এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • গোধূলির গল্প

    Sandipan Majumder লেখকের গ্রাহক হোন
    ১২ জানুয়ারি ২০২২ | ৪১৫ বার পঠিত
  • সুজয় জানলার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বাবার দিকে তাকালো। বাবা ডাকছেন তাকে। বাবা অসুস্থ, সারাদিন প্রায় শুয়েই থাকেন, দুয়েকটা কথা বলেন অসংলগ্ন। এখন একটা পেন চাইছেন সুজয়ের কাছে । সুজয় একটা পেন আর কাগজ ধরল বাবার সামনে। বাবা, ভবতারিণী হাইস্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক, অনেক কষ্ট করে যেটা লিখলেন কাগজে সেটা পড়ে সুজয় একটু থমকে গেলো ‘ হু উইল টেক কেয়ার অব মি আফটার মাই ডেথ?’

    সুজয় নিজে নাস্তিক। বিজ্ঞান মঞ্চের সদস্য বলে শুধু নয়, নিজেও ভালো করে পড়াশোনা করে নাস্তিক হয়েছে – প্রবীর ঘোষ থেকে রিচার্ড ডকিন্স পর্যন্ত যতটুকু পড়াশোনা করা সম্ভব আর কি, তার ডেইলি প্যাসেঞ্জারির এই ব্যস্ত জীবনে। তাই ভাবলো এর সহজ উত্তরটাই দিয়ে দেবে । মৃত্যুর পর যেহেতু আর কিছুই থাকে না তাই তারপর আর দেখভাল করার, যত্ন নেওয়ারও কিছু থাকে না। এটাই জীবন। কিন্তু থমকে গেলো সুজয়। একজন মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকা মানুষকে তার আজীবনের বিশ্বাস থেকে সরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তার চেয়ে এমন একটা কিছু বলা দরকার যাতে তিনি আশ্বস্ত বোধ করেন। এটা কোনো মিথ্যাভাষণ নয়। এটা অনেকটা সাইকোথেরাপির মত যাতে রোগী আশ্বস্ত বোধ করেন। তাই সুজয় বাবার লেখার নিচে লিখল ‘গড’। বাবা লেখাটা পড়লেন । দুবার তাঁর ঠোঁট নড়ে উঠলো। যেন তিনি কিছু উচ্চারণ করছেন। কিন্তু কী বলছেন সেটা সুজয় ঠিক বুঝতে পারলো না। বাবা দুচোখ বন্ধ করলেন। জানলার সার্সিতে বসা প্রজাপতিটা উড়ে চলে গেলো। সুজয় মুখ বাড়িয়ে দেখলো প্রজাপতিটাকে কোথাও দেখা যায় কিনা। বাইরে অসীম শূণ্যতার ভেতর প্রজন্মান্তরের মানুষদের হাঁটাচলা টের পাওয়া যাচ্ছিলো। আর কিছুমাত্র নয়।



    বাবার মৃত্যুর পর পূর্ণাঙ্গ শ্রাদ্ধ না হলেও একটা কমপ্রোমাইজড অ্যারেঞ্জমেন্ট হয়েছিলো বাড়িতে। আসলে সুজয়ের বোনেরা আছে, তাদের একটা দাবি আছে বাবার ব্যাপারে। তারই মধ্যে যতটুকু করা যায় আর কি। সুজয় ভেবেছিলো একটা স্মৃতিচারণ সভা করবে বাবাকে নিয়ে। পরে ভেবে দেখলো ব্যাপারটা প্রহসন হয়ে যাবে। বাবার বন্ধুরা কেউই তো আর বেঁচে নেই। আছে বলতে ওই নারায়ণকাকু। শেষ বয়সে বাবার যা কিছু সংযোগ তা তো ছিল ওই নারায়ণকাকুর সঙ্গেই। কিন্তু নারায়ণকাকু তো আর লেখাপড়া শেখে নি । আর ওঁর কথা শুনবেই বা কে ? সুজয় এবং তার বোনেরা ছোটো থেকে ওকে কাকু ডাকলেও বাকি সবার কাছে তো সে একজন রিকশাওয়ালা। বাবা রিটায়ারমেন্টের পর থেকেই নারায়ণকাকুর রিকশায় চেপেই বাজার থেকে আরম্ভ করে সব জায়গায় যেতেন। আর শীতকালের প্রত্যেক রবিবার দুপুরবেলা ছিলো বাবার স্পেশাল ট্যুর। সেদিন নারায়ণকাকু রিকশায় চাপিয়ে বাবাকে শহরের প্রান্তসীমায় নানা ফাঁকা জায়গায় নিয়ে যেত। সেখানে একটা ছাতিম গাছের তলায় বাবা চুপ করে বসে থাকতেন । কিংবা কখনো নারায়ণকাকুকে জিজ্ঞেস করতেন বিভিন্ন অচেনা ফুলের নাম, পাখির নাম,গাছের নাম । নারায়ণকাকু যে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতো তা নয়। অনেক সময় বাবা উত্তর পেতে তত ব্যগ্রও থাকতেন না। এমনও হয়েছে প্রশ্ন করতে করতে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। শিশুর মত।আকাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া পাখির ঝাঁক দেখে নারায়ণকাকু ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তাঁকে বলেছে, ‘’ টুকুন, উঠেন ক্যানে। বেলা বয়ে গ্যালো যে ।“

    নারায়ণকাকুর রিকশায় এখন আর কেউ চাপে না। প্যাডেল করা রিকশায় কে আর চাপবে, টোটো আসার পর। কদাচিৎ আগের থেকে অর্ধেক ভাড়ায় দুএকজন প্যাসেঞ্জার পেলে তাঁদের নিয়ে দীর্ঘপথ পাড়ি দেয় নারায়ণকাকু। শরীর আর দেয় না। তবু বাড়িতে নিজের আর স্ত্রী মিনতির পেটদুটো তো চালাতে হবে। ছেলেটা আলাদা সংসার করেছে। এক ডাক্তারের গাড়ি চালায়। ভালো থাকুক ওরা। নারায়ণকাকুর একটা ভরসা ছিল বাবার দেওয়া মাসকাবারি টাকাটা। গত তিনবছর থেকে বাবার বাইরে বেড়োনো বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু নারায়ণকাকুর টাকাটা বন্ধ হয় নি। বাবা আকারে ঈঙ্গিতে ঠিক খোঁজ নিয়ে নিতেন নারায়ণকাকুর টাকাটা দেওয়া হয়েছে কিনা। এক পারিবারিক শুভাকাঙ্খী বলেছিলেন, দেখো, এসব কিন্তু প্যারাসাইটিক মনোবৃত্তির জন্ম দেয়।এমনিতেই তো আমাদের ট্যাক্সের টাকায় ফ্রি রেশন টেশন খাচ্ছে।

    সুজয় আপত্তি করে বলেছিল, ও তো নিতে চায় না। আমরাই তো জোর করে দি। তাছাড়া বাবার ইচ্ছে।



    বাবা চলে গেছেন আজ একমাস হল। নারায়ণকাকু আজ এসেছে। সুজয়ের মনের মধ্যে খচখচ করছিলো তাহলে কি সেই পারিবারিক শুভাকাঙখীর কথাই ঠিক ? নারায়ণকাকু কি টাকাটা নিতেই এসেছে ? কিন্তু ,এখন আর দেবো কেন টাকাটা ? ঐ টাকাটা তো বাবার জন্যই দেওয়া হত। বাবাই তো আর নেই।

    কিছুক্ষণ বসে নারায়ণকাকু উঠে দাঁড়ালো। সুজয় বলল, চললে নারায়ণকাকু ?

    নারায়ণকাকু গামছায় মুখটা মুঝে বলল ‘ হ্যাঁ।‘

    তারপর সুজয়ের মুখের দিকে স্পষ্ট করে তাকালো।

    সেই দৃষ্টির সামনে সুজয় কেমন বিহ্বল বোধ করল। বলল, দাঁড়াও নারায়ণকাকু। তোমার টাকাটা নিয়ে যাও।

    ও টাকা তো আমি নিতে পারবো না আর । উনিই তো আর রইলেন না।

    না না । এ টাকা আমি তোমাকে দিচ্ছি। তুমি আমাকে তোমার রিকশায় চাপাবে।

    কেন, তোমার তো বাইক আছে।

    সেটা আলাদা। তোমার রিকশায় চেপে ঘুরবো।

    আগে ঘোরো। তারপর টাকা দিবা।

    চলো, আজই যাবো। আজ তো রবিবার।

    বিকেল চারটের সময় রিকশা নিয়ে হাজির নারায়ণকাকু। সুজয় একটা সাদা সোয়েটার পরে বসেছে । এই সোয়েটারটা সুজয়ের স্ত্রী শ্রীপর্ণার ঠিক পছন্দ নয়। বলে সুজয়কে নাকি এটা পড়লে কেমন বুড়োটে দেখায়। যদিও উলটা খুব নরম বলে সুজয় এটা পড়তে পছন্দ করে।

    কোথায় যাবে ছোটোবাবু ?

    বাবা যেখানে যেত ।

    ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ করে রিকশা চলতে শুরু করে। এই পথটা আসলে শহরের পেছন দিকে যাওয়ার পথ । এত তাড়াতাড়ি শহরের বাইরে চলে আসা যায় যে বিশ্বাস হতে চায় না পৃথিবীতে নির্জনতা এত সহজলভ্য। একটা বড় ঝিল আছে এখানে। ওপারে কিছু দোকানপাটও আছে। কিন্তু তাতে এপারের নির্জনতা ভঙ্গ হয় না। মাতাল বা প্রেমিক প্রেমিকারা আজকাল আর নির্জনতা খোঁজে না। গোপন করার মত কিছু তাদের নেই।

    ছাতিম গাছটার তলায় একটা বেদী আছে। কবে কারা বানিয়েছিল কে জানে। এখানেই বাবা বসত।

    সেখানে বসেই সুজয়ের বিকেলটা কেটে যায়। কে জানে ক্লান্ত ছিল বলে কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছিল কিনা। হঠাৎ গাটা শিরশির করে ওঠে। টের পায় সন্ধ্যে নামছে। কুয়াশাও। শ্রীপর্ণার কথা মনে পড়ে। বাড়ি ফিরতে হবে। কোথাও কাউকে দেখতে পায় না সুজয় ।

    সুজয় চিৎকার করে নারায়ণকাকুকে ডাকার চেষ্টা করে । গলা দিয়ে স্বর বেরোয় না। তখনই বুঝতে পারে বাবা সেদিন ঠোঁট নেড়ে কী বলছিলেন।

    বলছিলেন, নারায়ণ, নারায়ণ।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন