কয়েকবছর আগেও আমি পুরো ভেতো বাঙালি ছিলাম। আজকাল তো আদিখ্যেতা করে ভাত না খেলেও কিছু মনে হয় না।
দুর্গাপুজোর অষ্টমীর দিন আমাদের বাড়িতে ভাত খাওয়ার রেওয়াজ ছিল না। আজও নেই। লুচি আমার পছন্দের তালিকায় কোনও কালেই নেই। আমাদের স্কুলে যেহেতু পুজো হয়, তাই অষ্টমীর দুপুরে ভোগ খেতে যেতাম। বড় হয়ে স্কুল পেরোলে আর যেতে ইচ্ছে করত না। তাই দুপুরে মাছ ভাত খাওয়ার জন্য মেজমা মানে মেজোপিসিমনির বাড়িতে চলে যেতাম। তারপর স্কুল কলেজ পেরিয়ে আবারও যখন নতুন সম্পর্কে জড়ালাম তখন ওদের বাড়ি। ও বাড়িতেও অষ্টমীতে লুচির রেওয়াজ ছিল না।
২০০৬ এ আমার এইচ আইভি ধরা পড়ল দুর্গাপুজোর আগে আগেই। স্বাভাবিক ভাবেই (?) ভালবাসার মানুষটা নিজের নেগেটিভ রিপোর্ট পেয়ে একসাথে আর থাকতে চায়নি। মনে আছে সেবছরও ওর মা দুপুরে খেতে যেতে বলেছিলেন। আমাদের সম্পর্কের ভাঙনটা আমার সাথে সাথে ওদেরও সামলাতে সময় লেগেছিল। ৩৭৭ বহাল অবস্থায়ও আসলে সম্পর্কটা শুধুমাত্র আমাদের দুজনের ছিল না। কাকু কাকিমা ততদিনে আমার তথাকথিত শ্বশুর শাশুড়ী। কাকিমা যখন পুজোর কেনাকাটায় আমার জন্য প্যান্ট শার্ট কিনতো তখন দাদাভাই মানে ওর দাদা আওয়াজ দিতো, "বউমার জন্য শাড়ি কোথায়! "আর কাকিমার সপ্রতিভ উত্তর, "ওদের কে বর কে বউ আমি জানিনা, আমার চোখে ওটা আমার আর একটা ছেলেই। তাই চাকুরি করা আমার মডার্ণ বৌমা জিনস আর শার্টই পড়বে।"
সে বছরে সারা দুপুর ও বাড়িতে কাটিয়ে অষ্টমীর সন্ধ্যেতে পুজোর উপহার হিসাবে সদ্যপ্রাক্তন হয়ে যাওয়া মানুষটা, বাড়ীর কাছে পুজোমন্ডপের অনুষ্ঠানে এইচ আইভি সচেতনতার স্বার্থে আমার গোপন কথা গোপন রাখেনি। এইচ আইভি ধরা পড়া আর সম্পর্কের ভাঙনের সাথে সাথে হাটের মাঝে নিজের গোপনীয়তার সবটুকু হাট হয়ে গেছিল মানুষটার বদান্যতায়। সন্ধিপুজোর সন্ধিক্ষণে কঠোর বাস্তবের রূঢ়তায় হারিয়ে ফেলেছিলাম নিজেকে সেদিন।
২০০৬ থেকে আজ ২০২০, সেদিনের ঘটনা সামলে ওঠার পরথেকে হয়তো অন্য অনেকের ভালো থাকার জন্য নিজের কথা নিজেই বলে বেড়াই। কারণ আমি জানি এইচ আইভি নিয়েও সুস্থ থাকা যায়। আমি আজও বিশ্বাস করি আমি কোনও অন্যায় করিনি। পুরুষে পুরুষে যৌনতায় কন্ডোমের ব্যবহার নিয়ে আজ ৩৭৭ পরবর্তী সময়েও আলোচনা হয় কতটা! কন্ডোম আর এইচআইভি যৌনস্বাস্থ্য প্রচার সেটা তো স্বাস্থ্যদপ্তরের ঘাড়ে দিয়ে নিজেদের দায় এড়ানোতেই অভ্যস্ত আমরা। আজও আসলে অন্দরমহলের মধ্যে এসব নিয়ে আলোচনায় ছুঁতমার্গ কমেনি। টিভির পর্দায় কন্ডোম বা স্যনিটারি ন্যাপকিনের বিজ্ঞাপন এড়িয়ে চ্যানেল পাল্টেদিতেই অভ্যস্ত সমাজ আসলে বিজ্ঞানের মুখোমুখি হতে ভয় পায় আর সত্যটাকে এড়িয়ে চলে নিজের অসচেতনতার দায় এড়াতেই ভালবাসে!
পুজো আসে পুজো যায়, ঢাকের আওয়াজ, ছাতিমের গন্ধে, অঞ্জলির মন্ত্রে, আজও হারিয়ে যাই চোদ্দ পনেরো বছর আগের সন্ধেবেলাটায়। দুর্গাপুজোর অষ্টমী তাই লুচি আর ভাতের মতই আমার কাছে আজ আর কখনও আলাদা করে দাগ কাটেনা।