এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  পুজো ২০১০

  • পরজনমে হইও গাধা

    সুমেরু মুখোপাধ্যায়
    ইস্পেশাল | পুজো ২০১০ | ০১ অক্টোবর ২০১০ | ১৪২৬ বার পঠিত


  • রাজকন্যার সখ

    মানুষের নানা রকম শখ থাকে, কেউ মানুষ মারে কেউ মোবাইল কেনে, ইচ্ছেমত, একেরপরে এক। মোদ্দা কথা হল অপচয়। কীভাবে কে কতখানি অপচয় করবে সেটাই তার সখ। বাঈজি পোষা, ঘুড়ির সুতোয় বেঁধে বা ফানুসে টাকা ওড়ানো, বিড়ালের বিয়ে দেওয়া সবই তখন ব্যাকডেটেড। নতুন কিছু একটা সখ আবার না থাকলেই নয়। রানী যা আবদার করেন রাজা তা না করতে পারেন না। আর রাজকন্যা তো দুজনকারই ইস্যু। এখন থেকে সখটা যদি নারচার না করা যায় তবে কী আর বড় বয়সে অভ্যাস করান যাবে? রাজকন্যার বয়েস তখন মাত্র বারো। রাজা রানীকে ছুঁয়ে ওয়াদা করলেন, এক বছরের মধ্যে রাজকন্যার জন্য সলিড ও ইউনিক একটা শখ না বার করতে না পারেন তবে রাজ সিংহাসন ছেড়ে বনবাসে চলে যাবেন। রানী আদর করতে করতে বললেন, একবছর কিন্তু খুব কম সময় মনে রেখ, হারলে তুমি ঠিক যাবে তো? তুমি ফেল করলে আমি কিন্তু কিছুতেই তোমার সঙ্গে যাব না। বনে আমার বড্ড ভয় লাগে। রাজারও বন জঙ্গল হালকা ভয় লাগত। তিনি গোপনে মধুপুর হাফ আর মহেশখালির প্যারাবন পুরোপুরি সাফ করে দিয়েছিলেন। সুন্দরবনটা ভেবেছিলেন ক্লাইমেট-চেঞ্জে ফুটে যাবে, কোথায় কী! সেদিনই কাগজে বেরিয়েছে আবার ভেসে উঠছে, বাঘও নাকি বাড়ছে ইদানিং। জঙ্গলের নামে নিজেরই ভয় ভয় করতে লাগল, রানীর কোলের মধ্যে শুয়ে। না: একটা শখ খুঁজে পাওয়া যাবে না একবছরে? নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে আর তখন সবারই তাক লেগে যাবে। মুখে শুধু বিড়বিড় করলেন, সবুরে মেওয়া ফলে।

    সারা রাজ্যে ঢেড়া পেটান হোল। বিজ্ঞাপন দেওয়া হল সমস্ত প্রথম শ্রেনীর দৈনিকে, দরকার হলে টিভিতেও বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে, কমিটি রেডি। রিপ্লাই আসতে লাগল ফটাফট। এক সপ্তাহে যা সব সাজেশন এল সব দেখে রাজার চক্ষু চড়কগাছ। সাপের ছোবল, কাঠখোলায় ভাজা টিকটিকির ল্যাজ, পাঁউরুটিতে আয়োডেক্স, ডেনড্রাইট! এই তাদের মেয়ে বড় হয়ে রাজকন্যা হবে না নামজাদা ইঞ্জিনিয়ার? নাহ, এই ভাবে হবে? দিন খামোখা চলে যাচ্ছে। রোজ রাতে স্বপ্নে হানা দিচ্ছে বিদঘুটে এক মিশমিশে জঙ্গল, স্মেলে বাঘ আর ভাল্লুক। ইস একটা নতুন শখ খুঁজে পাওয়া যাবে না? মন্ত্রীকে বরখাস্ত করে বলিউডের এক নামজাদা প্রোডাকশন ম্যানেজারকে আনলেন উড়িয়ে, রানীর পরামর্শে। রানী ছিলেন সমস্ত সিনেমার ম্যাগাজিনের পোকা, অন্যদিন থেকে আনন্দলোক। তিনি জানতেন প্রোডাকশন ম্যানেজাররা গোরুর গাড়ি থেকে বাঘের দুধ সব জোগাড় করতে ওস্তাদ। এই বার দেখা যাক ওস্তাদের কেরামতি। ওস্তাদ উড়ে এসেই রানীর সঙ্গে টানা সিটিং করলেন ছয় রাত্রি সাত দিন। রানীর যে আইডিয়া, যে জিনিসেরই কথা বলেন সবই নাকি সেলিব্রিটিদের আগে থেকেই আছে। কার কুকুরের হাসপাতাল আছে, কার পোষা সিংহ আছে, কে রাতে গাড়ি করে রাতে ফুটপাতে ঘুমন্ত মানুষদের মারে, কে প্রতিমাসে প্রেমিকা বদলায়। শুনতে শুনতে রানীর মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। ভাগ্যিস হাবলা রাজাটা শোনেনি, তাহলে মাথা আউলে এখনই দৌড়াত জঙ্গলের দিকে। তার নিজেরই এখন পাগল পাগল দশা। টানা সাতদিন স্নান নেই খাওয়া নেই, বেশ-ভুষা আউলা। রানীর মরার সময় নেই, শুধু প্রোডাকশন ম্যানেজারের পায়ে ধরতে বাকি, আপনি যা চান তাই দেব, শুধু একটা নতুন শখের কথা আমাদের বলুন। প্রোডাকশন ম্যানেজার বুঝলেন তার আর নিস্তার নেই। ইমিডিয়েট একটা আইডিয়া না এলে তাকে আর বেঁচে ফিরে যেতে হবে না।

    প্ল্যান একটা এল বটে কিন্তু রানী গিয়ে রাজাকে বলতেই রাজা অগ্নিশর্মা। অবশ্য যে শুনবে তার মাথাতেই আগুণ জ্বলে উঠবে। প্রোডাকশন ম্যানেজারের আক্কেলটা বোঝ। বলে রোজ নাকি একজনের সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে রাজকুনারীর। তার রেকর্ড বলছে এক্সপার্ট লোকেরও বিয়ের লিমিট ৬/৭। কেউ লুকিয়ে-টুকিয়ে আরো কিছু করে থাকলেও কত আর হবে ৫০-১০০ তার বেশি নিশ্চয়ই নেই। আর রাজকন্যা যদি তের থেকেই যদি মন দিয়ে শুরু করেন তো ছয় মাসের মধ্যে সবার টপে। ছি: ছি: তাদের মেয়ে রাজকন্যা না বেবুশ্যে? প্রোডাকশন ম্যানেজার যত বোঝান আজ কাল এটা কোন ব্যাপারই না, তত রাজার মাথায় আগুণ চড়তে থাকে। বড় বড় নায়িকারা নাকি রোজই আলাদা আলাদা লোকের সঙ্গে শোয়। এগুলো আজকার দিনে নাকি কোন ব্যপারই না, তাদের কী মাল ছোট থাকলে চলবে? বড় তো তাদের হতে হবে না কি? রানী বলে, হ্যাঁ হ্যাঁ আমিও বইতে পড়িসি মনে হতিসে। হোক তোমার মনে, ব্যাটাকে আমি শুলে চাপাব। বিদেশ মন্ত্রী খবর পেয়েই দৌড়ে এলেন, বিদেশি এক্সপার্ট মেরে দিলে আর দেখতি হবে না। পানি বন্ধ, গরু বন্ধ, জেমসের হিন্দীগান গাওয়া অবধি বন্ধ হয়ে যাবে। মুখে বললেন, মহারাজ বিদেশে এটাই এখন লেটেস্ট ট্রেন্ড, মানুষে রোজ দুবেলা আলাদা আলাদা লোকের সঙ্গে শুচ্ছে, কোন দু:খ-কষ্ট নেই, সবাই হ্যাপি। রাগলে রাজার সত্ব নত্ব জ্ঞান থাকে না। হুকুম দিলেন, দুটোকেই হাওয়া করে বিদেশে পাঠিয়ে দাও। লোকজন তারাতাড়ি তাদের সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে আমেরিকার টিকিট কিনে আমেরিকা পাঠিয়ে দিল।

    দুঁদে উকিল মনিরুল হক কচিকে ডেকে আনালেন, শলা করলেন রানী। ব্যারিস্টার কচি শুনেই বললেন, অসম্ভব। রোজ বিয়ে হতে পারে, কিন্তু ডিভোর্স পাবেন কী করে। লিগাল নোটিশ, সেপারেশন, একেকটা বিয়ে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতেই ছয়মাস! একটা হতে পারে ছয়মাস অন্তর বিয়ে করল রাজকন্যা। আগে এটা চেক করে দেখুন। রানী রাজাকে গিয়ে বললেন কুইক। আমার মিনিমাম দশ হালি রিসার্চার দরকার। মেলা বিজ্ঞাপন, মেলা আপ্লিকেশন, মেলা ইন্টারভ্যু, মেলা ইন্সটিট্যুট সব হল কিন্তু প্রপার ডেটাবেস কিছুই রেডি করা গেল না। এদিকে দিন চলে যাচ্ছে হু হু করে। রিসার্চাররা নিজেদের মধ্যেই বাওয়াল করে। কিছু বলে আগে হয়েছে, কেউ বলে না কখনই হয়নি। নিজেদের মধ্যে ব্যাপক গোলমাল বেধে গেল। এদিকে যে রিসার্চারদের রসার্চ পেপার বেরোয় রাজকোষের টাকায়, পরদিন সেই যায় টপকে। ভাইরে গোলমাল বোলে গোলমাল। পাশের দেশে নাকি ছমাস অন্তর ইস্যু বেরোয় নানা লিটিল ম্যাগাজিনের। আরে গাধা, ইস্যু যখন হচ্ছে তখন বিয়েও নিশ্চয়ই হচ্ছে, না কি সবই ঐ লিভটুগেদার! রাজা হুকুম দিলেন, কাঊকে দিতে হবে না পি এইচ ডি ডিগ্রি। খাক-দাক-বগল বাজাক, কিন্তু সিঙ্গল পি এইচ ডি যেন না দেওয়া হয়। শিক্ষামন্ত্রী মাথা নেড়ে চলে গেলেন। রিসার্চারা বেশির ভাগই বেচারা রিসার্চ করছিল একটা সার্টিফিকেটের আশায়, দেশে থেকে আর কোন আশা নেই, তখন তারা ছড়িয়ে পড়তে লাগল নানা দেশে। নিজেরা তো গেলই পারলে বৌ-বাচ্চাও নিয়ে যায়। দেশে জন-সংখ্যা গেল রাতারাতি কমে, রানীর মাথায় হাত। হায় হায় রাজকন্যা তো রেগুলার বিয়ে করার পাত্রও পাবে না দেশে!

    জ্যোতিষে রাজার একদম আস্থা নেই, তবু রানীর কান্নাকাটিতে ডাকতেই হোল। এরা সব বুজরুক। সায়েন্সের যুগে ঐসব গণনা ফননা চলে না। আর মালটা হোমিওপ্যাথি আয়ুর্বেদের মতই স্লো, আফটার অল দেশি মাল। এরমধ্যেই কেটে গেছে কয়েকমাস, এখনো জুতের একটা সলিউশন পাওয়া যায়নি। জ্যোতিষ হল, ফেং সুই হল, বিখ্যাত ক্রিকেট ম্যাচ ফিক্সার মাজহার মজিদ অবধি ফেল। কিছুতেই ফিক্স হল না রাজকুমারীর সখ। এদিকে ছয়মাস কেটে গেছে। রাজা গোপনে নির্দেশ দিলেন জঙ্গলে প্রাসাদ বানানোর, আর হাপিশ করে ফেল সব জন্তু জানোয়ার। সবই কিন্তু হতে লাগল গোপনে গোপনে। রাজা একদিন চুপিচুপি ভিতপু§জো করে এলেন। ফেরার সময় পথ আটকাল এক পাগল। প্রাথমিক ভয় কাটতেই রাজার সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল পাগলটার। তিনিও খুঁজছেন, সেও খুঁজছে কিছু একটা। বাহ কী চম্‌ৎকার মিল! দারুন লাগল তাকে বুকে জড়িয়ে নিতে। ইস কতদিন তিনি নির্বান্ধব ছিলেন! সেই পাগলই রাজাকে পরামর্শ দিল একটা একঘর করে পাগল-পুরী বানানোর। তাতে গিজগিজ করবে পাগল। পাগল কম পড়লেও বানিয়ে নেওয়া যায়, ইলেকট্রিক শক-টক দিয়ে। দি আইডিয়া। পাগল পুষবে রাজকন্যা। রিসার্চারদেরও সব দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে ইমিডিয়েটলি, প্রলোভন-টন দেখিয়ে। আর যাই হোক পাগলের কখনও কম পড়বে না দেশে।

    কিন্তু ব্যপারটা হল ঠিক উলটো। দেশে যখন বিশাল বিশাল এসি বাড়ি বানিয়ে যখন পাগল খোঁজা শুরু হল, তখন কোথায় কে। সব ভোঁ-ভাঁ। দু চারজন এসেছিল বটে কিন্তু তারা সব সেয়ানা পাগল, কেউ ফিল্ম মেকার কেউ বা সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার। রাজা সব দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেন। প্রথম থেকেই প্রোজেক্টে ভেজাল মাল ঢুকতে শুরু করলে শেষে আসল বলেই কিছু থাকবে না। তোমরা হয়ত ভাবছ পাগলা গারদ এসি কেন? আরে রাজকন্যার পোষা পাগলদের আলাদা পেডিগ্রি হবে না? রাজকন্যাও সেখানে যাবে মাঝে মাঝে পুষ্যিদের দেখতে, এসি অনেক ভাবনা চিন্তা করে লাগিয়েছেন রাজা। সেখানেও হরেক রকম পাগলের জন্য হয়েক রকম ডিজাইন, ব্যবস্থা কেউ থাকবে ঝুলে। কেউ হাতে ভর দিয়ে দাঁড়াবে। অন্য ডিজাইনের টয়লেট। ঝুলন্ত ডাইনিং টেবিল। পাখা থেকে চেন দিয়ে বাঁধা পাগল থেকে শুরু করে জলের তলায়- আন্ডারগ্রাউন্ড পাগলের চিড়িয়াখানা। কিন্তু হায় সে সব ঘপাঘপ ভরা তো দূরের কথা, রাজকন্যার প্রাকটিশের জন্যও ঠিকঠাক পাগল দু-এক পিসের বেশি পাওয়াই গেল না। পেয়াদারা সারা দেশ তন্নতন্ন করে খুঁজেও বেশি মাল সাপ্লাই দিতে পারলনা। পাগলরা কিছুতেই স্বীকার করে না যে তারা পাগল, ঠিক মাতালদের মতই। মাতালেরা কখনই স্বীকার করবে না তারা মাতাল। রাজার হাতে তখন দুটো রাস্তা খোলা, স্কুল-কলেজ বানিয়ে লোকজনকে পাগলামি শিখিয়ে পড়িয়ে নেওয়া, অন্যটা ইম্পোরট করা, মানে অন্যদেশ থেকে পাগল আমদানী করা। দুটৈ সময় সাপেক্ষ ব্যপার। সেখানেও ঝাড়াই-বাছাই থাকবে। একবছর শেষ হতে আর মোটে দুইমাস বাকী। রাজা জঙ্গলের বাড়ি একদিন চুপিচুপি দেখে এলেন, টাইলস-মার্বেলস বসে গেছে, জল আর ইলেক্টিসিটিটা বাকি। রাজার নির্দেশে আবার ঢ্যাড়া পিটিয়ে দেওয়া হল, পাগলের প্রোজেক্ট ক্যানসেল। আজকাল কোন কিছুই আর খালি পড়ে থাকে না। সেই এসি পাগলাগারদগুলিতে ঝপাঝপ গজিয়ে উঠল সব শপিংমল।

    রাজার ওয়াদা পূরণ হতে আর মাসখানেক বাকী। রাজার হাত পা এখন থেকেই শুকিয়ে যায়। নিজে একদিন ছদ্মবেশে জঙ্গলের বাড়ি চেক করে এসেছেন, প্লাজমা মনিটরে ডিস টিভি চলছে সারাক্ষণ। এমনিতে সবই ভাল। কিন্তু ওখানে যাওয়া মানে তো প্রজা, সেবাদাসী সব ছেড়ে চলে যেতে হবে। রাজা তো আর থাকতে পারবেন না! পাওয়ারের একটা অন্য মজা আছে। এই অর্ডার করছেন, একে বকছেন, ওমুকের গর্দান নিচ্ছেন, তমুককে দেশান্তরে পাঠাচ্ছেন, একটা অন্য স্যাটিস্ফেকশন, ঘ্যামা ব্যাপার। এইসব ছাড়া বেঁচে থাকা মানে মরে বেঁচে থাকা। রাতে ঘুম হয় না, রানীর দিকে ফিরে শুয়েছেন লাস্ট বোধহয় তিনমাস আগে। রাজকন্যাও খুব মন মরা। তার বাগানে যাওয়া মানা, পুতুল খেলা মানা। খেলা বলতে তার মায়ের মোবাইল সেট। রানীর অবশ্য নেশাটা ছিল নিত্যনতুন মোবাইল সেট কেনার, তাই রাজপ্রাসাদে মোবাইল সেটও ছিল অগুন্তি। রাজকন্যার সারাদিনের একমাত্র কাজ ছিল টিপে টিপে সেটগুলো খারাপ করার। অবশ্য তাকে যে সব কাজ নিজে হাতে করতে হত তা নয়। রাজার বাড়িতে কাজের লোকের অভাব থাকে না কখনও। রাজকুমারী জাস্ট আঙ্গুল তুলে দেখানোর অপেক্ষা। লোকজন ঝাঁপিয়ে পাড়ত সেটা খারাপ করার জন্য। সন্ধ্যাবেলা খাজাঞ্জিরা এসে পরখ করে দেখত সব ঠিক-ঠাক খারাপ হয়েছে কী না। মাস্টাররা মার্কশিটে লিখে দিত সেদিন কটা মোবাইল নষ্ট হল। সেটাই ছিল তার মার্কস। রানী নিজে হাতে মার্কশিটগুলো দেখতেন আর আহ্লাদে ফেটে পড়তেন। নাহ, এই মেয়ে বড় হয়ে ঠিক নাম রাখবে তাদের, ইনশাল্লাহ!

    রানীর শোক

    রানী মাঝে মাঝে বিদেশে যেতেন মোবাইল সেট কিনতে। বিশেষত চিনদেশে, সেদেশে নানান রকম- আম, বেগুন ,কলার মত দেখতে গোলাপী-কমলা-তুঁতে রঙের সব মোবাইল সেট পাওয়া যেত রাস্তার ধারে ধারে। রানী চিন থেকে প্রতিবারই কিনে আনতেন তিরিশ চল্লিশ হাজার মোবাইল সেট। তার সঙ্গে যেত এক বিশাল টিম। এত এত মোবাইল সেট তিনি একাহাতে পছন্দ করবেনই বা কী করে। মাত্র তো পাঁচ থেকে সাত দিনের ট্যুর। ফলে তিনি মোটা বেতন দিয়ে একটা টিম তৈরি করে ছিলেন। সেই টিমে ছিল- নাট্যকার, চিত্রশিল্পী, আভিনেতা, কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ। তারাই মেনলি পছন্দ করে কিনত মোবাইল সেট। রাণী রাখতেন কড়া নজর। কোন বাজে মাল না ঢুকে পড়ে তাদের সিলেকশনে। রাজস্বের টাকায় কেনা মোবাইলে হক আছে সারা দেশবাসীরই। তারা কোন প্রশ্ন করলে জবাব তো দিতে হবে তাকেই। রাজা তো আর মাস খানেক পরেই হাপিস। রানী ঠিক করলেন শাসনভার হাতে নিয়েই প্রথমেই মোবাইল পরিষেবা সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। মোবাইল মানে কমিঊনিকেশান। আর কমিউনিকেশান ব্যাপারটা শুনতে শুরুতে যতই কম কম মনে হোক এটা খুব ইমপরটেন্ট। তার কথায় তার টিমের সবাই বলল ইয়েস, ম্যাম। ইয়েস, ম্যাম। ইয়েস ম্যাম। আসলে তারা রানীর সব কথাতেই ইয়েস ম্যাম, ইয়েস ম্যাম করত। কিন্তু জানই তো এইসব শিল্পী-টিল্পী মানুষেরা হয় পিটপিটে শয়তান। মুখে এক আর ভিতরে অন্য। তারা আসলে ওয়েট করছিল, কবে রানী নিজের হাতে সাম্রাজ্য তুলে নেবে। তখন নিশ্চিত তারা সব হবে মন্ত্রী। তারা সব সময় হিসেব করত কে হবে কয়লা মন্ত্রী আর কে হবে আবাসন মন্ত্রী, কোনটায় বেশি মাইলেজ আর কোনটায় শ্রেফ হুড়ো। সেগুলো তারা খবরদার মুখে প্রকাশ করত না, মুখে বলত শুধু, ইয়েস ম্যাম। ইয়েস ম্যাম।

    রানীর নির্দেশমত নাট্যকার নাটক লিখলেন মোবাইলের উপকারিতা নিয়ে। সঙ্গীতকার গান বাঁধলেন, মোবাইলের ভিতর ও বাহিরে অন্তরে অন্তরে আছ তুমি। চিত্রশিল্পী আঁকলেন এক মোবাইল পৃথিবী। দেশে সবাই প্রচুর প্রচুর মোবাইল কিনে সবাই সবাইকে মিস কল দিতে লাগল। বেশ একটা উৎসবের মত পরিবেশ, কেবল রাজারই মন খারাপ। আর পনেরদিন পরে তাকে চিরতরে চলে যেতে হবে নির্বাসনে। তার অমন রবি ঠাকুরের মত প্যাঁচানো খাসা সইটার আর কোন ভ্যালু থাকবে না, পনের দিন পর। তার দু:খের কথা শোনার সময় রানীর নেই। দুই বেলা প্ল্যান বদলাচ্ছেন, কোন ফাঁক যেন না থাকে। এই সময় রাজার আমসি পড়া শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে তার চলবে না। তিনি ঠিক করে রেখেছেন, রাজা বনবাসে চলে গেলে একদিন শোক করবেন। কালো জামদানীটা পড়বেন সঙ্গে জামাইকা থেকে আনা কালো হিরের সেটটা। ব্রেকফাস্টে নিরামিশ খাবেন, একবেলা পতাকা নামান থাকবে, স্কুলে ছুটি একমাস। শোক পর্ব ভঙ্গ করবেন আই-শিহরণ নামে আপেলের নতুন মডেলটা কিনে। ঠিক হল সেইদিন দেশবাসীকে বিনা মূল্যে মোবাইল বিতরণ করবেন, ১৬ কোটি। এই ঘোষণা রটে যেতেই পরদিন সকালে রাজপ্রাসাদের সামনে লোকে বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে লাইন দেওয়া শুরু করল। এবং লাইন বাড়তেই লাগল বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। একেক ফ্যামিলিতে ২০-৩০ জন করে লোক! সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল পরপর। সবাই সেখানেই খাচ্ছে, সেখানেই ঘুমোচ্ছে। এই ভাবেই চলবে আরো ১৪ দিন। সর্বনাশ! রানী বললেন, না। কাউকে নিরাশ হতে হবে না, প্রথম রাজা হব আমি। সবার জন্য তিনি কিনে আনবেন মোবাইল সেট। প্ল্যান মাফিক এক বিরাট ডেলিগেশান টিম নিয়ে এয়ারবাসে করে রানী পাড়ি দিলেন চিনে।

    অনেক খোঁজাখুঁজির পর পাওয়া গেল সন্ধান। সে প্রায় গন্ডগ্রামে, গলি তস্যগলির ভিতর এক গ্রামে কবি সন্ধান পেয়েছেন এমন মোবাইল সেটের। যার দাম কম, দেখতে টুথপিকের মতন। মালটা যদিও ইউজ-এন-থ্রো তবু তো মোবাইলরে বাবা! কিনে ফেলা হল কোম্পানীর সমস্ত মোবাইল, সে প্রায় চল্লিশ লক্ষ কুইন্টাল। এই গ্রাম থেকে নিয়ে যাবেই বা কী করে? গাড়িই চলে না সেই সব রাস্তা দিয়ে। ভাগগিশ সেদিন কবি রাস্তা ভুল করেছিলেন হোটেলের তাই সন্ধান পেলেন এই জনতা-মোবাইলের। যা হবে তার দেশবাসীর আগামীদিনের হাতিয়ার। কবিকে উদ্ধার করলেন তারাই। তাদের এখানকার একমাত্র পরিবহণ গাধা, সেই গাধাই মোবাইল সেট টেনে নিয়ে যাবে বাংলাদেশে। সেই তিব্বত, রানাঘাট রুট হয়ে। প্রায় ১১হাজার গাধা জোগাড় হল কুড়িয়ে বাড়িয়ে। দাম পড়ল মোবাইলের দামের তিনগুণ। তবু উড়োজাহাজ কেনার থেকে তো সস্তা! যদি ১১ হাজার উড়োজাহাজ কিনতে হত? রানীর কথায় সবাই বলল ইয়েস ম্যাম, ইয়েস ম্যাম। গাধার পিঠে রানীর নাম লেখা চটের ছালায় মোবাইল পুরে সবাই নিশ্চিন্ত মনে ফিরে এল দেশে। ১১ হাজার গাধা হেলতে দুলতে যখন বাংলাদেশে পৌঁছাল তখন দেখা গেল তাদের পিঠে শতছিন্ন বস্তা বাঁধা আছে বটে কিন্তু একটা মোবাইলও নেই। রানী ভেঙে পড়লেন। আর অন্যদিকে তো হাহাকার। খবর বাতাসের থেকেও দ্রুত ছোটে। সমস্ত চ্যানেল ব্রেকিং নিউজ দেখায়। এক্সক্লুসিভ লেখা গাধার ফুটেজ, রানীর কান্না ভেজা চোখ, নিঝুম রাজপ্রাসাদ। রাজার বনবাসের শোক যেন দুইদিন আগেই শুরু হয়ে গেছে। রানী কাঁদছে, ইয়েস ম্যাম টিম কাঁদছে, রাজার কান্না তো এখন প্রেজেন্ট কনটিনিউয়াস ব্যাপার।

    লোকে মায়া কান্নায় ভুলবে কেন? আম জনতা স্বপ্ন দেখেছে মোবাইল ফোনের! রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, ক্লাইমেট চেঞ্জ উপেক্ষা করে তারা লাইন দিয়েছে মোবাইলের আশায়। একবেলার খাবার তিন বেলা খেয়েছে। একজনের খাবার পাঁচ জনে। সব দু:খ কষ্ট ভুলে যেত মোবাইল সেটটা হাতে পেলে। তারা রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করল। সবাই ঠিক করল আর তারা গ্রামে ফিরে যাবে না। ঢাকাতে বসেই হেন তেন প্রকারে মোবাইল জোগাড় করে দুইবেলা পালা করে রানীকে মিসকল দিয়ে দিয়ে মারবে। সে ঢাকা শহরে শুরু হল বিভ্‌ৎস অরাজকতা। চারিদিকে পিলপিল করছে মানুষ। ভাই ছিনতাই করছে ভাই এর মোবাইল। তার থেকে আবার অন্যকেউ। চারিদিকে লুঠ, ডাকাতি, ছিনতাই। রাজারপ্রাসাদও রেহাই পেল না। নগরে যখন আগুন লাগে তখন দেবালয়ও রেহাই পায় না। চুরি গেল অবশ্য কেবল মোবাইল সেট। রানীর প্রানাধিক প্রিয় সেই সব সেট, যার অধিকাংশই অবশ্য এখন অচল তবু নানা দেশে থেকে কেনা মেমেন্টোরই সমান। লোকজন সেই সবই নিল, কিছু আছাড় মেরে ভাঙ্গল আর কিছু সিন্দুকে ঢুকিয়ে তার চাবি পকেটে নিয়ে চলে গেল! রাজা আসন্ন বনবাসের কথা মাথায় রেখে সোনা-দানা, সুন্দরী সেবাদাসী সবই সরিয়ে ফেলেছিলেন জঙ্গলের বাড়িতে। তাই তার দু:খ হল কম কিন্তু রানী একেবারে ভেঙ্গে পড়লেন মোবাইলের দু:খে। সারা রাজপুরিতে শোকের ছায়া কিন্তু রাজকন্যার মুখে তখন ঝিকমিক করছে হাসি। রাজবাড়ির উঠোনে সার সার বাঁধা সব গাধা। কোন এক গাধার ওপর দিয়ে লাফিয়ে অন্য গাধায় যাচ্ছে সে। সেখান থেকে অন্য গাধায়। রাজা দূর থেকে দেখেই দৌড়ে মেয়ের কাছে। রাজকন্যা খুশিতে ডগমগ, আবদার ধরে এ সমস্ত গাধা সে নাকি পুষবে।

    মানুষ যখন ডুবতে থাকে তখন খড়কুটো পেলেও আঁকড়ে ধরে। গাধা পোষার ব্যাপারটা রাজার বেশ মনে ধরল, সাবাশ বেটি। নিশ্চয় গাধা কেউ পোষে না! শুরু হল খোঁজ নেওয়া। গুগুলে সার্চ করে তথ্যমন্ত্রী বললেন, না স্যার এখন আর কেউ পোষে না। আগেকার দিনে ধোপারা গাধা পুষত, কাপড়ের পোটলা বইবার জন্য। এখন স্যার তারা ন্যানো বা সিঞ্জি নিয়ে ঘোরে। ন্যানো? ন্যানোটা কি? গাধার মতই সাইজ কিন্তু স্যার চাকা লাগানো। সিঙ্গুরের নাম শুনেছেন? রাজা গেলেন চটে, কেন রে আমি কি ভুগোল মন্ত্রী নাকি! সব জায়গার নাম মুখস্ত করতে হবে। গুগুলটা আছে কী করতে। তথ্য মন্ত্রী বলল, ইয়েস স্যার। ভূগোল মন্ত্রী দূর থেকে হাত নাড়ল, ইয়েস স্যার। রাজা ঘোষনা দিলেন, আমার মেয়ে আজ থেকে গাধা পুষবে, আজ থেকে কেউ যেন গাধা না পোষে। পুষলেই গর্দান। তার নির্দেশে রাতারাতি খালি করে ফেলা সমস্ত শপিংমল, সেখানে থাকবে রাজকন্যার গাধারা। আগামী একমাস রাজকুমারী নামকরণ করবে সমস্ত গাধার। নাম দেওয়া হলে তবেই তারা থাকতে যাবে শপিং মলে, আলফাবেটিক্যালি। সব কিছুর একটা সিস্টেম আছে। তৈরি হল কমিটি, উপদেষ্টা পরিষদ। দুইবেলা দশটা করে গাধার নামকরন করা হয়। রাজাও হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন, রানীও ধিরে ধিরে শোক কাটিয়ে উঠছেন, মোবাইলের ক্যাটালগ, সাইট নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করেছেন। রাজার মনে এখন অভূতপূর্ব সুখানুভূতি। জঙ্গলে পাস করা মালপত্র- সোনাদানার ট্রাঙ্ক, মোহরের ঘড়া দুটো দুটো করে ফিরিয়ে আনছেন রাজপ্রাসাদে। রানীর চামচা নাট্যকার, কবি, সঙ্গীতজ্ঞ এখন রাজার কথামত ওঠে ও বসে। তারা এখন সুখ নিয়ে নাটক, গান কবিতা লিখছে। বিজ্ঞাপন দিয়ে আরো দশ হাজার গাধা কিনেছেন আফগানিস্থান আর আমেরিকা থেকে, এফডিসি ভাড়া নিয়ে বানিয়েছেন আরো দুটো ফাইভ স্টার আস্তাবল। রাজকন্যার ইচ্ছায় সেই সব গাধাদের নিয়ে রিয়েলিটি শো চালু করেছে সরকারি টিভি চ্যানেল। সেরা গাধা নির্বাচন করতে রানী এখন সারাদিন তার পছন্দের গাধার নাম্বারে জখজ করেন, লোক রেখেছেন খান দশেক ঐ জখজ করার জন্য।

    রাজার সুখ

    ধিরে ধিরে রাজা দেশ-বিদেশের সমস্ত গাধাই কিনে নিলেন রাজকন্যার জন্য। সে অবশ্য আর এখন ছোটটি নেই। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে সে এখন গাধাদের সঙ্গেই থাকে, হেসে খেলে বেড়ায়, সেটাই এখন রিয়েলিটি শোয়ের সাবজেক্ট, বিগ অজজ আনলিমিটেড। আমাজনে অনলাইনে ভাল ভাল বিদেশি ব্রিডের গাধা কেনে রাজকন্যা অর্ডার দিয়ে, শো মাস্ট গোজ অন। রানীও এখন একটু থিতু, মোবাইল সেটের অভিনব মিউজিয়াম নিয়ে সে ব্যস্ত, সারাদিনরাত। মোবাইলে তোলা ছবির এগজবিশান, মোবাইলে তোলা সিনেমার চলচ্চিত্র উৎসব আরো কত কী! রাজার চামচারাও সব নিজের পছন্দের সব ডিপার্মেন্টে মন্ত্রী। রাজা নতুন নতুন ডিপার্টমেন্ট খুলে মন্ত্রী বানিয়ে দেওয়াতে তারা পিছন পিছন ল্যাংবোটের মত ঘোরা বন্ধ করেছে। রাজার ধারণা ছিল তিনি খুব সুখি। সেইমত প্রচার করতেন। প্রচুর মানুষ সুখ দেখতে আসত, দূর দূরান্ত থেকে। কড়া প্রহরায় সুখ তারা হাতে তুলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখত টিকিট কেটে। তারপর সময় শেষ হলে বেল বেজে উঠত। সুখ তাদের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে কাঁচের বোয়ামে ঢুকিয়ে ফেলত রাজ কর্মচারীরা। বর্ডার গার্ডরা ছিল খুব কড়া, সুখ কিছুতেই দেশের বাইরে যেতে দেওয়া হত না। কেবল তার প্রজারা সুখের ছটা অনুভব করত।

    বজ্রা আটুনি ফস্কা গেরো। রাজার সুখ গেল চুরি। রাজা খুব অসুখি হয়ে গেলেন। খুব রাগ, বদমেজাজ, হাই ব্লাডপ্রেসার, যাকে পারেন শূলে চড়িয়ে দেন আর কি? ঘুম টুম নেই, খালি খিটখিট। হুকুম দিলেন, সমস্ত সুখি মানুষদের ধরে আনো। প্রাজারা ছিল সবাই অতিষ্ঠ, খামখেয়ালি রাজার কারণে তাদেরর জীবনে কোন সুখ ছিল না। সেপাইরা নির্দিষ্ট দিনে কোন সুখি মানুষই হাজির করতে পারল না। রাজা নি:সন্দেহ হলেন, সুখ তার এলাকার বাইরে চুরি গেছে। বর্ডার গার্ডদের গর্দানের নির্দেশ দিয়ে কিছুটা সুখ ফিরে পেলেন। এই বর্ডার গার্ডগুলো কোন কাজের না খালি বখরার হিসাব করে আর মাঝে মাঝে অপারেশন ডাল ভাত। সেনাবাহিনীর ওপরেও রাজার ক্ষার ছিল বিস্তর। তারা রাজার প্রয়োজনের সময় একটা পাগলও সাপ্লাই দিতে পারেনি। সাফিশিয়েন্ট পাগল পেলে এই রকম চড়া দামে দেশ-বিদেশ থেকে গাধা কিনতে হত না। র‌্যাব, সেনা সবাইকার হল ডিমোশন। এখন থেকে তারা হবে আস্তাবলের সহিস। সারাদিন ধরে পরিচর্যা করবে দেশি-বিদেশি গাধার। নির্দেশ জারি করে রাজা আরো কিছুটা সুখ খুঁজে পেলেন।অবাকী রইল রানী। সারাজীবন রাজাকে টাইট দিয়ে এসেছেন। রাজকোষের শ্রাদ্ধ করে করে মোবাইল সেট কিনেছেল, রাজা কোনদিন টু শব্দটাও করতে পারেন নি, কিন্তু সুখ চুরি যাওয়ার পর থেকেই রাজার মাথার ঠিক নেই। মোবাইলে রিং বাজলেও গা গুলোচ্ছে। রাজার নির্দেশ জারি হয়ে গেল, বাংলাদেশে যার কাছে একের বেশি মোবাইল থাকবে দুদমি (দুর্নিতি দমন মিশন) তাদের ধরে জঙ্গলে সমস্ত নেটওয়ার্ক পরিসীমার বাইরে রেখে দিয়ে আসবে। রাজার আদেশ। কাজও শুরু হয়ে গেল। যথারীতি রানীকেই প্রথম ধরল দুদমি। রাজা আরো কিছুটা হৃত সুখ ফিরে পেলেন।

    মেলা দিন পরে এক ভিকিরি মানুষ সাত সকালে সারেন্ডার করল, সে সুখ চুরি করেছে। রাজা উটকো মন্ত্রীকে পাঠালেন তদন্তের জন্য। মন্ত্রী তার সাথে কথা বলে ভ্যবাচ্যাকা খেয়ে গেল। এল ভ্যাবাচ্যাকা মন্ত্রী। পাগল নিরুত্তাপ সে শুধু হাসে। প্রতি প্রশ্নের একই উত্তর, হাসি। হাসি মন্ত্রী গোয়েন্দাদের কথায় কনভিন্সড হলেন, এই সুখ চুরি করেছে। টানতে টানতে অমিতবিক্রমে নিয়ে গেলেন রাজার কাছে। হাসি দেখে রাজারও ভ্যাবাচ্যাকা লাগল। তিনি এক্সট্রা¡ক্ট মন্ত্রীকে হুকুম দিলেন একে এখান থেকে নিয়ে যাও আর সমস্ত সুখ বের করে নাও। ডাক্টাররা আÒট্রাস্নো আর সিটি ইস্ক্যান করে কূল পেল না। সবাই মাথা চুলকাতে লাগল। শালা যে সুখটা কোথায় লুকিয়েছে কেউ ঠাউরই করতে পারছে না! রাজা সমস্ত ডাক্টার ধরে ধরে কোতল করে দিলেন। পাগল ভিখারির হাসি এতে আরো বেড়ে গেল। তাই দেখে কান মাথা সব রাগে টনটন করতে লাগলো। কিন্তু রাজা ছিলেন বিচক্ষণ তাই চুপ করে সব সহ্য করতে লাগলেন। রাজা সবাইকে এক বছরের নোটিশ দিলেন। যেমন করে হোক তার সুখের ফর্মুলা চাই যে এনে দেবে তকে অর্ধেক রাজত্ব আর তার নিজের মেয়ের সাথে বিয়ে দেবেন। সায়েন্টিস্টরা দুদ্দাড় দেশ ছেড়ে পালাতে লাগল, তারা ভাল করেই জানে একবছর পর তাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে। দেশে আর সায়েন্স পড়তে কেউ চাইল না। নব জাতেকদের সবাই মাদ্রাসায় ভর্তি করতে লাগল। মাদ্রাসার সংখ্যা প্রচুর বেড়ে গেল।

    ভিখারিটাকে এক অন্ধকার কারাগারে বেঁধে রাখা হয়েছিল। কড়া প্রহরায়। প্রহরীদের কানা ঘুসো ক্রমশ: বাইরে আসতে লাগলো, রোজ রাতে নাকি ভিকিরিটা গাধা হয়ে যায়। তাও যে সে গাধা নয়। সোনার গাধা। রাজার নির্দেশে গাধা কেয়ার মন্ত্রী গেলেন তদন্তে। অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে আছেন তো আছেন, ঘুমে চোখ লেগে আসছে। হটাৎ চোখ কচলে দেখেন, সত্যিই কারাগারে একটা সোনার গাধা বাঁধা আছে। দৌড়াতে দৌড়াতে রাজাকে গিয়ে জানালেন সেই কথা। রাজার মাথায় একটা বুদ্ধি এল, সোনার গাধাটাকে যদি রাতের ভেতর বদল করে ফেলা যায়? এটাই হবে রাজকন্যার আসন্ন জন্মদিনের গিফট। মন্ত্রী বলল, সেটা ঠিক হবে না মহারাজ। সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁসের গল্প পড়েন নি? সিচুয়েশনটা নষ্ট না করে কাল আপনাকে কারাগারে বেঁধে রাখি। আগে দেখি গুণটা ঘরের না লোকটার! রাজার শুনে গা পিত্তি জ্বলে গেল, নিশ্চয়ই গাধা মন্ত্রীটা আমাকে কারাগারে পাঠিয়ে নিজে রাজা হতে চায়! পিস্তলটা বার করে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্কে এ চালিয়ে দিলেন গুলি।

    রাজা সারাদিন ভাবলেন, গাধা মন্ত্রীর কথা একেবারে উড়িয়ে দিতে পারলেন না। এতদিন তার পরামর্শই শুনে এসেছেন গাধা প্রতিপালনের ব্যপারে, অভ্যাস বলেও তো কিছু আছে! আরেস্ট মন্ত্রীকে হুকুম করলেন তাকে বেঁধে ঐ কারাগারে রাখতে। কারা মন্ত্রী জানাতো এই নির্দেশ না মানলে তাদের কি অবস্থা হবে, তাই বিনা বাক্যব্যয়ে তারা রাজাকে বেঁধে ঐ কারাগারে নিয়ে গেল। আর কি আশ্চর্য কারাগারে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে রাজা আস্ত একটা রামছাগলে পরিণত হল। ভিখারির হাসি আর থামেনা, বলল, রাজা তুই পরের জন্মে গাধা হোস বরং, এখন এই ভাবে থাক। সবাই তার অলৌকিক ক্ষমতার কথা না জানলেও এই পরিস্থিতিতে সবাই তার কথা মেনে নিল। অন্তত খামখেয়ালি আর বদমেজাজি রাজার পাল্লায় আর পড়তে হবে না। রাজকুমারী খবর পেয়ে ছুটে এল কারাগারে। রাজার অবস্থা দেখে প্রথমে একটু চমকালেও ভিখারির চোখে চোখ রাখতেই ঝলসে গেল তার কলিজা, আহা আমার গাধা সোনা। মনে হল ভিকারি যেন স্বয়ং ঈশ্বরের পাঠানো ফেরেস্তা। তার কাছে এসে ধিরে ধিরে তাকে প্রেম নিবেদন করল রাজকন্যা। অত:পর বিয়ে। ভিখারি আর ভিখারি রইল না। সেই হয়ে বসল সে রাজ্যের রাজা, আর সবাই সুখে কালাতিপাত করতে লাগল।

    ছবি- সায়ন কর ভৌমিক
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ইস্পেশাল | ০১ অক্টোবর ২০১০ | ১৪২৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে প্রতিক্রিয়া দিন