এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ  গুরুচন্ডা৯ ছয়

  • যুদ্ধরথের জীবন চরিত

    দীপ্তেন
    আলোচনা | বিবিধ | ০১ মে ২০০৬ | ৭৫৩ বার পঠিত
  • রথ তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?

    হরপ্পা সভ্যতায় ঘোড়ার কোনো ছবি টবি নেই, পোড়ামাটির খেলনা রয়েছে ষাঁড়ে টানা "গোরুর" গাড়ী। তার চাকা সলিড। অনুমান, যে, বহিরাগত আর্যরা ঘোড়া ও যুদ্ধরথ নিয়ে আক্রমন করে হরপ্পা সভ্যতার বিনাশ করেন। গোঁড়া হিন্দুত্ববাদী পন্ডিতেরা বলেন, "না, অমনটি ঘটে নি। রথ চিরকালই ছিলো ভারতবর্ষে। আর এখান থেকেই খাইবার পাস হয়ে সেই টেকনলজি কিনা গিয়েছে ইউরোপে আর অন্যান্য যায়গায়।"

    ঐ উৎপত্তি নিয়েই তো বিপত্তি। সামান্য রথ - অথচ ওর ইতিহাসেই লুকিয়ে রয়েছে আর্যদের আদিভুমি'র বিতর্কের চাবিকাঠি। কিছু সাহেব বলেছেন রথ - বিশেষত: যুদ্ধরথ ইরান আর ইরাকের মধ্যবর্তী পাহাড়ী অঞ্চল থেকে ছড়িয়ে পড়েছে পাশের রাজত্বে। হামুরাবীর সাম্রাজ্য ধ্বসে গেছে প্রায় দুশো বছর। এইবার ঐ যুদ্ধরথ চালকেরা পুর্ব দিকে বিস্তার করলেন। হরপ্পা বা সরস্বতী
    সভ্যতা গেলো সেই অভুতপুর্ব মিলিটারি টেকনলজির মুখে। আর এক শাখা চলে গেছে চীনে - সেখানে শাঙ্গ রাজত্বে ও পৌঁছে গেছে যুদ্ধরথ । আরো তিনশো বছর ধরে যুদ্ধরথের কারিগরী কৌশল আরো উন্নত হবে আর সেটা সমগ্র ইউরো-এশিয়ায় আরো বিস্তৃত হবে। পক্ষে ও বিপক্ষে লেখা হয়েছে, প্রচুর হুদো হুদো কিতাব - তবু তর্কের খাতিরে ধরেই নিন এরাই সেই আর্য।

    কলকব্জার কথা

    কিন্তু এই তর্কে ঝাঁপিয়ে পড়বার আগে ভাবুন রথের জন্য দরকার হতো কি কি জিনিস? প্রথমে চাই কাঠ। সব কাঠ দিয়ে তো হবে না, চাই স্পেশাল কাঠ। যেমন ধরুন রথের বডি তৈরী হতো শিংশপা গাছের কাঠে কিন্তু ত:রন অর্থাৎ অনির জন্য চাই আরো শক্ত পোক্ত কাঠ, চাই খদির বৃক্ষ। আর চাকার জন্য শাল্মলী কাষ্ঠ। চাকার চারপাশে চাই চামড়ার বাঁধুনি। চাই চর্মকার। চাকার হাবে একটু ধাতু না হলে চট করে ভেঙে যাবে। চাই ধাতুবিদ। অশ্বতর বা নিছক গাধায় টানা রথ ছিলো কিন্তু যুদ্ধের জন্য চাই দ্রুতগামী ঘোড়া। চাই অশ্বকার, সহিস, ঘোড়ার ডাক্তার।

    ভাবুন মিশরের কথা। তারা রথের চাকা মুড়ে দিতো হয় চামড়া দিয়ে নয়তো বার্চ গাছের বাকল দিয়ে। তো বার্চ গাছ মিশরে কোথায়। আর ঘোড়াই বা কই। সে সব আসতো মধ্যপ্রাচ্য, সুমের থেকে জাহাজে চেপে।

    গ্রিক লিখিত ইতিহাসে আছে যুদ্ধযাত্রার আগে কত স্পেয়ার পার্টসের যোগান তৈরী থাকতো রথের জন্য। যুদ্ধের জন্য রথের মেকানিকেরাও যেতো সামরিক বাহিনীর সাথে সাথে। তবে অসমতল ও পাহাড়ী যায়গা বলে গ্রিসে খুব একটা রথ চলেনি - মানে পাবলিকে খায় নি। কিন্তু ভারতবর্ষে রথ চলেছে বহু দিন।

    তারপর ধরুন আরো কত বিষয়ে ভাবতে হয়। ঘোড়া যে জুতবেন তো কোনখানে লাগাবেন চামড়ার ফাঁস? প্রাচীন ছবিতে দেখবেন প্রায় সব ক্ষেত্রেই ফাঁসটা আছে গলায়। অসুবিধে হলো হঠাৎ করে রথ থামালে ওটা ঘোড়ার গলা ডিঙিয়ে বেড়িয়ে আসবে কেননা ঘোড়ার গলাটা মাথার কাছে এসে সরু হয়ে যায়। আর যে যুপকাষ্ঠ এক্সেল বা অনির সাথে যুক্ত সেটা ঘোড়ার উপর চাপ যাতে বেশী না ফেলে তার জন্য রথের অনি রাখতে হবে একেবারে পিছনের দিকে। এতে ঘোড়ার গতি বাড়লেও ঝট করে গতি বদলাতে গেলে রথ উল্টে যাবে।

    তখনকার দিনের ঘোড়াও ছিলো অনেক ছোটো। দুটো ঘোড়া একেবারে সমতলে বড়জোর ৫০০ কেজি টানতে পারতো কিছুট দ্রুতগতিতে ছুটে। যদি দুজন যোদ্ধা রথে থাকে আর রথের ওজন এই ৬০/৭০ কেজির মধ্যেই সীমিত রাখেন তাহলে বেশ কিছুটা সময় - মানে ঘন্টা খানেক রথে চড়ে যুদ্ধ করা যেতো।

    ঋগবেদে ও বহু উল্লেখ আছে রথের। দেবতারা সবাই রথে চরে যুদ্ধে যান। ইন্দ্রের রথের ঘোড়া রঙ হলুদ (হরি) আর অশ্নিনদ্বয়ের রথ টানে দুটি গাধা। চাকার বর্ণনায় কখনো মনে হয় সেটা ছিলো সলিড আবার কয়েক যায়গায় রয়েছে প্রাধির (স্পোক) উল্লেখ। সুর্য্যের রথের চাকার বর্ননা অবশ্যই প্রতীকী। এক্সেল বা অক্ষ বোধহয় তামা বা তামার সংকর কোনো ধাতুর (ও) তৈরী হতো।

    যুদ্ধের কথা

    পদাতিক সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াইটা হতো কিভাবে? অর্ধচক্রাকারে যুথবদ্ধ রথেরা আসতো - পদাতিক সেনানীরা খুব তেড়ে আসলে ঝট করে পিছিয়ে পরতো মধ্যের রথেরা আর সেই সুযোগে আউটফ্ল্যান্‌ক করে এগিয়ে যেতো দুই পক্ষ(wings)। প্রায় একশো, কখনো দুশো গজ দুর থেকে রথ থেকে তীর ছোঁড়া হতো। মিনিটে পাঁচ বা ছয় জন সেনানীকে বিদ্ধ করা খুব কঠিন ছিলো না এই ঘুর্নায়মান রথীদের। মিনিট দশেকের যুদ্ধেরই প্রায় শ'পাঁচেক পদাতিক সেনানী ঘায়েল হতো।

    ভাবুন একবার অসিরীয়ান সাম্রাজ্যের আগ্রাসন। রথের সাথে সাথে রথে চলার উপযোগী রাস্তাও তৈরী হতে লাগলো আর সেই রাস্তা দিতে দিনে প্রায় তিরিশ মাইল যেতে পারতো সৈন্য বাহিনী। তিনশো মাইল দুরের রাজ্যে গিয়ে লড়াই করে আসাটাও খুব আর কঠিন রইলো না। এই ধরুন আটশ থেকে সাতশো বিসি - এই ভাবে অসুর সাম্রাজ্য এগিয়ে চলেছিলো দুর্মর গতিতে।

    "টেকনোলজি ট্রান্সফার" - ওটাই মুল মন্ত্র। তো রথের ফষ্টিনষ্টি সবাই জেনে ফেললে লড়াইটা হতো রথী আর রথীতে। কেমন ছিলো সে সব যুদ্ধু? পৃথিবীর প্রথম লড়াই যার ঠিক ঠাক হিসেব ও বর্ননা এখনো বিদ্যমান সেটা ১২৬৯ বিসি-র, প্যালেস্টাইনের উত্তরে মেগিদ্দো শহরে। একদিকে মিশরের অধিপতি তৃতীয় টুথমসিস আর বিপক্ষে তার বিরোধী পক্ষের এক যুক্তফ্রন্ট। কিন্তু যুদ্ধ হলোই না - মিশরের রাজার রথের সংখ্যা দেখেই দুদ্দাড় করে পালিয়ে গেলেন বিদ্রোহী রাজারা। প্রায় হাজার দুয়েক ঘোড়া পেয়ে গেলেন মিশরের অধিপতি। এর দুশো বছর পর দ্বিতীয় রামেসেস যুদ্ধে গেলেন হিট্টাইট-দের সাথে - দক্ষিন সিরিয়ার অরনটেস নদীর ধারে। তখন মিশরের সম্রাটের বাহীনিতে ছিলো পাঁচ হাজার সেনানী আর কুল্লে বাহান্নোটা রথ। কিন্তু তাতেই কেল্লা ফতে। বিপক্ষের রথের সংখ্যা জানা যায় নি যদিও তাদের সেনানী ছিলো মিশরের থেকে বেশী। বোঝা যায় কেন রথ এতো গুরুত্বপুর্ন ছিলো সে সময়।

    তা ঐ তীর ধনুক তো পদাতিকের কাছেও আছে তো রথীদের এতো রমরমা কিসের ছিলো? এক তো গতি - দ্রুত এগিয়ে পিছিয়ে যেতে পারতো যেটা পদাতিকরা পারতো না। আর দ্বিতীয় রথে অনেক বেশী তীর নেওয়া যেতো আরো সাথে রাখা যেতো বল্লম আর তরোয়াল, কুড়াল - এমন অনেক অনেক অস্ত্র শস্ত্র।

    সে যুগে ব্রোঞ্জের তরোয়াল আর লোহার ফলকের তীর বেশীক্ষন ধারালো রাখা সম্ভব ছিলো না। মুখোমুখি লড়াইয়ে তাই রক্তপাত ও নৃসংশতা ছিলো অবধারিত। আবহমানকালে দেখা গেছে মুখোমুখি লড়াইয়ে মানুষ বেশীদিন মানসিক স্থৈর্য রাখতে পারে না। কিন্তু যে সব সেনানী হেভি মেশিন গান বা দূরপাল্লার কামান দাগাচ্ছেন তাদের ঐ বৈকল্য হয় না। তারা তো দেখছেন না কারা মারা পড়ছে, আহত হচ্ছে।

    ব্রোঞ্জ যুগেও রথীরা ঐটুকু দুরত্ব পেতো - হয়তো দুশো গজ - তাও চোখে চোখ রেখে শত্রুর শরীরে ভোঁতা তরোয়াল ঢুকিয়ে দেবার কষ্টটা পেতে হতো না। তাই রাজা গজারা সব সময়েই রথেই যুদ্ধ করতেন।

    মহাভারতের কথা অমৃত সমান

    আমাদের রাজারাজড়াও শুধু রথে চেপেই যুদ্ধ করতেন। শ্রীরাম দেখুন - রথ নেই তো কি হোলো - হনুমানের কাঁধে উঠে লড়ে গেলেন। মহাভারতেও একই কথা। একাদশ দিনে সেনাপতি দ্রোণ ঘোড়ায় চেপে ব্যুহ প্রদর্শনে গেছিলেন। ব্যস। এ ছাড়া পুরো যুদ্ধে সবাই শুধু রথে চেপে ছিলেন। আসামের লোক ভগদত্ত ছিলেন হাতির পিঠে। ব্যতিক্রম। আর কুরুক্ষেত্রর যুদ্ধের শেষ দিনে বেশ কয়েক জনে ঘোড়ার পিঠে উঠেছিলেন - রথ টথ বোধহয় তখন আর অবশিষ্ট কিছু ছিলো না।

    রামায়নে আরো দেখুন - ভরত গেছেন রাম কে ফিরিয়ে আনতে। তো সেটা গেলেন যুদ্ধরথে চেপেই। গাছের উপর থেকে সেটা দেখে লক্ষন তো চটেই কাঁই। প্রায় তখনই লড়াই শুরু করে দেন আর কি। ঘোড়ায় চড়তো তাহলে কে ? মিথিলায় রাম লক্ষণের বিয়ে ঠিক হলে জনকের দূত তিন দিন নাগাড়ে ঘোড়া ছুটিয়ে অযোদ্ধ্যায় পৌছে ছিলেন। স্যমন্তক মনি চুরি করে পালাতে গিয়ে কৃষ্ণের মুখোমুখি ভোজরাজ শতধন্বা। রথারুঢ় কৃষ্ণ আর ভোজরাজ হৃদয়া নামে এক বড়বার (মেয়ে ঘোড়া) পিঠে। কিছুক্ষন যুদ্ধ করেই ভোজরাজ হৃদয়ার পিঠে চেপে ভোঁ দৌড় - পিছু পিছু ছুটছেন কৃষ্ণ - কিন্তু ঐ রথে চেপেই!! কি আশ্চর্য্য - চোর ধরবার সময়েও কি ঘোড়ার পিঠে উঠতে পারলেন না? বা, রাজা দুষ্মন্ত - মৃগয়ায় বেরিয়েও গভীর জঙ্গলে সেই রথেই বসে। ঘোড়ার পিঠে কেউই বসতেন না। আমাদের দেবদেবীরাও কম লড়েন নি কিন্তু কারুর বাহনই ঘোড়া নয়। ইঁদুর পেঁচা কুমীর - সব জন্তুই চান্স পেয়েছে কিন্তু বেচারা ঘোড়া - তার পিঠ আর দেবতার ছোঁয়া পেলো না।

    ঠাকুর দ্যাবতারা সন্তুষ্ট হলে অস্ত্র শস্ত্র, তীর ধনুক গদা রণশংখ কবচ কুন্ডল ইত্যকার কতকিছুই তো দিতেন কিন্তু একটা ভালো রথ কাউকে দেন নি। যদিও সারথির ভুমিকা তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো - কিন্তু.... ঐ রথ নিয়ে প্রযুক্তিটা বোধহয় খুব একটা এগোয়নি।

    পুরু আর আলেকজান্ডার

    অক্ষৌহিনির সব থেকে ছোটো সংঘটন - তাকে বলে পত্তি। অর্থাৎ কিনা প্ল্যাটুন। তাতে একটি রথ, একটি হাতি পাঁচজন পদাতিক আর তিনজন ঘোড়সওয়ার। কিন্তু মহাভারতের যুদ্ধে এমন কি খুব ছোটো রাজাও ঘোড়ার পিঠে ছিলেন না। কিন্তু এই রথের উপর বসে থাকা - এর ফলে আমাদের যুদ্ধ ভয়ানক স্ট্যাটিক হয়ে পরে। একটু শুনুন আলেকজান্ডার আর পুরুর যুদ্ধের কাহিনি - বুঝবেন কি ভাবে আমাদের সামরিক কৌশল শুধুমাত্র ব্যক্তিগত বীরত্বের গাথা হয়েই রইলো।

    তো শুনুন না পুরু আর আলেকজান্ডার কি ভাবে যুদ্ধু করেছিলেন। পুরু মহারাজের সৈন্যবল নেহাৎ কম ছিলো না। লড়াই করতে তিনি যোগাড় করেছিলেন ত্রিশ হাজার পদাতি, চার হাজার অশ্বারোহী, দুশো হাতী আর তিনশো রথ। মে মাসের প্রথম দিকটায় এই লড়াই হয়েছিলো - ঝিলম নদীর পাশে। এই পারে আমি আর ঐ পারে তুমি - এ ভাবে দুই পক্ষ। বরফ গলা নদী প্রায় আধ মাইল চওড়া। কিছুদিন অপেক্ষা করার পর (আমি ছোটো করেই গপ্পোটা বলছি) এক ঝড়ের রাতে অন্ধকারে প্রায় এগারো হাজার সৈন্য নিয়ে নদী পার হলেন গ্রীক সম্রাট। পুরুর সেনাপতিরা টেরই পেলেন না - যখন বুঝতে পারলেন তখন বড় দেরী হয়ে গেছে।

    নানা মুনির নানা মত - তবু সবাই একমত যে প্রধানত: ঘোড়সওয়ার তীরন্দাজ ছিলো গ্রীক সেনাবাহীনিতে। পুরু পাঠালেন তার ছেলেকে দুহাজার ঘোড়সওয়ার আর পদাতিক সেনানী আর ১২০ রথ - আর যুদ্ধটা শুরু হলো কাড়াই-এ বালুভুমিতে। এই রথনির্ভর বাহিনী অচিরেই ধ্বংস হল - পুরুর ছেলেও মারা গেলেন। সব রথ গেলো মায়ের ভোগে। এবার পুরু স্বয়ং তার পুরো সেনা বাহিনী নিয়ে রণক্ষেত্রে হাজির। গড়ুর ব্যুহ সাজালেন পুরু। সামনে দুশো হাতী একশো ফুট দুরে দুরে রাখা এই হাতীর পাল - তার পাশে রথ আর তার পিছনে ঘোড়সওয়ার।

    কেমন ছিলো সেসব রথ? চার চরটে ঘোড়া টানতো সেই সব ভয়ানক ভারী রথ। আলেকজান্ডার মুখোমুখী লড়াই না করে তার ঘোড়সওয়ার তীরব্দাজেদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন পুরুর বাম পক্ষে। আর ডান দিকে যাতে বিপদ না আসে তৈরী রাখলেন তার সেনাপতি কৈনস আর তার অধীন হাজার দুয়েক অশ্বারোহী সেনানীকে।

    হায় রে কপাল! যুদ্ধের আগের দিনেই খুব বৃষ্টি হয়েছিলো। পুরুর ঐ থপথপে রথেরা ভেজা বালুকাবেলায় গোরুর গাড়ীর স্পিডে চলতে লাগলো। স্লথগতি পুরুর বাহিনীকে একেবারে অবাক করে দিয়ে কৈনস ডান দিক দিয়ে এগিয়ে একেবারে পিছন থেকে আক্রমন করলেন পুরুর বাহিনীকে। প্রচন্ডো ক্যাওস। রথে সব সেনাপতি টতি বসে। তাদের নির্দেশ ছাড়া পুরুর সেনানীরা হতভম্ব।দ্রুতগতি অশ্বারোহী তীরন্দাজের কাছে কুর্মগতি রথ এঁটে উঠলো না। যুদ্ধ যখন শেষ হলো তখন পুরু হারিয়েছেন তার সমস্ত গজবল আর প্রায় পনেরো হাজার পদাতিক সেনানী। আর উদিকে আলেকজান্ডারে লস বলতে হাজার খানেক ঘোড়সওয়ার। ব্যস।

    মুলত: ঐ স্ট্যাটিক আর মোবাইল যুদ্ধের পরিনতি। একদা রথ ছিলো পদাতিক সৈন্যের বিরুদ্ধে এক দারুন স্টেট ওব দি আর্ট টেকনলজির বিজয়। কিন্তু তিনশো বছর পরে সেই প্রযুক্তি হলো ইতিহাস। আর দ্রুতগতি ঘোড়সওয়ার তীরন্দাজ বাহীনির টগবগে গতিতে শেষ হয়ে গেলো প্রাচীন যুগের কারীগড়ি কুশলতা - থেমে গেলো রথের বিজয় রথ (ইস্‌স!!!)।

    আসলে পুরুর সময়েই রথের মরণ ঘন্টা বেজে গেছিলো। মাত্র চার বছর আগেই দারিউসের সাথে লড়াইতেও প্রমান হয়েছিলো - সেখানেও রথ নির্ভর পারসীকেরা হেরে গেছিলো অশ্বরোহী প্রধান গ্রীক বাহিনীর কাছে। যাতে রথের লড়াই ভালো জমে সেই জন্যে দারিউস আগেই জমি সমতল ও রথোপযোগী রাস্তা করে রেখেছিলেন কিন্তু আখেরে লাভ হলো না।

    মনে করা যেতে পারে যে আমাদের যুদ্ধরথ ছিলো খুবই ভারী আর স্লথগতি। এক তো ভালো ঘোড়া ভারতে কখনোই ছিলোনা আর দ্বিতীয়ত: ভারতীয় যুদ্ধ ছিলো খুবই - যাকে বলে স্ট্যাটিক ওয়ারফেয়ার। অলেকজান্দার বিশ্বজয় করে ফেললেন তার প্রিয় ঘোড়া বুকেফেলাসের পিঠে চেপে, কিন্তু, এমন কি কৌটিল্য পন্ডিত পর্য্যন্ত জানিয়ে দিয়েছিলেন রাজা বা প্রধান সেনাপতি হাতী বা রথে চড়েই যুদ্ধ করবেন। ১১৭০ বিসি-তে মিশরীয় বাস রিলিফে আছে একজন লোক একাই একটা রথ কাঁধের উপর বহন করে আনছে। ইজিপশিয়ান সমাধিতে পাওয়া রথ ও তার ছবি দেখলে বোঝা যায় সেই রথ ছিলো নেহাৎই হাল্কা পুল্কা। তুলনায় ভারতীয় রথ প্রথম থেকেই একটু ঐ কি বলে অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত আর রাজার প্রতীক - তাই খুব ভারী।

    তুলনা করুন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরের কিছু পরীক্ষামুলক ভারী ট্যাংক - সেই সব লৌহদানব ৭৫ থেকে ৯০ টন পর্য্যন্ত ওজন হতো - কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে যখন নাৎসী সৈন্য ব্লিৎসক্রীগ শুরু করলো তখন আর ঐ ভারী ট্যাংক নিয়ে কেউ মাথা ঘামালো না। গতির কাছে চলমান দুর্গ অচল। ভারী ট্যাংক তো দুরের কথা অমন যে ম্যাজিনো লাইন - নাৎসি ঝটিকা যুদ্ধের কাছে সেও মাথা লুটিয়ে পড়লো।

    অথচ মিশরীয় বা আসিরিয়ান বা কেলটিক - এসব দেশের যুদ্ধরথ দেখুন। দুই চাকা - গড়ে ছয়টা স্পোকের চাকা। "টায়ার" তৈরী হতো চামড়ার ফালি বা গাছের বাকল দিয়ে। হাব ও এক্সেলে থাকতো সংকর ধাতুর ঢাকনা। বেতের এক বাস্কেটে বা হাল্কা কাঠের বাক্সে খুব ঘেঁশাঘেশি করে দুই জন তীরন্দাজ দাড়িয়ে লড়াই করছে। আলাদা সারথি ছিলো না। মূল লক্ষ্য ছিলো দুর্বার গতি - তাই ওজন কম রাখার দিকেই নজর ছিলো বেশী।

    ধনুক নিয়ে, গদা নিয়ে, রণশংখ নিয়ে যেমন কতই আদিখ্যেতা ছিলো - ঘোড়া বা রথ নিয়ে পুরানে কোনো আহ্লাদ নেই। ঋগবেদে বেশ কয়েকবার উল্লেখ আছে ভালো চাকার রথের কথা, মহাভারতে অর্জুনের রথের কথায় বলা হয়েছে নি:শব্দ চাকার রথ - অর্থাৎ ক্যাঁচ ক্যঁচ শব্দ হতো না। কই - এ ছাড়া তেমন মাতামাতি কিছু নেই।

    রথের বর্ননায় আছে বরুথ শব্দ - মানে রথের মধ্যে গোপন প্রকোষ্ঠ। কেন রে বাবা? কত বড় রথ ছিলো যে একটা লুকোনো চেম্বার ও থাকতো? অধিষ্ঠান বলা হতো রথের উপর রাখা ছোটো চেয়ার বা চৌকিকে। পরিশ্রান্ত রাজা ওটাতে বসে একটু বিশ্রাম নেবেন আর কি !!

    মহাপ্রস্থানের পথে

    ৩২৭ বিসি - ততদিনে হায়! রথের দিন গিয়াছে। ফ্র্যানে্‌কনস্টাইনের দত্যির মতন রথের মধ্যেই ছিলো রথের মৃত্যুবীজ। সেটা কি?

    সেটা হচ্ছে ঘোড়া। ক্রমশ:ই সুপ্রজনন প্রথায় ঘোড়া আরো শক্তিশালী হয়ে উঠলো আর তার সাথে সাথে রেকাব লাগাম জিন - এইসবের আবিষ্কারও হয়ে গেলো। তখনকার বিজ্ঞানী প্রযুক্তিবিদেরাও খুব মাথা খাটাচ্ছেন - composit bow অর্থাৎ শুধু বাঁশের ধনুক নয় , কাঠ, ধাতু, কখনো হরিণ বা অন্য জন্তুর শিং দিয়ে তৈরী যৌগিক ধনুক - যেটা তৈরী করতে সময় লাগতো প্রায় এক বছর আর সাইজে ছোটো হলে কি হবে প্রায় তিনশ গজ পর্য্যন্ত লক্ষ্যভেদ করতে পারতো। রথের থেকে অনেক দ্রুতগামী ঘোড়সওয়ার - ঘোড়ার পিঠে বসেই দিব্বি তীর ছুঁড়ে নিখুঁত লক্ষভেদ করতে সক্ষম দুরন্ত ক্যভালরি।

    ব্রোঞ্জ যুগের শেষে - তখন পুর্ব ইউরোপ আর মধ্য এশিয়ার সুবিশাল তৃণভুমি থেকে নেমে আসছে তাতার, মোঙ্গোল, হুনেরা। তাদের সংঘবদ্ধ ক্যাভালরী আক্রমনে ভেসে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠিত রাজ্যপাট - যেমন একদিন রথচক্রে গুঁড়িয়ে গেছিলো দীর্ঘধনু, বল্লম ও অসিধারী পদাতিক সেনানীর সুরক্ষিত সাম্রাজ্য ও নগর সভ্যতা।

    কিন্তু শেষ হাসি ছিলো ঐ নগর সভ্যতারই। লুটপাট করা সেই বর্বরেরা অনেকেই থেকে গেলেন বিজিত দেশে - ঘর বাঁধলেন, চাষ বাসের দিকে মন দিলেন। এখন আর খুঁজেও পাবেন না কারা ছিলো শক, কোথায় গেলো সেই হুনেরা। ঐ - যাকে বলে এক - এক দেহে হলো লীন।

    ষোড়শ শতাব্দী থেকে শুরু হয়ে গেলো বারুদের যুগ। তীর ধনুকের বদলে হাতে উঠলো বন্দুক - কোনো প্রয়োজনই ছিলো না তাও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্য্যন্ত চার্জিং ক্যাভালরী লড়ে গেছিলো।

    মানুষ আর ঘোড়ার মৃতদেহের উপর অনেক জল গড়িয়ে গেছে এতোদিনে। দুর্গম পাহাড়ী জায়গায় সামরিক বাহিনীতে তাও এখনও খচ্চর আর পাহাড়ী ঘোড়া পরিবাহক হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ঐ পর্য্যন্তই।

    আর রথ? শুধু পাবেন চিরকালের জন্য পাথরে খোদাই হয়ে - দেবস্থান। মহাবল্লীপুরম বা কোনারকে বা হাম্পীতে। আর ভরা বরষায় মেলার মধ্যে। খুব কপাল মন্দ হলে রাজনৈতিক নেতার প্রচার বাহন হিসাবে। তো তাদের ধ্বংস শক্তি ও কম নয়। নয় কি?
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ০১ মে ২০০৬ | ৭৫৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল মতামত দিন