এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • ধর্ম, মৌলবাদ ও আমাদের ভবিষ্যৎ : কিছু যুক্তিবাদী চর্চা

    Debasis Bhattacharya লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৫ ডিসেম্বর ২০২২ | ৪৭৭১২ বার পঠিত | রেটিং ৪.৫ (২ জন)
  • ইসলাম সম্পর্কে আলাদা করে দু-চার কথা

    মৌলবাদ নিয়ে এই ধরনের একটা লেখায় যদি কেউ ঘোষণা করেন যে, এইবার ইসলাম নিয়ে আলাদা করে কিছু বলা হবে, তখন পাঠকের সে নিয়ে একটা প্রত্যাশা তৈরি হতে পারে। কাজেই, এখানে গোড়াতেই সে ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে বলে রাখা দরকার, না হলে পাঠক হয়ত বিভ্রান্ত ও ক্ষুব্ধ হবেন। সম্ভাব্য প্রত্যাশাটি এই রকম যে, মৌলবাদের স্বরূপ নিয়ে যখন চর্চা হচ্ছে, এবং তার মধ্যেই আলাদা করে ইসলাম নিয়ে চর্চার ঘোষণা হচ্ছে, তখন নিশ্চয়ই দেশে দেশে ইসলামীয় মৌলবাদের উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে ঐতিহাসিক বিবরণ পাওয়া যাবে এখানে, বিভিন্ন স্থান-কালে তার সাধারণ বৈশিষ্ট্য ও বিশেষ বিশেষ বৈচিত্র্যের উল্লেখ পাওয়া যাবে, এবং অন্যান্য ধর্মের মৌলবাদের সঙ্গে তার মিল ও অমিল এবং তার কার্যকারণ ইত্যাদি বিষয়ক অনুসন্ধান ও তার ফলাফলও পাওয়া যাবে। হ্যাঁ, এখানে তা করতে পারলে ভালই হত, কিন্তু তার উপায় নেই। সেটা করতে গেলে আগে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ধর্মের মৌলবাদের কার্যকলাপ নিয়ে একটা সুনির্দিষ্ট ও বিস্তারিত আলোচনা সেরে রাখতে হত, তবেই তার প্রেক্ষিতে ইসলামীয় মৌলবাদের বৈশিষ্ট্যগুলো স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠতে পারত। দুঃখের বিষয়, সে পরিসর এখানে ছিল না, এখানে তো এতক্ষণ মৌলবাদ নিয়ে শুধু কতকগুলো অতি সাধারণ কথাই বলেছি। বলে রাখা দরকার, এখানে আমি সরাসরি সেইসব নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করব না, যদিও যা আসলে বলব তার মধ্যে এ বিষয়ে আমার মতামত ও চিন্তাভাবনারও কিছু ইঙ্গিত হয়ত মিলবে। এখানে আমি মূলত কথা বলব ইসলাম ধর্ম ও সংশ্লিষ্ট মৌলবাদ প্রসঙ্গে আমাদের সমাজের মূলস্রোত ধ্যানধারণা নিয়ে, এবং তার ঠিক-বেঠিক নিয়েও। এ নিয়ে কথা বলব কারণ, আমার ধারণা, ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে যাঁরা ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লড়তে চান, তাঁদের এ বিষয়টি এড়িয়ে যাবার কোনও উপায় নেই।
     
    ওপরে বলেছি, যাঁরা ধার্মিক নন বরঞ্চ ‘ধর্ম’ জিনিসটার সমালোচক, তাঁদের মধ্যে ইসলাম নিয়ে দু রকমের ভাবনা বেশ পরিচিত। অনেকে মনে করেন, এই ‘মৌলবাদ’ সংক্রান্ত সমস্যাটা আসলে শুধুই ইসলামের সমস্যা, আর কারুরই নয় --- ধর্মের নামে ফতোয়াবাজি আর মারদাঙ্গা মূলত মুসলমানেরাই করছে। অন্যদের যদি আদৌ কিছু সমস্যা থেকেও থাকে, তো সেটা শুধু ইসলামি জঙ্গিপনার প্রতিক্রিয়া মাত্র। আবার, এ অবস্থানটি অন্য অনেকের দুশ্চিন্তারও কারণ। ইসলামি জঙ্গিপনার বিপদ স্বীকার করেও তাঁরা মনে করেন যে, এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে নির্দোষ ও নিরীহ আম মুসলমানের ঢালাও খলনায়কীকরণ হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ছড়ানো হচ্ছে ঘৃণা বিদ্বেষ ও হিংস্রতা। প্রথম ভাবনাটি ভুল, কেন তার কিছু ব্যাখ্যা নিচে আছে।
     
    আর ওই দ্বিতীয় প্রকারের যে দুশ্চিন্তা, আমি এবং আমার মত অনেকেই যার শরিক, তার এক প্রতিনিধি-স্থানীয় দৃষ্টান্ত আমার হাতে এসেছে কয়েকদিন আগে, আমার এক তরুণ বন্ধুর সাথে ফেসবুকীয় কথোপকথনে। তিনি কে, সেটা এখানে প্রাসঙ্গিক না, কিন্তু তিনি আমাকে যে সব প্রশ্ন করেছেন তা বোধহয় অতিশয় প্রাসঙ্গিক। এখানে সেগুলো হুবহু উদ্ধৃত করলে হয়ত আমাদের আলোচ্য প্রশ্নগুলোকে সুনির্দিষ্ট আকার দিতে সুবিধে হবে। অবশ্য, এখানে উদ্ধৃত প্রত্যেকটি প্রশ্নগুলোর সুনির্দিষ্ট ও নিষ্পত্তিমূলক উত্তর দেওয়া এ লেখার উদ্দেশ্য ততটা নয়, যতটা হল মূল প্রশ্নগুলোকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে সমস্যাটাকে আরেকটু স্পষ্ট করে তোলা। নিচে রইল সেই তরুণ বন্ধুর দুশ্চিন্তা-জারিত প্রশ্নগুলো।
     
    দাদা,

    একটা বিষয় একটু বিস্তারিত জানতে চাই আপনার কাছে। আপনি যদি সময় করে একটু ডিটেইলসে উত্তর দেন, খুব উপকৃত হই। অনেকদিনই এটা আপনাকে জিজ্ঞেস করব করব ভেবেছি, কিন্তু করা হয়নি, কারণ বিষয়টা একটু সেন্সেটিভ, আর প্রশ্নটা একটু বিস্তারে করতে হবে।

    ছোটবেলা থেকেই (ক্লাস ওয়ান থেকে) আমি দেখে এসছি, আমার পরিমণ্ডলে শুধুমাত্র ধর্মে মুসলিম হওয়ার জন্য মানুষকে সন্দেহের চোখে, বিদ্বেষের চোখে দেখা হয়। ক্রিকেটে পাকিস্তান জিতলে "কীরে, খুব আনন্দ বল!" বলে টন্ট কাটা হয়, কেবল নাম দেখে বাড়িভাড়া দিতে অস্বীকার করা হয়, এমনকি মুসলিম ছাত্র ক্লাসে ভাল রেজাল্ট করলেও "আশ্রম থেকে শেষে মুসলিম ফার্স্ট হবে" এরকম কথা খোদ টিচারের মুখেই শুনেছিআমি ঘটনাক্রমে মুসলিম পরিবারে জন্মাইনি, কিন্তু একদম ছোটবেলা থেকেই আমার মুসলিম বন্ধু বা প্রতিবেশীদের এভাবে সামাজিক হেট ক্যাম্পেনিং এর মুখে পড়াটা ভীষণ দুঃখজনক লাগে। এই খারাপ লাগাটা ক্লাস ওয়ান থেকেই শুরু হয়েছিল, তো তখন তো আমি ধর্ম ভাল না খারাপ, যুক্তিবাদ ভাল না খারাপ, এতকিছু তো বুঝতাম না।

    এখন মুসলিমবিদ্বেষকে যারা জাস্টিফাই করে, তাদের থেকে যে যুক্তিগুলো উঠে আসে, সেগুলো -

    ১) আর কোন ধর্মে আইসিস, তালিবান, বোকোহারামের মত সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আছে?

    ২) "ওরা" (মুসলিমরা) সংখ্যায় বাড়লেই ইসলামিক রাষ্ট্র চায়, সংখ্যায় কমলেই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র চায়।

    ৩) সব ধর্মে সংস্কার হয়েছে, কিন্তু "ওরা" এখনও মধ্যযুগেই পড়ে আছে।

    ৪) সব ধর্মেই বহুবিবাহ বন্ধ হয়েছে, কিন্তু "ওদের ধর্মে" বহুবিবাহ আজও জায়েজ, ওদের ধর্মে নারীর অবস্থা সবচাইতে খারাপ।

    ৫) "ওরা" নিজেদের বাঙালি মনে করে না, মননে চিন্তনে আরব, ওদের কাছে ধর্মই সব।

    ৬) ধর্মের নামে মানুষ হত্যা "ওদের ধর্মের মত কোন ধর্মই করেনি।"

    ৭) "ওদের" বাড়াবাড়ির জন্যই বিজেপির মত দলের সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ, হিন্দু মৌলবাদ ইসলামিক মৌলবাদের প্রতিক্রিয়ার ফসল।

    ইত্যাদি ইত্যাদি। আপাতত এই কটাই মনে পড়ছে।

    এখন আমার প্রশ্ন

    ১) মুসলিমবিদ্বেষীদের এই দাবিগুলো কি তথ্যগতভাবে সত্যি?

    ২) সত্যিই কি ইসলাম আর পাঁচটা ধর্মের থেকে ব্যতিক্রমী ভায়োলেন্ট? এখন তো যুক্তি, তথ্য, পরিসংখ্যানের বিভিন্ন মেথডলজি দিয়ে অনেক বিষয় কম্পারেটিভ স্টাডি করা যায়। "ইসলাম অন্য পাঁচটা ধর্মের থেকে ভায়োলেন্ট" - এই বিষয়টা কি যুক্তি, তথ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা যায়? মানে আমার প্রশ্ন, দাবিটার গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু?

    ৩) ধরে নিলাম, ইসলাম সবচাইতে ভায়োলেন্ট ধর্ম। কিন্তু তাতে করেই কি মুসলিমবিদ্বেষ জায়েজ হয়ে যায়?

    ৪) একজন নাস্তিক হিসাবে মুসলিম সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার হরণ করা হলে তার প্রতিবাদ করা কি অন্যায়?

    ৫) হিন্দু মৌলবাদ কি সত্যিই ইসলামিক মৌলবাদের প্রতিক্রিয়ার ফসল? ইসলামিক মৌলবাদ না থাকলে সত্যিই কি হিন্দু মৌলবাদ বলে কিছু থাকত না?

    ৬) আইসিস বা তালিবানের মত মুসলিম লিগ বা বর্তমানে মিমকে কি মৌলবাদী বলা যায়? নাকি "সাম্প্রদায়িক, কিন্তু মৌলবাদী নয়"-এমনটা বলা উচিত?

    আমার প্রশ্ন করার মূল কারণটা কিন্তু কোনভাবেই ইসলামকে ডিফেন্ড করা বা তার ভয়াবহতাকে লঘু করা নয়। আমিও ধর্মহীন সমাজের স্বপ্ন দেখি, সব ধর্মের মত ইসলামের অবসানও আশা করি।

    কিন্তু মধ্যবিত্ত শিক্ষিত স্তরে ইসলামের সমালোচনাটা যেভাবে হয়, তার টোনটা ঠিক যুক্তিবাদের নয়, টোনটা বিদ্বেষের। এখন রিলিজিয়াস ক্রিটিসিজমকে ঢাল করে বুঝে বা না বুঝে অনেক প্রগতিশীল মানুষও বিদ্বেষের টোন ব্যবহার করছেন। এটা খুব আশঙ্কার।

    এখন, এই প্রশ্নগুলোর প্রত্যেকটাকে আলাদা করে উত্তর দেবার চেষ্টা না করে বরং এ প্রসঙ্গে কতকগুলো সাধারণ কথা ভেবেচিন্তে দেখি। তাতে করে সমাধান না আসুক, অন্তত সমস্যাটার চেহারাটা আরেকটু স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠতে পারে কিনা, দেখা যাক। হতে পারে, ভাবতে গিয়ে হয়ত ওপরের দু-একটা প্রশ্ন শেষতক বাদই পড়ে গেল, বা উল্টোভাবে, যে প্রশ্ন এখানে নেই তেমন কিছু এসে কথার মধ্যে ঢুকে পড়ল।

    প্রথমেই বলা দরকার, অনেকে আধুনিক মৌলবাদী উত্থানকে মুসলমান জঙ্গি উত্থানের সঙ্গে এক করে দেখেন, যা মোটেই সঠিক নয়। বর্তমান পৃথিবীর প্রধান ধর্মীয় ধারাগুলোর সবকটির মধ্যেই মৌলবাদী উত্থান ঘটেছে, বিভিন্ন মাত্রা, ভঙ্গী ও ধরনে। আমেরিকায় খ্রিস্টান মৌলবাদীদের কথা আমরা জানি, জানি ইসরায়েলের ইহুদী মৌলবাদীদের কথা, জানি ভারতের হিন্দু মৌলবাদীদের কথা, এবং জানি এই ভারতেই আশির দশকে তেড়েফুঁড়ে ওঠা শিখ মৌলবাদীদের কথাও --- যাদের হাতে ভারতের এক প্রধানমন্ত্রী নিহত হয়েছিলেন। ‘অহিংসার ধর্ম’ বলে কথিত বৌদ্ধধর্মও এ প্রবণতার বাইরে নয় মোটেই। থাইল্যান্ড, বর্মা ও শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধ ধর্মের তরফেও জঙ্গি প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে। আজ অনেকেরই হয়ত আর মনে নেই, দুহাজার এক সালের কুখ্যাত ‘নাইন ইলেভেন’-এর ঘটনার আগে পর্যন্ত সবচেয়ে বড় ধর্মীয় নাশকতার ঘটনা বলে ধরা হত উনিশশো পঁচানব্বই সালের দুটি ঘটনাকে। তার একটি ঘটেছিল আমেরিকার ওকলাহোমা সিটি-র ‘ট্রেড সেন্টার’-এ, যাতে বিস্ফোরক-ভর্তি ট্রাক দিয়ে ওই ভবনটিতে ধাক্কা মেরে প্রায় দেড়শো লোকের প্রাণনাশ করা হয়েছিল, এবং সেটা ঘটিয়েছিল কতিপয় খ্রিস্টান মৌলবাদী। অন্যটি ঘটেছিল জাপানে, যেখানে পাতাল রেলের সুড়ঙ্গে বিষাক্ত সারিন গ্যাসের কৌটো ফাটিয়ে দেওয়া হয়, তাতে বিষাক্ত গ্যাসে সরাসরি যত না মারা যায় তার চেয়ে অনেক বেশি লোক মারা যায় এবং গুরুতরভাবে জখম হয় সুড়ঙ্গের ভেতরে আতঙ্কগ্রস্তদের দৌড়োদৌড়িতে পদপিষ্ট হয়ে --- এবং সেটা ঘটিয়েছিল কট্টরপন্থী বৌদ্ধদের একটি ক্ষুদ্র উপগোষ্ঠী। আমরা বৌদ্ধধর্মটা অন্তত অহিংস বলে জানতাম, তাই না? তার দু বছর আগে উনিশশো তিরানব্বই সালে ভারতে সংঘটিত কুখ্যাত ‘বম্বে বিস্ফোরণ’ অবশ্যই একটি বৃহৎ নাশকতা, এবং সেটা ঘটিয়েছিল মুসলমান জঙ্গিরাই। কিন্তু, মুসলমান মৌলবাদীদের বক্তব্য অনুযায়ী, সেটা ছিল তার এক বছর আগে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিক্রিয়া। বলা বাহুল্য, এই বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনাটিকেও আবার মুসলমানদের অত্যাচারের প্রতিক্রিয়া বলেই দেখানো হয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সেটা কোনও সাম্প্রতিক ‘অত্যাচার’-এর প্রতিক্রিয়া ছিল না। হিন্দু মৌলবাদীদের নিজেদের দাবি অনুযায়ীই, এটা নাকি মোগল সম্রাট বাবরের তরফে ঘটে যাওয়া পাঁচশ বছরের পুরোনো এক অন্যায়ের প্রতিকার মাত্র! এবং, এই বাবরি মসজিদের ধ্বংসও আবার এ দেশে ধর্মীয় নাশকতার প্রথম ঘটনা নয়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও নয়। এ দেশে আজ পর্যন্ত ধর্মীয় নাশকতার সবচেয়ে বড় ঘটনা বলে যদি কোনও বিশেষ ঘটনাকে ধরতেই হয়, তো সেটা সম্ভবত উনিশশো চুরাশি সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধিকে হত্যা করার ঘটনা। সেটা মুসলমানেরা ঘটায়নি, ঘটিয়েছিল শিখ মৌলবাদীরা।

    ধর্মের সমালোচনা যে আধুনিক পৃথিবীর অন্যতম প্রধান কাজ, তাতে সন্দেহ নেই। সমালোচনা মানে সব ধর্মেরই সমালোচনা, ইসলামেরও।  কিন্তু, ইসলাম ধর্মের সমালোচনায় একটি ভুল আমরা প্রায়শই করে থাকি। আমরা বলি, ইসলাম ধর্ম (এবং সেইহেতু ওই ধর্মাবলম্বীরাও) তো হিংস্র হবারই কথা, কারণ, ইসলামীয় ধর্মশাস্ত্রে হিংসার উপাদান খুব বেশি আছে। হয়ত সত্যিই আছে, কিন্তু যুক্তিটা তা সত্ত্বেও ভুল, এবং দুটো দিক থেকেই ভুল। কারণ, প্রথমত, সব ধর্মশাস্ত্রেই হিংসার উপাদান কমবেশি আছে। এবং দ্বিতীয়ত, যে ধর্মের শাস্ত্রে হিংসার উপাদান কিছু কম আছে সে ধর্মগোষ্ঠীর মানুষের আচরণে হিংসা কম থাকবেই --- এ প্রত্যাশার ভিত্তিটাও বোধহয় খুব পোক্ত নয়।
     
    হিংস্রতার বর্ণনা ও তার নৈতিক সমর্থন হিন্দু শাস্ত্রগুলোতে কোরানের চেয়ে কিছু কম নেই। কম নেই বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টেও, যদিও, হয়ত বা সত্যিই কিছু কম আছে নিউ টেস্টামেন্টে।  আবার, শাস্ত্রগ্রন্থে হিংস্রতার বর্ণনা কম থাকলেই যে ধার্মিকেরা কিছু কম হিংস্র হবেন, এমন নিশ্চয়তাও পাওয়া কঠিন। যুদ্ধলিপ্সা, হত্যা এবং হিংস্রতায় যিনি প্রবাদপ্রতিম, সেই চেঙ্গিস খান কিন্তু মোটেই মুসলমান ছিলেন না, 'খান' পদবী দেখে যা-ই মনে হোক।  খ্রিস্টানরা ষোড়শ-সপ্তদশ শতক জুড়ে আমেরিকাতে স্থানীয় অধিবাসীদের বিরুদ্ধে যেভাবে হত্যালীলা চালিয়েছে নিউ টেস্টামেন্টের যাবতীয় ক্ষমার বাণী সত্ত্বেও, তা ইতিহাসে বিরল। মধ্যযুগের শেষে এবং আধুনিক যুগের গোড়ায় 'ক্ষমাশীল' খ্রিস্টানদের ডাইনি পোড়ানোর হিড়িক দেখে আতঙ্কে শিউরে ওঠেন না, এমন কেউই কি আছেন এ যুগে? 'ইসলামিক স্টেট' তার ঘোষিত 'বিধর্মীদের' হত্যা করে হত্যার উদ্দেশ্যেই, বা প্রতিশোধের উদ্দেশ্যে, এবং সেটা সারা জগতের লোককে ডেকে দেখানোর জন্যেও বটে। দেখ হে, আমরা কত ভয়ঙ্কর, কত বড় বীর, এই রকম একটা ভাব। কিন্তু মধ্যযুগের খ্রিস্টানরা ডাইনি মারত ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা দিয়ে, এবং যন্ত্রণা দেওয়াটাই সেখানে মূল উদ্দেশ্য, যাতে অকথ্য অত্যাচার করে তার মুখ থেকে অন্য আরেক ‘ডাইনি’-র নাম বার করে আনা যায়। এই কাজটির জন্য তারা বিচিত্র ও বীভৎস সব কলা-কৌশল ও যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেছিল। কাজেই, বিশেষ একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় হিংস্রতার সঙ্গে তার শাস্ত্রীয় অনুমোদনের একটা সহজ সরল সম্পর্ক ধরে নেওয়াটা বোধহয় সব সময় খুব নিরাপদ নয়।

    মুসলমানদের হিংস্রতার মতই আরেকটি বাজে গল্প আছে মুসলমানদের জনসংখ্যাবৃদ্ধি নিয়ে। মুসলমানদের হুহু করে বংশবৃদ্ধি হচ্ছে, এবং দ্রুত তারা হিন্দুদেরকে ছাপিয়ে গিয়ে গোটা দেশটাকে দখল করে ফেলবে, এই মিথ্যে আতঙ্কটা হচ্ছে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রচারের অন্যতম প্রধান বিষয়বস্তু, বহু মানুষই যা সরলমনে বিশ্বাস করেন। এখানে বলে নেওয়া দরকার, মুসলিম জনসংখ্যা যে বাড়ছে এবং তার হার যে হিন্দুদের চেয়ে এখন পর্যন্ত কিছু বেশিই বটে, এটা কিন্তু মিথ্যে নয়। মিথ্যে হল এই প্রচারটা যে, এইভাবে বাড়তে বাড়তে হিন্দুদের চেয়ে তাদের সংখ্যা নাকি বেশি হয়ে যাবে, এবং তারাই দেশটাকে গ্রাস করে ফেলবে। আসলে ঘটনা হল, সব ধর্মের জনসংখ্যাই বাড়ছে, এবং সংখ্যালঘুদের জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার সব দেশেই সংখ্যাগুরুদের চেয়ে সামান্য একটু বেশি হয়, যদি সেখানে সংখ্যালঘু নিধন না চলে, এবং বিশেষত যদি সে সংখ্যালঘুরা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া হয়। জনসংখ্যাবৃদ্ধির আসল যোগটা ধর্মের সঙ্গে নয়, অর্থনীতির সঙ্গে। হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যেও গরিবদের জনসংখ্যাবৃদ্ধি যদি আলাদা করে হিসেব করা হয় তো দেখা যাবে যে তা সচ্ছল হিন্দুদের চেয়ে অনেক বেশি। সম্পন্নরা ভাল রোজগার করতে চায়, ভালভাবে থাকতে চায়, এবং সন্তানের জীবনযাপনও যাতে সে রকমই হয়, সে ব্যবস্থা করতে চায়। তারা জানে যে সেটা করতে গেলে সন্তানকে উচ্চমানের শিক্ষাদীক্ষা দেওয়া দরকার, তার পেছনে ভাল করে যত্ন ও খরচাপাতি করা দরকার, এবং সেটা করার ক্ষমতাও তাদের আছে। ছেলেপুলে বেশি হলে তা সম্ভব নয়, এবং তাতে করে বাচ্চার মায়ের স্বাস্থ্যের বারোটা বাজবে, মা ঘরের বাইরে গিয়ে পেশাগত কাজকর্ম করে অর্থ উপার্জনও করতে পারবে না। ফলে, তারা বেশি সন্তান একদমই চায় না। উল্টোদিকে, গরিবরা এত কথা জানেও না আর তাদের সে ক্ষমতাও নেই। ফলে তারা যত বেশি সম্ভব সন্তান চায়, সেটা মায়ের স্বাস্থ্যহানি ও মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে হলেও। গরিবরা জানে তাদের সন্তান দুধেভাতে থাকবে না, এবং শেষপর্যন্ত কোনও শ্রমসাধ্য কাজেই যোগ দেবে যাতে শিক্ষা বা 'স্কিল' সেভাবে লাগে না। ফলে, সন্তানের সংখ্যা বেশি হলে দুরবস্থা আর অযত্নের মধ্যেও হয়ত রোগভোগ মৃত্যু এড়িয়ে কেউ কেউ টিঁকে যাবে, আর পরিশ্রম করে পরিবারের আয় বাড়াতে পারবে, যৎসামান্য হলেও। অথচ এদেরই যখন অর্থনৈতিক উন্নতি হবে, তখন এরা মেয়েদেরকে পড়াশোনা শেখাতে চাইবে, ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সন্তানকে কেরানি-আমলা-ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-উকিল এইসব বানাতে চাইবে, ফলে স্বল্পসংখ্যক সন্তান চাইবে, এবং মায়ের জীবন ও স্বাস্থ্যকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করবে। একটু ভাল করে খোঁজখবর করলেই জানা যাবে, অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ঘটছে কিন্তু আসলে ঠিক তাইই, হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের ক্ষেত্রেই। এবং, মুসলমানরা পিছিয়ে আছে বলেই তাদের অগ্রগতিও দ্রুততর। তাদের জন্মহারের বৃদ্ধি কমছে কিছু বেশি দ্রুতলয়ে। এভাবে চললে আর দেড় দুই দশক পরেই হয়ত হিন্দু-মুসলমানের জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার সমান হয়ে যাবে, এবং মুসলমানদের ভারত দখলের কুৎসিত অশিক্ষিত গল্পতেও তখন আর কেউই পাত্তা দেবে না। ইতিহাসের স্বাভাবিক গতি এই দিকেই।
     
    এখানে 'অগ্রগতি' বলতে জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার কমিয়ে আনার কথা বুঝিয়েছি। মুসলমানদের ক্ষেত্রে এই কমিয়ে আনাটা হিন্দুদের চেয়ে বেশি হারে ঘটছে (বৃদ্ধির হার কমে যাওয়া মানে জনসংখ্যা কমে যাওয়া নয় কিন্তু, এ হার কমতে কমতে শূন্যের নিচে নামলে তবেই জনসংখ্যা কমতে শুরু করবে)। এই কমে আসাটা উন্নয়নের পরোক্ষ সূচক। এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিন বাদে যে হিন্দু-মুসলমানের জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার সমান হয়ে যাবে তাতে সন্দেহ নেই।  পিছিয়ে আছে বলেই অগ্রগতি বেশি তাড়াতাড়ি হচ্ছে --- এ কথাটা হয়ত অনেককে বিস্মিত করতে পারে, কিন্তু কথাটা বলার কারণ আছে। নিশ্চয়ই জানেন, ভারত চিন ব্রাজিলের মত একটু এগিয়ে থাকা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ইউরোপ আমেরিকার উন্নত দেশগুলোর থেকে বেশি। এর কারণ হচ্ছে, একবার উন্নত হয়ে গেলে একই গতিতে আরও আরও উন্নত হতে থাকাটা ক্রমশই আরও বেশি বেশি করে কঠিন হয়ে ওঠে, তাই উন্নয়নের প্রথম দিকে বৃদ্ধির যে গতি থাকে পরের দিকে আর তত গতি থাকে না। মুসলমানদের জনসংখ্যার ক্ষেত্রেও তাইই ঘটছে, এবং আরও ঘটবে (ও দুটোকে খুব নিখুঁতভাবে মেলানোর দরকার নেই, যদিও)।

    আমরা যারা এই বিষয়গুলোকে এইভাবে ভাবার চেষ্টা করি, তাদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আসে প্রায়শই, ফেসবুকে সে গর্জন রোজই শোনা যায়। এখন, এটা তো সত্যি কথাই যে, পশ্চিমবাংলার যুক্তিবাদীদের লেখালিখিতে, এবং যথারীতি আমার নিজের লেখাতেও, হিন্দু মৌলবাদের সমালোচনাই বেশি আসে, মুসলমান মৌলবাদের কথা বাস্তবিকই আসে অনেক কম। ঠিক এই অভিযোগটি সেক্যুলারদের প্রতি হিন্দু মৌলবাদীরা করে থাকেন নিয়মিতই (বস্তুত, প্রত্যেক ধর্মের মৌলবাদীরাই তাদের নিজস্ব গোষ্ঠী বা সমাজের সেক্যুলারদের প্রতি এই একই অভিযোগ করে থাকে)। কিন্তু একটু ভাবলে বুঝবেন, এটাই প্রত্যাশিত ও স্বাভাবিক। এবং, অন্যরকম কিছু হলেই বরং অত্যন্ত অস্বাভাবিক ও অসঙ্গত হত, এমন কি অন্যায়ও হত। কেন, তার একাধিক কারণ আছে। প্রথমত, এ দেশের রাষ্ট্র ও সমাজ যে মৌলবাদী হুমকিটির মুখোমুখি, সেটা তো হিন্দু মৌলবাদই, অন্য কোনও মৌলবাদ নয়। শিক্ষা-প্রশাসন-বিচারব্যবস্থার ধর্মীয়করণ, সংবিধানকে পাল্টে দেবার পরিকল্পনা, ভিন-ধর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন, ধর্মের জিগির তুলে তার আড়ালে সরকারি সম্পত্তি পাচার --- এ সব তো মুসলমানরা করছে না, হিন্দুত্ববাদীরাই করছে। অতএব, তাদের মুখোশ খোলাটাই এখানে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক। মুসলমান জঙ্গিরা নাশকতা ঘটালে তার মোকাবিলার জন্য পুলিশ-মিলিটারি আছে, কিন্তু নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসা মৌলবাদীদের রোখবার দায়িত্ব তো আর পুলিশ-মিলিটারি নেবে না, সেটা সাধারণ ভারতীয় নাগরিকের কাজ। আমি যে দেশে এবং যে ধর্মীয় সমাজের মধ্যে বাস করি, সেখানে যারা অন্ধত্ব ও হিংস্রতা ছড়াচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রকে বিনাশ করছে, তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোটাই তো আমার পক্ষে স্বাভাবিক, তাই না? বাংলাদেশি মুক্তমনারা যদি মুসলমান ধর্ম ছেড়ে হিন্দুদেরকে গালি দিতে থাকতেন, বা বার্ট্র্যান্ড রাসেল যদি 'হোয়াই আই অ্যাম নট আ ক্রিশ্চান' না লিখে 'হোয়াই আই অ্যাম নট আ হিন্দু' লিখে বসতেন, তাহলে যেমন উদ্ভট অসঙ্গত কাজ হত, এখানে আমরা হিন্দু ধর্ম ছেড়ে মুসলমান নিয়ে পড়লেও ঠিকই একই ব্যাপার হবে (যদিও বাংলাদেশি মুক্তমনারা ঠিক যা বলেন এবং যেভাবে বলেন, তার অনেক কিছুর সঙ্গেই আমার দ্বিমত আছে, তবে সেটা এখানে প্রাসঙ্গিক না)। দ্বিতীয়ত, আমরা পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগ মুক্তমনা যুক্তিবাদী নাস্তিকেরা হিন্দু সমাজে জন্মেছি বলেই সে সমাজ ও তার ধর্ম শাস্ত্র রীতিনীতি আচার বিচার এইসব অনেক বেশি জানি, ফলে সে ব্যাপারে আমাদের সমালোচনা অনেক বেশি নিরেট, নির্ভুল এবং অর্থবহ হয়, যা ভিনধর্মী সমাজে যারা জন্মেছে তারা পারবেনা। ঠিক একই কারণে, মুসলমান সমাজ ও ধর্ম সম্পর্কে মুসলমান সমাজে জন্মানো যুক্তিবাদীদের সমালোচনা অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য ও ফলপ্রসূ হয়। যদিও, এর মানে মোটেই এই নয় যে এক ধর্মে জন্মানো লোক অন্য ধর্মের সমালোচনা করতেই পারবেনা --- যে কোনও মানুষের যে কোনও ধর্মের সমালোচনা করার অধিকার আছে, এবং করা উচিত। তবে কিনা, নিজের সমাজের অন্ধত্ব অযুক্তি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথমে সোচ্চার হওয়াটা যে কোনও মানুষেরই ‘স্বাভাবিক’ অধিকার, কর্তব্যও বটে।
     
    আচ্ছা, তা সে যা-ই হোক, মোদ্দা কথাটা তাহলে কী দাঁড়াল --- মুসলমানেরা ধর্মান্ধতায় অন্যদের চেয়ে এগিয়ে, না পিছিয়ে? এসব ঠিকঠাক বলতে গেলে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে পৃথিবীজোড়া সমীক্ষার নির্ভরযোগ্য ফলাফল চাই, না হলে সবটাই চায়ের দোকানের আড্ডা হয়ে যাবে। আপাতত আছে কি সে সব, আমাদের হাতে? সুখের বিষয়, সে সব আছে। এই কিছুদিন মাত্র আগেও সেভাবে ছিল না, কিন্তু এই একুশ শতকে বেশ ভালভাবেই আছে। বেশ কয়েকটি বিখ্যাত সংস্থা এখন মানুষের জীবনের নানা দিক নিয়ে প্রামাণ্য সমীক্ষা করে থাকে, তার মধ্যে ধর্মবিশ্বাসও পড়ে। এইসব সমীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে বড় বড় বিশেষজ্ঞরা নানা গভীর গবেষণাও করে থাকেন, এবং তাতে তেমন চমকপ্রদ কোনও ফলাফল পাওয়া গেলে সারা পৃথিবীর গণমাধ্যমে সে নিয়ে আলোড়ন উঠে যায়। এই রকমই একটি সংস্থা হল ‘উইন গ্যালাপ’। তারা সারা পৃথিবী জুড়ে মানুষের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে এক বিখ্যাত সমীক্ষা চালিয়েছিল ২০১২ সালে, তাতে বিভিন্ন ধর্মগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মবিশ্বাসের প্রাবল্য, ধর্মবিশ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে আসা মানুষের সংখ্যা, এইসবের হিসেব ছিল। তাতে কি দেখা গেল? নিচে দেখে নিন ২০১২ সালের পৃথিবীজোড়া সমীক্ষার ফলাফল, সুন্দর করে সারণিতে সাজানো। এখানে পরিষ্কারভাবেই দেখা যাচ্ছে, নিজেকে বিশ্বাসী বলে দাবি করেন অথচ ধার্মিক বলে দাবি করেন না --- এমন মানুষের অনুপাত মুসলমানদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি। কারা কবে সমীক্ষাটি করেছে, এবং তা কোন নথিতে প্রকাশিত, সব তথ্যই পাবেন এখানে।
     
     
    এবার একটি ইসলামীয় দেশকে নিয়ে ভাবা যাক, যেখানে প্রায় সর্বাত্মক মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং ইসলামীয় রাষ্ট্র আছে। ধরুন, ইরান। এই  দেশটা সম্পর্কে আপনি কী জানেন? জানি, এ প্রশ্নের উত্তরে প্রায় সকলেই একই কথা বলবেন। ছিয়ানব্বই দশমিক পাঁচ শতাংশ (সরকারি সেন্সাসের তথ্য অনুযায়ী) মুসলমান অধ্যুষিত একটি ধর্মান্ধ দেশ, যার মধ্যে আবার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা শিয়া মুসলমানদের। কট্টর মৌলবাদীরা সেখানে দেশ চালায়, প্রশ্ন করলেই কোতল হতে হয়, মুক্তচিন্তা কল্পনাতীত। সম্প্রতি সেখানে হুলুস্থুলু ঘটে গিয়েছে, সে সব খবরাখবর আপনারা দেখেছেন। একটি মেয়েকে ইসলাম-সম্মত পোশাক না পরার অপরাধে সেখানে হত্যা করা হয়েছে, তাই নিয়ে প্রবল আন্দোলন হলে রাষ্ট্রের তরফে নেমে এসেছে দমন-পীড়ন, এবং সদ্য-সমাপ্ত ফুটবল বিশ্বকাপে সারা পৃথিবীর সামনে তার প্রতিবাদ করায় সে দেশের জাতীয় দলের এক খেলোয়াড়কে দেওয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। এখানে মৌলবাদের দাপটের ছবিটা একদমই স্পষ্ট, আবার গণমানুষের আপত্তিটাও খুব আবছা নয়।

    আসলে, এখানে ধর্মীয় রাষ্ট্রের দোর্দণ্ডপ্রতাপের তলাতেই লুকিয়ে আছে অন্য এক বাস্তবতা। নেদারল্যান্ডের একটি গবেষণা সংস্থা (GAMAAN), ইরানই যাদের অনুসন্ধানের বিষয়বস্তু, তারা ২০২০ সালে  ইরানে সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছে। সে সমীক্ষার ফলাফল যদি বিশ্বাস করতে হয়, তো সেখানে সাঁইত্রিশ শতাংশ মত লোক নিজেদের মুসলমান বলে দাবি করেন (শিয়া-সুন্নি মিলিয়ে), যাঁরা কোনও ধর্মীয় পরিচয় দিতে রাজি নন তাঁরা বাইশ শতাংশ, যাঁরা পরিষ্কারভাবে নিজেকে নাস্তিক-অজ্ঞাবাদী-মানবতাবাদী এইসব বলে পরিচয় দেন তাঁরা সব মিলিয়ে প্রায় সতেরো শতাংশ, যাঁরা নিজেকে শুধুই 'স্পিরিচুয়াল' বলেন তাঁরা প্রায় সাত শতাংশ, এবং বাকিরা আরও নানা বিচিত্র ধর্মের মানুষ। নিচের ছবি দুটোয় সমীক্ষার ফলাফল এক নজরে পাওয়া যাবে। হ্যাঁ বন্ধু, একুশ শতকে পৃথিবী বদলাচ্ছে, এবং হয়ত বিশ শতকের চেয়েও দ্রুত গতিতে! এবং, ইসলামীয় দেশগুলো কোনওভাবেই এ প্রবণতার বাইরে নয়। নিচে সে সমীক্ষার ফলাফল দেখুন, চিত্রাকারে।
     
     
    ধর্ম, ঈশ্বর, স্বর্গ, নরক, মৃত্যু-পরবর্তী জীবন, অবতার ইত্যাদি ধ্যানধারণা বিষয়ে ইরান-বাসীদের বিশ্বাস (বা অবিশ্বাস) ঠিক কী রকম, সে চিত্রও উঠে এসেছে সমীক্ষা থেকে। নিচে দেখুন।
     
     
     
    তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, মুসলমানদের ধর্মপ্রীতি নিয়ে আমাদের অধিকাংশের মধ্যে যেসব জনপ্রিয় ধ্যানধারণা আছে, তার সমর্থন এইসব সমীক্ষার ফলাফল থেকে মিলছে না মোটেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে ইঙ্গিত এখান থেকে আমরা পাচ্ছি, সেটা সামগ্রিক বৈশ্বিক প্রবণতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, নাকি একটা সম্পূর্ণ আলাদা উল্টোপাল্টা কিছু। সেটা বুঝতে গেলে বর্তমান শতকের বিগত কয়েকটি দশকে গোটা পৃথিবীর ধর্মবিশ্বাসের গতিপ্রকৃতি এক নজরে দেখে নেওয়া দরকার। এমনিতে সেটা একটু মুশকিল, কারণ, তার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংস্থার করা অনেকগুলো সমীক্ষা-কর্ম খুঁটিয়ে দেখে সেগুলোর প্রাসঙ্গিক ফলাফলটুকু বেছে নিয়ে তুলনা করতে হবে। সেইজন্যে, আমি যতটা পেরেছি সেগুলোকে সাজিয়ে একটা মাত্র সারণিতে নিয়ে এসেছি, তাতে পাঠিকের কিছু সুবিধে হবার কথা। সেটা নিচে দিলাম, দেখুন। সারণির কোন সংখ্যাটি কোন সংস্থার করা কবেকার সমীক্ষায় পাওয়া গেছে, সেটা ওখানেই দেওয়া আছে। প্রথম সংখ্যাটি অবশ্য কোনও সংস্থার তরফে দেওয়া নয়। এটি দিয়েছিলেন সমাজতত্ত্ববিদ ফিলিপ জুকারম্যান, তখন পর্যন্ত প্রাপ্য সমস্ত টুকরো টুকরো সমীক্ষার ফলাফল এক জায়গায় করে।
     
     
     
     
    এবার নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে, মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসের গতিপ্রকৃতি অন্য ধর্মাবলম্বীদের থেকে খুব বেশি আলাদা নয়। আসলে, এই একুশ শতকে দাঁড়িয়ে, সব ধর্মগোষ্ঠীর মধ্যেই ধর্মবিশ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে আসার যে প্রবণতা রয়েছে, মুসলমানরা কোনও মতেই সে প্রবণতার বাইরে নয় (অবশ্যই, এ হিসেব সামগ্রিক ও বৈশ্বিক, এবং অঞ্চল ও অন্যান্য পরিস্থিতি-ভেদে মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য আছে)।

    কেন এই জগৎজোড়া প্রবণতা? আমাদের স্বাভাবিক বুদ্ধি বলবে, সবই যুগের হাওয়া। মানে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং গণতন্ত্র-মানবতাবাদ-যুক্তিবাদ এইসবের প্রভাবই এর কারণ। কথাটা সত্যি, কিন্তু সমাজবিদেরা এর চেয়েও বড় কারণ আবিষ্কার করেছেন। তাঁরা আজ সুপ্রচুর তথ্য-যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন, মানব সমাজের উন্নতির সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক বিপ্রতীপ। দেশের মাথাপিছু আয় বাড়লে, সমাজকল্যাণে সরকার বেশি বেশি খরচা করলে, অর্থনৈতিক অসাম্য কমলে এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের হাল ভাল হলে ধর্মের রমরমা কমতে থাকে (এখানে আর বিস্তারে যাব না, যদিও আগে এ নিয়ে আলোচনা করেছি এবং পরেও করব)। সমাজ-বিকাশের এই সাধারণ নিয়ম মুসলমান সমাজের ওপরে প্রযোজ্য হবে না, এমনটা  ভেবে নেওয়ার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। ইরানে যা ঘটছে, সেটা সমাজ-বিকাশের এই সাধারণ নিয়মের চাপেই। নেটে একটু খোঁজাখুঁজি করলেই দেখতে পাবেন, ইরানের মাথাপিছু উৎপাদন ভারতের প্রায় আটগুণ, বাজেটের শতাংশ হিসেবে স্বাস্থ্যখাতে সরকারি খরচ প্রায় সাতগুণ এবং শিক্ষাখাতে তা দেড়গুণেরও বেশি, এবং নারী ও পুরুষ উভয়েরই আয়ু আমাদের থেকে ভাল (গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের দশা শোচনীয়, যদিও)। কাজেই, ইরানে মৌলবাদী রাজনীতি ও প্রশাসনের ওপর কেন গণ-অসন্তোষের চাপ আছে এবং পাকিস্তান আর আফগানিস্তানে কেন তা ততটা নেই --- এইটা বুঝতে পারা খুব কঠিন না।

    বলা প্রয়োজন, সমাজ-বিকাশজাত এই চাপের খেলা সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান উন্নত পশ্চিমী দেশগুলোতেও, বিশেষত এই একুশ শতকে। এই সেদিন পর্যন্ত আমেরিকা আর আয়ার্ল্যান্ডে ধর্মবিশ্বাসের প্রাবল্য ছিল অন্যান্য উন্নত দেশের চেয়ে অনেক বেশি। ধার্মিক সমাজবিদেরা তাই দেখিয়ে বলতেন, অর্থনৈতিক উন্নতি হলেই ধর্মের রমরমা কমবে, এটা হচ্ছে গিয়ে প্রগতিবাদীদের বানানো একটা মিথ্যে কথা। কিন্তু সময় যতই গড়াচ্ছে ততই বিষয়টা জলের মত স্বচ্ছ হয়ে আসছে, এবং আপত্তি তোলবার পরিসর হয়ে আসছে অতিশয় সঙ্কুচিত। মার্কিন সমাজে ধর্মবিশ্বাসের পরিবর্তনটা দেখতে পাবেন এক নজরেই, নিচের লেখচিত্রে। লক্ষ করে দেখুন, ১৯৫০ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত আমেরিকাতে যখন খ্রিস্টানরা এসে ঠেকেছে ৮৫ শতাংশ থেকে ৬৯-এ, এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা যখন মোটের ওপর একই আছে, তখন ধর্মহীনদের শতকরা অনুপাত গিয়ে ঠেকেছে শূন্য থেকে একুশে (অন্য কিছু সমীক্ষায় এটি প্রায় তিরিশ বলে দেখানো হয়েছে, যদিও)।
     
     
     
    আর, এই শতকের প্রথম দশকে আয়ার্ল্যান্ড-বাসীর ধর্মবিশ্বাসে যা ঘটেছে, সেটা দেখে নিন নিচের সারণিতে। আয়ার্ল্যান্ড হল গোঁড়া ক্যাথোলিক অধ্যুষিত একটি দেশ। একটা উন্নত পশ্চিমী দেশের পক্ষে অবিশ্বাস্যভাবে, এই সেদিন পর্যন্তও এই দেশটিতে গর্ভপাত নিষিদ্ধ ছিল, এবং গর্ভপাতের দরকার পড়লে আইরিশ নারীদেরকে পার্শ্ববর্তী ব্রিটেনে গিয়ে হাজির হতে হত। তারপর উন্নত আধুনিক অর্থনীতির সঙ্গে রক্ষণশীল ধর্ম-সংস্কৃতির দীর্ঘ সংঘর্ষের ফলাফল তখনই সারা বিশ্বের নজরে এল, যখন দু হাজার আঠেরো সালে গর্ভপাত আইনসিদ্ধ হয়ে গেল (আয়ার্ল্যান্ড নিয়ে আমার আলাদা একটি লেখা ‘গুরুচণ্ডালি’-তে পাবেন)।
     
     
    বলা বাহুল্য, মোটের ওপর এই একই ঘটনা ঘটবার কথা মুসলমান-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতেও, এবং ঘটছেও তাইই। বেশ কয়েকটি ধর্ম-শাসিত রক্ষণশীল দেশে কমছে কঠোর ধর্মীয় বাধানিষেধ, বাড়ছে ধর্মহীনতা, এবং সাধারণ্যে কমছে ধর্মের প্রতি আনুগত্য, যদিও অনেক ক্ষেত্রেই তা  এখনও স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান নয়। বিষয়টাকে যদি খুঁটিয়ে নজর করা হয়, তাহলে এমন অনেক কিছুই হয়ত জানা যাবে, যে ব্যাপারে আমরা আগে সচেতন ছিলাম না। যেমন, ইরান-ইরাক-আফগানিস্তান যেভাবে ধর্মনিরপেক্ষ থেকে ধর্মীয় রাষ্ট্র হয়ে গেল, এবং যেভাবে তুর্কি দেশটিতে ক্রমেই শক্ত হচ্ছে মৌলবাদের মুঠি আর টলমল করছে ধর্মনিরপেক্ষতার আসন, সে নিয়ে আমরা প্রায়শই দুশ্চিন্তিত হই। ঠিকই করি। কিন্তু, আমরা কখনই খেয়াল করে দেখিনা যে, এই ধরাধামে একান্নটি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মধ্যে একুশটিতে কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ সরকারই চলছে (সে ধর্মনিরপেক্ষতার দশা প্রায়শই আমাদের চেয়ে খুব একটা ভাল নয় যদিও, তবে সেটা তো অন্য চর্চা)। এবং, ধর্মনিরপেক্ষীকরণের প্রক্রিয়া এখনও চালু, সে তালিকায় এই সেদিনও যুক্ত হয়েছে সুদান।

    তবুও প্রশ্ন আসতেই পারে, এবং আসবেও, জানা কথা। ওপরে উদ্ধৃত আমার তরুণ বন্ধুর ভাষায়, সে প্রশ্নটা এ রকম --- “আর কোন ধর্মে আইসিস, তালিবান, বোকোহারামের মত সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আছে?”। সত্যিই তো, প্রশ্ন হতেই পারে। ওপরে ব্যাখ্যা করেছি (এবং পূর্ববর্তী পর্বগুলোতেও), মৌলবাদী উত্থান সব ধর্মেই হয়েছে, শুধু ইসলামে নয়। এবং, জঙ্গি ক্রিয়াকলাপও কম বেশি হয়েছে সব ধর্মের তরফেই। সেই সত্যে ভর করে আমি হয়ত তর্ক করতে পারতাম, অন্যান্য ধর্মের মৌলবাদের সঙ্গে ইসলামের তফাতটা তাহলে গুণগত নয়, নিছকই পরিমাণগত। এরা কম, ওরা কিছু বেশি, এটুকুই মাত্র। কিন্তু, এ তর্ক শেষতক দাঁড়াবে না। পাথরের নুড়ির সঙ্গে পাথরের টিলার গুণগত পার্থক্যকে স্রেফ পরিমাণের দোহাই দিয়ে নস্যাৎ করাটা বোধহয় খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ইসলামীয় জঙ্গিপনার নিবিড়তা, ঘনত্ব, প্রচণ্ডতা এবং আন্তর্জাতিকতা, এ সবকে নিছক কম-বেশির ব্যাপার বলে উড়িয়ে দেওয়া অসম্ভব। যদি বলি, মধ্যপ্রাচ্যে একাধিক আধুনিক রাষ্ট্র থেকে খামচে নিয়ে একটা গোটা এবং আনকোরা নতুন ধর্মীয় রাষ্ট্র বানিয়ে তোলা, অনেকগুলো দেশে ধর্মনিরপেক্ষ সরকার উল্টে দিয়ে মৌলবাদী রাজত্ব কায়েম করা, প্রায় সবকটি মহাদেশে বড়সড় নাশকতা চালানোর মত সংগঠন তৈরি করতে পারা --- এত সব শুধুই জঙ্গিপনার কম-বেশির ব্যাপার, তার মধ্যে আলাদা করে বলার মত গুরুত্বপূর্ণ গুণগত বৈশিষ্ট্য কিছুই নেই --- তাহলে অবশ্যই বোকামি হবে, বাস্তবকে অস্বীকার করার বোকামি। কাজেই, জঙ্গিপনার এই ভয়ঙ্কর নিবিড়তা আর ব্যাপকতাকে ইসলামীয় মৌলবাদের একটি স্বতন্ত্র গুণগত বৈশিষ্ট্য বলে স্বীকার করে নেওয়াই ভাল। কিন্তু মুশকিলটা হচ্ছে, সেটা মেনে নিলেও আসল সমস্যাটা রয়েই যায়। সব মুসলমানই তো আর মৌলবাদী জঙ্গি নন, তার এক অতি ক্ষুদ্র অংশই কেবল মৌলবাদী জঙ্গি। কাজেই, এই জঙ্গিপনাকে ইসলামীয় মৌলবাদের একটি স্বতন্ত্র গুণগত বৈশিষ্ট্য বলে মেনে নিলেও প্রশ্ন থাকে, ‘ইসলাম’ নামক ধর্মটির কোনও মৌল উপাদান থেকেই কি এই বৈশিষ্ট্যটি উৎসারিত হচ্ছে, নাকি, মুসলমান অধ্যুষিত সমাজ তথা রাষ্ট্রগুলোর  কোনও বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিই এ বৈশিষ্ট্যের নির্মাতা?
     
    কেউ কেউ এ প্রশ্নের উত্তর খুব দ্রুত দিয়ে ফেলতে ভালবাসেন। তাঁরা বলেন, এ বৈশিষ্ট্য অবশ্যই ‘ইসলাম’ নামক ধর্মটিরই মৌল উপাদান থেকে নিঃসৃত, কারণ, ইসলামীয় ধর্মশাস্ত্রে হিংসার অনুমোদন আছে। এ যুক্তিটি যে ভুল, সে আলোচনা ওপরে করেছি। কিন্তু কথা হচ্ছে, এ প্রশ্নের উত্তর তবে কীভাবে খোঁজা যায়? আজকের দিনে বিজ্ঞানে, বিশেষত সমাজবিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে, এ ধরনের প্রশ্নের সমাধানের জন্য যা করা হয় তাকে বলে ‘কন্ট্রোল্‌ড্‌ এক্সপেরিমেন্ট’। সমাজের ওপর তো আর পরীক্ষা চলবে না, অতএব সেখানে দরকার ‘কন্ট্রোল্‌ড্‌ অবজার্ভেশন’ বা সুনিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণ। অর্থাৎ, পুরোপুরি একই রকম করে তৈরি (বা সংগ্রহ) করে রাখা দুটি ক্ষেত্রের মধ্যে একটিতে একটি সুনির্দিষ্ট নির্ধারক উপাদান যোগ করে (বা একটি সুনির্দিষ্ট নির্ধারক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে), এবং অপরটিতে তা না করে, শুধুমাত্র প্রথম ক্ষেত্রটিতে কোনও এক নির্দিষ্ট প্রত্যাশিত ফলাফল এলো কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা, যাতে ওই নির্দিষ্ট উপাদানটির (বা প্রক্রিয়াটির) সঙ্গে ওই ফলাফলটির কার্যকারণ সম্পর্ক সন্দেহাতীতভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়। কোনও ওষুধের কার্যকারিতা প্রমাণের জন্য যেমন একই ধরনের দু দল রুগির মধ্যে একদলকে সে ওষুধ দিয়ে এবং অন্যদলকে তা না দিয়ে পরীক্ষা করা হয় যে দ্বিতীয় দলের তুলনায় প্রথম দলের কিছু বেশি উপকার হল কিনা, এও তেমনি। মনে করুন প্রশ্ন উঠল যে, মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামের যে মৌলবাদী উত্থান দেখা গেল, ইরাকের খনিজ তেল এবং আফগানিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থানগত সামরিক গুরুত্ব না থাকলেও কি তা ঘটতে পারত, শুধুমাত্র ইসলামীয় শাস্ত্র, সমাজ ও সংস্কৃতির একান্ত নিজস্ব আভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যের কারণেই? এ প্রশ্নের বিজ্ঞানসম্মত ও বস্তুনিষ্ঠ উত্তর বেরিয়ে আসতে পারে একমাত্র সেই ধরনের পদ্ধতিতেই, অর্থাৎ, ‘কন্ট্রোল্‌ড্‌ অবজার্ভেশন’ বা সুনিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। যেখানে ইসলামের প্রবল প্রভাব আছে অথচ কোনও বড়সড় অর্থনৈতিক বা সামরিক লাভালাভের পরিস্থিতি নেই, সে রকম সমস্ত জায়গাতেও কি মৌলবাদী জঙ্গিপনার উদ্ভব ঘটেছে? আবার, যেখানে ওই ধরনের পরিস্থিতি আছে অথচ ইসলাম নেই, সে রকম কোনও জায়গাতেই কি জঙ্গি আন্দোলনের উদ্ভব ঘটেনি? এই ধরনের অনুসন্ধান হয়ত আমাদেরকে এ ধরনের প্রশ্নের বস্তুনিষ্ঠ উত্তরের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ প্রসঙ্গে এ রকম গবেষণার কথা আমাদের জানা নেই।
     
    এই যে মুসলমান মৌলবাদের অস্তিত্বের কারণ হিসেবে ইসলামের আভ্যন্তরীণ কারণকে পুরোপুরিই দায়ী করা, ওপরের দুই অনুচ্ছেদে যার কথা বললাম, এর ঠিক উল্টো প্রবণতাটা হচ্ছে এর পেছনে ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ’ (বা আরও সাধারণভাবে ‘পশ্চিমী চক্রান্ত’) বা ওই জাতীয় ইসলাম-বহির্ভূত কোনও কিছুকে পুরোপুরি দায়ী করা (এবং সেইহেতু ইসলামীয় সমাজ ও সংস্কৃতির আভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যগুলোকে এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক বলে সাব্যস্ত করা)। মুসলিম মৌলবাদের উত্থানের পেছনে পাশ্চাত্য শক্তি, বিশেষত আমেরিকার ভুমিকা অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বের সাথেই আলোচনা করা উচিত। কিন্তু, বিশ শতকের পৃথিবীর ইতিহাসের সমস্ত ঘটনাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অঙ্গুলিহেলনে ঘটছে, চোখ বুজে এইটা বলে দিলে আপাতদৃষ্টিতে হয়ত তাকে নিন্দা করা হয়, কিন্তু আসলে শেষ বিচারে তার ক্ষমতাকে অনেকখানি বাড়িয়ে দেখা হয়। আমেরিকা (বা সাধারণভাবে ‘পশ্চিম’) মুসলমান দেশগুলোর আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল, শুধু এটুকু বললে প্রায় কিছুই বলা হয় না --- আসল প্রশ্ন হচ্ছে তারা তা পারল কী করে --- পৃথিবীর সব জায়গাতেই যে তারা যা চেয়েছে তাইই পেরেছে এমন তো আর নয়। মুসলমান সমাজ ও দেশগুলোর সুনির্দিষ্ট বিন্যাস ও ঐতিহাসিক পরিস্থিতি, বিকাশের সুনির্দিষ্ট অবস্থা, তাদের সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা, অন্তর্দ্বন্দ্ব, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সংশ্লিষ্ট সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তাদের তরফে নানা মতাদর্শ ও গোষ্ঠী-পরিচিতি নির্মাণের খেলা, এবং কখন ঠিক কোন তাড়নায় তারা কোন বৃহৎ শক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব বা শত্রুতার সম্পর্কে আবদ্ধ হচ্ছে, আর কোন বৃহৎ শক্তিই বা তাদেরকে সামলানো বা ব্যবহার করার জন্য ঠিক কী চাল চালছে --- এই সবের ভাল বিশ্লেষণ ছাড়া বিষয়টা ঠিকভাবে বোঝাই যাবে না। তাছাড়া, এই দেশগুলোতে 'সেক্যুলার' শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পরেও প্রায়শই শাসকরা স্বৈরাচারি এবং দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে কেন, এবং, কেনই বা মৌলবাদীরা বারবার তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জনগণের পাশে থাকার ভাণ করতে পারে, এটাও এ প্রসঙ্গে গভীরভাবে বোঝার বিষয়।  

    বলা বাহুল্য, এ সব প্রশ্নে যথার্থ ও যথেষ্ট বিশ্লেষণ এবং নিষ্পত্তিমূলক উত্তর এখনও আসেনি সমাজবিজ্ঞানীদের তরফ থেকে। যতদিন তা না আসে, ততদিন আমরা কী করতে পারি? ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে পারি, বিষয়টি সম্পর্কে ইতিমধ্যে যা জানা গেছে সে সব জানার চেষ্টা করতে পারি, যুক্তিসম্মত ও বস্তুনিষ্ঠ চিন্তার অভ্যাস করতে পারি …………… আর কিছু পারি কি?

    হ্যাঁ, পারি বোধহয়। মন থেকে অকারণ সন্দেহ ঘৃণা হিংসা বিদ্বেষ এইসব চিহ্নিত করে তা বর্জন করার অনুশীলনটা চালিয়ে যেতে পারি।

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৫ ডিসেম্বর ২০২২ | ৪৭৭১২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Debasis Bhattacharya | ১৮ এপ্রিল ২০২৩ ০৮:৪২518821
  • পাগল ছাগলদের সঙ্গে প্রথম দু চারটে কতাবাত্রা এন্টারটেইনিং হয়, তারপর খুব বোরিং লাগে। 
     
    কাজকম্মো ফেলে বকবক করে লাভ নেই। ভাল প্রশ্ন এলে কথা বলা যাবে। 
  • আধুনিকতার খোঁজে | 42.110.147.58 | ১৮ এপ্রিল ২০২৩ ১৫:১৯518829
  • @অনন্ত 
    প্রথমে ভাবছিলাম উপেক্ষা করবো। কিন্তু দুয়েকটা কথা আপনাকে (তুই করে বলা উচিত ছিল; যা কচি সাজার ন্যাকামি দেখছি!) বলা দরকার। 
     
    প্রথমত এই থ্রেডটিতে দীর্ঘ কয়েকমাস ধরে টানা বিতর্ক চলছে। অনেকে অংশ নিয়েছেন। তীব্র মতানৈক্য হয়েছে। বিশেষ করে দেবাশিসবাবুর সঙ্গে আমার বিতর্ক আড়াআড়ি চলেছে। নানারকম অফেন্সিভ মন্তব্যও হয়েছে। কিন্তু আপনার মতো এইরকম মোটাদাগের বিরক্তিকর  হামবড়া খোরাকগিরি কেউ করেনি। সময় পেলে পুরো থ্রেডটায় চোখ বুলিয়ে নিন। 
     
    দ্বিতীয়ত মাতৃভাষাটা আগে ঠিক করে শিখুন। 
     
    তৃতীয়ত বাঁদরের বিচি নিয়ে আপনার অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসর্ডার আছে। শিগগির ডাক্তার দেখিয়ে নিন। 
     
    পুনশ্চঃ উত্তেজনা আর সময়ে-অসময়ে দাঁড়ানো-ফারানোটা ইগনোর করে দিলাম। ভদ্র জায়গা তো! নাহলে আমি কালীঘাট পাড়ার ছেলে তো, পাঁক একবার তোলা শুরু করলে তুমি নিতে পারবে না খোকা। 
  • Debasis Bhattacharya | ১৮ এপ্রিল ২০২৩ ১৬:৪৭518832
  • আধুনিকতার খোঁজে,
     
    সাইর‍্যা দ্যান, বেচারা পোলাপাইন !!! 
  • দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ | 115.187.40.139 | ১৮ এপ্রিল ২০২৩ ১৬:৫৬518833
  • @দেবাশীষ ভট্টাচার্য , @আধুনিকতার খোঁজে, @অনন্ত সকলে আলোচনাটা চালিয়ে যান। হেরে গিয়ে পালানোটা কিন্তু যুক্তিবাদী , দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী কারোরই লক্ষণ নয় smiley
  • Debasis Bhattacharya | ১৮ এপ্রিল ২০২৩ ১৭:৪৪518835
  • পালাচ্ছি, এমন কোনও বার্তা দিয়ে ফেললাম নাকি?
  • দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ | 115.187.40.57 | ১৮ এপ্রিল ২০২৩ ২৩:২৫518842
  • হ্যাঁ 
  • Debasis Bhattacharya | ১৯ এপ্রিল ২০২৩ ০১:২৩518846
  • না বোধহয়। আমি শুধু বলবার চেষ্টা করছিলাম, অর্থপূর্ণ প্রশ্ন ছাড়া আলোচনা এগোতে পারেনা। 
  • khik | 139.99.209.67 | ১৯ এপ্রিল ২০২৩ ০২:৪৬518847
  • পচ্চিমবংগে চাকরি নেই, ফলে বিএসসি ফেল যুক্তিবাদী পোচ্চুর !
  • Debasis Bhattacharya | ১৯ এপ্রিল ২০২৩ ০৭:১৮518849
  • ধুর্মোয়ায়, কেলাস ফোরই টপকাতে পাল্লুম না, তো বিএসসি!
  • Debasis Bhattacharya | ১৯ এপ্রিল ২০২৩ ১২:৩৭518853
  • guru,
     
    আপনার প্রশ্নটা ভালো ছিল, কিন্তু আপনি তো সপ্তাহ খানিক এদিকে ফিরবেন না বললেন। ফিরে সাড়া দিন প্লিজ, আপনার প্রশ্নের উত্তর দেব। 
  • Debasis Bhattacharya | ১৯ এপ্রিল ২০২৩ ১২:৪২518854
  • রাধার কানাই,
     
    আপনার কথাতেই তো দ্বন্দ্ববাদ শুরু করলাম, কোথায় গেলেন? মার্ক্সবাদীদের মত বিশ্বাসী নাহলেও, বিষয়টাতে আমি খুব ইন্টারেস্টেড, সেই জন্যেই সময় নিয়ে সবিস্তারে উত্তর দিয়েছি। 
     
    মাও সে তুং-এর 'অন কনট্রাডিকশন'-এ আমি লেনিনের বক্তব্যের ভুল উপস্থাপনা লক্ষ করেছি, আর কারুর কি চোখে পড়েছে তেমন কিছু? 
  • রাধার কানাই | 42.110.165.6 | ২১ এপ্রিল ২০২৩ ০১:৫৩518873
  • @দেবাশিসদা
     
    ১) দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ নিয়ে আপনি যেভাবে বললেন, ডায়ালেক্টিক্স এ ঠিক সেভাবে বলে কি? মানে প্রথম দিকটা নয়। দ্বন্দ্ব মানলে যেভাবে সত্য মিথ্যার ভিত্তিটা ধ্বসে পড়ে বলে দেখালেন, সেটার  কথা বলছি। একটা শুয়োপোকা একটা নির্দিষ্ট সময়ন পর প্রজাপতি হয়। পুরো শুয়োপোকা থেকে পুরো প্রজাপতি হওয়ার মধ্যবর্তী সময়টা ওটি "কিছুটা শুয়োপোকা কিছুটা প্রজাপতি" - এরকম অবস্থানে থাকে, p আর নেগেশন অফ p এর সহাবস্থান বলতে ডায়ালেক্টিক্স এ এরকম কিছু বলতে চায় যতদূর জানি। তার মানে তো এই নয় যে "শুয়োপোকা = প্রজাপতি", বা যাহা শুয়োপোকা তাহা প্রজাপতি !!
     
    তাছাড়া ডায়ালেক্টিক্যাল লজিক যদি ফর্মাল লজিকের ফাঁকফোকরগুলো পূরণ করতে পারে, তাহলে ফর্মাল লজিকের তো ধ্বসে যাওয়ার কথা নয়, বরং টিকে থাকারই কথা। (যদি পদ্ধতিটি ঠিক হয়) আর যদি পদ্ধতিটি ভুল হয়, তাহলে তার অন্য ব্যাখ্যা দিতে হবে, এই ব্যাখ্যাটা ঠিক মন:পুত হল না। (সেটা আমার তরফ থেকেও ভুল হতে পারে) 
     
    ২) আমার একটা বিষয় জানার ছিল, কার্ল পপার থেকে শুরু করে বিজ্ঞান দর্শন চর্চার যে পরম্পরা  তৈরী হয়েছে, তার সাথে এঙ্গেলস এ ডায়ালেক্টিক্স ইন নেচার এ ডায়ালেক্টিক্স অনুসরণ করে প্রকৃতি বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলো ব্যাখ্যা করার কি কোন বিরোধ আছে? মানে, ব্যাপারটা এমন কি, যে একটা মানলে অন্যটা মানা যাবে না? নাকি দুটো পরম্পরা নিজের নিজের মত করে তৈরী হয়েছে?  নাকি উভয় একে অপরের পরিপূরক?? 
     
    ৩) আপনি শুরুতেই বলেছেন, রিচার্ড ডকিন্সরা যেভাবে ডায়ালেক্টিক্সকে সম্পূর্ণ বিজ্ঞানবিরোধী বলে সাব্যস্ত করেন, আপনি তার সাথেও একমত নন। এটা কেন? ডকিন্স বা ডকিন্সপন্থীদের সঙ্গে এব্যাপারে একমত না হওয়ার কারণটা সংক্ষেপে একটু বলতে পারবেন?  
  • রাধার কানাই | 42.110.165.6 | ২১ এপ্রিল ২০২৩ ০২:০৮518875
  • @আধুনিকতার খোঁজে 
    বাবু ও অন্যান্যরা 
    সকলের কাছেই প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। বারবার "অমুক সময়ে আসব" বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে কোনবারই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারছি না। এক আধবার হলে মানা যায়, কিন্তু বারবার এ জিনিস হলে নিজেরই দায়িত্বজ্ঞানহীনতা প্রমাণ হয় কাজেই আর আগাম কোন কথা দিচ্ছি না। সময়মত নিশ্চয়ই আলোচনায় অংশগ্রহণ করব
  • রাধার কানাই | 42.110.165.6 | ২১ এপ্রিল ২০২৩ ০২:১০518876
  • @খিক
    চাকরি না থাকার সঙ্গে বিএসসি ফেল করার সম্পর্কটা কিচ্ছু বুঝলাম না, একটু বুঝিয়ে দেবেন কাইন্ডলি? 
  • Debasis Bhattacharya | ২১ এপ্রিল ২০২৩ ০৮:২২518879
  • রাধার কানাই,
     
    প্রশ্নগুলো ভাল লেগেছে। অবশ্যই উত্তর দেব, একটু সময় দেবেন প্লিজ। 
  • Debasis Bhattacharya | ২৩ এপ্রিল ২০২৩ ০১:১৮518917
  • রাধার কানাই,

    (১) আপনার প্রশ্ন – দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ নিয়ে আপনি যেভাবে বললেন, ডায়ালেক্টিক্স এ ঠিক সেভাবে বলে কি? মানে প্রথম দিকটা নয়। দ্বন্দ্ব মানলে যেভাবে সত্য মিথ্যার ভিত্তিটা ধ্বসে পড়ে বলে দেখালেন, সেটার  কথা বলছি। একটা শুয়োপোকা একটা নির্দিষ্ট সময়ন পর প্রজাপতি হয়। পুরো শুয়োপোকা থেকে পুরো প্রজাপতি হওয়ার মধ্যবর্তী সময়টা ওটি "কিছুটা শুয়োপোকা কিছুটা প্রজাপতি" - এরকম অবস্থানে থাকে, p আর নেগেশন অফ p এর সহাবস্থান বলতে ডায়ালেক্টিক্স এ এরকম কিছু বলতে চায় যতদূর জানি। তার মানে তো এই নয় যে "শুয়োপোকা = প্রজাপতি", বা যাহা শুয়োপোকা তাহা প্রজাপতি !!
    তাছাড়া ডায়ালেক্টিক্যাল লজিক যদি ফর্মাল লজিকের ফাঁকফোকরগুলো পূরণ করতে পারে, তাহলে ফর্মাল লজিকের তো ধ্বসে যাওয়ার কথা নয়, বরং টিকে থাকারই কথা। (যদি পদ্ধতিটি ঠিক হয়) আর যদি পদ্ধতিটি ভুল হয়, তাহলে তার অন্য ব্যাখ্যা দিতে হবে, এই ব্যাখ্যাটা ঠিক মন:পুত হল না। (সেটা আমার তরফ থেকেও ভুল হতে পারে)

    আমার উত্তর - না, অবশ্যই ঠিক ওভাবে বলে না, কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রশ্নটা তো অনিবার্যভাবে ওখানেই যাবে শেষতক! দেখুন, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ নিয়ে যাঁরা প্রামাণ্য আলোচনা করেছেন, তাঁরা তো কেউই পাগল নন, বোকা নন, মূর্খও নন। বরং, এর মূল প্রবক্তারা সকলেই মস্ত মস্ত ব্যক্তি। ফলত, স্বাভাবিক যুক্তিকে তাঁরা খামোখাই অস্বীকার করবেন, এমনটা মোটেই হবার কথা না। কিন্তু, অ্যারিস্টোটলীয় যুক্তিশাস্ত্রের প্রথম যে নিয়মটি, অর্থাৎ ‘ল অফ আইডেন্টিটি’, তাকেই তাঁরা চ্যালেঞ্জ করতে চান, এবং যে নিয়মটি দিয়ে প্রতিস্থাপিত করতে চান সেইটা হচ্ছে দ্বন্দ্বতত্ত্বের প্রথম সূত্র --- ইউনিটি অ্যান্ড কনট্রাডিকশন অফ অপোজিটস --- “বিপরীতের দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়”। কেন করতে চান, তার কারণটা আপনি প্রজাপতি-শুঁয়োপোকার দৃষ্টান্ত দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন, আমি করেছি ছাগলের দৃষ্টান্ত দিয়ে। 
     
    মূল যুক্তিটা একটাই --- সাবেকী যুক্তিতে শুধু স্থিতিশীল ‘সত্তা’ গুরুত্ব পায়, ‘প্রসেস’ বা ‘প্রক্রিয়া’ তাতে ততটা ধরা পড়েনা। যে কোনও বস্তু, শুঁয়োপোকা হোক বা ছাগল, এবং গোটা জগৎটাই, প্রতি মুহূর্তে পালটে যাচ্ছে, ফলে সত্তার মূল বৈশিষ্ট্যগুলোই পালটে যাচ্ছে, ফলে ‘ক’ আর ‘ক’ থাকছে না, প্রতি মুহূর্তে নিজেকে ‘নেগেট’ করে অন্য কিছু হয়ে যাচ্ছে। এইভাবে, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ ‘ল অফ আইডেন্টিটি’ নিয়মের সীমাবদ্ধতা দেখাচ্ছে, এবং তার বিকল্পও হাজির করার চেষ্টা করছে, এবং সেখানেও থেমে না থেকে এর একটা দার্শনিক ব্যাখ্যাও হাজির করছে। ব্যাখ্যাটা হচ্ছে, বস্তু তথা জগত ক্রমাগত পাল্টায় কারণ তার সত্তার ভেতরে দুটো বিপরীত প্রবণতার টানাপোড়েন সব সময়েই চলতে থাকে। ব্যাখ্যাটি চমৎকার, সন্দেহ নেই। যৌক্তিক, অলৌকিকতা-বর্জিত, পুরোপুরি  বস্তুবাদী। সর্বোপরি, জগতের পরিবর্তনশীলতা ও জটিলতা বিষয়ে সচেতন। কিন্তু, এবার সমস্যার দিকটা ভাবুন।
     
    প্রথমত, সত্তার ভেতরে যদি দুই বিপরীত প্রবণতা থাকে, তো তাতে দুটো বিপরীত কথা যুগপৎ সত্যি হতে হবে, তার বিপদটা কিন্তু আমাদের জানা আছে। সেটা ঘটলে এ প্রসঙ্গে আমার প্রথম বড় মন্তব্যে দেখানো লজিকের অঙ্ক অনুযায়ী যাবতীয় সত্তা ও জ্ঞান ভেঙে পড়বার কথা। মার্ক্সবাদ যদি মিস্টিক দর্শন হত, তো এতে খুশি হতে পারত। কিন্তু তা তো আর নয়, মার্ক্সবাদ যুক্তিবাদ এবং এনলাইটেনমেন্টেরই সন্তান, কাজেই যৌক্তিক জ্ঞান ধ্বসে পড়ার সম্ভাবনায় তার উল্লসিত হবার কথা না। ধ্রুপদী যুক্তিশাস্ত্রের সমালোচনা করা যেতেই পারে, কিন্তু এই গেরোটা না পেরিয়ে তো আর কোনও উপায় নেই! দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের ভেতরে তার কোনও নিরাময় আছে কি? আমার জানা নেই, আপনার জানা থাকলে জানতে চাই।
     
    দ্বিতীয়ত, ধ্রুপদী যুক্তির প্রতি দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের এই সমালোচনাটি চরিত্রে পুরোপুরি গুণগত, কিন্তু আজকের দিনে ‘বিজ্ঞান’ বলে গণ্য হতে গেলে তাকে নিছক গুণগত চরিত্র ছাপিয়ে উঠে পরিমাণগত হয়ে উঠতে হবে। অর্থাৎ কিনা, তার অন্তর্নিহিত ধ্যানধারণাগুলো গাণিতিকভাবে প্রকাশযোগ্য হয়ে উঠতে হবে। ধ্রুপদী অ্যারিস্টটলীয় যুক্তিকে গাণিতিকভাবে প্রকাশ করা গেছে বলেই আজ গাণিতিক যুক্তিবিদ্যার এতখানি বিকাশ হতে পেরেছে, এবং তথ্যপ্রযুক্তির অকল্পনীয় বিকাশে মূল হাতিয়ার হয়ে উঠতে পেরেছে। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদে সেটা ঘটল কোথায়? 
     
    ধ্রুপদী অ্যারিস্টটলীয় যুক্তির তিনটি মূল নিয়মকেই চমৎকার সুসংবদ্ধ গাণিতিক আকারে প্রকাশ করা যায়। 
     
    যেমন --- (১) A = A, (২) (A & ~A) = 0, (৩) (A or ~A) = 1 [‘~’ মানে নেতি বা অস্বীকৃতি]। 
     
    কিন্তু, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের নিয়মগুলোকে কেউ এভাবে গাণিতিক আকারে প্রকাশ করতে পেরেছেন বলে আমার জানা নেই। সেটা কেউ পারলে তো ভালই হত, আমরা এক উন্নততর যুক্তি ও গণিত পেতাম, এবং তার ওপর ভর করে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিও মস্ত লাফ দিতে পারত। আমি সোভিয়েত কল্পবিজ্ঞানে এ রকম কল্পনা পেয়েছি, কিন্তু বাস্তবে কোথাওই পাইনি।
     
    এই যে বললেন, “ডায়ালেক্টিক্যাল লজিক যদি ফর্মাল লজিকের ফাঁকফোকরগুলো পূরণ করতে পারে, তাহলে ফর্মাল লজিকের তো ধ্বসে যাওয়ার কথা নয়, বরং টিকে থাকারই কথা” --- এইটা একদম ঠিক কথা, ঠিক এটাই তো বলতে চাইছিলাম। সংখ্যা আবিষ্কারের কথা ধরুন। পূর্ণসংখ্যা, ভগ্নাংশ, অমূলদ সংখ্যা, ‘ইমাজিনারি’ সংখ্যা, ‘ইনফাইনাইটসিমাল’ সংখ্যা। একেকটা আবিষ্কারে বাস্তবতাকে খানিকটা ধরা গেছে, খানিকটা বাকি রয়ে গেছে। পরের আবিষ্কারটি এসে সে ফাঁক পূরণ করছে, কিন্তু আগেরটাকে বাতিল করেনি মোটেই। 
     
    কিন্তু, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ আদৌ তেমন কিছু ঘটিয়েছে কি?
  • Debasis Bhattacharya | ২৩ এপ্রিল ২০২৩ ০১:৪৮518918
  • (২) আপনার প্রশ্ন – “আমার একটা বিষয় জানার ছিল, কার্ল পপার থেকে শুরু করে বিজ্ঞান দর্শন চর্চার যে পরম্পরা  তৈরী হয়েছে, তার সাথে এঙ্গেলস এ ডায়ালেক্টিক্স ইন নেচার এ ডায়ালেক্টিক্স অনুসরণ করে প্রকৃতি বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলো ব্যাখ্যা করার কি কোন বিরোধ আছে? মানে, ব্যাপারটা এমন কি, যে একটা মানলে অন্যটা মানা যাবে না? নাকি দুটো পরম্পরা নিজের নিজের মত করে তৈরী হয়েছে?  নাকি উভয় একে অপরের পরিপূরক?
     
    আমার উত্তর -  আমাদের অ্যাকাডেমিক বা বৈদ্যায়তনিক বিজ্ঞান-দর্শন কিন্তু পপার থেকে শুরু নয়, ফ্রান্সিস বেকন থেকে শুরু। বা, আরেকটু গভীরে গিয়ে ভাবলে, মধ্যযুগে রজার বেকন প্রমুখ পণ্ডিতদের দিয়ে শুরু। যদিও স্বয়ং পপার ভাবতেন যে এর সাথে মার্ক্সবাদের অনিবার্য বিরোধ আছে, এবং মার্ক্সীয় দর্শন বিজ্ঞান-বিরোধী, যুক্তি-বিরোধী, গণতন্ত্র-বিরোধী, কিন্তু আমি তা ভাবিনা। আমার মতে, এগুলোর সঙ্গে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের অনিবার্য বিরোধ নেই, কিন্তু মৌলিক পার্থক্য আছে ।
     
    এগুলো হচ্ছে এক ধরনের ‘ফিলোজফি অফ মেথডোলজি’ বা পদ্ধতিদর্শন, আর দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ হচ্ছে এক ধরনের ‘ফিলোজফি অফ নেচার’ বা প্রকৃতিদর্শন। অর্থাৎ, এগুলোতে বলা হচ্ছে প্রকৃতিকে কীভাবে ঠিকঠাক জানা যাবে (বা, কোন পদ্ধতিতে জানলে তাকে ‘বৈজ্ঞানিক’ বলা যাবে), জানবার পরে প্রকৃতির চেহারাটা কি দাঁড়াবে সে নিয়ে তার মাথাব্যথা কম। প্রকৃতি সম্পর্কে যা জানা গেল সেটা তো খোদ বিজ্ঞানের আওতায়, আমি শুধু কথা বলব জানার পদ্ধতি নিয়ে --- এই হল বৈদ্যায়তনিক বিজ্ঞান-দর্শনের মনোভাব বা অবস্থান। 
     
    আর, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ সেখানে সরাসরিভাবে বস্তু বা জগতের নিজস্ব সত্তা সম্পর্কেই কিছু একটা বলবার চেষ্টা চলছে। কাজেই, আধুনিক বৈদ্যায়তনিক বিজ্ঞান-দর্শন যদি হয় ‘এপিস্টেমোলজি’ বা জ্ঞানতত্ত্ব, তবে মার্ক্সবাদ হচ্ছে ‘মেটাফিজিক্স’। এখানে কিন্তু ‘মেটাফিজিক্স’ কথাটাকে বিশুদ্ধ অ্যাকাডেমিক অর্থেই নেবেন, নিন্দার্থে নেবেন না।
  • Debasis Bhattacharya | ২৩ এপ্রিল ২০২৩ ০২:০৫518920
  • (৩) আপনার প্রশ্ন – “আপনি শুরুতেই বলেছেন, রিচার্ড ডকিন্সরা যেভাবে ডায়ালেক্টিক্সকে সম্পূর্ণ বিজ্ঞানবিরোধী বলে সাব্যস্ত করেন, আপনি তার সাথেও একমত নন। এটা কেন? ডকিন্স বা ডকিন্সপন্থীদের সঙ্গে এব্যাপারে একমত না হওয়ার কারণটা সংক্ষেপে একটু বলতে পারবেন?

    আমার উত্তর -  এই ব্যাপারটা অল্প কথায় বোঝানো খুব শক্ত, উভয়পক্ষের তর্কগুলো খুঁটিয়ে না পড়লে সেটা বোঝা যাবেনা। ডকিন্সের বিভিন্ন লেখা (মূলত ‘দ্য সেলফিশ জিন’) সম্পর্কে মার্ক্সবাদী বিজ্ঞানীরা যে সমালোচনা করেছেন, এবং ডকিন্স তার যে প্রত্যুত্তর দিয়েছেন, সেই ধারাটা অনুসরণ করলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে। আমি আপনাকে অনুরোধ করব দুটি বই পড়বার জন্য। রিচার্ড লিউওন্টিনের ‘দ্য ডকট্রিন অফ ডিএনএ’ এবং যৌথভাবে লিউওন্টিন, রোজ ও কামিন লিখিত ‘নট ইন আওয়ার জিনস’। স্টিফেন জে গুল্ড-এর বইগুলোতেও ডকিন্সীয় অবস্থানের চমৎকার সমালোচনা পাওয়া যায়, কিন্তু সেগুলো ঠিক মার্ক্সীয় ধারায় সমালোচনা নয়।
  • guru | 160.238.93.64 | ২৩ এপ্রিল ২০২৩ ১৪:০৫518935
  • @দেবাশীষ বাবু 
     
                           ফিরে এসেছি এক সপ্তাহ পরে | 
     
    ১ |  এইবার আমি যে প্রশ্নটি করেছিলাম অর্থাৎ এই রাজ্যের সর্বস্তরের মানুষের কাছে যুক্তিবাদী আন্দোলনের না পৌঁছে কেবলমাত্র কলকাতার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের "ভদ্রলোক " মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা যার ফলে আমি মনে করি আসলে এরাজ্যে যুক্তিবাদী আন্দোলনের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত বিশেষ করে যেহেতু এই আন্দোলনের বর্তমান কর্ণধারদের যাদের জন্ম ধরুন সত্তর ও আশির দশকে হয়েছিল তাদের স্বাভাবিক মৃত্যুর পরে |
     
    ২ | এই বিষয়ে একটি হিস্টোরিক্যাল প্যাটার্ন কাজ করছে বলে আমি মনে করি | দেখুন নবজাগরণের পরে উন্নততর ব্রিটিশ সভ্যতার সম্পর্কে এসে বাংলার যে মননের নবজাগরণ হয়েছিল তার ফসল হচ্ছেন রামমোহন বিদ্যাসাগর ডিরোজিও ঠাকুর পরিবারের অনেকে | আজকে এরা অনেকেই বর্তমান বাঙালির তরুণ প্রজন্মের মধ্যেই বিস্মিতপ্রায় বা অধিকাংশক্ষেত্রেই হয়তো তাদের বর্তমান দিল্লীশ্বরদের শিক্ষাব্যবস্থাতে ইচ্ছে করেই অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া হয়েছে | রবীন্দ্রনাথ যেটুকু টিকে আছেন সেটুকু শুধু তার গানগুলোর জন্য | এছাড়া সেই আমলের দিকপাল মানুষদের মধ্যে একমাত্র উজ্জ্বল উপস্থিতি শুধু বিবেকানন্দ ও রামকৃষ্ণের যেহেতু এদের দুজনকেই বর্তমান দিল্লীশ্বরদের হিন্দুত্ব আইকন হিসেবে প্রয়োজন |
     
    আচ্ছা এই ক্ষেত্রেও কি আমার আগের যুক্তি খেটে যায় ? যেহেতু এইসব দিক্পালেরা বাঙালী সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে সেইভাবে পৌঁছতে পারেননি সেই কারণেই কি বর্তমানে তারা বিস্মিতপ্রায় ? এই বিষয়ে আমার এক তুতো ভাইয়ের কথা মনে পড়ে গেলো | ভাইটি JNU থেকে সমাজবিদ্যাতে ডক্টরেট করছে বর্তমানে | তার মোতে এদেশে দুটি জাতির মধ্যে বামপন্থী রাজনীতি জনপ্রিয় হতে পেরেছিলো , বাঙালী ও মালয়ালী | কিন্তু বাঙালিদের ক্ষেত্রে তৃণমূল স্তরে এই চেতনা পৌঁছয়নি মালয়ালীদের মতো  |
     
    আপনি কি বলেন ? এই বিষয়ে আপনার মতামত জানার ইচ্ছে রইলো |
  • Debasis Bhattacharya | ২৩ এপ্রিল ২০২৩ ১৫:০৯518939
  • guru,
     
    আপনি অনেক ভাল ভাল প্রশ্ন করেন, কিন্তু সেগুলোর বিষয়বৈচিত্র্য কিঞ্চিৎ বেশি হওয়ায় মাঝে মাঝে আমার পক্ষে পাল্লা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। অত সব বিষয়ে কথা বলার মত জ্ঞান-বুদ্ধি কি আর আছে ভাই! 
     
    যাই হোক, তবু যতটুকু জানি-বুঝি বলে মনে হয় তার জবাব দেবার চেষ্টা করব। এখন থ্রেডে থাকছেন তো? একটু সময় দেবেন প্লিজ। আমার ওই এক সমস্যা, নানা কারণে দ্রুত জবাব দিতে পারিনা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। 
  • Guru | 2409:4060:10c:efa4:25dd:19a4:ef54:5a50 | ২৪ এপ্রিল ২০২৩ ০৭:১৩518952
  • @দেবাশীষ বাবু                                                                             আপনি সময় নিয়ে জবাবদিন . কোনো তাড়াহুড়ো নেই আমার . আপাতত আমি গুরুতে আছি . 
  • কলা | 115.187.40.133 | ২৪ এপ্রিল ২০২৩ ১৫:০১518958
  • @গুরু 
    এইবার আমি যে প্রশ্নটি করেছিলাম অর্থাৎ এই রাজ্যের সর্বস্তরের মানুষের কাছে যুক্তিবাদী আন্দোলনের না পৌঁছে কেবলমাত্র কলকাতার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের "ভদ্রলোক " মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা যার ফলে আমি মনে করি আসলে এরাজ্যে যুক্তিবাদী আন্দোলনের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত বিশেষ করে যেহেতু এই আন্দোলনের বর্তমান কর্ণধারদের যাদের জন্ম ধরুন সত্তর ও আশির দশকে হয়েছিল তাদের স্বাভাবিক মৃত্যুর পরে |
     
    আপনি সম্ভবত ​​​​​​​যুক্তিবাদীদের ​​​​​​​মধ্যে ​​​​​​​আন্তর্বিবাহ সম্পর্ক স্থাপনের রীতি সম্পর্কে অবহিত নন। সেটা জানলে এই প্রশ্নটার উত্তর পেয়ে যেতেন। 
  • Debasis Bhattacharya | ২৫ এপ্রিল ২০২৩ ০০:৩৫518967
  • Guru,

    যতদূর বুঝলাম, আপনার আশঙ্কা, যুক্তিবাদী আন্দোলন যেহেতু শহুরে উচ্চবিত্তদের মধ্যে সীমাবদ্ধ, এবং নিচুতলায় যেহেতু তার অনুপ্রবেশ ঘটেনি, অতএব সাময়িক সাড়া জাগিয়ে এ আন্দোলন ইতিহাসের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে, যেমনটি গেছে অক্ষয় দত্ত-বিদ্যাসাগরদের যুক্তিবাদী শিক্ষা, যেমনটি গেছে ব্রাহ্ম ধর্ম, যেমনটি গেছে ডিরোজিয়ানদের আধুনিকতাবাদী বিদ্রোহ। ঠিক কবে নাগাদ সেটা ঘটতে পারে তারও একটি ইঙ্গিত আপনি দিয়ে রেখেছেন --- সত্তর ও আশির দশকে জন্মানো লোকজন আস্তে আস্তে মারা গেলে। এ থেকে বোঝা যায়, আপনি এ আন্দোলনকে একান্তভাবে চার-পাঁচ দশকব্যাপী এবং কলকাতা-কেন্দ্রিক একটি আলোড়ন বলে মনে করেছেন।
     
    এ আশঙ্কাকে আমার অমূলক বলেই মনে হয়। কেন মনে হয়, সেটা ব্যাখ্যা করবার আগে আপনার বক্তব্যের মধ্যে কোন কোন ধারণা/প্রত্যাশা প্রকাশ পাচ্ছে, সেটা একটু মনোযোগ সহকারে দেখে নেওয়া যাক। সেগুলো বোধহয় এই রকম।

    (১) যুক্তিবাদী আন্দোলন শহুরে (কলকাতা-কেন্দ্রিক)
    (২) যুক্তিবাদী আন্দোলন এলিট-দের মধ্যে সীমাবদ্ধ
    (৩) যুক্তিবাদী আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গের একটি স্থানিক-কালিক আলোড়ন মাত্র
    (৪) উনিশ শতকীয় রেনেসাঁর যুক্তিবাদ, ধর্মীয় উদারতাবাদ ও আধুনিকতাবাদের আন্দোলন বিলীন হয়ে গেছে

    এবং, এইসব ধারণা থেকে আপনি ওই উপরোক্ত সিদ্ধান্ত/প্রত্যাশায় পৌঁছতে চান --- যুক্তিবাদী আন্দোলন আর দু-এক দশক বাদে বিলীন হয়ে যাবে। কে বলতে পারে --- হয়ত সত্যিই যাবে, আমরা তো কেউই ভবিষ্যৎ দেখতে পাই না! কাজেই, শুধু যদি বলতেন, এ এক আপনার অতি বিশেষ কোনও উপলব্ধি, তো সে নিয়ে তর্ক করা যেত না। শুধু বা হয়ত বলা যেত, না মশায়, আমার তো কই ও রকম কনও উপলব্ধি হয়না!  কিন্তু এখানে আপনি কোনও মরমীয়া উপলব্ধির দাবি করছেন না, এখানে আপনার সিদ্ধান্ত/প্রত্যাশার পেছনে একটা নির্দিষ্ট যুক্তি দিচ্ছেন। তাই সে নিয়ে কিছু কথা বলা যায়, পাল্টা যুক্তি দেওয়া যায়। এই যে আপনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছচ্ছেন, তার পেছনে আবার অন্য আরেকটা ধারণা-নির্ভর যুক্তি আছে। সেটা এই রকম যে, যে আন্দোলন/চিন্তা/সংস্কৃতি নিচুতলায় ছড়াতে পারেনা, তা বিলীন হয়ে যেতে বাধ্য।

    আমার মতে, উপরোক্ত প্রত্যেকটি ধারণাই, পুরোপুরি ভুল না হলেও খণ্ডসত্য --- তথ্য ও যুক্তি দুই স্তরেই।

    (১) যুক্তিবাদী আন্দোলনের প্রভাব অবশ্যই শহরে বেশি (অন্তত তৃতীয় বিশ্বে), যেহেতু এই আন্দোলনে জ্ঞানচর্চার একটা বড় ভূমিকা আছে, এবং সে চর্চার সুযোগ শহরে বেশি। কিন্তু, শিক্ষা, যোগাযোগ-ব্যবস্থা এবং নাগরিক সুযোগ-সুবিধার প্রসারের ফলে মফস্বল এবং গ্রামেও যুক্তিবাদী চিন্তার প্রসার ঘটেছে, প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম হলেও। শুনলে হয়ত খুশিই হবেন যে, আমাদের যুক্তিবাদী সমিতিতে এখন সংখ্যার হিসেবে অন্তত কলকাতার চেয়ে জেলার লোকজন অনেক বেশি।

    (২) না, যুক্তিবাদী আন্দোলন এলিটদের আন্দোলন নয় (আবার সাব-অল্টার্ন আন্দোলনও নয়), অন্তত পশ্চিমবঙ্গে। সফল পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী/উদ্যোগপতি --- এঁরা এ আন্দোলনে এখনও পর্যন্ত খুব বেশি নেই। আবার, একেবারে দরিদ্র কৃষক-শ্রমজীবী ধরনের মানুষও খুব বেশি নেই। আমার যা বাস্তব অভিজ্ঞতা, তাতে মধ্যবিত্তদের নিম্নাংশেরও এক স্বাধীনচেতা ও আদর্শবাদী ভগ্নাংশ, যাঁদের মধ্যে শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার আগ্রহ অনেক বেশি, মূলত তাঁরাই এ আন্দোলনে আসেন।

    (৩) না, যুক্তিবাদী আন্দোলন নিছক পশ্চিমবঙ্গ-ভিত্তিক ফেনোমেনন নয়, এ এক জাতীয় তথা আন্তর্জাতিক ফেনোমেনন। একটু খোঁজ করলেই দেখতে পাবেন, বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, সারা ভারতেই, এবং আসলে সারা পৃথিবী জুড়েই, যুক্তিবাদী সংগঠন গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ ব্যাপারটা মোটেই স্থানিক নয়, বরং এক ‘গ্লোবাল ফেনোমেনন’। তবে, প্রতিটি গ্লোবাল ফেনোমেনন স্থানকালের ওপর নির্ভর করে একেকটি বিশেষ রূপ লাভ করে, পশ্চিমবঙ্গেও করেছে। পশ্চিমবঙ্গে ষাট-সত্তর দশকের উত্তাল বাম আন্দোলনের নানা ধারা এর ওপরে অনপনেয় প্রভাব ফেলেছে, এর আকার ও ইতিহাসকে এক অতি বিশেষ রূপ দিয়েছে। সেই বিশেষ রূপটি স্থানিক, গোটা ফেনোমেনন-টি নয়।

    (৪)  না, উনিশ শতকীয় রেনেসাঁর যুক্তিবাদ, ধর্মীয় উদারতাবাদ ও আধুনিকতাবাদের আন্দোলন মোটেই বিলীন হয়ে যায়নি, যদিও তার রূপ আমূল বদলেছে, এবং তা নানা ঐতিহাসিক চ্যালেঞ্জেরও সম্মুখীন হয়েছে। একটু ভেবে দেখবেন, অষ্টাদশ শতকের ভারত এবং বিশ শতকের ভারতের তফাতটুকু। এ দুটোর মাঝে হাইফেনের মত ঝুলে আছে উনিশ শতক, যেখানে ঘটেছিল ওইসব অত্যাশ্চর্য ঘটনাগুলো। ওগুলো না ঘটলে আমরা কোথায় থাকতাম, কীভাবে থাকতাম?

    এবং সর্বশেষে বলি, কোনও আন্দোলন/চিন্তা/সাংস্কৃতিক উপাদান ‘এলিট’ স্তরে উদ্ভুত হলেই তার প্রভাব বিলীন হয়ে যায়, এ ধারণাটিও একপেশে। বস্তুত,  লিপি গণিত বিজ্ঞান প্রযুক্তি শিল্প সাহিত্য তত্ত্বচিন্তা যুক্তিবাদ মানবাধিকার গণতন্ত্র --- সবই এক সময়ে ভীষণভাবে এলিটদের কুক্ষিগত ছিল। এগুলোর মধ্যে যদি সারবস্তু কিছু থাকে, তবে তা সমাজ ও ইতিহাসকে ব্যাপক ও গভীরভাবে প্রভাবিত করবেই, আজ অথবা কাল।
  • &/ | 151.141.85.8 | ২৬ এপ্রিল ২০২৩ ২৩:২৭519032
  • ফেরৎ এসেছি। দেবাশিসবাবু আপনার সবিস্তার উত্তরটি চমৎকার লাগল। বিশেষ করে দু' নম্বর পয়েন্টটি। "মধ্যবিত্তদের নিম্নাংশেরও এক স্বাধীনচেতা ও আদর্শবাদী ভগ্নাংশ, যাঁদের মধ্যে শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার আগ্রহ অনেক বেশি", এই ব্যাপারটা আর একটু বলুন। এঁরা কারা? শিক্ষক? অধ্যাপক? গবেষক? চাকুরিজীবী? এঁদের সংগঠিত হওয়া প্রয়োজন, সময়েরই দাবী সম্ভবত এটা।
  • &/ | 151.141.85.8 | ২৬ এপ্রিল ২০২৩ ২৩:৩০519033
  • ডকিন্সের মতবাদের সমালোচনাগুলো আমিও শুনতে আগ্রহী। গোটা কয়েক পয়েন্ট যদি দিতেন, খুবই ভালো লাগত।
  • Debasis Bhattacharya | ২৭ এপ্রিল ২০২৩ ০৮:৪৯519044
  • মূলত স্কুল শিক্ষক, কেরানি, ছোট ব্যবসায়ী, এবং এদের পরিবারের ছাত্র --- এই ধরনের লোককেই দেখি, যদিও অন্য লোকেরাও আছে অল্পস্বল্প। পড়াশোনার সুযোগ আছে, অথচ খুব বেশি ক্ষমতা ভোগ করেন না, এমন সব লোকজন। অবশ্য, পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের ছোট একাংশের সমর্থন আমরা পেয়ে থাকি, সরাসরি অংশগ্রহণ না থাকলেও।
     
  • Debasis Bhattacharya | ২৭ এপ্রিল ২০২৩ ০৮:৫১519045
  • ডকিন্স ও অন্যন্যদের মতামতের সমালোচনার বর্ণনা দিতে সময় লাগবে, একটু সময় মঞ্জুর করবেন প্লিজ!
  • &/ | 107.77.232.60 | ২৭ এপ্রিল ২০২৩ ১০:০৩519048
  • হ্যাঁ হ্যাঁ আপনি সময় নিন ।আসলে ডকিন্সের লেখা পড়ে আমার  কিছু একটা খটকা লাগে কিন্তু ধরতে পারি না কেন খটকা লাগছে। তাই ভালোভাবে জানতে চাই যাঁরা চর্চা করছেন তাঁদের কাছ  থেকে 
  • Debasis Bhattacharya | ২৭ এপ্রিল ২০২৩ ১২:২৫519054
  • আসলে, জিনতত্ত্ব ও ডারউইন-তত্ত্ব মিশিয়ে বিবর্তন-তত্ত্বের যে 'সিন্থেটিক ডারউইনিজম' নামক প্রামাণ্য ও মূলস্রোত ভাষ্য এখন চালু, তার মধ্যে কতকগুলো লুকোনো স্বতঃসিদ্ধ (বা নিঃশব্দে ধরে নেওয়া কথা) আছে, যা কিনা ডকিন্স-বিরোধীদের মতে প্রশ্নযোগ্য। আমি বিভিন্ন পক্ষের মতামত ও তর্ক-বিতর্ক পড়ে যতটুকু বুঝেছি, ডকিন্স ও অনুরূপ মতাবলম্বীদের তত্ত্বগত সমস্যা মূলত দুটো। প্রথমত, জীবের বৈশিষ্ট্য ও তার পরিবেশ এই দুটোকে একেবারে পরিষ্কার ও বিচ্ছিন্ন দুটি পৃথক সত্তায় ভেঙে ফেলা। এবং দ্বিতীয়ত, জীবের দৈহিক বৈশিষ্ট্যের মতই তার মানসিক/সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকেও জিন-নিয়ন্ত্রিত বলে ধরে নেওয়া।  
  • guru | 146.196.44.235 | ২৭ এপ্রিল ২০২৩ ১৩:১০519055
  • @দেবাশীষ বাবু 
     
                         অনেক ধন্যবাদ সময় নিয়ে বিস্তারিত ভাবে আপনার কথা গুছিয়ে বলার জন্য | এইজন্যই আপনার সঙ্গে এই ফোরামে আলোচনা করতে এতো ভালো লাগে |
     
    ১ | ব্যাপারটা কি জানেন তো আমি তো আগেই বলেছি দাদা আপনি একজন প্রবল আদর্শবাদী এবং আশাবাদী | আমার সমস্যাটি হলো যে আমি প্রবল বাস্তববাদী এবং তথ্য নিয়ে কাজ করতেই ভালোবাসি | আমি সত্যি খুশি জেনে গ্রামবাংলার জেলার মানুষের মধ্যে যুক্তিবাদী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে কিন্তু আপনার লেখার চুলচেরা বিশ্লেষণ করলে এটাও বোঝা যায় সমাজের এক খুবই স্বল্প সংখ্যক মানুষের মধ্যে আপনাদের আন্দোলন সীমাবদ্ধ | কাজেই ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তার কারণ রয়েই যাচ্ছে |
     
    ২ | আচ্ছা এখানে যুগধর্ম (zeitgeist - বানানটি এবারো ঠিকঠাক লিখলাম কিনা একটু বলে দিন ) বলেও একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে | দেখুন আপনি নিজেই বলেছেন যে যখন বামপন্থীরা এরাজ্যে ক্ষমতাতে ছিল তখন সেই অর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে যুক্তিবাদী আন্দোলনের উদ্ভব  অনেকটাই একটা সেইসময়ের বাই প্রোডাক্ট হিসেবে কাজ করেছিল | বর্তমানে কিন্তু এই ফ্যাক্টরটি অনুপস্থিত বরঞ্চ হিন্দুত্বের প্রভাবের ফলে মানুষের মনে এখন বিজ্ঞানসচেতনা ব্যাপারটিই বেশ বিপদের সম্মুখীন | হোয়াটস্যাপ ইউনিভার্সিটির প্রভাবে মানুষ এখন সত্য মিথ্যার পার্থক্য ভুলতে বসেছে বলা যেতে পারে | বর্তমানের দিল্লীশ্বর হয়তো এটাই চায় কাজেই আমরা দেখি সিলেবাস থেকে ডারউইন ও মুঘলরা একসঙ্গে বাদ পড়েছে | কাজেই এই যখন যুগধর্ম তখন যুক্তিবাদের কি ভবিষ্যৎ ?
     
    ৩ | ডেমোগ্রাফিক একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় | দেখুন উনিশ শতকের নবজাগরণ মূলতঃ উন্নততর ব্রিটিশ সমাজের যাদের মধ্যে অলরেডি শিল্পবিপ্লব হয়ে গেছিলো তাদের সঙ্গে বাঙালী উচ্চবিত্তের মেলামেশার ফল | বর্তমানে শাসকশ্রেণী কিন্তু সভ্যতার আলোকে আলোকিত ব্রিটিশ শ্রেণী নয় বরঞ্চ রাজস্থান বা গুজরাটের ব্যবসায়িক শ্রেণী যারা এখনো নিজেদের গ্রামে সতীদাহ প্রথা বন্ধ করেছে কিনা বলা মুশকিল ! আমি নিজে এই গতবছরই টালা পার্ক অঞ্চলে স্থানীয় হিন্দুস্থানীদের সতীমাতার (সতীদাহের) পট সাজিয়ে পুজো করতে দেখেছি | কাজেই এইধরণের ডেমোগ্রাফিকের সঙ্গে মেলামেশার ফলে আদৌ বাঙালী সমাজের মননে উনিশ শতকের মত কোনো উন্নতি হবেনা এটা বলাই যায় | আমি নিজে এইবছর  গেলো ফেব্রুয়ারী মাসে বড়বাজারে কোন খাটু শ্যাম নামক মাড়োয়ারি দেবতার পুজোর জন্য স্ক্রিন খাটিয়ে উৎসব করতে দেখেছি | সেন্ট্রাল মেট্রোর সামনে রানা প্রতাপের যে বিশাল মূর্তিটি বর্তমানে আমরা দেখছি সেটি কি বাঙালীর এক অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যৎকেই উল্লেখ করেনা ?
     
    আপনি কি বলেন ?
     
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক প্রতিক্রিয়া দিন