এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • রসন পিয়া

    Sandipan Majumder লেখকের গ্রাহক হোন
    ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১৩০৮ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • নিচের ভিডিওতে যাকে গান গাইতে, গান শেখাতে, বন্দিশ লিখতে দেখছেন তাঁর বয়স  তখন ১০৬ বছর। হ্যাঁ, ভুল পড়েন নি কিছু, যে তথ্যচিত্রের ট্রেইলার এই ভিডিওটি, সেটির কাজ শেষ  হয় ২০১৫ সালে আর ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রয়াত হন উস্তাদ আব্দুর রশিদ খান (জন্ম ১৯ আগস্ট, ১৯০৮)। তানসেনের বংশের সরাসরি উত্তরাধিকারী উস্তাদজি, যাকে সবাই বাবা নামে ডাকত, তাঁর পরিবারের সঙ্গীতের ঐতিহ্য ৫০০ বছরের। লখনৌয়ের কাছে রায়বেরিলির উপকন্ঠে তাঁর আদি নিবাস এবং সঙ্গীত সাধনা। পাশাপাশি রসন পিয়া নামে তাঁর কবিতা এবং বন্দিশ রচনা। আই টি সি সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমির প্রাক্তন প্রধান বিজয় কিচলুর অনুরোধে ১৯৯৪ সাল থেকে তিনি স্থায়ীভাবে কলকাতায় বাস করে শিক্ষাদানের ভার নেন। তার হাত এবং পায়ের আঙ্গুল নেই। বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পাঁচ বছর প্রায় শয্যাশায়ী ছিলেন ষাটের দশকে। ৯৪ বছর বয়সে পড়ে গিয়ে একবার হিপ জয়েন্ট ভেঙ্গে যায়। তারপর আবার  উঠে দাঁড়ান। গান গাওয়া থেকে শুরু করে সমস্ত কর্মকাণ্ড শুরু করেন। গোটা তথ্যচিত্র জুড়ে দেখা যায় শিশুর মত এক নিষ্পাপ এক শিল্পীকে যিনি সাধারণ প্রথম শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ মানের শিষ্যকে প্রাণের উৎসাহ নিয়ে গাইতে শেখাচ্ছেন। বন্দিশ লিখছেন কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে কারণ তিনি বলছেন যে তিনি কৃষ্ণভক্ত (এই ভিডিওর শেষ সংলাপটি লক্ষ্য করুন)। আবার তিনি নিয়মিত নামাজ পড়েন, সুফি গান করেন, তার পীরের দরগায় উরস উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও তিনি খেয়াল বিশেষজ্ঞ শুধু নন, ধ্রুপদ, ধামার, ঠুংরি --- সবকিছুতেই  উৎকর্ষের চূড়া ছুঁতে পারতেন। এই তথ্যচিত্রটি দেখতে পাওয়া আমার সৌভাগ্য — এটি  Mubi নামক ওটিটিতে দেখানো হচ্ছে। আসলে সাধক ও শিল্পীর সমন্বয়, আমাদের সময়ে ক্রমশ বিরল হয়ে আসা এই ঐতিহ্যর উদাহরণ দেখতে পেলে মনটা অপার বিস্ময়ে ভরে যায়। গুরু শব্দটা যে পরম্পরার মধ্যে গুরুত্ব পেয়ে এসেছে সেটাকে খুঁজে পেলে ধর্মীয় বিভাজনের এই ইতর সময়ে মনে হয়  আশা আছে, মানুষ তাঁর সৃষ্টিশীলতাকে আঁকড়ে বাঁচতে পারবে। শুধু কাঞ্চন মূল্যের বিনিময় আর ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাই শেষ কথা বলবে না।

    এক ঘণ্টা ২০ মিনিটের এই তথ্যচিত্রের নবীন নির্মাতা নীহারিকা পোপলি সম্পর্কেও দুচার কথা না বললে নয়। ২০১০ সালে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতক হওয়ার সময় নীহারিকার বাবার গান শুনে মুগ্ধতা জন্মেছে মাত্র, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ নয় সে। নীহারিকা তখন নাটক নির্দেশনা, শিক্ষকতা ইত্যাদি কাজে যুক্ত। ২০১২ সালে চণ্ডীগড়ে বাবার একটি অনুষ্ঠান শোনার পর নীহারিকা ব্যাকস্টেজে বাবার সঙ্গে দেখা করতে যান। সেখানে বাবার নাতি বিলালের সঙ্গে দেখা হলে নীহারিকা জানতে চান বাবার সম্পর্কে জানার জন্য কোনো বই বা তথ্যচিত্র আছে কিনা। কিছু নেই জেনে তিনি অবাক হয়ে যান আর স্থির করেন তিনিই বানাবেন তথ্যচিত্র। যদিও সেটা কীভাবে বানাতে হয়, কিভাবে টাকা জোগাড় করতে হয়, কীভাবে প্রদর্শন করতে হয় — সেসবের কিছুই তিনি তখন জানতেন না। কিন্তু  শুধু একজন ক্যামেরাম্যানকে (অক্ষয়, যাঁরও এটি প্রথম কাজ) নিয়ে কীভাবে তিনি এরকম একটি শিল্পসফল, তথ্যনিষ্ঠ তথ্যচিত্রর মাধ্যমে বাবার শিল্পসাধনা, শিক্ষকতা এবং দেবপ্রতিম চরিত্রকে তুলে ধরলেন – সেটা ভেবেও আমাদের বিস্ময় হয়  বৈকি। প্রচণ্ড শ্রদ্ধা ও সাধনাই এই প্রকল্পের প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে, একথা বোঝা যায়। তবে জানিয়ে রাখা ভালো, এই প্রকল্পের জন্য সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুয়ারে ঘুরে বেড়িয়েও নীহারিকা আর অক্ষয় কোনো আর্থিক সাহায্য পান নি। 

    বিস্তৃত গবেষণা এবং  কুড়ি দিনের শুটিং করার পরও কনভিন্সড করতে পারেন নি কাউকে। অবশেষে নিজেরা অন্য কাজ  করে, সেই  উপার্জিত অর্থ দিয়ে তাঁরা এই  ফিল্মের কাজ শেষ করেন। উস্তাদ আব্দুর রশিদ খান বেঁচে থাকবেন তাঁর কণ্ঠের মাধ্যমে, তাঁর শিষ্য শিষ্যাদের বাহিত পরম্পরার মাধ্যমে। আর মানুষটিকে তাঁর সামগ্রিক সত্তায়  আমাদের হৃদয়পটে খোদিত করে রাখবে রসন পিয়া নামে এই শ্রদ্ধার্ঘ্য। নীহারিকা আর অক্ষয়ও এই পরম্পরার অংশ হয়ে গেলেন। আমাদের জন্য রেখে গেলেন হৃদয়ের রাজার খোঁজে যে পথে হাঁটতে হয় তার দিকনির্দেশ।



     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • দেখতে চাই  | 151.197.224.113 | ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৫:১৬503932
  • দারুণ 
  • Kausik Ghosh | ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৯:২৩504357
  • বাঃ! 
     মুবিতে পাবো বলেছো, দেখে নিই।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন