -আমার আর ভাল্লাগে না। -ভাল্লাগেনা? কেন কি হয়েছে? ... ...
– ‘জিগেশ করছিলে না? কী করে বাঁচিয়ে রাখি? বড় মায়া দিয়ে বাবু। মায়া না থাকলি এ দুর্যোগে কিছুই রাখা যায় না। ঐ কচিগুলো, এত নেওটা আমার, এত মায়া যে ছাড়ি যেতি দিলাম না। এই মাঠও তাই। তোমাদের ফেলাট বানানোর গর্ত রোজ এসে গিলে ফেলতি চায় এই জমি। খুরপি নিয়ে লড়াই করি বাবু, মায়া দিয়ে আটকে রাখি যেটুকু জমিজমা পারি। আবার হেরে যাই যখন সব গর্তে ঢুকি যায়। রাবিশের নিচে ঢেকে যেতি থাকে বীজতলা, চার, ফসল সব। আবার খুরপি দিয়ে খুঁচোই। ফিরিয়ে আনি কিছু। লড়াই চলে গো বাবু। আমার ছেলেগুলো কই গেল দেখি! ’ ... ...
এই প্রথম তার সাথে আমার কথা হয়। এর পর যখনই ছাদে যেতাম তখন তার সাথে বিভিন্ন রকমের গল্প হত। আমি অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকতাম তাই সাধারণত সকাল বেলা চায়ের কাপ হাতেই ছাদে যেতাম বেশি। ছুটির দিনে কখনো কখনো বিকেলের দিকে। বিকেলের আকাশ আমার খুব ভালো লাগে। এই সময়ে আকাশ আস্তে আস্তে রং বদলায়। এর বৈজ্ঞানিক কিছু কারণ আছে। সূর্যরশ্মির বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিচ্ছুরণ।। কিন্তু ওসব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। বিকেলের পশ্চিম আকাশ যখন নিজের রং বদলাতে বদলাতে সন্ধ্যার দিকে ধাবিত তখন আমার একে মনে হয় কিছু মধ্যবিত্ত অসম্পূর্ণ স্বপ্নের অব্যক্ত প্রগাঢ় বেদনার সম্মিলিত রূপ। যখন সময় পেতাম তখন আমি এই বেদনার গাঢ় রং বোঝার চেষ্টা করতাম, যদিও আমার জীবনযাপনের সাথে এর কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। ... ...
বছর যেতে আর কি? আমরা এখন বড় হয়ে গেছি। আমার পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি জুটেছে। ওদিকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তিন ভুবনের পারে বলে একটা ছবিতে কি ইনোসেন্ট এক মস্তানের রোলে কী অসাধারণ অভিনয় করেছেন! তনুজা তাঁর শিক্ষয়িত্রী স্ত্রী। পল্টুদা অবশ্য মস্তান হতে পারে নি। তবে সুন্দরই আছে। সাধারণ একটা সরকারি চাকরি করে। পাত্র হিসেবে তেমন কিছু নয়, তবে বিয়ের আশা ছাড়ে নি। মা বাবা তো নেই। ধনমাসীমা বলে এক ধনবতী মাসীর পালিত পুত্র। ধনমাসীমা বলেন “জন্মকালে মা-হারা দুর্ভাগারে কে আর মাইয়া দিবো।” আমরা ভাবি আহা, পল্টুদা সাহিত্য ভালবাসে, মিশুকে, পরোপকারী। কেউ না কেউ ভালবাসবেই ওকে। কিন্তু তেমন কেউ দেখা দিল না। ... ...
ইদানিং আরেক পরেশানি হয়েছে মতির এই দলজিৎ সিংকে নিয়ে। ছেলেটার নাম তাই। খুব ভাব এখন মতির সঙ্গে। প্রায়ই আসে এ পাড়ায়। পেছনের গেট দিয়ে সোজা ঢুকে পড়ে মতির আস্তানায়। আঙ্কল আঙ্কল করে পাগল। অবাক হয়ে যায় শক্ত মোটা ভিশতি দেখে। খুঁটিয়ে জানতে চায় কী করে তৈরী হয়। অগত্যা অমলতাসের হলুদ পাঁপড়ির ওপর থেবড়ে বসে মতি খবর দেয় কী করে বকরি ইদের পরে সেরা ছাগচর্ম বেছে নিয়ে তাকে ফোটানো হয় বিরাট লোহার কড়াইতে। তার সঙ্গে মেশানো হয় কিকার গাছের বাকল। এই বাকলের সাপ্লাই আসে অনেক দূরের দেশ আফ্রিকার উত্তরি ভাগ থেকে। বারবার ফোটানোর পর কম-সে-কম কুড়িদিন ভিজিয়ে রাখা হয় ওই কড়াইতে। কিকার-জল থেকে চামড়া যখন তোলা হয় তখন সে আর চামড়া নেই। হয়ে গেছে ইষৎ হলদে মাখনের মত নরম। এইবার আচ্ছা করে মোষের চর্বি ঘষা হয় বাইরে দিকটাকে জলনিরোধক করার জন্য। কিকার-জলের এত গুণ যে সব দূর্গন্ধ, সব খতরনাক জীবানু ধ্বংস করে চামড়াকে একেবারে ঝাঁ চকচকে করে দেয়। শেষে দক্ষ হাতে ভিশতিতে সেলাই পড়ে। ... ...
মঙ্গলার ওদিকে এক গোঁ কিছুতেই পণ দিয়ে বিয়ে করবে না সে। এই নিয়ে কম অশান্তি হয় নি মা বাপের সাথে। এমন এক পাত্রের মাকে মঙ্গলা বলে ফেলেছিল ‘আপনারা শহরে গিয়ে মন্দিরের সামনে আঁচল পেতে বসতে পারেন তো, শুনেছি দিনে পাঁচ ছয় হাজার রোজগার হয়। ও দুই তিন মাস বসলেই আপনার বেশ ক লাখ ...’ কথা শেষ করতে পারে নি, মায়ের ঠাস সপাটে নামে মঙ্গলার গালে। ছোট বোনটাকে ধরে সামলায় নিজেকে, শান্ত পায়ে গিয়ে মাছমাংস কোটার বঁটিটা আর একগাছা নারকেল দড়ি এনে মায়ের সামনে ধরে বলে ‘হাত পা বেঁধে গলা কাটো আমার, নাতো পণ দিলে আমি তোমাদেরই কেটে ফেলব হয়ত।’ ... ...
কন্ডাকটর সাড়ে সাত সেকেন্ড হাঁ করে থেকে, পিছনের দিকে এগিয়ে গেল। অফিসের স্টপ আসতেই বাস থেকে দ্রুত নেমে গেলেন বৃংহণবাবু। রাস্তা পারাপারের সময় আচমকা একটা গাড়ি সামনে এসে যাওয়ায় দুটো বাজে গালাগাল দিলেন। ড্রাইভার না শুনতে পাওয়ায় এই যাত্রায় বেঁচে গেলেন। ঝামেলা ১-০ গোলে হেরে গেল। ... ...