এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • গোলকিপার - ১

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৮ ডিসেম্বর ২০২১ | ৮৫৬ বার পঠিত
  • ‘রাতদিন মাঠে ঘাটে খেলে বেড়ালে কি আর পড়াশোনা হয়। আমি মরলে ছেলের কি দশা যে হবে ঈশ্বরই জানেন। সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারিনা নানা ভাবনা চিন্তায়’ - এ হল নিতুর বাবা সত্যেন প্রামানিকের নিজের একমাত্র সন্তান সম্পর্কে দৈনন্দিন খেদোক্তি। নিতুর মা মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন এই সময়ে। জানেন যে, তার এ সময়ে যে কোন বাক্যস্ফূরণ হওয়া মানে আগুনে ঘি পড়া। তার অবারিত প্রশ্রয়ই যে নিতুর জীবন বরবাদ হওয়ার পথ সুগম করছে সে ব্যাপারে সত্যেনবাবুর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তাই দুর্বিষহ অগ্নুৎপাতের প্রবাহ থেকে বাঁচবার উদ্দেশ্যে নিতুর মা বোবা এবং কালা হয়ে যান।

    নিতু যথারীতি আবার ফেল করেছে। অংক আর ইংরীজি সহ চার সাবজেক্টে ফেল। ক্লাস সেভেন থেকে এইটে ওঠা এক কঠিন গাঁট হয়ে দাঁড়িয়েছে নিত্যানন্দের কাছে। রিপোর্ট কার্ড হাতে নিয়ে ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। তার শোকের কারন যতটা না পরীক্ষায় অকৃতকার্যটাপ্রসূত তার চেয়ে বেশি তার রগচটা বাবা সত্যেন প্রামানিকের সম্ভাব্য ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়ার ভয়জনিত।

    তার জনা তিনেক সুহৃদ বন্ধু অবশ্য তাকে ছেড়ে বাড়ি চলে যায়নি। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল এবং তার বাবার রাগের ঝাপটা থেকে বাঁচবার নানা বিচিত্র কৌশল উদ্ভাবন করতে ব্যস্ত রইল। পরিত্রাণের নানাবিধ অগ্রহণযোগ্য পরিকল্পনা নিয়ে বিস্তর নাড়াচাড়ার পর অবশেষে সাত্যকি একটা মোটামুটি বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ রূপায়ণের প্রস্তাব দিল।

    আমতায় তার মাসির বাড়িতে নিতু কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারে। সাত্যকির বক্তব্য অনুযায়ী তার মাসি অত্যন্ত স্নেহপরায়ণা এবং সাত্যকিকে তিনি পুত্রবৎ স্নেহ করেন। সুতরাং নিতুর সেখানে গিয়ে কিছুদিন থাকবার বন্দোবস্ত সাত্যকি অনায়াসেই করতে পারবে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হলে ছেলের অকস্মাৎ নিখোঁজ হওয়ায় অনিবার্য অপত্যস্নেহজনিত দৌর্বল্যের কারণে নিতুর ওপর তার বাবার উষ্মার প্রাবল্যে ভাঙন ধরা নিশ্চিৎ বলেই মনে হল তিন বন্ধুরই। তার মায়ের কথা তাদের আলোচনায় বিশেষ বিবেচিত হল না। কারণ নিতুর মা নিবিড় কোমল তরল স্নেহপরবশ আর পাঁচজন সাধারণ বঙ্গজননীর প্রকৃষ্ট প্রতিমূর্তি। তার মোকাবিলা করা বিশেষ কষ্টের ব্যাপার হবে বলে মনে হল না ওদের।

    সাত্যকি প্রথমে নিতুকে ওদের বাড়ি নিয়ে গেল, তারপর ওখান থেকে পরটা আর আলুভাজা খেয়ে মাসির বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল অন্তত দিন তিনেকের জন্য। সাত্যকির মাসি চন্দনা সাঁতরা তো অপ্রত্যাশিতভাবে বোনপো এবং ফাউ হিসেবে তার এক বন্ধুর আবির্ভাবে তো একেবারে আহ্লাদে আটখানা। চন্দনা দেবী হলেন গুচ্চের লোকজনের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শের উত্তাপে নিরন্তর জড়িয়ে থাকতে চাওয়া মার্কা মারা মফস্বলি মাসীমা। তিনি যে উৎফুল্ল হবেন এতে আশ্চর্যের কিছু নেই।

    সাত্যকির মেসোর বন্ধু জগন্নাথ সরকার চিন্তাকুল মুখে মেসোর ঘরে মুখ গোঁজ করে বসে ছিলেন। সামনে চায়ের কাপ ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। সন্ধে সাতটা বাজে ।জগন্নাথবাবু কর্পোরেশন ব্যাঙ্কে চাকরি করেন। সেটা তার পেশা। তাছাড়া তার একটা পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া ব্যবসাও আছে। দুটো আলুর হিমঘর। সেখান থেকে তার আয়পয় ভালই। কিন্তু নেশাটা অন্য জায়গায়। তার একটা ফুটবল টিম আছে। ফুটবল ক্লাবও বলা যেতে পারে। সেটাই তার হৃদপিন্ড। আমতা সুহাসিনী স্পোর্টিং ক্লাব। সুহাসিনী হল জগন্নাথ সরকারের পরলোকগতা স্ত্রীর নাম।

    সে যাই হোক, সুহাসিনী কিন্তু আন্ত হাওড়া জেলা ক্লাব টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতা শুরু হতে চলেছে আগামী পরশু থেকে। প্রথম দিনই সুহাসিনী স্পোর্টিংয়ের খেলা পড়েছে পুরুলিয়ার একটা ক্লাবের সঙ্গে হাওড়া স্টেডিয়ামে। ওটাই উদ্বোধনী ম্যাচ। ক্রীড়ামন্ত্রী টু্র্নামেন্ট উদ্বোধন করবেন। একজন প্রাক্তন প্রখ্যাত ফুটবলার উদ্বোধনী ম্যাচে উপস্থিত থাকবেন। এখন, জগন্নাথের দুশ্চিন্তার কারণ হল, পরশু দিনই খেলা পড়েছে, অথচ তার টিমের গোলকিপার, যে তার দলের মস্ত বড় ভরসা কাল প্র্যাকটিস করতে গিয়ে মোক্ষম চোট খেয়ে বসে আছে ডান পায়ের গোড়ালিতে। এক্স রে রিপোর্ট বলছে লিগামেন্টের অবস্থা খুব খারাপ । অন্তত পনেরদিন মাঠে নামার প্রশ্নই ওঠে না। জগন্নাথের রাতের ঘুম চলে গেছে।

    সাত্যকির মেশোমশাই পরিমলবাবু বেশ বিপন্ন বোধ করছিলেন। তার বন্ধুর এমন ঘোর সমস্যায় তিনি কি পরামর্শ দিতে পারেন তার মাথায় আসছিল না। তিনি এই আশু সমস্যার সমাধানের কোন পথ না পেয়ে গতানুগতিক কথাটাই বললেন — ‘ অন্য আর কেউ রিজার্ভে নেই ? যদি খেলে দিতে পারে .....’
    — ‘আরে থাকবে না কেন .... সৈকতই তো আছে, সৈকত সাঁপুই। কিন্তু ..... গোলকিপিং একটা স্পেশালিস্ট জায়গা। ক্রিকেটে উইকেটকিপারের মতো। সেখানে আজারকে রিপ্লেস করার মতো স্টাফ সৈকত নয়। ওর অনেক প্রবলেম আছে। বিশেষ করে এয়ারে বল গ্রিপিং-এ ......’

    এই পর্যন্ত বলে জগন্নাথ একটা সুদীর্ঘ শ্বাস ছাড়লেন। তারপর বললেন, ‘সবই কপাল ..... যাই দেখি কি করা যায়। এখনও কালকের দিনটা হাতে টাইম আছে। উপায় একটা বার করতে হবে। গোলকিপার ..... লাস্ট লাইন অফ ডিফেন্স। ভাইটাল পজিশান ..... বুঝতে পারছ ....’। জগন্নাথবাবু কাপের চা টা এক চুমুকে শেষ করে ‘দেখি কি করা যায় ... ’, বলে উঠে পড়লেন।

    পরদিন সকালে রেল লাইনের পাশের মাঠে জগন্নাথ পুরো টিমকে প্র্যাকটিসে নামালেন। গোলকিপার সংক্রান্ত দুশ্চিন্তা তার মাথায় চেপে বসে আছে। একটা দুর্ভেদ্য গোলকিপার একটা দলকে সাফল্যের চূড়ায় টেনে তুলতে পারে.... লাস্ট লাইন অফ ডিফেন্স। ওখানে দাঁড়িয়ে প্রতি মুহুর্তের অতন্দ্র প্রহরী। তার অনুমানের সামান্য ভুলচুকের পরিণতি তার দলের শোচনীয় ভরাডুবি ডেকে আনতে পারে। স্ট্রাইকার একটা গোল মিস করলে আবার সুযোগ পেতে পারে। একজন ডিফেন্ডার ভুল করে ফেললেও অন্য কোন ডিফেন্ডার সামাল দিয়ে দিতে পারে। কিন্তু গোলকিপার হল যৌথ পরিবারের নানা সমস্যা মোকাবিলার দায়িত্ব বহন করা এক একাকী নির্জন গৃহকর্তা। দলের বাকিরা দায়িত্ব পালন করে যৌথভাবে। আর গোলকিপার যাবতীয় ঝক্কি সামলায় সঙ্গীহীন একাকী।

    মিনিট কুড়ি প্র্যাকটিসের পর তিনি সৈকত সাঁপুইকে গোলে দাঁড় করিয়ে ছেলেগুলোকে পেনাল্টি কিক নেওয়াতে বললেন আবীরকে। আবীর মানে, আবীর দাস। টিমের ফিজিক্যাল ট্রেনার কাম কোচ। ওকে পয়সাকড়ি কিছু দিতে পারেন না জগন্নাথবাবু, তবে জগন্নাথবাবুর বাড়ি তার দুবেলা দুটো মিল বাঁধা। তাছাড়া অসুখ বিসুখে চিকিৎসা, ওষুধপত্তর সব দায়িত্ব জগন্নাথ নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। আবীর পিতৃহীন এবং আর্থিক বিচারে খুবই দরিদ্র। এটুকু সহায়তাই তার কাছে অনেক। প্রতিদানে সে নিজেকে নিংড়ে দেয়। শুধু টিমের কোচিংই করানো নয়, টিম ম্যানেজিং-এর যাবতীয় কাজ, জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ সব সে পরম নিষ্ঠা এবং ভালবাসা দিয়ে করে। আবীরের গেম রীডিং খুব উঁচু মানের। অনেক খ্যাতনামা কোচের চেয়েও বেশি। অনেক ম্যাচে সঠিক সময়ে সঠিক প্লেয়ার বদল করে সে অনেক ম্যাচের রঙ বদলে দিয়েছে। প্রধানত এই কারণেই জগন্নাথবাবু তাকে এত ভালবাসেন এবং ওর ওপর নির্ভর করেন।

    নিত্যানন্দ আর সাত্যকি দুই দোস্ত ভোরবেলায় বেরিয়ে পড়েছে। রেললাইন দিয়ে একটা এক্সপ্রেস ট্রেন গেল ঝড়ের বেগে। রাস্তার দুপাশে গাছগুলোয় পাখিরা জেগেছে। তাদের কলরব মুখরিত প্রভাতবেলা। নিতু পোশাক আশাক কিছু আনতে পারেনি। তার পায়ে একজোড়া কেডস পরা ছিল। সেটা পরেই বেরিয়েছে ভোরবেলায়। সারারাত দু:স্বপ্নে বাবার ভীষণ রেগে থাকা মুখ দেখেছে। ঘুম ছুটে গেছে বারংবার। এখানে এই পাখির মনোরম কলকাকলির মধ্যেও বাবার রাগ এবং আক্ষেপ মেশানো মুখটা মাঝে মাঝে মনের মধ্যে ঝিলিক দিয়ে উঠছে, আর নিতু আঁতকে আঁতকে উঠছে।

    সাত্যকি বলল, ওই বাগানটা পেরোলেই রেলের মাঠ। ওখানে প্র্যাকটিস করে এ এরিয়া থেকে অনেক প্লেয়ার উঠেছে। মাঠ পেরোলে রেললাইন। আমাদের আমতা স্টেশনটা খুব ছিমছাম সুন্দর নিরিবিলি। অনেকে বেড়াতে আসে এখানে কলকাতা থেকে। আর স্টেশনের ধারের মিস্টির দোকানের ল্যাংচা খেলে জীবনে ভুলতে পারবি না। কোথায় লাগে তারাপীঠের বা বাগনানের ল্যাংচা।বিকেলে তোকে নিয়ে যাব ল্যাংচা খেতে।

    নিত্যানন্দ আনমনে চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছিল। সাত্যকির কথাগুলো এলেমেলোভাবে এপাশে ওপাশে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। ঠিক মাথায় ঢুকছিল না। শুধু বাবার উগ্র উষ্মার মুখে পড়ার ব্যাপার নয়, বার বার ফেল করে এক ক্লাসে পড়ে থাকার যন্ত্রণাময় গ্লানিতে সে একেবারে ভেঙেচুরে যাচ্ছিল ভিতর থেকে।এই স্বচ্ছ অমল ভোরবেলায় মার কথা মনে পড়ে তার কান্না পেতে লাগল। তার পাশাপাশি চুপচাপ হাঁটতে দেখে সাত্যকি নিতুর মনের কিছুটা আন্দাজ পেল। বলল, ‘মন খারাপ করিস না, মাসীমা মেশোমশাই তোর খবর ঠিক পেয়ে যাবে। পিনাকিরা নিশ্চয়ই যোগাযোগ করেছে। শুধু কোথায় আছিস না বললেই হল। সেটা নিশ্চয়ই ওরা বলে নি। অত চিন্তা করছিস কেন? মেশোমশায়ের রাগটা একটু পড়লেই তো ফিরে যাবি। আর স্কুলে হেডস্যারকে বলে দেখা যাক না কিছু করা যায় কিনা।’

    নিতুর মনে চিন্তার জট এসব কথায় একটুও কাটল না। সে একবুক মনোকষ্ট নিয়ে সাত্যকির সঙ্গে রেলের মাঠের দিকে হাঁটতে লাগল।

    মাঠের ধারে দুজনে পৌঁছে দেখল সুহাসিনী স্পোর্টিং-এর ছেলেরা প্র্যাকটিসে নেমেছে। জগন্নাথ সরকার মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে আবীরের সঙ্গে কি সব আলোচনা করছে। দুজনকেই বেশ চিন্তাকুল দেখাচ্ছে।

    মিনিট কুড়ি প্র্যাকটিসের পর আজারের বিকল্প গোলকিপার সৈকত বারের নীচে দাঁড়াল। পাঁচজন পেনাল্টি শট নিল। পাঁচটাতে পাঁচটাই গোল খেল সৈকত। হয় উল্টোদিকে ঝাঁপাল আর নয়ত শটের গতিতে পরাস্ত হল ল্যাজেগোবরে হয়ে। জগন্নাথের মুখ দুর্ভাবনার যন্ত্রনায় কুঁচকে গেল। প্যান্টের দু পকেটে হাত ঢুকিয়ে মাথা নীচু করে কি চিন্তা করতে লাগল বিষাদগ্রস্ত হয়ে।

    নিতু আর সাত্যকি মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে প্র্যাকটিস দেখছিল। দেখতে দেখতে নিতুর হাত পা নিশপিশ করতে লাগল। আবছা হয়ে যেতে লাগল চার সাবজেক্টে ফেলের গ্লানি, স্কুলের ক্লাসঘর, হেডস্যারের গম্ভীর মুখ, বাবার রাগ, মায়ের দু:খ। চোখের সামনে, মনের ঘরে জেগে থাকল শুধু রেলের মাঠের এক পাশের গোলপোস্ট।

    নিতু নিজের অজান্তেই হাল্কা লাফ দিতে দিতে দুহাত আড়াআড়ি ওপর নীচ করতে লাগল। সে বোধহয় একটা খেলার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। সাত্যকি ওকে ভালরকম চেনে। সে একটুখানি তাকিয়ে থাকল নিতুর দিকে। তারপর বলল, ‘কিরে .... দাঁড়াবি নাকি বারের নীচে .... কাকুকে বলব?’

    নিতুর ম্লান মুখে যেন সহসা ভোরের শুভ্র আলো এসে পড়ল। সে লাফানো থামিয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘ও দেরিতে নড়ছে। সেই জন্যে হচ্ছে না ....’ নিতু মাঠের দিকে চেয়ে রইল। সাত্যকি আবার বলল, ‘কিরে .... জগন্নাথ কাকুকে বলব নাকি?’
    সাত্যকি মৃদু হেসে মৌন রইল। বলল, ‘ওরা কি রাজি হবে!’
    — ‘আরে দূর ..... তুই আয় না...’

    জগন্নাথবাবু এত আত্মনিমগ্ন ছিলেন যে এতক্ষণ ওদের খেয়ালই করেন নি। নিতুরা সামনাসামনি আসতে তার নজর পড়ল।
    — ‘কিরে তোরা কখন এলি? দেখতে পাইনি তো .... ’
    — ‘অনেকক্ষণ .... আপনি ব্যস্ত ছিলেন বলে খেয়াল করেন নি। কাকু .... বলছিলাম যে নিতু খুব ভাল গোলকিপার। আপনি যদি পারমিশান দেন একটা ট্রাই করতে পারে.... ওই পেনাল্টি আটকাতে.....’, সাত্যকি প্রস্তাব রাখে।

    জগন্নাথবাবু স্নেহ, প্রশ্রয় এবং দাক্ষিণ্য মিশ্রিত স্বরে দুহাত উল্টে হতাশামাখা হাসি হেসে উদার ভঙ্গীতে বলেন, ‘আ....চ্ছা ট্রাই করুক .... চাইছে যখন ... ক্ষতি কি .... আবীর .... আবীর, এই যে ..... এই ছেলেটা যাচ্ছে.... দেখ একটু ....’, বলে মাঠের একধারে গিয়ে মাথা নীচু করে কি সব চিন্তা করতে করতে পায়চারি করতে লাগলেন।

    নিত্যানন্দ প্যান্ট খুলে ফেলল। ভিতরে শর্টস পরা ছিল। একটু ছুটে গিয়ে ছোট লাফ মেরে ক্রসবার ছুঁয়ে নিল। গোললাইনের মাঝখানে পা দিয়ে দাগ কেটে নিল। দাঁড়াল দুপা ফাঁক করে দু হাত দিয়ে আলতো করে দুটো হাঁটু ছুঁয়ে।

    গোলপোস্ট আগলে দাঁড়িয়ে বিপক্ষের আক্রমণ রোখা, জীবনে এই একটা কাজই সে ভালভাবে করতে পারে। নিতু একজন গোলকিপার । তার খালি মনে হয় গোল বাঁচানোর জন্যই তার জন্ম হয়েছে। গোলকিপিং বাদে তার বাকি জীবনটা একটা বিরাট শূন্য।

    পেনাল্টি বক্সে বল বসিয়েছে একজন। নিতু গোললাইনের ওপর মৌমাছির মতো নাচতে লাগল দুপায়ের টাপুর টুপুর ছন্দে।

    প্রথম শট নিল প্রশান্ত নাথ। শক্ত পোক্ত চেহারার ছেলে। কিকে খুব পাঞ্চ আছে। নিতু চোখ দেখে বুঝে নিল তার বাঁদিকে মারবে। প্রশান্ত কিক নিল। হ্যাঁ নিতুর বাঁদিকেই রাখল। স্ট্রং পাঞ্চ । নিতু দুপায়ে নাচতে নাচতেই বিদ্যুৎ গতিতে বাঁদিকে সরে গেল বল পৌঁছবার আগেই। এত দ্রুত মুভ করল যে বডি থ্রো করার দরকারই হল না। স্রেফ বাঁ পা দিয়ে শটটা আটকে দিল। শরীরের বিদ্যুৎগতির নড়া চড়াই নিত্যানন্দের গোলকিপিং-এর মূলমন্ত্র।

    পরের শট নিল শেখ সেলিম। জোরাল গড়ানো শট প্লেস করল গোলপোস্টের ডানদিকের কোনে। নিতু আন্দাজে ভুল করে বাঁ দিকে হেলেও তার জন্মগত রিফ্লেক্সের গুনে সেকেন্ডের ভগ্নাংশে ডানদিকে সুইচ করে শরীর ফেলল। এটা যে গোল হল না তার বিশ্বাস পাকা হতে উপস্থিত সকলের অন্তত দশ সেকেন্ড সময় লাগল। প্রায় তিরিশ গজ দূরে চিন্তাকুল চিত্তে পায়চারি করতে করতে হঠাৎ থেমে গেলেন জগন্নাথ সরকার। সম্মোহিত চোখে তাকিয়ে রইলেন পেনাল্টি শ্যুট আউটের দিকে।

    পরের শট নেবে তড়িৎ বিশ্বাস। টিমের পেনাল্টি কিক এক্সপার্ট বলা যায় তাকে। মাটিতে বা বাতাসে কখন কিভাবে বল রাখে কোন গোলকিপার আন্দাজ পায় না।

    নিতু কিন্তু ধরে নিল। এ দক্ষতা তার জন্মগত। পৃথিবীতে একটা কাজই সে ঠিকমতো করতে পারে — গোলকিপিং।

    তড়িৎ সাধারণত তড়িৎ গতিতে কিক নেয় না। এখানেও নিল না। বলের তলায় বাঁ পায়ে আলতো চাঁটা মারল পোস্টের মাঝামাঝি বল রেখে জিনেদিন জিদানের অনুকরণে। পোস্টের ডানদিকেও না, বাঁদিকেও না, মাঝখান দিয়ে ঝরাপাতার মতো বাতাসে ভাসতে ভাসতে গোলে ঢুকছিল বল। নিতু ধোঁকা খেয়ে গেল। গোলের মাঝখানে পেনাল্টি কিক গেলে গোলকিপার তো ধোঁকা খাবেই। সে আন্দাজমতো পোস্টের একদিকে শরীর নিয়ে ফেলে। নিতুও তাই করল। ডানদিকে ব্যালান্স শিফট করে ফেলেছিল। তারপর বিস্ময়করভাবে বলের দিকে চোখ রেখে চিৎ সাঁতার কাটার মতো শরীর ভাসিয়ে দিল হাওয়ায়। উড়ন্ত অবস্থাতেই ফিস্ট করে বারের ওপর দিয়ে বল তুলে দিল।

    তিরিশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে থাকা জগন্নাথবাবুর মাথায় চারশো চল্লিশ ভোল্টের স্পার্ক লাগল। তিনি নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন সবে গোঁফের রেখা বেরনো একটা ছোটখাটো চেহারার দুর্ভেদ্য গোলরক্ষীর দিকে। গলায় হুইসল্ ঝোলানো আবীর ঘোষ সাবাশ ....সাবাশ.... এক্সেলেন্ট .... এক্সেলেন্ট ....এইসব বলতে বলতে নাগাড়ে হাততালি দিতে লাগল। জগন্নাথ সরকার চুপচাপ এগিয়ে আসতে লাগলেন গোলপোস্টের দিকে। তার মাথার মধ্যে নানা রঙীন স্বপ্ন ফের মাথা চাড়া দিয়ে উঠে বসছে।

    বাকি দুটো শট নিতু অনায়াসে বাঁচাল। একটা বুলেট পাঞ্চ বারের ওপর দিয়ে তুলে দিয়ে । আর একটা মাটিতে দলের স্ট্রাইকার কুন্তল চক্রবর্তীর তীব্র গতির শট — বাঁদিকে বডি ফেলে একদম স্প্রিং-এর মতো।

    জগন্নাথ বক্সের মাথায় দাঁড়িয়ে মাথা নীচু করে কি ভাবতে লাগলেন। তারপর চোখ তুলে নিত্যানন্দের দিকে তাকিয়ে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। তারপর আবার মাথা নীচু করে মনে মনে কি ছক কষতে লাগলেন। তারপর আবার মুখ তুলে নিতুর দিকে তাকিয়ে রইলেন বিস্ময়স্পৃষ্ট দৃষ্টিতে। তার দু চোখের তারা উজ্জ্বলতায় উদ্ভাসিত হয়ে কাঁপতে লাগল।

    একটু পরে নিতুর কাঁধে হাত রেখে জগন্নাথবাবু বললেন, ‘নিতু তোমার বাবার মোবাইল নম্বরটা যে চাই বাবু .... তার পারমিশান ছাড়া তো আমার কিছু করা উচিৎ নয় .... তাই না?’
    নিত্যানন্দ আঁতকে উঠল এ কথা শুনে, ‘না না বাবার নম্বর আমি জানি না .... আমি সত্যি জানি না.... চল চল সাত্যকি .... বাড়ি চল।’ ভয়ে নিতুর মুখ শুকিয়ে গেল এক নিমেষে। সাত্যকিকে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেল রেলের মাঠ পেরিয়ে রাস্তার দিকে।

    জগন্নাথ সহ তার পুরো দল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল পলায়মান আতঙ্কগ্রস্ত এক দুর্ধর্ষ গোলকিপারের দিকে।

    (পরের অংশ পরের পর্বে)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • bhanga gala | ০৯ ডিসেম্বর ২০২১ ০০:৪৬501881
  • প্রায় মতি নন্দী , পুরোটা নয়
  • kk | 68.184.245.97 | ০৯ ডিসেম্বর ২০২১ ০৩:২২501882
  • "মার্কামারা মফস্বলী মাসীমা" হবার ক্রাইটেরিয়া কী কী? শহুরে মাসীমাদের সাথে এঁদের তফাৎই বা কী?
  • &/ | 151.141.85.8 | ০৯ ডিসেম্বর ২০২১ ০৪:৪২501883
  • মার্কামারা মফস্বলী মাসীমা!!!! শুধু তাই না, পদবীগুলোর দিকে খেয়াল করলেও শক লাগে। সাঁপুই, প্রামাণিক ইত্যাদি ইত্যাদি। ফেল টেল করে ফুটবল খেলে বেড়াবে তো এরাই! সেখানে কি আর মুখুজ্জে বাড়ুজ্জেদের সুবর্ণচন্দ্র সন্তানেরা আসবে?
    কী সাংঘাতিক প্রচ্ছন্ন রেসিজম আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে!!!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন