এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  লঘুগুরু  কড়চা

  • আলোয়ারের বুড়ি ও বিবেকানন্দ

    শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী লেখকের গ্রাহক হোন
    লঘুগুরু | কড়চা | ২২ আগস্ট ২০২২ | ৮৭১ বার পঠিত
  •  
    আলোয়ারের সেই বুড়িমা'কে ভুলতে পারেন নি বিবেকানন্দ। 

    সে অনেকদিন আগেকার কথা – ঠাকুরের দেহরক্ষার পর যখন তরুণ পরিব্রাজকরূপে তিনি ছুটে চলেছেন সারা দেশে, তখনই কোনও একটা সময়ে এসে ক'দিন আলোয়ারেও ছিলেন। সেই সময়ে দু'বেলা পেট চলে ভিক্ষার অন্নে। যেদিন কিছুই জোটে না ভিক্ষায়, সেদিন সন্ন্যাসীর জঠরাগ্নির জ্বালা কমায় এলাকার আরেক ভিখারিনি – বুড়িমা। পথের ধারে তাঁর জরাজীর্ণ কুঁড়ে ঘর; দিনশেষে ক্লান্ত, অবসন্ন, ক্ষুধার্ত সেই তরুণ এসে বসলে বুড়ি আস্তে আস্তে কিছুটা বজরার আটা বার করে – ভিক্ষারই ধন সে সব। তারপর সে আটা মেখে, হাতের চাপে চ্যাপ্টা করে, আগুনে পুড়িয়ে খানকতক রুটি বানিয়ে সন্ন্যাসীর দিকে এগিয়ে দেয়, "এ নে, খা রে লালা।" ও, বলা হয়নি, সন্ন্যাসীকে বুড়ি ডাকে "মেরে লালা" বলে; আর সন্ন্যাসী তাঁকে ডাকে "মাঈ"। বজরার রুটির সঙ্গে কাঁচালঙ্কা কামড়ে কামড়ে খেয়ে তৃপ্তির হাসি হাসে 'লালা', বুড়ির আদ্ধেক খাওয়া তাতেই হয়ে যায়।

    তারপর অনেকদিন পেরিয়ে গেছে; বুড়ি জানেও না যে দেশ পেরিয়ে, মহাদেশ পেরিয়ে, সমুদ্র পেরিয়ে 'লালা' আজ স্বামী বিবেকানন্দ হয়ে আবার ফিরে এসেছেন আলোয়ারে। না, এখন তিনি ভিক্ষাজীবী নন, রাজার অতিথি। সকাল থেকে সন্ধে রাজসভায় হাজার হাজার লোক আসে যায়, স্বামীজীকে দেখে, কথা বলতে চায়, আশীর্বাদ পেতে চায়। দু'পা এদিক ওদিক গেলে সবসময় সঙ্গে থাকে রাজার দেওয়া দুই পাহারাদার – মন হাঁপিয়ে ওঠে এসবে বিবেকানন্দের। মনে পড়ে এখানে এর আগেকার আসা – আধপেটা কিন্তু স্বাধীন পায়ে ঘুরে বেড়ানো। নিমেষে মনে পড়ে যায় 'মাঈ'র কথা। সেই কুঁড়েঘরে বসে গরম গরম বজরার রুটি, বুড়ির মুখের সেই হাসি ... আহা! কেমন আছে সে, কে জানে! আদৌ আছে তো? একবার দেখে এলে হয়। প্রহরীর চোখের আড়ালে, সন্ধের মুখে একাই বেরিয়ে পড়েন বিবেকানন্দ।

    জায়গাটা খুঁজে পেতে অসুবিধে হয় না, এই ক'বছরে আলোয়ার বদলায় নি তেমন একটা। ওই তো বুড়ির কুঁড়েঘর, যেন আরও কিছুটা জীর্ণ। দরজায় একটা নোংরা কাঁথা ঝুলছে। বাইরে থেকেই স্বামীজী হাঁক দিলেন, "মাঈ! ও মাঈ!"
    ভিতর থেকে কর্কশ স্বর আসে বুড়ির, "ওহ! বুড়ো মানুষ, দুটো কাজ সারছি, তাতে শান্তি নেই! কে চেল্লাস এই সন্ধে করে?"
    "আরে বাইরে এসেই দেখো না, কে!"
    হেঁয়ালি সইতে পারে না বুড়ি, ঝাঁঝিয়ে ওঠে, "ওহ, কে আমার রাজপুত্তুর এল রে, বেরিয়ে তাকে দেখতে হবে! কে রে বেটা তুই?"
    "আরে, তোর লালা ... মনে নেই মাঈ? তোর লালা এসেছে।"

    হাড়-জিরজিরে বুড়িমা উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে আসে, "কই ... সত্যিই তুই লালা? তুই ... ফিরে এসেছিস? কই, কাছে আয় দেখি... দেখতে পাই না তো চোখে ভালো..."
    কাঁপা হাতে স্বামীজীর গাল ছুঁয়ে, অনেক কষ্টে নিজের চিবুক উঁচু করে তাকায় বুড়ি, "সত্যিই তো, আমার লালা! কোথায় গেছিলি? কোথায় চলে গেছিলি বাপ, মাঈকে ছেড়ে?"
    "সে সব অনেক গল্প রে মাঈ, হবে 'খন। দুটো খেতে দে তো আগে, বড্ড খিদে পেয়েছে!"
    "ওই দ্যাখো! তখনও লালার পেটে আগুন জ্বলতো, আর এখনও! বলি এ ক'বছর কিছু খাস নি, নাকি? আমার কাছে কী আছে, যে তোকে খেতে দেবো এই অবেলায়?"
    "কেন, তোর সেই বজরার রুটি দিবি না? লঙ্কা দিয়ে?"

    কয়েকমুঠো বজরার আটা মেখে, গনগনে আঁচে পোড়ানো রুটি এগিয়ে দেয় মাঈ, তাঁর লালাকে। ছেলের মুখে সেই তৃপ্তির হাসি দেখে ফোকলা মা'ও হেসে ফেলে। নিজের ছেলেই তো তাঁর! বুড়ির পেটের ছেলে জোয়ান বয়সে চলে গিয়েছিল; সেই থেকে এক লালা ছাড়া আর কাউকেই তেমন আপন ভেবে বাঁচেনি বুড়ি। লালাও পালিয়েছিল বছর কয়েক আগে; এবার ফিরে এসেছে যে, আর সহজে যেতে দেবো না – এই ভেবে চোখ মোছে বুড়িমা। 

    "আহা, কী স্বাদ রে মাঈ! কোথায় লাগে এসবের পাশে রাজবাড়ির মণ্ডা মেঠাই!"

    "আরে ও লালা, শুনেছিস –", কী যেন মনে করে সোজা হয়ে বসে বুড়ি, "শুনেছিস, এখানের রাজবাড়িতে নাকি মস্ত এক সাধু এসেছে! সঙ্গে কত লোকজন, সাহেব মেম, ভক্ত! সে নাকি বিরাট নামডাক করেছে; এ পথ দিয়ে কত লোক রোজ যাচ্ছে তাকে দেখতে, জানিস? তুই যাবি নাকি দেখা করতে, হ্যাঁ?" লালা উত্তর দেওয়ার আগেই বুড়ি আবার বলে, "না না, থাক! তোর গিয়ে কাজ নেই! পেটই ভরলো না তোর ভালো করে, আর কয়েকটা রুটি দিই? তোর ওদিকে গিয়ে কাজ নেই!"

    "কেন রে মাঈ? গিয়ে কাজ নেই কেন?"

    "ও বাবা, না, ও সাধু বড়লোক, বিরাট লেখাপড়া করা! কী বলতে শেষে কী বলে দেবে, আমার লালার মনে কষ্ট হবে শুধুশুধু..."

    মুখে সাঙ্ঘাতিক এক দুষ্টুমির হাসি নিয়ে তাঁর লালা ঝুঁকে পড়ে, বুড়ির কাছে এসে বলে, "এ মাঈ! একটা মজা করবি? চল, তুই-আমি দুজনেই গিয়ে ওই স্বামীজীকে দেখে আসি! চল চল, যাবি?"

    "ধুর ক্ষ্যাপা! রাজবাড়িতে আমাকে ঢুকতে দেবে, না তোকে? ধ্যাতানি খেয়ে ফিরে আসতে হবে! কোত্থাও যেতে হবে না তোকে, আমার কাছে বোস তো!"

    "মাঈ, শোন...", যেন কিছুটা গাম্ভীর্যের ছলেই বিবেকানন্দ বলেন, "বলছি, সেই সাধু যদি আমিই হই? তবে?..."

    একপল নীরব থেকে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে ফোকলা বুড়িমা। "কথা শোনো আমার পাগলা বেটা'র! তুই? তুই হবি সেই সাধু? বড় হয়েও মজা করার স্বভাব গেল না তোর, বল? ওরে তুই তো আমার লালা! আমিও গরিব, তুইও গরিব! ও'সব বড় বড় সাধুর বেশি বেশি কথায় কাজ নেই আমাদের!"

    আশপাশটা বড় একটা বদলায় নি মাঝের কিছু বছরে। সন্ধেবেলায় চাঁদ উঠেছে, সেই চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে আলোয়ার, তার জনবসতি, পথঘাট। আর সেই পথের ধারের কুঁড়েঘরে বসে এক মাঈ আর তাঁর লালা আগুন-পোড়া বজরার রুটি খেতে খেতে হাসিতে, খুনসুটিতে, আহ্লাদে, আদরে উড়িয়ে দিচ্ছে জীবনের একটা সন্ধে, সেই রাজঅতিথি সন্ন্যাসীর থেকে বহু, বহু দূরে। 

    (তথ্যঋণ : 'বন্ধু বিবেকানন্দ' – শঙ্করী প্রসাদ বসু)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • লঘুগুরু | ২২ আগস্ট ২০২২ | ৮৭১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে মতামত দিন