এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • খেলার মাঠে লোকে খিস্তি করে কেন 

    সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৪ নভেম্বর ২০২২ | ৩৯৯ বার পঠিত
  • ফুটবল খেলায় দেখবেন, মাঠের দর্শকরা বাধ্যতামূলকভাবে খিস্তি দেয়। সে দুনিয়ার সবাই কোনো-না-কোনো সময়ে দেয়, কিন্তু মাঠের খিস্তি ট্রাম-বাস-টেম্পো-কলেজ-ইশকুল-পিকনিক সবার থেকে মোটামুটি একশগুণ চড়া। "অমুকের মায়ের অমুক জায়গায় বলটা ঢুকিয়ে দে" -- রাগারাগি ছাড়াই, এসব মাঠের স্বাভাবিক লব্জ। জিজ্ঞাসা করলে বলবে, "মাঠে খিস্তি দেব না তো কোথায় দেব।" 

    আরেকটা জিনিস দেখবেন, সমর্থকরা পারলেই মারপিট করে। মাঠে এবং বাইরে। খেলার সময় তারা জার্সি পরে দলবদ্ধ ভাবে ঘোরে। মদ-টদ খায়। সুযোগ পেলেই অন্য জার্সিধারীদের পিটিয়ে দেয়। এটা অবশ্য ইউরোপেই বেশি হয়। এখন পুলিশি নজরদারিতে বোধহয় কমে গেছে। খবর পাইনা। খেলার খবর রাখিনা বলেও হতে পারে। 

    তা, এইগুলো কিন্তু আজকের গপ্পো না। এসব ইউরোপের পুরোনো প্রথা। ইউরোপ বলতে রোমান এবং বাইজেন্টাইন আমলের। গ্রিক না। ইউরোপে প্রথম খেলা-গুন্ডামি, যেটা আমি পড়েছি, সেটা ষষ্ঠ শতাব্দীর। মানে বাংলার পশ্চিমদিকে আর্যভট্ট যখন অঙ্ক-টঙ্ক কষছেন, তাঁতিরা যখন মসলিন বানিয়ে রোমে অবধি পাঠাচ্ছে, তখন রোম সাম্রাজ্যে খেলা নিয়ে দাঙ্গা হত। সেই সময় তো ফুটবল ছিলনা, হত দুই বা একাধিক দলের রথের দৌড়। এখনকার ফুটবল-টুটবলের মতোই দলগুলোর জার্সি হত, নীল, সবুজ এইসব। বিশালাকার স্টেডিয়ামে নিজের দলের জার্সি পরে দর্শকরা হট্টগোল এবং দরকারে মারপিট করত। সেবার নীল আর সবুজ দলের খেলা ছিল। ফলাফল মনঃপূত না হওয়ায় দাঙ্গা লাগে। প্রচুর লোক মারা যায়। কনস্ট্যান্টিনোপল, আজকের ইস্তাম্বুলের অর্ধেক নাকি ধ্বংস হয়ে যায়। 

    এর পিছনে নাকি রাজনীতি-টিতি ছিল। কিন্তু শুরু হয়েছিল খেলার স্টেডিয়াম থেকে। এই বিরাট স্টেডিয়াম, থিকথিকে লোক, মারকাটারি ভিড় এবং মারমুখী মেজাজ, এই পুরোটাই মানবসভ্যতায় রোমের অবদান। অ্যাম্ফিথিয়েটার তো সব্বাই জানেন। ওই মান্ধাতার আমলের রোমের অ্যাম্ফিথিয়েটারে হাজার পঞ্চাশেক লোক বসতে পারত। হিপোড্রোমে আরও বেশি লোক বসতে পারত। সাম্রাজ্যের সব শহরেই অ্যাম্ফিথিয়েটার ছিল। বিখ্যাত স্পার্টাকাসই ছিলেন কাপুয়ার গ্ল্যাডিয়েটর, রোমের নয়। ব্যক্তিগত খুনখারাপি ছাড়াও, কনস্ট্যান্টিনোপলের মতো দলবদ্ধ খেলাও হত। জার্সি-টার্সি পরে। খেলোয়াড়দের ছিল সত্যিকারের আগ্রাসন এবং জিঘাংসা, অর্থাৎ কিনা অ্যাগ্রেশন এবং কিলার ইনস্টিংকট, নইলে জিতে বেরোনো মুশকিল ছিল। এখনকার খেলায় এসব শব্দ এমনি এমনি উচ্চারিত হয়না। দর্শকদের মার-মার ভাবেও মিল ছিল। জাস্ট ভাবুন, দুটো দল জার্সি পরে একে অপরকে মেরে ফেলতে কিংবা জখম করতে উদ্যত, আর এক লাখি স্টেডিয়াম একসঙ্গে চিৎকার করছে, 'মার মার, মেরে ফেল।' সে উন্মাদনা এখন আর পাওয়া যায়না। এখন শুধু দুধের সাধ মেটাফরে মেটানো।

    খেলায় তারকা প্রথাও ছিল, বলাবাহুল্য। জীবিত খেলোয়াড়রা পরমবীর চক্রপ্রাপ্তের মতো সম্মান পেতেন। টাকা-পয়সারও ইয়ত্তা ছিলনা। সত্যিকারের তরোয়াল নিয়ে যারা বিপক্ষকে মারতে নেমে পড়বে, কুচ করে গলা কেটে দেবে, বুকে বর্শা বসিয়ে দেবে, কিংবা রথ চালিয়ে বিপক্ষকে পিষে দেবে, সেরকম হিরোও আজ আর দেখা যায়না।

    রোম আরও অনেক ব্যাপারেই পথিকৃত। এটা তো ঠিক খেলার উন্মাদনা নয়, যুদ্ধের উন্মাদনা। সেটাকে রাজনীতির কাজে ব্যবহার করা। অনেকেই করেছেন। সবচেয়ে বিখ্যাত মনে হয় রাজা কমোডাস। তিনি হিরো হতে নিজেই গ্ল্যাডিয়েটর হয়ে যুদ্ধে নেমে গিয়েছিলেন। দুনম্বরী করে জিতেছিলেনও, (বিপক্ষকে নকল অস্ত্র দেওয়া হত) শোনা যায়। কিন্তু 'চুর' হলেও হিরো হয়ে গিয়েছিলেন, আইসিসির কাছে নালিশ করার মতো কেউ টিকে ছিলনা। এটা একটু বাড়াবাড়ি, কিন্তু সংকট বিক্ষোভ হলেই 'খেলা' আয়োজন করা হত। সবাই করতেন। রোমকে সদাযুদ্ধরত জাতিতে পরিণত করতে এই 'খেলা' সবসময়েই খুব কাজে লেগেছে। 

    প্রসঙ্গত, খেলা ছাড়া আরেকটা জিনিসও রোমান নৃপতিরা করতেন। সার্কাস। সে ঠিক আজকের সার্কাস নয়, কিন্তু আমোদের ফান্ডাটা একই ছিল। সংকটে পড়লেই রোমান নৃপতি বা শহরের শাসকরা একটা 'খেলা' আর একটা 'সার্কাস' নামিয়ে দিতেন। দুটোই উন্মাদনা দিত। হিরো-টিরো ছিল। নেহাৎই মুভি ক্যামেরা ছিলনা। কিন্তু সংগঠিত জিঘাংসা, সংগঠিত আমোদ এবং তারকাব্যবস্থা, সবই রোমান সাম্রাজ্যের অবদান।    

    সব খেলাই এরকম ছিলনা। গ্রিসের অলিম্পিক যেমন আলাদা। "জেতাহারা বড় কথা না, অংশগ্রহণই আসল" -- এইটার খুব সম্ভবত একটা গ্রিক ঐতিহ্য আছে। বিশ্বের বহু জনগোষ্ঠীতেই খেলার মানেটা তাইই। রোমের ফান্ডাটা অন্যরকম। সেটাই আপাতত জিতছে। এই পুরো ব্যাপারটাই এখন খুবই সিস্টেমেটিক। "হাঙ্গার গেমস"এর মতো। "অংশগ্রহণই আসল" এখন ইয়ার্কির বিষয়। খেলায় "জিঘাংসা" হল ইন থিং। তারকা ব্যবস্থা এবং বীরপুজো তৈরি করা হয় খুব হিসেব-নিকেশ করে। রোমান পদ্ধতি অনুসৃত হয় মসৃণভাবে। এতই মসৃণ, যে, আমরা ভোক্তারা এর অংশ হয়েও টের পাইনা, কোন ব্যবস্থার কারিগর হয়ে টিকে আছি। রোমানরাও পেতেননা।

    নৈতিক নিন্দে করা হচ্ছেনা। সব্বাই খেলা দেখে। আম্মো নয়-নয় করে এক আধটা দেখে ফেলি। কিন্তু ব্যবস্থাটা নিয়ে সচেতন থাকাও দরকার। আর যদি কেউ না পড়ে থাকেন, তো "হাঙ্গার গেমস" টা অবশ্যই পড়ে ফেলবেন। প্রথম পর্বটা। ওইসব হ্যারি পটার-টটারের চেয়ে ঢের ভালো।

    পুঃ এই তথ্যগুলো মোটের উপরে ঠিকই আছে। আশা করি। কিন্তু স্মৃতি থেকে লেখা। চেক করে নেবেন। নামধাম বলা আছে, সবই নেটে পাবেন। 
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে প্রতিক্রিয়া দিন