এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ  গুরুচন্ডা৯ দশ

  • সালাম ইসমায়েল

    বিক্রম পাকড়াশী
    আলোচনা | বিবিধ | ০৩ জুন ২০০৭ | ৭৭২ বার পঠিত
  • ইরাক ও তার দুরবস্থা নিয়ে এত বেশি লেখালেখি হয়েছে, যে সেগুলো ইদানিং বড়ো একটা পড়া হচ্ছে না, মানে চোখে পড়ছে না। এমনিতেই কেস হোপলেস, সুতরাং তা নিয়ে বেশি উচ্চ বা নীচ কোনো বাচ্যই না করা বিধেয়। বছরখানেক আগে ডক্টর সালাম ইসমায়েলের সাথে আমার কিছু কথাবার্তা হয়। কথা শেষে আমার সাথে হাত মিলিয়ে উনি বলেন আমি আজকে আপনার সাথে হাত মিলিয়ে গেলাম বটে, কিন্তু পরের মাসে ইহলোকে থাকবো কিনা সেইটা একটা বিরাট বড়ো প্রশ্ন। আজকে সকালে কি একটা খবরে দেখলাম ডাক্তারবাবুর আঠাশ বছর বয়েস হয়েছে, বহাল তবিয়তে বেঁচে আছেন। দেখে বড়ো ভালো লাগলো। ভদ্রলোক এখনও বেঁচে আছেন বলেই, এই একটি কারনের জন্য। ডক্টর ইসমায়েল আগে বাগদাদে এবং তার পরে (আমার সাথে কথার সময়) ফালুজার চীফ জুনিয়ার ডাক্তার ছিলেন। ফলত:, একেবারে বোমা ও বন্দুকের সামনে অকুতোভয়ে তাঁকে কাজ করে যেতে হয়েছে।

    কিভাবে ব্যবস্থা করা হয়েছিলো জানি না, তবে গেল বছর উনি 'ইনসাইড ফালুজা: অ্যান আই উইটনেস রিপোর্ট' বলে একটি প্রেজেন্টেশান নিয়ে ইংল্যান্ড ও আয়ার্ল্যান্ডে ঘুরে গেছিলেন। প্রেস কনফারেন্সে কিছু ভয়াবহ ছবি ও ভিডিও দেখানো হয়েছিলো, আর সরাসরি কথা বলার ফাঁকে আরো বেশি কিছু দেখিয়েছিলেন ওনার পার্সোনাল কালেকশান থেকে। তবে এই ভয়াবহতা নিয়ে ইন্টারনেট ও কাগজে যে পরিমান তত্ত্ব ও তথ্য পাওয়া গেছে যে তার বিশেষ কোনো কাভারেজের দরকার অনুভব করি না। 'আপনারা আজ যা দেখলেন, সে কেবল আইসবার্গের ওপরটুকু', এই কথা বলে উনি শেষ করার পরে আলাদা করে যা টুকটাক প্রশ্ন উত্তর হলো, সেইটুকুই আমি এখানে তুলে দিচ্ছি। এই ইন্টারভিউ উনি হয়তো অনেক জায়গায় অনেক বার দিয়েছেন। কিন্তু আমার কাছে ওনার দেওয়া সময়টুকু অমূল্য হয়ে আছে। একটাই অনুরোধ - ওনার কথার মধ্যে তত্ত্ব, তথ্য ও আবেগের শতাংশ পরিমানের হিসেব নিক্তিতে মাপতে যাবেন না। কাজটা লজ্জার হবে।

    সালাম ইসমায়েল: আমি এখানে কেন এরকম একটা প্রশ্ন আপনি নিশ্‌চই করবেন? আমি নিজে ফালুজার লোক, ওখানেই আমার জন্ম কর্ম। আমার বন্ধুরা, আমার সঙ্গী ডাক্তাররা, আমার একাধিক ভাই ঐ শহরে মারা গেছে। ভেতরে কি ঘটে চলেছে সে কথা বাইরের দুনিয়ায় এসে বলা আমার দায়িত্ত্ব। ইংল্যান্ডে আমি আমার শেষ লেকচারে জর্জ বুশকে বাঁদর বলেছিলাম, আজকে ডাবলিনে এসে ক্ষমা চাইছি কারন তাতে বাঁদরদের অপমান করা হয়।

    বিক্রম: ইরাকে কতজন লোক মারা গেছে, সেই নিয়ে তো কাগজে কেবল কূটকচালি চলছে।

    সালাম ইসমায়েল: এই মুহূর্তে আমার মতে প্রায় এক লক্ষ লোক আমেরিকার হাতে ইরাকে মারা গেছে। আই সোয়্যার টু গড, আমি ফরগিভ বা ফরগেট, এর কোনওটাই করবো না। যখন ইরাকের লোকের হাতে দেশের ক্ষমতা আসবে আমি এদের বিরুদ্ধে কোর্টে যাবো। অপারেশান টেবিল থেকে ডাক্তারদের অ্যারেস্ট করা হয়েছে, রোগীরা সেই টেবিলেই মারা গেছে।

    বিক্রম: চিকিৎসাব্যবস্থার তার মানে ভয়ানক অবস্থা।

    সালাম ইসমায়েল: বীভৎস। হাসপাতালে খুব রেয়ারলি আমেরিকান সৈন্য ওষুধ, বা এইড, বা রোগীকে ঢুকতে দিচ্ছে। একাধিক ক্ষেত্রে চিকিৎসার জন্য রোগীকে ফালুজা থেকে বাগদাদ যেতে অনুমতি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বাগদাদে ঢোকার মুখে তারা আটকা পড়ে গেছে। পঁয়তাল্লিশ বছরের কম বয়েসী কোনও লোককে এমনকি চিকিৎসার কারনে পর্যন্ত ফালুজা থেকে বেরোতে দেওয়া হচ্ছে না। এটাই এখন আইন। শহরে কোথাও কোনো খাবার নেই, ওষুধ নেই। যেকোনও মুহূর্তে টাইফয়েডের মড়ক লাগতে পারে। আমি নিজে গিয়ে সৈন্যদের বলেছি শহরে অন্তত: এইড ঢুকতে দিতে - কি লাভ হয়েছে? আমাকে ফাক অফ বলে তারা আবার নিজেদের মতো দাঁড়িয়ে গেছে - দেখলেন তো ভিডিওতে। আমরা গোপনে যতদূর সাধ্য রোগী আর ওষুধের ব্যবস্থা করছি। কিন্তু তাতে কি কিছু হয়? হাসপাতালের সাথে যে ব্রিজটা যোগাযোগ রাখছিলো সেটা বোম মেরে উড়িয়ে দিয়েছে। ইলেকট্রিসিটির সাপ্লাই কেটে দিয়েছে। খাবার জলের সাপ্লাই কেটে দিয়েছে। আমরা নিজেরা হাসপাতালের মধ্যে একসময় খাবার হিসবে শুধু ফুল খেয়েছি। তারপরে সব ফুল শেষ হয়ে গেলে চিনি খেয়ে থেকেছি, যাতে আমাদের মধ্যে চিকিৎসা করার মত শক্তি থাকে।

    বিক্রম: ডাক্তারদেরকে কখোনো পার্সোনালি অ্যাটাক করা হয়েছে?

    সালাম ইসমায়েল: হবে না? কার্ফুর সময়ে ডাক্তাররা চিকিৎসার জন্য কোথাও যেতে পারবে না। সে কথা আমরা শুনি নি। আমাদের একমাত্র কাজ চিকিৎসা করা। এবং রাস্তায় নেমে আমরা সেই কাজ করছিলাম, ই দা প্রসেস আমার দুই সঙ্গী ডাক্তারকে সেখানেই গুলি করে মারা হয়। আমার ক্লিনিক বোম মেরে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে, ভাগ্যিস আমি নিজে সে সময়ে ছিলাম না। ক্লিনিকের প্রত্যকটি পেশেন্ট এবং বেশ কিছু ডাক্তার সেই বম্বিং এ মারা যায়। সেই সমস্ত ডেডবডি আমি নিজে হাতে সরিয়েছি। এখন আর কতজনের মৃত্‌দেহ সরালাম সেই সংখ্যা গুনি না। শেষ যে আক্রমন হলো তাতে তিন হাজারের বেশি লোক মারা গেছে।

    বিক্রম: আপনাকে কখোনো ইন্টারোগেট করা হয়েছে?

    সালাম ইসমায়েল: ইন্টারোগেশান? আমার নিজের বাড়ি চার বার অ্যাটাক করা হয়েছে। আমি সব বলতে পারবো না, শুধু এইটুকু বলছি যে সিআইএ যখন আমাকে ইন্টারোগেট করে, তখন সাদা কাগজে যা সই করেছিলাম তার মোদ্দা মানে ছিলো যে আমি ডাক্তার হিসাবে আমার সমস্ত অধিকার ত্যাগ করলাম। আরো লিখেছিলাম, যে আমি মিডিয়ার সামনে একটি কথাও বলবো না এবং আমেরিকান গভর্মেন্টের প্রতিটি নির্দেশ মেনে চলবো। এক জেনারেল গিলবার্ট আমায় প্রশ্ন করছিলো, সে আমাকে পেপসি খেতে দিলো তারপর বললো যে আর কোনওদিন যদি আমাকে শহরের মধ্যে দেখা যায় তবে গুলি করে মারবে। আরো বলেছিলো - তোদের চার হাজার ইরাকি ডাক্তারের বদলে আমরা যে কোনো অর্ধেক পয়সা দিয়ে চার হাজার আমেরিকন ডাক্তার নিয়ে আসতে পারি। থ্যাংক গড যে এইসব কথা আমি বলার জন্য এখনও বেঁচে আছি।

    বিক্রম: আর আপনার ফ্যামিলির লোককে?

    সালাম ইসমায়েল: এক রাতে চার পাঁচজন আমেরিকান সৈন্য ঘরে ঢুকলো। আমার বাবার বয়েস পঁয়ষট্টি, শরীর ভালো না - আমার মায়ের সামনে ওনাকে লাথি মেরে ফেলে দিলো। বাবার মাথা মাটিতে ঠেকে আছে, আর একটা বুটজুতো ওনার ওপর - সে একটা বন্দুক বাবার মাথার দিকে পয়েন্ট করে চিৎকার করছে - তোকে মেরে ফেলার আগে তুই নিজেই নিজেকে মেরে ফেল। তারপর বাবাকে হাতকড়া পরিয়ে ওরা ছাদে প্রশ্ন করতে নিয়ে যায়। আসলে মানুষকে ভয় দেখানোর এটা একটা খুব কমন অস্ত্র। জোর করে কোনও বাড়িতে ঢুকে তারপর বাড়ির কর্তার দিকে বন্দুক দেখিয়ে তার বাচ্চাদের সামনে তাকে মেরে ফেলর হুমকি দেওয়া। কি প্রচণ্ড অপমান!

    বিক্রম: মহিলাদের?

    সালাম ইসমায়েল: দেখুন, ইরাকে আমরা মহিলাদের ব্যাপারে কুব রেস্পেক্টফুল। এটা ওরাও জানে। যখন আমরা কথা বলি না, তখন খবর বের করার জন্য ওরা মা, বৌ বোনেদের ধরে নিয়ে যায়। বহু মহিলা এইভাবে ভ্যানিশ হয়ে গেছে। সিকিউরিটি চেকের নাম করে কত মহিলার সাথে যে এরা নোংরামি করেছে কি বলবো। ওরা কাউকে ছাড়ে না।

    বিক্রম: সাদ্দামের ক্ষমতাচ্যুত হবার পরে কোনও পরিবর্তন দেখছেন?

    সালাম ইসমায়েল: নাথিং। নতুন ডিক্টেটার এসেছে। তারা সাম্রাজ্যবাদের মাধ্যমে আমাদের দেশ দখল করেছে তেল পাবে বলে। কিন্তু আমার একটাই প্রশ্ন - ওয়াজ ইট ওয়ার্থ ইট? এই যে এই ভিডিওটা - একটা ক্লাস্টার বোম পরিবারের পঁচিশ জনকে মেরে ফেললো - একটি বাচ্চা মেয়ে ছাড়া। আর ওদিকে মাইক্রোফোনে শোনা যাচ্ছে যে বোম্বারকে বাহবা দেওয়া হচ্ছে। এই যে আমার ক্লিনিকের এই বাচ্চা ছেলেটি - এর দুটো হাত, দুটো পা, যৌনাঙ্গ সব তো নষ্ট হয়ে গেছে, কিন্তু বেঁচে আছে। এই যে এই লোকটি - যার ঘিলু রাস্তায় গড়াচ্ছে, এই লোকটি যার নাড়িভুঁড়ি সব বেরিয়ে এসেছে, মরার জন্য পড়ে আছে - এই সমস্ত তেলের জন্য? আমি আবার জিজ্ঞাসা করছি - ওয়াজ ইট ওয়ার্থ ইট? সাদ্দামএর সময়ে আমরা ভয়ে ভয়ে থাকতাম, মহিলারা বেরোতে পারতো না, কিন্তু অন্তত: বোরখা পরবে না পরবে তার চয়েস ছিলো। এখন সবাই নিজেদের জীবনের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আমাদের কোনো খাবার নেই।

    বিক্রম: যুদ্ধ থেকে তাহলে ইরাকিরা কিছুই পায় নি?

    সালাম ইসমায়েল: না। আমরা একটা জিনিস পেয়েছি যুদ্ধ থেকে। তা হলো ঐক্য। সাদ্দাম আমাদের ছোটো ছোটো টুকড়োয় ভেঙে ফেলেছিলো। আর এইসব সেগমেন্টলো গুলো সবসময় একের বিরূদ্ধে অন্যে লড়াই করতো। কিন্তু এখন এরা বুঝেছে যে আমেরিকানদের তাড়াতে গেলে সকলকে একজোট হতে হবে। আমার এখনও মনে আছে, একদিন শিয়া আর সুন্নিরা এক হয়ে ট্রাকভর্তি শস্য ফালুজাতে পাঠিয়েছিলো। ঐ একদিন, আই স্মাইলড, আমি ওদের দিকে হাত নাড়ছিলাম - ঐ এক দিন আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে এই যুদ্ধ থেকে আমরা কিছু অন্তত: পেয়েছি। দু:খের কথা এই যে অনেক ইম্পর্টেন্ট লোক কিছু ডলারের বিনিময়ে বিকিয়ে গেছে। এরা এখনও সেই আগেকার মতো আমেরিকানদের আমাদের ওপর অত্যাচার করে যেতে দিচ্ছে। বেইমানির একটা বিরাট হাত আছে আমাদের নিজেদের অবস্থার জন্য।

    বিক্রম: এমন কোনও পলিটিশিয়ান আছেন কি যিনি ইরাক সামলাতে পারবেন, মানে যদি কখনও ভবিষ্যতে ভোট হয়?

    সালাম ইসমায়েল: না। কেউ নেই। নেক্সট যে আসবে সে হবে আমেরিকার পাপেট। আমি তো বললাম , এরা সব বিকিয়ে গেছে ডলারের বিনিময়ে। আর অদূর ভবিষ্যতে ভোট হবার আমি কোনও আশাও দেখি না। এই আমেরিকানরা ডেমোক্রেসির কথা বলে - কিসের ডেমোক্রেসি? এই যে এই ভিডিওটা - একজন ইরাকি আমেরিকান সৈন্যকে বলছে চলে যেতে, এটা ওদের দেশ নয়। আর সেই সৈন্য বলছে তুই ভাগ, নয়তো আমি তোকে ভাগাচ্ছি। জাস্ট বিকজ হি হ্যাজ আ গান। দ্যাটস অল। আপনার ধারনা আমেরিকানরা কতজন ইরাকি মরলো তার খোঁজ রাখে? ইরাকি মেরে মেরে বোর হয়ে গেলে রাস্তার কুকুরের ওপর টার্গেট প্র্যাকটিস করে। আমি কিন্তু মজা করছি না। এটা রোজ হয়।

    বিক্রম: এই দু:সময়ে অন্যদের কোনও ভূমিকা থাকা উচিত ছিলো, বা কোনো ভূমিকা থেকেছে বলে আপনি মনে করেন?

    সালাম ইসমায়েল: দেখুন সমস্ত দেশই খুব ভালো। সব দেশের প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে। আমি শুধু আপনাকে বলতে পারি যে একজন ইরাকি আজকে বাকি দেশের সম্বন্ধে কি ভাবে। যখন কিছু করার দরকার ছিলো তখন আপনারা সবাই কাঠপুতুলের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন। বিভিন্ন দেশ আমেরিকাকে তাদের বিমানবন্দর ব্যবহার করতে দিয়েছিলো। তার প্লেনের ট্যাংক ফুল করে দিয়েছিলো। আমাদের কেউ কোনও সাহায্য করে নি। এখন আর কারো থেকে আমাদের কোনও কিছুর দরকার নেই। ইরাক এমন একটা জায়গা ছিলো যেখানে কেউ কখনও আপনার দেশ বা ধর্ম নিয়ে বেশি প্রশ্ন তুলতো না, সবাই নিজের নিজের মতো থাকতো। এখন বহু প্রজন্মের বুকে কেবল গভীর ক্ষত। আমার মনে হয় না, যে বিদেশীদের ব্যাপারে আমাদের অ্যাটিচুড আর আগের মতো থাকবে। লক্ষ্য করেছেন কি যে শুধু ওয়েস্টার্নাররাই নয়, বাংলাদেশীদেরও ইরাকিরা অপহরন করেছে? আরও একটা কথা, নিজেদের দেশের জন্য যারা লড়ছে তাদের গায়ে টেররিস্ট তকমা এঁটে দেওয়া হচ্ছে।

    বিক্রম: আজকে তো নানা পত্রিকার লোক উপস্থিত ছিলো। প্রেস বা মিডিয়া কি কোনওভাবে কাজে লাগতে পারে?

    সালাম ইসমায়েল: আরে আপনারা কোনও কাজেই লাগবেন না। এই যে আমি দেশে দেশে ফালুজা নিয়ে কথা বলে বেড়াচ্ছি এসব কিছুই আমার করার ইচ্ছে ছিলো না। সমস্ত আমার বাবার প্ল্যান। আমার বাবা মা দুজনেই টীচার। তাঁদের ইচ্ছে ফালুজায় কি ঘটছে সেসব দেশবিদেশের লোক জানুক। আপনরা অন্তত: যে খবরগুলো পাচ্ছেন সেগুলো আগে ঠিক ভাবে লিখুন তাতেই আমার চলবে। ইংল্যান্ড থেকে বহু বাচ্চা ওষুধ আর চিঠি পাঠিয়েছিলা। ইন ফ্যাক্ট, ওয়েলসের একটা স্কুল আমাদের বাচ্চাদের আসার জন্য ইনভাইটও করেছিলো। আই ওয়াজ মূভড বাই অল দীজ। ইরাক বাকি পৃথিবীর থেকে আলাদা হয়ে যাক এমন আমি কখনও চাই না। দরকারের সময়ে আপনারা কোথাও ছিলেন না, এখন অন্তত: আমাদের মরাল সাপোর্ট দিন। এইটুকু অন্তত: করুন, বলুন যে ইউ আর উইথ আস।

    বিক্রম: মিডিয়া কি পুরো ইনভেশানটাই খুব বায়াসড ভাবে দেখিয়েছে?

    সালাম ইসমায়েল: আপনাকে একটা গল্প বলি। ইংল্যান্ডে চ্যানেল ফোর আমার একটা ইন্টারভিউ নিয়েছিলো। প্রোগ্রামের শেষে ঠিক এই প্রশ্নটাই ওরা আমাকে জিগেশ করে। আমি বলেছিলাম যে ওয়েস্টার্ন মিডিয়া কখনই মানুষের সামনে সত্যিটাকে আসতে দেয় নি। তাতে ওরা আমাকে উত্তরে বললো যে আসলে আমরা কখনও সত্যির খুব কাছে আবার কখনও একটু দূরে থাকি, কিন্তু সবসময়েই চেষ্টা করি যেন যা ঘটেছে তা যথাসম্ভব ঠিকঠাক ভাবে রিপোর্ট করা যায়। উনি আমাকে ওনার ইমেল অ্যাড্রেস দিয়েছিলেন আর বলেছিলেন যে ফালুজায় যা ঘটছে তা যদি আমার মনে হয় ওনাদের রিপোর্টে সত্যের থেকে দূরে সরে যাওয়া হচ্ছে তবে যেন আমি ইমেল করে জানাই। তারপর থেকে প্রত্যেকদিন আমি ওদের মেল করে লিখেছি - ইউ আর অ্যাওয়ে ফ্রম দা ট্রুথ। (হাসি)

    বিক্রম: আরবী মিডিয়াতেও কি সেই একই ব্যাপার?

    সালাম ইসমায়েল: ওয়েল, যেখানকারই হোক, কিছু লোক আছেন যাঁরা এখনও যা সত্যি তাই লেখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ওনাদের কোনও নিরাপত্তা নেই।

    বিক্রম: আরেকটু বলুন।

    সালাম ইসমায়েল: দেখুন, আমেরিকানরা আপনাকে যা লিখতে বলছে বা দেখাতে বলছে, তার বাইরে কিছু করতে যাওয়াটা স্বাস্থের পক্ষে হানিকর। আপনি বিবিসি না সিএনএন না রয়েটার্স, তার ওপর এসব নির্ভর করে না। আল জাজীরার একজন রিপোর্টার ছিলেন, উনি অনেক দিন ধরে ইরাকের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে রিপোর্ট করার চেষ্টা করছিলেন। ওনাকে নিজের প্রাণ হাতে করে এসব করে যেতে হয়েছিলো কারন আমেরিকান স্যাটেলাইটগুলো ক্রমাগত ওনার মোবাইল ফোন ট্র্যাক করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলো।

    বিক্রম: তার মানে আমেরিকান মিডিয়াই প্রাধান্য পাচ্ছে?

    সালাম ইসমায়েল: অবশ্যই। কিন্তু তার সাথে এটাও মনে রাখবেন যে আমেরিকান মিডিয়া অর্গ্যানাইজড ভাবে দেখিয়ে চলেছে যে ওরা ইরাকের কতো উন্নতি সাধন করে চলেছে। আমার মনে হয় যে ইরাককে এরা একটা টেররিস্ট দেশ হিসাবে ক্রমাগত পোরট্রে করছে, হোয়েন ইট ইজ জাস্ট দা আদার ওয়ে রাউন্ড। এমনও হয়েছে যে আমেরিকান গুপ্তচররা জার্নালিস্ট হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে।

    বিক্রম: এই কারনেই কি জার্নালিস্টদের অপহরন করা শুরু হয়েছিলো?

    সালাম ইসমায়েল: এটা হয়তো একটা কারন, কিন্তু এটাই একমাত্র কারন নয়। ভেতরে ভেতরে এখনও বহু ছোটো ছোটো গ্রুপ লড়ে যাচ্ছে নিজেদের বিরুদ্ধে। এরা এই গণ্ডগোলের মধ্যে কিছু টাকা বানাতে চায়। আসল কথা হচ্ছে যে ইরাকিরা এখন আর বিদেশীদের বিশ্বাস করে না। বিশ্বাসের যে ব্রিজটা ছিলো সেটা ভেঙে গেছে। হয়তো একদিন তা জোড়া লাগবে, কিন্তু দু পক্ষ থেকেই তার জন্য চেষ্টা করতে হবে।

    বিক্রম: আপনি তো এই কদিনে বহু জায়গা ঘুরলেন। আপনার সমস্ত কথা কি আপনি বলতে পারলেন?

    সালাম ইসমায়েল: আমার যতটুকু সাধ্য তা আমি করলাম। এবার আপনাদের দায়িত্ত্ব এগুলোকে ঠিকভাবে রিপোর্ট করা। একজন ডাক্তার যখন তার রোগীদের ফেলে নানা দেশে ঘুরে বেড়াই তার পেছনে একটা কারন তো আছে না কি? বহুদিন ভেবে তবে আমি ডিসাইড করি যে আমি নানান দেশে আমার কথাগুলো বলে বেড়াবো। আমার চোখের সামনে আমার দেশ দখল হয়ে যাচ্ছে, আমি এই সময়ে চুপ করে বসে থাকবো? আমাদের একমাত্র দোষ এই যে ইরাকে তেল আছে। যতবার আমি ভাবি একটাই কথা মনে হয় - ওয়াজ দিস ব্লাডশেড ওয়ার্থ ইট? ওদের প্রত্যেকটা সৈন্য মরলে ওরা গুনে রাখে, একেকটা ক্লাস্টার বোমে কতজন মরে সেই হিসেব কে দেবে? তবে হ্যাঁ, এই কাজ ওরা প্রথমবার করছে না।

    এর পরে ডাক্তার ইসমায়েল কথাবার্তায় ইতি টানেন এবং আরেকটি প্রেস কনফারেন্সের জন্য বিদায় নেন।
    যাবার আগে শেষ কথা - আমি আজকে আপনার সাথে হাত মিলিয়ে গেলাম বটে, কিন্তু পরের মাসে ইহলোকে থাকবো কিনা সেইটা একটা বিরাট বড়ো প্রশ্ন।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ০৩ জুন ২০০৭ | ৭৭২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন