এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • গর্গর গ্রেপ্তার

    সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ১২ আগস্ট ২০২২ | ৯১৬ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • দু বছরের পুরোনো মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে গর্গ চট্টোপাধ্যায়কে। খবরের কাগজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গর্গ বছর দুয়েক আগে অহোম সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা সুকাফাকে বহিরাগত চৈনিক আখ্যা দিয়েছিল। তাতে কারো কারো ভাবাবেগে আঘাত লাগে। আসামে মামলা হয়। এই 'অপরাধ'এ আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। গ্রেপ্তরের নির্দেশ দেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল। যদিও, গর্গকে সে সময় গ্রেপ্তার করা হয়নি। সেজন্য পশ্চিমবঙ্গের পুলিশের দিকে আঙুল ওঠে। এর পর আদালত নতুন পরোয়ানা জারি করে গর্গকে গ্রেপ্তার করার জন্য কলকাতা পুলিশের কমিশনারকে নির্দেশ দেয়। সেই নির্দেশের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার গর্গকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কলকাতার আদালত শর্তসাপেক্ষে জামিন দিয়ে গুয়াহাটির আদালতে হাজিরার নির্দেশ দেয়। আসামে গেলে গর্গকে গ্রেপ্তার তো করা হবেই, মামলাও চলবে,  জামিন পাওয়া যাবে কিনা সেটা অনিশ্চিত। কারণ গর্গর বিরুদ্ধে একটা নয়, নানা থানায় মোট ছটি মামলা করা হয়েছে। আইপিসির যা যা ধারা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেল, তা হলঃ 120B, 153, 153A, 153B, 294, 500, 506, 511। এছাড়াও রয়েছে আইটি আইনের 66 এবং 67। সংক্ষেপে অপরাধগুলি হলঃ  জনতার ভাবাবেগে আঘাত, ঘৃণা ছড়ানো, ফৌজদারি ষড়যন্ত্র, অশ্লীলতা, মানহানি, ভীতিপ্রদর্শন, ইত্যাদি।

    এই যে বিপুল অপরাধের তালিকা, যা একদিকে ভাবাবেগ থেকে অন্যদিকে অশ্লীলতা পর্যন্ত, একদিকে ষড়যন্ত্র থেকে অন্যদিকে ভীতিপ্রদর্শন অবধি বিস্তৃত, তা কীসের জন্য? না, সুকাফাকে বহিরাগত বলার জন্য, যে কথাটা সম্ভবত মিথ্যেও না, কারণ, উইকি খুলে দেখছি, সে ভদ্রলোক চিনের উনান অঞ্চল থেকে এসেছিলেন। তথ্যসূত্র থাকলেও,অবশ্য উইকি সর্বজ্ঞ না, আমিও অহোম সাম্রাজ্য নিয়ে কিসুই জানিনা, ফলে এই নিয়ে বিতর্কও থাকতে পারে, এমনকি বিতর্ক না থাকলেও, কেউ কেউ চক্ষু বন্ধ করে উল্টো কথা মনেও করতেই পারেন, সম্পূর্ণ ব্যক্তিস্বাধীনতা আছে। যেমন আর্যদেরও কেউ কেউ ভারতে গজানো উদ্ভিদ মনে করতে পারেন। কিন্তু উল্টো কথা শুনলেই, ষড়যন্ত্র, অশ্লীলতা, ভাবাবেগে আঘাত বলে গ্রেপ্তার? এ কি মাতুলালয়? অবস্থা যা, রবীন্দ্রনাথ এখন "দ্রাবিড়, চীন, শক-হুন-দল, পাঠান, মোগল, এক দেহে হল লীন" লিখলেও নির্ঘাত ভাবাবেগে আঘাত লেগেছে, বলে গারদে পোরা হত। আর্যদের বহিরাগত বললে তো নির্ঘাত ফাঁসি, কারণ, এখন মহাভারত মানে টিভি সিরিয়াল, আর ইতিহাস মানে হোয়াটস্যাপ ফরোয়ার্ড। বিতর্ক ফিতর্কের জায়গাই নেই। 

    আসলে বেসুরে কথা বললেই শাসকরা জুতিয়ে লাল করে দেবে, এ হল ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার। মুজতবার দেশে-বিদেশেতে আছে, ব্রিটিশকে দুটো গালমন্দ করায় লেখক আঁতকে উঠছেন, ওরে বাবা সিডিশন। সে আমলে একেই বলা হত আইনের শাসন। এই আইনগুলি, বস্তুত আস্ত ভারতীয় দন্ডবিধিই তো আসলে তো ব্রিটিশ আমলের। একটু নেড়েচেড়ে দেশীয় শাসকদের সুবিধেমতো করে নেওয়া হয়েছে মাত্র। সিডিশন আইনটাই যেমন। স্বাধীন ভারতে বাকিটা সবটা হুবহু এক রেখে এক আধটা শব্দ শুধু দুমদাম বদলে দেওয়া হয়, যেমন 'হার ম্যাজেস্টি' বদলে হয়েছিল 'ভারত সরকার', 'দ্বীপান্তর'কে পালটে করা হয় 'কারাবাস'। অর্থাৎ, ব্যাপার একই, শুধু রানিমাকে কুচ্ছিত বললে ব্রিটিশ আমলে দ্বীপান্তর হত, আর এখন জেলে পোরা হয় 'ভারতমাতার ডানা নাই' বললে। দন্ডবিধিতে এই 'ভাবাবেগে আঘাত' ব্যাপারটার টিকিয়ে রাখারও লম্বা গল্প আছে, তার জন্য এমনকি সংবিধান সংশোধনও করতে হয়েছিল। অত কচকচানির দরকার এখানে নেই, সংবিধানের প্রথম সংশোধনী দিয়ে খুঁজলেই পেয়ে যাবেন। এখানে মোদ্দা কথা হল, ভারতরাষ্ট্রের এই আইনগুলি পাবলিকের স্বার্থরক্ষার জন্য বর্তমান তা নয়, বরং ব্রিটিশ উপনিবেশের ঐতিহ্য অনুযায়ী, এরা আছে জনতাকে বাঁশ দেবার জন্য, আরও ভাল করে বলতে গেলে যেকোনো ভাবে বেসুরো কণ্ঠস্বরকে 'ফাঁসানো'র জন্য। গর্গ, যে, বেসুরো কণ্ঠস্বর, এ নিয়ে তো বিশেষ কারো সন্দেহ থাকার কথা নয়। অতএব তার বিরুদ্ধে এসব তো ব্যবহার করা হবেই।

    কিন্তু তার পরেও, কথা হল, ব্যক্তি গর্গ এখানে বিষয়ই নয়। অনেকে গর্গর রাজনীতি অপছন্দ করেন, পুরোটা বা খানিকটা। অনেকেই পছন্দও করেন। করতেই পারেন। কিন্তু যেটাতে সকলেরই একমত হবার কথা, সেটা হল, গর্গই ভারতের একমাত্র বেসুরো কণ্ঠস্বর নয়। বাদবাকিদেরও একই কায়দায় জেলে পোরা হয়েছে, হচ্ছে, এবং হবে। আমরা উমর খালিদকে চিনিনা, কিন্তু গর্গর সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক-ঝগড়া-আড্ডা এসব মেরেছি। গর্গর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেখিয়ে দিচ্ছে, বিপদটা কাছে এসে গেছে। রাজনৈতিকভাবে আপনি গর্গকে কী মনে করেন, সেটা কোনো বিষয়ই নয় আর, বিষয়টা বাক-স্বাধীনতা। আমিও তো ঠিক গর্গর রাজনীতির সমর্থনে লিখছি তা তো নয়। গর্গর ক্ষেত্রে চুপচাপ থাকলে, কে জানে, পরশুদিন আমার ঘাড়েই পড়বে কিনা, ভয়ের কথা এইটাই। 
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সিএস | 2401:4900:3eee:d485:6454:a809:9bc0:a4f3 | ১২ আগস্ট ২০২২ ১৬:২২510941
  • এই কেসে তো গর্গবাবু তখনই ক্ষমা চেয়েছিল, কিন্তু কেসটা বন্ধ হয়নি বোঝাই যাচ্ছে।

    ঝাড়খণ্ডের বিধায়কদের কাছ থেকে টাকা পাওয়ার তদন্তে রাজ্য সিআইডি ক'দিন আগে গৌহাটি গিয়ে এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে নোটিস দিয়ে এসেছিল। এক জয়গায় পড়লাম তাঁর আবার আসাম সরকারের ওপর দিকে যোগ আছে।

    কে জানে, কী যোগ ! বোড়ে খাওয়া চলছে হয়ত।
     
     
  • ar | 173.48.167.228 | ১২ আগস্ট ২০২২ ২০:৩৪510947
  • আসাম সরকারের ওয়েবসাইট থেকে টুকলাম। উইকির লিঙ্কটাও থাক। কেন কেস দেওয়া হবে জানিনা। ক্ষমার চাইবারও দরকার নেই, কিন্তু উনি ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছেন। ভাবাবেগে আঘাত লাগা না বেসুরো কন্ঠস্বর দাবিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা???
    https://en.wikipedia.org/wiki/Sukaphaa
    https://assam.gov.in/about-us/394

    The name ‘Aham’ or ‘Asom’ was probably given by the Ahoms who came to Assam in 1228 A.D. Even though the origin is ambiguous but it is believed that the modern name Assam is itself an anglicization.

    The Ahom’s entered Assam fully assimilated and ruled Assam for nearly six hundred years. The period of Ahom rule is a glorious chapter in the history of Assam. The Ahom dynasty was established by Sukaphaa, a Shan prince of Mong Mao who came to Assam after crossing the Patkai Mountains. It is between 13th and 19th century that several tribal communities also came into the historical forefront of Assam. Kacharis, Chutias and Koch were the prominent tribal groups that were found in the medieval times of Assam.
  • পলিটিশিয়ান | 2603:8001:b143:3000:56f0:104b:33ec:e26b | ১৪ আগস্ট ২০২২ ০৫:১৮510976
  • রোদ্দুর রায়ের কেসটাও প্রায় এরকমই।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল প্রতিক্রিয়া দিন