এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  টুকরো খাবার

  • স্প্যানিশ স্যাটারডেঃ পিকো দে তর্তিয়া

    নিয়ামৎ খান লেখকের গ্রাহক হোন
    টুকরো খাবার | ১০ জানুয়ারি ২০১১ | ১১০২ বার পঠিত
  • আচ্ছা, স্পেন বললেই আপনার কিসের কথা মনে হয় বলুন তো? লাল চাদর হাতে ম্যাটাডোর? দুরন্ত লড়ুয়ে ষাঁড়? না তারে তারে ঝঙ্কার তোলা গীটার? পেনিলোপি ক্রুজের কথাও কারু না কারু মনে হয়না এ বললে আমি মানবো না। আবার নিশ্চয়ই আপনাদের মধ্যে এমন কেউও আছেন যাঁর স্পেন বললেই মনে হয় স্প্যানিশ অলিভ-অয়েলের কথা। ঠিক ভাই ঠিক। স্প্যানিশ অলিভ অয়েলের জুড়ি নেই কোনো। স্প্যানিশ খাবারেরও না।

    স্পেনকে ইউরোপের "সব্জিভুঁই' বলে ধরা হয় জানেন তো? চাষবাস খুব ভালো কিনা এখানে? বেশ গরম মতন গ্রীষ্ম, মৃদু শীত, উত্তরদিকটায় বছরভর বৃষ্টি ফলনের পক্ষে চমৎকার। প্রচুর জলপাই হয় এখানে (ঐ জন্যই না অমন অতুলনীয় অলিভ অয়েল?),আর কমলালেবু। সত্যি বলতে কি লেবু আর আঙুর রফতানিতে স্পেনই দুনিয়ায় এক নম্বর এখন। আর হয় ধানের চাষ,আর জাফরান। সে কথায় একটু পরেই আসছি। আর আছে স্পেনের বিখ্যায় লাল মিষ্টি লংকা "পিমেন্তো দে পেকিও'। চাষ আবাদের কথা যখন উঠলোই তখন এও একটু বলে রাখা ভালো যে ডেয়ারী ফার্মিং ও এদেশে মন্দ না। এখানের ভেড়ার দুধের মাঞ্চেগো চীজের নামডাক তো পৃথিবী জুড়ে। আবার উত্তরের উপকূল এলাকায় মাছ,চিংড়ি, কাঁকড়া,স্কুইড, ঝিনুকও পাওয়া যায় প্রচুর।

    স্প্যানিশ কুইজিনের একটা বেশ আলাদা স্বকীয়তা আছে। খুব বেশি অন্যদেশী প্রভাবে দো-আঁশলা নয়। আসলে বেশি খাবারের ধারা এসে মেলেনি এখানে। চার দিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা তো? তবে একেবারে কিছুই কি আর নেই? উত্তর উপকূলের দিকে গালিসিয়া, মাদ্রিদ অঞ্চলের রান্নায় পর্তুগীজ প্রভাব কিছু আছে বই কি। কিছুটা সেল্টিক ধারাও আছে। আবার উত্তরপূর্বের কাতালোনিয়া এলাকার খাবারে রোমান,ভিসিগথ, মূরিশ, ফরাসী কুইজিনের ধাঁচ দেখতে পাবেন। মূরদের প্রভাব দক্ষিনপূর্বের খাবারেও আছে। তাদের হাত ধরেই তো ধান আর জাফরান এদেশে এসেছিলো। আর আজ দেখুন ভ্যালেন্সিয়া অঞ্চলে এই দুই ফসলের কি রমরমা। এই দুই দিয়ে তৈরী স্প্যানিশ খাবার "পায়েইয়া'র নাম শোনেনি এমন খাদ্যরসিক পাবেন না। অবিশ্যি অনেক লোকে বানান দেখে তাকে সেরেফ "পায়েল্লা' বানিয়ে দিয়েছে। তবে সেটা মোটে ঠিক উচ্চারণ নয়; "স্বপন'কে কেউ যদি "সোয়াপান' বলে ডাকে তাহলে যেমন হবে, ঠিক তেমনি।

    "পায়েইয়া' একা নয়। বিশ্বের ডাইনিং টেবিলে আরো অনেক স্প্যানিশ খাবারেরই বেশ আদর আছে। এই যেমন ধরুন ঠান্ডা স্যুপ "গাজপাচো', মুর্গি বা ভেড়ার ঝোলঝোল স্ট্যু কোচিডো, মিষ্টি কাস্টার্ডের মত "ফ্লান',বাদামবাটা-রসুন-পাঁউরুটি দিয়ে করা ঘন গ্রেভী "পিকাডা',বিনা ডিমের মেয়োনেজের মত স্যস "আয়োয়ি' ("এয়োলী' ও বলেন কেউ কেউ), আর যার কথা না বললেই চলেনা সেই "তাপাস'। তাপাস জিনিশটা "বারফুড'এর দুনিয়ায় বেজায় জনপ্রিয়। এর চলন শুরু হয়েছিলো দক্ষিণ স্পেনে উনিশের শতকে। তাপাস শব্দটা এসেছে "তাপার' থেকে, তার মানে "ঢাকনা'। ঐ অঞ্চলের বার গুলোতে তখন বেশির ভাগ সময়ে শেরীর গেলাসের ওপরে এক টুকরো হ্যাম বা সসেজ দিয়ে ঢাকা দিয়ে পরিবেশন করা হতো। সেই থেকেই চালু হয়ে গেলো পানীয়র সাথে টুকটাক মুখ চালাবার জন্য 'ক্ষুদে খাবার' তাপাস। এখন তো প্লেন জলপাই বা বাদাম থেকে শুরু করে হাজার রকম 'তাপাস' আসরে নেমে পড়েছে। কারুর থেকে কম যায়না কেউ। তা, আজ আমরা সেইর'ম একখানা তাপাস বানাইনা কেন? নামখানাও বেশ গালভরা আছে -- 'পিঞ্চো দে তর্তিয়া'।

    আজকাল খবরের কাগজে বিদেশী রান্না নিয়ে লেখা বেরোয় অনেক। সেসব লেখায় "তর্তিয়া'র সাথে পরিচয় হয়ে গেছে আপনার অ্যাদ্দিনে (অবিশ্যি নামী কাগজ টাগজে তাকে টর্টিলা লেখে)। কিন্তু আমরা আজ সে তর্তিয়ার কথা বলছিনা। সে হলো মেক্সিকান রুটি। আমাদের এই তর্তিয়ার সাথে রুটির সম্পক্কো নেই। এ হলো গিয়ে বিশুদ্ধ অমলেট। স্পেনের ষাঁড়ের লড়াই বা স্প্যানিশ গিটারের থেকে এই অমলেটের কৌলীন্য কোনো অংশে কম নয়। আর পিঞ্চো দে তর্তিয়া মানে? গোদাভাষায় পাঁউরুটি আর ডিমভাজা। নিরাশ হবেন না। স্পেনের প্রতিটি "বার' এ, হাইফাই ককটেল পার্টিতে এই খাদ্য আসর জাঁকিয়ে থাকে। বলছি তো "তাপাস' এর মধ্যে এঁর জনপ্রিয়তা তুমূল। দেখাই যাক না আমাদের আটপৌরে ডিম্পাঁউরুটি কোন কায়দায় অমনটা হয়ে উঠতে পারে?

    আগে তাহলে তর্তিয়া বানানো যাক। একে স্প্যানিশরা বলেন তর্তিয়া দে পাতাতা। অর্থাৎ কিনা আলু দিয়ে অমলেট। পাতাতা মানে পোটেটো ছাড়া কিছু না। কি করতে হচ্ছে তাহলে? একটা বড় পেঁয়াজ কুচিয়ে নিন, আর চার পাঁচ কোয়া রসুন। গোটা তিনেক মাঝারী মাপের আলু খোসা ছাড়িয়ে ছোট ছোট টুকরো করে রাখুন। এবারে বড় দেখে ফ্রাইপ্যান চাপান মাঝারী আঁচে। তিন বড় চামচ সাদা তেল দিয়ে পেঁয়াজ-রসুনের কুচি ছেড়ে দিন। একটু রং ধরলে আলু দিয়ে আঁচ সামান্য কমিয়ে দিন। নেড়ে চেড়ে ভাজতে থাকুন যতক্ষণ না আলু নরম হয়ে যায়। এইবারে হাতা দিয়ে আলু ইত্যাদি অন্য পাত্রে তুলে রাখুন। দেখবেন প্যানে তখনো অনেক খানি তেল রয়েছে। অতটা তেল লাগবেনা আমাদের। বেশির ভাগটাই ছেঁকে তুলে রাখুন।

    আচ্ছা, এইবার আসছে ডিমের পালা। বড় একটা বাটিতে চারটে ডিম ভেঙে নিন, আর দু-তিন চামচ দুধ। আন্দাজ মতো নুন দিয়ে দিব্যি করে ফেটিয়ে নিন। এর মধ্যে মিশিয়ে দিন ঐ আগের আলু-পেঁয়াজ ভাজা। এবারে ফ্রাইপ্যানে যে বাকি তেল রয়েছে তার মধ্যে ঢেলে দিন সবটা। আঁচ একটু কমের দিকে থাকলেই ভালো। যখন দেখবেন ওপর দিকটায় ডিম বেশ জমে এসেছে, টলটলে নেই, তখন সাবধানে তর্তিয়া ওল্টাতে হবে। এটা করার একটা ট্রিক আছে। একটা প্লেট নিয়ে চাপা দিন প্যানের ওপরে, এবারে হাত দিয়ে ধরে প্যান শুদ্ধু উল্টে দিন। তর্তিয়া তাহলে এসে পড়লো প্লেটের ওপরে, তাই তো? এবার আস্তে করে স্লাইড করে ওকে আবার প্যানে নামিয়ে দিন। তাহলেই উল্টো হয়ে গেলো। এই পিঠটাও মিনিট খানেক ভেজে নিলেই তর্তিয়া তৈরী।

    আগুন থেকে নামিয়ে একে ছোট ছোট চারকোণা টুকরো করে কেটে নিন। পাঁউরুটিও কেটে নিতে হবে ঐ একই মাপের টুকরো করে। এবার এক টুকরো পাঁউরুটির ওপরে একটা তর্তিয়ার টুকরো রেখে পরিবেশন করুন। স্প্যানিশরা প্রত্যেকটা টুকরো একটা করে টুথপিক দিয়ে গেঁথে দেন। যাতে ঐ টুথপিক ধরেই টুকরোটা মুখে পোরা যায়, হাত লাগাতে না হয়।

    টুথপিককে স্প্যানিশ ভাষায় বলে 'পিঞ্চিতো'। তার থেকেই এর নাম হয়েছে "পিঞ্চো'।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • টুকরো খাবার | ১০ জানুয়ারি ২০১১ | ১১০২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন