প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বেঙ্গল এবং শান্তিনিকেতন স্কুল ছাড়াও মুম্বাইয়ের জে জে স্কুল অফ আর্ট এক স্বতন্ত্র ঘরানার জন্ম দিয়েছিল। এই সমস্ত ঘরানায় নতুন যে শিল্পীরা কাজ শুরু করলেন , তাদের অনেকেই দেখলেন এই অশান্ত সময়ের সঙ্গে এই ঘরানাগুলো কোনোটাই যাচ্ছে না। কেউ কেউ অন্যরকম পথ খুঁজছিলেন। বাংলায় এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠেন চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য্য। চিটাগঙে কলেজে পড়ার সময় বিপ্লবীদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন , বৃটিশ ঔপনিবেশিকতা এবং বাঙালি জমিদারী , ব্রাহ্মণ্যবাদ ইত্যাদির বিরুদ্ধে তার প্রবল ক্ষোভ ছিল। নিজের পদবী ব্যবহার করতেন না। আঁকার সময় বেঙ্গল স্কুলের শিল্পরীতিকে বর্জন করলেন এবং বেছে নিলেন প্রিন্টমেকিংকে। পঞ্চাশের মন্বন্তরের ওপর তৈরী , অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি সদস্য চিত্তপ্রসাদের প্রিন্টের বই 'হাংরি বেঙ্গল' বৃটিশ সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল এবং অধিকাংশ কপি নষ্ট করে ফেলা হয়েছিল।
মন্বন্তরের সময় দুই কঙ্কালসার শিশু / চিত্তপ্রসাদ / লিনোকাট
প্রিন্টমেকিংয়ের ব্যাপারে এখানে কিছু কথা বলা যায়। উডকাট প্রিন্ট অর্থে একটা কাঠের ব্লক নিয়ে সেটার ওপর পুরো ডিজাইনটা করা হত এঁকে [ectching] বা খোদাই করে। তারপর কাগজের ওপর সেই ব্লকের ছাপটা নেওয়া হত। লিনোকাটের ক্ষেত্রে কাঠের বদলে লিনোলিয়াম বলে তারপিন তেল , গঁদের আঠা , কাঠের করাতের গুঁড়ো এইসব মেশানো একটা রাসায়নিক ব্যবহার করা হত। এই লিনোলিয়াম দিয়ে মেঝে ঢাকা হত অনেক সময় , পরে যার বদলে ভিনাইল আসে।
চিত্তপ্রসাদের দুজন সুযোগ্য ছাত্রকে পেয়েছিলেন। প্রথমজন সোমনাথ হোড় , তিনিও চিত্তপ্রসাদের পথে তেলরং , টেম্পেরা ছেড়ে জলরঙ এবং প্রিন্টমেকিং বেছে নেন। কমিউনিস্ট পার্টির 'জনযুদ্ধ' কাগজে সোমনাথ হোড় নিয়মিত পঞ্চাশের মন্বন্তর এবং তেভাগা আন্দোলনের ওপর কাজ করেছেন।
সোমনাথ হোড়ের জলরং / তার শিল্পে সবসময় উঠে এসেছে আন্দোলনের ছবি /১৯৬৯
সোমনাথ হোড়ের বিখ্যাত 'ক্ষত' সিরিজের একটি ছবি / কাগজের মন্ড [paper পাল্প ] দিয়ে তৈরী
চিত্তপ্রসাদের আরেক ছাত্র ছিলেন জয়নুল আবেদিন। ১৯৭১ এ বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তিনি বাংলাদেশের 'শিল্পাচার্য্য' সম্মান পেয়েছিলেন।
গোর্কি ১৯৭০ / জয়নুল আবেদিন / বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের ওপর আঁকা জয়নুলের এই একটিমাত্র ছবি দিল্লির গ্যালারিতে আছে
সোমনাথ হোড়েরই সমসাময়িক আরেকজন মাস্টার প্রিন্ট মেকার ছিলেন কোচবিহারের হরেন্দ্র নারায়ণ দাস , তার প্রিন্টের বিষয়বস্তু ছিল অন্যরকম , মূলত গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রা।
হরেন দাস / উডকাট প্রিন্ট
বেঙ্গল স্কুলের আরেকজন ছাত্র ছিলেন দেবী প্রসাদ রায়চৌধুরী। তিনি প্রথমে ছবি আঁকলেও পরের দিকে , ভারত স্বাধীন হবার পর ভাস্কর হিসেবে বেশি প্রসিদ্ধি লাভ করেন। দেবীপ্রসাদের তৈরী মূর্তিগুলোর মধ্যে সবথেকে বিখ্যাত গান্ধীজির ডান্ডি যাত্রার সময়ের এগারো জনের মূর্তি , যেটা আগে পাঁচশো টাকার নোটের পিছনে থাকত। মূর্তিটা আছে রাষ্ট্রপতি ভবনের পিছনের রাস্তার ধারে এবং ওটা অনেকসময় গাড়িতে করে পর্যটকদের দূর থেকে দেখানো হয়। দেবীপ্রসাদের তৈরী আরেকটা বিখ্যাত মূর্তি চেন্নাইয়ের মেরিনা সৈকতের Triumph of Labour.
নোংরা বস্তি / দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী/ বেঙ্গল স্কুল হলেও দেবীপ্রসাদ ছবিতে কঠোর বাস্তব ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন
ইতিমধ্যে ভারত স্বাধীন হবার পর পাশ্চাত্যের আধুনিকতা , কিউবিজম , বিমূর্ত [abstract] ইত্যাদি ভাবধারা আবার ভারতের শিল্পে ঢুকতে শুরু করে। এই সময় দিল্লি , কলকাতা , মাদ্রাজ এবং বোম্বাইয়ের মত বড় শহরগুলোতে শুরু হল প্রোগ্রেসিভ শিল্পীদের সঙ্ঘ। ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করল রঙের ব্যবহার। ছবি অনেক উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
প্রথমে দিল্লী। ভবেশ চন্দ্র সান্যাল যামিনী প্রকাশ গাঙ্গুলীর কাছে আঁকা শিখলেও বেঙ্গল স্কুলে যোগ দেননি। লাহোরে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনের আগে লালা লাজপত রাইয়ের একটা মূর্তি গড়ার জন্য তাকে লাহোর যেতে হয়েছিল। তারপর সেখানেই থেকে যান এবং কালক্রমে লাহোরের আর্ট কলেজের পত্তন করেন। সাতচল্লিশের দেশভাগের পর দিল্লী চলে আসেন এবং গোল মার্কেটের ২৬ নম্বর দোকানে নিজের ষ্টুডিও খোলেন। সেটা দ্রুত দিল্লিতে আসা উদ্বাস্তু শিল্পীদের আখড়া হয়ে ওঠে এবং ১৯৪৯ সালে 'দিল্লি শিল্প চক্র' প্রোগ্রেসিভ দলের পত্তন।
নিজামুদ্দিনের মেলায় / ভবেশ সান্যাল / ছবিতে কারুর চোখ মুখ স্পষ্ট নয় , বিমূর্ততার প্রতীক
আত্মপ্রতিকৃতি / ভবেশ সান্যাল / ছবিতে শিল্পীর কাঁধে বসে থাকা পাখির গায়ের রং শিল্পীর চেক লুঙ্গির রঙের সঙ্গে মিলে গেছে
mourners / প্রাণনাথ মাগো / ১৯৫০ / ছবিতে একদল মহিলা শোকে কাঁদছেন , কিন্তু কারুর মুখ বা চোখ দেখা যাচ্ছেনা
rice planters / প্রাণনাথ মাগো / ১৯৫২ / সমস্ত কৃষকের মুখ মাটির দিকে নামানো বা অন্যদিকে তাকানো , যেন তারা শিল্পীর দিকে তাকাতে ভয় পাচ্ছে বা কাজে অত্যন্ত ব্যস্ত
জলের ঘট নিয়ে মেয়েরা / কৃষ্ণ শ্যামরাও কুলকার্নি / কুলকার্নি অজন্তার শিল্পধারার সঙ্গে সফলভাবে আধুনিকতা মিশিয়েছিলেন
মুখোশ / কৃষ্ণ শ্যামরাও কুলকার্নি / মুখোশের দুদিকের গড়ন , আঁকা আলাদা
orchard/ অবিনাশ চন্দ্র /
পরবর্তীকালে ইউকে চলে গেছিলেন
উপত্যকায় হ্রদ / জয়া আপ্পুস্বামী / দিল্লি শিল্প চক্রের সদস্য হলেও জয়া মূলত ছিলেন শিল্প ক্রিটিক
এই সংঘের সদস্য ছিলেন প্রদোষ দাশগুপ্ত , ধনরাজ ভগতের মত ভাস্কর এবং কানওয়েল কৃষ্ণর মত প্রিন্টমেকাররাও। একসময় ভবেশ সান্যালের ডাকে সাড়া দিয়ে কলকাতা থেকে দিল্লি এসেছিলেন শৈলজ মুখার্জি। শৈলজ মুখার্জিই আগের পর্বে লেখা নজন শিল্পীর মধ্যে একমাত্র , স্বাধীনতা পরবর্তীকালে যিনি ওই তালিকায় স্থান পেয়েছিলেন। শৈলজ ছেচল্লিশ বছর বয়সে ১৯৬০ সালে অটোরিকশা এক্সিডেন্টে মারা গেছিলেন।
শৈলজ মুখার্জির আঁকা প্রায় দুষ্প্রাপ্য , সেজন্যই তাকে নজনের তালিকায় রাখা হয়েছে কিনা নিশ্চিত নই / ছবিতে এক মসজিদের সামনে বোরখা পরিহিত চার নারীর বিমূর্ত ছায়া
লাহোরের আর্ট কলেজে ভবেশ সান্যালের কাছে আঁকা শিখেছিলেন দুজন - সতীশ গুজরাল এবং কৃষেন খান্না। এদের মধ্যে সতীশ গুজরাল ছিলেন ইন্দের কুমার গুজরালের ভাই , ইন্দের গুজরাল অনেক পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবেন। আর কৃষেন খান্না ব্যাংকে চাকরি করতেন দিনেরবেলা আর রাতে আঁকা শিখতেন। এরাও দিল্লি শিল্প চক্রে যোগ দিয়েছিলেন দেশভাগের পর।
আত্মপ্রতিকৃতি / সতীশ গুজরাল / চোখের জায়গায় গর্ত এবং খোঁচা হয়ে থাকা কালো চাদর
face ghost/ সতীশ গুজরাল/ পুরুষের মুখে রক্ত লেগে আছে কিন্তু নারীর মুখ ঢাকা
প্র্যাকটিস / কৃষেন খান্না / রঙের আঁচড়ে দুই ট্রাম্পেট বাজনদার
এর আগে ১৯৪৩ সালে সুভো ঠাকুর , নীরদ মজুমদার , পরিতোষ সেন , গোপাল ঘোষ এরা শুরু করেছিলেন 'ক্যালকাটা গ্রূপ'। এদের মধ্যে সুভো ঠাকুর ছিলেন ঠাকুরবাড়ির বিক্ষুদ্ধ সদস্য যিনি পরিবার থেকে স্বেচ্ছায় বেরিয়ে এসেছিলেন। নীরদ মজুমদার ছিলেন কমলকুমার মজুমদারের ভাই। এই গ্রূপ টারই ছবি দিল্লীর গ্যালারিতে বেশ কম দেখলাম। নীরদ মজুমদারের একটা 'নেতার ঘাট', গোপাল ঘোষেরও একটা। পরিতোষ সেনের কিছু দেখলাম না।
গোপাল ঘোষের ল্যান্ডস্কেপ / ১৯৫০
নীরদ মজুমদারের আঁকা একটা ছবি / এটা গ্যালারিতে ছিল না / যে ছবিটা গ্যালারিতে ছিল নেটে পেলাম না
এতক্ষণে তিনতলায় ঢুকে পড়েছি।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।