এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • টালিগঞ্জ অবহেলিত ইতিহাস

    Manab Mondal লেখকের গ্রাহক হোন
    ১১ মে ২০২১ | ১১৭৩ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • আমার একটি লেখা প্রসঙ্গে একজন লিখেছিলেন -

    "ভাষার সাথে ধর্মের সংঘাত আমার মতে সবচাইতে বড়ো মূর্খামির পর্যায়ে পরে, কারণ

    ১) যে মানুষটা বাংলা বলে সে হিন্দুও হতে পারে বা মুসলিমও হতে পারে বা খ্রিস্টানও হতে পারে
    ২) যে হিন্দু শুধুই বাংলা জানে চিকিৎসা করাতে নামকরা মুসলিম ডাক্তারের কাছে গেলে ধর্ম তার চিকিৎসায় বাধা হবে না, কিন্তু ভাষা একটা বড়ো ব্যাপার হবে ডাক্তার বাংলা না জানলে হিন্দু বাঙালী সঠিক চিকিৎসা পাবে না, আমাদের চলার পথে ভাষাই সব, ধর্ম নয়
    ৩) ধর্মের পরিবর্তন ঘটে কিন্তু ভাষার পরিবর্তন হয় না। আজ যে মুসলিম-বাঙ্গালী কাল সে ধর্মের পরিবর্তন করে হিন্দু-বাঙ্গালী হতে পারে কিন্তু ভাষা একই থাকে।"

    তাই বাঙালি ভাষা আন্দোলন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, বেঁচে থাকার লড়াইএর সাথে এটি সরাসরি যুক্ত। বাঙালি জাতির মেধা আর সংস্কৃতির পরিচিত। কিন্তু বাঙালী দুধেভাতে থাকা মধ্যবিত্তে আটকে থেকেছে, তাদের কোন উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই - তেমন ছবি তৈরি হয়েছে। গুজরাটি কিংবা মারোয়ারী মানে বড়লোক। কিন্তু তখনই মনে হল কলকাতার চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বাঙালির যে ঐতিহ্যগুলো তাকে তুলে ধরা উচিত। চাঁদবনিকরা কাব্যের কাল্পনিক চরিত্র হলেও বাস্তবে ঠাকুর কিংবা রায়চৌধুরীরা ছাড়াও বড়লোক বাঙালি ছিলেন।

    ধরুন বড় রাসবাড়ির কথা বলি। মন্ডল জমিদাররা প্রতিষ্ঠা করে এই মন্দির। দক্ষিণ কলকাতায় ৮০, টালিগঞ্জ রোডে রয়েছে বাওয়ালিদের বড় রাসমন্দির। রানি রাসমণির সঙ্গে এই মন্দিরের একটি সম্পর্ক আছে। প্রমীলা মন্ডল রানী রাসমনির নাতনি ছিলেন। এখানকার দ্বাদশ শিবমন্দির গুলোর অবস্হা খারাপ হলেও রাধাকৃষ্ণ মন্দিরটি মনভোলানো পরিবেশে। নাটমন্দিরের প্রাচীনত্ব গঠনশৈলী নজর কাড়ে। আটচালা মন্দির এটি। ১৭৫৬ সালে উদয়নারায়ণ মন্ডল এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। বড় রাসবাড়ির কিছু দূরে আছে ছোট রাসবাড়ি। ৫৫, টালিগঞ্জ রোডে ছোট রাসমন্দির প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৪৬ নাগাদ। ছোট রাসবাড়ির এই মন্দিরগুলি নির্মাণ করেন পেয়ারিলাল মন্ডল ও মনিমোহন মন্ডল। মন্দিরগুলি সবই আদি গঙ্গার তীরে। মন্দিরের ভিতরের বড় উঠোনটি দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। সাদা ও কালো মার্বেল পাথর দিয়ে দাবার ছকের ডিজাইন করা। মন্দিরে ঢুকেই প্রথম চোখে পরে উত্তর দিকের একটি নবরত্ন মন্দির, আর তার পাশের দুই দিকে দুটো পঞ্চরত্ন মন্দির। নবরত্ন মন্দিরটি উৎসর্গ করা হয়েছে শ্রীশ্রী গোপাল জীউ-এর নামে। আর পঞ্চরত্ন মন্দির দুটি কাশীপতি শিবকে উৎসর্গ করা হয়েছে। নবরত্ন ও পঞ্চরত্ন মন্দিরটির রূপ দেখলে চোখ ফেরানো যায় না। আর গোপালের মূর্তিটিও অতি সুন্দর।

    পুরো মন্দির চত্বরের ভিতরের দেয়াল ঘেঁষে আছে ১২টি শিবমন্দির, যাতে আছে কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ। তবে সংস্কারের অভাবে, আজ সবই ভগ্নপ্রায়। মন্দিরের বারান্দায় রাখা আছে একটি বড় কাঠের সিংহাসন, সেটার অবস্থাও বেশ খারাপ। এখানে একটি ঘাট আছে যা ছোট রাসবাড়ি ঘাট নামে পরিচিত। এই ঘাটটি চার কলাম বিশিষ্ট। কিন্তু বর্তমানে এর অবস্থা খুবই শোচনীয়। প্লাস্টার চটে গেছে এবং প্রায় ধ্বংসের মুখে। এখানে একটি নহবতখানাও ছিল। এক সময়ে এই ঘাটের দুদিকে দুটি ঘর ছিল। অনেক সিঁড়ি বেয়ে নেমে তবেই ঘাটে নামা যেত। কিন্তু এর অবস্থা এখন বেহাল, আদিগঙ্গার মতই।

    দুই বাড়িতে অবশ্য প্রতি বছর পুজো হয়। প্রথমটিতে কার্তিক পুজো, দ্বিতীয়টিতে চৈত্র পুজো হয়। তিন দিন ধরে মেলা বসে। বাংলা ১২২৩ সালের ফাল্গুন মাসে কৃষ্ণ একাদশীর দিন টালিগঞ্জে বর্তমান দ্বাদশ মন্দিরের মাঝখানে সাজানো চিতায় বংশের এক পূর্বপুরুষ মানিক মণ্ডলের স্ত্রী সহমৃতা হয়েছিলেন। সতী মুক্তকেশীর শাখা-সিঁদুর এখনও রয়েছে টালিগঞ্জে বাওয়ালিদের বাড়িতে। আদিগঙ্গার ধারে এককালে গৃহদেবতার নামে তৈরি হয়েছিল গঙ্গাগোবিন্দের ঘাট, গোপালজীর ঘাট। স্থানীয় হাজার রকম লোক এই সব ঘাট ব্যবহার করছে।

    তবে এদের প্রতিষ্ঠিত নিউআলিপুর অঞ্চলে মন্দিরটাও নজর করার কথা সবার। আঠারো শতকের কোন এক সময়ে রবার্ট ক্লাইভ মণ্ডলদের কলকাতায় এসে বসবাসের জন্য অনুরোধ করেন।রবার্ট ক্লাইভের কথা রাখতে রামনাথ মন্ডল ও মানিক মন্ডল তৎকালীন আদিগঙ্গার তীরে বর্তমানে টালিগঞ্জ এলাকায় এসে বসবাস শুরু করেন।

    রামনাথ মন্ডল এবং মানিক মন্ডল পারিবারিক সংস্কার, ঐতিহ্য, পরম্পরা রক্ষা করে চেতলা অঞ্চলে বহু মন্দির এবং মন্দির কমপ্লেক্স তৈরি করেন। দেবদেবীদের প্রতি মণ্ডলদের ছিল অগাধ বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা, তাছাড়া তারা ছিল কুলীন বংশ। যে সমস্ত মন্দির তারা নির্মাণ করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান মন্দির ছিল নিউআলিপুর অঞ্চলের এই রাধাকান্ত মন্দির। রামনাথ মন্ডল এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই মন্দিরটির নির্মাণ শুরু হয় ১৭৯৬ সালে এবং শেষ হয় ১৮০৯ সালে। এটি একটি নবরত্ন মন্দির। রাধাকান্তদেবের এই মন্দিরটি কলকাতার সর্বাপেক্ষা উচ্চ মন্দির। এর উচ্চতা প্রায় ১১০ ফুট। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য দক্ষিণেশ্বরে রানী রাসমণি প্রতিষ্ঠিত ভবতারিণী মন্দিরটি অনেকের মতে এই মন্দিরের আদলে তৈরি। এই দুটি মন্দিরের মধ্যে গঠনশৈলীতে সাদৃশ্য রয়েছে।

    এই মন্ডল বোয়ালির জমিদাররা মূলত রাম রাইয়ের উপাধি বহন করে। রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা বাসুদেব রামরায় ষোল শতকের (১৫০০-১৬০০) মানুষ ছিলেন। বাসুদেব রামরায়ের নাতি ছেলে শোভারাম রায়। শোভারাম রায় মোগল সম্রাট আকবরের সেনাদলের এক পদস্থ আধিকারিক ছিলেন, পরিচিত ছিলেন সেনাপতি মানসিংহের সাথে। শোভারাম রায় দক্ষতার সাথে বিভিন্ন বিদ্রোহ দমন করেছিলেন। জলদস্যু দমনেও তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দেন। খুশি হয়ে সম্রাট তাকে তিন লক্ষ একর জমি দান করেন এবং তিনি 'মন্ডল' উপাধি প্রাপ্ত হন। সেই থেকেই তারা 'রায়' পদবী বাদ দিয়ে 'মন্ডল' পদবী ব্যবহার করতে থাকেন। ধীরে ধীরে উন্নতি করতে থাকে এই মণ্ডল রাজ পরিবার। শোভারামের নাতি রাজারাম মেদিনীপুরের হিজলির রাজ পরিবারের প্রধান সেনাধ্যক্ষ ছিলেন। রাজারামের সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়ে রাজা তাকে ৫০টি গ্রাম দান করেন, যার মধ্যে বাওয়ালি এবং বজবজ ছিল। তারা ১৭১০ সালের দিকে বাওয়ালিতে স্থায়ী হয়। রাজরামের নাতি হারাধন, যিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতা উপভোগ করেছিলেন এবং তাঁর ছেলেরা বাওয়ালিতে অনেক মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। তবে এই অঞ্চল তখন ছিল বন জঙ্গল। 'বনে এলি গেলি’— এই কথা থেকে ‘বাওয়ালি’।

    যাই হোক এই মন্দিরগুলোয় যাতায়াত করা মানুষজনের অনেক অভিযোগ আছে। বাঙালি বনেদি পরিবারেরগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হওয়ায়, হয়ত বাঙলার অনেক জায়গায় এই রকম অনেক মন্দির পাওয়া যাবে। নিন্দুকেরা বলেন, বাংলার মতো ভারতের কোন রাজ্যে ভুমি সংস্কারের কাজ হয় নি। ফলে বাংলার জমিদারেরা হঠাৎ করে তাদের শ্রী হারিয়েছে। বাংলার এলিট শ্রেণীরা তখন বিপদে পরেছেন, তখনই মারোয়ারী গুজরাটিরা দখল করেছে বাংলার অর্থনৈতিক তালা চাবি।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন