রাজার ব্যাটা কেরোসিন তেলওয়ালা। এটা দেখতে আমরা একেবারেই অভ্যস্ত নই। কারণ বাবর পুত্র হুমায়ূন মসনদে বসেছিলেন। তারপর তাঁর পুত্র আকবর। তারপর পুত্র জাহাঙ্গীর। তাঁর পুত্র শাহজাহান। তারপরে তাঁর পুত্র ঔরঙ্গজেব। এই জাতীয় পিতাপুত্রের পরম্পরার কাহিনী ইতিহাস ছেয়ে রয়েছে। সেটা ছিল রাজরাজড়াদের একনায়কতন্ত্রের যুগ। গণতন্ত্রের বালাই ছিল না। দেশ স্বাধীন হবার পর গণতন্ত্রের জোয়ার এল। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হল। জনতাই হল জনার্দন। এই আপ্তবাক্য ঢাক ঢোল পিটিয়ে প্রচারিত হল। জনতার ভোটে নির্বাচিত হয়ে জনপ্রতিনিধিরা দেশ বা রাজ্য শাসন করবেন। সংবিধানের ছত্রে ছত্রে এমনটাই বর্ণিত। যোগ্যতার নিরিখেই জনপ্রতিনিধিগণ দেশ শাসনের অধিকার পাবে। গণতন্ত্রের কষ্টিপাথরে যাচাই করার পরেই মিলবে দেশ চালানোর চাবিকাঠি। জনসাধারণের মধ্যে থেকেই উঠে আসবেন, জনগণের প্রতিনিধি। মানে মোদ্দা কথা হল, গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় দেশের চারদিকে গণতন্ত্র কিলবিল করবে। কেউ সেখানে পরম্পরাগত সুযোগ সুবিধে কদাপি পাবে না। ইচ্ছে করলেও না।
রাজার পরে রাজসিংহাসনে কোনো রাজপুত্রের ঠাঁই হবে না। তাহলে কি, কালের বিবর্তনে অনেক কুপ্রথার মতই রাজতন্ত্রও বিলুপ্ত ? আজ্ঞে না। গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় রাজতন্ত্রকে ভিন্ন খোলসে পুরে পরিবেশনের চেষ্টা মাত্র। আশা করি স্বাধীনতার পরে এতগুলো বছরে এইটুকু সকলেই বুঝে গেছে। সংসদীয় গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় জনপ্রতিনিধিদের পাওনার বহর লক্ষ্য করে দেখলেই অঙ্কটা পরিষ্কার বোঝা যায়। যেমন জনগণের করের টাকায় জনপ্রতিনিধিদের ভরণপোষণ কি রাজসূয় যজ্ঞের তুলনায় কম বলে মনে হয় ? জনপ্রতিনিধির তকমা একবার নিজের গায়ে লাগিয়ে নিতে পারলেই কেল্লাফতে। তারপরে শুধু নিজের জীবন নয় পরবর্তী উত্তরপুরুষদের জন্যেও সৌভাগ্যের দ্বার উন্মুক্ত। এইখানেই গণতন্ত্রের খোলসের মধ্যে রাজতন্ত্র নিঃশব্দে ঢুকে পড়েছে। বাবা মা খুড়ো পিসির হাত ধরে পুত্র কন্যা ভাইপো ভাইঝিরাও আধুনিক কালের রাজপুত্র বা রাজকন্যা নির্দ্বিধায় বনে যাচ্ছেন।
আমরা সকলেই নাম ধরে বলতে পারব, সারা ভারতে কতজন রাজনীতিবিদ বাবা অথবা মায়ের সন্তান মসনদে বসেছে। বা বসতে চলেছে। কিংবা ক্ষমতার আশপাশে ঘোরাঘুরি করছে। এটাও দেখেছি, মৃত হলে তো কথাই নেই। এমনও হয়েছে রাজ্যের রাজা জীবিত অবস্থাতেই নিজ সহধর্মিণীকে মসনদে বসাতে ছাড়েননি। সেই সহধর্মিণী রাজনীতির "র" জানতেন না। তিনি শুধুমাত্র গৃহবধূ হওয়া সত্ত্বেও তাঁর সিংহাসনে বসা আটকায়নি। অবশ্যই গণতন্ত্রের নির্ধারিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এতক্ষণে নিশ্চয় অনেকেই বুঝে ফেলেছেন, কার নামোল্লেখ করতে চাইছি ! একমেবাদ্বিতীয়ম শ্রী শ্রী লালুপ্রসাদ যাদব ও তাঁর সহধর্মিণী শ্রীমতী রাবড়ি দেবী।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই পরম্পরার শুরু সেই জওহরলাল নেহেরু থেকে। তাঁর পরিবারের যোগ্য অযোগ্য বংশধরেরা এখনো পর্য্যন্ত ক্ষমতার বৃত্তে রয়ে গেছেন। এরকম নাম সারাদেশে প্রচুর রয়েছে। আলাদা করে তাই তাদের নাম করে শব্দ সংখ্যা বাড়িয়ে লাভ নেই। বরং রাজাদের থুড়ি জনপ্রতিনিধিদের বংশধরদের কিভাবে মসনদের পায়া ধরবার উপযোগী করে তোলা হয়, সেই প্রসঙ্গে আসি। পৃথিবীতে সম্মানজনক এত পেশা থাকতে রাজপুত্র ও কন্যাদের কিভাবে রাজনীতির সমুদ্রে সাঁতার কাটতে শেখানো হয় !
যদি রাজনীতিবিদ পিতার একাধিক সন্তান থাকে। তাহলে তিনি তন্মধ্যে যোগ্যতম অর্থাৎ সরেসটিকে বেছে নেন। নিজের লাল কার্পেট বিছানো পথে হাঁটবার জন্য। পড়াশোনা শিখলে অতীব উত্তম। শিক্ষিত জনপ্রতিনিধির কদরই আলাদা। আর না শিখলেও ক্ষতি নেই। অন্য যেকোনো ব্যবসায় ঝুঁকি অনেক বেশি। বরং রাজনীতির ব্যবসায় তুলনামূলক কম। পুত্রকে তো আর সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে হবে না। ঘাম রক্ত খুইয়ে নেতা হতে হবে না। রাজার ব্যাটা রাজা। এই মহিমাই যথেষ্ট। ফুলের তোড়া নিয়ে তাকে স্বাগত করতে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলই লালায়িত থাকে। দীর্ঘদিন মিছিল মিটিং করা, ঘাম রক্ত খোয়ানো কর্মীগুলি পড়ে থাকে সেই একই জায়গায়। একেবারে পিছনের সারিতে। তারা কেউ দেওয়াল লেখে। কেউ পার্টি অফিস ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার রাখে। কেউ মিছিলে গলা ফাটায়। আর নেতা, বিধায়ক, মন্ত্রী কিংবা সাংসদ পুত্রের মাথায় এক ঝটকায় বড়ো নেতার মুকুট উঠে যায়। তার মুখের আড় না ভাঙলেও বিধায়ক বা নিদেন পক্ষে কাউন্সিলর হওয়ার টিকিট অক্লেশে জুটে যায়। সেই দেওয়াল লেখা, ঝাড়ু দেওয়া কর্মিগুলিকে বাধ্য হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। সেই রাজপুত্রকে ভোটে জিতিয়ে আনার লক্ষ্যে।
ইদানিং স্বজনপোষণ শব্দটির প্রচলন খুব বেড়ে গেছে। ফিল্মি দুনিয়ায় নায়ক বাবা মায়ের ছেলেমেয়েরাই নাকি সব সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। কথাটা অর্ধসত্য। ফিল্মি দুনিয়া এমন একটি স্থান, যেখানে সত্যিকারের প্রতিভা না থাকলে টিকে থাকা অসম্ভব। কারণ বিচারকের ভূমিকায় সেখানে দর্শক। কারোর যোগ্যতা না থাকলে দর্শক তাদের ছুঁড়ে ফেলে দেয়। নাহলে হাতেগোনা কয়েকজন অভিনেতা পুত্র কন্যাই সাফল্য পেতেন না। বহু নায়ক পুত্র কন্যা সুপারিশের জোরে হয়ত ফিল্মে পা রাখতে পেরেছিলেন। কিন্তু প্রতিভা না থাকায় তাঁরা ধুলিস্যাৎ হয়ে গেছেন। কিন্তু রাজনীতির ময়দানে সেটা খুবই কম। কারণ এখানে প্রকৃত অর্থে প্রতিভার জোরে নয়, টিকে থাকতে লাগে মুরুব্বির জোর।
অন্যান্য সব রাজ্যে বা কেন্দ্রে রাজার ব্যাটা রাজা। এই পরম্পরা বহুদিন ধরে চললেও বাংলায় সেটির প্রচলন খুব একটা ছিল না। বিগত কংগ্রেস বা বাম আমলে কদাকচিৎ। স্বয়ং জ্যোতি বসুর পুত্র চন্দন বসুকে শিল্পপতি বানিয়ে তোলার গল্প সর্বজনবিদিত। বসু পরিবারে এই কুখ্যাতিটুকু থাকলেও রাজনীতির ময়দানে এনে মসনদ পাইয়েছেন, এমন অপবাদ নেই। তার পরবর্তীতে রাজ্য দখলকারীদের দলে এই উদাহরন ভুরি ভুরি। শাসকদলে স্বামী স্ত্রী, পিতা পুত্র বা কন্যা একই দলে সিংহাসনের পায়া ভাগাভাগি করে বসেছেন। তাঁদের একমাত্র যোগ্যতা তাঁরা শাসকদলের নেতা বা মন্ত্রীর সন্তান। এই পরম্পরায় বাংলার রাজনীতিতে সংযোজন মুখ্যমন্ত্রীর ভাতুষ্পুত্র। শাসকদলের প্রতিষ্ঠাতা সব সদস্যদের পিছনে ফেলে তাঁর নিঃশব্দে উত্তরন ঘটেছে। মুখ্যমন্ত্রীর বয়স বাড়ছে। তাই তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে পরিবারের কাউকে ভীষণ প্রয়োজন। সেই রাজতন্ত্রের পরম্পরা নাহলে বজায় থাকবে কিভাবে !
____________________
কলমে@রজত দাস