এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ  গুরুচন্ডা৯ ছয়

  • নোয়ার নৌকাতে কয়েক ঘন্টা

    প্রত্যূষা বসু
    আলোচনা | বিবিধ | ২৭ জানুয়ারি ২০০৬ | ৬৫৬ বার পঠিত
  • মিসিসিপি ২৯শে আগস্ট, ২০০৫

    নোয়ার নৌকো

    এখন সকাল ছটা। বাইরে ঝোড়ো হাওয়া, সঙ্গে বৃষ্টি। কিন্তু এখনো সেই কালান্তক হারিকেন আসেনি। ওটা দুপুর নাগাদ এসে পৌঁছবে বলছে খবরে।
    ঘরে আলো জ্বলছে, ঝটচলছে, খবরে দেখাচ্ছে ঘূর্নীঝড় ক্যাট্রিনাকে। ওটা উপকূলে আছড়ে পড়েছে, এখন এদিকে এগিয়ে আসছে।

    আমরা নজন মানুষ এখন এই নড়বড়ে কাঠের বাড়ীতে। সঙ্গে এগারোটা কুকুর আর একটা বেড়াল। প্রাণী আরো কটা আছে, পাঁচটা লাল-সোনালী মাছ, একটা মস্ত বড়ো কাঁচের বোলে। কুকুরলোর মধ্যে একটা ছোটো আকারের শান্ত কুকুর, সাদা খরগোসের মতন দেখতে, নাম প্রিসি, ঝড়ে বাদলে খুব ভয় পায়। সে জেনিনের কোলের মধ্যে মুখঁ জে, তিরতির কাঁপছে।

    নৌকোর মাঝিমাল্লা

    সবচেয়ে ছোটোজনের বয়স দুই। নাম চার্লি। দুরন্ত ছেলে, সে এসব ঝড় ঝঞ্ঝা বোঝে না, এর মধ্যেই তুরতুর করে ছুটে বেড়াচ্ছে আর মাকে বাবাকে হয়রান করছে। চার্লি জেনিফার আর চার্লসের একমাত্র সন্তান, ওরা তিনজনে থাকে উপকূলের শহর বিলোক্সিতে। সেখানে চার্লস একটা ক্যাসিনোতে মেন্টেনান্স ম্যানেজার হিসাবে কাজ করে। গতরাতে তিনজনেই এখানে এসে পৌঁছেছে। বিলোক্সি থেকে সমস্ত লোক সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, শহরটি জলোচ্ছ্বাসে ডুবে যাবার সম্ভাবনা আছে বলে।

    দশ বছরের ছেলে ম্যাথিউ, সে সুজানের ছেলে, ওরা থাকে কাছেই একটা মোবাইল হোমে, গতরাত থেকে এখানে আছে। সে চুপ করে বসে আছে সোফাতে, সঙ্গে ওর পেয়ারের কুকুর আর্নি।আর্নির মুখের চারপাশে মস্ত মস্ত দাঁড়িগোঁফ, দেখলে কেন জানি বুড়ো মানুষের কথা মনে পড়ে যায়। ম্যাথিউ আর আর্নি দুজনেই খুব চুপচাপ।

    অন্যদিকের সোফায় বসে আছে মিশেল, ম্যাথিউর দুই বছরের বড়ো দিদি। সদ্য ফুটতে থাকা কিশোরী, খুব সুন্দরী হবে বড়ো হলে। গোলাপ ফুলের মতন গায়ের রং, লম্বা চুল কালচে বাদামী। শান্ত মেয়েটি, এখনি অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ফুটতে আরম্ভ করেছে। এই বয়সেই এত ঠান্ডামাথা খুব কম দেখা যায়।মিশেল সোফায় বসে চুপচাপ বই পড়ছে আর মাঝে মাঝে ঝটর পর্দার দিকে তাকাচ্ছে।

    চার্লস দিব্যি হাসিখুশী তারুণ, সেই ছেলেকে দৌড়ে দৌড়ে সামলাচ্ছে বেশীটা। হয়তো ছেলেদের ঘাবড় যাওয়া মানা, আর সে সুদ্ধু ঘাবড়ালে চলবে কেন? তাই চার্লস এত গন্ডগোলের ডামাডোলের মধ্যেও একটুও আপসেট হয়ে পড়া দেখাচ্ছে না। চার্লস আর জেনিফারের বিয়ে হয়েছে বছর চারেক, আগে নাকি এই বাড়ীতে জেনিফার থাকতো বোর্ডার হয়ে। তখন সে ছাত্রী ছিলো। পড়তে পড়তেই বিয়ে হয়ে বিলোক্সি চলে যায়, তারপরও পড়া চালিয়ে গেছে ওখান থেকে যাতায়াত করে। ছেলে হবার পরেও পড়া ছাড়ে নি। দিনের বেলা ও পড়তে চলে আসতো যখন, তখন চার্লিকে ওর বাবা দেখতো, কারণ চার্লসের আপিস রাত্তিরে। গত বছর পাশ করলো জেনিফার, তখন এখানে এসেছিলোও। গোলাপের স্তবক দিয়ে তখন অভ্যর্থনা করেছিলো এই বাড়ীর ল্যান্ডলেডি, জেনিন। মিষ্টি চেহারার তরুণী জেনিফার, এই ঝড় বৃষ্টি বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে জেনিফারের সুন্দর মুখখানা শুকিয়ে গেছে। নতুন সংসার, কত কষ্ট করে গোছানো বাড়ীঘর, কয়েক ঘন্টার নোটিশে সব পিছনে ফেলে গাড়ীতে অল্পকটা আবশ্যকীয় জিনিস নিয়ে চলে আসতে হলে মনের অবস্থা কেমন হয়, তা তো না ভাবাই ভালো।

    ম্যাথিউ মিশেলের মা সুজান ল্যান্ডলেডী জেনিনের বড়োমেয়ে। সেও তরুণী, তবে খুব অল্পবয়স নয়। একটু স্থূলকায়া হয়ে পড়েছেন ইদানীং। ইনি পেশায় নার্স। কিছুদিন আগে খুব গন্ডগোল গেছে এনার জীবনে, ড্রাগের নেশা ইত্যাদি নিয়ে, এখনো নিয়মিত কাউন্সেলিং এ একটু ভালো, আরোগ্যের পথে।এই ঝড়ে বাদলে কিন্তু ইনিও আপসেট হন নি, বরং দিব্যি গল্প করে যাচ্ছেন, কফি বানাচ্ছেন, চিপ্স এনে দিচ্ছেন।

    সুজানের স্বামী কেন ও আছেন এই বাড়ীতে। ইনি সুজানের থেকে অনেক বেশী বয়সী, ইনি সুজানের দ্বিতীয় স্বামী। প্রথম স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়েছে সুজানের বেশ কয়েক বছর, এই ম্যাথিউ-মিশেল দুজনেই সেই বাবার ছেলেমেয়ে। উনি থাকেন অন্য শহরে, অন্য স্ত্রী সন্তান নিয়ে। কেন-কে কেন জানি সুজানের মা জেনিন একেবারে দেখতে পারেন না, হয়তো সে ড্রাগ অ্যাডিক্ট বলে, হয়তো ওর ব্যক্তিত্ব জেনিনের নাপসন্দ বলে। কি জানি। কেন-কে আমার কেন জানি খুব ছেলেমানুষ মনের লোক বলে মনে হয়, জোরে জোরে কথা বলেন, কখনো কখনো লোকে কি মনে করছে, তাও খেয়াল রাখেন না। সেরকম কোনো স্টেডি চাকরিও নেই, বউয়ের উপর নির্ভর করে সংসারে আছেন। কিন্তু মোটের উপর লোকটাকে খারাপ লাগে না।

    জেনিন, আমাদের ল্যান্ডলেডির বছর পঁয়ষট্টি বয়স, টকটকে রঙ, একমাথা সাদা চুল ববছাঁট মারা, এখনো দেখলে বোঝা যায় যৌবনে খুব সুন্দরী ছিলেন। খুব স্ট্রং মহিলা। এই বয়সে নানা অসুখের সঙ্গে লড়তে লড়তেও সংসার, পোষা প্রাণী, বাগানের গাছপালা পরিচর্যা সব কিছু এতটুকু বিরক্ত না হয়ে সামলে চলেছেন। এই তো এই সকালে এখন রেন কোট গায়ে দিয়ে নেমে পড়েছেন ম্যাগনোলিয়া আর ক্যাপসিকামের গাছ খুঁটিতে ভালো করে বাঁধতে, যাতে ঝড়ে না ছিঁড়ে দেয়।

    সবশেষে আমি। চুপচাপ একবার নিজের ঘর আর একবার মাঝের ঘর করে চলেছি, কি আর করবো? সুজান কফি আর চিপস নিতে সাধলেন, না করলাম, খেতে ইচ্ছে করছিলো না সত্যিই।
    এ বাড়ীতে আমি ছাড়া আরো যে দুটি বোর্ডার থাকেন, জেফ আর মেরি-দুজনেই গত রাতে অন্য জায়গায় চলে গেছেন। মেরি টেক্সাসে আর জেফ কাছেই অন্য একটা শহরে, নিজের বৃদ্ধা মায়ের কাছে। এইসব ঝড়বাদলের ঝঞ্ঝাট মিটলে ফিরবেন দুজনে।

    যাত্রা শুরু

    সকাল আটটা, প্রাণভোমরা বিদ্যুৎ চলে গেলো। ব্যস, এইবারে ঝট বন্ধ, আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। রেডিও আছে দুখানা, তাতে খবর অবশ্য পাওয়া যাচ্ছে, নিউ অর্লিয়ান্সের সাংঘাতিক সব খবর। সেখানে ইতিমধ্যেই প্রলয়কান্ড ঘটে গেছে। বিলোক্সির খবরো খুব খারাপ, সেখানেও পরিস্থিতি অতি ভয়াবহ।

    জেনিফার উদ্বিঘ্ন, চার্লসকে বারে বারে নানারকম আশংকার কথা বলছেন, চার্লস ওকে আশ্বস্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করে চলেছেন।

    নিজেদের কিরকম বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন বলে মনে হচ্ছে যেন। যেন অগাধ সমুদ্দুরে ভাসছে একখানা জাহাজ, ভিতরে আমরা এই কটা প্রাণী। ফোনও করা যাবে না এখন, ল্যান্ডলাইন তো গেছেই, সেলফোনও কাজ করছে না। কোথায় কি হচ্ছে, কেউ আমাদের খোঁজ করছেন কিনা, তাও জানা যাবে না।
    এদিকে বিদ্যুৎ নেই বলে রান্নার কোনো উপায় নেই, ফ্রিজও বিকল।
    প্যাকেটের আমিষ নিরামিষ খাবার আর ফলটল দাবার সব বড়ো ক্রেটে বরফের মধ্যে রেখে দেওয়া হতে লাগলো।
    মাঝের ড্রয়িং রুমে সবাই জড়ো হয়েছি আবার। রেডিওতে নানারকম খবর বলছে, বেশীরভাগই এই ঘূর্নীঝড় হ্যারিকেন ক্যাট্রিনা নিয়ে।
    এদিকে রান্নাঘরে এক কান্ড করে বসলেন জেনিন। উনি একখানা রেডিও সেট নিয়ে ওঘরে টেবিলে রেখে কি কাজ করছিলেন। টেবিলে ছিলো লালসোনালী মাছের বড়ো গোলছে মতন জারটাও।তাড়াতাড়িতে হাত লেগে গেলো সেটা উল্টে। ভেঙে চুরমার কাঁচের পাত্র। ঘরময় জল আর মাছগুলো মেঝেয় খাবি খাচ্ছে। চটজলদি মাছগুলো আর জলজ গাছড়াটা তুলে উনি অন্য একটা ছোটো জারে রাখলেন জল দিয়ে। কিন্তু ততক্ষণে রেডিও সেটে জল পড়ে সেটার বারোটা বেজে গেছে। কি অবস্থা!

    দে দোল দোল দোল তোল পাল তোল চল ভাসি সব কিছু তাইগ্যা

    বেলা দশটায় ঝড়ের গোঙানি বাড়তে লেগেছে, বৃষ্টিও তখন আরো বেশী। আকাশ তো ল্যাপাপোঁছা মেঘে। ঘরের ভেতর অন্ধকার, ইলেক্ট্রিসিটিও নেই। বেশ কটা ফ্ল্যাশলাইট মানে টর্চ হাতের কাছে যোগাড় রাখা হলো। বাথরুমে টাথরুমে যেতে তো টর্চ ছড়া উপায় নেই! কি ভাগ্যি জলের সাপ্লাই ঠিক আছে এখনো!

    বাড়ীটা কাঠের একতলা বাড়ী, চারপাঁচটা ঘর, রান্নাঘর, দুখানা ছোটো ছোটো কলঘর। বাড়ীর আশেপাশে অনেক মস্ত মস্ত লম্বা পাইন গাছ। একটা তো ঘরের একেবারে লাগোয়া, ঠিক পুব দক্ষিণের ঘরের দেওয়ালের দুহাতের মধ্যে ওর মস্ত মোটা শতবর্ষের কান্ড। ঐ ঘরটায় আবার থাকি আমি। ঝড়ে এখন সব গাছই খুব দুলছে,থেকে থেকে শাখাপল্লব ঝড়ে ভেঙে পড়ছে উঠানে।
    ঐ ঘরে থাকতে না করলো এখন, সবাই বললো যেন মাঝের ড্রয়িং রুমেই থাকি। তো তাই রইলাম।

    ভেসে যায় আদরের নৌকা

    সাড়ে এগারোটা নাগাদ হাওয়ার গোঁগোঁয়ানি বেড়ে হুইসিলের মতন শব্দ শুরু হলো। এসে গেছে ক্যাট্রিনা। সেই ভয়ংকরী ঘূর্ণিঝঞ্ঝা, যাকে কাল রাতে টিভির খবরে দেখছি আর আজ সকালে বিদ্যুৎহীন বাড়ীতে রেডিওতে শুনেছি। হাওয়ার গতি এখন প্রচন্ড, মস্ত মস্ত পাইন গাছ দেশলাই কাঠির মতন মট মট করে ভেঙে দিচ্ছে কালান্তক হারিকেন ঝড়।

    ধারালো চাবুকের মতন বৃষ্টি, আকাশটা ধূসরকালো। যড়যন্ত্রীর মতন চেহারা তার।

    সুজানের স্বামী কেন দরজায় দাঁড়িয়েছিলো, ঝড় লক্ষ্য করছিলো। দরজাটা আমার ঘরের খুব কাছেই, আমি নিজের ঘরে তখন এসে একটু বসেছি।

    বাইরে মড়াৎ শব্দ, কেন চিৎকার করে কইলো, "দ্যাট ওল্ড ট্রী হ্যাজ ফলেন।" কই, কোন ড ওল্ড ট্রী? বসার ঘর থেকে জেনিন আর সুজান দৌড়ে এলো দেখতে। জেনিনের আবার নিজে দেখে হয় না, আমায় ডাকেন, "কাম কাম,সী হোয়াট হারিকেন ডাজ।" পাশের প্রতিবেশীর সামনের উঠানে অনেক লো পাইনগাছের মধ্যে সবচেয়ে ধারেরটা একেবারে গোড়া থেকে উপড়ে পড়েছে রাস্তায়। অদ্ভুৎ লাগছে, রাস্তার এধার থেকে উধার জুড়ে পুরো রাস্তা আড়াআড়ি ব্লক করে পড়ে আছে উচ্চশীর্ষ সেই সরল পাইনগাছ। বেশ মোটা গাছ, সম্ভবত আশি নব্বই বছর বয়স হবে সে গাছেরঁ গুড়ির স্থূলত্ব দেখে যা মনে হয়, সেই গাছ পুরো ঘাসের চাপড়ার মতন তুলে ফেলে দিয়েছে ক্যাট্রিনা!

    দেখে টেখে ঘরে এসেছি আবার, ওরা তখনো দরজায়, আবার তীব্র চিৎকার, কি হলো রে বাবা। এইবারে সোজাসুজি সামনে, বেশ অনেকটা দূরে, একখানা পাইনগাছ ঝড়ে লম্বালম্বি গেছে চিরে। দুদিকে দুখানা ফালি কাত হয়ে পড়েছে মাটিতে!

    সামনের বাড়ীর তেকোনা ছাদে দমাস করে পড়লো একখানা গাছ। পলকা কাঠের ছাদ ঢুকে গেলো ভেতরে।

    আমরা এখন আবার জমায়েৎ মাঝের ঘরে। শুধু সুজানের স্বামী কেন দরজায়। ঘরের পাশের মোটা পাইনগাছটা ভয়ানক দুলছে, থেকে থেকেই শাখাপল্লব ভেঙে পড়ছে গাছের উঁচু অংশ থেকে।
    কেন সেটার দিকে লক্ষ্য রাখছে।

    বাড়ীর পিছনের চত্বরে মস্ত একটা ওয়াটার ওক গাছ ভেঙে পড়েছে বেড়ার উপরে। বেড়ার সে অংশটাঁ ড়িয়ে গেছে, বাকী অংশের কাঠের ফালিগুলোও শুয়ে পড়েছে মাটিতে।

    পাশের বাড়ীর একটা পাইন গাছ এসে দমাস করে পড়লো পিছনের উঠানে। বড়ো গাছ, ওর দেহটা উঠানে আর মাথাটা গ্যারেজের পলকা ছাদে, ধাক্কায় গ্যারেজের কিছুটা অংশ গেলো ভেঙে।কয়েক ইঞ্চির জন্য বেঁচে গেলো মেরির ঘর, জেনিনের বাড়ী।

    জেনিফার কাঁদতে শুরু করলো এই মুহূর্তটায়। এ কি হচ্ছে? প্রলয়? কিছুই কি আর থাকবে না?

    জেনিন সাহস ও সান্ত্বনা দিলেন, "না না ভয়ের কিছু নেই। পুরানো গ্যারেজ, বাজে গাছ গেছে যাক না। ভালোগুলো সব থেকে যাবে।"

    চার্লস স্ত্রীকে শান্ত করার চেষ্টা করছে তখন। জেনিফার ফোঁপাচ্ছে, বাচ্চাটা এসব বোঝেনা, কিন্তু মাকে কাঁদতে দেখে সেও কাঁদতে শুরু করেছে, চার্লস বৌ না ছেলে কাকে সামলাবে কিভাবেই বা সামলাবে, ভেবে পাচ্ছেন না। জেনিফার ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলছে, "চার্লস, হানি, এখানেই যদি এরকম হয়, কি অবস্থা তাহলে আমাদের রেখে আসা বাড়ীর?"

    চার্লস বলছে, "কেন সেসব ভাবছো? যা হবার তাতো হবেই! আমার নিজেরা তো চলে আসতে পেরেছি, এটাই অনেক নয়? আমি, তুমি, আমাদের ছেলে সবাই বেঁচে আছি, এর চেয়ে আরো কি চাইতে পারি?"

    জেনিফার সান্ত্বনা পায় না, বলে "কি হবে চার্লস, যদি ফিরে গিয়ে দেখি কিছুই নেই? যদি বাড়ীঘর সব ভেসে যায়, নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়?"

    চার্লস বলে, "কি হবে আর? গেলে যাবে। ভেবে লাভ আছে কিছু? ভগবান সহায় থাকলে যা যাবে তার বহুগুণ ফিরে পাবো। ভালো কথা ভাবো হানি, ছেলেটার কথা ভাবো, মিছিমিছি ভয় পেয়ো না।"

    এই সংকটমুহূর্তে প্রায় সবাই ভেঙে পড়েছে, ম্যাথিউ সোফায় এলিয়ে পড়ে কাঁদছে, ওর মা সুজান ছেলেকে জড়িয়ে ধরে অস্ফুটে কিসব বলে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। কোনাকুনি সোফাতে বসে আছে চুপ করে বসে আছে কিশোরী মিশেল, সে এখন আর বই পড়ছে না, বইখানা পাশের টেবিলে বন্ধ করে রাখা। মিশেলের কোলে ছোট্টো সাদা কুকুর প্রিসি, যে কিনা ঝড়বাদলে খুব ভয় পায়।কুকুরটা সত্যি সত্যি কাঁপছে, মিশেল ওর গায়ের উপরে একটা শুকনো তোয়ালে দিয়ে জড়িয়ে দিলো।

    আমি চুপচাপ বসে আছি সোফাতে, দর্শকের মতন, সিনেমার একটা ভয়াবহ দৃশ্যের সামনে সন্ত্রস্ত দর্শকের মতন। কিছুই করার নেই, কিছুই বলার নেই, শুধু অপেক্ষা করা ছাড়া।

    বাড়ীটা ঝড়ের ধাক্কায় যেন দুলে দুলে উঠছে, বাইরে মড় মড়াৎ করে আগের মতোই গাছ ভাঙছে। নিজেদের প্রলয়কালের নৌকাযাত্রীর মতন লাগছে। নোয়ার নৌকা মনে পড়ছে আমার।বাইবেলের গল্প। নোয়া আর তার ছেলেপুলে স্ত্রী এরা সঙ্গে সব রকমের প্রাণী জোড়া জোড়া নিয়ে ভেসে পড়েছিলো নৌকায়, প্রলয় ঝড়েজলে বাকী পৃথিবী ধুয়ে গেছিলো! পরে ঝড়বৃষ্টি থামলে ওরা নৌকো নিয়ে এসে ঠেকেছিলো এক পাহাড়ে!

    চারিদিকের প্রলয়ঝঞ্ঝা কি আর থামবে না? সত্যি কি চল্লিশ দিন ধরে চলবে, যেমন চলেছিলো বাইবেলের গল্পে?

    মন ঝাঁকি দিয়ে তাড়িয়ে দিতে চাই এসব গল্পকথা। কিছু একটা জিনিস চালু থাকলেও তাতে সবাই ইনভলভড হওয়া যেতো, টিভি বা রেডিও, যে কোনো কিছু। বা যে কোনো আলোচনা, বা কোনো বোর্ড গেম। কিন্তু সেই সময়টায় মনে হয় কিছুই কারু ভালো লাগছিলো না, ভাবতেও ভালো করে কেউ পারছিলো না।

    সবার মনে স্পষ্ট বা অস্পষ্ট শুধু একটাই ভাবনা তখন, কখন এ হারিকেন থামবে? অন্তত কখন এ ঝড়ের বেগ কিছুটা কমে আসবে, বৃষ্টিটা ধরবে। অন্তত বোঝা যাবে, উই হ্যাভ পাসড দ্য ওয়ার্স্ট। ধুম ধম ধম।বিরাট আওয়াজ। এইবারে এই বাড়ীর ছাদের উপরে। বিরাট এক পাইন ডাল পড়েছে ছদে, কলঘরের ছাদ থেকে জল পড়া শুরু হলো ধারা বেয়ে, সেখানটা ফুটো হয়ে গিয়েছে। মাঝের আরেকটা ঘরেও জল পড়ছিলো।

    এইবারে আবার সবাই ব্যস্ত। বড়ো বড়ো বালতি নিয়ে জলপড়ার জায়গালোতে রাখা হতে থাকলো। জলে তা ভরে গেলে বাথটবে সেই জল ঢেলে বালতি খালি করে দিয়ে ফের পাতা হতে থাকলো। বাইরে বৃষ্টির ধার তখনো একই রকম।

    তবে এই ছাদফুটো বিপর্যয়ে আমাদের চুপ করে ভয়ার্ত বসে থাকার ডেডলকটা কেটে গেল অন্তত। সবাই অন্তত কিছু কাজ করতে পারছে, কিছু কথা কইতে পারছে। সবই অবশ্য জল পড়া সংক্রান্ত ছেঁড়া ছেঁড়া কথা, "বাকেট ইজ ফুল গ্রাম্মা। "ম্যাথিউ চেঁচাচ্ছে, জেনিন কিচেন থেকে চিৎকার করে কইছেন, "এম্পটি দ্যাট,এমপ্টি দ্যাট,পুট আ নিউ ওয়ান।"

    এইরকম সব সুরতালহীন বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্ন কাজের কথা, কিন্তু তবু তা চুপ করে বসে প্রলয়ের কথা ভাবার থেকে ভালো।

    ঝড় আর কতক্ষণ চলবে কে জানে। কিন্তু এই জলপড়া, বালতি পাতার ব্যবস্থায় ধাতস্থও হয়ে গেলাম সবাই খানিকক্ষণের মধ্যে। বৃষ্টিও খানিক কমে এলো।

    প্রায় সবাই ফের এসে সোফায় বসেছে, কেন আবার গিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে ঝড় পর্যবেক্ষণ করছেন, এমন সময় আরেক কান্ড!

    স্যামি বলে বাদামী রঙের মস্ত গ্রেহাউন্ড কুকুরটা এতক্ষণ চুপচাপই ছিলো। স্যামি মেয়ে কুকুর, এমনিতে খুব শান্ত, জোরে ঘেউ ঘেউ অবধি করে না। জেনিন ওকে এ বাড়ীতে আনার আগে ও ছিলো দৌড়োনোর কুকুর, ডগ শোতে নাকি দৌড়োতো। সেখান থেকে রিটায়ার করার পরে এই তিনবছুরে স্যামিকে উনি এনেছেন। জেনিন কুকুর খুব ভালোবাসেন, বলেন এলি ওনার ছেলেমেয়ের মতন নাকি। জেনিন আগে ছিলেন ব্যস্ত নার্স, এখনো কাজ করলে করতে পারতেন, কিন্তু নানারকম অসুখ আর অপারেশনের ধাক্কায় স্বেচ্ছাবসর নিতে বাধ্য হয়েছেন। এখন ছেলেপুলেরা বিয়ে হয়ে চলে গেছে, চাকরিতেও যেতে হয় না, এই এত সময় উনি কুকুর নিয়েই কাটান।

    তো এখন স্যামি হঠাৎ ভুক করে ডেকে উঠেই খোলা দরজা দিয়ে দে দৌড়। বাইরে বৃষ্টিঝড়ের মধ্যেই রাস্তা দিয়ে দৌড়েছে। সুজান দৌড়ে গেছেন দরজায়, প্রথমে সেখান থেকেই কবার চেঁচিয়ে ডাকলেন, কিন্তু স্যামি পিছনে না তাকিয়ে দৌড়ে চলে গেছে।রান্নাঘরে ছিলেন জেনিন, তিনি স্যামির পালানো দেখেন নি। মেয়ের চিৎকারে ছুটে এসে তিনিও গলা চিরে স্যামিকে ডাকলেন, কিন্তু স্যামির চিহ্ন নেই। জেনিন ঐ ঝড়ের মধ্যেই প্রায় তখন দৌড়ে বেরোন আর কি। সুজান কোনোরকমে ঠেকিয়ে রাখে, বলে, "একটু পরে। ঝড়টা একটু কমুক, বৃষ্টিটা ধরুক।তখন আমিও তোমার সঙ্গে যাবো। এই ঝড়ের মধ্যে বেরিয়ে কোনো লাভ নেই।"

    জেনিন এতক্ষণ দিব্যি শক্ত ছিলেন, এখন চোখে জল দেখলাম। কিন্তু কি করেন, খানিকক্ষণের মধ্যেই সামলে নিয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

    তারপরে আরো আধা ঘন্টাখানেক পরে কমে এলো ঝড়ের গোঁগোঁয়ানি। এখনো ছেঁড়া ছেঁড়া ঝড়ের আঁচল মাঝে মাঝে হুইসিল দিয়ে যাচ্ছে, তবে বোঝা যাচ্ছে উই হ্যাভ হ্যাড দ্য ওয়ার্স্ট।তখনো বৃষ্টি চলছে কিন্তু।

    মাঝের ঘরে সকলেই আছি আবার। জেনিন একখানা বড়ো সাইজের বাটি আর চিপসের প্যাকেট আনলেন, বললেন, "এসো চিপস খাওয়া যাক।ঝড় আরেকটু কমলে না হয় বাইরে বেরিয়ে দেখা যাবে।"

    বাটিতে উনি চিপ্স ঢালছেন, চারিদিকে হতভম্বের মতন আমরা। কিন্তু উনি ঠিক, যা হবার তাতো হবেই, মনকে অন্যদিকে ব্যস্ত রাখা দরকার।

    খেতে খেতে কমে এলো বৃষ্টি। জেনিন স্যামির বকলসটা নিয়ে মেয়েজামাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন পথে। স্যামিকে খুঁজতে।

    আধাঘন্টা পরে যখন স্যামিকে নিয়ে ফিরলেন জেনিনের তখনকার হাসিটা দেখলে আলেকজান্ডারের বিশ্ববিজয়ের হাসিটা কেমন ছিলো বোঝা যেতো। বললেন,"জানো, এক ভদ্রলোক দেখতে পেয়ে ঘরে তুলেছিলেন ওকে। চেনা ভদ্রলোক, ভাগ্যিস উনি স্যামিকে চিনতেন আর ওঁরই চোখে পড়েছে স্যামি।"

    বাইরে তখন মেঘ কেটে ফ্যাকাশে আলো ফুটেছে।ঘরে আঁধার। বিদ্যুৎহীন বাড়ীতে লম্ফ জ্বেলে রাখা হতে থাকলো ঘরে ঘরে।

    মাঝের ঘরে আমরা কটি প্রাণী আবার জড়ো হয়েছি। ঝড়বাদলের শেষে প্রলয় পরবর্তী পৃথিবীর কটি বেঁচে থাকা প্রাণীর মতন।

    বাইরে ঠান্ডা হাওয়া বইছে তখন, শান্ত মৃদু নরম। কূলে এসে ঠেকেছে নৌকা আমাদের।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২৭ জানুয়ারি ২০০৬ | ৬৫৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল প্রতিক্রিয়া দিন