এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক

  • ক্লিশিতে শান্ত দিন (কোয়ায়েট্‌ ডেইজ ইন ক্লিশি) - পর্ব - ৬

    হেনরি মিলার :: ভাষান্তর : অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ১১ আগস্ট ২০১৯ | ১৩৩১ বার পঠিত
  • ‘‘তোমরা ওদেরকে চেক দিতে পারবে না?’’ কাতরভাবে বলল।


    শুনে কার্ল তো হেসেই খুন। ও বলতে যাচ্ছিল যে আমাদের চেক বইও নেই, তখনই আমি মাঝখানে আটকে বললাম, ‘‘নিশ্চয়ই, দারুণ আইডিয়া... তোমাদের সবাইকে একটা করে চেক দেব, কেমন?’’ একটাও কথা না বলে আমি কার্লের ঘরে গেলাম আর ওর পুরনো একটা চেক বই নিয়ে ফিরে এলাম। ওর চমৎকার পার্কার পেনটা এনে ওর হাতে দিলাম।


    এই সময় কার্ল ওর ধুরন্ধর চালাকি দেখাল।


    ওর চেকবই বের করার জন্য এবং ওর ব্যাপারে নাক গলানোর জন্য আমার ওপর রাগের ভান করে বলল, ‘‘সবসময় এটাই হয়।’’ (অবশ্যই ফ্রেঞ্চে বলল কথাগুলো) ‘‘এই সমস্ত বোকামির জন্য আমিই সবসময় টাকা দিই। তুমি নিজের চেকবইটা কেন হাতে করে আনলে না?’’


    এতে আমি খুব লজ্জিত মুখে জানালাম আমার অ্যাকাউন্টে কিছুই নেই। তাও কার্ল আপত্তি জানাতে থাকল, বা ভান করল আরকি।


    ‘‘ওরা কাল অবধি কেন অপেক্ষা করছে না?’’ আদ্রিয়েনের দিকে ফিরে কার্ল বলল। ‘‘ওরা কি আমাদেরকে বিশ্বাস করে না?’’


    ‘‘কেন বিশ্বাস করব আমরা?’’ অন্য একটা মেয়ে বলল। ‘‘একটু আগেই তুমি এমন ভান করছিলে যে তোমার কাছে কিছুই নেই। এখন তুমি আমাদেরকে কালকে অবধি অপেক্ষা করাতে চাও।


    ওসব চলবে না আমাদের সাথে।’’


    ‘‘তো, ঠিকাছে, তাহলে বেরিয়ে যাও,’’ মাটিতে চেকবইটা ছুঁড়ে কার্ল বলল।


    ‘‘ছোটলোকামি ক’রো না,’’ আদ্রিয়েন ককিয়ে বলল, ‘‘আমাদের হাতে সবাইকে একশো ফ্রাঙ্ক করে ধরিয়ে দাও আমরা আর একটা কথাও বলব না।’’


    ‘‘সবাইকে একশো ফ্রাঙ্ক করে?’’


    ‘‘হ্যাঁ, অবশ্যই,’’ ও বলল, ‘‘খুব বেশি তো নয়।’’


    ‘‘দিয়ে দাও কার্ল,’’ আমি বললাম, ‘‘অত কঞ্জুস হয়ো না।


    আর তাছাড়া, দু একদিনের মধ্যে আমার ভাগের টাকাটা দিয়েই দেব তোমাকে।’’


    ‘‘ওটা তুমি সবসময়েই বলো,’’ কার্ল বলল। 


    ‘‘ইয়ার্কি ছাড়ো,’’ আমি বললাম, ইংরিজিতে। ‘‘চেক লিখে বিদেয় করো ওদের।’’


    ‘‘বিদেয় করব? চেক দেবার পর চলে যেতে দেব? নো স্যর, আমার টাকার পুরো দাম আমি চাই, সে চেকগুলো যতই ফালতু হোক। ওরা তো আর সেটা জানে না। এত সহজে ওদের যেতে দিলে ওরা মরা ইঁদুরের গন্ধ পাবে না?


    ‘‘এই যে, তুমি,’’ হাতের চেকটা নেড়ে একটা মেয়েকে দেখিয়ে কার্ল চেঁচিয়ে বলল। ‘‘এর জন্য আমি কী পাব? আমি স্পেশাল কিছু চাই, শুধু পাতি শুলে হবে না, হুঁ।’’


    কার্ল চেক দিতে থাকল। পুরো ন্যাংটো হয়ে হাতে চেক নিয়ে দাঁড়িয়ে, মজার লাগছে দেখতে। এমনকী চেকগুলো যদি সত্যিকারেরও হত, এভাবে দেখলে মনে হত নকল। সম্ভবত এর কারণ আমরা সবাই-ই ন্যাংটো।


    মনে হয় মেয়েগুলোরও তা-ই মনে হচ্ছে যে, এই টাকা দেওয়া আসলে নকল দেওয়া, ধাপ্পাবাজি। শুধু আদ্রিয়েনের নয়, ও আমাদেরকে বিশ্বাস করে।


    আমি শুধু মনে মনে প্রার্থনা করে যাচ্ছিলাম যে ওরা যেন নিজেদের মতো কাজ করে যায়, যেন জোর করে যন্ত্রণাদায়ক ‘ফাকিং’ রুটিনে নামতে না হয় আমাদের। 


    আমি ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। জিভ বেরিয়ে গেছিল। আমাকে গায়ে-গতরে খাটাতে হলে, এমনকী ডান্ডাটুকু দাঁড় করাতে হলেও অনেকদূর মেহনত করতে হত ওদের। অন্যদিকে, কার্ল ভাব করছে এমন যে সত্যিই যেন তিনশো ফ্রাঙ্ক দান করে দিয়েছে।


    সেই টাকার বিনিময়ে ওর কিছু চাই, এমন কিছু যা অদ্ভুত।


    ওরা যখন নিজেদের মধ্যে এসব নিয়ে কথাবার্তা বলছে আমি তখন সোজা বিছানায়। ওই পরিস্থিতি থেকে মানসিকভাবে তখন আমি এতোটাই দূরে যে কদিন আগে মনে আসা একটা গল্পের ভাবনায় ডুবে গেছি।


    একটা খুন নিয়ে গল্পটা। চমৎকার লাগত যদি এখন ন্যারেটিভটা লিখতে বসতে পারতাম আর সেই মাতাল খুনির ওপর মনোযোগ দিতে পারতাম যাকে তার স্ত্রীর মুণ্ডুহীন ধড়ের সামনে বসিয়ে রেখেছি, যে স্ত্রীকে সে কখনও ভালোবাসেনি। আমি হয়তো খবরের কাগজের খুনের ঘটনাগুলো নিয়ে বসব, দুটোকে মিলিয়ে দেখব, তারপর নিজের মতো করে রূপ দেব খুনটার, যখন টেবিলে গড়িয়ে আসবে মাথাটা। এটা মনে হয় দারুণ হবে, হাতহীন, পা হীন একটা লোক চাকাঅলা পাটাতনে চেপে রাতের প্লাটফর্ম ধরে যাচ্ছে, তার মাথাটা পথচলতি কোনও মানুষের হাঁটুর কাছাকাছি। আতঙ্কের একটা পরিবেশ আমি চাইছি কারণ চমৎকার একটা প্রহসনের ভাবনা মাথায় এসেছে, ওটা দিয়েই শেষ করব লেখাটা।  


    অল্প সময়ের বিরতিতে যেটুকু চিন্তা করতে পারলাম তাতেই কদিন আগের হারানো মুডটা ফিরে এল, সেই রিভলভারধারিণীর আগমনে যেটা চটকে গেছিল।


    আদ্রিয়েনের খোঁচায় ঘুমটা ভেঙে গেল, ও আমার পাশে নিজের জন্য জায়গা করে নিয়েছে। কানের সামনে ফিসফিস করে কিছু একটা বলছে আদ্রিয়েন। টাকা নিয়ে আবার কিছু মনে হয়। আমি ওকে আবার বলতে বললাম, আর একইসাথে গল্পটা নিয়ে তক্ষুনি আসা ভাবনাটা যাতে হারিয়ে না যায় তাই নিজেও বলতে থাকলাম — ‘‘টেবিলের ওপর মাথা গড়িয়ে আসছে — মাথা গড়িয়ে...চাকার ওপর মানুষ...চাকা...পা... লক্ষ লক্ষ পা...’’


    ‘‘ওরা জানতে চাইছে তোমরা কি ট্যাক্সি ভাড়ার জন্যে কিছু খুচরোও দেবে না, অনেকটা দূরে থাকে তো ওরা।’’


    উদাসীনভাবে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘‘অনেক দূরে?


    কত দূরে?’’ (মনে করছি — চাকা, পা, গড়িয়ে আসা মাথা... বাক্যের মাঝামাঝি শুরু হয়েছে)


    ‘‘মেনিলমঁতা,’’২৩ আদ্রিয়েন বলল।


    বললাম, ‘‘আমাকে পেন্সিল আর কাগজ দাও তো একটা — টেবিলে আছে।’’


    ‘‘মেনিলমঁতা... মেনিলমঁতা...’’ পাগলের মতো বলতে বলতে হিজিবিজি করে কিছু শব্দ লিখতে থাকলাম, রাবারের চাকা, কাঠের মাথা, স্ক্রু লাগানো পা, এইসব।   


    ‘‘কী করছ?’’ হ্যাঁচকা টান মেরে হিস হিস করে আদ্রিয়েন বলল, ‘‘হয়েছেটা কী তোমার?’’ 


    ‘‘পুরো মাথা খারাপ হয়ে গেছে,’’ বিছানা থেকে উঠে হতাশ ভাবে হাত তুলে চেঁচিয়ে বলল আদ্রিয়েন।


    ‘‘আর আরেকজন কোথায়?’’ কার্লের খোঁজ করে বলল।


    ‘‘হে ভগবান,’’ যেন অনেক দূর থেকে ওকে বলতে শুনলাম, ‘‘ও ঘুমোচ্ছে।’’ তারপর, অনেকক্ষণ থেমে : ‘‘ঝাঁটা মারি এদের মুখে। চলো এখান থেকে। একটা মাতাল আর একটা পাগল।  


    আমরা শুধু শুধু সময় নষ্ট করছি। বিদেশিগুলো এরকমই — সবসময় অন্য জিনিস নিয়েই এরা ভাবে। কিছু করতে জানে না, শুধু সুড়সুড়ি দিতে পারে।’’


    সুড়সুড়ি। এই শব্দটাও লিখে রাখি। ঠিক মনে পড়ছে না ফরাসিতে ও কী বলল, তবে যা-ই বলে থাক, এটা ছিল বিস্মৃত কোনও বন্ধুকে ফিরিয়ে আনা। সুড়সুড়ি। বহুকাল এই শব্দটা ব্যবহার করিনি। তখনই আরেকটা শব্দ মনে এল, এটাও খুব অল্প ব্যবহার করেছি : মিসলিং। এর মানে কী আমি জানি না। তাতে কী? কোথাও এটাকে ঠিক বসিয়ে দেব।


    আমার শব্দতালিকা থেকে অনেক অনেক শব্দ বেরিয়ে যাচ্ছে, দীর্ঘদিন বিদেশে থাকার ফল।


    পেছনে হেলান দিয়ে আমি দেখি ওরা চলে যেতে প্রস্তুত। এটা যেন বক্সে বসে স্টেজ পারফরমেন্স দেখা। পক্ষাঘাতগ্রস্তের মতো নিজের হুইলচেয়ারে বসে অনুষ্ঠান উপভোগ করছি। ওদের মধ্যে কেউ যদি আমার মুখে এক গামলা জল ছুঁড়ে দেবে বলে ভাবে, তাহলেও আমি একচুলও নড়ব না। বড়জোর একটু কেঁপে উঠব, আর হাসব — যেভাবে কেউ মজাদার ভঙ্গীতে হাসে।


    (সেরকম কিছু কি ছিল?) আমি শুধু চেয়েছি ওরা চলে যাক আর আমাকে একটু চিন্তামগ্ন থাকতে দিক। আমার কাছে কয়েন থাকলে ছুঁড়ে মারতাম ওদেরকে।


    যেন এক অনন্তকাল পর ওরা দরজার দিকে এগোল।


    আদ্রিয়েন বহুদূর থেকে হাওয়ায় একটা চুমু ভাসিয়ে দিল, ওর ভঙ্গিমা এতোটাই অবাস্তব যে প্রলম্বিত অবস্থায় শূন্যে ভেসে থাকা ওর বাহু দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম; একটা লম্বা করিডরে সে হাত আবছা হতে হতে যেন সরু ফানেলের মুখে ঢুকে যাচ্ছে, মণিবন্ধের কাছে হাতটা তখনও ভাঁজ, কিন্তু আরও আবছা, আরও স্তিমিত, শেষ অবধি একটুকরো খড়ের মতো পাতলা হয়ে গেল।


    ‘‘বেজম্মা শালা শুয়ার কোথাকার,’’ ওদের মধ্যে একটা মেয়ে বলল আর তারপর দরজাটা দড়াম করে বন্ধ হতেই আমি নিজেকে বলতে শুনলাম, ‘‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস। বেজম্মা। আর তুই কী? ঘেয়ো কুত্তী শালা। নেশাখোর...’’


    হঠাৎ হুঁশ এলে বলি, ‘‘শিট, এসব কী বলছি?’’   


    চাকা, পা, গড়িয়ে আসা মাথা... বেশ বেশ। কালকের দিনটা আর পাঁচটা দিনের মতোই আরেকটা দিন, আরও ভালো একটা দিন, আরও রসালো, আরও তাজা। প্লাটফর্মের ওপর গড়াতে গড়াতে লোকটা ক্যানারসির২৪ শেষ সেতুস্তম্ভের কাছে আসবে। তার মুখ ভরতি হেরিং মাছ।      


    আবার খিদে পেয়ে গেল। উঠে খোঁজ করলাম স্যান্ডউইচের অবশিষ্ট কিছু আছে কিনা। টেবিলে একটা টুকরোও নেই। অন্যমনস্কভাবে বাথরুমে ঢুকেছি, ভাবছি পেচ্ছাব করব। দেখি দু ফালি পাউরুটি, কয়েক টুকরো চীজ আর ছড়ে যাওয়া ক’টা অলিভ এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে। দেখে মনে হচ্ছে, যেন নিতান্ত অরুচিতে কেউ ছুঁড়ে ফেলেছে। 


    একটুকরো রুটি তুলে দেখলাম আদৌ খাওয়া যাবে নাকি। কারুর রাগী পায়ে পিষ্ট হয়ে গেছে। অল্প একটু সর্ষে লেগে ওতে। সর্ষেই তো? বরং আরেকটা দেখা যাক। ধ্বংসের মুখ থেকে একটা ঠিকঠাক পরিষ্কার টুকরো তুলে আনলাম, ভেজা মেঝেতে সপসপে ভেজা একটা ছোট্ট টুকরো, যাতে এক টুকরো চীজ চেপ্টে আছে। বেসিনের পাশে একটা গ্লাসে একফোঁটা ওয়াইন দেখলাম। গলায় ঢেলে, তারপর সন্তর্পণে কামড় দিলাম। খারাপ নয় একেবারে। উলটে, বেশ ভালোই লাগছে। ক্ষুধার্ত কিংবা অনুপ্রাণিত মানুষকে জীবাণুরা উত্যক্ত করে না। একেবারেই পচে গেছে মনে হয়, এই বিরক্তিটা আসছে ভেজা সেলোফেনটা থেকে আর শেষ কে এটা ধরেছিল ভেবে। ঝট করে পেছনে ঘষে মুছে নিলাম একবার। তারপর গিলে ফেললাম। আর তবে কীসের দুঃখ? আশেপাশে দেখলাম সিগারেট পাই কিনা। কয়েকটা পোড়া টুকরোই রয়েছে। সবথেকে বড় টুকরোটা বেছে নিয়ে জ্বাললাম। চমৎকার গন্ধ। আমেরিকার স’ ডাস্টের মতো নয়। একেবারে খাঁটি তামাক। অনেকটা কার্লের গলোয়াজ ব্লুয়ের২৫ মতো।      


    আচ্ছা কী নিয়ে যেন ভাবছিলাম আমি?


    রান্নাঘরে টেবিলে বসে পা দোলাতে লাগলাম। কী হল তারপর?


    কিছুই দেখি মাথায় আসছে না। আমার কিন্তু দারুণ লাগল এটা।


    সত্যিই তো, চিন্তার কী আছে?


    হ্যাঁ, অনেকটা সময়। বস্তুত বেশ ক’টা দিন। মাত্র ক’দিন আগে আমরা এইখানটায় বসেছিলাম, অবাক হয়ে ভাবছিলাম কোথায় যাব। যেন গতকালকেই।


    অথবা একবছর। কী আসে যায় তাতে? একজন ফুলে ফেঁপে উঠল, আর আরেকজন ভেঙে পড়ল। সময়ও ভাঙল। বেশ্যারা ভেঙে পড়ল। সবকিছু ভেঙে গেল। ভেঙে গেল গনোরিয়ার ভেতর।


    জানলার ঝনকাঠে বসে একটা সকালবেলার পাখি ডাকছে।


    মনোরমভাবে, তন্দ্রাবশে, মনে পড়ল এইভাবে ব্রুকলিন হাইটে বসেছিলাম ক’বছর আগে। অন্য একটা জীবন ছিল সেখানে। হয়তো আর কখনও ব্রুকলিন দেখা হবে না। দেখা হবে না ক্যানারসি, শেল্টার আইল্যান্ড, মনটক পয়েন্ট কিংবা সীককাস, পোকোটোপগ লেক, অথবা নেভারসিঙ্ক নদী। স্ক্যালপ, বেকন, হ্যাডক কিংবা মাউন্টেন অয়েস্টারও আর খাওয়া হবে না হয়তো।  


    অদ্ভুত, মানুষ যে কীভাবে তলানিতে বসে বসে আধসেদ্ধ হয় আর ভাবে এটাই তার ঘর। যতক্ষণ না কেউ এসে বলছে মিনেহাহা কিংবা ওয়াল্লা ওয়াল্লা। ঘর। শেষমেশ ঘর রইলে তবেই তো ঘর থাকে।  


    কোথায় তুমি তোমার টুপি ঝুলিয়েছ সেটা অন্য ব্যাপার। অনেক দূরের মানে ও বলেছিল মেনিলমঁতা। ওটা কিন্তু খুব একটা দূর নয়। বরং চীন অনেক দূরে। অথবা মোজাম্বিক।


    সোনামণি, চিরটাকাল এভাবে ভেসে বেড়াতে হবে। প্যারিস বড় নোংরা জায়গা। হয়তো সেখানে কিছু রয়ে গেছে তার।


    লুক্সেমবুর্গ যাওয়া যায়। মাথা খারাপ নাকি, কত জায়গা রয়েছে যাবার। যেমন, বালি, কিংবা ক্যারোলিন। পাগল, সবসময় খালি টাকার কথা বলে যাবে। টাকা। টাকা। টাকা। কোনও টাকা নেই। অনেক অনেক টাকা। দূরে কোথাও, অনেক দূরে। বই নেই, টাইপরাইটার নেই, কিচ্ছু নেই। কোনও কথা নেই, কোনও কাজ নেই। শুধু স্রোতে ভেসে যাও। নিস মাগীটার সাথে।


    ফুটো ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। কী জীবন মাইরি! হুঁ হুঁ, সুড়সুড়ি — ভুললে চলবে না।


    হাই তুলে, হাত পা ছড়িয়ে, পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ছি আমি।


    ফুরিয়ে যাচ্ছি একটা সরু দাগের মতো। মহাজাগতিক নরককুণ্ডের ভেতর তলিয়ে যাচ্ছি আরও। অদ্ভুত সূর্যালোকিত জলের গভীরে সাঁতরে যায় সমুদ্রদৈত্য। জীবন যেমন চলার চলতে থাকে, সর্বত্র। কাঁটায় কাঁটায় ঠিক দশটায় ব্রেকফাস্ট। হাতকাটা, পা কাটা একটা লোক দাঁত দিয়ে একটা ডান্ডা বাঁকিয়ে দিচ্ছে। ওই উঁচু স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার থেকে স্বতঃপরিবর্তনশীল গতিতে পড়ছি। লীলায়িত ভঙ্গিতে দীর্ঘ পাক খেয়ে খেয়ে নামছে জুতোর ফিতে। একজন মহিলা শরীরে গভীর ক্ষত নিয়ে তার ছিন্ন মাথাটা লাগাতে মরিয়া। সেজন্য তার টাকা চাই।  


    কীসের জন্য? সে জানে না কীসের জন্য। তার শুধু টাকা চাই। ফার্ন গাছের মগডালে বুলেট ঝাঁঝরা একটা তাজা ডেডবডি শোয়ানো। একটা লোহার ক্রস তার ঘাড় থেকে ঝুলছে। কেউ একজন স্যান্ডউইচ চাইল।


    টগবগিয়ে জলও ফুটছে স্যান্ডউইচের জন্য। ডিকশনারিতে ‘এস’ বর্ণের শব্দগুলো দ্যাখো।  


    উৎকৃষ্ট, ফলপ্রসূ একটা স্বপ্ন, ভেসে যাচ্ছে রহস্যময় নীল আলোতে। আমি সেই বিপজ্জনক স্তরে চলে গেছিলাম যেখানে নিখাদ সুখ আর বিস্ময়ের বাইরে একটামাত্র চ্যুতি নীচের মাটিতে এনে ফেলবে। অস্পষ্ট সেই স্বপ্নের মধ্যে আমি বুঝতে পারছিলাম হারকিউসিলের মতো একটা চেষ্টা আমায় করতে হবে। সেখানে উপরিভাগ ছোঁয়ার আয়াস ছিল মর্মান্তিক, অনবদ্যভাবে মর্মান্তিক। মাঝেমাঝে চোখ মেলতে পারছিলাম বটে; দেখছিলাম এই ঘর, যেন কুয়াশা ঢাকা ঝাপসা, কিন্তু আমার গোটা শরীর রয়েছে কাঁপা কাঁপা আলোয় সমুদ্র গভীরে। যেখানে জ্ঞান হারিয়ে ফেলাটা পরম ইন্দ্রিয় সুখের। একটা অগাধ তলহীন তলে পড়ে যাচ্ছিলাম, যেখানে একটা শার্কের মতো অপেক্ষা করেছিলাম আমি। তারপর, ধীরে, খুব ধীরে, উঠে দাঁড়ালাম। চারদিক বন্ধ, কোনও পাখনা নেই। একদম উপরিভাগের কাছে যেতেই আবার আমাকে টেনে নিল, নীচে, আরও নীচে, কী এক লোভনীয় অসহায়তায়, ফাঁকা জলের ঘূর্ণিতে, যেখানে অন্তহীন এক সুড়ঙ্গপথে অপেক্ষা করতে হবে আমার ইচ্ছাশক্তিকে একত্রিত করার জন্য আর জলমগ্ন এক বয়ার মতো নিজেকে তুলে আনার জন্য।


    কানে পাখির কিচিরমিচির আসতে ঘুম ভেঙে গেল। ঘরটা আর কুয়াশা ঢাকা নয়, পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আমার ডেস্কে দুটো চড়ুই একটা রুটির ছোট্ট টুকরো নিয়ে ঝগড়া করছে।


    কনুইয়ে ভর রেখে শুয়ে ওদের দেখতে থাকলাম। ঘুরে ঘুরে উড়তে উড়তে বন্ধ জানলার দিকে চলে গেল। তারপর ঘরের মধ্যে উড়তে থাকল, আবার ফিরে এল, উদ্বেল হয়ে বেরোনোর পথ খুঁজছে।


    উঠে জানলাটা খুলে দিলাম। তখনও ওরা ঘরে উড়েই যাচ্ছে, যেন একটু হতচকিত। আমি একদম স্থির রইলাম। তারপর হঠাৎ ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল জানলার দিকে। ‘‘বোনজুর, মাদাম উর্সেল,’’ যেতে যেতে কিচিরমিচির স্বরে বলে গেল।


    সময়টা ছিল ভরা দুপুর, বসন্তের তৃতীয় কি চতুর্থ দিন।





    (শেষ)




    পরিশিষ্ট

    ২৩. মেনিলমঁতা : প্যারিসের পার্শ্ববর্তী একটি অঞ্চল। 


    ২৪. ক্যানারসি : নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনের দক্ষিণ পূর্বে অবস্থিত একটা বাণিজ্য অঞ্চল।


    ২৫. গলোয়াজ  : একটি ফরাসি সিগারেট। 


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ১১ আগস্ট ২০১৯ | ১৩৩১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল মতামত দিন