দসমি সেই কবে গ্ৰাম ছেড়ে প্রিয়রঞ্জনের সঙ্গে সংসার করতে এসেছিল আর তা মনে নেই। মেয়েদের তো এই! এই প্রিয়রঞ্জনের ঘরই তার নিজের ঘর। নিজের বাপের ঘর সব মেয়েদের মতো ভুলেই গিয়েছিল দসমি। বিয়ে হয়ে গেলে সে ঘর কি আর নিজের থাকে? দূরেও বটে বাপের গ্ৰাম। তাছাড়া তিনটে মেয়ে, দুটো ছেলে নিয়ে ভরা সংসার। তাই সেই যে বিয়ে হয়েছিল, আর যাওয়া হয় নি সেখানে।
জ্ঞান হওয়া অবধি জানত মা, বাপ, ছোট দুটো ভাইকে নিয়ে জগৎটা ওরই। ওরাও তো দসমিকে ভালোবাসত বলেই মনে হত। বাপটা নেশায় চুড় হয়ে থাকলেও হাটবারে দসমির পছন্দের লাল চুড়ি, মাথার ফিতে মনে করে এনে হাতে দিত। হাটের থেকে যেবার সেই জংলা ফুল আঁকা হলুদ শাড়ি এনে দসমিকে বাপটা দিয়েছিল... সঙ্গে লাল জ্যাকেট... বাসন্তী পূর্ণিমায় পরবে বলে! দসমি সেবার খুব সেজেছিল। হাতে লাল চুড়ি। গলায় পলাশ ফুলের মালা আর মাথার খোঁপায় এই এত্তোবড় একটা শিমুল ফুল দিয়ে... দসমিকে দেখে কেউ আর চোখ সরাতে পারে নি। তখনই তো গ্ৰামের কুন্নি মাসির ননদ এসে দসমিকে পছন্দ ই করে ফেলল, ছেলে প্রিয়রঞ্জনের বৌ করবে বলে। ব্যস্ এক সপ্তাহ বাদেই বিয়ে হয়ে ভোরের সূর্য যখন সবে পুকুরধারের তালগাছের মাথায় আলো ফেলেছে তখন নিজের গ্ৰাম ছাড়ল।
প্রিয়রঞ্জন কাগজের মিলে ভালো রোজগার করত। ভালো অবস্থা ছিল ওদের সে সময়। সুখেই ছিল ওরা। শুধু এক একদিন খুব মন কেমন করত বাপের ঘরটার জন্য। নিজেই নিজেকে বোঝাত ও ঘর নিজের নয় বলে।
এখনও মাঝেমধ্যে যখন সুস্থ থাকে মনে পড়ে ছোট ভাইগুলোর কথা। দসমিকে ওদের কি আর মনেই পড়ে না? নিজেরই তো কত বয়স হয়ে গেল। মা, বাপ কি আর এ দুনিয়ায় আছে? ভাবলে বুকটা টনটন করে ওঠে। তা সুস্থ আর কতক্ষণই বা থাকে দসমি? হাড়িয়ার নেশায় সে সারাদিন টলমল করে। সেই যেবার ছোট ছেলেটা সাপের কামড়ে মরে গেল সেই থেকেই এই হাড়িয়াতেই সুখ দসমির। দিন রাতের বিচার নেই। হাড়িয়া খেয়েই ওর সময় কাটে। প্রথম প্রথম বাধা দিলেও কথা না শোনায় এখন আর বাধাও দেয় না কেউ ওকে। প্রিয়রঞ্জনের কাগজের মিলের কাজটাও আর নেই। সেও খায় হাড়িয়া। তবে দসমির মতো নয়। দুটো মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বিশেষ আসা যাওয়া তারাও করে না। বড় ছেলেটা কয়লা খাদানে কাজের সুবাদে অফিস থেকে থাকবার জায়গা পেয়ে সেখানেই বৌ নিয়ে থাকে। দসমির অঢেল ফুরসৎ তাই। ছোট মেয়ে, ছুটকি রান্নাবাড়া না করলে প্রিয়রঞ্জনের খাওয়াও জুটত না। অবশ্য মন ভালো থাকলে এক একদিন দসমি রান্না করেও। এভাবেই বেশ কিছু বছর ওরা কাটিয়ে ফেলল।
দুর্গাপূজো পার করে ই সন্ধ্যের পর থেকে নতুন ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে। দসমি সেদিন সারাদিন ধরে হাড়িয়া খেয়ে সন্ধ্যের পর ঘরের দাওয়াতেই শুয়ে পড়ে রইল। ঠাণ্ডা লেগে পরদিন থেকে দিন দশেক পার হল হালকা জ্বর নিয়ে। তাপ যে বেশী তা নয়। থেকে থেকে পেটে ব্যথা। খাওয়া দাওয়া বন্ধ। মুখে রুচিও ছিল না। এমনিতেও সে খাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল হাড়িয়ার নেশায়। এখন তো জ্বরের মুখ! ছুটকি বুধবারের হাটে গিয়ে বুড়োচাচার কাছ থেকে জরিবুটির দাওয়াই নিয়ে এল। বড়িগুলো দুধের সঙ্গে দিতে বলেছে বুড়োচাচা। সে দসমিকে খাওয়াবে কে? মুখে জোর করে খাইয়ে দিলে থু থু করে ফেলে দিল দসমি। ঐ শরীরেও তার হাড়িয়া চাই। কিছুদিন এভাবে গিয়ে একটু ঠিক হল দসমি।
একটু একটু খাওয়াদাওয়া শুরু করল দসমি। মেয়েটাই একটু আধটু যা কথা বলে ওর সঙ্গে। প্রিয়রঞ্জন ও তো বাইরেই পড়ে থাকে। সংসারে তার যেন কোনোও টানই আর নেই। দেওয়ালিতে ছেলে, বৌ এসে একদিন ছিল। সেদিন দসমি সারাদিন নেশা করে নি। ওরা চলে যেতেই গুম হয়ে থাকল দিনভর। তারপর রাতের থেকে আবার নেশায় মন।
মাস কয়েক পরের কথা। শীত তখন যায় যায়। কিছুদিন বাদেই হোলি। প্রিয়রঞ্জনদের এক ফালি ক্ষেতের গম কেটে বস্তা ভরে ঘরে এসেছে। আনন্দের দিন। সারাদিন হৈ চৈ করে দসমি সেদিন বেহঁশ হয়ে গেল। পরদিন বেলা হয়ে গেলেও জ্ঞান এল না। ছুটকি কেঁদেকেটে বাপকে পাঠাল বাজারের ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার এসে দেখে ওষুধ দিয়ে চলে গেল কিছুই না বলে। বিকেল পার করে দসমির জ্ঞান এল। ফ্যালফ্যাল করে এদিক ওদিক চাইল সে। ছুটকি গরম দুধ জোর করে খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দিল। সকাল হতেই দাদা এল। প্রিয়রঞ্জন খবর দিয়ে আনিয়েছে ছেলেকে। ছেলেকে দেখে একমুখ হাসিতে দসমির মুখ ভরে গেল। রুগ্ন শরীরেও যেন বল পেল সে। শান্তিতে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ল।
ছুটকি ঘরের কাজে ব্যস্ত। বাপ, ছেলে আস্তে আস্তে কথাবার্তা বলছে।
দুপুরের পর সদর দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ। ছুটকি দেখল কে একজন এসেছে যেন। বাবা আর দাদা কথা বলে তাকে নিয়ে এল দসমির কাছে। ছুটকি অতিথির জন্য জল নিয়ে এসে জানতে পারল এ তার মামা হয়। দসমির ছোট ভাই। দসমিকে জাগানো হলে সে কিন্তু ছোট ভাইকে চিনতেও পারল না সহজে। দসমি যখন গাঁ ছেড়েছিল তখন তো ভাই দুটোর একটা আট, একটা দশ বছর বয়স। এতকাল পরে সে কি করে চেনে আর! যাই হোক খানিক বাদে ছোট ভাইকে চিনে খুব আনন্দ পেল দসমি। বাপ, মা সব মরে গেছে জেনে দুঃখ পেলেও এরপর যা শুনল তাতে দসমির আনন্দে পাগল হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হল – ভাই দিদিকে নিয়ে যেতে এসেছে । গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে যাবে সে দিদিকে। এত সুখও ওর ভাগ্যে ছিল!
আধঘন্টার মধ্যেই শেষ বিকেলে ভাই দিদিকে নিয়ে রওনা দিল। ছুটকি কাঁদতে কাঁদতে মাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে এল। দাদা ফিরে গেল।
রাতে বাপের খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে ঘরে চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়ল ছুটকি। দিন দুই পরেই পূর্ণিমা। ঘরের জালনা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে বিছানায়। আকাশটা খুব পরিষ্কার। বড্ড মন খারাপ করছে ওর।
হোলির দিন সকালে খবর এল দসমি আর নেই। বাপের ঘরে গিয়ে এক রাত কাটিয়ে সে এ জন্মের মতো সংসারের মায়া কাটাল। কঠিন অসুখ ওর জেনে প্রিয়রঞ্জন আর বড় ছেলে ওকে ওখানে পাঠিয়ে দিয়েছিল। ওরা জানত, দসমি আর কখনও ফিরবে না।
প্রিয়রঞ্জনের ঘরটাও দসমির ঘর ছিল না। দসমির সত্যিই কি কোনোও ঘর ছিল?
মেয়েদের নিজের সত্যিই কোনোও ঘর কি থাকে?
পড়ে মন্তব্য করুন সকলে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।