এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  ছবিছাব্বা

  • ‘সব দাড়িওয়ালা মানুষ রবীন্দ্রনাথ নন’

    Debraj Goswami লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | ছবিছাব্বা | ০৭ আগস্ট ২০২০ | ৩৮৪৯ বার পঠিত

  • ইদানিং মাঝেমাঝেই দেখি সোশ্যাল মিডিয়ায় মৃত্যুশয্যায় শায়িত এক দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ মানুষের ছবির নিচে লিখে দেওয়া হয় ‘উইলিয়াম রোদেনস্টাইন অঙ্কিত মৃত্যুশয্যায় রবীন্দ্রনাথের বিরল ছবি’। স্বভাবতই এ ছবি দেখে বাঙ্গালী আবেগের স্রোতে ভেসে পড়েন, হাজারে হাজারে ‘লাইক’ দেন আর শয়ে শয়ে শেয়ার করে একটি অদ্যন্ত ভুল তথ্যকে চক্রবৃদ্ধি হারে মহামারীর মত ছড়িয়ে দেন দেশে দেশে , দিশে দিশে । অথচ তাঁরা একবারও ভেবে দেখেন না কলকাতায় রবীন্দ্রনাথ যখন মৃত্যুশয্যায় , তখন চিত্রকর রোদেনস্টাইন রয়েছেন ইংল্যান্ডে , কিভাবে তিনি এমন একটি ছবি আঁকতে পারেন ? কেউকেউ হয়তো বলবেন ছবিটি মন থেকে আঁকা । কিন্তু যাদের ছবি সম্পর্কে সামান্যতম জ্ঞান আছে তাঁরা এ ছবি দেখলেই বুঝতে পারবেন এটি সামনে থেকে দেখে আঁকা ছবি যাকে শিল্পীদের ভাষায় বলে ‘লাইভ স্টাডি’। ১৯১০ সালে রোদেনস্টাইন প্রাচ্য শিল্পসন্ধানে ভারতবর্ষে এসেছিলেন । সে সময় তিনি গিয়েছিলেন অজন্তায় । তখন লেডি হ্যারিংহামের নেতৃত্বে অজন্তার প্রতিলিপি অঙ্কন করছিলেন শিল্পী নন্দলাল বসু । রোদেনস্টাইনের ব্যক্তিগত পরিচয় হয় এঁদের সঙ্গে এবং সেই সুত্রে ওই একই বছরে তিনি কলকাতায় আসেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে । জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে এসে অবনীন্দ্রনাথ ছাড়াও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে রোদেনস্টাইনের । এরপর ১৯১২ সালে যখন ইউরোপে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ , তখন ইংল্যান্ডে রোদেনস্টাইনের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব প্রগাঢ় হয় এবং রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি প্রতিকৃতিও এঁকেছিলেন তিনি । এরই একটি পরবর্তীকালে গীতাঞ্জলীর ইংরিজি সংস্করণের সঙ্গে ছাপা হয় । কিন্তু ১৯২৬ সালের পর রবীন্দ্রনাথ ও রোদেনস্টাইনের মুখোমুখি আর দেখা হয় নি । কাজেই ১৯৪১ সালে রোদেনস্টাইনের পক্ষে মৃত্যুশয্যায় রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকার কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না ।
    এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে যে ছবিটিকে ‘মৃত্যুশয্যায় রবীন্দ্রনাথ’ বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে সেই ব্যক্তিটি আসলে কে ? এই ব্যক্তির পরিচয় দেওয়ার আগে একটা তথ্য দেওয়া দরকার । ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ইংল্যান্ডের একদল লেখক-শিল্পী-স্থপতি- নকশাকার মিলে একটি বিশেষ শিল্প ধারা গড়ে তুলেছিলেন । এই ধারার নাম ‘প্রি রাফেলাইট’ শিল্পধারা । এঁরা মনে করতেন শিল্পী রাফায়েল এবং মাইকেলএঞ্জেলো যে বিশেষ শিল্পধারার প্রচলন করেন তা আসলে শিল্পের মানের অবনমন ঘটিয়েছে । রাফায়েল প্রবর্তিত ধারার অনুসরণকারী ইংল্যান্ডের প্রখ্যাত চিত্রকর স্যার জেশুয়া রেনল্ডস ও রয়্যাল একাডেমীতে চর্চিত শিল্পের বিরোধীতা করেন এই ‘প্রি রাফেলাইট শিল্পীরা । রাফায়েল পূর্ববর্তী শিল্পকেই আদর্শ বলে মনে করতেন এঁরা । এই ‘প্রি রাফেলাইট ধারার একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন ইংল্যান্ডের নকশাবিদ, লেখক, কবি, স্থাপত্য বিশারদ উইলিয়াম মরিস । ইংল্যান্ডের সংস্কৃতি জগতের অত্যন্ত সম্মানীয় এই ব্যক্তিত্ব ১৮৯৬ সালে বাষট্টি বছর বয়েসে পরলোকগমন করেন । উইলিয়াম মরিস যখন গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় মৃত্যুশয্যায় শায়িত তখন তাঁর একটি প্রতিকৃতি অঙ্কন করেছিলেন প্রিরাফেলাইট ভাবধারায় অনুপ্রাণিত আর এক শিল্পী চার্লস ম্যুরে । ১৮৯৬ সালের ৪ঠা অক্টোবর তারিখে আঁকা (স্পষ্ট করে ছবির উপরের ডান দিকের কোণে লেখা আছে) এই ছবিটিকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘মৃত্যুশয্যায় রবীন্দ্রনাথের বিরল ছবি’ বলে বেমালুম চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে । একই সঙ্গে এই ছবির শিল্পী হিসেবেও রোদেনস্টাইনের নাম উল্লিখিত হচ্ছে চার্লস ম্যুরের পরিবর্তে ।
    লেখাটা হয়তো এখানেই শেষ করে দেওয়া যেতে পারতো । কিন্তু এই অদ্ভুত তথ্যবিকৃতি যে কিভাবে ঘটলো , সে বিষয়ে স্বভাবদোষেই কিছুটা ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি না করে থাকতে পারছি না। প্রথমেই যেটা বলা দরকার তা হল রোদেনস্টাইনের আঁকা রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতিগুলি এবং চার্লস ম্যুরের আঁকা উইলিয়াম মরিসের প্রতিকৃতি উভয়েই রয়েছে লন্ডনের টেট গ্যালারীর স্থায়ী সংগ্রহে । এখন সিধু জ্যাঠার সঙ্গে গুগল জ্যাঠার তথ্য সরবরাহ করবার কিছু মৌলিক পদ্ধতিগত পার্থক্য রয়েছে । টমাস গডউইন বিষয়ে বলতে গিয়ে কিন্তু সিধু জ্যাঠা প্রথমেই সচেতন করে দিয়েছিলেন যে শেলির শ্বশুর গডউইনের সঙ্গে এঁকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না, এঁরা আলাদা ব্যক্তি । দুর্ভাগ্যবশত আমাদের সর্বজনপ্রিয় গুগল জ্যাঠা এই কাজটি করেন না । ফলে যখনই তার কাছে জানতে চাওয়া হয় উইলিয়াম রোদেনস্টাইনের আঁকা রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি সম্পর্কে , তিনি খুলে দেন টেট গ্যালারীর সংগ্রহশালা। কিন্তু উইলিয়াম নামটি তাঁর যন্ত্র মগজে ফিড হয়ে যায়, ফলে ওই একই তালিকায় গুগল জ্যাঠা মেলে ধরেন উইলিয়াম মরিসের মৃত্যুশয্যার ছবি । যারা ফিলোজফিতে লজিক পড়েছেন তাঁরা মনে করতে পারবেন সেই চারিপদ ঘটিত দোষের বিখ্যাত উদাহরণটির কথা, যেখানে রামছাগল এবং রবীন্দ্রনাথ দুজনেরই দাড়ি থাকার কারণে ‘রবীন্দ্রনাথ ছিলেন রামছাগল’ এই উদ্ভট সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছেন একজন কেউ । এক্ষেত্রে পরিস্থিতি তার চেয়ে অনেক বেশী আশাপ্রদ । রোদেনস্টাইনের আঁকা রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেল মৃত্যুশয্যায় শায়িত এক সাদা দাড়িওয়ালা বৃদ্ধের ছবি । ব্যাস আর তবে কেন মিছে খোঁজ করে দেখতে যাওয়া ইনি আসলে কে । নির্দ্বিধায় চাপিয়ে দাও উধোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে । তারপর তো রয়েইছে বাঙ্গালীর আবেগাপ্লুত মনন, আছে দুঃখ , আছে মৃত্যু , বিরহ দহন লাগে ... আছে কান্নার , ভালোবাসার, বিস্ময়ের ইমোজি , আছে শেয়ার অপশান । আর আছে ভুল তথ্যে হাবুডুবু খেতে খেতেও সঠিক তথ্যকে উড়িয়ে দিয়ে এঁড়ে তর্ক করে যাওয়ার চিরকালীন স্বভাব যা আমাদের শিখিয়েছে ‘বিশ্বাসে মিলায় রবীন্দ্রনাথ , তর্কে বহুদুর’ ।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ০৭ আগস্ট ২০২০ | ৩৮৪৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • π | ০৮ আগস্ট ২০২০ ১৫:১৯96057
  • আরো কত যে এরকম ছড়িয়েছে! ঃঃ(

    যাহোক, লেখাটার জন্য অনেক ধন্যবাদ!
  • নির্মাল্য নাগ | 115.187.37.161 | ১০ আগস্ট ২০২০ ১২:৪৭96125
  • ভাল লাগল।   

  • | ১০ আগস্ট ২০২০ ১৫:৫৭96136
  • হুঁ এরকম গাদা ফেকছবি ছড়ায়। আরেকটা খুব জনপ্রিয় ছোট সত্যজিত রবীন্দ্রনাথের সাথে বলে, ওটাও ফেক।
  • b | 14.139.196.11 | ১০ আগস্ট ২০২০ ১৮:৩০96138
  • "ছোট সত্যজিত" হলেন অভিজিত চন্দ, রাণী/অনিল চন্দের ছেলে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন