এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  স্মৃতিচারণ  নস্টালজিয়া

  • সিনেমা দেখার সিনেমা

    নির্মাল্য কুমার মুখোপাধ্যায়
    স্মৃতিচারণ | নস্টালজিয়া | ১৯ এপ্রিল ২০২২ | ২৫৯৪ বার পঠিত | রেটিং ৩ (৮ জন)



  • প্রথম পর্ব
    চোরাপথে পর্দা-খড়ি


    সত্তরের শেষ থেকে আশির দশকের মাঝামাঝি যে সব নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেদের যৌবন এসেছে এবং সেই যৌবন মফঃস্বলে কেটেছে, তাঁরা জানেন লেখাপড়া, বেকারত্ব এবং যৌবনকে একসঙ্গে পাশাপাশি টেনে নিয়ে চলা কী ভয়ংকর ব্যাপার। ক্লাস এইট থেকে ধূমপানে হাতেখড়ি, নাইন থেকে নিয়মিত সিনেমা দেখা এবং ফার্স্ট ইয়ার থেকে প্রেমিকা - এইগুলো না যোগাড় না করতে পারলে তখন আপনি ব্যাটাছেলেই নন।
    ক্লাস এইট-নাইনে হাতে আস্ত টাকা আসত না। বড়জোর টিফিনে পার ডে ১০ পয়সা। দশ পয়সায় ঝালমুড়ি, সেটা পাঁচ পয়সার নিলে আধপেটা হয় বটে, কিন্তু ১০ দিন এইভাবে চালাতে পারলে 'গান্ধি ক্লাসের' একটা টিকিট কেনা যায়।

    টাউনে সিনেমা হল দুটি-- 'প্রামানিক সিনেমা' এবং 'রানাঘাট টকিজ'। টকিজে উত্তম সুচিত্রার রাজত্ব। কিন্তু সেই সব ছবি দেখে সেই বয়েসে ঠিক গা গরম হয় না। বরং রবিবারে ম্যাটিনি শুরুর সময়, হলের গেটে দাঁড়ালে, ইঁট চাপা ঘাসের মত ফুটফুটে ফর্সা কিছু নামীদামী ফ্যামিলির মেয়েদের, মা কাকিমার সঙ্গে লেডিজ গেটে দেখা যেত, এই যা।

    তার চেয়ে বরং 'প্রামানিক সিনেমায়' - হান্টারওয়ালি - জওয়ানি কি আগ - কুমারী কি মোহাব্বত এই জাতীয় ছবি লাগছে ঘন ঘন। মাঝে মাঝে লাগছে—সঙ্গম, এ্যারাউণ্ড দ্য ওয়ার্ল্ড, ফুল আউর পথ্‌থর, শোলা আউর শবনম, একফুল দো মালি, মেরা গাঁও মেরা দেশ...।
    প্রত্যেক শো আরম্ভ হওয়ার আগে এপেটাইজার হিসেবে লাউড স্পিকারে গাঁক গাঁক করে বাজছে -- ডম ডম ডিগা ডিগা/ ও মেরে যহরা জবি/ হাম কালে হ্যায় তো ক্যা হুয়া দিলঅয়ালে/ বোল রাধা বোল সঙ্গম-- ইত্যাদি।

    সকাল সাড়ে দশটায়, স্কুল যাওয়ার পথে কেষ্টদা, (শহরের দুটো হলেরই ঘোষকের দায়িত্ব প্রাপ্ত) রিকশায় চারদিকে পোস্টার ঝুলিয়ে মাইকে হেঁকে গেছে---
    ‘আজ থেকে বেলা ২টো, ৫ টা ও ৮টায় প্রামানিক সিনেমার রুপালি পর্দায় দেখুন রোমাঞ্চ, রহস্য, প্রেম আর এ্যাক্সানে ভরপুর সাম্মি কাপুর শর্মিলা ঠাকুর প্রাণ অভিনীত সম্পূর্ণ বিদেশের মাটিতে তোলা -- এ্যান ইভনিং ইন প্যারিস।’
    রিক্সার পেছনে শর্মিলা ঠাকুর ওয়ান পিস বিকিনিতে টাঙান । হাতে একটা ওয়াটার স্কেটিঙের দড়ি, পায়ের নিচে ফেনা তোলা জলরাশি। গালে টোল। মাথায় কিন্তু সেই ঢাউস খোঁপাটি।
    এইসব সিনেমার পোস্টার লাগান দেখাও একটা প্রবল উত্তেজনার ব্যাপার। রেল ষ্টেশনের বাইরে বড় রাস্তার ধারে রিকশা স্ট্যান্ডের পেছনের দেওয়ালে, হল পিছু একটা করে বড় লোহার বিলবোর্ড। ফ্রেমের ধাপ বেয়ে এক দুজন পোস্টার বয় উঠে গেছে। হাতের ভাঁজ খুলে খুলে ছাপান পোস্টারের টুকরোগুলো স্যাটাস্যাট আঠা দিয়ে সেঁটে দিচ্ছে।
    প্রথম টুকরোয় শুধু হিরোইনের বুক থেকে নাভি। তারপর লাগল ডান দিকের টুকরো। সেখানে হিরোর বাইকের চাকা সমেত একটা পা। বাঁ দিকের নিচের টুকরোয় দেখা দিল ভিলেনের ফ্রেঞ্চ কাট চিবুক, কোট আর পিস্তলের বাঁট।
    আস্তে আস্তে টুকরোগুলো জুড়ে যাচ্ছে আর সম্ভাব্য দৃশ্যগুলো টুকরো থেকে একটা সমগ্র সিনেমার ট্রেলার হয়ে উঠছে। আমরা মোহাবিষ্ট হয়ে যাচ্ছি, ভুলেই যাচ্ছি যে শাঁখ বেজে যাওয়ার পর বাড়ি ঢুকলে স্কেলের বাড়ি খেতে হবে।
    রাস্তায় আমাদের,কচিপাকাদের ভিড়ে রিকশাওয়ালা বিরক্ত হচ্ছে। হোক। কাল শুক্রবার। আজ সন্ধের ভেতর শহর ছেয়ে যাবে পোস্টারে পোস্টারে। পকেটে অলরেডি ৪৫ পয়সা ষ্টক। কাল ইস্কুলে ৫ পয়সা সেভিন্স করলেই ৫০ হবে। পায় কে?
    কারও কারও খিদে বেশি। তারা নিজের টিফিন খেয়েও আমাদের দিকে হাত বাড়াত। ফলে তাদের স্বল্প সঞ্চয়ের অবস্থা করুণ।
    তাদের জন্য ছিল ‘শ্রী কৃষ্ণ আটা কল’।
    সপ্তাহে এক কিলো গম আসত পরিবার পিছু। ভাঙাতে লাগত ১৮ পয়সা। ভাঙানর পর দুশো গ্রাম আটা শ্রী কৃষ্ণ আটা কলের মালিককে বেচে দিলে আর ভাঙানর চার্জ লাগত না। হিসেবে তিন সপ্তাহ আটা ভাঙাতে পারলে বেচা বুচি সেরে আমাদের মাসে রোজগার ৫৪ পয়সা। মালিক সেটুকু আটা বেচতো ২০ পয়সা করে মাসে চারবার, মানে আশি পয়সা।
    যারা কৃচ্ছ সাধন টিফিনে করতে পারবে না তাদের জন্য এই চোরা পথই একমাত্র উন্মুক্ত।
    এই পথে একজন ফেঁসে গিয়েছিল একবার। তাদের বাড়িতে ধান মাপার পাল্লা ছিল। তার বাবার সন্দেহ হওয়ায় মেপে দেখেন যে দুশো গ্রাম আটা কম। তিনি প্রবল ক্রুদ্ধ হয়ে ব্যাগ সমেত শ্রীকৃষ্ণ আটা কলের দিকে রওনা হন।
    আমাদের বন্ধুটি পাঁচিল টপকে দৌড়ে শর্টকাট করে বাবার আগে আটা কলে পৌঁছে সব খুলে বলে। মালিক তার বাবাকে মাপের ভুল স্বীকার করে দুশো আটা ফেরত দেয় এবং পাশের গলিতে লুকিয়ে থেকে সব শুনে বাবা চলে যাওয়ার পর বন্ধুটি মালিককে ১৮ পয়সা ফেরত দেয়।
    ফুল আউর পাথ্‌থর সিনেমা সে মিস করে এবং কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে আমাদের কাছে পরে এসে গল্পের ধারা বিবরণী শুনে নেয়।
    পরের বার আটা বিক্রির সময় শ্রী কৃষ্ণ আটা কল প্রথমে তার আটা সরাতে অস্বীকার করে। তখন বন্ধুটি একটি মোক্ষম যুক্তি দিয়ে তাকে রাজি করায়।
    এক কিলো আটায় ২০০ গ্রাম ভুসি মেশালে কোন ক্ষতি নেই, কারণ ডামাডোলের বাজারে তখন রেশনের গম প্রায় অখাদ্যে পরিণত। এমনিতেই বাড়ির জন মজুরেরা সেই রুটি খাচ্ছে। ফ্যামিলি মেম্বাররা দুবেলা ভাত খাচ্ছে তখন।


    দ্বিতীয় পর্ব
    সিনেমাহলের আভিজাত্য


    আসলে 'রানাঘাট টকিজ' আর 'প্রামানিক সিনেমা' এই দুই হলের ভেতর রিয়েল মাদ্রিদ ভার্সেস বার্সেলোনার মত একটা ঠাণ্ডা লড়াই ছিল।
    লড়াইটা আভিজাত্যের। টকিজ অনেক পুরোন। সব সময় বাংলা সিনেমা বেশি আনত। তাতে হয়ত ভিড় প্রামানিকের চেয়ে কম হত। কিন্তু দর্শক ছিল মাপা। শিক্ষিত রুচিসম্পন্ন রানাঘাটিরা পছন্দ করতেন টকিজকে। এর আরেকটা অন্যতম প্রধান কারণ ছিল, হলের ভেতর নাচ গান এমনকি রোম্যান্টিক দৃশ্যেও কান ফাটান সিটি, যেটা প্রামানিক হলে, আলো নিভলেই শুরু হয়ে যেত, সেটা একদম হত না।
    সুচিত্রা উত্তমের বুকে, শেষ সিনে মাথা পেতে দিলে হয়ত কোন কোন অর্বাচীন প্রামানিকিয় অভ্যাস থেকে সিটি মেরে ফেলত। কিন্তু আশেপাশের জ্যাঠা কাকারা তাকে সঙ্গে সঙ্গে মারতেন ধমক। সে বেচারা কেমন যেন গুটিয়ে যেত।
    ‘রানাঘাট টকিজ’ ছিল রেল ষ্টেশনের কাছে, একমাত্র হল। অনেকে তাকে পাঁচু কুণ্ডুর [মালিক] হল বলে ডাকত। পরে 'প্রামানিক সিনেমা' তৈরি হল দেড় কিলোমিটার দূরে জাতীয় উচ্চ সড়কের ধারে। স্বাভাবিক ভাবেই টকিজের বহিরাগত দর্শকরা ছিল ট্রেন যাত্রী আর প্রামানিকের জন্য বাস যাত্রী। মূল শহরের দর্শকের চেয়ে বাইরের গঞ্জ এবং গাঁ থেকে বেশি মানুষ আসত দু-হলেই।
    পরবর্তী কালে আরও দুটি সিনেমা হল তৈরি হয় রানাঘাটে 'গীতাঞ্জলী' ও 'সুরেন্দ্র'। তাদের গল্প ক্রমশ বলব।
    প্রামানিক সিনেমা হলটি আমাদের যৌবনের বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে ওঠে। যে দিন শুনলাম যে এই নতুন হলটা তৈরি হবে সে আমাদের কী উত্তেজনা। জানা গেছে, সাইজে বড় হবে। সীট বেশি হবে এবং আমাদের বাড়ি যেদিকে সেখান থেকে এক দৌড়ে পৌঁছে যাওয়া যাবে।
    আস্তে আস্তে চোখের সামনে প্রামানিক সিনেমা হল মাথা তুলতে লাগল। টকিজের চেয়ে অনেকটা খোলা মেলা জায়গা পেল বলে তাকে যেন এক রূপকথার জাহাজের আদলে তৈরি করলেন প্রামানিক ভ্রাতৃদ্বয়। তারা ততদিনে রানাঘাটের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এবং টকিজের প্রতিষ্ঠাতা কুণ্ডু পরিবারের রীতিমত প্রতিদ্বন্দ্বী।
    আমরা স্কুল ফেরতা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁ করে ওই হাইওয়ের পাশে নয়নজুলি মিন্সিপালটির গাড়ি গাড়ি ময়লা ফেলে বোঁজান ঢিপির ওপর রোড রোলারের সমতল বানান, তারপর লরি লরি ইট বালি সিমেন্টের মিশেলে কর্কশ আওয়াজ তুলে ঢালাই, মোজেক, পাথর সেটিং সব দেখতাম। ছুটির দিন তো ছোটখাটো একটা মিছিল মত জমে যেত সাইটে।
    প্রথম দিন হলে ঢুকে একদম হাঁ। হল মানে হলের বারান্দায় আমরা। হালচাল বুঝতে এসেছি। টোটাল বিল্ডিং রাশি রাশি গাঁদা ফুলের মালা দিয়ে, আলো দিয়ে সাজান।
    মালিকের গোটা পরিবার হাজির। হাজির শহরের গণ্যমান্য বরেণ্য নাগরিকবৃন্দ।
    বারান্দার মেঝে, গোল চকচকে থাম, লবিতে গদিওয়ালা সোফা, দেওয়ালে কাঁচের বাক্সোর ভেতর ভেলভেট বোর্ডে টাঙান বারো বাই দশ সাইজের গ্লসি ফটোয় ধর্মেন্দ্রর বাইসেপ। আলো দেখা যাচ্ছে অথচ আলোর উৎস, বাল্ব বা টিউবলাইটগুলো দেখা যাচ্ছেনা। সব জায়গায় একটা নরম আলোর আঁধারির আভার খেলা ।
    ভাবছি, ইস, টকিজটা কি ম্যাড়মেড়ে।
    সে এক চরম উত্তেজক অবস্থায় আমরা সিঁড়ি বেয়ে সেদিন তিনতলার মেশিন ঘরে উঠে গেছি। সেখানে কামানের মত দুটো প্রজেক্টার। সামনে দুটো ঘলুঘুলি।
    আমরা জানি ঐ ঘুলঘুলি দিয়ে নীলচে আলোর কিছু ধোঁয়াটে ছটা গিয়ে রূপালী পরর্দায় পড়লেই দেখা যাবে ধর্মেন্দ্র একা সাতজনকে ধোলাচ্ছে।
    কী করে যে এসব সম্ভব, জানতে আমাদের ব্যাচের যারা সায়েন্স নিয়েছিল তাদের ইলেভেন অবধি ওয়েট করতে হয়েছিল। আর্টস আর কমার্সরা ওদের কাছে তারও পরে বসে কোন রকম ভাবে বুঝে নেয়।
    যাই হোক, হল ভিজিটের শেষ পর্বে আমরা গেলাম টিকিট ঘর দেখতে। ওটাই আসল। ওটাই সমস্যা এবং ওটাই চ্যালেঞ্জ। নিচের বারান্দায় লবির সামনে সবচেয়ে দামী টিকিট ঘর। পাশাপাশি তিনটে ঘুলঘুলি। ব্যলাকনি, রিয়ার স্টল আর ফার্স্ট ক্লাস । ইংরাজি এবং বাঙলায় টিকিটের দাম বড় করে লেখা। দেখেই আমরা ভিরমি খেয়ে ছিটকে গেলাম। আর একটা উত্তেজনার বিষয় হল, যেটা টকিজে তখনও নেই, সেটা প্রামানিক করেছে, তার নাম 'বক্স'।
    বক্সের টিকিট ব্যালকনিরও দ্বিগুন। আর বক্সের চারিদিকে কাঁধ সমান উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। কেন ঘেরা?
    জানা গেল বক্স কেবল ‘জোড়া’দের জন্য। কিন্তু ভেতরকার ডিজাইন ঠিক কেমন? কটা জোড়া বসবে ভেতরে? পাশাপাশি বসবে না দুজন দুজন করে আলাদা সীট? কেউ কিচ্ছু জানিনা আমরা, কেবল কল্পনায় জাল বুনছি।
    লবির উলটো দিকে আরেকটা কাউন্টার, একটু ফাঁকায়। তার মাথায় লেখা 'লেডীজ'। তখন দু হলেই দোতলায় পার্টিশন করে একপাশে লেডিজ আর একপাশে ব্যালকনি ছিল। সুবিধে এই যে কম দামের টিকিট কেটেও ব্যালকনির সমান স্বাচ্ছন্দ্য মেয়েরা উপভোগ করতে পারত।
    হলের মেন বিল্ডিঙের পাশ দিয়ে টানা পাঁচিল। দারোয়ান জানাল, পাঁচিলের শেষ মাথায় সর্বনিম্ন দামের টিকিট ঘরটি রাখা হয়েছে । মানে গান্ধি ক্লাসটা ওদিকে, শেষ মাথায়। সেদিকে গুটি গুটি এগোলাম এবং কাউন্টার দেখেই মনটা খারাপ হয়ে গেল।


    তৃতীয় পর্ব
    গান্ধি ক্লাস


    গান্ধি নামটার [পরিবার নয়] ভেতরেই একটা গরীব গরীব গন্ধ আছে। হাফ নেকেড ফকির। খালি অথবা খড়ম পড়া পা। হাঁটুর ওপর ধুতি। গা-ও খালি, বড় জোর একটা চাদর। হাতে লাঠি। চশমার পেছনে দুটো ঝকঝকে চোখ, হাসছে। এই রকম পোশাকে, এই রকম শীর্ণ জীর্ণ চেহারায় একটা লোক সব সময় কী করে হাসিখুসি থাকে এটা তখনো একটা রহস্য।
    পকেটে পয়সা কম বা না থাকলেই গান্ধির সঙ্গে একটা মিলমিশ ভাব আসে। মনে হয়, আরে এই তো আমাদের লোক পেয়ে গেছি একটা।
    যাঁদের পকেটে কম পয়সা অথচ সিনেমা দেখার বাই চেগেছে তাদের জন্য সেই সময় সব হলেই গান্ধি ক্লাস রাখাটা বাধ্যতামূলক ছিল। প্রামানিক সিনেমাকেও রাখতে হল।'রানাঘাট টকিজ' হলের পুরো চেহারাটাই তখন গান্ধি ক্লাসের মত। ক্লাসের অবস্থা আন্দাজ করে নিন। পুরোন ঝুরঝুরে হলের তুলনায় নতুন হলে গান্ধি ক্লাস একটু তো ভাল হবে এই আশায় শনিবার হাফডে স্কুল করে এক ছুটে চলে এলাম কাউন্টারে। আজ স্যারের বাড়ি টিউশন বাঙ্ক।
    উদ্বোধনের দিন কাউন্টার দেখে মন মেজাজ খিঁচরে গিয়েছিল। একদম শেষ মাথায় হলের পেছেন দিকে সেই কাউন্টার। সেখানে তখন মিন্সিপাল্টির ময়লার গন্ধ তখনও ম ম করছে। তার ভেতরেই একটা টেম্পরারি ইউরিনাল খাড়া করে দিয়েছে মালিকপক্ষ।
    মালিক জানে ভারতীয়দের জলবিয়োগ লাইনে দাঁড়িয়েও পাবে এবং টিকিট না কাটলে ভেতরের বাথরুম ব্যবহার করবার অধিকার জন্মাচ্ছে না। পুরো এলাকা ভাসিয়ে দেবে এরা।
    যাই হোক, এই কাউন্টারে একটা মাত্র ইগলু আকারের ঘুলঘুলি। আর একটু ওপরে একটা ছোট্ট খোপ। সেটা আবার জাল দিয়ে ঘেরা। ভেতরে যে বসে তার চশমা পড়া চোখ দুটো দেখা যাবে কেবল।
    ঘুলঘুলির ওপরে লেখা 'মূল্য ৬৫ পয়সা মাত্র' । ঠিক নিচে লেখা ' একজন দুটির বেশি টিকিট পাইবেন না' ।
    নিচের ইগলু-খোপে একটু ভাল স্বাস্থ্যের লোকের কেবল চারটে আঙ্গুল ঢুকবে, পুরো মুঠো যাবে না। খুব হাড় জিরজিরে হাত হলে মুঠোর হাফ যাবে।
    কিন্তু ঘুলঘুলি অবধি আমরা কজন জিরজিরে পৌঁছব কী করে?
    ছোটখাটো একটা কুরুক্ষেত্র চলছে তখন সেখানে। শহর এবং গঞ্জ থেকে ঝেঁটিয়ে নতুন হলে সিনেমা দেখতে মানুষ এসেছে। সব কিসিমের মানুষ। যারা মেয়েদের সঙ্গে করে আনবার সৌভাগ্য বহন করেছে তারা গান্ধি ক্লাসের কাউন্টারে নেই।
    তারা ব্যালকনি, লবি এইসব জায়গায় চাক বেঁধে আছে। কিছু গ্রামের মেয়ে, টাইট করে শাড়ি পড়ে এসেছে। দু একজন দুঃসাহসিনি তারই ভেতর প্রেমিকের/তুতো দাদার হাত থেকে সিগারেট টেনে নিয়ে দু একটান দিয়ে কেশে মরছে। গঞ্জের মেয়েদের সুবিধা হল , শহরে তাদের কেউ চট করে চিনবে না।
    তারা এসেছে এডভেঞ্চারে, বইটা [ মুভি তখনও বই] তাদের কাছে গৌণ।
    গান্ধি কাউন্টারের সামনে যারা তাদের চেহারা বেশির ভাগই 'বাবু' ক্লাসের না। অনেককে দেখলেই বোঝা যায়, রীতিমত সকালে মাঠে ধান টান কেটে তবে এসেছে। তাদের গায়ে অসুরের মত জোর। তাদের গায়ের মাংসপেশি লোহার মত শক্ত। তাদের এক এক ধাক্কায় জিরজিরে 'বাবু' ঘরের ছেলেরা ছিটকে ছিটকে যাচ্ছে।
    এদেশের কালচার অনুযায়ী লাইন যথারীতি সরল রেখায় নেই। পেছন দিকটা যাও বা আছে, ঘুলঘুলির কাছে গিয়ে থেবড়ে মেবড়ে মৌচাকের মত চারপাশের দেওয়ালে লেপটে গেছে। সেখানে মানুষ, কত রকম ভাবে ঘুলঘলির কাছে যাওয়া যাবে তার মরীয়া চেষ্টায় রত।
    পায়ের ফাঁক দিয়ে বেঁটেরা, পাঁচিলের গা ঘেঁষে লম্বারা হাত ঢুকিয়ে দিয়ে ঘুলঘুলি কিনারা ধরবার চেষ্টা করছে। কিনারায় একটা আঙ্গুল, তারপর দুটো, তারপর তিনটে এইভাবে ওই ঘুলঘুলিতে অন্তত তিন চারটে হাত একসঙ্গে প্রবেশ করতে চাইছে।
    যে দু আঙুল ঢোকাবার পর আরেক বাহুবলির ধাক্কায় ছিটকে গেল সে চরম চিৎকারে বাহুবলির বাপ মা তুলছে।
    দুটো করে টিকিট হাত পিছু। কিন্তু কোন কোন গ্রুপে এসেছে চার জন। ফলে দুজন লাইনে আর দুজন তাদের ছাড়া চটির ওপর বসে উদ্বিগ্ন ভাবে বিড়ি টানছে।
    গান্ধি কাউন্টারে পৌঁছতে হলে দর্শককে নগ্নপদ ফকির হতেই হবে।
    যে দু এক জন মুঠোর ভেতর করে অলিম্পিকের পদকের মত টিকিট নিয়ে হাত উঁচু করে বার হয়ে আসছে, তার দলের অপেক্ষমানেরা তাকে উষ্ণ সম্বর্ধনা দিচ্ছে।
    কেউ কেউ ছড়ে যাওয়া কুনুই বা হাঁটুর ওপর হাত বুলিয়ে পরীক্ষা করছে ক্ষতের গুরুত্ব।
    টিকিট পাওয়ার উত্তেজনায় তারা এতক্ষণ সব জ্বালা যন্ত্রণা ভুলে ছিল একদম। এইবার টিউকলে গিয়ে হাত পা ধুচ্ছে। জল দিচ্ছে ঘাড়ে মাথায়।
    খালি গায়ে মাঠে নেমেছিল কেউ কেউ , তারা ঘাম শুকিয়ে ছেড়ে রাখা জামা গায়ে গলিয়ে নিচ্ছে । এহেন সিচুয়েশনের ভেতর 'মার মার' 'মার শালা খা_কির ছেলেকে'-- 'ধর শালা বা_চোতকে, সর সর শুয়ো_র বাচ্ছারা সর' , শব্দ তুলে ডাকাত পড়বার মত করে কিছু ছেলে এসে পড়ল। তাদের হাতে নানা সাইজের বাটাম।
    তাদের কেউ কেউ আমাদের চেনা। তারা বাসের হেল্পার, গ্যারেজের মিস্ত্রি, ধাবার রাঁধুনি। কেউ কেউ স্কুল ছুট। আমাদের সঙ্গেও পড়েছেও কেউ কেউ।
    তারপর 'গরীবী হটাও' স্লোগানের আগেই হটে গেছে স্কুল থেকে।
    তারা 'ছোটলোক'। আমরা তাদের সঙ্গে বেশ ক-বছর ধরে কথা বলিনা।
    ওরা রে রে করে এসেই এলোপাথাড়ি বাটাম চালাতে লাগল। বলির সময় খাঁড়া চালানর মত ওদের হাত কাউনটার ঘেঁষে উঠতে নামতে লাগল।
    'বাপরে মারে মরে গেলাম রে ' আর্তনাদের সঙ্গে মুহূর্তে কাউন্টার ফাঁকা। হাত কাঁধ চেপে ধরে অনেকেই কাতরাচ্ছে।
    কেউ কেউ পালাতে গিয়ে ছিটকে পড়েছে মিন্সিপাল্টির ময়লার গাদায়। দু একজনের হাতে কপালে কালশিটে, রক্তও। কাউন্টার ফাঁকা।
    স্কুলছুটরা তখন পটাপট হাত দুটো পালা করে ইগলু-ফুটোয় ঢোকাচ্ছে আর বার করছে। আর পকেটে পুরে নিচ্ছে টিকিটগুলো। উপছে পড়ছে পকেট।একেই বোধয় বলে ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়া।
    ঝমঝম করে ফার্স্ট বেল পড়ে গেল। কাউন্টারের কর্মচারী ঠকাস করে কাঠের ঢাকনা ক্লোজ করে দিলেন। 'গান্ধিফুল' ।
    এবার ওরা নামল মাঠে।
    ‘১ কা ১, দো কা দো’ হাঁকে মুখরিত হল এলাকা। ব্ল্যাকাররা সব সময় হিন্দিতে কেন হাঁকতো কে জানে!!
    এক্সট্রা ৩৫ পয়সা আমাদের পক্ষে অসম্ভব তখন। আমরা একটু মন খারাপ ভোলার জন্য মুখ ঘুরিয়ে মেয়ে দেখতে ব্যস্ত হলাম।
    হঠাত একটা নিচু গলা --
    -- তোরা ক'জন আছিস?
    তাকাতেই দেখি 'ছোটলোকদের' একজন। বাবলু, লরির খালাসি, ধেনোখোর।
    আমতা আমতা করে বললাম,
    -- আমাদের কাছে এক্সট্রা পয়সা নেই রে বাবলু।
    - যা টিকিট তাই দে। আজকে তোরা প্রথম এইচিস। ফিরবি কেন?
    চোখের কোন চিকচিক করেনি ঠিক কিন্তু বুকের ভেতর একটা হাতুরির বাড়ি পড়েছিল। এদের মুখ দেখা বারণ ছিল আমাদের তখন।
    টিকিট হাতে যখন গেট পার হচ্ছি তখন সেকেন্ড বেল পড়ল। একটু পরেই শুরু হবে 'ফুল আউর পাথ্‌থর , যার নায়কের ভুমিকায় ধর্মেন্দ্র একজন ‘ছোটলোক’ । ভূমিকাটি ছিল পকেটমারের।


    চতুর্থ পর্ব
    রাজেশ খান্না বনাম মোনিকা ও মাই ডারলিং


    ধর্মেন্দ্রর সঙ্গে তার আশপাশের সমসাময়িক নায়কদের একটা বিপুল পার্থক্য ছিল।
    মনোজ কুমার , দিলীপ কুমার, দেব আনন্দ, রাজেন্দ্র কুমার, রাজকুমার এরা সকলেই দেশ প্রেমিক , ভাল ছেলে।নায়িকাকে ভাল লাগলেও গায়ে পড়া ভাবটা নেই।
    কেবল রাজকাপুরের পটাটো ছিল হাইলি ডিফেক্টিভ। [লুজ ক্যারেক্টারের সমার্থক শব্দের রক ভার্সান] ।
    পার্সোনাল লাইফের সেই অভ্যাস পর্দায় ছিটকে ছিটকে চলে আসত। আমরা ইলেভেনে উঠে দেখি রাজকাপুরের গলার চামড়া ঢিলে হয়ে এসেছে অথচ পাশে উত্তুংগ গিরিশৃংগের ন্যায় যুবতি বৈজয়ন্তী , হেমা [ একবার মাত্র] , পদ্মিনী, নার্গিস। তখনকার হিসেব অনুযায়ী ৪০ পারসেন্ট উন্মুক্ত। রাজু ভাই কে একদম কাকা কাকা লাগছে ওদের পাশে।
    আবার গানের লাইন রেখেছে—
    বোল সঙ্গম হোগা কি নেহি?
    উত্তরে নায়িকা বলছে,
    হোগা....হোগা.... হোগা.....।
    মানায় না একদম মানায় না।
    কিন্তু বাকিরা ভাল ছেলে। নায়িকার পেছনে কক্ষনও ছোটে না। বরং নায়িকা বৃষ্টিতে ভিজে সপসপ [তখনও জবজবে ভেজা সিন আসেনি] করলেও নায়ক স্বামীজির স্টাইলে দু হাত আড়াআড়ি বুকের ওপর রেখে একটু পেছন ফিরে কেত মেরে দাঁড়িয়ে।
    এই রকম একটা অবস্থার ভেতর ধর্মেন্দ্রর আবির্ভাব। চোর, ডাকাত, লোফার, পকেটমার, স্মাগলার , সব বদের বাসার চরিত্র।
    কিন্তু আসল জায়গায় ঠিক। টং হয়ে মদ গিলে এসেও, মীনাকুমারি কে ওই ভাবে একলা রাতে পেয়েও , গায়ের জামা খুলে নিজে খালি গা হয়ে আব্রূ রক্ষা করে দিল। উফ্ সেকি গা!! একদম পাথ্থ‌র।
    এই খারাপ মানুষটারও ভাল হয়ে উঠবার অদম্য ইচ্ছেটাও দেখবার মত। মীনাকুমারিকে ভালবেসে ফেলবার পর ধর্মেন্দ্র আর হারাম কি কামাইতে নেই। তাই শ্যামকুমার যখন ধর্মেন্দ্রর হাত থেকে ঘাম ঝরানো রোজগারের টাকা লাথি মেরে জলে ফেলে দিল তখন এমন ক্যলানো শুরু হল, ভাবলাম মেরেই ফেলবে বুঝি।
    যাই হোক, সেই প্রথম দিন প্রামানিক সিনেমার গান্ধি ক্লাসে ঢুকতেই একটা মুক্তির উল্লাস যেন কানে এল। প্রবল সিটির আওয়াজে কান ফাটো ফাটো। কেন সিটি ? কেউ জানেনা। সবাই বাজাচ্ছে।
    যথেচ্ছ বিড়ি সিগারেট উড়ছে। ধোঁয়ার ধোঁয়া চতুর্দিক। ধুমপান নিষেধ লেখা পর্দার ওপর একটা স্লাইড। সেটা পড়াই যাচ্ছে না এত ধোঁয়া। গোহাটার মত একটা গমগম ধ্বনিতে হল মুখরিত।
    একদম সামনের দুই রো ৬৫ পয়সা। তার পরেই ১ টাকা ৩০। তফাৎ হল, আমাদের কোন হাতল নেই। বেঞ্চির মত টানা বসার জায়গা। পিঠেও টানা তক্তা। বাকি সবার হাতল আছে।
    যাগগে, হাতল দিয়ে কী হবে। বসা নিয়ে কথা। কিন্তু কেউ বসে নেই। সবাই দাঁড়িয়ে । সবারি ঘাড় পর্দার উলটো দিকে।
    আমরাও ঘার ফেরাতেই কারণ বুঝলাম। দোতলার ব্যাল্কনির হাফ লেডিজ এলাকা জুড়ে মেয়েরা রেলিঙের গায়ে দাঁড়িয়ে। টর্চ হাতে তাদের এক এক করে বসিয়ে দিচ্ছেন বয়স্ক লাইটম্যান। সময় লাগছে বসাতে।
    ওরা সেই ফাঁকে নিচে ঝুঁকে ছেলে দেখছে। ব্যস, যায় কোথায়। সিটির আওয়াজ বাড়ানর সঙ্গে সঙ্গে কেউ কেউ বেঞ্চির ওপর উঠে পড়েছে। গায়ের জামা খুলে ফেলে শুধু চুস্‌ প্যান্ট পরে জামা ঘোরাচ্ছে বাঁই বাঁই করে। যেন ওই জামা নাড়ান দেখে জাহাজডুবিতে অসহায় কাপ্তেনকে বাঁচাতে মেয়েরা নিচে ঝাঁপ দিয়ে পড়বে এখুনি।
    সহসা ছাদের সঙ্গে লাগান ডুমো ডুমো আলোগুলো কমতে শুরু করল। নেপথ্যে বেজে উঠল থার্ড বেল। আমরা বসে পড়লাম।
    হল অন্ধকার হতেই পর্দায় এসে পড়ল একটা থামের মাথায় অশোক স্তম্ভের সাদা কালো ছবি। আর ঘ্যাসঘেসে আওয়াজে টাইটেল পড়ল 'ফিল্ম ডিভিশন কা ভেট'।
    এই এক জ্বালা। তখন সবে বাঙলা দেশ স্বাধীন হয়েছে। কাজেই ইন্দিরা ছাড়া গীত নেই। এই প্লেন থেকে নামছেন, এই প্লেনে উঠছেন। সারা দুনিয়ার লোক তাঁর বক্তব্য শুনছে , আবার সঙ্গে এই মুজিব, এই ইয়াহিয়া, এই ভুট্টো [ ৬৫ -র যুদ্ধের কিছু খণ্ড চিত্র দেওয়া হত] এই হাততালি।
    এইসব চলবে মিনিট দুয়েক। বিড়িতে সুখটান মেরে কিছু দর্শক মেঝেতে ফেলে দিতেই সার্টিফিকেট পড়ল। অমনি একটা ষড়যন্ত্রের মত আওয়াজ উঠে এল দর্শকের কণ্ঠে--- ১৬, ১৬ বা ১৮ , ১৮ ফিস্ফাস।
    এইটা বুঝতে একটু সময় লেগেছিল। বছর খানেক পরে জানলাম এটা রিলের সংখ্যা। ১৬ মানে ১৬ রিলের বই, ১৮ মানে ১৮ রিলের। এইটা সার্টিফিকেট উল্লেখ করা থাকে। সত্যি বলতেকি আমি আজও সেই লেখার জায়গাটা তাক করে পড়ে উঠতে পারলাম না। পড়বার আগেই গায়েব হয়ে যায় সার্টিফিকেট।
    সোয়া ঘণ্টার মত ছবি চলবার পর হাফটাইম হল। ব্লক লেটারে বড় হাতের গোটা গোটা হরফে লেখা 'ইন্টারভ্যাল" শব্দটা পর্দার যে কোন একটা ইম্পরট্যান্ট জায়গা থেকে , ধরুন , ভিলেনের রিভলবার থেকে একটা ধ্রাম করে ফায়ারিং হল, গুলির বদলে নল দিয়ে বেড়িয়ে এসে পর্দা জুড়ে আছড়ে পড়ল 'ইন্টারভ্যাল' লেখাটা। তারপর আলো জ্বলে উঠল।
    এখন এক কোণায় কুতকুত করে লেখা আসে-- ইন্টারমিশন। সেই ধাক্কাটা আসেনা আর। এখানে একটু জানান দরকার, কলকাতায় রিলিজ হওয়ার বছর খানেকের আগে কোন বই তখনও রানাঘাটে এসে পৌঁছত না। যত বাসি হত তত দাম কমাত ডিস্ট্রিবিউটর । কমতে কমতে মোটামুটি জলের দরে এসে গেলে তবেই আমরা দেখতে পেতাম।
    ততদিনে সেলুলয়েডের ওপর ময়লা পড়ে নানা রকম হিজিবিজি দাগ নায়িকার গালে বা ল্যান্ডস্কেপের মাঝখানে এসে জুড়ে বসত।
    হিট সুপার হিট বই আসতে সময় নিত পাঁচ বছর।
    যারা সিনেমাখোর তারা ততদিন অপেক্ষা করতে পারত না। কলকাতার হল থেকে দেখে চলে আসত। তারা আমাদের কাছে ছিল কলম্বাস বা ভাস্কো - ডা- গামার চেয়েও দুঃসাহসী ভেঞ্চারিস্ট।
    তাদের কাছেই জানতে পারি যে কলকাতার হলগুলোতেও গান্ধীক্লাস আছে। তবে তার ক্যারেক্টর সম্পূর্ণ আলাদা।
    সেখানে নাকি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপকরাও এই ক্লাসে বই দেখতে আসেন।
    স্বাধীনতার এ্যালা রং ততদিনে চটতে শুরু করেছে। দেশের নানা জায়গায় খাদ্য ,চাকরির দাবীতে নানা আন্দোলন শুরু হয়েছে। বাঙলায় বাম ডান লড়াই । পরের জেনারেসনের যুব সমাজ ক্রমশ রাফ এন্ড টাফ হয়ে উঠছে ।
    তাদের শান্ত করতে এই ধরণের মারকুটে হিরোর পাশাপাশি আনতে হবে রোমান্টিক হিরো, ছড়াতে হবে রোমান্টিসিসজম।
    বিপুল সংখ্যক মহিলা দর্শক, যারা বইয়ের ৭০ ভাগ কেবল ঝাড়পিট দেখে সন্তুষ্ট নয়, তাদেরকেও টেনে আনতে হবে হিন্দি সিনেমার ছাদনাতলায়।
    আর, কে না জানে প্রেম মানুষের দৈনন্দিনতার ব্যথা ভুলিয়ে দেওয়ার একমাত্র অব্যর্থ দাওয়াই।
    অতএব এমন একজন হিরোকে আনা হল যাকে দেখলে মনে হবে পাশের বাড়ির আধা বেকার শিক্ষিত ছেলে।
    নরম শরম, ঈষৎ লোক দেখান লাজুক কিন্তু আসলে লেডি কিলার। অথচ তাঁর চেহারা খুব মাচো নয়।
    টুকটাক ওয়ার্ম আপ সেরে রাজেশ খান্নাকে নিয়ে ৬৯ সালে ঝাঁপিয়ে পড়ল 'আরাধনা' । কানের ভেতর কামনার গরম শিসে ঢেলে দিলেন কিশোরকুমার -- রূপ তেরা মস্তানা -- প্যার মেরা দিওয়ানা--- ভুল কোই হামসে না হো যায়ে। আহা কি মধুর সেই ‘ভুল’।
    ভিজে নায়িকাকে না ছুঁয়ে শুধু 'ভ্রূ পল্লবে ডাক দিয়ে'ই কী ভাবে একটা দৃশ্যে দর্শকের রক্তে তুফান তুলে দেওয়া সম্ভব, সেটা দেখালেন রাজেশ খান্না। সঙ্গে শর্মিলার ঢাউস খোঁপা সমেত অনবদ্য এক্সপ্রেশন।
    ৭২-৭৩ সালে রানাঘাটে পৌঁছল 'আরাধনা'। শহরে হিন্দি সিনেমার হলে মেয়ে-দর্শকের এই প্রথম বান ডাকল।
    আরও উত্তেজক বিষয় হল, উঁচু ক্লাসের টিকিট না পেয়ে কোন কোন দুঃসাহসিনী লেডিজ এলাকা ছেড়ে নিচে পুরুষ অধ্যুষিত এলাকায় বই দেখতে চলে এল।
    তাদের ভেতর কেউ কেউ আবার আধা শহুরে সাহস অবলম্বন করে নেমে এলেন গান্ধিক্লাসেও।
    তবে এনাদের সঙ্গে পুরুষ সঙ্গী থাকত। এই সসব দেখে গান্ধির ব্রহ্মচর্য যায় যায়।
    আরাধনা লেগেছিল রানাঘাট টকিজে। প্রামানিক সিনেমা তখন খাঁ খাঁ। সব লোক টকিজ মুখো। মুখের ওপর ছুঁড়ে দেওয়া এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলাও করল ভারী সুন্দর ভাবে প্রামানিক ভ্রাতৃদ্বয়।
    ডিস্ট্রিবিউটরকে একটু বেশি পয়সা দিয়ে নিয়ে এলেন ‘ক্যারাভ্যান’-- পিয়া তু, আব তো আজা---।।
    পথে ঘাটে উঠল অকস্মাৎ আর্তনাদ ---- ও মোনিকা, ও মাই ডারলিং।
    আমরা দেখলাম একজন ক্যাবারে নর্তকী কী ভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিল উঠতি ও প্রতিষ্ঠিত বাঘা বাঘা সুপার স্টারদের।
    কোন হলে আজ কত গেল ব্ল্যাকের রেট এইনিয়ে লোকাল কাগজগুলোয় শুদ্ধ খবর বার হতে লাগল।
    আমরা পড়লাম মুস্কিলে। দুটোই দেখতে হবে। অথচ পকেট আর পারে না। তখন কলেজে পা, ফলে ক্যান্টিন চা বিস্কুট বিড়ি সিগারেটের একটা আলাদা বিল লাগছে।
    তাই ঠিক হল ফুড- ফর- ওয়ার্কের ধাঁচে টিউশন -ফর- সিনেমা প্রকল্প চালু করতে হবে।


    পঞ্চম পর্ব
    রাজেশ না অমিতাভ -- মাথার দখল কে নেবে


    ইতিমধ্যে সমস্যা একটু জটিল হয়েছে। রাজেশ খান্না এসে আমাদের চুলের ভোল বদলে দিতে শুরু করেছেন। সেলুনে সেলুনে বিশাল ডিমান্ড, রাজেশ ছাঁট চাই।
    ১৮ বছর যে ছেলেটা একভাবে চুল কেটে এবং আঁচড়ে এল, হঠাত করে তার চুল শেপ পালাটাবে কেন? চুল হল কুকুরের লেজের মত। একবার সেট হলে সহজে ঘুরতে চায় না।
    রাজেশ চুল তাই অনেকের মাথায় শুয়োরের খুঁচির মত খাড়া হয়ে রইল। তার মধ্যে আবার দু ইঞ্চি সিঁথি থাকা চাই। অনেকের পকেটে চিরুনি, পানের দোকানের আয়নায় ভিড়।
    রাজেশ যখন অলরেডি ছক্কার পর ছক্কা মেরে চলেছেন, তার একটু আগেই তার চারপাশ দিয়ে একজন লম্বু উঁকিঝুঁকি মারছিলেন বেশ কিছুদিন ধরেই।
    সাত হিন্দুস্তানি ছবিতে তাঁর দিকে তাকান যায়নি। একটা রুগ্ন পাংশু ডিপ্রেসিভ লুক নিয়ে ল্যাম্পপোস্টের মত লম্বা এক মানুষ এসে দাঁড়িয়েছিলেন পর্দায়। তাও, এক বাঙালির রোলে।
    মানুষ জাস্ট তাকায়নি তাঁর দিকে। তারপর তিনি উঁকি মারলেন রাজেশের পিঠের পেছন থেকে বেশ ভাল মতই । লোকের চোখ টেনে নিলেন 'আনন্দ' ছবিতে।
    টুকটাক করে ছুঁয়ে গেলেন পরওয়ানা, রেশমা অউর সেরা, গুড্ডি আর বম্বে টূ গোয়া-তে। তখনও বুঝিনি কী জিনিষ আসছে।
    ‘৭৩ -এ মুক্তি পেল জঞ্জির। আমার শহরে সে এল ‘৭৫ সাল নাগাদ।
    সেই ‘জঞ্জির’-এর ঝনঝনানি যে এই ভাবে আমাদের পাগল বানাবে কেউ ভাবতেই পারিনি। ‘দিওয়ার’ এলে প্রথম হলে পুলিশের লাঠি চার্জ শুরু হল।
    ততদিনে প্রামানিক সিনেমার আমাদের সেই কাউন্টারের চেহারা, এই সব দাঙ্গা থামানর উদ্দেশ্যে আরও সুরক্ষিত হয়েছে।
    কী সেই সুরক্ষা?
    ৫০ ফুট আগে থেকে কাউন্টারের ফুটো অবধি কংক্রিটের টানেল বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেটা এত সরু যে দু কাঁধ দু দিকের দেওয়ালে ঠেকে যায়।
    একটু অসাবধান হলেই জামা ফেঁসে যাবে।
    সেই সরু কাউন্টারের ভেতরটা দিন দুপুরেই ঘুটঘুটে অন্ধকার। ছাদে একটা ভুতুরে ডুম লাগান আছে বটে কিন্তু সেটা এত বার ভেঙ্গে দিয়েছে জনতা যে, কর্তৃপক্ষ বিরক্ত হয়ে তাকে ঘিরে একটা লোহার জাল লাগিয়ে দিয়েছে।
    সেই জালে মাকাড়সার বাসা এত ঘন যে আলো আর বেরতেই পারে না প্রায়।
    মেঝেতে সব সময় সামান্য জল কাদা। চটি পড়ে ঢুকলে আটকে যাবেই। তাই সবাই বাবা তারকনাথের লাইনের মত, খালি পা। সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় কাউন্টারের ডান দিকে দেওয়াল একটু কাটা। সেটাই বেরবার একমাত্র রাস্তা।
    সবিস্ময়ে দেখলাম ব্ল্যাকাররা সেই বাহির পথ দিয়েই প্রবেশ করে ফেলছে।
    হাতে ছোট হ্যাক্সো ব্লেড, যা দেখলেই সাদা টিকিটের মানুষ হাত সরিয়ে নেবে।
    পাব্লিকের কোন সুরাহা হল না এই ভাবে টানেল বানানয়। যেটা হল, কাউন্টার খোলার ১০ মিনিটের ভেতর সব টিকিট শেষ। কারণ ব্ল্যাকাররা প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দীতায় জিতে যেতে লাগল ।
    দিওয়ারের টিকিট একটাও সাদা ভাবে না পাওয়ায় পাব্লিক হলের দিওয়ার ভেঙ্গে ফেলে আর কি!
    সামনের লবির কাচ ফাচ ভেঙে চূরে একসা করে দিল। মেয়েরা চিল চিৎকার দিয়ে পালাতে লাগল । দোকানের ঝাঁপ বন্ধ হল ঝপাঝপ।
    পাশের থানা থেকে পুলিশের ভ্যান ঢুকল।
    পুলিশ যে লাঠি দিয়ে এত জোরে মারে সেই প্রথম টের পেলাম। লাঠি কাঁধে এসে পড়তেই কাঁধ থেকে হাত যেন খসে পড়ল।
    মানুষ যে ভয়ে এতো জোরে দৌড়তে পারে সেটাও টের পেলাম সেদিন।
    প্রথম বার দিওয়ার আমরা দেখতেই পাইনি। দেখেছি দ্বিতীয় বার, বছর খানেক বাদে যখন ফের ঘুরে এল তখন।
    দিওয়ার দেখার পর নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লাম আমরা। চুল রাজেশ ছেড়ে বচ্চন বানাতে হবে। কান ঢেকে ফেলতে হবে। চুল পেছন দিকে কলার ছোঁবে। কপালের ওপর এক গোছা এসে পড়বে আবার।
    জামার নিচের দিকের বোতামগুলো খুলে গিঁট মারতে হবে।
    এই প্রথম, সামনের চুল ছোট থাকবে, বড় হবে পেছনদিকটা।
    কারও কারও কড়া ধাঁচের বাপ কাকা, দু বার করে সেলুনে পাঠাচ্ছেন কাউকে কাউকে, ভুলভাল চুল ঠিক করে আসবার জন্য।
    এক বচ্চন ভক্ত প্যাঁক দিল রাজেশের শিষ্যকে, একদিন তোর গুরুও দেখিস, আমার গুরুর মত করে চুল আঁচড়াবে।
    প্রত্যেকের পকেটে তখন চিরুনি। মা একদিন বাবাকে জানাল, ছেলের পকেটে চিরুনি পেলাম প্যান্ট কাচতে গিয়ে।
    বাবা বললেন, লেখাপড়া বাদ দিয়ে ওকে বল একটা সেলুন খুলতে।
    বচ্চন সায়েব তখনও বেশ রোগা কাঠামোর মানুষ। তাই রোগা আর লম্বারা আগে নিজেদের পালটাল। পরে মোটারা অন্তত চুলটুকু বদলে নিল কোন রকমে।
    এইসবের ভেতর ৭৫ সালে এসে পড়ল 'শোলে'। সবার গুরুই হাজির সেখানে। সঞ্জীব আঁতেলদের গুরু। ধর্মেন্দ্র, হাতুড়ির মত ঘুসির গুরু। আর বচ্চন, তখন সবার গুরু প্রায়। কেবল রাজেশকে যারা আঁকড়ে আছে গুরু ধরে তারা একটু ম্রিয়মাণ।
    রাজেশ সাম্রাজ্যের ছায়া একটু অস্তগামি তখন। শোলেতে রাজেশ নেই !!!
    'শোলে' আমাদের শুইয়ে দিল। রানাঘাটে কবে আসবে কেউ জানে না।
    দেরি হচ্ছে বলে আমাদের এক বন্ধু কলকাতার জ্যোতি হলে দেখে এল বইটা। সে এসে আর কথা বলে না। শুধু অসমতল জায়গায় পায়চারি করে। কোমরের বেল্ট হাত থেকে মাটি ছুঁই ছুঁই ঝুলছে।
    যেখানে সেখানে থুতু ফেলে বলছে -- থুঃ।
    আমরা বলি, থুতু ফেলছিস কেন?
    ও বুক পকেট থেকে খৈনির থলে বার করে দেখায়।
    কোথায় পেলি?
    হলের বাইরেই বিক্রি হচ্ছিল। এক জোড়া কিনে নিলাম।
    আমরা প্রমাদ গুনলাম। বললাম, গুরু কেমন করেছে?
    কে গুরু?
    কেন বচ্চন?
    না, আমার গুরু আজ থেকে গব্বর সিং।


    ষষ্ঠ পর্ব
    কিতনে আদমি থে


    শোলে আসার আগেই রানাঘাটে লিমিটেড কিছু দোকানে এসে গেল শোলের অডিও ক্যাসেট। একাধিক ক্যাসেটের একটা বাক্স। পরপর নম্বর দেওয়া।
    চালালে ঘণ্টা তিনেক নিশ্চিন্ত। নাওয়া খাওয়া ভুলে লোকজন চাক বেঁধে মাথা একটু নিচু করে দাঁড়িয়ে পড়বে।
    এদের কেউ কেউ শোলে দেখেছে। তাদের মাথার ৭০ মিমি স্ক্রিনে মুভিটা আবার চলছে।
    বেশির ভাগই দেখেনি। শ্রবণেন অর্ধ দর্শনম্‌ তারা।
    কিন্তু এভাবে সুখ নেই । এই প্রথম রানাঘাটবাসি অজিতদার[প্রামানিক ভ্রাতৃদ্বয়ের জ্যেষ্ঠ] কাছে দাবী জানাল শোলে আনবার।
    অজিতদা বললেন, অনেক খরচ। পর্দা, সাউন্ড বক্স সব চেঞ্জ করতে হবে।
    আমরা বললাম , আপনি আনুন। উঠে যাবে।
    অজিতদা বললেন, তথাস্তু।
    খবরটা লিক করে গেল।
    দেখা গেল রানাঘাট টকিজ এবং প্রামানিক সিনেমা দুই হলেই একসঙ্গে লেগেছে শোলে।
    ব্ল্যাকারদের সঙ্গে আমরা চুক্তিতে এলাম। ৬৫ পয়সার টা তোরা যা খুশিতে ব্যাচ, আমারা পাঁচজন করে আসবে পালা কারে, নাইট শো'য় [৯টা- ১২টা] । ১ টাকা করে দেব।
    ওরা এই শর্তে রাজি হয়ে গেল কারণ ততদিনে থানার নতুন বড় বাবুর ছেলে তখন আমাদের কলেজে ক্লাসমেট।
    মুশকিল হল, রাত ন'টা থেকে বারো'টা বড় কঠিন সময় বাড়ির বাইরে থাকার পক্ষে। অগত্যা অশ্বত্থামাকে হত হতেই হল।
    কেউ পড়ার নাম করে, কেউ নোটস কপির নাম করে, কেউ অমুকের মা আজ একটু খাওয়াবেন-এর নাম করে ওই টাইমে হলে এলাম।
    শোলে আমাদের অবশ করে দিল।
    আমরা প্রায় ভিরমি খেতে খেতে বড় পর্দায় শোলে দেখলাম এবং শেষ হওয়ার পর সীট ছেড়ে উঠতে টাইম নিলাম ঘোর কাটানর জন্য।
    ঠাকুর সাহেবের হাত দুটো যে গব্বর সত্যি সত্যি কাঁধ থেকে নামিয়ে দেবে আমরা কল্পনাই করতে পারিনি।
    ভারতীয় চলচিত্রের ইতিহাসে নিষ্ঠুরতম ভিলেন হিসেবে নাম চির স্মরণীয় হয়ে গেল ওই একটি দৃশ্যেই।
    টিউশনের টাকা পেয়ে রেয়ার স্টলের টিকিট কেটে শোলে রিপিট করতে গেলাম দ্বিতীয় বার রানাঘাট টকিজে। হেলেনের নাচের সিনে কান ফাটানো সিটি এড়ানো আরেকটা উদ্দেশ্য ছিল।
    মুশকিল হল, গব্বর হাড় হিম করা আওয়াজে বলছে,
    কিতনে আদমি থে?
    পাশের বাবার বয়েসি আধা শহুরে লোকটি ফিসফিস করে বললেন,
    ভাই কী বলল?
    আমিও ঘাড় নিচু করে ফিসফিস করে বললাম,
    কজন ছিল?
    দো আদমি সর্দার।
    কী বলল ভাই?
    দুজন ছিল।
    তুম কিতনে থে?
    এবারো লোকটা ফিসফিস করল।
    আমি প্রমাদ গুনলাম
    সারা বই আমাকে ট্রান্সলেট করতে হবে নাকি?
    ঘাড় ভাল করে ঘুরিয়ে বললাম,
    আপনি হিন্দি বোঝেন না?
    সে মানুষটি জানাল
    একদম না।
    তাহলে এসেছেন কেন? হিন্দি না জানলে তো এই বইয়ের কিচ্ছু বুঝতে পারবেন না।
    আসলে আমি আসতাম না। কলকাতা থেকে মাল আসার কথা। কাঁচরাপাড়ায় টেরেন অবরোধ হয়েচে। তাই এখেনে এসে বসেচি।
    কী মাল?
    এই ধুতি কাপড়।
    অবরোধ কেন?
    শোলের টিকিট পায়নি বলে ছেলেপুলে রেললাইনে বসে পড়েচে।
    এমন একটা সময় এল যখন শোলের ডায়লগ কে কতটা মুখস্থ বলতে পারে তার ওপর পাড়ার দোকানে দোকানে ক্লাবের চাঁদায় চা ঘুগনি পাউরুটী ফ্রি পাওয়া শুরু হল।
    যারা দেখেনি অথচ ডায়ালগ নাইনটি পারসেন্ট পারছে তাদের ফ্রিতে শোলে দেখান শুরু করল কোনো কোনো গ্রুপ।
    আমাদের এক বন্ধু ছিল এদের মধ্যে চাম্পিয়ান। তাকে নানা জলসায় ডেকে নিয়ে যাওয়া হত। এবং নানা স্বরে সবার ডায়ালগ বলতে পারত নিখুঁত ভাবে।
    তার নামই হয়ে গেল--- রানিং শোলে মনতোষ।
    শেষমেষ তার দক্ষতা এত তুঙ্গে উঠল যে সে শোলের অখ্যাত অভিনেতাদের ডায়লগও হুবহু নামিয়ে দিত। যেমন---
    শুনলো গাঁওবালো, ইয়ে হ্যায় গব্বর সিং-কি চিঠ্‌ঠি--- বলে পুরো চিঠিটাই বলে যেত গড়গড় করে।
    ঠাকুর সাহেবের অনুগত ভৃত্যের সব কটি ডায়লগও তার কণ্ঠস্থ ছিল।


    সপ্তম পর্ব
    বচ্চন, ভিডিও এবং তিন খান


    বচ্চনের অশ্বমেধের রথের ঘোড়া তারপর আর একবারও গতি কমায়নি। এমনকী এই বয়সে এসেও উনি যে কোন চরম সফল তারকার ঈর্ষার পাত্র।
    মরণ ছুঁয়ে ফিরে এসেছেন। ফিরেছেন রেখাকে ছুঁয়েও, যিনি মরণের থেকেও তীব্র এবং অমোঘ। ফিরেছেন রাজনীতি ছুঁয়ে। ঘুরে দাঁড়িয়েছেন দেউলিয়া হয়েও ।
    মানুষকে ক্রোড়পতি বানিয়েছেন, নিজেও বনেছেন বার বার।
    বচ্চন একজন অরণ্যদেব টাইপের মানুষ। উনি নিজের ইতিহাস নিজেই লিখে চলেছেন। যেখানে উনি খাড়া হবেন আজও, লাইন সেখান থেকেই শুরু হয়।
    আমাদের যৌবনে আরও কেউ কেউ আমাদের মাতিয়ে দিয়েছিল। তাদের নাম না করলে পাপ হবে।
    এদের একজন হলেন ফিরোজ খান।
    উফ্‌। কী মারাত্নক ভাবে হলিউডের কাউবয় ! পা দুটো ঈষৎ বাঁকা। কালো ভেলভেট কর্ড কিংবা ব্রাউন জিন্সের লো ওয়েস্ট । কোমরে টোটার মালা। মাথায় কাউবয় হ্যাট।
    ঠোঁটের কোন একটু চাপা, সেখানে একটা টুথপিক কিংবা সিগারেট। গায়ে বুক খোলা কাঁধে তবক দেওয়া জ্যাকেট।
    একনলা বন্দুকটা কাঁধে অথবা সাদা ঘোড়ার জিনের পাশে খাপে ঝুলছে--- [খোটে সিক্কে , কালা সোনা]।
    আবার যখন সুপার কপ্‌ তখন হলস্টারে ঝুলছে পুলিসি নাইন এম এম। [কুরবানি, জাঁ-বাজ]
    একদম জ্যাঙ্গো থেকে যেন নেমে এসেছেন ভারতীয় ফ্র্যাঙ্কো নিরো।
    অবলীলায় মমতাজকে সমুদ্রে হাজির করে দিলেন টু পিস বিকিনিতে [অপরাধ] ।
    গড ফাদার থেকে নিজেই নেমে এলেন 'মাইকেল করলিয়নি' হয়ে, হেমাকে নামালেন আফগান ট্রাইব বানিয়ে আর রেখাকে আনলেন এক বস্ত্রে [ধর্মাত্মা] ।
    প্রায় সব ছবিতেই পাশে নিলেন ড্যানি দেংগ্জাপ্পাকে।
    প্রামানিক সিনেমা হলের ছাত সিটিতে উড়ে যাবে বলে মনে হল এইবার।
    ভিলেন থেকে আরেক হিরো উঠে এলেন-- বিনোদ খান্না। এলেন শুধু তাই নয়, বচ্চনের সিংহাসন ধরে টানাটানি শুরু করে দিলেন [অমর আকবর এন্টনি, মুকদ্দর কা সিকন্দর]।
    এর মধ্যে ঘটল একটা আশ্চর্য পালা বদল। মানুষের হাতে হাতে চলে এল ভিসিআর আর ভিডিও টেপ।
    সে এক অত্যাশ্চর্য গ্যাঁড়াকল। ঘরে, বারান্দায়, ক্লাবে, মন্দিরের চাতালে বসে সিনেমা দেখা যায় সেই যন্ত্রে। সঙ্গে লাগে কেবল একটি টিভি সেট। প্রামানিক, রানাঘাট টকিজ, ব্ল্যাকার, মারামারি, সিটি সব যেন কেমন মিইয়ে গেল। পাড়ায় পাড়ায় ভাড়া পাওয়া গেল অতীব সুলভে। একবার মুখ খুলতেই ওদের লোক এসে সেট ফেট সব সেট করে দিয়ে বিড়ি খেতে চলে গেল, আবার এল ঠিক শেষ হওয়ার মাথায়।
    চলমান সেই সিনেমা হল নিমেষে গুটিয়ে নিয়ে চলে গেল সাইকেল রিকশা কিংবা ভ্যান রিকশায় চেপে। এ যেন আলাদিনের সেই প্রদীপের দৈত্য, শুধু একবার -- হুকুম মালিক।
    মাঝে মাঝে সারারাতের জন্যও ভাড়া করা শুরু হল। বেডরুম হয়ে উঠল সিনেমা হল।
    এইসময় থেকে প্রামানিক সিনেমা, রানাঘাট টকিজ এবং তারপর গজিয়ে ওঠা আরও দুটি হল, সুরেন্দ্র আর গীতাঞ্জলী, তৈরি হয়েছিল খুব জাঁক করে। আরামদায়ক ছিল আগের দুজনার চেয়ে। কম্পিটিশনে ফেলেও দিয়েছিল পুরনোদের কিন্তু এই ভিসিআরের দাপটে কেমন যেন মিইয়ে গেল সব হল।
    প্রামানিক আর শো শুরুর আগে গান বাজায় না, কেষ্টদা একদিন লিভার পচে মরে গেল। মাইকে ঘোষণা বন্ধ হল। পাড়ায় নানা বাড়িতে দরজা জানলা বন্ধ। ভেতর থেকে শুধু ভিডিওর গুম গুম শব্দ।
    ভিসিআর একটা প্রজেক্টরএর চেয়েও সহজে চলে। ইচ্ছা মত থামান যায়। মুভি আগু পেছু করা যায়। এক সিন হাজার বার দেখা যায়।
    কিন্তু আমার প্রবল প্রতাপান্বিত পিতৃদেবকে উপেক্ষা করে বাড়িতে ভিসিআর আনার ক্ষমতা তখনও অর্জন করে উঠতে পারিনি। তাই ক্লাবই ভরসা।
    একদিন শুনলাম কর্মচারী ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদে প্রামানিকে স্ট্রাইক। হল বন্ধ।
    এতো কষ্ট জীবনে পাইনি কোনদিন।
    জীবন কারও জন্য থেমে থাকে না। একদিন সত্যি সত্যি দেখলাম প্রামানিক হলের গেটে লাল শালুর ওপর পোস্টার। আর স্লোগান -- ইনকিলাব ইত্যাদি। আস্তে আস্তে হলটা রঙ টং উঠে চোখের সামনে একটা হানা বাড়িতে পরিণত হল। আজও দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে।
    যে তিনজন খান [আমির সালমন এবং সারুখ] ইতিমধ্যে উঁকি ঝুঁকি মারতে শুরু করেছে তাদের দেখে আমাদের, মানে এই মধ্য বয়েসীদের কেমন যেন করুণা হল। মনে হল আমাদের ভাইপো বোনঝিরা সব এইবার নায়ক নায়িকা হবে।
    না আছে এদের বাজখাই গলা, না আছে হাতুড়ির মতো ঘুসি চালাবার ক্ষমতা। তবে হ্যাঁ, এদের অভিনয় ক্ষমতা যে মারাত্নক , সেটা হাঁড়ির দু-একটা চাল টিপেই বোঝা গেল।
    এর মধ্যে পেয়ে গেলাম জনা দুই বাপ কা বেটা। একজন সানি আরেক জন সঞ্জু । এই প্রথম আরও জানলাম ধর্মেন্দ্ররা দেওল।
    যাই হোক বুঝলাম এরা কিছুটা হলেও গা গরম করতে এসেছে।
    আস্তে আস্তে এদের ভেতর আবার আমির হয়ে উঠল একজন সত্যিকারের আমীর। এক এক ছবিতে একেক আমির। আগের সঙ্গে পরের কোন মিল নেই। কী অসম্ভব নিষ্ঠা থাকলে এটা পারা যায় ভেবে আকুল হই এখনও।
    সারুখ জিতলেন পাশের বাড়ির ছেলের মত ইমেজে। যেন কতদিনের চেনা এক অসহায় কিশোর। বুকে আগুন নিয়ে চলেছে। আর সলমন নিলেন সেই দুষ্টু ছেলের জায়গা যাকে ভাল না বেসে থাকা সম্ভব নয়।
    হিন্দি ছবিতে আরেকটা বড় চেঞ্জ এল বিশ্বায়নের পর। দেখা গেল গরীব নায়ক বা নায়িকা আর নেই। নেই মিডল ক্লাসের কেউ। সব ঝাঁ চকচকে বড়লোক। এমনকি পাশের বাড়ির সারুখ এখন বিশাল ধনী। ফলে নিজেকে আর ততটা এইসব ফিলমের সঙ্গে রিলেট করতে পারলাম না। ফিল্ম একদম হয়ে দাঁড়াল এমিউজমেন্ট। সে সময় থেকে বেশি বেশি করে ঝুঁকে পড়লাম হলিউড এবং বলিউডের ইনটেলেকচুয়াল ছবির দিকে।
    এইসব আঁতেল ছবির কিছু বৈশিষ্ট থাকবেই।
    নায়ক নায়িকা কেউ খুব একটা আহামরি দেখতে তো হবেই না , কেউ কেউ হবেন রীতিমত আগলি। রোগা গাল ভাঙ্গা অথচ ধারাল চোখমুখ, তুমুল অভিনয় ক্ষমতা।
    প্রয়োজনে এরা শুয়োর চড়ান [পার] রিকশা চালান[ সিটি অফ জয়] রোগা পুলিশ [ অর্ধসত্য ] ইত্যাদি যে কোন ধরণের রোলে বেশি স্বচ্ছন্দ এবং জাতীয় বিজাতীয় নানা পুরষ্কার নিতে বিশেষ ভাবে দক্ষ।
    এইসব ছবি বেশির ভাগই ঘরের মধ্যে তোলা। সবিশেষ নাচ গান বিহীন এবং অল্প আলোয় আধা অন্ধকার।
    টিকিট ঘর ফাঁকা। ভেতরে গিয়ে সামনের সিটে পা তুলেও বসা চলে। কিন্তু দেখতে দেখতে শিরদাঁড়া খাড়া করে দেয়।
    আমাদের ব্যাচে যারা এইসব ছবি বেশি দেখে তাদের মেনস্ট্রিমের লোকেরা আঁতেল বলে ডাকত।
    আমরাও বচ্চনের যৌবনের জমানা চলে গেলে সেই সব ছবি দেখতে আরম্ভ করলাম। বুঝলাম এইবার বয়েস হচ্ছে।


    সমাপ্ত
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • স্মৃতিচারণ | ১৯ এপ্রিল ২০২২ | ২৫৯৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • হীরেন সিংহরায় | ১৯ এপ্রিল ২০২২ ১২:৫৬506685
  • আমার সময়টাকে চমৎকার তুলে ধরলেন। অনেক কথা মনে করিয়ে দিলেন! 
    জোড়া সিনেমা হলের পাল্লা দেওয়ার ( রানাঘাট আর পরামানিক হলের মতো ) বরানগরে ছিলো জয়শ্রী নিউ তরুন। দমদমে লীলা নেত্র । ৬৫ পয়সার পরে ছিলো ১.৪০ পয়সার টিকিট ১.৩০ নয় ! সেখানে বসার পয়সা ছিলো না। টকি শো হাউসে খাঁচার ভেতরে লাইন দিতে হতো  লাইন ভাংগার প্রচেষটা বাতুলতা - আমার বন্ধু অশোক দত্তর বাডি ছিলো উলটো দিকে। গানস অফ নাভারোন ছবি চলেছিল বহু সপ্তাহ - অশোক বলতো রাত্রি সাড়ে দশটা বাজলেই শোনা যেতো গুম গুম গোলা বন্দুকের আওয়াজ। ঘুমনো অসম্ভব ।
     
    ইউরোপে এসে থেকে সিনেমা শব্দ নিয়ে গোলমালে পডেছি। সিনেমাকে বই বলতাম। খুব খারাপ বইকে খাতা বলতে শুনেছি বরানগরে। পরে উত্তরন হলো সিনেমায়। আমরা বলতাম " ওই সিনেমাটা দেখেছিস"
    যেখানে দেখানো হতো তাকে বলতাম সিনেমা হল। এখানে সিনেমা মানেই সিনেমা হল। আমাদের অর্থে সিনেমা মানে মুভি ।বা ফিল্ম । 
     
    অবশ্য আমরাও দেশে সিনেমা অর্থে " ফিলিম" শুনেছি মনে হয়। 
  • Sabyasachi | 2409:4060:2e0f:ad34:4089:24cb:c2ea:c9c3 | ১৯ এপ্রিল ২০২২ ১৩:৪৭506690
  • darun darun
  • Amit Lahiri | ১৯ এপ্রিল ২০২২ ২১:৫৭506716
  • চমৎকার!
     
  • কল্লোল | ২০ এপ্রিল ২০২২ ০৭:০৯506723
  • জানি, আপনে  তো তবিয়ত খুশ কর দিয়া 
  • Amit | 121.200.237.26 | ২০ এপ্রিল ২০২২ ০৭:৫৯506724
  • শোলে বোধহয় প্রথম যেখানে হিরোদের থেকে ভিলেন বেশি পপুলার হয়েছিল। আমি অনেক পরে দেখেছি শোলে ক্লাস ১০ এ উঠে ৮০ দশকের শেষাশেষি। কিন্তু অত বছর পরেও তখনও হয়তো  লোকের ম্যাডনেস প্রায় এক লেভেলে। টিকিট দিব্যি ব্ল্যাক হচ্ছে। আর হলে ডায়লগ শোনার আগেই আশেপাশের পাবলিক চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পুরো 100-% মুখস্ত বলে দিচ্ছে। সে এক মহা ঝামেলা। 
     
    তারপরেও যে কতবার দেখেছি ঠিক নেই। এখনো কোনসময়  টিভি তে শোলে দেখালে বেশ খানিকক্ষণ দেখি বসে  বসে। :) 
     
    ৬০-৭০ একটা অন্যরকম সময় ছিল মনে হয়। হিরোরা প্রায় ডেমি গড। এখন ভাবি এতো দুনিয়ার টিভি চ্যানেল আর ইউটুব হাতের মুঠোর যুগে ওরকম স্টারডম আর সম্ভব কি না। 
  • | ২০ এপ্রিল ২০২২ ১১:১২506729
  • উফ্ফ এই লেখাটা গুরুর হল অব ফেমে যাওয়ার মত। কি যে ভাল লাগল, যদিও মফস্বলের মেয়েদের বাস্তবতা আরেকটু অন্য ছিল। 
  • স্বাতী রায় | 117.194.33.251 | ২০ এপ্রিল ২০২২ ১৯:৩০506737
  • দারুণ লেখা । দারুণ। পঁয়ত্রিশ বারের পরে আর গোনার খেই হারিয়ে যাওয়া শোলে-মুগ্ধ বন্ধুদের কাছে শোনা গল্পের সঙ্গে যে কী মিল!  পরে আবার করে খুব হিংসে হল।  আমাদের এ সব কিচ্ছু ছিল না। একটা অনন্যা,একটা জয়শ্রী  খুব আহ্লাদ হলে মিনার আর বাবা-মার  শক্ত করে হাত ধরা, এদিকে মায় নেত্র শুনলেও বাবার রক্তচক্ষু আর আবেদন নাকচ - এ ছাড়া  আর স্কুলবেলা কই!  তারপর অবশ্য দিন পাল্টাল। খুব এনজয় করলাম লেখাটা।    
  • এলেবেলে | 202.142.80.13 | ২০ এপ্রিল ২০২২ ২১:২৮506740
  • লেখাটার সঙ্গে নিজেকে রিলেট করতে পারলাম। একে তো নদীয়া, তায় এক আদ্যন্ত ফিল্মের পোকার সরস উপস্থাপন ভঙ্গি। তবে আমরা ছিলাম কলকাতা থেকে নতুন সিনেমা দেখিয়েদের দলে। ইন ফ্যাক্ট ধর্মতলা চত্বর একদা চিনতাম সিনেমা হলের অবস্থান দেখে। মনে পড়ে ১৯৮৪-তে লাইটহাউসে দেখেছিলাম উমরাও জান আর এলিটে অন্ধা কানুন (বোধ হয় সামান্য পরে)। সেসব দেখে আসার পর মফস্‌সলে আমাদের কলার কিছুদিন উঁচুতে থাকত এমনিই।
     
    তবে কৃষ্ণনগরের মিমিতে প্রচুর ছবি দেখলেও রানাঘাটে ছবি দেখতে যাইনি কোনও দিন। আর আমাদের শহরে গান্ধী ক্লাসেও বিড়ি-সিগারেট টানা নিষিদ্ধ ছিল। সেটা উসুল করে নিতাম মিমিতে। যত দূর মনে পড়ে, আমাদের আমলে গান্ধী ক্লাসের টিকিট ছিল বারো আনা কিংবা ৯০ পয়সা।
     
    আহা! কীসব দিন ছিল।
  • Sara Man | ২০ এপ্রিল ২০২২ ২৩:৪২506743
  • চমৎকার। অপূর্ব লাগলো। আমাদের ইস্কুল বেলাও উত্তম সুচিত্রা জড়ানো। তবে মেয়েদের স্বাধীনতা একটু কম থাকে। সেটা পুষিয়ে নিয়েছিলাম কলেজ জীবনে। 
  • সুপ্রিয় চৌধুরী | 2405:201:8008:d071:94de:2a37:3204:2d76 | ২১ এপ্রিল ২০২২ ১৯:১২506756
  • আহা কি লিখলেন ভাই নির্মাল্য মুখোপাধ্যায়! রসের মোড়কে চুবিয়ে প্রায় পাঁচ দশকের মেইনস্ট্রিম সিনেমার একটা জার্নিকে পুরে দিলেন মহাজাগতিক একটা কালের ক্যালাইডোস্কোপে। এই জার্নিতে সিনেমার পাশাপাশি হাঁটলো সমাজ, মানুষ, শ্রেণিচরিত্র, কৈশোর, যৌবন, পেটে খিল ধরানো হাসি, দমচাপা দুঃখ, দারিদ্র্য, অব্যক্ত ক্রোধ, অসহায় প্রতিবাদ, স্যাটায়ার, রোমান্স, বিশ্বায়ন আর উন্নয়নের দাপটে বেবাক চুপকথা হয়ে যাওয়া কত রুপকথা! হাঁটলাম আমরা, যারা এই মূহুর্তে আপনার লেখাটা পড়ছি, পড়ে উঠলাম অথবা খুব তাড়াতাড়ি পড়ব। জানি না কোন সৃষ্টি স্বীকৃতি পায়। তবে হঠাৎ একরাতে গিটার হাতে বেজে ওঠা 'তোমাকে চাই' যদি স্বীকৃতি পায়, দিনের পর দিন অনাহারে থাকা মফস্বলি কবির 'মা নিষাদ' যদি সমাদৃত হয়, সিফিলিস,  
    ক্ষুধা আর অপরিসীম দারিদ্র্যের সাথে সহবাসকারী কোন 
    শিল্পীর সূর্যমুখী সিরিজ যদি তাঁর প্রয়াণের পর অযুতকোটিতে বিকোয়, স্থির বিশ্বাস এ সৃষ্টিও একদিন তার প্রাপ্য মর্যাদা পাবে। পাবেই।
  • nirmalya mukherjee | ২৪ এপ্রিল ২০২২ ১৫:৪৫506858
  • সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা পড়বার ও মন্তব্য করবার জন্য।  আনন্দম্। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন