এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  অপর বাংলা

  • রিকশা ফ্যাশনের নান্দনিকতা এবং

    কল্লোল মুস্তাফা লেখকের গ্রাহক হোন
    অপর বাংলা | ০৪ এপ্রিল ২০১১ | ১৬৯০ বার পঠিত
  • একটু কল্পনা করুন তো: জীর্ণ লুঙ্গি-শার্ট পড়া কিছু মানুষ প্রেসক্লাবের সামনে একটা ব্যানার হাতে দাড়িয়ে আছেন, ঢাকার রাস্তা থেকে রিকশা উচ্ছেদের প্রতিবাদে সুশীল মানববন্ধন করছেন আর দলে দলে সাংবাদিক-ফটো সাংবাদিক তাদের ছবি তুলছেন, সাক্ষাতকার নিচ্ছেন আর দিন শেষে ইলেক্‌ট্রনিক মিডিয়ায় এবং পরদিন প্রিন্ট মিডিয়ায় আট কলাম জুড়ে বিশাল হেডলাইন: "ঢাকার রাস্তায় রিকশা উচ্ছেদের বিরুদ্ধে রিকশা চালকদের প্রতিবাদ'!! গাজা কিংবা ইয়াবা না খেলে এই দৃশ্যটির কথা কারো পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব না। কিন্তু দৃশ্যটা পুরোপুরি না মিললেও আংশিক মিলে গেছে, দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় বিশাল হেডলাইন হয়েছেন তারা!

    যুগান্তর: রাজধানীতে রিকশাচালকদের বিক্ষোভ: বেপরোয়া তান্ডব

    প্রথম আলো: শতাধিক গাড়ি ভাঙচুর করে রিকশা চলাচল বন্ধের প্রতিবাদ!

    সমকাল: যত রাগ গাড়ির ওপর!



    হেডলাইনের বক্তব্য তাদের বিরুদ্ধে গেলেও তারা হেডলাইন তো হয়েছেন! ভুল ভাবে, আংশিক ভাবে, বিকৃত ভাবে তাদের বক্তব্য/ক্ষোভ যন্ত্রণা উপস্থাপন করা হলেও একরকম উপস্থাপন তো হয়েছে! হ্যঁ¡, শুধু মাত্র দৃশ্যপটে তাদের করুণ উপস্থিতির কথা সজোরে ঘোষণা করা, নিজেদের দাবী-দাওয়ার কথা দেশবাসীর কাছে কেবল তুলে ধরার জন্যই গার্মেন্টস শ্রমিক কিংবা রিকশা শ্রমিকদেরকে রুটি-রুজি বন্ধ রেখে হলেও রাজপথে নেমে আসতে হয়, "তান্ডব' চালাতে হয়। বড়লোকের যাতায়াত, আরামদায়ক যোগাযোগ কিংবা নিত্যনতুন ফ্যাশানের মাধ্যম গাড়ির চলাচল নির্বিঘ্ন করার নামে তাদের জীবিকা বন্ধ করা হলেও তারা যখন উপায়ন্তর না দেখে সেই সব গাড়ি ভাঙচুর চালাবেন সেটা তখন পত্রিকার পাতায় একটা আশ্চর্যবোধক চিহ্নসহ হাজির হবে- এটা কিন্তু মোটেই আশ্চর্যজনক নয়!

    অবশ্য পত্রিকায় প্রথম কিংবা শেষ পাতার খবর সাম্প্রতিক কালে আরো তারা হয়েছেন: বিশ্বকাপ উপলক্ষে। বিশ্বকাপ উপলক্ষে পরিবেশবান্ধব ও বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী বাহন হিসেবে রাস্তায় রাস্তায় রিকশার প্রদর্শনী করা হয়েছে, বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জাকালো সাজে সাজানো রিকশায় চড়ে অধিনায়কেরা মাঠেও গিয়েছেন:

    "আগামীকাল সন্ধ্যায় রিকশায় চড়ে বিশ্ব প্রদক্ষিণ করতে বেরোচ্ছে বাংলাদেশ! রিকশা নামের এই ত্রিচক্রযান মধ্যবিত্তের কাছে যদিও এখনো স্বস্তির, কিন্তু উচ্চবিত্তের কাছে বিরক্তি। যানজট ঘটায়, গাড়ির রাস্তায় বাধা। কিন্তু এসব ছাপিয়ে এ রিকশাই আগামীকাল ইতিহাসে ঢুকে যাচ্ছে বাংলাদেশের পরিচয়ের সূচক হয়ে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে জমকালো করতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই, খরচাপাতি হচ্ছে, গান-বাজনার বহু আয়োজন; কিন্তু সেসব তো সব দেশের, সব খেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেই থাকে। কিছু দেশজ সংস্কৃতির প্রদর্শনী, গানে গানে কিছু আমন্ত্রণ-নিমন্ত্রণ। বাংলাদেশের বিশেষটা কী? এই রিকশা। ১৪ দেশের অধিনায়করা রিকশায় চড়ে মাঠে ঢুকবেন আর বাংলাদেশ সেই রিকশার অদৃশ্য যাত্রী হয়ে পৌছে যাবে বিশ্বের দেশে-দেশে। মাঠে ঢোকার খবরটা আর সব ছাপিয়ে এমন কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে যে সন্ধ্যায় এক বিদেশি সাংবাদিক ফোনে খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন, সেই রিকশাগুলো আছে কোথায়! সৌভাগ্যবান রিকশাওয়ালাই বা কারা! তাঁর দেশের পত্রিকা সম্ভবত এগুলোর ছবি-পরিচয় এসব চায়। আমাদের রিকশা আজ এতটাই মর্যাদাকর!.....'

    সূত্র: http://www.dailykalerkantho.com/?view=details&type=gold&data=Wallpaper&pub_no=433&cat_id=1&menu_id=13&news_type_id=1&index=0&archiev=yes&arch_date=16-02-2011

    আহা! রিকশা চালকের সৌভাগ্য যেন আর ধরে না।অথচ বিশ্বকাপ চলাকালিন সময়েই রাজধানীর বিভিন্ন ভিআইপি সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, আমরা স্টেডিয়ামের পাশেই দেখেছি রিকশার হাওয়া ছেড়ে দেয়া হচ্ছে!


    মিরপুর স্টেডিয়ামের সামনে গ্যালারির শো-পিসের মতো সাজানো রিকশার ডামি


    মিরপুর-১০ থেকে ষ্টেডিয়ামের দিকে যাওয়ার রাস্তায় রিকশার চাকার হাওয়া ছেড়ে দেয়া হচ্ছে

    আর বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার আগেই বিশ্বকাপে ""বাংলাদেশের ঐতিহ্য'' রিকশার চলাচল আরো কয়েকটি রাস্তায় বন্ধ করে দেয়া হলো। তথাকথিত ভিআইপি রোডগুলো থেকে ধারবাহিক ভাবে রিকশা উচ্ছেদের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে গত ২৮ মার্চ সকাল থেকে কাকরাইলের নাইটিঙ্গেল মোড় থেকে মে?চাক, মালিবাগ এবং মগবাজার মোড় হয়ে রামপুরা পর্যন্ত রিকশা চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রতিবাদে রিকশা শ্রমিকরা মুক্তাঙ্গনে সমাবেশ করতে চাইলে সেখানে তাদেরকে দাড়াতে দেয়া হয়নি। সামনের অন্ধকার ভবিষ্যতের আশংকায় দিশেহারা রিকশা শ্রমিকরা উপায়ন্তর না দেখে অবশেষে শুরু করেন ভাঙচুর। সেই ভাঙচুরে স্বাভাবিক ভাবেই গাড়িওয়ালা উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে অফিসগামী পথচারী মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত ভোগান্তির মধ্যে পড়েন। সেই ভোগান্তির চিত্র, খবর পত্রিকার পাতায় বিশদ ভাবে স্থান পেলেও যে নির্মম বাস্তবতায় রিকশা শ্রমিকেরা এই ""তান্ডব'' চালাতে বাধ্য হয়েছেন তা কিন্তু তথাকথিত গণমাধ্যমে স্থান পায়নি। তাই বাস-গাড়ি থেকে তাড়াহুড়া করে নামতে গিয়ে পথচারী আহত হওয়ার খবর ছাপা হলেও, কিংবা গাড়ি-যাত্রী শিশুর কান্নার ছবি ছাপা হলেও রিকশা চালকের অন্ধকার ভবিষ্যতের কথা, বস্তির জীর্ণ ঘরে অপুষ্ট শিশুটির শুকনো মুখের ছবি আমরা পত্রিকার পাতায় দেখিনা। এগুলো গণমাধ্যম না শ্রেণীমাধ্যম?

    অবশ্য কর্মসংস্থানের কোন ব্যাবস্থা না করেই যানজট নিরসনের নামে ঢাকার রাস্তা থেকে রিকশা উঠিয়ে দিলে আমাদের কি? রিকশা ফ্যাশন তো আছেই। রিকশা শ্রমিক অভাবে অনটনে পচে মরলেও রিকশা আমাদের কাছে ক্রমশ ঝলমলে হয়ে উঠছে, রিকশা শ্রমিক "নোংরা', "অসভ্য', "ইতর' কিংবা "ছোটলোক' হলেও ""ঠিক ধরেছেন, রিকশা আর্ট বা রিকশাচিত্রই আসলে বাংলাদেশের রিকশার আসল সৌন্দর্য।''

    http://www.eprothomalo.com/index.php?opt=view&page=33&date=2011-03-22



    ফলে: ""রিকশা হয়তো আর থাকবে না, তবে সৌন্দর্যপ্রিয় কিছু মানুষ আর দেশি ফ্যাশন হাউসগুলে?র উদ্যোগে পোশাক, ঘরসাজানোর উপকরণ এবং ঘরের দেয়ালে রয়ে যাবে এই চিত্র।''



    বাহ! কি মজা! কত উন্নত হয়েছি আমরা। রাজপথ থেকে রিকশা এখন স্থানকরে নিচ্ছে বড়লোকের অন্দরে: ""রিকশার পেছন থেকে অন্দরে জায়গা করে নিয়েছে রিকশা চিত্র। ঘরসাজাতে রিকশা চিত্রের ব্যাবহার এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।''

    http://www.eprothomalo.com/all.php?opt=view&page=42&date=2011-03-22



    ড্রয়িংরুমের দামি সোফাসেট যখন রিকশা-সিট কিংবা রান্না ঘরের কিচেন-ক্যাবিনেট যখন রিকশার বর্ণিল চিত্রে সজ্জিত হবে যখন অলিতে গলিতে সেই রিকশা চালানো রিকশা শ্রমিক ও তার পরিবার অভাবে-অনটনে ধুকে ধুকে মরবে।

    জয় হোক এই পাশবিক নান্দনিকতার!!

    পুনশ্চ: ঢাকার রাস্তায় যানজট, যানজটের পেছনে প্রাইভেট কারের ভূমিকা, শাসক শ্রেণীর নগর পরিকল্পনার বদমাইশি ইত্যাদি নিয়ে মঞ্জুরুল হক এর একটি দারুণ লেখা আছে, নীচের লিংক থেকে লেখাটি পড়ে দেখার অনুরোধ রইল।
    http://on.fb.me/hOzus3
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • অপর বাংলা | ০৪ এপ্রিল ২০১১ | ১৬৯০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ মতামত দিন