ঝামেলাটা আজকেই হল । বলে কিনা উত্তর দিকের দেওয়াল বরাবর কিছু রাখতে নেই ।
বাস্তু দোষ হয় ...
জীবনে কিচ্ছু লুকোতে পারিনি । না নিজেকে না নিজের কপালকে । বিয়ের ঠিক আগের দিনই বউকে লুকোতে গিয়েছিলাম নিজের ভাগ্য । পারিনি । শশুরবাড়িতে অম্বল লুকোতে গিয়েও একই অবস্থা । চাকরি জীবনের শুরুতে নিজের আঁতলামি আর বাবা হবার আগে ডাক্তারের কাছে নিজের জ্ঞান , সওওব লুকোতে গিয়েও বারবার ধরা পড়ে গেছি । ঘনিষ্ট লোকজনেরা বলে আমার ফাটা কপাল , তাই সব দেখা যায় । তা বেশ । সত্য স্বীকারে আমার অসুবিধা নেই ।
সংসার যখন নিজের হল তখন থেকেই চেষ্টা করি নিজের ফাটা কপালের দোষগুলো প্রানপনে বাইরে রেখে ঘরে আসার সময় কপাল সেলাই করে আসার । যেমন ধরুন ঠিক যে সময় ফ্লিপ কার্টে দিনের বেলায় সেল শুরু হয় সেদিনই আমার বাইরের সবচেয়ে ইম্পর্টেন্ট কাজ মনে পড়ে । আবার রাতে যখন সহধর্মিনীর কোন অভাব অভিযোগের কথা শোনাতে ইচ্ছে হয় ঠিক তখনই সারাদিনের খাটুনির অজুহাতে এত তীব্র মাথা ব্যাথা হয় যে ওনার অভিযোগের থেকেও আমার ব্যথার চোটে কাহিল হয়ে যাওয়ায় উনি নিজেকেই অপরাধী ভেবে বসেন । এছাড়াও টুকটাক ব্যাপারে ইম্পর্টেন্ট ফোন তো আছেই । আমার মনে হয় নব্বই শতাংশ মধ্যবিত্ত পুরুষ মানুষ এভাবেই জীবন চালান । একেই মনে হয় সংসার বলে ।বেশ চলছিল । কেটে যাচ্ছিল বেশ ।
লকডাউন এসেই সমস্যা শুরু হল । আস্তে আস্তে মনে হল ফেটে যাওয়া কপালটা আরো একটু একটু করে চওড়া হচ্ছে । এখন আর বাইরে যাবার তাড়া নেই । তাই লুকানোর কিছুই নেই । এখন সারাদিনের ক্লান্তি নেই ,তাই মাথাব্যথায় কাহিল হয়ে যাওয়াও নেই । চাকরিক্ষেত্র বন্ধ ,তাই ইম্পর্টেন্ট কল আসছে বলতে দ্বিধা লাগে মনে । সর্বপরি বাইরের খাবারও বন্ধ তাই অম্বলও হতভাগা সাথ ছেড়েছে । সমস্যা অন্য জায়গায় ।
প্রায় প্রতিদিন অল্প অল্প করে ক্ষয়ে যাচ্ছি জানেন । শরীরে নয় । মনের দিকে । ঘটা করে ব্রাইট ফিউচারের আশায় ছেলে ইনজিরি মিডিয়ামে । সাধ্যের বাইরে তবে সাধের নয় । এখন শুনেছি বাংলা মিডিয়াম নাকি ন্যাস্টি । লকডাউন বেশ চলে ছেলের অনলাইন ক্লাস । এখন আবার গার্জেন রা মিলে হোয়াটস এপ গ্রূপে এড করেছে । ছেলের মা হাত তুলে স্বীকার করেছে ওসব গ্রূপে উনি নেই । ওই সব টেকনিক্যাল উনি বোঝেন না । অগত্যা আমার নম্বরই এড হয়েছে গ্রূপে । সমস্যা শুরু । যদিও এখনও পর্যন্ত্য খুলে দেখিনি গ্রূপে আছে টা কি । শুধু টুক টাক মেসেজের আওয়াজ আসতে বিরক্ত হয়ে মিউট করে রেখেছিলাম । ছেলের মা ই দায়িত্ব নিয়ে রোজ রাতে সব চেক করে মন দিয়ে ।
সকালে বউকে বাজারে পাঠিয়ে বাপ ব্যাটা মিলে ঘর পরিষ্কার করছিলাম । সব জিনিসপত্র ,আসবাব যা ছিল সব ঝাড়পুছ করে তকতকে ঝকঝকে করে নতুন ভাবে পজিশন করে বাপ,ব্যাটা মিলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলাম ওর মাকে সারপ্রাইস দেব । একটা অদ্যিকালের পুরোনো সোফা কে বিছানার চাদর দিয়ে পরিপাটি করে ঠিক টিভির সোজাসজি করে রেখেছিলাম । ড্রেসিং টেবিল টা উত্তর দিকে বিছানার পাশেই রাখলাম । গত বছর কাঁচটা ভেঙেছিল । কিনবো কিনবো করেও কিনে উঠতে পারিনি নতুন । বাধ্য হয়ে বউ একটা আয়না নিয়ে এসেছিল তাও সাইজ ছোট । ফাঁকা জায়গাটা কালারফুল রবিবাসরীয় দিয়ে সুন্দর ভাবে মেকাপ করে দিলাম । ছেলেকে ছোট বেলার স্নান করানোর টুলটা উল্টে কাপড় বিছিয়ে ওর ওপর জলের বোতল গুলো রাখলাম ।ক্ষয়ে যাওয়া আলনার পায়াটা ডিস্টার্ব দিচ্ছিল খুব । দেওয়ালের সঙ্গে সেট করে পুরো একটা ওয়ান বি এইচ কে মার্কা লুক দিয়ে বিজ্ঞ নজরে অপেক্ষায় ছিলাম উনি এসে কি বলেন । কিন্তু বললাম না কপাল ফাটা । উনি এসেই হাউমাউ । নাম তো দূরে থাক । ছেলেকে একচোট নিল । বুঝলাম আমারটা পছন্দ হয়নি একবারে । আমারও পছন্দ হয়নি । হল ও খুব । দু ঘন্টা প্রায় ।
রাগ হচ্ছিল বুঝলেন । সার্থক প্রেমিক কোন দিনই ছিলাম না । ব্যর্থ স্বামীও হলাম মনে হয় । রাগের চোটে জিজ্ঞাসা করতে বললো উত্তর দিকের দেওয়াল নাকি ফাঁকা রাখতে হয় । বাস্তু । আমিও নাছোড় । চললো অনেক ক্ষণ । আরো চলতো । মাঝে হাত থেকে পড়ে ফোনটা ভাঙলো । ভয়ে না লজ্জায় না আফশোষ এ কে জানে চুপ হয়ে গেলাম দুজনেই ।
সালা তিন হাজার গেল । ফোন সারিয়ে নিয়ে এসে সব রিস্টোর করছি এক এক । ছেলের স্কুলের হোয়াটস এপ গ্রূপ সব্বার আগে রিস্টোর হল । ২৩৫ মেগাবাইট । জীবনে দেখিনি । আজ দেখলাম । পড়াশোনা সংক্রান্ত মাত্র ছয় কি সাতটা মেসেজ ।
বাকি...
বাকি গার্জেন দের এগারো টা সেনকো গোল্ড এর নতুন সোনার হারের ।
প্রায় নটা নীলকমল এর লেটেস্ট মডেল এর ডাইনিং টেবিলের ।
তিনটে কিং সাইজ ড্রয়ার দেওয়া বেড ।
আঠারো খানা মালদ্বীপ ট্রিপের ছবি ।
ডবল ডোর ফ্রিজের চারটা ।
ফ্রন্ট লোডেড ফুললি অটোমেটিক ওয়াশিং মেশিন দুটো ।
মাত্র দুটো থ্রি বি এইচ কে এর গৃহপ্রবেশ ।
আর দেখতে পারিনি । এখন বুঝছি উত্তর দিকের দেওয়াল টা খালি রাখা খুব দরকার । অনলাইন ক্লাসে খালি দেওয়াল ই দেখায় শুধু । খালি কপাল না ।
বললাম না । কপাল ফাটা । লুকোতে পারি না । বউ মনে হয় প্রথম বুঝেছিল ।
এখন আমিও বাস্তু মানি ।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।