এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা

    Yashodhara Raychaudhuri লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১৩ মে ২০২০ | ২৮৬৯ বার পঠিত
  • রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা
    যশোধরা রায়চৌধুরী

    পাত্রপাত্রী পরিচয় ঃ
    নায়ক নায়িকা-
    শশধর বাবু, জেন্ডারে নারী কিন্তু আত্মায় রবিনসন ক্রুসো, বসবাস কর্মস্থল ভুবনেশ্বর, ও
    তাঁহার পরিবার পরিজন, কলিকাতাস্থ বাটীতে। ঘনিষ্ঠ তম আত্মজন "জাতিস্মর" মহাত্মা তৃণ, (কেন জাতিস্মর কিছু পরে জানা যাইবে), দার্শনিকতায় প্লেটো বুদ্ধ ও উইটগেনস্টাইনের যোগফলকে তিন দিয়া ভাগ করা এক্স ফ্যাক্টর , ও স্বীয় অস্থিমজ্জার অংশ কোকিলাবেন, বিংশতিবর্ষীয়া, সবুজচুলো পিক্সিকাট।
    পার্শ্বনায়ক -
    কেন্দ্র সরকার
    ওড়িশা সরকার
    পশ্চিমবংগ সরকার
    ( এই তিন চরিত্রই আসল, নায়ক নায়িকা দেব কোয়েলের ন্যায় ডিস পেন্সেবল। পার্শ্বনায়ক রা কখনো পরিত্রাতা কখনো ভগবান কখনো ভিলেন। কেহ রজতাভ কেহ কমল মিত্র কেহ ছায়া দেবী। ইহাদের আকর্ষণেই হল ভর্তি হয়)
    মূল প্রতিনায়িকা - ক্রুয়েলা ডেভিল করোনাদেবী
    পশ্চাদ্ পটঃ
    ডিসেম্ব্র ১৯ থেকে করোনাদেবীর আত্মপ্রকাশ , চিনা মাতা নামেও ইনি সুপ্রসিদ্ধা ও করালবদনা। ইনি এমন সর্বস্ব ধ্বংস কারিকা যে শশধরা বাবুও স্মৃতিভ্রষ্ট হইয়া এঁর নাম করতে ভুল্যা গ্যাসেন প্রথম ড্রাফটে। এর ভয়ে থরহরি কম্পমান দ্যাবা পৃথিবী। তবে এই মাতাকে তুষ্ট বা নষ্ট করার নানা উপায় থাকলেও বিবিধ উপায়ের মধ্যে শঙ্খ ঘন্টা আদির পাশাপাশি তালাবন্দি বা লকডাউন নামক এক বিধান আছে। ভারত এই তালাবন্দি বিধান চিরকাল বিশ্বাস করেছে। উদাহরণ - ভুলভুলাইয়া নামক হিন্দি চিত্র। (অক্ষয়কুমার শোভিত। )

    পর্ব ১

    লকডাউন ভার্শান ১.০ ছিল, ২৪ মার্চ থেকে ১৪ এপ্রিল অব্দি। ভদ্রমহোদয়গণ আপনাদের স্মরণে থাকবে যে তার আগে ২২ মার্চ ছিল জনতা কারফিউ ও থালা বাজানোর মওকা। ওড়িশা সরকার, নবীন বাবু, ২১ রাত থেকেই রাজ্যের লকডাউন ঘোষণা করেছেন। শশধরবাবু নবীন প্রশস্তি গাহিলেন। জানেন না ইহাই বাঁশঝাড় হইবে কিয়দ্দিন পর।
    তার ও আগে ১১ মার্চ দোল যাত্রার ছুটি কাটিয়ে ফিরে গিয়েছেন শশধর ভুবনেশ্বর। করোনাভীতি তখন তুংগে এবং ওয়াটস্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম বিবিধ ষড়যন্ত্র তত্বে পরিপূর্ণ। ২২ হইতে, মিডিয়া চীৎকৃত করোনাভয়প্রচারক প্রোগ্রাম সমূহে পরিপূর্ণ। অথচ বাগিচা কোকিল দোয়েলের চীৎকারে গুঞ্জিত। আশ্চর্য বৈপরিত্য। আঙিনায় ময়ূর নাচানাচি করিতেছে নানা শহরে, চিতাবাঘ রাস্তা পার হইতেছে নির্ভয়ে। অথচ বাঘা সরকারি কর্মীরা সব বাড়িতে বন্দী। wfh শব্দবন্ধ খুব টি আর পি পাইল। উহা প্রায়শই গুলাইয়া যায় যে শব্দবন্ধের সহিত তাহার অর্থও অতি নিকটবর্তী। তাহা wtf.!!!!!!
    শশধরের এদিকে একাকিত্ব, ওদিকে অনিশ্চিতি। এক বৎসর আগের ফণির দিন মনে পড়া অনিবার্য।
    তফাত এই যে বিজলিবাতি ও নেট আছে। নেট অবশ্য ঠিকে ঝির মত আসা যাওয়া করে এবলা ওবলা।
    রবিনসন ক্রুসো সত্ত্বা তুংগে। রোজ নব নব আবিষ্কারে মত্ত শশধর। কিছু ফেলা যাবে না, অল্পে সন্তুষ্ট হতে হবে। রাঁধাবাড়া দারুণ এক্সপেরিমেন্টাল। লাউ দিয়ে মাংসের ঝোল রাঁধা বা বাগানের বিবিধ ছেঁড়া ফাটা ফল মূল, শেষ বেলার পালং আর শীর্ণ ইঁচড় দিয়ে কাজ চালাবেন। সব জিনিস রোদ্দুরে এনে ফেলবেন।
    শুধু রাত্রে ঘুমে আলুর ট্রাকে চেপে কলকাতা পালানোর স্বপ্ন দেখেন। ট্রাক ড্রাইভারের হেল্পার সেজে বা আলুর বস্তার তলায় লুকিয়ে।
    এদিকে ওয়ার্ক ফ্রম হোম। দুপুরে ভীত ও বাসন মেজে ক্লান্ত দেহে যখন শোব শোব ভাবছেন, দিল্লি ফোন করে বলছে অডিট রিপোর্টে কী কী ঢুকবে তার তালিকা পাঠাতে।
    এদিকে বিষের সংগে খোঁজ নেই। ওদিকে কুলোপানা চক্কর। ফিল্ড ফর্মেশন সব বন্ধ। নো অডিট পার্টি। কারণ ওড়িশা সরকার সম্পূর্ণ লকডাউনে। যেখানে মূল ক্রিয়াকর্ম বন্ধ সেখানে তার অডিট হবে কী!!

    পর্ব ২

    এই উপন্যাসের ভাষা ও ভাব হাস্য রস সিঞ্চিত কেন, অনেকে প্রশ্ন তুলিতেছেন। তাঁহাদের নিকটে আমার প্রশ্ন, স্বনামে, পাত্র পাত্রীকে নির্দিষ্ট করিয়া লিখিলে অনেকের গুসসা হইবার সম্ভাবনা, সরকারি চাকুরেমাত্রই জানেন কন্ডাক্ট রুলে আটকাইবে। হাস্যকৌতুকের বর্মাচ্ছাদন বড়ই সুবিধাজনক। সহজে ক্যাঁক করিয়া ধরিবার পূর্বেই পাখি পলাইয়া যায়। উপরন্তু ইতিমধ্যেই শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় থাকা পাঠকের আপাত মুক্তি ঘটে।

    এই আপাত কৌতুকের অন্তরালে কী প্রচন্ড দুর্বহ দৈনন্দিনতার পাঁচালি আছে তাহা গুণী ও সহৃদয় মাত্রেই বুঝিবেন।

    যাহা হৌক, মূল গল্পে প্রবেশ করা যাউক। মূল গল্পে দেশ কাল ও আমাদের পাত্রপাত্রীরা এমন ভাবে জড়াইয়া আছেন যে কোনটা পার্সোনাল কোনটা পলিটিকাল বোঝা যাইতেছে না।

    ২১ মার্চ থেকে রাজ্য ও কেন্দ্রের লকডাউন লকডাউন খেলা শুরু হল। প্রথমে রাজ্য বলে টুকি, আমি করে দিলাম বন্ধ আমার সকল দরজা, খুকি!

    তখন কেন্দ্র বলে তাইত, রাজ্য বলছে চাইনা যাতায়াত। তবে থাকুক ট্রেন বন্ধ আর বন্ধ হোক বিমান গতায়াত। একে একে সমস্ত বন্ধ হল, গাড়ি ঘোড়া, বাইক, ট্রেন , প্লেন। ফাঁকা রাজপথে ক্রিকেট খেলাও।

    একটি মিডিয়া রিপোর্ট বলিতেছে ভারত আবার লাইসেন্স রাজে ফিরিয়া গিয়াছে। ২০২০ ও করোনামাতা আমাদের সমূলে বর্তমান হইতে উৎপাটিত করিয়া অতীতে নিক্ষেপ করিয়াছে। এখন আবার তেলের লাইন জলের লাইন পাউরুটির লাইন। রেশনের জন্য অধীর অপেক্ষা ইত্যাদি। বাজারে আজ রুটি আছে ত মাখন নাই। কাল মাখন আসিলে তাহা পাঁচশো গ্রামের প্যাকেট । একশো গ্রাম চাহিলে উপায় নাই। তিনশো টাকায় বড় প্যাকেট ই লইতে হইবে।

    একটি হিসাব বলিতেছে , মার্চ হইতে ৬৬০ টি সরকারি বিজ্ঞপ্তি আনিয়াছে কেন্দ্র সরকার। এবং ৩৫০০ সরকারি বিজ্ঞপ্তি সবকটি রাজ্য সরকার মিলিয়া। শশধর বাবুর স্মরণে আছে যে উড়িষ্যা সরকারের বিজ্ঞপিপত্র প্রায় পর্বতপ্রমাণ, এবং কেন্দ্র সরকারের ততোধিক। এই সব তাঁহার মোবাইল ফোনে ওয়াটস্যাপ মাধ্যমে আসিয়া তাঁহার মোবাইল ক্র্যাশ করিয়া দিয়াছে একাধিক বার।

    করোণামাতার কৃপায় ডাবলিং রেট শব্দটি অতি প্রচল ইদানীঙ। আজ যতজনের করোণাকৃপা ঘটিয়াছে, তার ডবল বা দ্বিগুণ জনের করোনা আক্রান্ত হইবার মধ্যে কটি দিনের ফারাক? ইহা দ্বারা গণৎকারগণ পাটি পাতিয়া বলিয়া দিতেছেন কতদিনে ভারতের সব লোক আক্রান্ত হইবে।

    তা, শশধরবাবু ও তাঁহার বন্ধু জামিলা কামিলা সোপ্রানো নন্দানো প্রমুখ প্রায়ই আলোচনা করেন, যে, সরকারি বিজ্ঞপ্তির ডাবলিং রেট করোনার ডাবলিং রেটের অধিক দ্রুত। তিন চার দিনেই ডবল হইতেছে।

    ২১ দিন দ্রুত কেটে গেল রবিনসনগিরি করতে করতে। গাছ থেকে আম পেড়ে সেই আম কেটে খর রোদে দিয়ে সেই আমকে আচারে পরিণত করা হল। তারপর ইঁচড়ের পরোটা, ছোলার পায়েস ইত্যাদি বানানো হল। প্রচুর কেক বেক করা হল, প্রচুর অমূল্য দুধের গুঁড়ো আর কনডেন্সড মিল্ক ধ্বংস করে পিঠা বানালেন শশধর, তার অর্ধেক এত ভুলভাল হল, যে ইঁটের মত শক্ত, খাওয়াই গেল না।

    ইতিমধ্যে বংগ সরকারের নিন্দায় কান পাতা যায়না। ছায়াদেবী প্রথমে প্রশংসা কুড়ালেন তারপর নিন্দা । কেননা তিনি মিষ্টির দোকান খুলে দিয়েছেন, এইদিকে মহিলারা এতদিনে রসগোল্লা ঘরে বানানোর আর তার ছবি দেবার কম্পিটিশনে ব্যস্ত ফেসবুক জুড়ে।

    ক্রমশ সংখ্যা বাড়ছে আক্রান্তের । ক্রমশ কাছে আসছে মৃত্যুর পদধ্বনি। গাঢ় থেকে গাঢ়তর পোঁচে আঁকা ছবিগুলিতে এবার পড়ছে নানা রং। হয় করোনা নয় ক্ষুধায় মরো না, বলে এক পালা খুব ভাল কাটতি পাচ্ছে। লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক বাচ্চাকাচ্চা সহ হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিতে পথে নেমেছেন, তাঁরা কেউ লাঠির বাড়ি খাচ্ছেন, কেউ জল খাদ্যের অভাবে ঝরা শিউলির মত শুকিয়ে ঝরে পড়ছেন পথে পথে।

    শশধরবাবুর নিজের খাস আর্দালি যেদিন শশধরবাবুর জন্য ডিম কিনতে গিয়ে পুলিশের লাঠির বাড়িটি খেয়ে আসতে পারল না, সেই দিন শশধরবাবু প্রথম কেঁদে ফেলল। ফোন করে মহাত্মা জীবনবান্ধবকে বলল, আমি ত আর পারিনা!

    আর কত সেলাই করা, আর কত আমের আচার! আর কত কাব্য লেখা, খবরে মজুর মৃত্যুর ছবি দেখা। ডিনায়াল মোডে আছি। কিন্তু আর ত সয় না প্রাণে! সখা হে আমাকে উদ্ধার করহ।

    পর্ব ৩
    জীবনবান্ধব বলিলেন, রোসো। রুশো কী বলিয়াছেন শুনহ। আর কনফুসিয়াস ও, বুদ্ধও, বলিয়াছেন বর্তমানে বাঁচ। একটি করিয়া দিন কাটাও।
    শশধর কহিলেন - না আ আ আ আমি এখন দর্শন শ্রবণ করিব না। আমি বাড়ি যাব। ভ্যাঁ ভ্যাঁ ভ্যাঁ।
    জীবনবান্ধব মহাত্মা মানুষ। বলিলেন, ধৈর্যং রহু। আর, তোমার ত তিন বছরের পোস্টিং বিগত প্রায়। আর কদিন ই বা তোমাকে রাখিবে কেন্দ্র। তুলিবেই ত! কাজেই সেই কয়দিন দাঁতে দাঁত দিয়া থাক। দুপুরে নেটফ্লিক্স ও রাতে আমাজন প্রাইম দেখ।
    ইতিমধ্যে ক্রাইসিস ঘনীভূত। সমস্ত দেশের অর্থনীতি এক মন্দা আক্রান্ত অবস্থায়। কে না জানে যে মন্দায় ধর্ম, দর্শন, গুরুবাদ ও হিন্দি সিনেমার কাটতি হয়।
    ধার্মিকগণ বলিল, ভিন্ন ধর্মের সব দোষ। করোনামাতা কুপিতা না হইবেন কেন, বলিতে লাগিল সনাতন ধর্মের লোক আড়চোখে অপরকে দেখিয়া। যেকোন বিধর্মীকে দেখিলে করোনাদুষ্ট ভাবিতে শুরু করিল সবে। যে কোন চিনাচেহারার উত্তর পূর্বাঞ্চলীয়কেও।।কোন বহিরাগতকে দেখিলে সন্দেহ। যে কোন ডাক্তার নার্স কে গৃহ হইতে তাড়ানো। এইসব হইতে লাগিল। মানে মনুষ্য সমাজের যত আদিম সদ্‌ গুণ ছিল সব উদ্ভাসিত।
    লকডাউন ভার্শান ১.০ থেকে ক্রমে আমরা লকডাউন ভার্শান ২.০ তে আসিলাম৷ এবার মোমবাতি হাতে ধরাইয়া ৩ মে অব্দি এক্সটেন্ড। পথ দেখাইলেন নবীন বাবু। তাঁহার চার কোটির রাজ্যে তখন সংখ্যা ৮৫ হইতে ৯০। কী বিশাল লাফ!! সুতরাং তিনি গলা বাড়াইয়া বলিলেন টুকি, লকডাউন বাড়িয়ে দিলাম এবার বেরোও দেখি!
    কেন্দ্র সুযোগ পাইয়া, রাজ্য চাইতেছে রাজ্য চাইতেছে বলিয়া ভীষণ রাজ্যদরদি হইল। এদিকে শশধর মূর্খের মত ১৭ এপ্রিলের প্লেনের টিকিট জীবন বান্ধবকে না জানাইয়া কাটিয়া বসিয়া আছে। ফাঁকেতালে ক্যান্সেল। ইতি পূর্বে আরেক সেট ২৭ মে-র টিকিট ক্যান্সেল হইয়াছিল।
    শশধরের ন্যায় মূর্খ কি আর আছ? ওই কয়েক কোটি ভারতবাসী যাহারা রেলের টিকিট কাটিয়াছিল বাড়ি যাব বাড়ি যাব বলে৷ ১৪ এপ্রিলে। তা কী ক্যান্সেল হয় নাই?
    দুর্জনে বলিয়া থাকে, মাত্র ৬৭ কোটি টাকা নাকি রেভিনিউ করিয়া ফেলিয়াছে রেল কোম্পানি সবার কুড়ি টাকা ক্যান্সেলেশন ফি কেটে। সব বাতিল।
    মুম্বই স্টেশনে সেই মূর্খ ভারতবাসী, খাটিয়া খাওয়া ভারতবাসীর কী হইয়াছিল, দেখেন নাই? ভিডিও দেখিয়া লইবেন।
    পর্ব ৪
    সুতরাং ভালোই বন্দোবস্ত হইল। একবার করিয়া লকডাউন এক্সটেনশন হইবে, শশধর ডুকরাইয়া উঠিবেন, মহাত্মা তাঁহাকে আশ্বস্ত করিবেন গীতার নিষ্কাম কর্ম বলিয়া, ইতোমধ্যে সরকার বাহাদুরের অপরূপ দূরদৃষ্টির ফলে আরো কটা মজুর মরিবে এবং আবার হা হুতাশে পাড়া মাত।
    যেন কলে চাপা পড়িয়া, না খাইয়া, আলুর ফলন খারাপ হইয়া বা ঋণ না শুধিতে পারিয়া আগে মানুষ মরে নাই। শশধরদের দরদ যেন কতই ছিল। ইতিমধ্যে মধ্যবিত্ত বাঙালি পূর্ণিমা চাঁদ ও ঝলসানো রুটির ছবি সাঁটাইতেছে কিন্তু ফুল স্যালারি গোটা এপ্রিলে কাজ না করিলেও কাজের লোককে দিতে হইবে ভাবিয়া বুক ফাটাইতেছে। কতজন এই দুঃখ সহিতে না পারিয়া লোক পুনর্বহাল করিলেন। এদিকে কত উচ্চ পদস্থ স্যালারিড ব্যক্তির স্যালারি হইল না।
    আবার কত লোক একের পর এক স্ত্রীঘটিত জোক্স বানাইয়া বাজারে ছাড়িয়া দিলেন। কত লোক বিবিধ প্রতিষ্ঠানে অভাবী বেরোজগারের জন্য নিজ দানের পরিমাণ লিখিয়া পেশ করিলেন।
    মহাত্মা বলিলেন৷ হে শশধর, শ্রবণ করহ। তুমি খাইতে পাও, মাথার উপর অটুট ছাত বর্তমান। স্যালারিও পাইলে। ক্রন্দন তোমাকে সাজেনা। তোমার ন্যায় প্রিভিলেজপ্রাপ্ত বাড়ি যাব বাড়ি যাব ক্যান করে?
    দিল্লি ধুয়া ধরিল, ক্যান করে? ক্যন করে?
    ওদিকে দিল্লি তলব দিল। ভিডিও কনফারেন্সে আইস। আপিস খুলিতে হইবে। আপিচর গণ পুরা ও স্টাফগণ ৩৩% আসিবে। লকডাউন ভার্শান ২.০ জগত মধ্যে সর্বাপেক্ষা কর্মময় লকডাউন বলিয়া ঘোষিত প্রতিষ্ঠিত ও খ্যাত হইবে। তোমার সকালে বাসন মাজা ও ঘর মোছার পরে তুমি অফিসে গিয়া কাজ বা কাজের ভাণ করিবে, মুখোশের আড়াল হইতে কথা বলিবে ( জানি, এতদিন ও তাহাই বলিতে, রূপককে আমরা বাস্তব করিলাম মাত্র) ও ফিরিয়া আসিয়া সব জামাকাপড় গরম জল সাবানে দিবে।
    ফুল স্যালারি পাও, বাড়ি যাব বাডি যাব করিবে না। অত্যন্ত এক্সট্রা অর্ডিনারি সারকামস্ট্যান্সেস না হইলে লকডাউনে কেহ ছুটি নিবে না। আর যাহারা যাহারা ছুটিতে ছিলে তাহারা ছুটিতেই থাকিবে।
    এমতাবস্থায়, শশধরের সহকর্মিনী বাঙালিনি সেই যে ছুটিতে কলিকাতা গিয়াছিলেন, তিনি আর ফিরিতে পারেন নাই। সেই আপিসের চার্জ শশধরকে আগে ৩ মাস দেখিতে হইয়াছিল, পরে আরো কতদিন দেখিতে হয় কে জানে। নিজেকে ভারবাহী গর্দভের ন্যায় মনে হইতেছে। সহকর্মিণীর প্রতি ঈর্ষা তুঙ্গে উঠিয়াছে।
    শশধর স্বপ্নে ভুয়া মেডিকাল সার্টিফিকেট দেখিতে লাগিলেন। দেখিলেন তাঁহার মাথার টিউমার বা পেটে কষ্টিপাথর বা যাহা যাহা মনুষ্যের চোখে দেখা যায় না তাহাই হইয়াছে বলিয়া ডাক্তার লিখিয়া দিয়াছে ও তিনি অ্যাম্বুলেন্স ম্যানেজ করিয়া কলিকাতার পথে।।।
    কিন্তু অ্যাম্বুলেন্সের কথা ভাবিলেই বুক ধড়ফড় করে। করোনামাতার দয়া যদি ছিটেফোঁটা থাকে উহাতে?
    আর, গেলেও আবার ছুটি অন্তে ফিরে আসতে ত হবে!! তাহলে!!

    পর্ব ৫
    ধৈর্যচ্যুতি ঘটিতে পারে তাই বার বার লকডাউনের দিনপঞ্জি লিখিতে চাহিনা।
    সবার যে একভাবে লকডাউন পালন হয় নাই কে না জানে। প্রিভিলেজ এর ব্যাশকম আছে। কিন্তু লক্ষ করলে নিশ্চিত দেখা যাইবে যে কোটাপুরণ সকলের হইতেছে।
    যথা, কোকিলাবেন কোনদিন গৃহকর্ম করে নাই। তাহার অভ্যাস হইয়া গেল ঘর মোছা। মহাত্মা কোনদিন বাসন মাজেন নাই। তিনি এখন সাবান প্রস্রবণে স্নাত হইয়া বাসন মাজিতেছেন ক্রমাগত। সে কী তৃপ্তি, জন্মের বাসন মাজিয়া লইবেন।
    শশধরের আড়াই দিন ঘরে থাকা সহে না। তিনি শপাহলিক। সপ্তাহে তিন দিন কাছারি হইতে গৃহে সরাসরি ফিরিবার অভ্যাস নাই। আজ গ্রসারি ত কাল উইন্ডো শপিং। পরদিবস ভুবনেশ্বর ইউনিট দুইতে চুলের কিলিপ ও লেসের ফিতা খুঁজিতে যান। পথ পার্শ্বস্থ বাজার হইতে অলিগলি, খাদি কেন্দ্র হইতে ঝাঁ চকচকে শপিং মল সর্বত্র ঘুরিবেন।
    সেই বাবুটি আজ করোনামাতার দাক্ষিণ্যে জুজু। ফেব্রুয়ারিতে শেষ বাজার গিয়াছিলেন। এখন সব দোকান বন্ধ। গৃহবন্দিত্বের কোটা পূরণ হইয়াছে শশধরের।
    সব কষ্ট মানা যায়, শুধু ফুচকা ও ঝালমুড়ির জন্য প্রাণ কাঁদে। এও ভাবেন, তাঁহার প্রিয় ফুচকাওলা ও ঝালমুড়ি ওলারা করিতেছে কী? যাহাদের দিনগত রোজগারে অন্ন আসে। ফোন তুলিয়া ফোন করেন হাজরাস্থিত বস্তির বিশালদেহী কিন্তু বালকতুল্য বুদ্ধির শংকুকে। উহার বৌদি রোজ টাকা রোজগার না করিয়া আনিলে তাহাকে ভাত দেয় না সচরাচর, তাই শংকু এর বাড়ির কলতলা ঝাঁট দিয়া ওর বাড়ির ময়লা পরিষ্কার করিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া টাকা রোজগার করে। আজ সেও গৃহে। বৌদি বলে, ফ্রি পায় নাই তবে রেশন দোকানে লাইন দিয়া রেশন মিলিয়াছে। শংকুকে ফোন ধরাইলে শংকু জানায়, টাকা পাঠান দিদি, টাকা না হলে খাব কী। উহার কন্ঠ শুনিয়া ধড়ে যেন প্রাণ আসে। শশধর বলিয়া ফেলে, এই নাম্বারে পে টি এম আছে? শংকু বোঝে না! শশধর জিভ কাটিয়া ভাবে, ইহার নাম ডিজিটাল ডিভাইড।
    ডিজিটাল ডিভাইডের ফাঁকে ফাঁকে পড়িয়া মরিতেছে ছাত্রেও। যাহার ফোর জি আছে সে সতত অনলাইন ক্লাসে, তাই সতত অ্যাহেড। যাহার নাই সে হোস্টেল ছাড়িয়া দেশ গাঁয়ে ফিরিয়া বোকা হইয়া থাকিবে।
    এদিকে করোনা আগমনের গুরুগুরু ধ্বনি ক্রমশ যুদ্ধ দামামা হইয়া বাজে। ক্রমে রাজ্যে রাজ্যে বিভেদ আনিতেছে করোনা।
    করোনা পূর্ব কালে, প্লেন উপচাইয়া পড়িত উড়িষ্যাগামী বাঙালি টুরিস্ট। বারমুডাশোভিত বৃহৎ উদরের দাদা, শাড়ি ছাড়িয়া টপাস করিয়া টপ জিন্স পরা বৌদি, মাথায় স্ট্র হ্যাট। আর নেট স্যাভি বালক বালিকা প্লেনে উঠিয়া কোনার্ক পুরী চিলিকা বৃত্তান্ত আলোচনা করিত আর নয়ত ফোনে গেম খেলিত।
    কথিত আছে পুরী বাঙালিদের সম্পত্তি। মিথ্যা নহে। পুরীর অর্থনীতি বং টুরিস্ট নির্ভর বটেই।
    ইদানীং আরো আছে কিট ও কিম, সোয়া ও সাম, আরো অজস্র বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালি ছাত্রদল। সবার সংগে শশধর বাবুর দেখাসাক্ষাৎ এয়ার এশিয়ার বাজেট ফ্লাইটে। গিস গিস করিত উড়িষ্যা আগমনকারী বাঙালি।
    ইদানীং দুই মাস যাবত কোথায় সেই বাঙালি আর কোথায় উড়িষ্যার অর্থনীতি চাংগাকারী বাঙালির প্রতি প্রীতিপূর্বক সম্ভাষণ।
    কেবলই নীরবতার মাঝে মাঝে দাঁড়ি সেমিকোলন এর ন্যায় ভীতিকর টুইট আসে। পুলিসের কমিশনার বা চিফ সেক্রেটারি সহসা মধ্য রাতে জানান, উড়িষ্যায় ১০০ ক্রস করিল করোনা আক্রান্ত। কেননা পশ্চিম বংগ হইতে আসিয়া পড়িয়াছে এক দল করোনাবাহক ব্যাক্তি।
    কেহ বলে না ইহাদের ডেমোগ্রাফি। ইহারা মূলত উড়ষ্যাবাসী, না কি বাঙালি? শুধু গ্রামে গ্রামে বার্তা রটিল, শেষাবদি west bengal returnee মানেই ভয়াবহ ব্যাপার।
    বর্ডার ক্রস করিলেই হাতে কোয়ারান্টাইন ছাপ্পা পড়িবে। কোয়ারান্টাইন সেন্টারে অর্থাৎ ফাঁকা স্কুল বাড়িতে রাখা হইবে west bengal returnee গণকে। খবরে প্রকাশ তাহার ভিতরে ১৫০ জন খারাপ ব্যবস্থা দেখিয়া পলাইয়াছে। তাহার ভিতরে খুঁজিয়া খুঁজিয়া ৫০ জনকে আবার ধরিয়া খাঁচায় পোরা হইয়াছে।
    এইসব খবর সচরাচর রাতের দিকে আসে। আর সারারাত ঘুমান না শশধর। চিরুনি চালাইলে ঝপাৎ করিয়া এত্ত চুল পড়ে৷ খাবারে স্বাদ নাই। হাত ধোয়া একমাত্র ব্যসন।
    সর্বাপেক্ষা দুঃখ, কেহ তিনি কলিকাতা ফিরিবার নাম করিলে আঁতকাইয়া ওঠে।
    ওড়িয়া বলে ওরে বাবা ওখানে রোগ খুব ছড়াইতেছে। যাইবেন না।
    বাঙালি বলে ওখানে তুই ভাল আছিস খুব। একদম খারাপ অবস্থা আমাদের এখানে। আসিস না।
    শশধর ভাবেন ওগো মরণ হে মোর মরণ, আমি যে তোমাকেই প্রিয় বলিয়া জানিয়াছি!
    পর্ব ৬
    একদিকে এই অবস্থায় গোটা ভারতের সংখ্যা বাড়িতেছে, অন্যদিকে রাজ্যগুলির সংখ্যা। আর প্রতি রাজ্য বলিতেছে, আমার বর্ডার ক্রস করিয়া করোনারুগি আসিতেছে ভিন রাজ্য হইতে।
    অনুভব হইল, এ আসলে এক মহাদেশ। প্রতি রাজ্য এক এক স্বকীয় সীমাবিশিষ্ট দেশ। বর্ডার ক্রস করিতে ভিসা পাসপোর্টের জরুরত হয়। বে আইনি অনুপ্রবেশের সম্ভাবনায় সবাই সংগীন উঁচাইয়া আছে।
    বর্ডার ক্রশ করিতে গেলে লাঠিপেটা, জেল, শুট অ্যাট সাইট ইত্যাদির ভয়। আলুর ট্রাকে উঠিলে নিস্তার নাই। খবরে শশধর পড়েন, কত জন পরিযায়ী শ্রমিক সিমেন্ট মিক্সারের খোঁদলে লুকাইয়া ঘরের ছেলে ঘরে ফিরিতে গিয়া ধরা পড়িয়াছে। মাথার উপর হাত তুলিয়া বাহির হইয়া আসিতেছে তাহারা এমন ছবিও ভাইরাল।
    শশধর এইসব ভাবেন আর বক্ষ দুরুদুরু কম্পিত হয়। কোনদিন কি আর বাংলা উড়িষ্যার সীমানা পার হইবেন?
    এতদিন উড়িষ্যা বাংলাকে বিশ্বাস করিতে ছিল না। এবার বাংলার প্রত্যুত্তর, সমস্ত বর্ডার বন্ধ। হুঁ হুঁ বাবা, আমাদের দোষারোপ আর লুকিয়ে আমাদের রাজ্যেই করোনা আশীর্বাদ ধন্যদের ঢুকিয়ে দেওয়া? নেহি চলেগা।
    শামলা মাথায় কাচারি যান বটে, তবে শশধরের প্রাণে মাঝে মাঝে সাহিত্যের বাই ত চাপিত। তাই সে সাহিত্য কীর্তি স্থাপন করিয়া তিনি দিল্লি তে।চিঠি ছাড়েন।তিন বৎসরের বনবাস যাপনের চিত্র আঁকেন সযত্নে। ক্রন্দনের বেগ খুব শব্দের মাধ্যমে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল। যে পড়িবে সে বিচলিত হইবেই।
    অতঃপর অপেক্ষা। নিশ্ছিদ্র শ্বাসরুদ্ধকর অপেক্ষা। শুধু সাইন্স অ্যান্ড সিম্বলস খোঁজেন। ওই গাছের ফুলটা যদি পড়ে, আমার পোস্টিং অর্ডার হইবে। এই বিড়ালটা যদি দৈবাত দই ভাত টা শেষ করে, আমার পোস্টিং অর্ডার হইবে।
    এক সন্ধ্যায় সজনে ডাঁটার স্তূপ লইয়া বসিয়া দুঃখের সংগে ইডলি সম্বর খাইতেছেন, মহাত্মা ফোন করিলেন।
    এইরূপ কথোপকথন হইলঃ
    যঃ ৩০ এপ্রিল রিটায়ার করছেন কলকাতার ক আপিসের খ বাবু। আমাকে ত ওখানে দিতে পারত, বলো?
    মঃ অত ভেবে লাভ নেই, কী আর করা, যা হয় হবে। দেখ জীবনে নানাকিছুই ত হল, এটাও হচ্ছে। লাফালাফি না করে আরো দুটো ইডলি খাও...
    যঃ ভাবি না ত। জান না এক মাস খবর ও দেখিনি? জান না এখানে কীভাবে আছি? কতদিন মাছ খাইনি?
    মঃ মাছ ভক্ষণ সুলক্ষণ না। কলকাতায় সব কাকুরা রোজ মাস্ক নামিয়ে মাছের বাজারে গিয়ে হইহল্লা করছে। মাছে কিছু হয়না। শুধুই মারকুরি।
    য ঃ উহারা আমাকে পোস্টিং যদি না করে আমি ভুয়ো ডাক্তার সার্টিফিকেট দেব।
    মঃ ছটফট কর না।।আর কতদিন বা তোমাকে ওখানে রাখবে। এর আগেও ত বদলি হয়েছ। এবার ও হবে। বদলিও পৃথিবীর নশ্বরতার মত অমোঘ। কনফুশিয়াস ও কার্ল পপার বলেছেন...
    যঃ (চীৎকার করিয়া) মহাত্মা তৃণ, আর তোমার এইসব জ্ঞান শুনতে চাইনা। Confucius my foot. It's not helping me anymore.
    শশধর সজোরে ফোন কাটেন ও বিছানায় উপুড় হইয়া ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতে থাকেন। আহা যেন উনবিংশ শতকের নায়িকা।
    অলৌকিক ভাবে, বিড়ালের দই ভাত খাইয়া উদ্গারে বিশ্বাত্মা তৃপ্ত হইয়া যায়। ফলত, পরদিন তাঁহার পোস্টিং অর্ডার আসিয়া যায়। কলিকাতার সেই ক অফিসে, খ বাবুর জায়গায়।
    তবে উপরে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা আছে, এই অর্ডার বলবতী হইবে দেশের পথঘাটে যাতায়াতের রেস্ট্রিকশন পাতলাহালকা হইলে। conditional.to the lifting of movement restrictions
    উহাতে বলা আছে ১ মে বা তাহার পরে যে কোন দিন শশধর জয়েন করিতে পারেন।।
    আহা এ যেন সোনার পাথরবাটি।
    মাথায় আনন্দ আর দুশ্চিন্তা যুগপত নৃত্য করে। বহুদিন পর পেট ভরিয়া ভাত খান। ভাল ঘুমান।
    পরদিবস উঠিয়া জানেন, ৩ মে র লকডাউন ১৭ মে অব্দি দীর্ঘায়িত।

    পর্ব ৭
    (signs and symbols ও angels and demons নামের মাহাত্ম্য)
    লকডাউনে এক জোক খুব চলিতেছে। যদি আপনি গৃহবন্দি অবস্থায় নিজের গাছ পালা বা ফ্রিজের সহিত কথা বলেন, পোষ্যদের সংগে মনোলগে ব্যাপৃত হন, ভয় পাইবেন না। ইহাই স্বাভাবিক।
    ভয় কখন পাইবেন? যখন তাহারা আপনার কথার প্রত্যুত্তরে কথা বলিতে শুরু করিবে।
    ১১ মার্চ হইতে ফাঁকা বাড়িতে। মে মাসের ১ তারিখ হইতে বিড়ালদের সংগে মনের প্রাণের কথা বলা শুরু হইল৷ 'ওরে, আমার সমস্যাটা শোন! ওরে, তোরা ভাল করে খা, দেখিস যেন আমাকে এবার বর্ডার পেরতে দেয়। ভেহিকল পাস ইসু হয় যেন'
    এইবার বেড়ালেও উত্তর দেয়। ম্যাঁও ম্যাঁও ম্যঁও উঁ উঁ উঁ....
    গভীর নিশ্চিন্তি। চিকেনের হাড্ডি রান্নাঘরের জানালার পাশে রাখেন শশধর। চিড়ে দই, পাউরুটি দুধের পাউডার।...
    আহা ওরা খাক। আমাকে এসে এসে বৈড়ালিক ভাষায় বলুক, সব ঠিক হ্যায়৷ আল ইজ ওয়েল।
    পোস্টিং অর্ডার খাতায় কলমে হইয়াছে। তাহাতেই হঠাৎ মহাত্না তৃণ দর্শনের খুঁটিনাটি ছাড়িয়া দিলেন। একেবারে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়া গিয়া আস্তিন গুটাইতে লাগিলেন। বেশ বেশ, এখান থেকে একটা গাড়ি অ্যারেঞ্জ করে ফেলি তবে, না কি? বল? চলে যাই তোমার ওখানে। তোমাকে পিক আপ করে আবার চলে আসি!!
    প্রাণে খর গ্রীষ্মেও মলয় বাতাস বহে। কিন্তু যাই বলিলেই যাওয়া যায়??????
    হ য ব র ল র বিড়ালটা ভুবনেশ্বর এর বাংলোর হাতার দেওয়ালে বসিয়া ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করিয়া হাসে।
    বলিল, অত সোজা না। প্রথমে দেখতে হবে বংগের ওয়েবসাইটে stranded person হিসেবে অ্যাপ্লাই করা যায় কিনা। west bengal এগিয়ে বাংলা সাইটে যান দিকি।
    কাঠি লইয়া মাটিতে একটা দাগ কাটে।
    তারপর দেখতে হবে উড়িষ্যা সরকারের সাইটে একজিট পাস দিচ্ছে কিনা। তবে উড়িষ্যা সরকারের আমলা যখন, সেটা বোধ হয় হয়ে যেতেও পারে।
    আরেকটি দাগ।
    তারপর দেখতে হবে মিনিস্ট্রি অফ হোম অ্যাফেয়ার্স এর কোন ক্ল্যারিফিকেশন এসেছে কিনা। ৪৪০০ কোভিড সংক্রান্ত অর্ডার। অনলাইন গিয়ে একে একে ডাউনলোড কর আর পড়।
    যে যে অ্যাক্টিভিটির জন্য লকডাউন শিথিল হয়েছে তার ভেতরে কি কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীর বদলি পড়ছে?
    মনে রাখা দরকার যে এখন দেশে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট চলছে। উহাকে লংঘন করিলে সিধা জেল। অথবা কোয়ারান্টাইন সেন্টারে স্থান।
    দাগের পর দাগ মাটিতে পড়িতেছে।
    খানিক পরে বেড়াল এক চোখে তাকাইয়া বলিল, তাহলে মোদ্দা কথা দাঁড়াইল কী!!
    এইরকম....( নিচে চিত্র দ্রষ্টব্য)
    |]]+++++]]]]]\\\>00000>>>\\\\\??????|||||-----<<<<<-
    ))))000000______///////]]][++++[/.,.';>>><<এখন প্রয়োজন একটা ব্রেইন ওয়েভ। একটা বিস্ফোরণ। অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী। অনেক এঞ্জেল।
    আসিল ও তাই। বাচ্চা বাচ্চা ডেপুটি, পঃ বংগের এ জি বন্ধু, অবসৃত আই এ এস দম্পতি। অসংখ্য মানুষ বুদ্ধি দিতেছেন।
    এঞ্জেল আছে, ডেমন ও আসিতেছে।

    পর্ব ৮

    এঞ্জেল গণ একের পর এক জিনিস পাঠান। ইনবক্স ভরিয়া যায়। যশধরের জন্য আসে নানা লিংক, ওয়েব সাইটের। নানা রকম তথ্য, নানা উপদেশ। আশায় বুক বাঁধেন শশধর । মহাত্মাও খোঁজ নেন। বুদ্ধি দেন। পরিকল্পনা করেন। ভবিষ্যতের দিশা না দেখিলে দর্শন, আর দিশা দেখিলে কর্মযোগ। এই হিসাব চলে মহাত্মার।

    আর শশধর এখন দর্শন কে বিড়াল দ্বারা রিপ্লেস করিয়াছেন। যেই একটা কিছুতে আটকান, ম্যাঁও ম্যাঁও করিয়া ডাকেন। বিড়ালের ভাষাতেই তাহার সহিত বাক্যালাপ করেন। কে আবার কষ্ট করিয়া প্রথমে বাংলা বলিয়া পরে তাহা বৈড়ালিক ভাষায় অনুবাদ করিবে।

    দুর্জনে বলিয়া থাকে, ভারত এখন পুলিস স্টেট। দুর্জনে এও বলে যে সত্তর দশকের লাইসেন্স রাজ ফিরিয়া আসিয়াছে। অতীব দুর্জন যাহারা তাহারা আবার আমেরিকার সেই পরীক্ষা নিরীক্ষার কথা বলিতেছে। যেখানে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা গিয়াছিল, সহপাঠীদের একাংশকে বন্দি ও একাংশকে পুলিশ সাজাইবার কিছুদিনের মধ্যে পুলিশ ছাত্রেরা বন্দি ছাত্রদের উপর অকথ্য অত্যাচার করিতে শুরু করিয়াছে।

    এঞ্জেল ডেপুটি বলে, ম্যাডাম পশ্চিমবংগ থেকে একজিট করতে দিচ্ছে, এনট্রির লিংক খুলছে না। অন্য ডেপুটি বলে ম্যাডাম আপনি বলে এতদিন রইলেন। অন্য কেউ হলে অনেক আগেই অসুখের বাহানা দিয়ে পালিয়ে যেত। আরেক ডেপুটি জানায়, উড়িষ্যার পুলিস আমরা অডিট করি ম্যাডাম। আপনি ত হোম সেক্রেটারির চা পার্টিতেও গেছিলেন। ওনাকে ফোন করে উড়িষ্যার পাস এর কথা বলে দিন।

    কিন্তু আসল সমস্যা প বঙ্গ লইয়া। কোথা হইতে কেন্দ্রীয় বাহিনী না কেন্দ্রীয় টিম আসিয়া শুলুক সন্ধান করতে শুরু করিয়াছে। কমল মিত্রের সহিত ছায়াদেবীর কীরূপ ছায়াযুদ্ধ চলিতেছে কে না জানে। এইসব কারণে রাজ্যের বর্ডার টেনশনে পরিপূর্ণ। কেন্দ্রীয় সরকারি চাকুরে শুনিলে বঙ্গবিধাতার হার্ট অ্যাটাক হইতেছে। কাহাকেও ঢুকিতে দিতেছে না। সূচ্যগ্র মেদিনী বা মেদিনীপুর , কিছুই ছাড়া নাই। উপরন্তু রেড জোন হইয়া গিয়াছে উড়িষ্যা সংলগ্ন পশ্চিম মেদিনীপুর। অনেকে ভুল করিয়া বলিতেছে রেড লাইট এরিয়া। ইহা লইয়া কুপিত বঙ্গবিধাতা , পুলিশের উপরে কড়া পাহারা রাখিবার সমস্ত ক্ষমতা অর্পিত।

    ইতিমধ্যে পাড়ার এক ভ্রাতৃসম ফোন করিয়া শশধরের সাহায্য চাহিয়া বসিল। জানাইল তাহার এক ভায়রা ভাই ঝাড়খন্ডের দেওঘরে আটক। তাহাকে উদ্ধার করিতে হইবে।

    কীমাশ্চর্যম অতঃপরম। নিজেকে সাহায্য করিতে অক্ষম শশধর বাবু তাহাকে সাহায্য করিয়া ফেলিলেন। ঝাড়খন্ডের এজি অফিসে জানাইতেই দু দিনে দেওঘরের এস ডি ও পাস দিয়া দিল। আর এই বালকটি যাদবপুর থানা হইতে এক হাড় জিরজিরে পাস লইয়া গাড়ি লইয়া বাহির হইয়া পড়িল অকুতোভয়ে ও বীরদর্পে। শশধর বুঝিলেন সকলি সম্ভব।

    ইতোমধ্যে কলকাতা স্থিত এজি , শশধরের অন্য এক এঞ্জেল, তাহার হবু আপিসের চার্জ দেখিতেছেন। এইসব অলৌকিক বারম্বার ঘটিয়া থাকে শশধরের জীবনে। ফলত তিনি তাহাকে আশ্বস্ত করিলেন, গাড়ির বন্দোবস্ত হইতেছে। এইবার তুই পাসের বন্দোবস্ত কর। হোম ডিপার্ট্মেন্টে সিধা ফোন লাগা।

    কলিকাতার পুলিস অডিট যে এজি করেন তিনি সদ্য জয়েন করিয়াছেন। লকডাউনে তাহার আপিস একেবারেই খালি। তাছাড়া কে না জানে যে পুলিশ কথা শোনেনা।

    শশধর এবার মরিয়া। ইহাও অলৌকিক! তিনি যে কলেজে পড়িয়াছিলেন কলিকাতার সে প্রাচীন কালেজের ছয় ব্যচের সিনিয়র প বঙ্গের অতিবড় আমলা এখন হোমসেক্রেটারি। ধৃষ্টতা করিয়া তাঁহাকে ওয়াটস্যাপে মেসেজ লেখেন। কালেজের নাম করিলে আজো অনেক কাজ হয়। অন্তত প্রাথমিক সৌজন্য বিনিময় চমৎকার হইলে। উনি আরো এক যিনি এঞ্জেল তালিকায় উঠিলেন।

    কিন্তু কাজের কথা তুলিতেই টিভির অনুষ্ঠানে র সেই পরিচিত ঢ্যাং-ং-ং করিয়া নিচুতারে বাঁধা ক্র্যাশিং সাউন্ড অন্তরীক্ষে বাজিয়া উঠিল। তিনি হাত তুলিয়া দিয়া বলিলেন, আসলে আপাতত খুবই ঝামেলায় আছি আমরা। পুলিশকে বলা হয়েছে সবাইকে আটকাতে। আমাদের কোন ডিসক্রিশন আপাতত নেই। কাজেই আপনাকে গাড়ির পাস দেওয়া আদৌ এই মুহূর্তে সম্ভব হবে না হয়ত। আর কদিন পর ভাবা যেতে পারে। অবস্থা পর্যালোচনা করে জানাব।

    অল্পবয়সে স্প্যানিশ ইনকুইজিশনের উপর আধারিত এক কাহিনি মনে দাগ কাটিয়াছিল। টরচার বাই হোপ। আগুস্ত ভিলিয়ের দ্য লিল আদাম রচিত বিখ্যাত কাহিনি। বন্দীকে মুক্তির আশা দেখানো হইতেছে, আর প্রতিবার মুক্তির একেবারে নিকটে এলেই তাহার সে সম্ভাবনা রদ করা হইবে। আশা করিতে করিতে ধুকুপুকু প্রাণ বাঁচি বাঁচি করিয়া উঠে, আবার নিরাশার অতলে তলায়। ডাঙায় তোলা মাছের মত খাবি খায় বন্দি। সেই বন্দি দেখে গরাদের ভারি দরজা অল্প ফাঁক । কিন্তু অতি সাবধানে কাছে গেলেই ক্যাঁচ করে বন্ধ হয়ে যায়। ওভাবেই প্রোগ্রামড থাকে সব। একেবারে শেষ দৃশ্যে কেউ কোথাও নেই, সে বেরিয়ে প্রায় পড়েছে। তারপর তাকে সান্ত্রী এসে পাকড়াও করে। ধক করে প্রাণপাখি বেরিয়ে যায় তার । মৃতদেহটা পড়ে থাকে।

    এই মুহূর্তে শশধরের অবস্থা তাইই।

    অধীর অপেক্ষায় এইভাবে সাতদিন কাটে। শেষাবধি সেরা অলৌকিক। সেই প্রাজ্ঞ আপিচর নিজে ফোন উঠাইয়া শশধরকে বলেন, আপনার কাজ হয়ে যাবে। তবে গাড়ি কিন্তু উড়িষ্যা ঢুকলে ঝামেলা। আমরা আমাদের বর্ডার অব্দি পাস দেব। আপনি উড়িষ্যার নাম্বার প্লেটের গাড়িতে জলেশ্বর অব্দি আসবেন। বর্ডারে গাড়ি বদল করবেন।

    সমস্ত বাগান গান গায় সমস্ত আকাশ বিকশিত হয় রৌদ্রে।

    এবার উড়িষ্যা। পশ্চিমবঙ্গ ইমেলে যে পাস দিয়াছে তাহাতে তারিখ নাই। উড়িষ্যা বলে, না না একটা ডেট দিতে হইবে। কবে যাবেন বলে দিন। তাছাড়া কোন পয়েন্ট দিয়ে ঢুকবেন তাও সিস্টেমে তোলা হবে। চেকপোস্টের নাম বলুন। ইহুদিরা জার্মানি ছাড়িয়া সুইজারল্যান্ডে পালাইতেছে এমন কত না সিনেমা সারা জীবনে দেখা হইয়াছে। সেসব দৃশ্য চোখে ভাসে শশধরের। পোঁটলাপুঁটলি গোছান। অতি রগরগে ঘ্যানঘেনে সব কবিতা লেখেন। সেন্টিমেন্টে চোবান।

    সব শেষে আরো তিন দিন ঘষ্টানোর পর, উড়িষ্যার পাস আসে। তাও এজি আপিসের সক্রিয় এঞ্জেলদারির ফল। সাধারণ মানুষ কীভাবে যাবে, কীভাবে পাবে এসব পাস? যাদের সত্যি দরকার? মাথায় ঢোকেনা। এত ধরাধরি চেনাশুনোর পর এত কষ্ট? কী ভয়ানক ।

    যেদিন সব পাস হস্তগত, তার ঠিক পরশুদিন সকাল সকাল গাড়ি বন্দোবস্ত হইয়াছে। উড়িষ্যা নাম্বার প্লেট, সরকারি নাম্বার প্লেট।

    সব যখন ঠিকঠাক, তারিখ ও ফিক্সড, তখন দিল্লি বলে, এখন জয়েনিং করিবে কী! এখন ত লকডাউন। আগে মাসখানেক থেকে অডিট রিপোর্ট ফাইনালাইজ করে দিয়ে যাও!

    শেষ পর্ব ( পর্ব ৯)

    জাতিস্মর ও "ছাতা ধর রে"

    কী উপায়ে শশধর দিল্লির হাত হইতে নিস্তার পাইলেন তাহা উহ্য রইল। ইহা ট্রেড সিক্রেট। করোনামুক্তি ইহা হইতে অনেক সহজ। আসলে নরম মাটি পাইলে আঁচড়ায় বলিয়া একটা কথা আছে। এইবার শশধরের হাড্ডিগুড্ডির দৃঢ়তার টেস্ট হইল।

    দুই রাত নির্ঘুম কাটাইলেন, খাবার খাইতে পারিলেন না, খাইলেও বমি হইয়া গেল। টেনশনের হদ্দমুদ্দ হইল। তিনি কৃতজ্ঞ কারণ তাঁহার এঞ্জেলকুল ফোন যোগে তাঁহাকে সর্বপ্রকার সহযোগিতা করিলেন। সরকারি রেড টেপের ফাঁসের বজ্র আঁটুনি যেমন ভয়াবহ হইতে পারে তেমনই লুপ হোল মানে ফসকা গেরো বাহির করাও এক শিল্প। তাছাড়া একটি পোস্টিং অর্ডার বার বার পাঠ করিয়া তাহার ভিতরের শাঁসটুকু লইতে হয়। ইমপ্লিকেশনগুলি বাহির করা প্রায় ধাঁধা সমাধানের ন্যায় গুরুতর কর্ম। সেবিষয়ে শশধর পাকা মাথার সাহায্য পাইয়া গেল। শেষ বাধা পার হইল।

    সবের পর বিধ্বস্ত নিদ্রাহীন রাত্রির অন্ত হইল। সুড়ঙ্গের শেষে আলো আসিল। সকাল সকাল সব জুনিয়র আসিয়া শশধরকে বিদায় জানাইলেন সামাজিক দূরত্ব মানিয়া। কোন ফুল না উপহার না করমর্দন না। শুধুই পাশে দাঁড়ানো। শশধরের চোখে জল আসিল। দস্যু রানির ন্যায় সে মুখে মুখোস বাঁধিয়া চল্লিশ চোরের সহিত দাঁড়াইয়া ছবি তুলিল।

    গাড়ি প্রথম পাঁচ ঘন্টা চলিল ৭০ কিমি গতিতে। ভুবনেশ্বর হইতে সকাল ৮ ঘটিকায় বাহির গমন। সকলেই বলিয়াছে পাঁজি দেখিয়া যাইবেন। বেস্পতিবারের বারবেলা বা শনিবারের কালযোগ ইত্যাদি এড়াইয়া নিতান্ত কুসংস্কারাচ্ছন্নের ন্যায় শশধর শুক্রবার বাহির হইলেন। আগের দিন বুদ্ধ পূর্ণিমা ছিল। সেই চাঁদ দেখিয়া আকুল হওয়া তাঁহার ঘটে নাই। শুধু বুদ্ধের শিক্ষা , আত্মনিয়ন্ত্রণের ও লিভ ইন দ্য প্রেজেন্টের , ইহাই মর্মে লইয়াছেন।

    নির্বিঘ্নে হ্যান্ড ওভার সম্পন্ন হইয়াছে শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা তিথিতে। অতঃপর রবীন্দ্রজয়ন্তী তিথিতে আমাদের যাত্রা হল শুরু এখন ওগো কর্ণধার, তোমারে করি নমস্কার, গাহিতে গাহিতে আর অনলাইনে রবীন্দ্রজয়ন্তী দেখিতে দেখিতে বাহির হইলেন।

    উড়িষ্যার রাষ্ট্রীয় হাইওয়ে নং ১৬ অতীব দুর্দশাগ্রস্ত দেখিলেন। ড্রাইভার উড্র দেশীয় কিন্তু খুব স্মার্ট। সে বলিল রাস্তার এই হাল আগে দেখে নাই। হয়ত লকডাউনে রাস্তা মেনটেনেন্স একেবারেই হইতেছে না।

    সাড়ে বারোটা বাজিল। সাড়ে চার ঘন্টা। কটক, ভদ্রক, মহানদী ব্রাহ্মণী পার হইয়া বালেশ্বর চলিয়া গেল। দাঁতে দাঁত , ক্ষমাহীন শশধর ভাবিতেছেন, এত এত বেড়াইয়াছি সারাজীবনে , গত তিন বছরে, আর কিন্তু আসিব না, উড়িষ্যা! বহুত ভুগাইয়াছ আমাকে। যদিও মালপত্র সব পড়িয়া আছে। তাহার জন্য লকডাউন উঠিলে ফিরিতে হইবে অন্তত একবার।

    রাস্তা ভাল হইলে আরো দ্রুত হইত। ওদিকে মহাত্মা ততক্ষণে আগে ভাগে বাহির হইয়া এন এইচ ষোল দিয়া ঝড়ের বেগে আসিয়া ৪৫ মিনিট পূর্বেই পৌঁছাইয়া গিয়াছেন। ফোনের টাওয়ারের প্রব্লেম । কথা হইতে পারে নাই ভাল করিয়া।

    সারা পথ জল পান করিলেন না শশধর। জলবিয়োগের কোন স্কোপ নাই বলিয়া। ডিম রুটি কফি। একবার থামিয়া এইসব ব্যাগ হইতে বাহির করিয়া খাইলেন। তারপর আসিল জলেশ্বর।

    টা টা বলিয়া জলেশ্বর টোল ট্যাক্স বুথ হইতে উড়িষ্যার গাড়িকে ছাড়িয়া দিলেন।

    এইবার পশ্চিমবঙ্গের গাড়ির সম্মুখীন। পশ্চিমবঙ্গের বর্ডার পার হইয়া, উড়িষ্যায় ঢুকিয়া আবার পশ্চিমবঙ্গে যাইবে। এই বার আসল মজা।'

    তাহাদের পুলিশে ধরিল!

    এক্ষণে এপিসোড ব্রেক করিবার চূড়ান্ত ইচ্ছা হইতেছে। কিন্তু না, সবাইকে শেষে আনিয়া আর সাস্পেন্সে রাখা না। বলিয়া ফেলি।

    ইনোভা গাড়িতে মহাত্মা ও শশধরের প্রায় দুই মাস পর দেখা সাক্ষাত হইল। আকাশ হইতে পুষ্প বৃষ্টি হইল না, বাতাসে শংক ঘন্টা বাজিল না, এমনকি দুজনের মুখ ও আচ্ছাদিত মুখোশে। তবু চারিচক্ষুর মিলন হইল। যে গৃহে কাক চিল বসে না সেগৃহেও আজ প্রেমবাতাস বহিতেছে, বিরহের এমন গুণ। সামাজিক দূরত্বের কারণ নাই, এমনিতেই পাবলিক ডিসপ্লে অফ অ্যাফেকশন যে মহাত্মার অতি না পসন্দ তা ইতিমধ্যে সব পাঠক বুঝিয়াছেন। সুতরাং তাঁহারা যেন কিছুই হয়নাই মুখ করিয়া গুটিগুটি গিয়া গাড়িতে উঠিলেন ও দু কদম গিয়া গাড়ি হইতে নামিতে বাধ্য হইলেন।

    পুলিশ বলিল, যান থার্মাল স্ক্যানিং করান। নাম বলুন, বাবার নাম, ঠিকানা সব বলুন, ল্যাপটপে উঠবে।

    স্থানটি পুলিশে পরিপূর্ণ। এবং যাত্রিকুল পুলিশকে ফাঁকি দিতে নানাভাবে উৎসুক। একটি বড় গাড়ি আসিয়াছে। বারোজনের দল । পুলিশ বলিতেছে সবাই লাইন দিয়ে ডিসট্যান্স মেনটেন করে আসুন। সবাইকে পর পর স্ক্যান করা হইবে। কিন্তু সে গাড়ি থেকে এক একজন আসছে আর কুমিরছানার খেলা খেলছে।

    এক আশাদিদি টাইপ বেচারি মহিলা আছেন। না আছে ঢাল না আছে তলোয়ার, না আছে পিপিই। শুধু গ্লাভস ও মুখোশ ভরসা। তিনি টেম্পারেচার মাপিতেছেন স্ক্যানার দিয়ে।

    আছে এক ক্ষুদ্র তাঁবু। একেবারেই চারজন মানুষের বসার স্থান। লাইন দেওয়া ডিসট্যান্সিং মানা যাত্রিকুল সব বাইরে। বেলা একটার খর রোদে দন্ডায়মান।

    মিনিট পনেরো রৌদ্রে দাঁড়াইবার পর আশাদিদি কপালের কাছে স্ক্যানার ধরিলেন। শশধরের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটিয়া উঠিল। "হল না হল না , বেশি আসছে বেশি আসছে"।

    তীরে এসে তরী ডোবে ডোবে। তাপমাত্রা জ্বরের অধিক।

    মহাত্মার কপালে ধরিলেন। তিনিও অধিক।

    ড্রাইভার হেল্পার দ্বয়ের কপালে ধরা হইল। তাহাদের ও। সকলেই ৩৮ প্লাস।

    চেন্নাই হইতে বরাবর গাড়ি চালাইয়া আসা ভেলোরের অসুস্থদল একই লাইনে আছেন। তাহাদের ও ৩৮। কেয়াবাত।

    এক ভেলোর প্রত্যাগতা মুখোশ খুলিয়ে খোশ গল্প করিতেছেন। শশধর ধমক দিলেন - ম্যাডাম, মুখোশ!

    পথে অনেক তামিলনাড়ু নাম্বার প্লেট দেখা গিয়াছে। ইঁহারা সকলেই ঐ ঐ সব স্থান প্রত্যাগত। বর্ডারে আকুল ভাবে প্রতীক্ষারত। অসুস্থ, সুস্থ, কাঙাল, ড্রাইভার সব ঘেঁষাঘেঁষি হইয়া চেক পোস্টে।

    আশাদিদি শশধর সহ সবাইকে গাড়িতে ফিরৎ পাঠাইলেন। যান এ সি চালাইয়া গাড়িতে দশ মিনিট বসিয়া তবে আসুন।

    রৌদ্রমুখরিত হাই ওয়ে হইতে আবার এসি শীতল গাড়ি। আবার গমন। দ্বিতীয়বার মহাত্মা ও ড্রাইভার রা পাস করিলেন। শশধরের মাথাগরমের ধাত। ভাল করিয়া রুমাল দিয়া মুছিলেন। একটু স্যানিটাইজার লাগাইতে ভুলিলেন না। ঘোমটা দিলেন।

    হঠাৎ ব্রেন ওয়েভ, ড্রাইভার বলিল, গাড়িতে বড় ছাতা আছে ম্যাডাম, ওইটা নিয়ে যাই?

    বার বার তিনবার। এইবার না হইলে কোয়ারান্টাইনে চালান। তৃতীয়বার শশধর চলিতেছেন। হীরক রাজার মন্ত্রীর ন্যায়। পিছনে ড্রাইভার ছাতা ধরিয়া। আশা দিদির সামনে আবার অন্য যাত্রীদের ভিড়। চীৎকার চেঁচামেচি হইতেছে।

    বিশাল ছাতায় অন্ধকার করিয়া আছে। এবার ৪০ ডিগ্রির সূর্যতাপ কী করিবে? কাঁচকলা।

    শশধর পাস করিলেন।

    লাইফ ইজ স্ট্রংগার দ্যান ফিকশন। লালমোহন উবাচ।

    এইবার সাট্টিফিকেট রচিত হইতেছে। ল্যাপটপ দেখিয়া আশা হয় সবার খবর কেন্দ্রীয় কোন ডেটাবেসে জমিবে। কিন্তু জমিল কই। সাট্টিফিকেট যন্ত্রনির্গত নহে! হস্তে লিখিত।

    ১৪ দিন হোম কোয়ারান্টাইনের বিধান আছে উড়িষ্যা আগতার জন্য।

    এইবার আবার যাত্রা। শুনশান পথ। একশো স্পিডে গাড়ি চলিল।

    কিন্তু হাইওয়ে অপরূপ। পরিচ্ছন্ন। গর্ত বিহীন। প্রচুর সাদা দাগে বাম্পার স্পিড ব্রেকার নির্দিষ্ট করা। অপরূপ মেদিনীপুর। হাইওয়েতে ভিজা ধান মেলিয়া মাড়াই বাছাই ঝাড়াই চলিতেছে। কাজের উৎসাহ, মানুষের ডিসট্যান্সিং মানিয়া কৃষিকর্ম দেখিয়া মন ভরে।

    উড়িষ্যা সাইডে এসব ছিল না। মাইল মাইল ফাঁকা মাঠ ছিল। এখানে কৃষির রমরমা। বাংলা হাসছে।

    হাইওয়ে দিয়া আসিতে আসিতে মাথায় পুঁটলি অনেক শ্রমিকদের চলিতে দেখিয়াছেন। ইহাদের গন্তব্যনিশ্চয় প বঙ্গ। কে বলে প বঙ্গে ভাল কিছু নাই। এই ত এত মানুষের গন্তব্য । এই ত এত মানুষের কর্মব্যস্ততার চিত্র। এই ত হাই ওয়ে এত ভাল। এগিয়ে বাংলা!

    চিরকাল বিপরীত শ্রবণ করি আমরা।

    ঠিক আড়াই ঘন্টা লাগিল। স্বপ্নবৎ উড়িয়া সাঁতরাগাছি পার হইলেন, হাওড়া হইয়া বিদ্যাসাগর সেতু ও মা ফ্লাইওভার।

    শুরুতেই শশধর বলিয়াছিলেন, কাল সারারাত ঘুম হয় নাই উত্তেজনায়। আজ এখনো এতটুকু ঘুম পাচ্ছে না কেন বল ত?

    মহাত্মা অসামান্য বাণী দিয়াছেন। "তুমি ত আর নকল ডক্টর হাজরা নও, যে, পাশে জাতিস্মর বসে রয়েছে, সোনার কেল্লাও একটু পরে পৌঁছে যাবে, তাও ঘুমিয়ে পড়বে?"

    বাংলা বর্ডার ক্রস হইল কিনা, নির্বিঘ্নে থার্মাল স্ক্যানিং ও সার্টিফিকেট প্রাপ্তি হইল কিনা, সব জানিবার জন্য শশধরের উড়িষ্যাবাসী এঞ্জেলকুল ও কলিকাতাবাসী এঞ্জেলকুল অধীর আগ্রহে মোবাইল পাশে লইয়া অপেক্ষা করিতেছিল। এ রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনার তুলনা নাই । একেবারেই মেরিকমের বায়োপিকের সমতুল্য। সুসংবাদ পাইয়া সবাই স্বস্তির শ্বাস ফেলিলেন। সুদূর মুম্বই শহরে প্রণম্য শুভাকাঙ্ক্ষী প্রবীণ বুরোক্র্যাট দম্পতি রান্না চাপাইলেন।

    আর হ্যাঁ দেখা গেল যে হিন্দি সিনেমার অন্তে যেরূপ, এ কাহিনির অন্তে সব ভিলেন ভালমানুশ হইয়া গিয়াছে।

    বাড়ি আসিয়া প্রথমেই দেখা হইলা কোকিলাবেনের সহিত। প্রতি লকডাউন এক্সটেনশনে সে কাঁদিয়াছে। তবে বাকি সময় কোকিলের ন্যায় গান গাহিয়াছে। আজ কোকিলাবেনকে.... না, জড়াইয়া ধরিলেন না। দূর হইতে দুই হাত নিমাই এর ন্যায় উঠাইয়া ভার্চুয়াল আলিংগন নৃত্য করিলেন।
    ইতি রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা সমাপ্ত ।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১৩ মে ২০২০ | ২৮৬৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিপ্লব রহমান | ১৪ মে ২০২০ ০৯:০৯93301
  • উরি বাপ রে! এ কী করোনা কাহিনী লিখিয়াছেন! টুপিখানি খুলিয়া রাখিলাম  

  • হি হি | 162.158.158.242 | ১৫ মে ২০২০ ২০:১৫93365
  • আবার পরে নিন 
    ঠান্ডা লেগে যাবে 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে প্রতিক্রিয়া দিন