এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  স্মৃতিকথা

  • কাবুলের বইওলাঃ পর্ব ৩

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | স্মৃতিকথা | ০৬ নভেম্বর ২০২১ | ১৩৬০ বার পঠিত
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩
    (৩)

    বই পোড়ানো

    নভেম্বর বিকেলের বরফজমা ঠান্ডায় কাবুলের চারহাই-এ-সদারতের মোড়ের মাথায় চলছে এক বহ্ন্যুৎসব। অগ্নিকুন্ড ঘিরে জড়ো হয়েছে রাস্তার ছেলেপুলের দল, তাদের নোংরা মুখে খেলা করছে আগুনের শিখার ছায়ার নড়াচড়া । ওরা নিজেদের মধ্যে বীরপুরুষ হওয়ার খেলায় মেতেছে — আগুনের কাছে কে বেশি ঘেঁষতে পারে! বড়রা অগ্নিশিখার দিকে একনজর তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সেই ভাল; সবাই জানে যে এই আগুন কোন চৌকিদার হাত সেঁকতে জ্বালায় নি। এ পবিত্র অগ্নিকুন্ড, এ হল ঈশ্বরের উদ্দেশে নিবেদিত হোমকুণ্ড।

    পবিত্র আগুনে দুমড়ে মুচড়ে কুঁকড়ে ছাই হচ্ছে রাণী সুরাইয়ার স্লীভলেস পোষাক, একই দশা তাঁর মৃণাল ভুজ ও গম্ভীর মুখের ছবির। রেহাই পান নি তাঁর স্বামী রাজা আমানুল্লা, বুকভরা একগাদা মেডেল সমেত তিনিও পুড়ছেন। আগুনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে রাজবংশের মিছিল, আফগানি পোশাকে ছোট মেয়ের দল, ঘোড়সওয়ার মুজাহিদীন এবং কান্দাহার মণ্ডির চাষিরা।

    সেই নভেম্বর বিকেলে ধর্মরক্ষক পুলিশের দল সুলতান খানের বইয়ের দোকানে ভেবেচিন্তে ঢুকেছিল। কোন বইয়ে যদি প্রাণীর ছবি থাকে, মানুষ বা পশুর, তাকে শেলফ থেকে টেনে নামিয়ে সোজা আগুনে ছুঁড়ে দিতে হবে। হলদে হয়ে যাওয়া পাতা নির্দোষ পোস্টকার্ড বা পুরনো আকর গ্রন্থের শুকনো মুচমুচে পাতা – সব গেল ওই খাণ্ডব দহনে।

    অগ্নিকুণ্ডের চারপাশে তামাশা দেখা বাচ্চার দলের মধ্যে ধর্মরক্ষক পুলিশের স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরাও ছিল। তাদের হাতে চাবুক, লাঠি ও কালাশনিকভ। এদের চোখে যারাই ছবি বা বই ভালবাসে বা পছন্দ করে ভাস্কর্য বা সঙ্গীত, নাচ, সিনেমা বা মুক্তচিন্তা – তারা সবাই সমাজের শত্রু। আজকে ওদের শুধু ছবিছাবা পোড়ানোর দিন।

    তাই ওদের নাকের ডগায় তাকে রাখা যত বেয়াড়া বইপত্তর, কিছুকিছু শাস্ত্রবিরোধীও বটে, সব আজকের দিনে ছাড় পেয়ে গেল। এই সৈন্যের দল ছিল নিরক্ষর, ফলে ওরা গোঁড়া তালিবানি ফরমানের অনুসারী বই ও বেয়াড়া চিন্তার বইয়ের মধ্যের ফারাকটা ধরতে পারে নি। ওরা শুধু ছবি ও অক্ষর এবং নির্জীব বস্তু ও সজীব প্রাণীর মধ্যে তফাত করতে পারত।

    শেষে রইল কিছু ছাই যা ধূলোবালির সঙ্গে মিশে ঘূর্ণিহাওয়ায় ভর করে ছড়িয়ে পড়ল রাস্তায় রাস্তায় এবং কাবুলের নালানর্দমায়। প্রিয় বইপত্র খুইয়ে বিধ্বস্ত বইওলাটিকে ঠুঁসে দেয়া হোল একটি গাড়িতে, তার দু’পাশে দুই তালিবানি সৈনিক। সৈনিকেরা ওর দোকান বন্ধ করে তাতে সীল মেরে দিল আর সুলতানের গতি হোল জেলখানাতে — ইসলামবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে।

    জেলে যাবার পথে সুলতান ভাবছিল- ওর কপাল ভাল যে ওই সশস্ত্র নির্বোধের দল বইয়ের তাকের পেছনের গুদামটা খেয়াল করেনি। নিষিদ্ধ বইগুলো ওখানেই বেশ কায়দা করে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। ওগুলো ও তখনই বের করে যখন কেউ কোন একটা বইয়ের নাম করে কিনতে চায় এবং যদি ওই গ্রাহককে বাজিয়ে নিয়ে বিশ্বাস করার মত মনে হয়।

    সুলতান জানত যে একদিন এরকমটা হবে। ও বহুবছর ধরে বে-আইনি বই, ছবি ও লেখাপত্তর বিক্রি করে আসছে। সৈনিকের দল ওকে কয়েকবার সাবধান করেছে, ধমকেছে এবং কখনও কখনও কিছু বই আরবাজেয়াপ্ত করে চলে গেছে। তালিবানের সর্বোচ্চ দপ্তর থেকেও ওকে ভয় দেখানো হয়েছে। একবার তো সংস্কৃতি মন্ত্রীর থেকে ডাক এল; সরকার বাহাদুরের ইচ্ছে ব্যবসানিপুণ বইওলাটির মগজধোলাই করে ওকে তালিবানি প্রচারের কাজে লাগাবেন।

    সুলতান স্বেচ্ছায় কিছু তালিবানি বই বিক্রি করল। ও ছিল মুক্তচিন্তার পথিক, ভাবত সবারই অধিকার আছে তার নিজস্ব মত প্রচার করার। কিন্তু ও তালিবানের ওই একবগগা প্রচার পুস্তিকার পাশাপাশি বিক্রি করতে চাইত ইতিহাস ও বিজ্ঞানের বই, ইসলামের মতাদর্শ নিয়ে বিতর্ক এবং উপন্যাস ও কবিতার বই । তালিবানের মতে বিতর্ক হোল ধর্মদ্রোহ এবং সন্দেহ মানে পাপ। কোরানের পুনরাবৃত্তি ছাড়া বাকি সব হোল অপ্রয়োজনীয় এমনকি বিপজ্জনক। বিগত ১৯৯৬ সালে তালিবান যখন কাবুলে ক্ষমতা দখল করল তখন সমস্ত মন্ত্রীদের দপ্তর থেকে পেশাদার লোকজনকে সরিয়ে দিয়ে মোল্লাদের পদস্থ করল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হোক বা বিশ্ববিদ্যালয়—সর্বত্র মোল্লাদের নিয়ন্ত্রণ শুরু হোল। ওদের লক্ষ্য—সপ্তম শতাব্দীতে আরব উপমহাদ্বীপে হজরত মহম্মদ যে সমাজে বাস করতেন তেমনই এক সমাজের নির্মাণ। ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল যে বিদেশি তেল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে দরাদরি ও চুক্তি করার সময়েও প্রযুক্তির ব্যাপারে অজ্ঞ মোল্লার দল আলোচনার টেবিলে জাঁকিয়ে বসে থাকত।

    সুলতানের দৃঢ় বিশ্বাস – তালিবান শাসনে দেশটা আরও গরীব, আরও বিপন্ন এবং অসুরক্ষিত হয়ে পড়বে। ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষ সমস্ত রকম আধুনিকতার প্রবেশ আটকাতে কটিবদ্ধ। ওরা আর্থিক বিকাশ বা প্রগতির ব্যাপারে না বোঝে না কোন নতুন ভাবনাচিন্তা করতে চায়। সমস্ত বৈজ্ঞানিক বিতর্ক — সে পাশ্চাত্ত্যে হোক বা মুসলিম দুনিয়ায় - তাদের কাছে অছুৎ। ওদের ঘোষণাপত্রে রয়েছে কিছু করুণ ও রুগ্ন ফরমানঃ যেমন কীভাবে পুরুষদের প্রার্থনার নির্দিষ্ট সময় মেনে চলতে হবে এবং মেয়েদের বাকি সমাজ থেকে আলাদা করে আগলে রাখতে হবে। ওরা ইসলাম বা আফগানিস্থানের ইতিহাসের ব্যাপারে কিছুই জানেনা এবং জানতেও চায় না। গাড়িটাতে দুই নিরক্ষর তালিবানি সৈনিকের মাঝে চিঁড়েচ্যাপ্টা সুলতান গাল পাড়ছিল নিজের দেশকে— কেন ওর লাগাম হয় ফৌজি নয় মোল্লার হাতে থাকে, এবং এত বছর ধরে! সুলতান ইসলামে আস্থাশীল কিন্তু উদারপন্থী মুসলিম। ও রোজ ভোরে উঠে নামাজ পড়ে কিন্তু দিনের মধ্যে বাকি চারবার আজান শুনলেও গা’ করে না, যদি না ধর্মরক্ষায় নিবেদিত প্রাণ পুলিসেরা ওকে এবং ওর মত রাস্তা থেকে ধরে আনা কিছু অনিচ্ছুক লোককে কাছের মসজিদে ধরে বেঁধে পাঠিয়ে দেয় । ও রমজানের সময় উপোস রাখে নিতান্ত অনিচ্ছায়, আর সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্য্যন্ত কিছু দাঁতে কাটে না, অন্ততঃ কেউ দেখে ফেললে। ও নিজের দুই স্ত্রীর প্রতি বিশ্বস্ত, ছেলেমেয়েদের কড়া শাসনে বড় করেছে এবং ওদের শিখিয়েছে ধর্মভীরু ভালো মানুষ মুসলিম হতে। তালিবানের জন্য ওর অনুভূতি অবিমিশ্র তাচ্ছিল্যের। ওর চোখে ওরা নিরক্ষর চাষাভুষো মোল্লার বেশি কিছু নয়। ওদের উদ্ভব দেশের সবচেয়ে পিছিয়েপড়া গরীব অঞ্চলে — যেখানে সাক্ষরতার হার খুব কম।

    ওর গ্রেফতার হওয়ার পেছনে কলকাঠি নেড়েছিল ‘পুণ্যবৃদ্ধি ও পাপবিনাশী দফতর’ বা ‘নৈতিকতা মন্ত্রালয়’। বন্দীশালায় জেরার সময় সুলতান ওর দাড়ি চুলকে নিল -- হ্যাঁ, তালিবানি মাপমত বটেক, একেবারে হাতের মুঠোর মাপে রাখা। ফের ও শালওয়ার কামিজ টান টান করল—এটাও তালিবানি অনুশাসন মেনে তৈরি, হাঁটুর নীচে জোব্বা এবং গোড়ালির নীচে প্যান্টুল। তারপর ও বুক চিতিয়ে বলল, ‘তোমরা আমার বই পোড়াতে পার, আমায় মেরে ফেলতে পার, কিন্তু আফগান ইতিহাসকে মুছে দিতে পারবে না’।

    বই হোল সুলতানের প্রাণ। স্কুলে গিয়ে প্রথম যখন হাতে বই পেল, তখন থেকেই বই এবং আখ্যানমালার কুহক ওকে মুগ্ধ করে রেখেছিল। জন্মেছে এক গরীব পরিবারে, বড় হয়েছে পঞ্চাশের দশকে কাবুলের বাইরে ‘দেহ খুদাইদাদ’ গাঁয়ে । ওর মা বা বাবা কেউ লিখতে পড়তে শেখেনি, কিন্তু কুড়িয়ে বাড়িয়ে ওকে স্কুলে পাঠানোর মত পয়সা জোগাড় করে ফেলেছিল। ও বড় ছেলে, তাই হাতে যাও আসত, সেটা ওর ওপরেই খরচ হত। ওর দিদি কখনও স্কুলের আঙিনায় পা’ রাখেনি এবং লিখতে পড়তেও শেখেনি। আজও ও শুধু কোন রকমে ক’টা বাজে সেটা বলতে পারে। তাতে কি, বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি যাওয়াটাই ওর নিয়তি যে!

    কিন্তু সুলতানের কথা আলাদা, ওর নিয়তি অনেক বড় হওয়া। প্রথম বাধা, কীকরে স্কুলে যাবে। খুদে সুলতান কিছুতেই স্কুলে যাবে না। ওর জুতো নেই যে! ওর মা বলল, ‘না না, তুমি পারবে; এই দেখ, এমনি করে’। এই বলে ওর মাথায় দিল এক চাঁটা — ব্যস, সুলতাম সুড়সুড়িয়ে স্কুলে গেল। কিন্তু অল্পদিনেই ও কিছু উপার্জন করে জুতো কেনার মত পয়সা জোগাড় করে নিল। স্কুলজীবনে সবসময় ও কিছু-না-কিছু রোজগার করেছে -- সকালে স্কুল যাওয়ার আগে এবং বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে, অন্ধকার নেমে আসা পর্য্যন্ত। ও মাথায় করে ইঁট বইত যাতে পরিবারের জন্য দুটো পয়সা আনা যায়। পরে একটা দোকানে কাজ পেল। বাড়িতে মাইনের ব্যাপারে সত্যি কথা বলত না, যা মাইনে তার আদ্দেক দিত; বাকি পয়সা দিয়ে বই কিনত।

    কিশোর বয়স থেকেই ও বই বিক্রি করে দু’পয়সা কামাতে শুরু করেছিল। ও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য ভর্তি হোল, কিন্তু ঠিকমত পাঠ্যবই পাচ্ছিল না। একবার চাচার সঙ্গে তেহরান যাত্রায় ওখানে বইয়ের বাজারে খুঁজতে খুঁজতে এমন একটা দোকান পেল যেখানে ওর সবক’টা বই রয়েছে। ও সব বই কিনলো কয়েক সেট করে আর কাবুলে ফিরে এসে ওর সহপাঠীদের কাছে সেগুলো বেচল দ্বিগুণ দামে। এই ভাবে জন্ম নিলো কাবুলের বিখ্যাত বইওলা, ও জীবনভর এই পেশাকে আঁকড়ে ধরে রইল।

    পাশ করার পর কাবুলে মাত্র দুটো বাড়ির নির্মাণে ও যুক্ত ছিল। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি বইয়ের নেশা তাকে টেনে নিয়ে গেল ইঞ্জিনিয়ারিং এর দুনিয়া থেকে বহুদূরে। ফের সেই তেহরানের বইয়ের বাজার আর তার হাতছানি। দেহাতি ছেলেটি ঘুরে বেড়াল পারস্যের মহানগরীতে বইয়ের আশ্চর্য জগতে -- কত রকম বই, পুরনোও নতুন, প্রাচীন ও আধুনিক। এমন সব বইয়ের দেখা পেল যাদের অস্তিত্ব নিয়ে ওর কোন ধারণাই ছিল না। ও কিনল ক্রেট ভরে ভরে ফার্সি কাব্য, শিল্পকলা, ইতিহাসের বই এবং — ওর নিজস্ব পেশা ইঞ্জিনিয়ারিং এর বই।

    কাবুলে ফিরে ও খুলল ওর প্রথম বইয়ের দোকান -- শহরের কেন্দ্রস্থলে মশলাপাতি ও কাবাবের দোকানের মাঝে একটা ছোট্ট দোকান। সেটা ছিল সত্তরের দশক এবং সমস্ত সমাজ তখন আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের দোলাচলে খাবি খাচ্ছিল। জাহির শাহের মত উদারপন্থী আলসে রাজা তখন ক্ষমতায় রয়েছেন। তাঁর দেশকে আধুনিক করার আধাখ্যাঁচড়া চেষ্টায় ধার্মিক গোঁড়াদের থেকে তিক্ত প্রতিবাদের ঢেউ উঠল। যখন কিছু মোল্লা রাজপরিবারের মেয়েদের হিজাব বা বুর্কা ছাড়া জনসমক্ষে বেরনো নিয়ে কটু কথা বলল, তাদের জেলে পোরা হোল।

    বিশ্ববিদ্যালয় ও লেখাপড়ার অন্যান্য পীঠস্থানের সংখ্যা বেড়ে গেল, সেই সঙ্গে এল ছাত্র আন্দোলন। এদের কর্তৃপক্ষ দমন করল এবং সেই বর্বরতায় বেশ কিছু ছাত্র মারা গেল। এইসময় অবাধ নির্বাচন না হলেও ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠল একগাদা রাজনৈতিক দল এবং বেশ কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠী। তাদের মধ্যে কট্টর বাম থেকে শুরু করে ধার্মিক মৌলবাদী সবই ছিল। বিভিন্ন গোষ্ঠীর নিজেদের মধ্যে লড়াই চলতে থাকল এবং দেশজুড়ে এক অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ল। তিনবছরের লাগাতার খরা ও ১৯৭৩ সালের ভয়ংকর দুর্ভিক্ষের পর দেশের অর্থনীতির গতি একেবারে থেমে গেল। জাহির শাহ যখন ইতালিতে ডাক্তার দেখাতে ব্যস্ত, তখন তাঁর তুতো ভাই দায়ুদ আচমকা এক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখল করে রাজতন্ত্রের অবসান ঘোষণা করল।

    রাষ্ট্রপতি দায়ুদের শাসনকাল তার আগের জমানার চেয়েও বেশি উৎপীড়ক হয়ে উঠল। কিন্তু সুলতানের বইয়ের দোকান ফুলে ফেঁপে উঠল। ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর — মার্ক্সিস্ট থেকে মৌলবাদী — সবার বই ও সাময়িক পত্রপত্রিকা বিক্রি করত। ও গাঁয়ের বাড়িতে মা-বাবার সঙ্গে থাকত এবং রোজ সকালে সাইকেল চালিয়ে কাবুলে গিয়ে নিজের দোকান খুলত এবং সন্ধ্যে নাগাদ বাড়ি ফিরে আসত। ওর একটাই সমস্যআঃ মা সারাক্ষণ টিকটিক করছে ও কবে বিয়ে করে বৌ আনবে! মা হরদম একটি নতুন পাত্রীর খবর নিয়ে আসে — কোন তুতো বোন পাড়ারই কোন মেয়ে। সুলতান তখনও ঘর বাঁধার কথা ভাবছিল না। অনেকগুলো কাজ ও ভেবে রেখেছে, বিয়ের জন্য কোন তাড়াহুড়ো নেই। ও ভালবাসত নানান জায়গা দেখে বেড়াতে। মাঝে মাঝেই ও চলে যেত তেহরান, তাশখন্দ বা মস্কোতে। মস্কোয় জুটেছিল এক রাশিয়ান প্রেমিকা – লুদমিলা।

    সালটা ১৯৭৯; সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক হস্তক্ষেপের ক’মাস আগে ও জীবনের প্রথম ভুলটা করে বসল। কট্টর কমিউনিস্ট নেতা নুর মহম্মদ তারাকি দেশের ক্ষমতায় এলেন। এক সামরিক অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি দায়ুদের গোটা পরিবার, ছোট শিশু সমেত, নিহত হলেন। জেলগুলো ভরে উঠল রাজনৈতিক বন্দীতে; হাজারে হাজারে বিরোধীদের ধরে এনে যন্ত্রণা দিয়ে মেরে ফেলা হোল।

    কমিউনিস্টরা চাইছিলেন সমগ্র দেশে তাঁদের নিয়ন্ত্রণকে মজবুত করতে এবং ইসলামিক গোষ্ঠীগুলোকে দমন করতে। যত ধর্মযোদ্ধা মুজাহিদীন নতুন শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরল। সংঘর্ষ ক্রমে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে এক নির্মম গেরিলা যুদ্ধের আকার নিল।

    এই মুজাহিদীনেরা ছিল বিভিন্ন চিন্তা ও মতাদর্শের সমন্বয়। এমন অনেক গোষ্ঠী তাদের সাময়িক মুখপত্র বের করত যাদের মূল ধরতাই ছিল ধর্মদ্বেষীদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ বা ‘জিহাদ’ ও গোটা দেশের ইসলামিকরণের সমর্থন। ওদিকে শাসকেরা কাউকে মুজাহিদীনের সমর্থক বলে সন্দেহ হলেই তাকে চেপে ধরছিল; এবং মুজাহিদীন ভাবধারার প্রচারপুস্তিকা ছাপা ও বিলি করা নিষিদ্ধ করা হোল।

    সুলতান একধারসে বিক্রি করত সবার সাময়িক পত্র ও পুস্তিকা – সে মুজাহিদীন হোক বা কমিউনিস্ট। এছাড়া ওর ছিল সংগ্রহের বাতিক, যা কিছু হাতে আসত-বই বা পত্রিকা — তার অল্প কিছু কিনে ধরে রাখত, পরে বেশি দামে বিক্রি করবে বলে। ওর কথা হোল গ্রাহকেরা যা চাইবে তার জোগান দেয়া ওর পরমকর্তব্য। নিষিদ্ধ বইপত্র লুকনো থাকত কাউন্টারের নীচে।

    বেশিদিন গেল না, ওর ব্যাপারে কেউ চুকলি করল। একজন খদ্দের ধরা পড়ল, তার কাছে পাওয়া গেল নিষিদ্ধ বই যা সুলতানের দোকান থেকে কেনা। পুলিশের খানাতল্লাসীতে পাওয়া গেল বেশ কিছু বে-আইনী কাগজপত্তর। বইয়ের প্রথম খান্ডবদাহন শুরু হোল। সুলতান গ্রেফতার হোল, বেদম মার খেল এবং একবছরের জন্য জেলের ভেতরে রইল। ওকে রাখা হোল রাজনৈতিক বন্দীদের সেকশনে, যেখানে লেখার সরঞ্জাম ও বইয়ের প্রবেশ নিষিদ্ধ। মাসের পর মাস কাটে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু ও মায়ের পাঠানো খাবারদাবারের বিনিময়ে কিছু পাহারাদারকে হাত করে ফেলল এবং প্রত্যেক সপ্তাহে চোরাপথে বইয়ের আসাযাওয়া অব্যাহত রইল। স্যাঁতসেতে পাথরের দেয়ালের ঘেরাটোপের মাঝে আফগান সংস্কৃতি ও সাহিত্য নিয়ে সুলতানের আগ্রহ বেড়ে উঠল। ওকে যাদু করল ফার্সী কাব্য ও নিজের দেশের নাটকীয় অতীত। যখন ছাড়া পেল ও জানত ওকে কী করতে হবে। ও পায়ের তলায় মাটির ছোঁয়া পেয়েছে। ও লড়ে যাবে আফগান সংস্কৃতি ও ইতিহাসের বিষয়ে জ্ঞানচর্চার প্রসারের জন্যে। ওর ইসলামিক গেরিলা এবং চীনপন্থীদের বে-আইনী প্রকাশনের বিক্রি জারি রইল, কিন্তু এবার ও আগের চেয়ে অনেক বেশি সতর্ক।

    ওর ওপর কর্তৃপক্ষের নজরদারি অব্যাহত ছিল, পাঁচ বছরের মাথায় ও আবার গ্রেফতার হোল। আবার ও পাথরের দেয়ালের কূপে বসে ফার্সী দর্শনের নিবিড় অধ্যয়নের অবসর পেল। কিন্তু ওর অপরাধের তালিকায় যুক্ত হয়েছে একটা নতুন অভিযোগ — পাতিবুর্জোয়া মধ্যবিত্ত, কমিউনিস্ট মতাদর্শের চোখে সবচেয়ে খারাপ অপরাধের অন্যতম। ও নাকি পুঁজিবাদী মডেলের ধাঁচে পয়সা কামাচ্ছে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩
  • ধারাবাহিক | ০৬ নভেম্বর ২০২১ | ১৩৬০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • স্বাতী রায় | ২০ নভেম্বর ২০২১ ২০:২৮501343
  • তারপর? অনেক দিন ধরে অপেক্ষা করছি। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই প্রতিক্রিয়া দিন