এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক

  • ক্লিশিতে শান্ত দিন (কোয়ায়েট্‌ ডেইজ ইন ক্লিশি) - পর্ব - ৪

    হেনরি মিলার :: ভাষান্তর : অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ১৮ জুন ২০১৯ | ১২১৮ বার পঠিত
  • আমি এও জানি যে ফাউস্টের এই কপিটার মধ্যে অল্প অল্প করে কিছু টাকা ও নিয়মিত লুকিয়ে রাখছে, কেননা ব্যাপারটা যাচাই করার জন্য পরে আমি একাধিকবার ওখানে গিয়ে দেখেছি। একবার প্রায় টানা দুদিন ওকে আমার সাথে উপোস করিয়ে রেখেছিলাম, এটা জেনেও যে ওইখানে টাকা রয়েছে। কতদিন ও আমায় টাকা না দিয়ে থাকতে পারে দেখার জন্য আমি যাকে বলে নিরতিশয় উৎসুক।


    আমার মাথা এখন কাজ করছে ক্ষিপ্র গতিতে। আমায় যেটা করতে হবে সেটা হল, ওদের দুজনকে আমার ঘরটার মধ্যে রাখা, ভল্টের থেকে টাকা বের করে আনা, এনে মেয়েটার হাতে দেওয়া, তারপর ও আরেকবার বাথরুমে গেলেই ওর ব্যাগ থেকে টাকাটা নিয়ে গ্যেটের ফাউস্টের ভেতরে আবার রেখে আসা। কার্লকে বরং ওর হাতে পঞ্চাশ ফ্রাঙ্ক দিয়ে দিতে বলব, যেটার কথা কার্ল বলছিল আরকি; ওটা ট্যাক্সি ভাড়ায় চলে যাবে। সকালের আগে ও নিশ্চয়ই দুশো ফ্রাঙ্কের খোঁজ করবে না; যদি সত্যিই ওর টাকার দরকার থাকে, তাহলে যেভাবেই হোক তার ব্যবস্থা করে নেবে, আর যদি তা না হয়, তবে খুব সম্ভব নিজেকে বলবে যে টাকাটা হয়তো ট্যাক্সিতে ফেলে এসেছে। যেটাই হোক না কেন, মোদ্দা কথা, যে অবস্থায় ও এই বাড়িতে ঢুকেছিল সেভাবেই বেরুবে — একটা আচ্ছন্ন ঘোরের মধ্যে। আর এ ব্যাপারে আমি একেবারে নিশ্চিত যে এখান থেকে বেরুবার পথে বাড়ির ঠিকানা দেখার জন্য ও কখনওই দাঁড়াবে না।


    পুরো ছকটা চমৎকারভাবে কাজ করল, এ বাদে ওকে ভাগাবার আগে আমরা দুজনেই ওকে চুদলামও। আসলে গোটা ব্যাপারটাই খুব অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটে গেল। কার্লকে অবাক করে আমি ওকে দুশো ফ্রাঙ্ক দিয়ে দিলাম, ওদিকে কার্লকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওর পকেট থেকে ট্যাক্সি ভাড়া বাবদ পঞ্চাশ ফ্রাঙ্কও খসালাম। একটা বই থেকে ছিঁড়ে নেয়া কাগজের ওপর মেয়েটা তখন পেন্সিল হাতে আরেকটা কবিতা লিখতে ব্যস্ত। আমি বসেছিলাম ডিভানে, আর ও আমার সামনে ন্যাংটো দাঁড়িয়ে, আমার মুখের সামনে তাকিয়ে আছে ওর পাছা। আমার মনে হল, লিখতে থাকা অবস্থায় ওর ফুটোর খাঁজে আঙুল দিয়ে দেখব। খুব আস্তে আস্তে আমি আঙুল ঘোরাচ্ছিলাম, যেন একটা গোলাপের নরম পাপড়ি ছাড়াচ্ছি। ও যেমন হড়বড় করে হিজিবিজি কেটে যাচ্ছিল, তা-ই করতে থাকল, এমনকী সম্মতি বা অসম্মতি সূচক একটা উ আ পর্যন্ত করল না, স্রেফ আমার সুবিধের জন্য পা দুটো একটু ফাঁক করল।


    ইত্যবসরে প্রবল লিঙ্গোত্থান হল আমার।


    আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং জোরে এক ধাক্কায় ঢুকিয়ে দিলাম।


    সামনে ডেস্কের ওপর ও এলিয়ে পড়ে গেল, পেন্সিলটা তখনও ওর হাতে। ‘‘এখানে... এখানে নিয়ে এসো,’’ কার্ল বলছে, কার্ল তখন বিছানায়, ঈল মাছের মতো কিলবিল করে লাফাচ্ছে। আমি ওকে ঘুরিয়ে সামনের দিকে ফেরালাম, আর পা দুটো ধরে তুলে নিয়ে সোজা বিছানায় টেনে আনলাম। মদ্দা শুয়োরের মতো ঘোঁৎ ঘোঁৎ করতে করতে কার্ল সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর ওপর। ওকে ভালোভাবে করতে দিয়ে তারপর আমি আবার পেছন থেকে লাগালাম। এসব শেষ হলে ও একটু ওয়াইন চাইতে যখন আমি গ্লাসে ঢালছি, ও হাসতে শুরু করল। সে এক ভূতুড়ে হাসি, এরকম হাসি আমি কখনও শুনিনি। তারপর হঠাৎ থেমে গিয়ে কাগজ আর পেন্সিল দিতে বলল, একটা প্যাডও, কাগজের নীচে রাখবার জন্য। উঠে বসে বিছানার ধারে পা রেখে আরেকটা কবিতা লিখতে শুরু করে দিল। দুটো কি তিনটে লাইন যখন লেখা হয়েছে, রিভলভার চাইল।


    ‘‘রিভলভার?’’ কার্ল আঁতকে উঠে একেবারে খরগোশের মতো বিছানা থেকে ছিটকে লাফিয়ে এল। ‘‘কীসের রিভলভার?’’


    ‘‘আমার ব্যাগে যেটা আছে,’’ শান্ত স্থিরভাবে বলল। ‘‘আমার এখন কাউকে গুলি করতে ইচ্ছে করছে। দুশো ফ্রাঙ্কে তোমরা ভালোই মস্তি করলে, এখন আমার পালা।’’ বলেই ব্যাগটা হাতে নেবার জন্য এক লাফ। আমরাও ওর ওপর ঝাঁপিয়ে ওকে ঠেলে মেঝেয় ফেললাম। কামড়ে, আঁচড়ে আর সর্বশক্তি দিয়ে লাথি চালাতে লাগল আমাদের ওপর।  


    ওকে প্রতিহত করতে করতে কার্ল বলল, ‘‘ওর ব্যাগটা দ্যাখো...ওখানে কোনও রিভলভার আছে কি না।’’ আমি লাফিয়ে ছোঁ মেরে ব্যাগটা নিলাম, দেখি যে, না, কোনও বন্দুক নেই; একইসাথে ব্যাগ থেকে দুশো ফ্রাঙ্ক বের করে ডেস্কের ওপর পেপার ওয়েটের তলায় লুকিয়ে রাখলাম।


    ‘‘মুখে একটু জল ছেটাও, জলদি,’’ কার্ল বলল, ‘‘মনে হয় ফিট হয়ে গেছে।’’


    আমি ছুটে সিঙ্ক থেকে একটা বড় পাত্র ভরতি করে জল এনে ছুঁড়ে দিলাম ওর মুখে। ডাঙায় পড়া মাছের মতো এপাশ-ওপাশ করতে করতে একটু খাবি খেয়ে উঠে বসল, আর মুখে এক ভূতুড়ে হাসি এনে বলল, ‘‘যথেষ্ট, অনেক হয়েছে... এবার আমাকে যেতে দাও।’’


    মনে মনে বললাম, যাক, শেষমেশ উদ্ধার পেলাম তাহলে। কার্লকে বললাম : ‘‘ওকে লক্ষ রাখো। আমি ওর জিনিসপত্র যা আছে নিয়ে আসছি। জামাকাপড় পরিয়ে একটা ক্যাবে উঠিয়ে দিতে হবে।’’


    গা মুছিয়ে আমাদের পক্ষে যতটা ভালো করে সম্ভব জামাকাপড় পরিয়ে দিলাম। যাবার আগে আবার নতুন করে কিছু শুরু করে কিনা ভেবে আমার কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। কিংবা রাস্তায় যদি বদমায়েশি করে চেঁচামেচি শুরু করে দেয় তো কী হবে।


    শ্যেনদৃষ্টিতে ওকে লক্ষ রেখে আমরাও ঝটপট জামা-প্যান্ট পরে নিলাম। ঠিক যখন আমরা বেরুতে যাব তখনই ডেস্কের ওপর ফেলে যাওয়া সেই আধলেখা কবিতার কাগজটার কথা ওর মনে পড়ল। ওটা হাতড়াতে গিয়ে পেপার ওয়েটের নীচে গুঁজে রাখা দুশো ফ্রাঙ্কে চোখ পড়তেই চেঁচিয়ে উঠল, ‘‘আমার টাকা!’’


    ‘‘বোকার মতো কথা বলো না,’’ হাত দিয়ে ওকে ধরে রেখে শান্তভাবে বললাম, ‘‘আমরা তোমাকে ঠকাব বলে নিশ্চয়ই মনে হয় না তোমার, কী? টাকাটা তুমি তোমার ব্যাগে রেখেছ।’’


    ঝট করে আমার দিকে একটা অন্তর্ভেদী দৃষ্টি ফেলে চোখ নামিয়ে নিল। ‘‘মাফ করো আমাকে,’’ ও বলল, ‘‘খুব নার্ভাস লাগছে আসলে।’’     


    ওকে তাড়া দিয়ে দরজার দিকে ঠেলতে ঠেলতে কার্ল বলল, ‘‘জানি, বলেছ তো আগে।’’ সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে কার্ল ইংরিজিতে আমাকে বলল, ‘‘চালাকিটা তোমার ছিল, জো।’’


    আমরা যখন ট্যাক্সি ডাকছি, কার্ল জিগ্যেস করল, ‘‘তুমি থাকো কোথায়?’’


    ‘‘কোথাও না,’’ ও বলল। ‘‘খুব ক্লান্ত লাগছে। ট্যাক্সিকে বলে দাও আমাকে একটা হোটেলে নামিয়ে দিতে, যেকোনও হোটেল।’’


    কার্লের বোধহয় মায়া হল। জিগ্যেস করল, ‘‘তুমি কি চাও আমরা তোমার সঙ্গে যাই?’’


    ‘‘না,’’ ও বলল। ‘‘আমি ঘুমোব।’’


    ‘‘কাম অন,’’ কার্লকে সরিয়ে এনে বললাম। ‘‘শি উইল বি অল রাইট।’’


     


    দড়াম করে দরজা লাগিয়ে হাত নেড়ে গুড নাইট জানিয়ে শুয়ে পড়লাম।


    ক্রমশ মিলিয়ে যাওয়া ট্যাক্সিটার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল কার্ল।


    ‘‘কী, ব্যাপার কী বলো তো তোমার? তুমি নিশ্চয়ই ওকে নিয়ে চিন্তিত নও, নাকি? সত্যিই যদি ও পাগল হয় তাহলে না তো ওর টাকার দরকার আছে, না হোটেলের।’’


    ‘‘আমি জানি, কিন্তু, কিন্তু... শোনো, জো, তুমি হচ্ছ একটা নিষ্ঠুর, কুকুরের বাচ্চা। আর হ্যাঁ, টাকা! আমরা যথেষ্ট ভালোভাবে ওকে লাগিয়েছি।’’


    ‘‘হ্যাঁ,’’ আমি বললাম, ‘‘কপাল ভালো যে আমি জানতাম তুমি কোথায় তোমার মালকড়ি রাখছ।’’


    ‘‘মানে, মানে ওটা আমার টাকা?’’ আমি কী বলতে চাইছি তা হঠাৎ বুঝতে পেরে বলল, ‘‘হ্যাঁ, শাশ্বত নারীত্ব চিরকাল আমাদের ঊর্ধ্বে টেনে তোলে, বিখ্যাত কবিতা, ফাউস্ট।’’    


    বলতে বলতে দেয়ালের দিকে গিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল, তারপর বেজায় জোরে হাসতে থাকল পাগলের মতো।


    ‘‘আমি ভাবতাম আমিই হচ্ছি সবচেয়ে সেয়ানা,’’ কার্ল বলল, ‘‘কিন্তু আসলে তো একেবারেই নাদান। শোনো, কাল আমরা টাকাটা খরচা করব। ঠিকাছে? ভালোমন্দ খাব কোথাও গিয়ে।


    তোমাকে দারুণ একটা রেস্তোরাঁয় নিয়ে যাব দেখো।’’   


    ‘‘আচ্ছা, ভালো কথা,’’ আমি বললাম, ‘‘কবিতাগুলো একটাও পদের ছিল? আমার পড়ার সুযোগ হয়নি। মানে বাথরুমের লেখাগুলোর কথা বলছি।’’


    ‘‘একটা লাইন ভালো,’’ কার্ল বলল, ‘‘বাকিগুলো সব লুনাটিক্যাল।’’     


    ‘‘লুনাটিক্যাল? ধুর! ইংরিজিতে এরকম কোনও শব্দই নেই।’’


    ‘‘সে হতে পারে, কিন্তু লেখাগুলো ওরকমই। ক্রেজি শব্দটা দিয়ে এটাকে ঠিক ব্যাখ্যা করা যায় না। তোমাকে তাহলে এর জন্য নতুন একটা শব্দ তৈরি করতে হবে।


    লুনাটিক্যাল। শব্দটা ভাল্লেগেছে বেশ। কোথাও ব্যবহার করব এটাকে... আর এখন তোমাকে আমি অন্য একটা জিনিস বলতে যাচ্ছি। জো, রিভলভারের কথাটা মনে আছে?’’


    ‘‘কীসের রিভলভার? কোনও রিভলভারই ছিল না।’’


    ‘‘ছিল, ছিল,’’ বিচিত্র একটা হাসি দেখিয়ে বলল, ‘‘পাউরুটির ডাব্বায় লুকিয়ে রেখেছিলাম।’’


    ‘‘তারমানে তুমি আগেই ওর ব্যাগ হাতিয়েছ, অ্যাঁ?’’


    কার্ল মাথা নীচু করে বলল, ‘‘আমি জাস্ট কিছু খুচরো খুঁজছিলাম,’’ যেন এটাতে খুব লজ্জা পেয়েছে ও।


    ‘‘বিশ্বাস হয় না,’’ আমি বললাম, ‘‘অন্য কোনও কারণ তো নিশ্চয়ই আছে।’’


    ‘‘তুমি বুদ্ধিমান,’’ বেশ ফুর্তির সাথে চট করে বলল, ‘‘কিন্তু মাঝামাঝে তুমি দু একটা জিনিস ভুলে যাও, জো।


    ফোর্টের ওখানে যখন ও পেচ্ছাব করতে বসল, মনে আছে? তখন ওর ব্যাগটা আমাকে ধরার জন্য দিয়েছিল। ওটার ভেতরে কেমন একটা শক্ত কিছু যেন টের পাচ্ছিলাম, একটা বন্দুকের মতো কিছু। তোমাকে বলিনি কারণ তোমাকে হঠাৎ ভয় পাইয়ে দিতে চাইনি। কিন্তু যখন তুমি ঘুরে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরলে তখন আমি ঘাবড়ে গেলাম। তারপর ও যখন এখানে বাথরুমে গেল, আমি ব্যাগ খুলে বন্দুকটা বের করি। পুরো দানাভরতি ছিল।


    এই যে বুলেটগুলো, তুমি যদি বিশ্বাস না করো...’’


    পুরো হতভম্ব হয়ে আমি বুলেটগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম। শীতল একটা স্রোত আমার মেরুদাঁড়া দিয়ে ওপর নীচে বয়ে গেল।


    ‘‘নির্ঘাৎ আস্ত পাগল মেয়েটা,’’ একটা স্বস্তির দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললাম।  


    ‘‘না,’’ কার্ল বলল, ‘‘পুরোপুরি পাগল ও নয়। ও খেলছে। আর ওর কবিতাগুলোও নিছক পাগলামি নয় — ওগুলো লুনাটিক্যাল। খুব সম্ভব ওকে হয়তো হিপ্নোটাইজ করা হয়েছে।


    কেউ হয়তো ওকে ঘুম পাড়িয়ে, হাতে বন্দুকটা ধরিয়ে বলেছে দুশো ফ্রাঙ্ক নিয়ে আসতে।’’  


    আমি ককিয়ে উঠে বললাম, ‘‘এ তো পুরো পাগলের প্রলাপ!’’


    ও কোনও উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাথা নীচু করে হেঁটে গেল। ‘‘যেটা আমাকে ধন্দে ফেলে দিচ্ছে,’’ ওপরে তাকিয়ে বলল, ‘‘সেটা হল — রিভলভারের কথাটা ও এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেল কীভাবে?


    আর যখন তুমি ওকে টাকার ব্যাপারে মিথ্যে বললে তখনই বা কেন ও ব্যাগ খুলে দেখল না? আমার মনে হয়, ও বুঝতে পেরে গেছিল রিভলভারটা গেছে, টাকাটাও গেছে।


    আমার মনে হয় ও ভয় পাচ্ছিল আমাদেরকে। আর এখন আমার আবার ভয় হচ্ছে। আজকে রাতের জন্য একটা হোটেলে চলে যাওয়াই ভালো মনে হয়। কালকে তুমি না হয় কোথাও একটা ঘুরতে চলে যেও — কটা দিন একটু দূরে দূরে থাকাই ভালো।’’


    আর একটাও শব্দ খরচ না করে আমরা স্থানত্যাগ করলাম আর দ্রুত হাঁটতে থাকলাম মঁমার্তের দিকে। সংক্রামক আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম আমরা...


    এই ছোট্ট ঘটনাটিই আমাদের লুক্সেমবুর্গে আচমকা যাত্রার কারণ। কিন্তু আমার গল্প থেকে আমি বেশ ক মাস এগিয়ে গেছি। বরং আমাদের মেনাজ আ ত্রোয়াতে২০ ফেরা যাক।


    কোলেৎ, সেই গৃহহীন অনাথিনী, ক্রমশই সিন্ড্রেলা, রক্ষিতা আর রাধুনীর এক মিশ্রণ হয়ে উঠছিল।  


    দাঁত মাজার কারিকুরি থেকে শুরু করে আমাদের ওকে সবই শেখাতে হচ্ছিল। এমন এক বেয়াড়া বয়েসে ও পৌঁছেছিল, সবসময় জিনিসপত্র হাত থেকে ফেলে দিচ্ছে, কথায় কথায় হোঁচট খাচ্ছে, টুকিটাকি জিনিস হারিয়ে ফেলছে, এরকমই সব। মাঝেমাঝেই টানা দু চার দিন উধাও হয়ে যেত। এই সময়টাতে ও যে কী করত, অসম্ভব ছিল তা বের করা।


    যত আমরা ওকে এ নিয়ে জিগ্যেস করতাম ততোই নিস্পৃহ আর চুপ হয়ে যেত। কখনও সকালে হাঁটার জন্য বেরুত আর রাস্তায় পাওয়া কোনও দলছুট বেড়াল বা কুকুরছানা নিয়ে মাঝরাত্তিরে ফিরে আসত। একবার আমরা গোটা দুপুর ওর পিছু নিয়েছিলাম, জাস্ট এটা দেখার জন্য যে করেটা কী। মনে হচ্ছিল ঘুমের মধ্যে হেঁটে যাওয়া একটা মানুষের পিছু নিয়েছি আমরা।


    এক রাস্তা থেকে আরেক রাস্তায় ও শুধু এলোমেলো ঘুরে গেল, কখনও একদৃষ্টে চেয়ে রইল কোনও দোকানের দিকে, কখনও রাস্তার বেঞ্চে বসে থাকল, পাখিগুলোকে দুটো খাবার দিল, নিজের জন্য একটা ললিপপ কিনল, ওটা শেষ হবার আগে একটু থেমে গেল যেন কী এক ঘোরের মধ্যে আছে, তারপর আবার চমকে উঠে সেই আগের মতো লক্ষ্যহীন, উদ্দেশ্যহীন। পাঁচ ঘন্টা ওর পেছন পেছন ঘুরে বুঝতে পেরেছি আমরা একটা বাচ্চার দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছি।  


    কোলেৎকে কার্লের ভালো লেগেছিল ওর সরল মনের জন্য।


    কার্ল নিজেও বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল ওর যৌনতাহীন জীবনে। আর একটু বিরক্তও, কেননা কোলেৎ ওর পুরো ফাঁকা সময়টা নিয়ে নিচ্ছিল। লেখালিখির সব ভাবনা মাথা থেকে চলে গেছিল ওর, প্রথমত টাইপমেশিনটা বন্ধকে রাখা ছিল, দ্বিতীয়ত, নিজের জন্য সময় বলতে ওর আর কিছুই ছিল না। বেচারা কোলেৎ, নিজেকে নিয়ে যে সে কী করবে তার কোনও ধারণাই ওর ছিল না। মাথা নষ্ট করে সারা দুপুর ও শুয়ে কাটাত, আর কার্ল ফিরে এলে বাকিটুকুও নষ্ট করার জন্য তৈরি হত। কার্ল সাধারণত বাড়ি ফিরত রাত তিনটের দিকে। আর বেশিরভাগ দিনই সন্ধে সাতটার আগে বিছানা ছাড়ত না, উঠত ঠিক খেয়েদেয়ে কাজে দৌড়বার সময়। এইভাবে চিড়েচ্যাপ্টা হতে হতে একসময় কার্ল হাতজোড় করে বলত, কোলেৎকে যেন আমিও একটু করি। ‘‘পুরো চুদে যাচ্ছি আমি,’’ কার্ল বলত, ‘‘গবেট মেয়েটা শালা, মাথার সব ঘিলু ফুটোতে গুজে বসে আছে।’’    


    কিন্তু কোলেৎ-এর আমার প্রতি কোনও আকর্ষণ ছিল না। আমি প্রেমে পড়েছি নিসের, কাফে ওয়েপলারে এখন ও প্রায়ই আসে। ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছি আমরা। সেখানে কোনও টাকার ব্যাপার নেই। হ্যাঁ, টুকটাক গিফট দিই বটে, কিন্তু সেটা অন্য জিনিস।       


    মাঝেমাঝেই ওকে দুপুরের দিকটা ফাঁকা রাখতে রাজি করিয়ে নিতাম। স্যেনের দিকে ছোটখাটো কোনও জায়গায় যেতাম আমরা, অথবা ট্রেনে চেপে কাছেপিঠে কোনও জঙ্গলে, যেখানে আমরা ঘাসের ওপর শুতাম আর আমাদের কামনার পূর্ণ চরিতার্থতায় মিলিত হতাম। ওর অতীত নিয়ে কখনও উত্তেজিত করিনি ওকে। আমরা সবসময় কথা বলতাম শুধু ভবিষ্যৎ নিয়ে। অন্তত ও তো তা-ই করত। হাজারো ফরাসি মেয়ের মতো ওরও স্বপ্ন ছিল দেশের কোথাও নিজের একটা ছোট্ট বাড়ির, সেটা মিডির কোনও জায়গাতেই বেশি পছন্দ।


    প্যারিসের প্রতি ওর খুব একটা কোনও টান ছিল না। এটা খুব ঘিঞ্জি, নোংরা, ও বলত।


    ‘‘আর সময় কাটাবার জন্য তুমি নিজে কী করবে?’’ আমি একবার জিগ্যেস করেছিলাম।   


    ‘‘আমি কী করব?’’ ও অবাক হয়ে বলেছিল।


    ‘‘আমি কিচ্ছু করব না। শুধু বেঁচে থাকব।’’


    কী অসাধারণ ভাবনা! কত স্বাভাবিক একটা চিন্তা। ওর এই ঔদাসীন্য, অলস বিমুখতা, এই অনাসক্তিকে ঈর্ষা হত আমার। আমি ওকে বলতাম এ নিয়ে আরও বিস্তারে বলতে, মানে, এই কিচ্ছু না করা নিয়ে। এ ছিল সেই অনবদ্য আদর্শ যা নিয়ে আমি কখনও নাড়াচাড়া করিনি। এতে সফল হতে গেলে হৃদয় শূন্য করে নিতে হবে, বা পূর্ণ। শূন্য করে নেওয়াই, আমার মনে হয়, ভালো হবে।


    নিসকে শুধু খেতে দেখাটাই ভীষণ প্রেরণাদায়ক। খাবার থেকে খুব যত্নে বেছে নেয়া প্রত্যেকটা টুকরোকে ও উপভোগ করত। যত্ন বলতে আমি ক্যালোরি বা ভিটামিনের সাথে কোনও সম্পর্কের কথা বলছি না। নিস যত্নবান ছিল নিজের পছন্দের জিনিসকে বেছে নিতে, এবং যা তার সহগামী হবে, কারণ সে তাদের স্বাদ নেবে তারিয়ে তারিয়ে। ওর খাওয়াটাকে ও যেন টেনে নিয়ে যেতে পারত অনন্তকাল, অসাধারণ রসবোধ বাড়ত ধাপে ধাপে, ওর আলস্য হয়ে উঠত আরও আরও মোহনীয়, মন হয়ে উঠত আরও সূক্ষ্ম, জীবন্ত, উজ্জ্বল।


    সুখাদ্য, সুবাক্য, সুসঙ্গম — দিনগুলো কাটাতে এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে। কোথাও কোনও জীর্ণতা নেই যা ওর বিচারবোধকে গিলে খাবে, এমন কোনও উৎকন্ঠা নেই যা সে ছুঁড়ে ফেলতে পারে না। শুধু স্রোতে ভেসে থাকা, আর কিচ্ছু নয়। ও সন্তান উৎপাদন করবে না, জনগণের হিতার্থে কোনও অবদানই থাকবে না ওর, জগতের ক্রম অগ্রসরতায় কোনও চিহ্ন ও ছেড়ে যাবে না।





    ক্রমশঃ

    পরিশিষ্ট

    ২০. মেনাজ আ ত্রোয়া (Ménage à trios) : তিনজনের একত্রে সংসার যাপন। যেখানে তিনজন একই ছাদের নীচে একসাথে থেকে একে অপরের সাথে প্রেম এবং/অথবা যৌনতার সম্পর্কে লিপ্ত হয়।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ১৮ জুন ২০১৯ | ১২১৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন