এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • মধু নিয়ে মধুর ষড়যন্ত্র

    Manab Mondal লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৫ মার্চ ২০২১ | ১০৭৫ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • সুন্দরবনে মধু খোঁজা আর বাঘ খোঁজা সমান কথা! কারণ দুটোই গহীন জঙ্গলে থাকে। জঙ্গলের গহীনে মৌচাকে মধু জমায় মৌমাছি। আর মৌমাছির কষ্টের ধন ‘মধু’ বনজঙ্গলে ঘুরে খুঁজে বের করেন একদল মানুষ। তাদের আমরা ‘মৌয়াল’ নামে চিনি। জীবিকার তাগিদে সুন্দরবনের ‘মউলি’ বা মধুসংগ্রহকারীদের ঘন দুর্গম জঙ্গলের ভয়াবহ বিপদসঙ্কুল পরিবেশে নিরাপত্তা ছাড়াই কাজ করতে হয় – একদিকে বাঘ কুমিরের ভয়, অন্যদিকে বনদপ্তরের ফতোয়ার সন্ত্রাস।

    সুন্দরবনে বিকল্প কর্মসংস্থান না করে বনজীবীদের পেশা হরণ করা উচিত নয়। সুন্দরবনে কোর এবং বাফার এরিয়া অলরেডি রয়েছে। কোরে মৎসজীবি, সাধারণ মানুষ, এমনকি পর্যটকদের প্রবেশ নিষেধ। যেটুকু অঞ্চল মৎসজীবিদের যেতে দেওয়া হয়, সেখান নির্দিষ্ট কিছু শর্ত মানতে হয়। যেমন, জ্বালানি কাঠ কতটা থাকবে, ইত্যাদি। সেক্ষেত্রে মৎসজীবিদের জঙ্গলে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা কতটা জরুরি? সবচেয়ে বড় আক্রমণ আসছে মধু সংগ্রহকারীদের ওপর।

    একটি সোস্যাল মিডিয়া প্রতিবাদে আমাদের সমীরণ মন্ডল লিখেছেন বা প্রশ্ন করেছেন - "আদালতের তাৎক্ষণিক রায় সম্পর্কে সুন্দরবন নিয়ে NGO ও বিশেষজ্ঞদের প্রতিক্রিয়া কী? আপনারা কথা বলছেন না কেন? প্রচুর লোক বেকার হলে তখন চালডাল নিয়ে গিয়ে ছবি তুলবেন তাই? নাকি সরকারি পুরস্কার বাতিল হতে পারে? কোন সম্ভাবনা থেকে কথা বলতে চাইছেন না? আমরা কী ধরে নেব আপনারা এলিট শ্রেণীরা কথা বলবেন না। সহযোগিতা করবেন না। অবাস্তববাদী প্রকৃতি প্রেমিক এটা বলে যে অন্যান্য জঙ্গলের মতো সুন্দরবন জঙ্গলের ভিতর মানুষ বসবাস করে না।"

    আপনারা বলবেন না, যে মৎসজীবিরা জঙ্গলে গেলেও তাদের জঙ্গলের একটি পাতা ছোঁয়ার অধিকার আমরা দিই না। আপনারা বলবেন না, যে বেঁধে দেওয়া সীমানার বাইরে একচুল ভুল করলে আমরা মৎস্যজীবিদের হাজার হাজার টাকা ফাইন করি? আপনারা বলবেন না, যে একটি মৎসজীবির নৌকায় কী কী থাকবে তার লিস্ট আমরা বানিয়ে দিই, তার থেকে বেশি কিছু পেলে আমরা নৌকা ও BLC বাজেয়াপ্ত করি। বলবেন না, যে ওদের অধিকার এমনিতেই আমরা হরণ করে রেখেছি। যাতে আমরা AC তে সুস্থভাবে ঘুমোতে পারি। বলবেন না আমাদের খনিজ তেলের ফোর হুইলার চালাতে অসুবিধা করার মতো ওদের কোনো অধিকার আমরা দিয়ে রাখে নি? আর একটা কথা বলুন এলিট শ্রেনী, পুরস্কার? না মানুষের হাসি এবং পেটের ভাত? কোনটির মূল্য বেশি?"।

    আসলে মুল সমস্যাটা অন্যখানে। কিছুদিন আগে একটা প্রতিবেদনে পড়ছিলাম যে কীটনাশক ব্যবহারের ফলে গ্রামবাংলার মৌমাছি প্রায় উধাও হয়ে গেছে। বুঝতে হবে যে কমবেশি কুড়ি হাজার প্রজাতির মৌমাছি রয়েছে। যার মধ্যে মাত্র কয়েকটা বাণিজ্যিক মধু উৎপাদন করতে পারে। ভারতে প্রতি বছর ৫৪ হাজার মেট্রিক টন মধু উৎপাদন হয়, যার অধিকাংশই হয় এই পশ্চিমবঙ্গ থেকে। বাণিজ্যিক মধু উৎপাদন করতে পারে APIS DORSATA, বা ডাঁস মৌমাছি, বা রকবি নামের একটি যাযাবর প্রজাতি। যারা কখনই পোষ মানে না। মধু উৎপাদন করতে পারে APIS INDICA নামের উত্তর ভারতের একটি প্রজাতি। APIS FLOREA নামের এক প্রকার ক্ষুদে মৌমাছি। APIS MELIFERA নামের একটি ইতালীয় প্রজাতি, যেটি ১৯৯০ সাল থেকে ভারতে চাষ হয়। এছাড়া ডামার(DAMAR) নামের একটি প্রজাতি, যারা মাটির নিচে গর্ত করে ছোট্ট চাক বানায়। সুন্দরবনে উৎপাদক মৌমাছি রকবি APIS DORSATA পাহাড়ি যাযাবর। ইতালিয়ান মেলিফেরার বানিজ্যিক চাষের জন্য, বহিরাগত ব্যাবসায়িদের স্বার্থে কি এই নিষেধাজ্ঞা? সুন্দরবনে যে সমস্ত ফুল থেকে মধু সংগ্রহ হয় সেগুলো হল - ক্যাওড়া, গর্জন, গরাণ, হরগোজা, খলসি, হেতাল। মৌমাছি প্রতিপালকরা মধু বাড়াতে মৌমাছির শরীরে বিভিন্ন হরমোন সহ অনিয়ন্ত্রিত অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করে, যার প্রভাব পড়ে মধুতে। যার ফলে এ রাজ্য থেকে অধিকাংশ মধু রপ্তানির যোগ্যতা হারায়। ফলে সুন্দরবনের মধু খাবো চাহিদাও অনেক। বোকা বানাচ্ছে সুন্দরবন ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট।

    দুর্যোগের পর বদলে যায় স্থানীয় মানুষের জীবিকার ধরণ। বাওয়াল, মৌয়াল, জেলে বা একজন কৃষক পরিণত হন শ্রমিকে। কাছ থেকে দূরে যেতে থাকে নদী, সুন্দরবন। এই মানুষেরা স্মৃতিকাতরতার চেয়ে বেশি উন্মুখ এক থালা গরম ভাতের জন্য। জেনে রাখা দরকার, সারা বিশ্বে ২৫৭ মিলিয়ন মানুষ Biosphere Reserve-এর মধ্যে বসবাস করে। সুন্দরবনে শুধু মানুষ বসবাস করে না। আর সুন্দরবনের মানুষ জঙ্গলের ভিতরেও বাস করে না। শ্রীপঞ্চমীর দিনে মৌপোকারা উড়ে আসে বাদাবনে। বন ঘুরে ঘুরে চাক বানানোর গাছ পছন্দ করে। এ সময় তারা আড়াইঘর চাক তৈরি করে প্রথম। প্রতিবছর নিয়ম করে মৌয়ালরা মধুচাক না কাটলে পরের বছর মৌচাক ও মধুর পরিমাণ অনেক কমে যাবে। এক ফোঁটা হলেও মধুচাক কেটে ঝরাতে হবে। মধুর চাক থেকে মধু সংগ্রহ করা হয় বলেই মৌমাছিরা আবার মধু সংগ্রহ করে। তা না হলে চাকে জমা মধু খেয়ে খেয়ে তারা অলস ও ভারী পোকা হয়ে যায়। এভাবে তাদের শক্তি কমে যায়। মৌমাছিরা যদি অলসভাবে চাকে বসে থাকে এবং বনের ফুলে ফুলে না যায় তবে গাছের মিলন বন্ধ হয়ে যাবে। মৌমাছির চাকে গুটলি দেখেই বোঝা যায় কেমন মিলন হয়েছে বনের গাছে। ঠিক একইভাবে এক বছর গোলপাতা না কাটলে, গোলের ঝাঢ় পরিষ্কার করে না দিলে পরের বছর গোলপাতা জন্মাবে কম।

    আমফান ঝড়ে গত বছর প্রচুর মৌমাছি নষ্ট হয়েছে। এমন দাবী করেছে বন দপ্তর। ফলে এই বছর জঙ্গলে মধু সংগ্রহ করার অনুমতি সরকার দেবে না। সরকারি আমলা বা সরকারের এমন নির্দেশের পিছনে যে যুক্তি আছে তা হাস্যকর।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন