ঋষিকেশকে বিদেশীদের মধ্যে আরো জনপ্রিয় করেছে ষাটের দশকের শেষদিকে বিটলসদের এখানে আগমন। বিটলসরা এসেছিলেন মহেশ যোগীর কাছে 'ট্রান্সেন্ডেন্টাল মেডিটেশন' শিখতে। আশ্রমটা ছিল সরকারের থেকে লিজে নেওয়া জায়গা। লিজ শেষ হয়ে যাবার পর পুরো আশ্রম পরিত্যক্ত হয়ে যায় এবং প্যান ট্রিনিটি দাসের মত হিপি শিল্পীরা ঢুকে ভাঙা বাড়িগুলোর সর্বত্র গ্রাফিত্তি করে যেতে থাকে। এতদিন রাজাজী জাতীয় উদ্যানের জঙ্গল ধীরে ধীরে খেয়ে নিচ্ছিল আশ্রমের ভাঙা ঘরবাড়ি। সরকার জায়গাটা ঘিরে দিয়েছে যাতে বন্য জন্তু না ঢুকে পড়ে। কিছু কিছু বাড়ি সারানো হয়েছে। ... ...
সকাল নটার সময় বন্দুক পাহাড়ে একগাদা জাদু ,হাতসাফাই দেখানোর দোকান। এটা মূলত বাচ্চাদের সময় কাটানোর জায়গা বোঝা গেল। বেশিরভাগ তামাশার দোকান তখনো খোলেনি। চাঁদমারিতে সাজানো ছিল রংবেরঙের বেলুন। পাশে দু তিনটে খেলনা বন্দুক সাজিয়ে রাখা। দোকানের লোকজন সেগুলোতে ছররা ভরছে। নীচের ম্যাল থেকে বন্দুক পাহাড়ে রোপওয়ে চলে। সেটাও এখনো চালু হয়নি। কুকুরগুলো কুয়াশাঘেরা মেঝেতে শুয়ে ঘুমোচ্ছে। ... ...
এরপর গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে খাজ্জিয়ারের ফটকের বাইরে ছেড়ে দিলেন। পুরো রাস্তাটা নির্জন থাকলেও এই জায়গাটায় একেবারে গাড়ির এবং মানুষের মেলা বসে গেছে। খাজ্জিয়ার একেবারে প্রাকৃতিক একটা গড়ের মাঠের মত। চারদিক কালাটপ বনাঞ্চলের পাইন দিয়ে ঢাকা। বৃষ্টির জল জমে মাঝখানে একটা ছোট হ্রদ। সেখানে অবশ্য এখন গরমকালে বড় বড় মানুষসমান ঘাসের ঝোপ জন্মেছে। বর্ষাকালের পর আবার জল বাড়বে ঘাসের ঝোপ ঢেকে যাবে। শীতকালে এই উপত্যকা বরফে ঢেকে যায়। কিছু থাকার জায়গাও হয়েছে এখন খাজ্জিয়ারের কাছাকছি। ... ...
মিনিট পঁয়তাল্লিশ বাদে তিনি উঠে দাঁড়ালেন, অর্জুন পাশের গাড়ি সরাতে বললেন আমরা রওনা দেব বাঘের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। রাস্তার (মানে জঙ্গলের ভেতরের কাঁচা পথ) দিকে খানিক এগিয়ে এসে এত গাড়ি দেখে বিরক্ত হয়ে তাড়ুবাবু আবার জঙ্গলের গহীন গহনে ঢুকে গেলেন। অর্জুন কিছু নির্দেশ দিয়ে গাড়ি নিয়ে গেলেন এক জলাশয়ের পাশে, তাড়ু জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দিয়ে এখানেই নাকি আসবে। আর সত্যিই এলোও। ধীরেসুস্থে এসে জলে নামল তারপর মুখ তুলে তাকালো। উফফ স্বাভাবিক পরিবেশে একদম খোলা জায়গায় খোলা গাড়িতে বাঘের সাথে প্রথম চোখাচোখি ... সে রোমাঞ্চ মানুষের জীবনে একবারই আসে, পরের পরের বারেরা শুধুই প্রথমবারের সাথে তূলনীয় হয়ে চলে। ... ...
উদয়পুরে এত সবুজতার কারণ পিচোলা এবং ফতেহ সাগর এই দুটো হ্রদ। পিচোলা হ্রদের মাঝখানে একটা দ্বীপে আছে জগ মন্দির। গরমকালে রানারা ওখানে গিয়ে থাকতেন, এখন সেটা একটা পাঁচতারা এবং যথেষ্ট দামী হোটেল। আর একটা দ্বীপেও 'লেক প্যালেস' বলে একটা হোটেল আছে , সেটা টাটাদের। মূল রাজপ্রাসাদেরও ক্যাম্পাসের ভেতরে দুটো বাড়ি হোটেল হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়। ... ...
গাড়ি ভীমতাল দাঁতের কাছে ছেড়ে দিল। সামনেই তালের মাঝে দ্বীপে একোয়ারিয়াম। এখানেই ভীমতালের প্রধান ঘাট। নানা রকম বোটিং করার জায়গা। রথের মেলার মত ভিড়। পড়ন্ত বেলায় মহিলারা আর বাচ্চারা দলবেঁধে স্কুপ আইসক্রিম খাচ্ছে আর লোকেরা গিয়ে বোটিংয়ের জন্য দরাদরি করছে। উত্তরাখণ্ডে কাফাল বলে একরকম লাল রঙের বেরিজাতীয় ফল পাওয়া যায়। ছোট ছোট লাল লিচুর মত কিন্তু খোসা ছাড়াতে হয় না। ছোট ছোট কাগজের প্লেটে এক এক মুঠো করে সাজিয়ে বিক্রি হচ্ছে। খুমানি [এপ্রিকট], হিসালু [কাফালের মত কিন্তু হলুদ রঙের থোকাথোকা] এসব ফলও সাজিয়ে নিয়ে বসেছে স্থানীয় লোকজন। ... ...
রেললাইনের পাশে পাহাড়ি ফুলের ঝোপঝাড়। ভিজে ভিজে ভাব হাওয়ায় ভাসছে। পাহাড়ের কোলে ছোট ছোট ব্রিজ আর সুড়ঙ্গ দিয়ে ট্রেন এগিয়ে যাচ্ছিল। দেড়ঘন্টা মত সময় লাগবে উধাগামান্ডালাম পৌঁছতে। লাভডেল ইত্যাদি ছোট ছোট স্টেশনও রাস্তায় পড়ে এবং সেখানে স্থানীয় লোকজনরা ওঠানামাও করে। ... ...
কাংড়া, ধরমশালা, ম্যাকলিওডগঞ্জ সব জায়গা থেকেই সামনে দেখা যায় ধওলাধার পর্বতমালা। যত ওপরের দিকে যাবেন তত আরো সামনে এগিয়ে আসবে। ম্যাকলিওডগঞ্জ অনেকে যায় ত্রিউন্ড বলে একটা জায়গায় ট্রেক করার জন্য। ট্রেক বিশেষজ্ঞদের মতে এটা হিমালয়ের সবথেকে সোজা ট্রেক এবং বাচ্চারাও করতে পারে। ট্রেকিংয়ের জুতো বা অন্যান্য গিয়ার না হলেও চলে। ... ...
একটা বয়স ছিল, যখন ট্রেনে উঠলেই মনে হত, আহা উল্টোদিকের সিটে যদি কোনও সুন্দরী এসে বসে! তখন এসে বসতো পাকা বাচ্চা, কানে ট্রানজিস্টর লাগানো দাদু, এরা। দু’এক বার আমাকে পরিহাস করতে সন্ন্যাসীও এসে বসেছে। তারপর ট্রেনে যাওয়া-আসা বাড়তে লাগলো, আর আমিও বুঝলাম, সুন্দরী মেয়ে আসলে ইয়েতির মতো একটা ব্যাপার। স্লীপার ক্লাসে তাকে খোঁজা বৃথা; তার চেয়ে পিএইচডি করা ভালো। ... ...
‘Wanderlust’ শব্দটা প্রথম শুনি ক্লাস সিক্স বা সেভেন-এ আগন্তুক সিনেমা থেকে। বলতে অসুবিধে নেই, তার সঠিক অর্থ (আক্ষরিক অর্থটুকু বাদ দিয়ে) বুঝতে অনেক সময় গেছে। হল্যান্ডে এসে ঠিক দুটি সপ্তাহান্ত পাচ্ছিলাম, তবে আপিসের কাজকর্ম বাদ দিয়ে বাকি সময়টুকু এক পল-ও নষ্ট করব না ঠিক করেছিলাম। অ্যানা ফ্র্যাঙ্কের বাড়ি ঘুরে আসার পর মনে হল, সব তো হল, নর্থ সী-কে তো একবার দেখা হলো না! তার উপর, হল্যান্ড দেশটা যে সমুদ্রতল থেকে সত্যিই অনেক নীচে তা-ই বা চাক্ষুষ হলো কই! হান্সের গল্প তো সেই ছোটোবেলায় কিশলয়ে পড়া, কিন্তু সেই সমুদ্রের তীরের উঁচু বাঁধই (এদেশে বলে ‘ডাইক’) বা দেখা হল কই! কাছাকাছি সমুদ্র দেখতে হলে আছে হল্যান্ডের রাজধানী দ্য হেগ (এখানে ডাচরা বলে ‘দেন হাগ’, নামটা শুনে কি মনে হয়, সে বিশ্লেষণে আর যাবো না), তারপর আপিসেও সহকর্মীরা বলল, রটারড্যাম-ও ঘুরে আসতে পারো। তো ম্যাপ ইত্যাদি দেখে যা বুঝলাম, একটু কষ্ট করলে দুটো শহর-ই একদিনে ঘুরে নেওয়া যায়। ... ...
নেদারল্যান্ডস বা হল্যান্ডের কথা বললে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা তো মাথায় আসেই, তার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায় অ্যানা ফ্র্যাঙ্কের কথাও। ক্লাস সেভেন বা এইটে কোনোভাবে হাতে এসেছিল সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনবদ্য অনুবাদে ‘আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরী’। আমারই বয়সী একটি মেয়ে, যে বয়সে আমরা স্কুলে যাচ্ছি, ক্রিকেট-ফুটবল খেলছি, কেউ আঁকছি, কেউ গান গাইছি, কেউ বা তবলায় হাত পাকাচ্ছি, সেই বয়সেই, অ্যানা নামের একটি মেয়ে লুকিয়ে পড়েছে অন্ধকার ঘরে, বাইরে বেরনো বন্ধ, স্কুলে যাওয়া, বন্ধুদের সাথে দেখা করা, খেলাধূলা, এমনকি গান-বাজনা পর্যন্ত বন্ধ, পাছে কেউ দেখে না ফেলে, পাছে কেউ শুনে না ফেলে। বাড়ির বাইরে থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই যে ভেতরে কয়েকটা গুপ্ত ঘরে লুকিয়ে রয়েছে আটটা তাজা প্রাণ (ডুসেল, আরেক প্রতিবেশী অবশ্য পরে যোগ দেন)। পড়তে পড়তে আনা-র সঙ্গে যেন আমিও ঢুকে পড়েছিলাম সেই গুপ্ত কক্ষে, ভাগ করে নিচ্ছিলাম অজানা আশঙ্কার মুহূর্তগুলো! ... ...
হল্যান্ড ওরফে নেদারল্যান্ডস এমন একটা দেশ যেখানে আবহাওয়া কখন ভালো হবে বা কখন চনমনে রোদ উঠবে, সেকথা ভেবে বসে থাকলে কোথাও ঘোরাই যাবে না। মানে রোদ-ঝলমল সকাল দেখে বেরিয়েও দশ মিনিটের মধ্যে বৃষ্টি এসে আপনাকে ভিজিয়ে দিতে পারে। হাওয়া তো আছেই সে-কথা আর আলাদা করে বলার নয়, তাপমাত্রা সব সময়েই পাঁচ ডিগ্রী কমিয়ে ধরতে হবে। প্রথম শনিবারটা সকালে উঠে ভেবে রাখলাম শহরের বাইরে কোথাও হাওয়া কল বা ট্র্যাডিশনাল উইন্ডমিল দেখতে যাব। সেইমত, চটপট প্রাতঃরাশ সেরে বেরিয়ে পড়লাম। এয়ারপোর্ট থেকে স্প্রিন্টার ধরে যাব স্লটারডিক, তারপর সেখান থেকে আবার অন্য এক স্প্রিন্টারে যাব 'জানডাইক - জ্যানসে স্ক্যানস' - হ্যাঁ স্টেশনের নাম ঠিক সেটাই। পুরো যাত্রাটাই একটা রিটার্ন টিকিটে সারা হয়ে যায়। জ্যানসে স্ক্যানস আদতে একটি গ্রামের গন্ধ-মাখা মফঃস্বল (কান্ট্রি-সাইড বলা চলে)। ... ...
"অমরত্বের প্রত্যাশা নেই , নেই কোনো দাবী-দাওয়া , এই নশ্বর জীবনের মানে শুধু তোমাকেই চাওয়া..." রাস্তায় চলতে চলতে অবচেতনে মনে আসছিল ভ্যান গঘের জীবন, জানি না কেন 'জাতিস্মর' গানটাই ভেসে উঠছিল তার সঙ্গে। ১৮৫৩ থেকে ১৮৯০ - একটা লোকের মাত্র ৩৭ বছরের জীবন,যে হঠাৎ তার ২৭ বছর বয়সে আবিষ্কার করে ফেললো যে সে শিল্পী হতে চায়, চিত্রশিল্পী; আর ঠিক পরের দশটা বছর সেই চিত্রশিল্পই তার নশ্বর জীবনকে এনে দিল অমরত্ব! মিউজিয়ামের চারতলায় ধাপে ধাপে হলঘরের মত স্টুডিও-তে যত্ন করে সাজিয়ে রাখা ছবির সম্ভার, অধিকাংশ-ই ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের, তবে বেশ কিছু ছবি আছে তাঁর সঙ্গে সম্পর্কিত মুহুর্তের আর মানুষের যেমন পল গগ্যাঁ, বার্নার্ড, কোনিং প্রমুখের। ... ...
উত্তম পুরুষে উপস্থিত করা নিচের বিবরণটা ২০০১ সালের মে মাসে হিমালয় পর্বতমালা'র বহু উঁচুতে এক তীর্থকেন্দ্রে যাওয়ার অভিজ্ঞতাকে ঘিরে। ছোট বোন মালবিকা'র (সেনগুপ্ত) এই অভিজ্ঞতার কাহিনী তার মুখে শুনে তারই নিজের জবানীতে এই বিবরণী প্রস্তুত করে উপস্থিত করছি আমি, তার বড় ভাই সুভাষ চন্দ্র গাঙ্গুলী। সুদূর অতীত থেকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তীর্থযাত্রীদের নিয়ে যাওয়ার কাজে স্ব-নিয়োজিত শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর এক জনের জীবনদায়ী দরদের এই কাহিনী অন্যদের সাথে ভাগ করে নেওয়ার উপযুক্ত বলে মনে হয়েছে, যদিও এমন এক নাড়িয়ে দেওয়া অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে ভাষার সীমাবদ্ধতা পুরোপুরি এড়ান সম্ভব নয়। এমন কারও কারও মনে হতেই পারে যে এই গোত্রের কাহিনী প্রায়ই ভুলে যাওয়া এমন এক বার্তা/বাণী বহন করছে যা উচ্চনিনাদে স্ব-ঘোষিত ভাবে জনতার মঙ্গলের জন্য নিবেদিত দল /সংগঠন ইত্যাদির মধ্যকার চালু পারস্পরিক বিতর্ক-তথা-বিবাদ-বিসম্বাদের আওতার বাইরে। ... ...
আইজল যাবার জন্য সড়কপথ নয় আকাশপথই শ্রেষ্ঠ। সস্তা এবং সময় সাশ্রয়ী। হাফলং থেকে আইজল যাওয়ার প্ল্যান করাটা আমার একেবারেই ঠিক হয় নি। মিজোরাম বেড়াতে গেলে খ্রীস্টমাসের সময় না যাওয়াই ভাল কারণ এই চার পাঁচদিন প্রায় গোটা রাজ্যই ছুটি কাটায়। যদিও আইজল শহরের আলোকসজ্জা বা উৎসবের আবহ সত্যিই চমৎকার। মিজোরাম যথেষ্ট বড় রাজ্য। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গার দূরত্বও যথেষ্ট আর রাস্তার অবস্থাও সর্বত্র ভাল নয়। অনেক জায়গায় রাস্তা চওড়া করা হচ্ছে। ফলে হাতে অন্তত এক সপ্তাহ নিয়ে না এলে বিশেষ কিছু দেখা হবে না। প্রকৃতি ঢেলে সাজিয়েছে মিজোরামকে, তাকে দেখার জন্য সময় নিয়ে আসতে হবে। ... ...
ফ্রায়েডরাইসে গার্নিশ করেছে কাঁচা বাঁধাকপি দিয়ে! তাজ্জব হয়ে বাঁধাকপির জাল সরিয়ে দেখি তার নীচে একস্তর সরু সরু ঝুড়িভাজা গোছের কিছু একটা। বাই মোটামুটি অন্যতম প্রধান পদ মিজো ক্যুইজিনে, কিছু অপরিচিত মশলা দেওয়া ছিল চিনতে পারিনি, স্বাস্থ্যকর এই খাবারটা খেতেও ভাল বেশ। পাশের দুই ঘরের বাসিন্দারা আজই বিকেলের দিকে এসে পৌঁছেছেন। এঁরা এখন বেরোবেন রাতের আইজল দেখতে। কথায় কথায় জানা যায় একজন কোন্নগরের বাসিন্দা, যদিও এখন কুচবিহারে থাকেন কর্মসুত্রে। আরেকজনের মেয়ে সম্প্রতি করমসূত্রে পুণেবাসিনী হয়েছে। আলাপ জমতে দেরী হয় না। বাকীরা কেউ গৌহাটি কেউ ডিমাপুর থেকে এসেছেন, মোট ৮ জনের দল। এঁরা কেউই সেই হাফলঙের সহযাত্রীদের মত গাঁকগাঁকে নন, বলাই বাহুল্য। আর শুধু কালকের দিনটা আইজলে, দেখা যাক কদ্দুর কী দেখে ওঠা যায়। ... ...
রাস্তার মাঝে জেব্রা ক্রসিং করা আছে। তো রাস্তার অর্ধেক তো খালি দেখে পেরোলাম। বাকী অর্ধেকে বাইক আসছে হু হু করে। একদম সামনের জন দাঁড়িয়ে গেলেন। আমি ইতস্তত করছি কারণ তাঁর পেছনে পাশে আরো বাইক আসছে দেখছি। উনি আমায় ইশারা করলেন এগোতে আর একইসাথে বাঁ হাত তুলে পাশের বাইককে থামতে ইশারা করলেন। এগোলাম এবং আশ্চর্য্য পরপর বাইকগুলো এসে থেমে যেতে লাগল আগেরজনের ইশারায়। অতঃপর এক মহিলা টলমলে পায়ে পিঠে এক বিশাল বোঁচকাটাইপ পিঠু নিয়ে আর ডানহাতে এক চাকাব্যাগ টেনে খানিক ক্যাবলার মত মাথা ঝুঁকিয়ে ঝুঁকিয়ে থ্যাঙ্কিউ থ্যাঙ্কিউ বলতে বলতে দিব্বি পেরিয়ে গেল আর একসারি দুরন্ত বাইক স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল যতক্ষণ না ওপারে একেবারে ফুটপাথ অবধি সে পৌঁছায়। ... ...
ঘন্টাখানেক পরে বাঁধানো রাস্তা শেষ হয়ে পাহাড়ের গায়ে জঙ্গলের রাস্তা ধরে নামা শুরু হল, এই রাস্তাটা একেবারেই যাকে বলে ‘Road less travelled’, নিত্যমের মতে এটা শর্টকাট। উঁচুনীচু, ছোটো নালা, জল-কাদা সব মিলিয়ে বেশ চাপের রাস্তা, তবে আমাদের আজ উৎসাহের অভাব নেই, মেরে এনেছি প্রায়! এতক্ষণ শুধু শব্দ পাচ্ছিলাম, এবার শ্রীখোলা নদী-ও আমাদের পাশে এসে হাজির, কলকলিয়ে ছুটে চলেছে পাথরের উপর লাফ দিয়ে দিয়ে, এখানে বুনো লতার সঙ্গে কিছু লাউ, চালকুমড়োর গাছ-ও একেবারে পথের উপর এসে পড়েছে, টাটকা ফলন সমেত। কিছু আধখাওয়া, পাখি বা পান্ডায় খেয়েছে হয়ত। এরপর বেশ কিছুটা রাস্তা ‘W’ এর মত, ওঠা আবার নামা। এই করে করে হঠাৎ এক জায়গায় এসে দেখি রাস্তা নেই। মানে যাকে বলে ‘literally’ নেই। দু-ইঞ্চি মত মাটি লেগে আছে পাশের দিকে, আর বাকি রাস্তাটা নীচে খাদে নেমে গেছে সোজা। এই নাকি নিত্যমের ‘শর্টকাট’! আমরা ভাবছি আবার কতটা ফেরৎ গেলে অন্য পথ পাবো, ওদিকে নিত্যম আর বাইচুং দেখি ওখান দিয়েই আমাদের পার করার মতলব করছে! মোটামুটি পাঁচ থেকে ছ’ফুট মত আমাদের পার হতে হবে, এ তো পুরো স্কুলের স্পোর্টস-এর লং জাম্প! একদিকে খাদ, আর একদিকে নব্বই ডিগ্রী খাড়া পাহাড়। যাই হোক, নিত্যম-এর উপদেশ-মত দু’জন করে হাত ধরাধরি করে এগোলাম, পেছনে রইল বিক্রম, সামনে নিত্যম, তারপর ওই আধ ইঞ্চি মাটিতে কি করে পা রেখে এগোলাম, ওপারে গেলাম, কিভাবে শরীরের ব্যালান্স রাখলাম - সে আর মনে করতে চাই না! এরপরের রাস্তা আর খুব বেশী ছিল না, পরপর কিছু ধাপ পার হতেই অবশেষে শর্টকাট শেষ হয়ে পথ মিলে গেল গাড়ির রাস্তায়। আর নীচে পাকদন্ডী শেষে দেখা গেল শ্রীখোলা ব্রিজ আর দু-তিনটে বাড়ির মাথা। ... ...