এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • মগ-মোগল-পর্তুগিজ-ব্রিটিশ-ওলন্দাজ-বাঙালি : এক ঐতিহাসিক ভুরাজনৈতিক উপন্যাস

    Sudeep Chatterjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৬ জুন ২০২১ | ১২৯৪ বার পঠিত

  • আন্দালুসিয়ার শহরে একটা বইয়ের দোকানে ঢুকে কয়েকটা বই নজরে পড়েছিল। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে পর্তুগিজদের ভারতবর্ষে আসা নিয়ে লেখা, বিশেষত বাংলা ও বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের নানা দেশ আর রাজ্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করার কাহিনী। মুর রাজাদের জাহাজ ব্যবহার করে পর্তুগিজ ব্যবসায়ীরা ভারতে পাড়ি দিয়েছিল, এদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তী সময়ে কুখ্যাত হয়ে উঠেছিল জলদস্যু হিসেবে। স্বাভাবিকভাবেই বইগুলো ছিল স্প্যানিশ ও পর্তুগিজ ভাষায় লেখা।

    যাই হোক, বাংলার এই ইতিহাস নিয়ে স্পেনের দোকানে সারি সারি বই দেখে আমি বেশ অবাকই হয়েছিলাম। সেই যুগের ইতিহাস ও পর্তুগিজ শাসকদের বাংলা ঔপনিবেশবাদ গড়ে তোলা নিয়ে বাংলায় খুব কম লেখাই চোখে পড়েছে। সমসাময়িক কালে এই প্রথম একটা পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস এসে সেই জায়গাটা ভরাট করল।

    ‘পাইয়া ফিরিঙ্গ ডর’ এক নিশ্বাসে পড়ে ওঠার জন্যে লেখা হয়নি। মগ, পর্তুগিজ, আরাকান, মোগলরা যখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, সেই সময়টাকে পুঙ্খানুুঙ্খভাবে তুলে ধরতে চেয়েছেন রাজর্ষি। বিভিন্ন চরিত্র ও বহুস্তরীয় দৃষ্টিকোণ ফুটে উঠেছে কাহিনীর আঁকেবাঁকে। নন লিনিয়ার ন্যারেটিভকে দক্ষ ভাবে ব্যবহার করেছেন লেখক, ফলে বিভিন্ন কাহিনীর মাঝে বুনে তোলা সূত্র জুড়ে গেছে একে অপরের সঙ্গে, সময়ের ফাটলগুলো ভরাট হয়ে গেছে সাবলীলভাবে।

    লেখাটা পড়তে আমার বেশ সময় লেগেছে, তার প্রধান কারণ এর ব্যাপ্তি ও ডিটেইটিং। এই আখ্যানের ভাঁজে ভাঁজে সূক্ষ্ম কারুকাজ আছে, নিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে প্রতিটা পরিসর, ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের সামাজিক জীবনযাত্রার খুঁটিনাটি। বস্তুত এই বিন্দুগুলো এই লেখার স্ট্রং পয়েন্ট, আগ্রহ থাকলে এই জায়গাগুলো দ্রুত পেরিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। মন দিয়ে পড়লে বোঝা যায়, তথ্যের খুঁটিনাটি ও সত্যতা সম্পর্কে লেখক কতটা যত্নবান! রাজর্ষি কোথাও ভাষাকে অযথা জটিল করেননি, কিন্তু বিষয়বস্তুর স্পষ্টতা আর পরিবেশ তৈরি করার ক্ষমতা নিয়ে কোন কথা হবে না।

    'পাইয়া ফিরিঙ্গ ডর' কে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা যেতেই পারে, আবার সামাজিক অথবা প্রেমের উপন্যাস বললেও ভুল হবে না। এই বহুকৌণিক কাহিনীতে যেমন টিবাও, ভিশকু আর কাবালহোর মতন পর্তুগিজ দস্যু আছে, সেরকমই আছে নগেনের মত ভাগ্যান্বেষী বাঙালি, ধনী পরিবারের ছেলে শ্যামল, আধা ফিরিঙ্গি ওফেলিয়া। এমনকি জলার পেত্নী কর্পূর্মঞ্জরীও আছে। (এরকম বাস্তবভিত্তিক লিটারারি উপন্যাসে পেত্নী দেখে সত্যিই ভড়কে গিয়েছিলাম, ব্যাপারটা মেটাফর কি না বোঝার চেষ্টা করছি, ইতিমধ্যে আবিষ্কার করলাম এই অলৌকিক আখ্যান সহজ ভাবে জুড়ে গেছে মূল কাহিনীর সঙ্গে, কোথাও খাপছাড়া মনে হয়নি। সুতরাং সেই চিন্তায় অব্যাহতি দিলাম )

    যাই হোক, আমার মতে, পাইয়া ফিরিঙ্গ ডর আদ্যোপান্ত রাজনৈতিক উপন্যাস। আরো ভাল করে বলতে গেলে ভূরাজনৈতিক উপন্যাস। সপ্তদশ শতাব্দীতে জিও পলিটিকাল ফিকশন লেখা হত না নিশ্চয়ই, সে অর্থে এই কাহিনী বিরল। ক্ষমতা লাভ ও সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের পাশাপাশি রাজনৈতিক সম্পর্ক, যুদ্ধের পরিকল্পনা, স্ট্র্যাটেজিক ওয়ারফেয়ার, কূটনীতি, ধর্মবিশ্বাস ও প্রতিশোধ... সব মিশে গেছে এই কাহিনীতে। এখানে বলে রাখা ভাল, বইয়ের শেষের দিকে সামুদ্রিক ঝড় এবং নৌযুদ্ধের একটা সিকোয়েন্স আছে, এমন রুদ্ধশ্বাস এবং ডিটেইলড বর্ননা আমি কোনদিন পড়িনি মনে হয়। রান্নাবান্না হোক অথবা ভাষা, নৌবিদ্যা হোক অথবা আলাপচারিতার ভাষা - কোথাও কোন খুঁত নজরে পড়ল না।

    শেষে বলি, চারিত্রিক বিশ্লেষণ না করলেও বোঝা যায়, এই গল্পে প্রতিটা চরিত্রের একটা যাত্রা আছে। এই যাত্রা একান্তভাবে ব্যক্তিগত, কিন্তু কাহিনীর মূলস্রোতের সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে ঠিকই। জীবন প্রতিটা চরিত্রকে বদলেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, ফলে তারা প্রায় রক্তমাংসের চরিত্রের মতোই জীবন্ত বলে মনে হয়েছে। সাদা হাতি পেগু অথবা পেত্নী করপূর্মঞ্জরী ও ব্যতিক্রম নয়। এই ক্যারেকটার আর্ক এই উপন্যাসকে অন্য স্তরে নিয়ে গেছে।

    প্রায় তিনশ পাতার এই উপন্যাস আদতে আবহমান ইতিহাসের একটা জানলা ( ওয়ার্মহোল বলাটা কি বাড়াবাড়ি?) যেখান থেকে খুব সহজেই চলে যাওয়া যায় চারশ বছর আগের একটা সময়ে। সচক্ষে দেখে আসা যায় সন্দ্বীপ, সেগ্রাম, রোসাঙ্গা অথবা চাটিগাঁকে। মগ মোগল পর্তুগিজ ব্রিটিশ ওলন্দাজ বাঙালিদের জীবন অনুভব করতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হয় না।

    পাঠকদের কাছে কাম্য, বইটাকে সময় দেবেন। এই বই আপনার মনোযোগ দাবি করে। আমার বিশ্বাস, 'পাইয়া ফিরিঙ্গ ডর' আপনাদের হতাশ করবে না।

    পাইয়া ফিরিঙ্গ ডর
    রাজর্ষি দাস ভৌমিক
    সৃষ্টিসুখ
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল মতামত দিন