এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • আমাকে তুই আনলি কেন....

    শিবাংশু লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৪ জুলাই ২০১৪ | ২৪২৪ বার পঠিত
  • ফিরিয়ে নে…



    মাতৃগর্ভেই মানুষের প্রথম সমুদ্রদর্শন । নোনাজলের স্বাদগন্ধ অনেকটা রক্তের মতো । অনঙ্গ অন্ধকারে হাত মেলে, পা ছড়িয়ে, অন্ধকারের মতো শীতল চোখ ছুঁয়ে ছুঁয়ে মায়ারুধির শ্যাওলা মেখে পৃথিবীতে নেমে আসা । ক্রমশঃ ট্রেনের বাঁশির স্বরে বেড়া ভাঙার আর্তকান্না, আমায় তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে .......


    ." কোমল বাতাস এলে ভাবি, কাছেই সমুদ্র ! তুই তোর জরার হাতে কঠিন বাঁধন দিস । অর্থ হয়, আমার যা-কিছু আছে তার অন্ধকার নিয়ে নাইতে নামলে সমুদ্র সরে যাবে
    শীতল সরে যাবে
    মৃত্যু সরে যাবে ।

    তবে হয়তো মৃত্যু প্রসব করেছিস জীবনের ভুলে ।...."
    -------------------------------------------
    সমস্তিপুর থেকে যে রাস্তাটা মুশরিঘরারি হয়ে বরৌনির দিকে গেছে সেই পথেই মাঝামাঝি পড়ে দলসিংসরাই। আমি তখন দিন সাতেক ধরে দলসিংসরাই ব্রাঞ্চ অডিট করছি। ছোট্টো জায়গা। এ দিগরে তামাক আর তিসি চাষের নাম সবাই নেয়। ক্যাশ ক্রপের দৌলতে এখানকার চাষীরা বেশ পয়সাওয়ালা। ব্রাঞ্চটাও বসতির তুলনায় বেশ বড়ো ই বলতে হবে। কারেন্সি চেস্ট আছে। সকালবেলা ব্রাঞ্চে এসে ইকনমিক টাইম্সটায় চোখ বুলাচ্ছি, আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট অনুভব শ্রীবাস্তব পাশে বসলো।
    হাঁ বতাও, কুছ মিলা ক্যা? বহুত খুশ নজর আ রহে হো ...
    সর, ইয়ে লোগ চেস্ট রিপোর্টিং মে বহুত দের কিয়া, কই বার... আর বি আই বড়কা জুর্মানা ঠোকেগা...
    হিসাব উসাব কুছ জোড়া?
    হাঁ সর, কম সে কম সাড়ে তিন লাখ কা চুনা লগেগা ব্যাংক'কা।
    য়ঁহা লাস্ট ইয়ার প্রফিট কিতনা রহা?
    বত্তিস লাখ সর..
    আরে করিবন টেন পর্সেন্ট কা কল্যাণ হো জায়্গা লগতা হ্যায়.... ঠিক হ্যাঁয় হিসাব য়ঁহি ছোড়কে যাও, জরা চেক করতে হ্যাঁয়....

    ক্যালকুলেটরটা নিয়ে ডুবে যাই হিসেবের জঙ্গলে।
    মাঝে মাঝে ভাবি, সত্যি এসব কার হিসেব কার নিকেশ। তখনই খাঁচার ভিতর অচিন পাখির মতো ডানা ঝাপটানো শুরু হয়ে যায়। আই নিড সাম চেঞ্জ।
    " .... কে জানে গরল কিনা প্রকৃত পানীয়
    অমৃতই বিষ !
    মেধার ভিতর শ্রান্তি বাড়ে অহর্নিশ ।"
    ----------------------------------------------
    ২.
    " বুকের মধ্যে চাষ করেছি একপো প্রেমের ধান
    তার আবার খাজনা কতো
    কার যে সর্বনাশ করেছি স্বতঃই সন্দিহান
    সে ভুলের বাজনা কতো....."

    ফোনটা যখন এলো, তখন আমি ব্রাঞ্চ ম্যানেজার বাবু গোপাল প্রসাদ সিংয়ের একটু ক্লাস নিচ্ছিলাম।
    এই লোকটি বোধ হয় পাঁজি দেখে দাড়ি কামায়। কে জানে মাসে কবার? সব সময়ই তো দেখি কাঁচা পাকা সজারুর কাঁটা সারা মুখে। গত সাত দিন ধরে একটাই কামিজ পরে আছে দেখছি, যেটা কোনওকালে হলদেটে রং ছিলো বোধ হয়। পাতলুনটার ওরিজিনাল রং সে নিজেও বলতে পারবে না। পায়ে চটি। কিন্তু একেবারে বাস্তুঘুঘু। মুজঃফরপুরে দোতলা বাড়ি ঠুকেছে। দুটো ছেলেই বিদেশে আছে, ভালো চাকরিবাকরি করছে বললো। একেকটার বিয়েতে লাখ চল্লিশ পঞ্চাশ তো নিশ্চিত উসুল করবে।
    অডিটরসায়েবের সামনে সর্বদা ঝুঁকে দুহাত কচলে যাচ্ছে। আমি জানি, ও যখন নিজের গাঁয়ে খাটিয়া টেনে পঞ্চায়ত করতে বসে, তখন ও একেবারে তইমুর লং।

    তো সিংসাব, ব্রঞ্চকা তো পুরা বাজা বজা দিয়ে...
    সর, থোড়া গড়বড় হো গয়া...
    থোড়া!!! সাড়ে তিন লাখকা চুনা লগায়ে মহারাজ... মুঝে তো অলগ রিপোর্টিং করনা পড়েগা,
    সর, থোড়া মেহরবানি করেঁ হুজুর... বিটিয়া কি শাদি করনা হ্যাঁয়...

    এইসব দেখলে এখন আর রাগ হয়না, আগে হতো...
    তখনই ফোনটা বাজলো।

    গোপালবাবু ফোন ধরে আমাকে দিলো,
    সর, আপকা...
    ওদিক থেকে বিরেন্দর পান্ডের গলা। বিরেন্দর পাটনা হেড অফিসে অডিট অ্যালোকেট করে। আমার পুরোনো চ্যালা।
    গুড মর্নিং বস,
    হাঁ জি বিরেন্দর, মর্নিং ... বতাও, সুবহ সুবহ কিস চিজ কা ইত্তিলা...
    বস, ইয়ে ব্রঞ্চ তো অউর তিন রোজ মেঁ হো জানা চাহিয়ে,
    হো জায়গা...
    তো হোলি মেঁ কঁহা রহনা পসন্দ করেঙ্গে?
    কঁহি ভি দে দো...
    অপনা ঘর তরফ যাইয়েগা?
    কঁহা ?
    কিরিবুরু...?

    মাথার ভিতর ডানা ঝাপটানোর আওয়াজটা বেশ শুনতে পেলুম। হোলির সময় কিরিবুরু...
    বসন্তের মাতাল সমীরণ যে কতোটা মাতাল, সেটা বোঝাতে হোলির জ্যোৎস্নায় মেঘাতুবুরুর শালবনে ঝরা পাতার গালচে পাতা আছে।
    -ঠিক বা, তোহার জইসন মর্জি...

    সর, আপ টিকট লে লিজিয়ে। ম্যঁয় টেলিগ্রাম ভেজ দেতা হুঁ।
    ---------------------------
    কমলদা একবার লিখেছিলেন, সিংভূম পেরিয়ে গেলে কবিতার রম্যভূমি শেষ। বড়ো সত্যি কথা। দক্ষিণ পশ্চিম সিংভূমের সীমান্তের ঐ সাতশো নীল পাহাড় চূড়া আর নিচের দিকে তাকালে সবুজ বনজঙ্গলের মাঝে কেওঁঝরের বোলানি, মহিষানি, বড়বিলের লাল হিমাটাইটের খাদান। সাহেবরা তাকে ব্লাড ওরও বলে থাকে। প্রায় আবিরের মতই রাঙিয়ে দেয় সারা শরীর। মনও রাঙায়। নাহ, এ রাঢ় পৃথিবীর লাল ধুলো নয় । অন্য লাল । সব রক্তই কি একই রকম লাল ? বৃক্ষের নিকটে কোন শান্তি, স্বস্তি পেতে যাওয়া ? তবে কেন বার বার ইঞ্চকেপ রকের ঘন্টা বাজে,..... আমায় তুই আনলি কেন ....?

    "সুন্দরের কাছ থেকে ভিক্ষা নিতে বসেছে হৃদয়
    নদীতীরে, বৃক্ষমূলে, হেমন্তের পাতাঝরা ঘাসে
    সুন্দর, সময় হলে, বৃক্ষের নিকট চলে আসে
    শিকড়ে পাতে না কান, শোনায় না শান্ত গান
    করতপ্ত ভিক্ষা দিতে বৃক্ষের নিকট চলে আসে....."
    ---------------------------------------------
    ৩.
    " যেতে-যেতে এক-একবার পিছন ফিরে তাকাই, আর তখনই চাবুক
    তখনই ছেড়ে যাওয়া সব
    আগুন লাগলে পোশাক যেভাবে ছাড়ে
    তেমনভাবে ছেড়ে যাওয়া সব
    হয়তো তুমি কোনদিন আর ফিরে আসবে না -শুধু যাওয়া...."

    প্রথম যখন চাকরিতে ঢুকি, আমার প্রথম পোস্টিং ছিলো চাইবাসায়। তা, চাইবাসা তখন সিংভূম জেলার হেড কোয়ার্টার, ছোট্টো পুরোনো গ্রামীণ জনপদ । 'শহর' বলতে বাধে, যদিও জামশেদপুরের থেকে প্রাচীন লোকবসতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বোমার ভয়ে জামশেদপুরের কিছু লোকজন অস্থায়ী ভাবে ওখানে পরিবার পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তার মধ্যে আমার ঠাকুরদাও ছিলেন। আমার বাবা তিনচার কেলাস চাইবাসা জিলা স্কুলে পড়েছিলেন। তার পর আবার জামশেদপুর ফিরে যান সকলে। কিছুটা আপনঘরের ছোঁয়া আমার সেখানেও ছিলো।

    সমীর রায়চৌধুরী জেলা মৎস অধিকারী হিসেবে ওখানে পোস্টেড ছিলেন সেই কালে । তাঁর টানে নিয়মিত সন্দীপন, শক্তি, সন্তোষ কুমার ঘোষ, উৎপল কুমার বসু বা আরও অনেক কৃত্তিবাস পার্টি যারা হাংরিতে যোগ দেয়নি, নিয়মিত আসা যাওয়া করতেন চাইবাসায়। আমাদের নিজেদের লিট্ল কাগজ ছিলো, 'উইঢিবি'। নিজেরা লিখতুম আর কলকাতার এইসব স্টার কবিদের পেলে জরিমানা হিসেবে কবিতা আদায় হতো কাগজের জন্য। পারিশ্রমিক শুধু মেরিটোলার মহুয়া ।সেই সময় আমি সারান্ডা চিনেছিলুম প্রায় গাছ ধরে ধরে। সঙ্গে থাকতো বন্ধু মাধব, ওরফে মধু । ও চাইবাসার ছেলে। টাটা কলেজে ফিজিক্সের স্টার ছাত্র, গ্রামীণ পরিবারের প্রথম স্কুলের গন্ডি পেরোনো ছেলে। ওর বাবা রবিবাবুর নামও শোনেননি বোধহয়, কিন্তু এই নিয়মভোলা ছেলেটা ছবি আঁকে, গান গায় আর অদ্ভুত পদ্য লেখে। একেবারে নিজের মতো। আমার একটা অভ্যেস আছে কেউ পদ্য লিখলেই খুঁজি একে কোন কবি গ্রাস করতে চাইছে? কিন্তু মধুর লেখায় কখনও কারও ছায়া দেখিনি। হয়তো খুব পাকা নয়, কিন্তু না ফোটানো মহুয়া ফুলের বাস থাকতো তার পদ্যে ।
    ---------------------------------

    " তোমাকে একটা গাছের কাছে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেবো
    সারা জীবন তুমি তার পাতা গুনতে ব্যস্ত থাকবে
    সংসারের কাজ তোমার কম- 'অবসর আছে' বলেছিলে একদিন
    'অবসর আছে- তাই আসি......"

    একটা ছুটির দিনে শীতের সকালে গিয়েছিলুম নোয়ামুন্ডি পেরিয়ে মুর্গামহাদেও। আমি আর মধু, আমার চিরসঙ্গী বাইকে চড়ে। এখানেই আমার সঙ্গে পর্ণার প্রথম দেখা । আত্মীয় বন্ধুদের সঙ্গে কলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছিলো। নোয়ামুন্ডিতে ওর কোনও এক ঘনিষ্টজন থাকতেন । তাদের সঙ্গেই তার যাওয়া, নোয়ামুন্ডি পেরিয়ে মুর্গামহাদেও। কোথা থেকে পেয়ে আমাদের কাগজের একটা সংখ্যায় রবিবাবুকে নিয়ে আমার লেখা একটা হাল্কা গদ্য পড়ে নিজেই আলাপ করেছিলো।

    কাগজটার ঐ সংখ্যাটিতেই শক্তি একটা পদ্য পাঠিয়েছিলেন, তার শুরুটা এরকম,

    ' ভালোবাসা ছিলো প্রজাপতিটির নাম,
    জানি, দিয়েছিলো বাগান অনেক দাম ....... ।'

    শক্তির বাঁহাতের লেখা কয়েকটি লাইন। তবে সেখানেও যেন কিছু থাকে। রেল লাইনের পাশে যত্নহীন বেড়ে ওঠা উজ্জ্বল আকন্দ ফুলের ঝাড় যেন। জীবন গিয়েছে চলে পঁয়ত্রিশ বছরের পার । বাহিরমহল আর ভিতরবাড়ির মধ্যে এখনও কোনো গন্ডি নেই । আরশিনগরের মেয়ের জন্য রয়ে গেছে কয়েক টুকরো নীলাভ স্ফটিক মূহুর্তের ছিন্ন রেশম জাল । মীর মোমিনের প্রিয় শ্যয়রি এলোমেলো গেয়ে যাওয়া দু'চার পশলা ঘুমভাঙানিয়া , ...
    " ওহ নয়েঁ গিলে ওহ শিকায়তেঁ
    ওহ মজে মজে কি হিকায়তে
    মুঝে সব হ্যাঁয় ইয়াদ জরা জরা
    তুমহে ইয়াদ হো কে না ইয়াদ হো
    .... ওহ জো হমমে তুমমে করার থা...."।
    --------------------------------------
    (ক্রমশঃ)

    ৪.
    ".....ছেড়ে দিয়েছে বলেই আমি সোনার মাছি জড়িয়ে আছি
    দীর্ঘতম জীবন এবার তোমার সঙ্গে ভোগ করেছি
    এই রোমাঞ্চকর যামিনী-সোনায় কোনো গ্লানি লাগেনা
    খুন করে নীল ভালোবাসায় চমকপ্রদ জড়িয়ে গেলাম ...."

    টাটানগর স্টেশন থেকে ইস্পাত এক্সপ্রেসে যাবো মনোহরপুর। কিরিবুরুর ব্রাঞ্চ ম্যানেজার পার্থ সেনকে বলেছি ওখানেই গাড়ি পাঠিয়ে দিতে। চিরিয়া মাইন্সের কাছে নদীতে এখন ব্রিজ তৈরি হয়ে গেছে, এবার সারান্ডা পেরোবো লাল মাটির পথ দিয়ে। আগে মাইন্সের মালগাড়ির গার্ডের সঙ্গে গপ্পো করতে করতে ঝিক ঝিক যেতুম সারান্ডার পার। এবার অন্য পথে।

    চক্রধরপুর পেরোলেই একটু একটু করে জঙ্গল কাছে আসতে থাকে । প্রথমে ছাড়া ছাড়া, চাবি ঘুরিয়ে তানপুরো বাঁধার সময় সুর-বেসুর যেমন তার বেয়ে এক সঙ্গে গড়িয়ে পড়ে, ঠিক তেমন স্লো মোশনে সবুজ বনস্পতিরা এগিয়ে আসে। লালমাটি, ধূসর ঘাসজমি, মোরমফেলা রাস্তা, খাপরাছাওয়া কুঁড়ে, ইতস্তত মোরগ, ছাগলছানা, শ্যামলা মানুষদের জটলার গুয়াশ পটচিত্র। শালবীথির ছায়া মেলা পথের পাশে অ্যালুমিনিয়মের হাঁড়ি সাজিয়ে বসে থাকা শাদা শাড়ি, উজ্জ্বল কৃষ্ণা ধরিত্রীকন্যারা। তারা হাঁড়িয়ার পসারিনী। সব কথাতেই হেসে আকুল, কিন্তু সহজাত সম্ভ্রমের কাচের দেওয়াল ভাঙেনা সচরাচর । সোনুয়া, টুনিয়া, গইলকেরা, পোসাইটা.... ছবির মতো ইস্টিশন সব, লালসবুজ পথে জলরঙে আঁকা লেভেল ক্রসিং, লাইনের দুধারে সাজানো গিট্টিপাথর-চুনাপাথরের বেড পেরিয়ে, সার সার কৃষ্ণচূড়ার আগুনলাগা বীথিকাদের দুলিয়ে দিয়ে, টানেলের পর টানেল আরপার, ছুটে যায় বি এন আর লাইনের ট্রেন । পোসাইটার পরেই এসে থামে আমাদের জঙ্গল রাজধানী, মনোহরপুর ।

    একটু নিচু প্ল্যাটফর্ম, লাফিয়ে নামতে হয় । চারদিকে তাকিয়ে দেখি । গার্ড ততোক্ষণে ঝান্ডা দোলাতে শুরু করে দিয়েছে । একটি রোগা লোক এগিয়ে এসে আমার বাক্সপ্যাঁটরা তুলে নেয় ।
    -ম্যাঞ্জর সাব গাড়ি ভেজা হ্যাঁয়...
    -তুম মুঝে পহচানা ক্যায়সে ?
    একটু দ্বিধা করে,
    -ম্যাঞ্জর সাব বোলা থা...
    -ক্যা বোলা থা ? অ্যায়সা দাড়ি হ্যাঁয়....?
    এবার হেসে ফেলে,
    -হাঁ সর...
    -চলো...

    স্টেশনের পাশের গেট দিয়ে বেরিয়েই একটি কালো অ্যাম্বাসাডর, এক রাশ কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে । কয়েকটা ফুল ঝরিয়েও দিয়েছে ততোক্ষণে গাড়ির উপর ।
    -ক্যা নাম হ্যাঁয় তেরা...?
    -আইগ্যাঁ, জগমোহন...
    -কেত্তে সময় লাগিব ?
    -আইগ্যাঁ, অঢ়াই ঘন্টা...
    ----------------------------------
    ৫.
    " জঙ্গল জংশন থেকে চার মাইল হবে।
    কিছুটা পিচের পথ, বাকি মেঠো, বসুন্ধরা তক;
    ব্রহ্মডাঙা ভেদ করে জঙ্গল করেছে,
    জঙ্গল ডাঙার পর ষাট বিঘা হবে।
    চারিদিক সেগুন শাল পিয়াল মেহগিনি,
    শিশু ও পলাশ আছে আর আছে কাঞ্চন বকুল, আছে বাওবাব বাঁশ হেঁটোকাঁটা কুল,
    সর্বত্র সমস্ত আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে।...."

    মনোহরপুর স্টেশনের বাইরেই একটা তেমাথা । উত্তরের রাস্তাটা নন্দপুর হয়ে চলে গেছে পোসাইটা আর অন্য রাস্তাটা সোজা পূবদিকে একটু গিয়ে ঘুরে গেছে দক্ষিণে । কোলেবিরা- হাটগামারিয়া শীর্ণ সড়ক । এই রাস্তাটা সমানে সঙ্গ দিয়ে গেছে কোয়না নদীটিকে । মনোহরপুরেই কোয়্না এসে মিলিয়ে গেছে কোয়েল নদীতে । এই কোয়েল দক্ষিণের কোয়েল । উত্তরে ডাল্টনগঞ্জে যে রয়েছে সে উত্তর কোয়েল । এই দুই কোয়েলের মতো মায়াময় স্রোতস্বিনী আমি তো আর দেখিনি কোথাও । খুব ক্লিশে উপমা বার বার ঘুরে ফিরে আসে, নদী আর নারী । হে শব্দফতুর কবি, নদীকে দেখো, নারীকে ছোঁও, ডুব দিও নিভৃতে, একা । তার পর ভেবে দেখো। কারো,কোয়েল, কোয়না, খড়কাই, সুবর্ণরেখা,.... অতো সহজে ধরা দেয়না।
    সালাই পর্যন্ত গিয়ে হাটগামারিয়ার রাস্তা ছেড়ে ধরতে হলো ছোটা নাগরার ভাঙাপথের রাঙা ধুলোর সড়ক । কোয়না চলেছে পাশে পাশে । ছোটা নাগরা পেরিয়ে সোজা দখিনে উঠে গেছে পাহাড়ের পথ । কোয়নার উপর ব্রিজ পেরিয়ে বরাইবুরুর ঘাটি । এখান থেকে আবার সঙ্গী হবে কোয়নার সখি কারো ।
    -------------------------------------------------
    "বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস
    এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে
    পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস
    দুয়ার চেপে ধরে....."

    এই সব খনি শহরে যাবার জায়গা খুব কম । সন্ধেবেলা টিভির সামনে আবর্জনা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়া নয়তো পরিচিতদের বাড়ি গিয়ে রাজাউজির মারা । অগস্ট মাস থেকে এখানে লোকে গরম জামা পরে । চলে সেই এপ্রিলের শেষ । সেতো মে-জুন মাসেও বৃষ্টি হয়ে জানালা দিয়ে গেলে ঘরের ভিতর মেঘের আনাগোনা । নীল পাহাড় আর দিগন্তসবুজ ক্লোরোফিল, মাঝখান চিরে লাল হিমাটাইটের ধুলোয় রঙিন সড়ক দিয়ে সমানে ছুটে যায় টিপার, ডাম্পার, আর্থমুভার । আঁধার ঝুঁঝকো হলেই কুয়াশার ভারি ডালপালা ঢেকে ফেলে চরাচর । যাবার জায়গা বলতে সেই অফিসার্স ক্লাব । কিছু তাস, কিছু টেনিস, কিছু বিলিয়ার্ড, বৃথা আড্ডা আর অভ্যেসবশে সুরাপান । চেনা মুখ, চেনা অভ্যেস, চেনা কথা ; তবু লোকে আর যাবে কোথায়? মানুষ তো আসলে মানুষ । নাগরিক বাঙালি অনেক রয়েছেন । মাইনিঙের লোকজনের তো কোনও অজুহাত নেই। তাঁরা নিজের পছন্দেই এই সব জায়গাতে চাকরি নিয়ে থাকেন। কিন্তু মেক্যানিক্যাল, ইলেক্ট্রিক্যাল জনগণ অদৃষ্টকে গালাগালি দেন । আসলে এসব জায়গায় সরকারি চাকরির একটা অন্যরকম স্বাচ্ছন্দ্য রয়েছে। অভ্যেস হয়ে গেলে ছাড়া যায়না । মাঝেমধ্যে কলকাতা আর জামশেদপুর, শহরের শিশুদের লালায়িত মুখ ওতেই শান্ত, আপোসিত ।

    পার্থ আমার অনেকদিনের বন্ধু। এখানে একা থাকে। বৌ-বাচ্চা পাটনায়। পাটনা এখান থেকে বহুদূর । তিন-চার মাসে একবার যাওয়া আর দিন গোনা। কতোদিনে পাপের মেয়াদ চুকবে। গান-বাজনার নেশা আছে ওর। দু'টো বেশ ঈর্ষণীয় মডেলের কর্গের কীবোর্ড আছে ওর বাড়ি । তবলাও বাজায়। এই গ্রামে কখনোসখনো গানাবজানার প্রোগ্রাম হলে বাজাতে যায়। নয়তো নিজে নিজেই বাদক ও শ্রোতা, বিষন্ন হিমসন্ধ্যাবেলায় সুরের পর্দায় জীবনের মানে খোঁজে। আমাকে পেয়ে পুলকিত । সন্ধেবেলা কাজ শেষ করে আমাকে নিয়ে তাদের মোল্লার দৌড় কেলাবে নিয়ে যায়। উদ্দেশ্য একটু আড্ডাফাড্ডা মেরে পানভোজনান্তে বিছানায় দেহরক্ষা করা ।

    অফিসার্স ক্লাবে সেদিন একটা প্রাক-হোলি পার্টির আয়োজন হয়েছিলো । পার্থ নিমন্ত্রিত, সঙ্গে আমিও রবাহূত। কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচয়, তার পর তুমুল আড্ডা। এর মধ্যে রটে যাওয়া আমি গানটান গেয়ে থাকি। পার্থের বাড়ি থেকে কীবোর্ড এসে যায়, এক আধজন আরো সুপ্ত প্রতিভা, আর কী লাগে ? সুর ও সুরার সাধনায় রাত গড়ায় বহুদূর । কিন্তু জনতার ক্লান্তি নেই । তবু শেষ তো করতে হবেই। তাই হলো মাঝরাত পেরিয়ে । বহু মানুষ, সুস্থ, প্রমত্ত শ্রোতার দল এসে শুভেচ্ছা জানিয়ে যাচ্ছেন । তাঁদের মধ্যে একজনকে নিয়ে পার্থ আসে আমার কাছে। পরিচয় করিয়ে দেয়, ইনি কুন্তল বাসু, ফিনান্সে আছেন । আমাদের নিত্য দশবার কথাবাত্তা হয়, বুঝতেই পারছো খুব কাছের মানুষ । সেই সুশীল, পুষ্ট চেহারার মানুষটি আমাকে স্বাগত জানান; প্রশ্ন করেন, আচ্ছা আপনি কি কখনও জামশেদপুরে থাকতেন?
    আমি সবিনয়ে জানাই, আমি কেন, আমার তিন পুরুষের বাস ঐ গ্রামে । কেন বলুন তো?
    -ঠিকই ধরেছে...
    -কী?...
    -মানে আমার শ্বশুরবাড়ি জামশেদপুরে। আমার ওয়াইফ বললো আপনাকে চেনে...
    -আরে, তাই নাকি? উনি এসেছেন কি?
    -আরে এসেছে বলেই তো দেখেছে আপনাকে...
    -কোথায় তিনি, দেখলে আমিও চিনতে পারবো নিশ্চয়...
    -দাঁড়ান....

    একটু পরেই তিনি সঙ্গে করে নিয়ে আসেন এক সুন্দরী মহিলাকে । গণেশ পাইনের রাণীর মতো দীর্ঘগ্রীবা, আয়তলোচনা, গঙ্গামাটির রঙ ত্বক ; ভাবি, ভদ্রলোকের স্ত্রীভাগ্য বেশ ভালো । আমি আগ বাড়িয়ে বলি, নমস্কার, শুনলুম আপনি আমাকে চেনেন...
    তিনি একটু তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলে ওঠেন,

    -শিবাজিদা, আমাকে চিনতে পারছো?

    (ক্রমশঃ)
    ৬.
    " এ- ঘর তখন ছোট্ট ছিলো, অনেকটা ঠিক তোমার মতন
    মলিন ছেঁড়া জামার মতন, দু-একটি পা নামার মতন
    ছোট্ট ছিলো, এখন অনেক বদলে গেছে
    কাঁঠালকাঠের চৌকি বদলে হয়েছে খাট
    কুঁড়েঘরের দরজা সরে জোড়া কপাট
    এখন অনেক বড়ো হয়েছে, এ-ঘর এখন বড়ো হয়েছে
    এখন অনেক বুড়ো হয়েছে, অনেকটা ঠিক তোমার মতন........"

    সদর বাজার থেকে যে রাস্তাটা বড়ি বাজারের দিকে গিয়েছে, তার বাঁদিকে স্টেডিয়ম রেখে ডানদিকে ঘুরলেই মাটির রাস্তা চলে গেছে সেনটোলা, সাহেববাঁধ । সেই পথের শুরুতেই একটা প্রায় খন্ডহরমার্কা বিশাল বাড়িতে থাকতো আমার বন্ধু কৌশিক দু'টো ঘর ভাড়া নিয়ে । কৌশিক ছিলো একটি টিপিক্যাল ক্যালকেশিয়ান উচ্চিংড়ে । পৃথিবীতে কিছুই তার অজানা নেই । মহানগরের লোকেরা জন্ম ইস্তক একটা প্রতিজ্ঞা করে ফেলে ; তারা কিছুতেই বিস্মিত হবেনা। 'এ আর নতুন কী?' সর্বক্ষেত্রে তাদের প্রথম প্রতিক্রিয়া। নেহাত ব্যাংকের চাকরি করতে এই অজ গ্রামে তাকে থাকতে হচ্ছে, নয়তো কা'কে সে চেনেনা ? অথবা কে তা'কে চেনেনা? কলকাতায় তার ঠিকানা ছিলো বাঙ্গুর । নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী নাকি ওদের প্রতিবেশী ছিলেন । ওর গপ্পোগুলো-ও ছিলো সেরকম। যেমন, বাঙ্গুরে বানভাসি হওয়ায় নীরেনদার কবিতা ' হ্যালো কলকাতা'র প্রথম শ্রোতা নাকি সে নিজে । আমাদের কাছে গাঁট্টা-ফাঁট্টা খেয়ে বললো তার প্রভাব সে একদিন প্রমাণ করেই ছাড়বে। কিছুদিন পরে সে একটা বেশ পুরোনো মতন দেখতে বই নিয়ে আমার বাড়িতে এসে হাজির। আমার সামনে সগৌরবে রেখে সে বলে, দ্যাখ এটা । আমি দেখি বইটি নীরেনদার প্রথম কাব্যগ্রন্থ "নীরক্ত করবী'র প্রথম সংস্করণ। আমার জন্মের ঢের আগে প্রকাশিত হয়েছিলো । খুঁজতে গিয়ে শুনেছিলুম, ছাপা নেই । তা সেই বই ওর কাছে? এখানেই শেষ নয়, সে প্রথম পাতা খুলে দেখায়, " কৌশিকের জন্য", নীরেনদার নিজের হাতে লেখা। ওঁর অপূর্ব হাতের লেখা আমি চিনি, একেবারে জেনুইন। মৌনতা ছাড়া আমার কোনও উত্তর নেই । তখন সে বলে, আমাদের কাছে সম্মান রাখতে নীরেনদার বাড়ি থেকে বইটা হাইজ্যাক করে নিয়ে এসেছে, ওঁর নিজের সংগ্রহ থেকে। খুব উদারভাবে আমাকে বলে, তুই যতোদিন ইচ্ছে বইটা নিজের কাছে রাখতে পারিস, শুধু মেরে দিসনা।

    সে হেন কৌশিক একদিন ভোর আটটায় আমার বাড়িতে এসে হাজির । বলে, আরে দ্যাখ সকাল সকাল পুরো কিচাইন। বলি, হলোটা কী?
    - আরে বুড়ো এসে হাজির সক্কালবেলায়, সঙ্গে একটা চ্যালাও রয়েছে। টিট্লাগড়ে এসে ভোরবেলা চক্রধরপুরে নেমে খুঁজতে খুঁজতে চাইবাসায় সোজা আমার বাড়ি। রাতভর মাল না খেয়ে শরীর আনচান করছিলো দুজনের । তেষ্টা মিটিয়ে এখন ঘুমোতে গেছে।

    বুঝতে পারি, 'বুড়ো'টি কে ।

    -তো, কী করবি, ছুটি নিবি আজ ?
    -মাইরি আর কী, আজ আমাকে ক্যাশ রেমিট্যান্স নিয়ে যেতে হবে বাইরে...
    -তবে..?
    -ঐ জন্যই তো তোর কাছে এলাম, এসব কবি-টবিদের কেস। আজকের দিনটা সামলে দে বাবা...
    -দ্যাখ, দু'জনকে সামলানো মুশকিল ; চ্যালাটা কে?
    - আরে ওটা বেকার, ফুলটুশ টাইপ। ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে নাকি কী সব আত্মীয়তা আছে। বেশি ঝামেলা করলে দাবড়ে দিবি...

    চিন্তায় পড়ে যাই। আমার স্বপ্নের কবি, কিন্তু সামলে রাখা একটা চ্যালেঞ্জ । তাঁর 'অভিনীত অপ্রকৃতিস্থতা'র মর্ম বোঝা 'মুশকিল নহি, নামুমকিন হ্যাঁয়'। চাইবাসার মতো একটা মধ্যযুগীয় গ্রামে চারদিকে জনতা হাবিলদার, জগতের চরিত্রপ্রহরী । ব্যাংকের ছেলেগুলো এমনিতেই সবসময় হাই স্ক্রুটিনিতে থাকে । তার উপর বিশেষ করে আমার প্রতি তারা আবার একটু বেশিই দয়াশীল । যাকগে দেখা যাবে...

    বলি, ঠিক আছে, সাড়ে ন'টার মধ্যে আমি চলে আসবো। একটা মহার্ঘ সি এল গেলো।

    "...যেখানেই থাকো
    এপথে আসতেই হবে
    ছাড়ান নেই
    সম্বল বলতে সেই
    দিন কয়েকের গল্প...."
    ---------------------------------------
    (ক্রমশঃ)
    ৭.
    ".... তুমি ছেঁড়া জামা দিয়েছো ফেলে
    ভাঙা লন্ঠন, পুরোনো কাগজ, চিঠিপত্র, গাছের পাতা-
    সবই কুড়িয়ে নেবার জন্য আছে কেউ
    তোমাদের সেই হারানো দিনগুলি কুড়িয়ে পাবেনা তোমরা আর ।"

    সুকান্ত আমার অনেকদিনের বন্ধু । সেই হাফপ্যান্টের আগে থেকেই । ডাকনাম সুকু । আমাদের মতো জামশেদপুরেই ওদেরও সব কিছু । ওর কাকা থাকতেন কদমায়। সুকুর সঙ্গে ছোটোবেলা থেকেই যাতায়াত ওঁদের বাড়ি । রিমা, মানে মধুরিমা সুকুর খুড়তুতো বোন । বছর তিনেকের ছোটো হবে আমাদের থেকে । ওকে যে দেখতে কেমন বা ও যে একটা মেয়ে, এমন কোনও অনুভূতিই আলাদাভাবে গড়ে ওঠেনি কখনও। ছেলেরা বড়ো হই মাথায়, মেয়েরা বড়ো হয় মনে। যখন কলেজে পড়ি , তখন মনে হতো রিমা বোধ হয় একটু অন্যভাবে কথা বলে আজকাল । খুব তাড়াতাড়ি বড়ো হয়ে যাচ্ছিলো সে । পুজোর সময় তাকে যে অনেকে ঘুরে দেখছে, সেটা বোঝা যেতো । নিয়মিত দেখাশোনা, তবু ব্যক্তিগতভাবে সে আমার ঘনিষ্ট বন্ধুর বোন, আমার কাছে সেটাই ছিলো তার পরিচয়। কলেজ ছেড়েই প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চাকরিতে ঢুকে পড়া । তার পর জামশেদপুর ছেড়ে বাইরে । নিত্য যোগাযোগ এভাবেই কম হয়ে যেতে থাকে । এর মধ্যে পর্ণা আসে মঞ্চে । আমি জামশেদপুরে ফিরে আসার পরেও বেশ কিছুদিন রিমার সঙ্গে দেখা হয়নি। হঠাৎ একদিন বিষ্টুপুর বাজারে মেঘানির দোকানের সামনে তার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। চিনতে পারি, কিন্তু তাকে এখন দেখতে হয়েছে যেন সোয়ানলেকের হংসপরী। আমি দেখছিলুম তাকে। আমার সেই বিস্মিত চাওয়া দেখে মৃদুস্বরে বলেছিলো, শিবাজিদা, চিনতে পারছোনা নাকি?
    -পারছি তো, কিন্তু তুই তো দেখছি একেবারে হিরোয়িন হয়ে গেছিস....!!
    -বাজে কথা রাখো । তুমি ফিরে এসেছো খবর পেয়েছি, কিন্তু একবারও বাড়িতে আসোনি । মা জিগ্যেস করছিলো...
    - হ্যাঁরে, এতো ব্যস্ত হয়ে পড়েছি ... সত্যি...
    -কাকে নিয়ে ব্যস্ত হলে, পর্ণা....?
    -আরে তুই এসব পাকা পাকা কথা শিখলি কবে ?
    -অনেকদিন...
    -তুই চিনিস ? পর্ণাকে...
    -চিনি তো, সাকচিতে থাকে । রবীন্দ্রভবনে গান শেখে...
    -হমম, অনেক কিছুই জানিস দেখছি...দাঁড়া আসবে একটু পরে ... পরিচয় করিয়ে দেবো...
    -থ্যাংক ইউ, পরিচয় করাতে হবেনা, আমিই করে নেবো... আজ আসি। বাড়িতে এসো , কথা হবে...
    -আয়....

    এ যেন এক অন্য রিমা । এতোদিন ধরে যাকে চিনি, সে নয়...

    সেদিন পর্ণা আর আসেনি। কামানি সেন্টারের সামনে থেকে দেখতে পেয়েছিলো রাস্তার ওপারে আমি আর মধুরিমা গপ্পো করছি । দেখা করার প্রয়োজন বোধ করেনি আর, ফিরে গিয়েছিলো উত্তপ্ত উষ্মায়।
    -----------------------------------------
    ৮.
    " আজ সকলই কিংবদন্তী, পাতালে বাস করলে গুঁড়ো
    সন্ধ্যেবেলায় পা ছড়িয়ে বসতে নাকি পাহাড়চুড়োয়?
    নিত্যি নতুন পোক্ত তাড়ি
    সর্বনাশের স্বপ্নে মেশা আঁধার করা বিষের হাঁড়ির -
    শক্তি, খেতে একচুমুকে, মন্দ নয় সে-কান্ডখানা!
    জগজ্জীবন চমকে দিয়ে ভাসতো সুবাস হাস্নুহানার-
    আজ সকলই কিংবদন্তী!...."

    দশটার মধ্যে বাড়ির চাবি আমাকে গচ্ছিত করে কৌশিক তো ভেগে গেলো । আমি ঘরে উঁকি দিয়ে দেখি দুজনে দুটো তক্তপোশে একেবারে পপাত চ। দেড় বোতল ঠররা তখনও স্টকে রয়েছে। ভাবলুম ঘুমোক যতোক্ষণ পারে । আমি একটু খাবারদাবারের ব্যবস্থা করি নাহয় । সদর বাজার ঘুরে আসতে আসতে দেখি দু'জনেরই ঘুম ভেঙে গেছে । হাতমুখ ধোয়াধুয়ি চলেছে কুয়োতলায়। আমি ঘরে ঢুকে পাতাফাতা সাজাতে সাজাতে দেখি কৌশিক ফিরে এসেছে।
    -কী হলো, চলে এলি ?
    -আরে বলিস না সুব্রতদা'কে তো চিনিস, আমার ব্রাঞ্চ ম্যানেজার...
    -চিনি তো..
    -সে কম বয়সে পদ্যটদ্য করতো। গিয়ে বললাম আজ আমার বাড়িতে বুড়ো এসেছে, শিবাংশুকে একা ঠেকিয়ে দিয়ে এসেছি... ছেড়ে দিলে ভালো হতো..
    -ছেড়ে দিলো ?
    -দিলো তো... পদ্যের মহিমা খুব পাওয়ারফুল...

    "কোথায় গেলি রে..." হুংকার দিতে দিতে নায়কের প্রবেশ । খালি গায়ে, কৌশিকের একটা লুঙ্গি জড়িয়ে, চুলের থেকে জল ঝরছে...
    -আছি, আছি, তোমাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করছি..
    -বাহ বাহ, লক্ষ্মী ছেলে, বেদম খিদে পেয়েছে বুঝলি....
    আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, আরেহ, এটা কে আবার ?
    - এ হলো শিবাংশু, জামশেদপুরের, তোমাদের লাইনের লোক...
    -অ্যাই ব্যাটা, তুই জামশেদপুরের, কমল'কে চিনিস?
    -হুমম, চিনি...
    -ও পেয়েছেটা কী ? শক্তি চাটুজ্যে পদ্য দিলে লোকে কভারে সেটা ছাপে, আর ও বলে কি দেরিতে পেয়েছি, ছাপবো-ই না...
    - এই গপ্পোটা তো আমি জানিনা। ঠিক আছে দেখা হলে জিগাবো এখন...
    -জিগাবি কী ? ওর বদলে এখন তোকে পেয়েছি, তোকে মেরে আমি এখন খন্ড'ৎ বানাচ্ছি দাঁড়া ।
    - অ্যাই বুড়ো, শিবাংশু'র সঙ্গে ঝাড়পিট কোরোনা, পাক্কা বিহারি, নিজে মার খেয়ে যাবে...
    -হ্যাঁ, ঠিকই বলেছিস, ওকে এবার ছেড়েই দিই তবে...

    কাছারির সামনে সরাইকেলা হোটেলে মাটনলিভারের একটা ফ্রাই দারুণ বানাতো। সেটার সঙ্গে রুটিফুটি আর কিছু আনুষঙ্গিক নিয়ে এসেছিলুম । জমপেশ খাওয়া হলো একেবারে। শুধু সেই ঠাকুরবাড়ির কবি ক্ষণে ক্ষণে এলিয়ে পড়ছিলো । ওস্তাদ বললেন, এ ব্যাটা আসল মাল কখনও খায়নি তো, স্কচ-ফচ খায়, টেঁসে না যায় আবার...
    আমি কৌশিককে বলি, যা লেবুটেবু খাইয়ে বমি করিয়ে দে, নয়তো পরেশান করবে...
    একটু পরে দু'জনে ফিরে আসে । ঠাকুরকবি কিস্যু না বলে সোজা তক্তপোশে গিয়ে শুয়ে পড়ে । বাইরে তখন প্রচন্ড রোদ, এপ্রিলের শেষ । কৌশিক শুধায়, কী বুড়ো নিমডি যাবে নাকি?
    -নাহ, আমি আর কখনও নিমডি যাবোনা । আমাকে একটা খাতা-কলম দে, আর বকবক করিসনা একদম... নয়তো মেরে খন্ড'ৎ....

    আমরা বেরিয়ে পাশের ঘরে চলে যাই।

    রোদ একটু পড়তে কবি বললেন, হ্যাঁরে লুপুংগুটু যাওয়া যাবে ?
    -হ্যাঁ, যাওয়া যায়, কিন্তু হেঁটে যেতে ঘন্টা খানেক লেগে যাবে..
    -চল তাহলে...
    -তোমার চ্যালার কী হবে ?
    -আরে ওকে ঘুমোতে দে, সুখী বালক...

    চাইবাসার অন্ধিসন্ধি কবির জানা। আমাদের জন্মের আগে থেকে, সমীর'দার প্রথম চাইবাসা বাসের সময় থেকে ওঁদের এই সব গলিঘুঁজি নিয়ে কারবার। নিজেই রাস্তা চিনে চললেন তিনি । এস পি জি মিশনের পিছনের মাঠ পেরিয়ে সোজা নামোদিকে আমরা চললুম লুপুংগুটু । ওখানে একটা ক্ষীণ পাহাড়ি জলধারা ছিলো । পুরোনো বনস্পতি আর রোদে পোড়া ঘাসের মাঠ, মাঝখান দিয়ে পায়েচলা মেঠো রাস্তা । আর একটু এগোতেই একটি চেনা দৃশ্য। মৌয়া সেদ্ধ করছে কয়েকজন । গার্হস্থ্য ভাটি, শাদা ধোঁয়া আর ম ম করছে মৌয়ার বাস । এই গন্ধটা আমার কখনও সহ্য হয়না । সুদূর কলকাতার কবিরা এই গরল সেবন করতে রাত জেগে ট্রেনে চেপে আসেন, কতোকাল হলো। কবি বলেন, ব্যস এখানেই বসা যাক । চাখনা বলতে ভেজা চানা আর নুন-লংকা , আর কী চাই?
    ঘর্মাক্ত শরীর, এলোমেলো কথামালা, কে জানে গরলই কি না প্রকৃত পানীয়, অমৃতই বিষ.....
    ফিরে আসার সময় কবির হেঁটে আসার সাধ্য নেই। রিকশা নিতে হলো।
    ----------------------------------------
    ৯.
    " প্লাতেরো আমারে ভালোবাসিয়াছে, আমি বাসিয়াছি
    আমাদের দিনগুলি রাত্রি নয়, রাত্রি নয় দিন
    যথাযথভাবে সূর্য পূর্ব হতে পশ্চিমে গড়ান
    তাঁর লাল বল হতে আলতা ও পায়ের মতো ঝরে
    আমাদের-প্লাতেরোর, আমার, নিঃশব্দ ভালোবাসা ।"

    মধুরিমার বাবা ছিলেন একটু অন্যধরনের মানুষ। টাটাবাবার স্মেলটারের আগুন আর পুড়িয়ে দেওয়া উত্তাপ তাঁর ভিতরের জলধারাকে শুকিয়ে দিতে পারেনি। গান-কবিতা-জীবনের গভীরতর সন্ধানের দিকে অমলিন টান রয়ে গিয়েছিলো । শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের 'চতুর্দশপদী কবিতা' ছিলো তাঁর প্রিয় বিলাস । আমাদের বিভিন্ন আড্ডা-জমায়েতে অবাধ আসতেন। বয়সের ফারাক বা বোধের পরিণতি আলাপের মধ্যে কোনও অস্বস্তির কারণ হতো না কখনও। চাইবাসা থেকে ফিরে মাঝেমাঝেই তাঁর বৈঠকখানায় আড্ডা হতো আমাদের। শক্তি ও বিনয়'কে নিয়ে আমার পাগলামির প্রতি তাঁর বিশেষ দুর্বলতা ছিলো। এই দুই কবির কবিতা নিয়ে কথাবাত্তা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে উঠতো প্রায়ই। সেই কথা চালাচালির চালচিত্রে শিবের মতন দাঁড়িয়ে থাকতেন জীবনানন্দ । রিমা আগের মতো ওদের বাড়ি গেলেই ঘরে এসে বসতো না । কখনও সখনও আসতো, কিন্তু মৌনতাই হয়ে যেতো তার অবয়ব। একদিন রাতে ওদের বাড়ি থেকে বেরোবার সময় এগিয়ে দিতে এলো বাগান পেরিয়ে । সেদিন চাঁদ ছিলো, হাওয়া ছিলো, ভাসাভাসি হাস্নুহানার গন্ধও ছিলো চারদিকে। এ রকম একটা সময়ে সে আমায় বলে, শিবাজিদা, আমাকে কোনোদিন শক্তির কবিতা শোনাবে, বুঝিয়ে দেবে একটু?
    -সে কী রে? তুই বাংলা কবিতা শুনবি ? তাও আবার শক্তির,...?
    -কেন, কবিতা কি শুধু পর্ণার জন্য...? আমি....
    -আরে শোন শোন... নিশ্চয় শোনাবো...
    সে আর অপেক্ষা করেনি, রুদ্ধশ্বাসে ছুটে ফিরে গিয়েছিলো । এতো অচেনা হয়ে গেলো মেয়েটা ।

    অন্য মেয়েটাও। দিল্লির স্কলারশিপটা পর্ণাকে এগিয়ে দিয়েছিলো অনেকদূর । ওখান থাকতেই ইন্ডিয়ানা থেকে একটা স্পন্সরশিপ পেয়ে যায় । আমিও খুব উৎসাহী ছিলুম । যাবার আগে যতোদিন বাড়িতে ছিলো রোজ দেখা করতে চাইতো। সেই পুরোনো যাবো কি যাবোনা, হ্যামলেটীয় সংলাপও শুনতে হতো আমাকে । আরে দু'টো বছর তো, পলকে কেটে যাবে।
    -তোমাকে বিশ্বাস করিনা...
    -সেটা ঠিক, কিন্তু একটু করেই দেখোনা, ঠকবে না...
    -নেচার অ্যাভরস ভ্যাকুয়াম...
    -ভ্যাকুয়াম কোথায় ? ঘাড়ে চড়ে তো আছো-ই...
    -সেটাই তো ভয়, সামনে আছি তাই ভালো ছেলে... নয়তো দেশে মধুরিমাও তো আছে...
    -আহা ঐ মেয়েটাকে কেন বারবার না জেনে চিমটি কাটো...
    -বাহ, স্বরূপ বেরিয়ে পড়েছে দেখছি.. এতো দরদ...
    -লো, সুধরেগি নহি বিলকুল...
    -নিজেকে শুধরাও আগে, আমি কিছুতেই যাবোনা....
    -আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়া গেছে...
    -ঠিক, আমিই পাগল..

    দিল্লি গিয়েছিলুম পর্ণাকে সী অফ করতে । কী দুর্বল চড়াইয়ের মতো ভাবসাব। এয়ারপোর্টের গেটে দাঁড়িয়ে, যেন ঢুকলেই বিপদ । ওর বাবা-মা আমাকে বলছেন, ওকে বোঝাও। বিদেশ-বিভুঁই জায়গা, কতো শক্ত হতে হবে...। কে কাকে বোঝায় ?

    আমার বন্ধু সন্দীপন তখন কলম্বস, ওহায়োতে। ওর ঠিকানা দেওয়া ছিলো । খুব পরোপকারী ছেলে, কোনও অসুবিধে হতে দেবেনা। কিন্তু কোনও আশ্বাসই যথেষ্ট নয় । তখন অ্যারোগ্রামের জমানা। পাৎলা নীল কাগজ হয়ে অনেকদিন পর্ণা আমার কাছাকাছি ছিলো । কিন্তু সব নীল কবে জলের আল্পনা হয়ে মিলিয়ে গেলো, তার খতিয়ান আর রাখা হয়নি।

    "হঠাৎ হারিয়ে গেলো, এলোমেলো হাওয়া, ভুল চাঁদ
    তার নিচে দাঁত খুলে খোয়াই পেতেছে নীল ফাঁদ
    বনের ভিতর হিংস্র জন্তু আছে, মানুষেরা আছে
    গাছের শিরার মতো সাপ আছে ছড়িয়ে সেখানে-
    এখন কোথায় সে কে জানে?
    এখন কোথায় সে কে জানে? .....
    .....পাথর গড়িয়ে পড়ে, গাছ পড়ে বোধে
    মানুষ হারায়, তা কি মানুষেরই ক্রোধে ? "
    --------------------------------
    (ক্রমশঃ)
    ১০.
    " ....ভালোবাসা মানেও হীনতা ।
    সে খুব বিস্তৃত নয়, জিরাফেরও মতো নয় অতিক্রান্ত উল্লোল নীলিমে,
    সে খুবই নূতনভাবে করে গেছে শব্দে প্রাণপাত,
    হে পরমেশ্বর, তুমি ধর্মে আছো, জিরাফেও আছো ।।"

    পাড়া পাড়া সেই বার্তা রটে গেছে ভ্রমে, কবি রাজচক্রবর্তী আজ চাইবাসায় আছেন । সুরা ক্লান্ত কবিকে নিয়ে যখন আমরা কৌশিকের বাড়ি ফিরে এলুম, ততোক্ষণে অন্ততঃ গোটা পঁচিশেক নানা মডেলের পদ্যওয়ালা ইধরউধর ঘোরাফেরা করছে । সবাই যে শ্যামলাল তা নয়, তবে অনেকেই । তাদের মধ্যে একজন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি বাড়িমালিকের জামাতা, জামশেদপুরের বাসিন্দা । আমি তাঁকে চিনি, কিন্তু তাঁর কাব্যরোগ বিষয়ে কিছু জানতুম না । এই 'গুরু'জনটির অনুগ্রহে একতলায় একটি বড়োঘরে কবির অভ্যর্থনা হবে, এমত বোধ হলো । কবি রিকশা থেকে নামতেই বেশ কজন ছুটে এলো, স্বাগত জানাতে । তাঁদের মধ্যে জামাতা বাবাজীবনও রয়েছেন । তিনি স্নান করতঃ পাটভাঙা চিকনের পাঞ্জাবি-পাজামা পরিধান পূর্বক ঘাড়ে বেশ উদারভাবে পাউডার লাগিয়ে কপিবুক হোস্ট । আসলে এই গ্রাম শক্তিকে বহুকাল ধরে চেনে । একসময় তাঁরও এই গ্রামের জামাতা হবার পূর্ণ সম্ভাবনা ছিলো। কিন্তু তাঁর আরো দু'জন কবিবন্ধুর ভায়রাভাই হবার ভাগ্য তাঁর আর হয়নি । তবে সেই সব পুরাকথা ততোদিনে কিম্বদন্তী হয়ে গেছে ।

    রিকশা থেকে নামতেই, আসুন, আসুন, আমরা খবর পেলাম, আপনি এসেছেন.. ইত্যাদি । তিনি নেমেই চেঁচিয়ে বললেন, মার্চ অন... তার পর লেফট-রাইট লেফট-রাইট বলতে বলতে কৌশিকের ঘরের দিকে যাত্রা করলেন । সমবেত কবিকুল বেশ হতভম্ব, কিন্তু শ্যামলালের দল কবেই বা এতো সহজে নিবৃত্ত হয় । তারা এসে ধরলো কৌশিককে, আমরা একটু আয়োজন করেছি স্থানীয় কবিদের নিয়ে । উনি যদি একটু তাদের সঙ্গে আলাপ করেন তবে তারা খুব উৎসাহিত হবে । সে চেহারায় একটা বিপন্ন ভঙ্গি এনে বলে, দেখছেনই তো, উনি কী অবস্থায় আছেন। এখন কি আর ওসব করা সম্ভব? আপনারা যদি একটু আগে জানাতেন... । যেন, আগে জানলে এসব করা যেতে পারতো ! জামাতাজি বলে ওঠেন, আমরা শুনেছি উনি নেশাটেশা করেন । তা বলে এই ভর সন্ধেয় ?
    -ওঁর আর সকাল-সন্ধে কী, এতো সারাদিনের ব্যাপার...
    -তবে কি কোনও আশা নেই?
    কৌশিক কিছু বলার আগেই কবিকে টানা বারান্দা ধরে "চলো যাই, চলো যাই, চলো যাই, চলো যাই, চলো দুর্জয় প্রাণের আনন্দে..." উচ্চৈঃস্বরে গাইতে গাইতে আসতে দেখা গেলো । শ্যামলালের দল ধীরে ধীরে হালকা । কীই বা আর করার ছিলো তাদের ? এতো বিপজ্জনক একজন লোক কবিতা লেখে ? তাদের কাব্যজীবন সমৃদ্ধ হলো।
    -------------------------
    ১১.
    ".... দোলপূর্ণিমায় তুমি গিয়েছো কখনো-জৈনমন্দিরের কাছে
    ওখানে নদীটি শুয়ে আছে
    পরস্পর
    যে-কথা বলেছি আগে তারই ফলে ভেঙে গেছে ঘর
    এখন জানালা তার ভেসে যায় জলে
    আমাকে গোপন কথা বলে
    তীরের জোনাকি
    'এখানে আসেনি কেহ, আমি একা থাকি!'..."

    চমকটা নিঃসন্দেহে ছিলো জোরদার । এই মূহুর্তে এইভাবে মধুরিমাকে মেঘাতুবুরু'তে দেখতে পাবো, প্রায় অবিশ্বাস্য । ওর বিয়ে হয়েছে, বাঙালিমতে ভালো ছেলের সঙ্গে, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, সে খবর পেয়েছিলুম । যথারীতি নেমতন্নো-ও ছিলো । কিন্তু অনুষ্ঠানটি হয়েছিলো পাত্রপক্ষের ইচ্ছায় কলকাতায় । আমি তখন হরদ্বারে কুম্ভমেলা সেরে জয়শলমের-বাড়মের করছি । যাওয়া হয়ে ওঠেনি । তারপর আবার জামশেদপুর ছেড়ে অন্য হাটে, অন্য ঘাটে । মাঝখানে প্রায় বারোটা বছর । এই মূহুর্তে রিমা'কে দেখে মনে হলো, লেভেল ক্রসিঙে দাঁড়ানো সাইকেলের মতো সময় এতোদিন ধরে যেন এক জায়গায় থেমে আছে। রাশি রাশি কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি ঝরিয়ে ভোরবেলার কিরনডুল গাড়ি যেন গড়িয়ে যাচ্ছে আরাকু টানেলের অন্যপার।

    -আরে তুমি এনাকে ভালো-ই চেনো দেখছি । বাহ, দারুণ । পার্থ, পরশু হোলি, কাল তাহলে আমার বাড়িতে একটু দোলযাত্রার পার্টি হোক। পিওর বেঙ্গলি স্টাইল, কী বলেন ?
    কুন্তল আমার দিকে সপ্রশ্ন চোখে তাকান...
    পার্থ বলে, ঠিক আছে, বাকি সব বাংলা চলবে, কিন্তু বোতলটা ইংরিজি চাই...
    -আরে সে আর বলতে ? গতমাসে সিঙ্গাপুর ফেরত এক বছরের স্টক নিয়ে এসেছি, তুমিও তো খেয়েছো শালা, বাইরের লোকের কাছে বদনাম করছো কেন?
    -আরে না না, সেতো আমি জানিই, সসুরালকে ইজ্জত বা...
    পার্থ এবার আমাকে জানায়, কুন্তল শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বড়ো সমঝদার । ওর কাছে খুব ভালো কালেক্শন রয়েছে। আমি বলি, বাহ...কিন্তু গৃহকর্ত্রী এরকম নীরব থাকলে সেটা কি মৌনং সম্মতির এলাকায় পড়বে?
    -হ্যাঁ, ঠিক ঠিক, রিমা হবে তো ?
    -হমম, হয়ে যাবে...
    -বাহ, আর কোনও কথা নেই....
    ------------------------------------
    ১২.
    ".... কবিতাকে তার খুব কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারি
    যে-জন ঈশ্বর, বাঘ, পারিজাতময় স্বর্গ, নারী ....
    আমি কবিতাকে তারও কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারি।।"

    কৌশিক যে বাড়িটায় থাকে তার মাঝখানটায় মস্তো একটা উঠোন । একদিকে কুয়োতলা আর বেশিটাই ঘাসপাতা ছড়ানো এলোমেলো জমি । চারদিকে বারান্দাঘেরা ভাড়াটে ঘরের সারি । উঠোনের বিভিন্ন কোণায় এদিকওদিক খাটিয়ারা শুয়ে বসে আছে । একদিকে দু'তিনটে খাটিয়া নিয়ে আমরাও জুড়ে বসি । কাব্যনেশাতুর জনতার দল ফিরে গেছে । উঠোনে ঢোকার মুখে কাঁটাতারের ভাঙাচোরা আগড়ের দু'দিকে লতিয়ে উঠেছে মালতীলতার গুচ্ছবীথি। মালতীলতা না মাতাললতা, সৌরভমত্ত নৈরাজ্যের নেশা...
    আকণ্ঠ মহুয়ার গরল কবিকে অন্যধরণের উৎফুল্লতা দিয়েছে । আড্ডা শুরু হয়, প্রথমে ছাড়া ছাড়া, তার পর মজে আসি ক্রমশঃ তাড়ির মতো শৃঙ্খলহীন । হঠাৎ প্রশ্ন করি, আপনাকে জীবনানন্দ এভাবে গ্রাস করলেন কীভাবে ? সচেতন ছিলেন না অবচেতনার ফাঁদে পড়ে গিয়েছিলেন শুরু থেকে ?
    তিনি ধমকে ওঠেন, এসব ভারি ভারি কথা বলে নেশাটা ছুটিয়ে দিসনা।
    -বেশ, তবে হাল্কা কথাটা কী ?
    -মোদ্দা কথাটা হচ্ছে কবিতা একটা লাইট খেলা, কবিরা নিজেদের মধ্যে ভারি ভারি কথা বলে এটার ওজন বাড়ায়...
    -আপনিও বাড়ান ?
    -চোপ শালা, ইন্টারভিউ নিচ্ছিস নাকি?
    - নাহ, তা নয় আপনিই তো বলেন পদ্য ট্র্যান্স থেকে আসে। কবি নিজের ভিতর সঙ্গোপনে নিজেকে উন্মুক্ত করে, শব্দগুলি নিজের সাজে অতর্কিতে কাগজে নেমে পড়ে, তার পর কবির কাজ শেষ । তাকে প্রকাশ্য সভায় কাটাছেঁড়া করে কিছুই পাওয়া যায়না । জীবনানন্দ কিন্তু এরকম ভাবতেন না ...
    -তোকে কে বলেছে আমি জীবনানন্দের চ্যালা..
    -সব্বাই বলে...
    -কারা তারা ?
    -যারা আপনার কবিতা পড়ে, পড়তে ভালোবাসে....
    -তারা সব @#$%&*... , তোদের মতো লোকজনসব....

    -অ্যাইই, গলাটা শুকিয়ে গেলো । জল আন, জল...

    কৌশিক ঘরের ভিতর থেকে আধোশেষ বোতল বের করে আনে । একচুমুকে খেয়ে ফেলেন তিনি । মুখটা মুছে হঠাৎ উঁচুগলায় গেয়ে ওঠেন, "মরি লো মরি, আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে ?"

    নাহ, বলতে পারবোনা, তিনি উঁচুদরের গায়ক। গলায় সুর সরে যায়, উচ্চারণে আরোপিত কাঠিন্য... কিন্তু নিবেদনের আকুতি বড়ো স্পষ্ট । গান নয়, আত্মসমর্পণের মন্ত্র শুনি আমরা । ঐ বাহিরে বাজিলো বাঁশি, পুনরাবৃত্ত তারসপ্তকে গলা ভেঙে যায়... কিন্তু জলের মতো গড়িয়ে আসে বালিকার অসহায় আর্তি, " বলো কী করি"....

    ঐপাশে অন্য একটি খাটিয়ায় দু'টি নারী, কৌশিকের প্রতিবেশী, একজন বিলম্বিত যৌবনে অন্যজন সদ্যোযৌবনে গরবিনী বিহারনন্দিনী, বাংলা বোঝেনা, কবির গান শুনে উচ্ছল হাসিতে ভেঙে পড়ে..
    -বাবা বহুত পী লিয়া হ্যাঁয়...

    কবির শাদা মোটা গুম্ফযুগল 'বাবা' হয়ে ওঠার প্রত্যক্ষ পাসপোর্ট । কবি গান থামিয়ে বলেন, এই মেয়েগুলো, চুপ কর, সারাদিন শুধু বকবক করে চলেছে.... তোরা দেখেছিস মেয়েগুলো শুধু কথা বলে....
    কৌশিক জনান্তিকে তাদের গিয়ে বলে, বহনজি, বুরা নহি মানিয়েগা...তারা আরো উৎসারিত প্রসন্নতায় হেসে ওঠে । কুছ জ্যাদা হী পী লিয়া হ্যাঁয় বাবা।

    গান থামে এভাবেই। আমি বলি আজ কিছু লিখলেন?
    -হ্যাঁ, লিখেছি, রোজই লিখি, কিছু থাকে, কিছু থাকেনা...
    -একটু শোনাবেন...?
    ভেবে ছিলুম প্রত্যাখ্যাত হবো । কিন্তু তিনি খুব উদারভাবে বললেন, কৌশিক আমার বালিশের নিচে কাগজগুলো আছে নিয়ে আয় তো..
    মন্দ্রসপ্তকে গলা নামিয়ে কবি পড়তে থাকেন শব্দ কেটে কেটে..

    "রোরো নদীর ধার থেকে ঐ একটি বালক
    কুড়িয়ে পেয়েছিলো রঙিন বুকের পালক
    এবং একটি পাথর পেয়ে, সেই পালকে
    জড়িয়ে ছুঁড়ে দিয়েছিলো এপার থেকে
    পালক কি আর একাকিনী ওপার যাবে?
    .... কুড়িয়ে পেয়ে ছড়িয়ে দিলুম বুকের পালক
    -আসছো কবে? আসছো কবে? আসছো কবে?"

    - অ্যাই, চল রোরো যাবো....
    কৌশিক দোনামনা করে, বেশ রাত হয়েছে। অনেকটা দূর, বেশি নেশা হয়ে গেলে ফেরার সময় রিকশা পাওয়া যাবেনা । আমার দিকে তাকায়। বলি, চলনা দেখা যাবে এখন...
    -বুড়ো, হেঁটে যেতে হবে, পারবে তো?
    -আমি দৌড়ে যাবো...
    -নাহ, দৌড়িওনা , প্রচুর কুকুর চারদিকে, কামড়ে দেবে..
    -না না , তবে হেঁটে যাবো...

    মেরিটোলা হয়ে শর্টকাট রাস্তাটা নিই আমরা । পথে সোমাই বিরুলির ভাটিখানা । কাছাকাছি আসতেই গন্ধ পেয়ে যান কবি। দাঁড়া, দাঁড়া, গলাটা ভিজিয়ে নিই । সোমাই আমাকে চেনে । না, ওর দোকানে আমার কোনো গতায়াত নেই । সরকারের ট্যাক্সোচালান ভরতে আসে ব্যাংকে মাঝে মাঝে । ওকে বাইরে ডাকি । আমায় দেখে সে চমকিত, এতো রাতে, তার দোকানে আমি! বলি একটা ভালো দেখে বোতল দাও ভাই, বিষমদ যেন না হয় । সে জিভ কেটে বলে, ছি ছি আপনাকে কি তা দিতে পারি? সে তার শ্রেষ্ঠ দেশি গরলটি এনে দেয় । তাকে আরো বলি, একটা রিকশা লাগবে । কেউ আছে তোমার দোকানে ? সে তার নিজস্ব রিকশওয়ালাটিকে ডেকে দেয় । সে মক্কেলও অলরেডি বেশ রসেবশে। তাকে বলি, নদী যাচ্ছি, একঘন্টা পরে এসো ওখানে। সে মাথা নাড়ে।

    এতো গ্রীষ্মে রোরো প্রায় শুকনো । তার বর্তুল মসৃণ পাথরের সজ্জার ভিতরে ক্ষীণ জলধারা চাঁদের আলোয় চিকচিক করে । ডানহাতে খানিকটা দূরে শ্মশান, পাশে কালীমন্দির । ঐ মন্দিরের মালিক আমার এক সহকর্মী। ব্যাংকের খাতায় ঠিকানা, শ্মশানঘাট ।
    কবির তর সয়না, বোতলটি কতোক্ষণে খোলা হবে ?
    পাথর টপকে টপকে বেশ খানিকটা নদীর ভিতর এগিয়ে আমরা দু'টো ছড়ানো পাথরে বসি । বোতল খোলা হয় । কবি নিঃশব্দে পান করে যান। আমাকে হঠাৎ বলেন, তুই বলছিলিনা আমি কার চ্যালা ..?
    -আমি ঐ বুড়োটার চ্যালা, ঐ বুড়োটার, আর কারো নয়...
    হঠাৎ গান ধরেন, " ওগো কাঙাল..." কিন্তু গলা আর টানতে পারছিলো না.. । কৌশিক আমাকে বলে, তুই গা'।
    -ও গান করে নাকি?
    -শোনোনা, চুপ করে..
    আমি কবির থেকে স্কেল নামিয়ে "ওগো কাঙাল" ধরি। কতোবার গেয়েছি গানটা, কিন্তু ঐ জায়গায় ছড়িয়ে যাওয়া প্রতিধ্বনি, নদীর মৃদু জলের শব্দ আর স্বপ্নের কবির সান্নিধ্যে নিজের গলাটাই যেন অচেনা লাগছিলো। " আমি আমার বুকের আঁচল ঘেরিয়া" সঞ্চারী আসতে আসতে দেখলুম কবি স্তব্ধ । কিস্যু বলছেন না,করছেন না। গান থামতে বললেন, এভাবেই একদিন মরে যাবো । কিস্যু লেখা হবেনা ।
    -শোন, অন্ধজনে দেহো আলো'টা জানিস..?
    -জানি..
    -গা' না....
    সেই গানও হয় । খাদে যখন, " তুমি করুণামৃতসিন্ধু, করো করুণাকণাদান, হা প্রভু..." , শুনি তিনিও গলা মেলাচ্ছেন ....
    কতোক্ষণ বসেছিলুম আমরা, খেয়াল নেই । শেয়াল ডাকছিলো অনেক । সোমাইয়ের রিকশাওয়ালা এসে ঘোর ভাঙালো, এবার ফিরতে হবে। কবিকে সঙ্গীসহ রিকশায় রওনা করে দিয়ে আমরা দুজন নিঃশব্দে ফেরার পথ ধরি। চাঁদ তখন মধ্যগগনে.....

    ".....অশ্রুপাত শেষ হলে , নষ্ট করো আঁখি ।
    কুড়িয়ো না ফুল মালা
    স্তবক সুগন্ধে আলু থালু প্রিয়কর স্পর্শ
    ওর গায়ে লেগে আছে
    গঙ্গা জলে ভেসে যেতে দিও ওকে মুক্ত , স্বেচ্ছাচারী
    ও চির প্রণম্য অগ্নি আমাকে পোড়াও ।"


    ---------------------------------------
    (ক্রমশঃ)
    ১৩.
    ".... পুরাতন বইগুলি রেখেছো কি ঘরে
    আজো কি আমাকে মনে পড়ে
    নির্দ্বিধায় ?
    হেমন্ত-সন্ধ্যায়
    গাছের শিথিল পাতা ওড়ে ঘূর্ণিঝড়ে
    আজো কি আমাকে মনে পড়ে ?
    তোমার সমস্ত গান ভোরবেলাকার রেলওয়ে-বিলে মাছরাঙা
    তোমার সমস্ত ছবি পাগল-ঝোরার...."

    দোলপূর্ণিমায় আমাদের ছুটি নেই । সারাদিন যাচ্ছেতাই রকম সরকারি কাজকম্মো সারা হলো। শীতল ধারাজলে সারাগায়ের পাপ ধুয়ে গেস্টহাউসের লাউঞ্জে এসে বসেছি, পার্থ হাজির । কুন্তলবাবুর বাড়িটি কাছেই, মেঘা অতিথশালা থেকে যে রাস্তাটা ডানদিকে নেমে চলে যাচ্ছে, তার পাশে । অন্য সব বাড়ির মতো-ই সবুজ, সবুজ-ঘেরা পরিকীর্ণ বাগান পেরিয়ে । বাগানে দাঁড়িয়ে আছে একটি আকাশছোঁয়া প্রাংশু শালবৃক্ষ । ঘাসজমি আর সাজানো ফুলের বিছানা । সন্ধে নামার একটু আগেই দোলপূর্ণিমার চাঁদ থেকে তখন পাতলা সরের মতো জ্যোৎস্নার স্বাদ মাটিতে নেমে আসছিলো। পার্থ আর আমি হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাই একটি শাদা রং কাঠের গেটের কাছে। নাহ, ওঁর বাড়িতে কোনও কুকুর নেই । ভিতরে গৃহস্বামী শাদা লখনউয়ে সেজে আদর্শ মেহমান নওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ।

    ওঁর বাড়িটি বেশ সাজানো । রুচির আঙ্গিকটি স্পষ্ট ও অভিরাম । নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় পিলু বাজাচ্ছিলেন, তাঁর গান্ধর্বী আঙুলের স্পর্শে ঘর ও বাহিরে বসন্ত থৈ থৈ সুরে ভেসে যাচ্ছিলো । এটি তাঁর স্টকহোমে বাজানো ১৯৭৫ সালের রেকর্ডিংটি । বেশ দীর্ঘ, ঘোর জাগানো কোলোনভেজা রেশমি কাপড়ের মতো মায়া তার সুরসঞ্চারে । এদেশে তখনও পাওয়া যেতোনা রেকর্ডটি। নিশ্চয় কেউ বিদেশ থেকে এনে দিয়েছেন । কুন্তল কিছু বলে স্বাগত জানাতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু আমার মুখ দেখে মৌনতায় স্থির। তার পরেও বাজনাটি বেজেছিলো অনেকক্ষণ, আমি নিমীল আশ্লেষে ডুবে শুনে যাচ্ছিলুম তার সব প্ররোচনা । চোখ খুলে দেখি সামনে রিমা বসে আছে । বলে, আমি তো ভাবলাম তুমি ঘুমিয়ে পড়েছো । আমি হাসি,
    -হ্যাঁরে, না ঘুমিয়ে এসব কি আর শোনা যায়...?

    গৃহকর্তা বিকল্প দেন, কালো কুকুর না শিবের শৃগাল । পার্থ বলে, শেয়াল থাকতে কুকুর কেন ?
    -বেশ ....
    নিবিড় চুমুকের সঙ্গে নিবিড়তর জীবনচর্যার গল্প চলে, চলতে থাকে প্রত্যাশিত শব্দকথার আলাপ আমাদের । কিন্তু সবার চেয়ে প্রগাঢ় যে নেশা সুরের হাত ধরে আসে, তার কাছে বাকি সব কিছু তো ছেলেখেলা । কুন্তল কলকাতায় উত্তম গুরু'র কাছে তবলা বাজাতে শিখেছিলেন । যন্ত্রটি এখন আর ততো প্রশ্রয়ে নেই, কিন্তু নেশাটি রয়েছে । দম্পতির আত্মজ, দশ বছরের বালক একটি, দার্জিলিঙে হস্টেলে থাকে । ফ্রেমের ভিতর থেকে উজ্জ্বলমুখে তাকিয়ে আছে সে সবার দিকে । কথায় কথায় কথামালা । পার্থ বলে, যাবে নাকি আরেকবার থলকোবাদ? আমার প্রথম দেখা থলকোবাদ তো আর নেই । শুনেছি সেই জঙ্গল এখন ধু ধু মাঠ । তবু সেই বালকবয়স থেকে বিভূতিভূষণ ঐ নামটির সঙ্গে আমাদের এমনভাবে বেঁধে রেখে গেছেন; যাবে? শুনলে 'না' বলতে পারিনা । বলি, হাতের কাজকম্মো শেষ হোক । পার্থ বলে, তোমার কাজকম্মো মানে আমার বাঁশ, যাওতো, একদিন আমাকে ফুরসত দাও । কুন্তল সাগ্রহে বলেন, আমরা ওঁকে নিয়ে যাবো । দেখছি, ডাকবাংলাটার বুকিং কবে পাওয়া যায় । মনে হচ্ছে ,ব্যাপারটা আমার নিয়ন্ত্রণে আর থাকছে না ।
    -রাত হলো, আজ উঠি..
    -শিবাজিদা, ওঠার আগে 'চিরসখা' একবার শোনাবে?
    -দ্যাখ, সুরাপান করে গীতবিতান গাইনা, তবে অন্য কিছু গাওয়া যেতে পারে, হয়তো...
    - তবে "আমি নিরালায় বসে", তোমার পেটেন্ট...
    -মনে আছে ? বেশ....

    "...... বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভালো- ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়
    সমস্ত পায়ে-হাঁটা পথই যখন পিচ্ছিল, তখন ওই পাথরের পাল একের পর এক বিছিয়ে
    যেন কবিতার নগ্ন ব্যবহার , যেন ঢেউ, যেন কুমোরটুলির সালমা-চুমকি- জরি-মাখা প্রতিমা
    বহুদূর হেমন্তের পাঁশুটে নক্ষত্রের দরোজা পর্যন্ত দেখে আসতে পারি ...."
    -----------------------------------
    ১৪.
    "বড় দীর্ঘতম বৃক্ষে ব'সে আছো, দেবতা আমার়
    শিকড়ে, বিহ্বল প্রান্তে, কান পেতে আছি নিশিদিন
    সম্ভ্রমের মূল কোথা এ-মাটির নিথর বিস্তারে ;
    সেইখানে শুয়ে আছি মনে পড়ে, তার মনে পড়ে ?
    যেখানে শুইয়ে গেলে ধীরে-ধীরে কত দূরে আজ !
    স্মারক বাগানখানি গাছ হ'য়ে আমার ভিতরে
    শুধু স্বপ্ন দীর্ঘকায়, তার ফুল-পাতা-ফল-শাখা
    তোমাদের খোঁজা-বাসা শূন্য ক'রে পলাতক হলো়
    আপনারে খুঁজি আর খুঁজি তারে সঞ্চারে আমার
    পুরানো স্পর্শের মগ্ন কোথা আছো ? বুঝি ভুলে গেলে
    নীলিমা ঔদাস্যে মনে পড়ে নাকো গোষ্ঠের সংকেত ;
    দেবতা সুদূর বৃক্ষে, পাবো প্রেম কান পেতে রেখে .."

    শক্তি'র কবিতা পড়ার অনেক আগে থেকেই শক্তি'র নামের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ছিলো, বাবার দৌলতে । সুদূর শৈশবস্মৃতিতে মনে পড়ে কোনও এক শারদীয় দেশ বা আবাপ'তে প্রকাশিত হয়েছিলো, অবনীর পদ্য । বাংলাভাষায় যে সব কবিতা কালো অক্ষরের শরীর পেরিয়ে মানুষের সার্বিক অবচেতনায় সংক্রামিত হয়ে গেছে, অবনীর পদ্য তার একটি । সেই বয়সে " বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস, এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে'এর ঝাপসা ছবিটিই স্পষ্ট লেগেছিলো, বাকি পাওয়াটা পরে এসেছে । হিজলিতে এক বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে গিয়ে শক্তি এই পদ্যটি শব্দে বেঁধেছিলেন । কখনও ভাবেননি এই পদ্যটি তাঁর পাঞ্জার ছাপ হয়ে যাবে।

    চার বছর বয়সে পিতৃহীন শিশু দাদামশায়ের সংসারে যুদ্ধ করে বেড়ে উঠছিলেন । কমার্স পড়তেন, মামার ব্যবসায়ে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে । হলোনা। প্রেসিডেন্সিতে বাংলা অনার্স, তাও হলোনা । যাদবপুরে বুদ্ধদেব বসুর স্নেহচ্ছায়ায় 'তুলনামূলক', তাও না । অসহ্য বস্তিবাস, এদিকওদিক কেরানিগিরি থেকে গুদাম সামলানো। ১৯৫১ থেকে ১৯৫৮ কম্যুনিস্ট পার্টির কার্ডধারী সদস্য, আবার ১৯৬১তে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী হাংগ্রিদলের অগ্রণী সহযোগী (তাঁর জীবন অবসানের পর একটি সাক্ষাৎকারে কবিপত্নী বলেছিলেন, যদিও শক্তি দলের কিছু নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে দলত্যাগ করেছিলেন, কিন্তু তিনি চিরকাল কম্যুনিস্ট আদর্শে বিশ্বাস করতেন)। কোনও কিছুই করা হয়ে উঠলোনা তাঁর । লিখতেন শুধু গদ্য । কিন্তু প্রেমে পড়ে কবি হয়ে উঠলেন, এই চাইবাসাতেই। প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'হে প্রেম, হে নৈঃশব্দ্য'এর কবিতা চাইবাসাতে বসেই লেখা হয়েছিলো । থাকতেন সমীর রায়চৌধুরির বাড়ি । প্রেম করতেন তাঁর শ্যালিকার সঙ্গে । এই সম্পর্কটি শেষ পর্যন্ত পরিণতি পায়নি, কিন্তু অনেক গবেষকের চিরন্তন খোরাক হয়ে থেকে গেলো । সম্প্রতি বেলা রায়চৌধুরি একটি কাগজে এই ইতিকথাটি তাঁর স্মৃতি থেকে লিখে রেখেছেন । শক্তির হলেও হতে পারতেন শ্যালকের সঙ্গে আমার চাইবাসা থাকাকালীন সৌহার্দ্য গড়ে উঠেছিলো ।

    বুদ্ধদেবের 'কবিতা' পত্রিকায় তাঁর প্রথম পদ্য প্রকাশ, 'যম"। তৃতীয় প্রকাশিত কবিতা, 'জরাসন্ধ', " আমায় তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে", তারপর থেকে সেই যাত্রা, যেখানে মৃত্যুর পরেও মাথা উঁচু হেঁটে যাওয়া, দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়া রুটমার্চ।

    যাঁদের সঙ্গে কবিতার সম্পর্ক নেই, তাঁরা শক্তিকে চেনেন তাঁর অবিরাম, অনশ্বর উৎকেন্দ্রিকতার নিরিখে । বাংলা কবিতার সঙ্গে সুরাপানকে অতো প্রবলমাত্রায় তিনিই জুড়ে দিয়েছিলেন । পদ্য'কে মদ্যের অপরপিঠ করে তোলার যে নিমসাধনা, তার ভগীরথ না হলেও পরশুরাম ছিলেন শক্তি । পরবর্তী প্রজন্মের কবিযশোপ্রার্থীদের 'কবি' হয়ে ওঠার কিছু মেড-ইজি তৈরি করে দিয়েছিলেন তিনি, হয়তো অসচেতনভাবেই । আবার সীমাহীন যশোপ্রার্থীদের গড্ডালিকার বাহুল্যে বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, " এতো কবি কেন?" আর কোনও বাংলা শব্দশিল্পী জীবৎকালে এতো অধিক উপকথার নায়ক হতে পারেননি । উৎকেন্দ্রিকতা না অপ্রকৃতিস্থতা, তাঁর চালিকা শক্তি কী ছিলো তাই নিয়ে আজ অনেক গবেষণা হয়ে থাকে । অলোকরঞ্জন যা'কে বলেছেন " অভিনীত অপ্রকৃতিস্থতা", শক্তি তাকেই নিজের বর্ম করে তুলেছিলেন । পাগলামি'কে এমত একটি স্বীকৃত অবস্থান করে তুলতে তখনও পর্যন্ত কোনও কবি'কে আমরা দেখিনি । অনেকে অতিষ্ঠ হয়ে বলেছিলেন, শক্তি পাগলামি ভাঙিয়েই খেলো । চ্যাপলিন যেমন বলেছিলেন ডিল্যান টমাস প্রসঙ্গে, " সে একজন পাগলের থেকেও অনেক বেশি পাগলামি করে থাকে।" শেষে কি এ তাঁর মুদ্রাদোষ হয়ে পড়েছিলো ? আমি শক্তি, এই আমার প্রকৃত মুদ্রা, আমি একেই ভাঙিয়ে খাবো। এতো বৃহৎমাত্রার অস্বভাবধর্ম পালন করেও কিন্তু তিনি একাধিক প্রজন্মের কবিতাপ্রেমীদের কাছে হিরোর ঊর্দ্ধে, আইকন । অনেক রসিক আক্ষেপ করেন, এখন আমারও মনে হয়, শক্তি যদি জীবদ্দশায় এতো লোকপ্রিয়তা, এমত খ্যাতি না পেতেন, তবে হয়তো তাঁর কাছ থেকে আরো অনেক শ্রেয়তর সৃষ্টি আমাদের নসিব হতে পারতো ।

    সাহিত্য অকাদেমি পেতে পেতে তিনি ফুরিয়ে গিয়েছিলেন। রাইনের মারিয়া রিলকে তাঁর এলিজি'র গুরু ছিলেন । শক্তি সারাজীবনে অসংখ্য এলিজি লিখেছেন । কিন্তু তাঁর শ্রেষ্ঠ এলিজি'টি ছিলো তাঁর অকাদেমি পাওয়া বইয়ের নামকবিতা । নেহাৎ সংযোগ, না নিয়তি নিবিষ্ট উপসংহার।

    "সকল প্রতাপ হল প্রায় অবসিত…
    জ্বালাহীন হৃদয়ের একান্ত নিভৃতে
    কিছু মায়া রয়ে গেলো দিনান্তের,
    শুধু এই -
    কোনোভাবে বেঁচে থেকে প্রণাম জানানো
    পৃথিবীকে।
    মূঢ়তার অপনোদনের শান্তি,
    শুধু এই -
    ঘৃণা নেই, নেই তঞ্চকতা,
    জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
    বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু। "
    -------------------------------------
    ১৫.

    ".....তোমার হাতের মাঝে আছে পর্যটন-
    একথা কি খুশি করে মন?
    একথা কি দেশ ঘুরে আসে
    স্মরণীয় বসন্তবাতাসে!

    এবার হলো না তবু ছুটি
    দুলে ওঠে মোরগের ঝুঁটি
    বেলা গেলো - বুকে রক্তপাত

    বাগানে কি ধরেছিলে হাত
    বাগানে কি ধরেছিলে হাত? "

    দফতরে বসে মাথা গুঁজে দলিলদস্তাবেজ ঘাঁটছিলুম। পার্থ বলে, দ্যাখো, কে এসেছে? দেখি কুন্তল হাসিমুখে সামনে এসে বসলেন ।
    -শুনুন থলকোবাদ ফরেস্ট বাংলো বুক হয়ে গেছে শুককুরবার রাতের জন্য । পার্থ বলছে আপনি বৃহস্পতির মধ্যে এখানে গুটিয়ে নেবেন । আমরা শুককুর সকালে বেরোবো, এদিকওদিক ঘুরেফিরে রাতে ওখানে থাকা । পরদিন সকালে আরাম সে উঠে ফিরে আসবো। এগ্রিড?
    -পার্থ, তুমি যাবে?
    -আরে না, আমার ফুরসত নেই, তোমরা যাও...
    -ঠিক আছে, থ্যাংকস...
    -আজ আসি, এর মধ্যে একদিন আসুন না..
    -যাওয়া যেতো.... রোজ খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে, সময় পাচ্ছিনা...
    -ঠিক আছে, বৃহস্পতিবার আমি একবার এসে বাকি ডিটেলসগুলো পাকা করে নেবো, আসি...

    কুন্তল চলে যা'ন।

    তাড়াহুড়ো করে কাজ শেষ করে নিচ্ছিলুম সেদিন । রিপোর্টটাকে একটা মোটামুটি জায়গায় আনতে হবে । সংখ্যাতত্ত্বের চাপে বেশ ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। যেকোনো ব্রাঞ্চ ক্লোজ করার সময় এই চাপটা থাকে ।
    -নমস্কার..
    দেখি কুন্তল দাঁড়িয়ে আছেন । বলি, বসুন ; আর একটুক্ষণ লাগবে, শেষ হয়ে এলো....।
    কিন্তু তিনি বিমর্ষমুখে দাঁড়িয়েই রয়েছেন,
    একটু অবাক হই, কিছু ঘটলো নাকি ?
    -একটা মুশকিল হয়ে গেছে, আজ রাতে আমাকে একটু বাইরে যেতে হচ্ছে....
    -বেশ তো, তাতে কী হয়েছে ?
    -নাহ, আমি কাল যেতে পারবো না । আজ রাতেই আমাকে কলকাতা বেরিয়ে যেতে হবে, কাল ওখান থেকে দিল্লির ফ্লাইট...
    -জরুরি কাজ নিশ্চয়...
    -অত্যন্ত, মার্চ মাসেই আমাদের পরের বছরের বাজেট অ্যালোকেশনটা করিয়ে নিতে হয় ....ভেবেছিলুম ডাকটা পরের সপ্তাহে আসবে, কিন্তু...
    -কিন্তু কীসের?
    -থলকোবাদ...!
    -ধ্যুৎ মশাই, ওটা কি আর কোনো ব্যাপার হলো...? নিশ্চিন্তে যান। পরেরবার আসবো যখন, তখন হবে ...
    -ওটাই তো বলতে এলুম, আপনি কালই যাবেন.... আমার লোক চলে গেছে ওখানে... সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে... শুধু আমি যেতে পারছি না... যা তা ব্যাপার...

    - না না, আমি একা একা গিয়ে আর কী করবো, বহুবার গেছি, পরে যাবো নাহয় আপনাদের সঙ্গে...
    -একা কেন যাবেন ? রিমা যাবে তো....
    -তো...
    -আপনিও যাবেন...
    -পাগল হলেন নাকি?
    তার পর অনেকটা সময় ধরে চললো একটা অসম্ভব রকমের দরাদরি । এভাবে তো যাওয়া যায়না । পূর্বপরিচিতি অনেক ধূসর হয়ে গেছে কালের ধুলোসরে । তার উপর রাতে থাকার একটা ব্যাপার রয়েছে । কিন্তু অনুভব করি এই ঘটনাক্রমটি ইতোমধ্যেই নিঃশব্দে আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে । যাবতীয় সংলাপ বৃথা এবং সদিচ্ছা বাহুল্য বোধ হচ্ছে । পার্থ'কে আরো এক বার যেতে অনুরোধ করি, লাভ হয়না। এতো দ্বিধা নিয়ে তো আমি দেবমন্দিরেও যাইনা। অসহায় লাগে...

    ".....একপ্রান্তে জনপদ অন্যপ্রান্ত জনশূন্য
    দুদিকেই কূল, দুদিকেই এপার-ওপার, আসা-যাওয়া, টানাপোড়েন -
    দুটো জন্মই লাগে
    মনে মনে দুটো জন্মই লাগে। ....."
    ------------------------------
    ১৬.

    ".....যেতে-যেতে ফিরে চায়, কুড়োতে-কুড়োতে দেয় ফেলে
    যেন তুমি, আলস্যে এলে না কাছে, নিছক সুদূর
    হয়ে থাকলে নিরাত্মীয় ; কিন্তু কেন? কেন, তা জানো না।
    মনে পড়বার জন্য? হবেও বা । স্বাধীনতাপ্রিয়
    ব'লে কি আক্ষেপ? কিন্তু বন্দী হয়ে আমি ভালো আছি....."

    সমস্ত সুন্দরেরই একটা নির্মাণ থাকে । তা'কে গড়ে উঠতে হয়। কবিতাও তার ব্যতিক্রম নয় । জীবনানন্দকে পরিচয় করিয়ে দেবার সময় বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, তিনি শুধু কবিতাই লেখেন। কবিতা ছাড়া আর কিছু লেখেন না । এই 'শুধু কবিতা লেখা' বলতে বুদ্ধদেব কী বোঝাতে চেয়েছিলেন? জীবনানন্দ বিহানযামিনী কেবল কবিতার 'ঘোরে' থাকেন । তাঁর সব চিন্তা, সব কাজ, প্রার্থনার সকল সময়, শুধু কবিতার ভাষাতেই প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে? বুদ্ধদেবের মতো বাংলাভাষার একজন ধীমান মনস্বী কি তবে সত্যিই বিশ্বাস করতেন কবিতায় শ্রমের স্থান নেই । জানি, দেশে-বিদেশে অনেক মনস্বীই সে রকম ভেবে থাকেন । কবিতা ট্র্যান্স থেকে , ঘোর থেকে উঠে আসা স্বয়ম্ভূ ব্যক্তিগত উচ্চারণ শুধু । কিন্তু যখন তা মুদ্রিত অক্ষরে লক্ষ মানুষের দরবারে গিয়ে পড়ে, তখন তার অবস্থান কী হবে? এই মোড়টিতে এসে বহু জিজ্ঞাসু থমকে যা'ন । পাঠক কি কবির জুতোয় সমান মসৃণতায় স্বচ্ছন্দ হয়ে থাকতে পারেন? স্পর্শ করতে পারেন কবির সব অভিমান? নয়তো তাঁর কাছে কবি নিজের পসরা নিয়ে যা'ন কেন?

    বুদ্ধদেব জীবিত থাকতে যদি ভূমেন্দ্র গুহ জীবনানন্দের সব পান্ডুলিপির খাতা উদ্ধার করতে পারতেন, তবে বুদ্ধদেব কি নতুন করে ভাবতে বসতেন । কবিতায় কোন অনুপাতে 'ঘোর' আর শুদ্ধ সচেতন 'শ্রম' ব্যবহার করে জীবনানন্দ কেউ কেউ 'কবি' দের মধ্যে পৌঁছে যেতে পেরেছিলেন । যে জীবনানন্দ ছাত্রপাঠ্য 'ইতিহাসচেতনার কবি' ন'ন, ন'ন 'অবক্ষয়ের প্রতীক' পদ্যকার, তিনি কে? কৃতার্থ পাঠকের কাছে তাঁর সৃষ্টির স্বরূপটি কী হতে পারে ?

    প্রতীক, রূপক, কিম্বদন্তী, মিথস্ক্রিয়া, জীবনানন্দের সবকিছুই ছিলো একটু অন্যরকম । যদি কবিতার আত্মার কথা ভাবি, তবে তিনি একজন ইংরেজ । কিন্তু কবিতার শরীর বাঙালি মেয়ের মতো । আর্দ্র, শ্যামল, নমনীয়, অলংকৃত, রহস্যময় । শক্তি নিজের কবিতায় জীবনানন্দের কাব্যশরীর'টিকে নিজের মতো করে গ্রহণ করেছিলেন । তাই তাঁর পদ্যে জীবনানন্দের উপস্থিতি বড্ডো প্রত্যক্ষ । কিন্তু শক্তির অনুভবের জগৎটি রবীন্দ্রনাথের বেশি কাছাকাছি । অতোদিন আগে যখন তিনি আমাকে বলেছিলেন, " আমি শুধু ঐ বুড়োটার চ্যালা", তখন আমারও বেশ বিস্ময় লেগেছিলো । জীবনানন্দের সঙ্গে শক্তি'কে, সমর সেনের সঙ্গে সুনীল'কে যুক্ত করে বিচার করার একটা প্রচেষ্টা প্রভূত স্বীকৃত হয়েছিলো । তার কিছু রেশ এখনও রয়েছে।

    শক্তি কবিতা'র ক্ষেত্রে শ্রম স্বীকার করার পক্ষে সওয়াল করে এসেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন " অনুশীলন করে প্রথমে ছন্দোবদ্ধ লেখা তৈরি করা কবিতারচনার প্রথম ধাপ।" কবিযশোপ্রার্থীদের জন্য তাঁর নির্দেশ ছিলো " অনুশীলনকামী মাত্রের প্রতি আমার সাদর নির্দেশ হলো-অন্তত একশোটা সনেট লিখুন। তারপর নিজের পথ চোখের সামনে খুলে যাবে।" প্রথমজীবনে তাঁর অনুশীলনপর্বে প্রচুর সনেট লিখেছিলেন । তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতাটি একটি সনেট, 'যম", যে'টি 'কবিতা' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিলো । পরবর্তীকালে অবশ্য তিনি এই কবিতাটিকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, " ওটি বাজে পদ্য" এই অভিযোগে। কোনও কাব্যগ্রন্থে সংকলিতও করেননি।

    কিন্তু এতোদিন ধরে কবিতার সঙ্গে সহবাস করে মনে হয়, বাংলা কবিতায় স্বভাব, মেজাজ, শরীর ও আত্মার নিরিখে জীবনানন্দের প্রধান উত্তরাধিকারী এক ও অদ্বিতীয়, বিনয় মজুমদার । শক্তি সে অর্থে উত্তরাধিকারী ন'ন, অধমর্ণ বলা যেতে পারে । অবশ্য তাতে শক্তির কোনও গৌরবহানি হয়না, অথবা বিনয়ের গরিমার প্রশ্নে কোনও সংশয় নেই।

    "....কেউ না কেউ, যা'কে তুমি চেনোনা
    অপেক্ষা করে থাকে পাতার আড়ালে শক্ত কুঁড়ির মতন
    মাকড়সার সোনালি ফাঁস হাতে, মালা
    তোমায় পরিয়ে দেবে- তোমার বিবাহ মধ্যরাতে, যখন ফুটপাথ বদল হয়
    -পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করে
    দেয়ালে দেয়াল, কার্নিশে কার্নিশ ।....."


    ----------------------------------------------
    (ক্রমশঃ)
    ১৭.

    ".....সুখের বারান্দা জুড়ে রোদ পড়ে আছে
    শীতের বারান্দা জুড়ে রোদ পড়ে আছে
    অর্ধেক কপাল জুড়ে রোদ পড়ে আছে
    শুধু ঝড় থমকে আছে গাছের মাথায়
    আকাশমনির ।

    ঝড় মানে ঝোড়ো হাওয়া, বাদ্লা হাওয়া নয়
    ক্রন্দনরঙের মত নয় ফুলগুলি
    চন্দ্রমল্লিকার ...."

    রোদ ক্রমে আসিতেছে। সকালে ঠিক সাতটা নাগাদ ফোন এলো রিসেপশন থেকে । গাড়ি এসে গেছে । নেমে আসি সামনের গাড়িবারান্দায় । কালো বন্ধ জীপ গাড়ি । খোলা জীপে ধুলোয় লাল হয়ে যেতে হয় । ড্রাইভার গাড়ির দরজাটা খুলে দেয় । উঠতে গিয়ে দেখি রিমা অন্যদিকের জানালার ধারে বসে।
    -গুড মর্নিং...
    সে ফিরে তাকাতেই চোখ পড়লো একটা টিপের দিকে, তার কপালে, লাল টুকটুকে । আমি রিমাকে সিঁদুরের টিপ পরে কখনও দেখিনি । সকালের আলো কি ধন্য হলো ঐ রংটাকে এতো বিশ্বস্তভাবে ধরতে পেয়ে ।
    -দারুউউণ...
    -কী...
    -টিপ...
    -মানে..?
    -কিছু না ....
    গাড়ি ড্রাইভওয়ে ধরে রাস্তায় নেমে এলো ।
    - শুনলাম তুমি নাকি আসতে চাইছিলে না..
    -না না , ঠিক তা না ; সব চেয়ে উৎসাহী ব্যক্তিটি যদি আটকে যান, তবে .. মানে স্ফূর্তিটা একটু নিভে যায় তো...
    -ওহ, আমি ভাবলাম অন্য কোনও কারণ রয়েছে...
    -তুই খুব ভাবিস না..?
    -কেন ? আমাদের কি ভাবতেও মানা ?
    -ঝগড়া করার মতলব আছে নাকি রে?
    -নাহ, সেটাও তো মানা....
    -বোঝো ...তবে বহুবচনটা, মানে 'আমাদের', ইহার ব্যাখ্যা বলহ...
    -'আমাদের' মানে, যাদের পর্ণার মতো এলেম নেই, লেসার মর্ট্যালস....

    এবার আমি ওর চোখের দিকে তাকাই, রিমা মুখটা ঘুরিয়ে নেয়..

    "যাবো না আর ঘরের মধ্যে
    অই কপালে কী পরেছো
    যাবো না আর ঘরে
    সব শেষের তারা মিলালো
    আকাশ খুঁজে তাকে পাবে না
    ধরে-বেঁধে নিতেও পারো তবু সে-মন ঘরে যাবে না
    বালক আজও বকুল কুড়ায় তুমি কপালে কী পরেছো
    কখন যেন পরে?
    সবার বয়স হয়
    আমার
    বালক-বয়স বাড়ে না কেন
    চতুর্দিক সহজ শান্ত
    হৃদয় কেন স্রোতসফেন
    মুখচ্ছবি সুশ্রী অমন, কপাল জুড়ে কী পরেছো
    অচেনা,
    কিছু চেনাও চিরতরে। "
    ----------------------------
    ১৮.

    " যদি কোনোদিন যাই মেঘের ওপারে
    তোমাকেও নেওয়া যেতে পারে।
    তার পরে, পথ নেই। ফুটে আছে ফুলের প্রদীপ
    তুমি কি পোড়াবে কিছু? জ্বালিয়ে নেবেনা সন্ধ্যাদীপ?
    আরো কিছুক্ষণ যেতে হবে
    পথ বড়ো সংকীর্ন, কঠোর

    তারই মধ্যে যাওয়া এলোমেলো-
    বলে, শান্ত, কে এখানে এলো?"

    কিরিবুরু আর মেঘাতুবুরু, প্রায় তিন হাজার ফুট পাহাড়ের উপর দুটো ছোট্টো শৈল বসতি। সেল কোম্পানির লোহা খাদান ঘিরে বসবাস। পাহাড়ের পায়ের কাছে সিংভূমের শেষ । অন্যপারে পাহাড় পেরিয়ে কেঁদুয়াঝাড় জেলা । সারান্ডা অরণ্যের কেন্দ্র এই শিখর শহর দুটি। হো ভাষায় 'সারান্ডা' মানে সাতশো পাহাড় । এটা সাতশো পাহাড়ের দেশ। সঞ্জীবচন্দ্রের দৌলতে ইংরিজিজানা বাঙালির কাছে পলামুর বনজঙ্গল পরিচিতি পেয়েছিলো ঊনবিংশ শতকেই। বেতলা, লাতেহার, ছিপাদোহর, মহুয়াডাঁড়, গাড়োয়া, গারু, কুটকু, বড়াসাঁড়, নানা ফরেস্ট রেঞ্জ । পূর্বদিকে নেতারহাট থেকে শুরু করে পশ্চিমে মির্জাপুর । উত্তরে হান্টারগঞ্জ, চাতরা থেকে দক্ষিণে গুমলা,সরগুজা । সে তুলনায় বাঙালির কাছে সারান্ডা ছিলো অচেনা । উত্তরে পোড়াহাট আর কোলহান অরণ্য, সারান্ডা জঙ্গলে রেঞ্জ আছে চারটি । সামটা, কোয়না, সসাংদা আর গুয়া, এটাই সাতশো পাহাড়ের দেশ । এই অরণ্যের হৃদয়দেশে দু'টো বনবাংলা, আজ তারা অতীত, থলকোবাদ আর কুমডি । বড়াজামদার দিক দিয়ে গেলে কিরিবুরু'র কাছে পড়তো কুমডি । আরো পনেরো-কুড়ি কিমি এগিয়ে গিয়ে থলকোবাদের সেই পুরোনো বনবাংলা। যা'কে বিভূতিভূষণ চিনিয়ে ছিলেন বাঙালিদের কাছে । বহুদিন আগে শক্তি আর সন্দীপনকে নিয়ে গিয়েছিলুম কুমডি বাংলায় । তাঁদের রাত জেগে কখনও ঘুম, কখনো নেশা, কখনও পাগলামি, আর এতোলবেতোল প্রমত্ত প্রলাপের অভিনীত অপ্রকৃতস্থতা থেকে উঠে আসা পরবর্তী কালের লেখালেখির বীজ, শুনেছিলুম আমরা । রাতের বেলা ওসব জায়গায় কোনও রকম শব্দদূষণ একেবারে মানা । তাই টেনশন নিয়ে পাহারা দিতে হয়েছিলো রাতভর। কিন্তু সেবার অন্ধকারে হরিণের সবুজচোখ ছাড়া আর কিছু দেখা যায়নি ।

    এবার অবশ্য অনেক স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে যাওয়া । গিট্টি-বালির লরি'র উপর বসে, সতত সতর্ক চোখে নেমে আসা গাছের ডালের দিকে নজর রেখে, আশেপাশের সবুজ অমল'কে খুঁজে যাওয়া এখন রীতিমতো অতীত হয়ে গেছে । রিমার মতো-ই, এখন সে মধুরিমা। পটুয়াদের গোটানো পট খোলা, আবার জড়িয়ে ফেলা, মধ্যলয়ে গেয়ে যাওয়া মনসামঙ্গলের গীতের মতো। পুরোনো সময় কখনও খোলে, আবার গুটিয়ে যায় নিজের মতো, বীথোফেনের ফিফথ সিম্ফনি, শব্দহীন, তিনি নিজে যেভাবে তা'কে খুঁজে পেতেন, শুনে যেতেন মনে মনে । আমিও শুনি সেই সব ছবি । সেই কিশোরী, এক পূর্ণা নারী, একজন মা, গৃহিনী, কয়েকজন মানুষের বেঁচে থাকার বাতিঘর ।

    স্তব্ধতা ভাঙি,
    - কী রে, অমন মুখ ব্যাজার করে বসে আছিস কেন ? ভালো লাগছে না ?
    -না তো, আমি ভাবলাম তুমি বিরক্ত হয়ে আছো বোধ হয়...
    -ওফ, শুধরাবি না আর...
    -আপেল খাবে ?
    -দে একটা...তোর ছেলেটা খুব মিষ্টি হয়েছে, ক'বার আসে বছরে ?

    এবার উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে সে যেকোনও মা'য়ের মতন । মসৃণ ঝর্ণায় অনর্গল আত্মজের গল্প ঝরে পড়ে । তার একেবারে ইচ্ছে নয়, ছেলেকে অতোদূরে রেখে পড়ায় । কিন্তু এ তল্লাটে তো কোনও ব্যবস্থা নেই। ভালো ইশকুল সেই জামশেদপুর । সে'ও খুব একটা কাছে নয় । আর সেখানে ভালো হস্টেল পাওয়া যায়না। কুন্তলের এক ভাই দার্জিলিঙে পড়তো । তার ছোটোবেলার স্বপ্ন ছিলো ঐ সব ইশকুল । নিজের হয়নি, ছেলেকে দিয়ে উপর সাধ মেটাচ্ছে ।

    এতোক্ষণে সে যেন স্বাভাবিকতায় ফিরে এলো । যা'কে চিনতুম, সেই মেয়ে । স্পষ্ট বড়ো হয়েছে, শরীরে, মনে । কাঁঠালকাঠের চৌকি বদলে এসেছে খাট, কুঁড়েঘরের দরজা সরে জোড়া কপাট , এখন অনেক বড়ো হয়েছে...
    চুপ করে শুনি তার উচ্ছল জলতরঙ্গের শব্দভাষ । তাকে বলি,
    -একটা কথা বলবো ?
    -নিশ্চয়, বলো...
    -নাহ, থাক, আফটার অল, ইউ আর আ পরস্ত্রী...
    -ন্যাকামি করতে হবেনা, এসব কবে থেকে শুরু করলে...
    -তবে বলি?
    -না, বোলোনা...
    -তবে বলেই ফেলি, কী বল..?
    এবার সে ভেঙে পড়ে হাসির সেই শব্দে, পিয়ানো'র বাঁদিক থেকে ডানদিকে দ্রুত গড়িয়ে দেওয়া আঙুল থেকে যে ঝংকার বেজে ওঠে , শালপাতায় ঝরে পড়া বৃষ্টির প্রথম পশলার মতো ধ্বনি, শুনতে পাই, বলি,
    -তোকে দেখতে খুব সুন্দর হয়ে গেছে...
    একটু লজ্জা পায় হয়তো, কিন্তু স্পষ্টতঃ খুশি হয়, তোমার আজ কী হয়েছে ?
    -না রে, কিছু হয়নি আলাদা করে, ভাবি বলি, তোকে দেখতে গণেশ পাইনের রাণীর মতো লাগছে...
    -তোমার মতলবটা কী বলোতো ?
    -আমার তো ওটাই মুশকিল.. কখনও কোনও মতলব আঁটতেই পারলুম না ..
    -এবার আমি তোমায় একটা কথা বলি?
    -বল...
    -পর্ণা কোথায় আছে ?
    -ঠিক জানিনা রে, ও দেশেই কোথাও হবে ...
    -খোঁজোনি?
    -খুঁজবো কখনও, ইচ্ছে হলে...
    -আরো কুড়ি বছর পর ?
    -তার বেশিও হতে পারে ....
    -ধ্যুৎ...

    "ঝড়ে হঠাৎ ভেঙে পড়লো তোমার মুখের জলপ্রপাত
    স্মৃতি? নাকি স্মৃতির মতন নিরুদ্বিগ্ন বিষণ্ণতার
    একটি করুণ মূর্তি, নাকি ভেঙে পড়লো পূর্ণিমারাত ?
    বুকের খড়ে মুখটি গোঁজা আধবোজা কোন স্বর্ণলতার
    ভ্রূমধ্যে টিপ সন্ধ্যাপ্রদীপ যদি দেখাও দুয়ারপ্রান্তে
    অনেক দূরের একা পথিক-আজো আমায় ডেকে আনতে
    তোমার ছেলেবেলার পাশে আর কি আছে সেই তামাশা-
    বলো এবং বলো আমার জীবনমরণ ভালোবাসার
    ভাষার অধীন, বিপর্যস্ত-স্থাপন করি মুখটি হাতে ।।"
    ------------------------------------------
    ১৯.

    " আজ আমার সারাদিনই সূর্যাস্ত, লাল টিলা-তার ওপর
    গড়িয়ে পড়ছে আলখাল্লা-পরা স্মৃতির মেঘ
    গড়িয়ে পড়ছে উস্কোখুস্কো ভেড়ার পাল, পিছনে পাঁচন
    জলও বা হঠাৎ-ফাটা পাহাড়তলির
    কিংবা বৃষ্টি-শেষের রাতে যেমন আসে কবিতার আলুথালু স্বপ্ন,
    সোনালি চুল...."

    গাড়ি ততোক্ষণে নেমে পৌঁছে গেছে কোয়েল উপত্যকায় । মাঝে মাঝে সমতল, কিন্তু ক্রমাগত চড়াই-উৎরাই । অরণ্য কখনও ঘন, কখনও ছোটো ছোটো গ্রামের কাছে এসে হাল্কা হয়ে যাচ্ছে । কোন প্রাক ইতিহাসকাল থেকে সিংভূমের এই শালের জঙ্গল, পিয়াল, জারুল, আমলকী, বট, কাঁঠাল, সেগুন, মানুষের নির্বাণভূমি হয়ে জেগে আছে , কে জানে ? একটা পাক খাওয়া রাস্তার চড়াই উঠে আমরা থলকোবাদ বনবাংলা পৌঁছে যাই । গাড়ির আওয়াজ পেয়ে বুধিয়া তামসোয় বেরিয়ে আসে । পিছনে আরো দুজন লোক । কুন্তলের পাঠানো স্কাউট পার্টি। দুজনে নেমে আসি । হাত-পা খেলাই । রোদ বেশ বেড়ে গেছে, কিন্তু হাওয়া ভারি স্নিগ্ধ । টালির ঢালু ছাদের বনবাংলা। সাহেবরা বানিয়েছিলো এই রম্য অরণ্য-আবাসটি সেই ১৯০২ সালে। একেবারে কাছে থেকে বন্য জন্তুদের দেখবে বলে । বিভূতিভূষণ এখানেই এসে রাত কাটিয়েছিলেন । তার পর সেই অনন্য জার্নাল, 'থলকোবাদে একরাত্রি'। বাঙালিদের কল্প ভ্রমণ মানচিত্রে তখন থেকেই এই জায়গাটা নিজের স্থান করে নিয়েছে। যদিও অতিথিরা আসেন এখানে নিয়মিতভাবে, কিন্তু বনবিভাগের রক্ষণাবেক্ষণ যে কোনও সরকারি উদ্যোগের মতো-ই ম্লান । বুধিয়া একদিন আগে এসে অবস্থা যতোটা শুধরানো যায়, তার ব্যবস্থা করেছে। আমি তো অনেক এসেছি সড়কছাপ লফঙ্গার উদাসিনতা সঙ্গে করে । এবার ব্যতিক্রম হলো। একেবারে সাহেবি অতিথি টাইপ, উন্নাসিক, ধন্য করে দেওয়া চালচলন নিয়ে। হাসি পায়, কিন্তু হাসিনা এখন আর।

    দু'জনকে দুটো পাশাপাশি ঘরের দিকে নিয়ে যায় বুধিয়া, সেই গাঢ় সবুজ রং দরজা জানালা চৌকাঠ । অ্যাজবেস্টসের ফলস সিলিং । নিরাভরন বিছানা, মশারি, জুটের কালীন । নতুন দেখলুম, জানালায় মশার জাল লেগেছে। এতো সরল, ভানহীন আয়োজন; পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে মসৃণ মিশে আছে । চোখেমুখে জল দিয়ে বাইরে আসি । বারান্দায় প্রাতরাশ সাজানো আছে । প্রাতঃকাল তো কখন কেটে গেছে, কিন্তু অল্পস্বল্প খিদে পাচ্ছে এই নির্মল অক্সিজেন আবহে। বেতের কুর্সিতে বসি । রিমাও বেরিয়ে আসে তখনই।
    -এতো খাবার ?
    -খা না যা ইচ্ছে,....
    -বুধিয়া একটু চা হবে ?
    -হ্যাঁ ম্যাডাম, এখুনি দেবো ?
    -দাও, গলাটা ভেজাই... হ্যাঁ, একটাই দাও, ইনি খান না....
    -তোর মনে আছে তা হলে...
    -আছে, আমার সব মনে থাকে...
    -তা ব্রেশ... শোন, আমার সব কিছু হয়তো মনে থাকেনা,... কিন্তু তুই একবার একটা কিছু চেয়েছিলি, অনেক অনেকদিন আগে...কিন্তু কখনও নিতে আসিসনি... কিছু মনে আছে তোর ?
    -হুঁ, আছে, শক্তি....কিন্তু তখন তোমার সময় হয়নি.....
    -সময় ? বোধ হয় গিয়েছে চলে ঝুড়ি ঝুড়ি বছরের পার...
    -তবে?
    -তবে শোন, এই কবিতাটা , জানিনা পড়েছিস কি না?
    -কোনটা?
    -অনন্ত কুয়ার জলে চাঁদ পড়ে আছে....
    -পড়েছি....
    বারান্দা থেকে নেমে আমরা ঢালের দিকে শালবীথির ছায়ায় এগিয়ে যাই। এখান থেকে অনেক নিচে কারো নদীর বাঁক নিয়ে বনের আরো ভিতরে গড়িয়ে যাবার দৃশ্যটা পরিষ্কার দেখা যায়।


    --------------------------------
    (ক্রমশঃ)

    ২০.
    ",.... এবার তোমাকে নিয়ে যাবো আমি নক্ষত্র-খামারে নবান্নের দিন
    পৃথিবীর সমস্ত রঙিন
    পর্দাগুলি নিয়ে যাবো, নিয়ে যাবো শেফালির চারা
    গোলাবাড়ি থেকে কিছু দূরে রবে সূর্যমুখী পাড়া
    এবার তোমাকে নিয়ে যাবো আমি নক্ষত্র-খামারে নবান্নের দিন ।

    যদি কোনো পৃথিবীর কিশলয়ে বেসে থাকো থাকো ভালো
    যদি কোনো আন্তরিক পর্যটনে জানালার আলো
    দেখে যেতে চেয়ে থাকো, তাহাদের ঘরের ভিতরে-
    আমাকে যাবার আগে বলো তা-ও, নেবো সঙ্গে করে....."

    ঠিক কোথা থেকে শুরু হয় কবিতা নিয়ে কথা, এখনও জানিনা। একটা শব্দ, একটা বাকপ্রতিমা, একটা ধ্বনিঝংকার, একটা অপ্রত্যাশিত নীরব যতি, কে যে কবিতা'কে ডেকে আনে, বোঝা যায়না । কবিতা কি অক্ষরবদ্ধ কিছু নির্মাণ, ভিতরে প্রস্তুত বারুদস্তূপে ফুলকি লাগানোর ডিটোনেটর । কবির প্রস্তুতি আগে হয়, না পাঠকের ? যার বারুদ যথেষ্ট শুকনো নয়, তার জন্য কবিতার কোনও যাথার্থ্য রয়েছে কি? কবিতা কি শুদ্ধ তীক্ষ্ণতা না নিরাময় প্রলেপ; না সব কিছু নিয়েই কবিতা । কবিতা কি কথিত বিশুদ্ধ পাগলামি না পবিত্র বোধির অক্ষরবৃত্ত শ্রমপ্রতিমা। যে শব্দ ব্রহ্ম, তার রূপ কেমন? অক্ষরবদ্ধ না শ্রুতিসম্ভব ?

    নক্ষত্র-খামারে নবান্নের দিন এবং সেখান থেকে শুরু এক আন্তরিক পর্যটন । তা'কে মনে রেখেও উঠানে কুয়ার জলে পড়ে থাকা চাঁদ, অনন্ত, সার্বভৌম। পৃথিবীর রঙিন পর্দাগুলি আর জানালার আলো, সবই ঘরের অন্তর্মুখ ব্যপ্তি । সবই সঙ্গে যাবে, যদি চাই। এই তো কবিতা, ব্যাখ্যাহীন, জটিলতাহীন, অমলিন। এখান থেকেই যদি শুরু হয় শক্তির পদ্যের দিকে যাত্রা, কবির উদ্দেশ্যটি চিনে নেওয়া যায়, কোনো ক্রূরকাব্যপ্রকরণের পরোয়া না করে ।

    ",.... সে কি জানিত না যত বড়ো রাজধানী
    তত বিখ্যাত নয় এ-হৃদয়পুর
    সে কি জানিত না আমি তারে যত জানি
    আনন্দ সমুদ্দুর

    আজ সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি
    এমন ছিলো না আষাঢ়-শেষের বেলা
    উদ্যানে ছিলো বরষা-পীড়িত ফুল
    আনন্দ-ভৈরবী।"

    এইখানে তাঁর গুরু, সেই 'বুড়ো' হাত ধরে লিখিয়ে নিচ্ছেন তাঁকে । যেন আমার গানের শেষে , থামতে পারি সমে এসে, ছয়টি ঋতুর ফুলেফলে ডালা ভরে নেবার আকাঙ্খা। অন্তহীন আশাবাদ আর শুদ্ধ বাঙালি পেশকারি । মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণবপদাবলীর মতো সীবনচিণ্হহীন আবহমান বাংলা । 'মহাপৃথিবী' বা 'সাতটি তারার তিমিরে'র মতো য়ুরোপীয় মার্জনা আর নিখুঁত অক্ষরচিত্র থেকে একটু দূরে, দেখা যাচ্ছে, কিন্তু ছোঁয়া যাচ্ছেনা । প্রায় একসঙ্গে শুরু করে, একসঙ্গে দীর্ঘকাল হেঁটে গিয়ে সুনীলের গরিমা বিবর্তিত হয় একজন কবিদলপতিরূপে, কিন্তু শক্তির যাত্রার অভিমুখ চিরকাল অন্তর্দিশার আলোকস্তম্ভের দিকে। তাঁর কবিতার শেষ ট্যাগলাইনকে হতে হবে " আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী"।

    সুনীল আর শক্তি দু'জনেই পড়াতে যেতেন শান্তিনিকেতনে । সুনীল নিবিষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে, প্রকৃত অধ্যাপকের মতো বিনিময় করতেন। মুগ্ধ করে রাখতেন প্রস্তুত শ্রোতাদের । কিন্তু শক্তি সব ছেলেমেয়েদের নিয়ে পথেঘাটে ঘুরে বেড়াতেন। কথা-কথকতা সব উঠে আসতো মানুষকে দেখে, বৃক্ষকে দেখে, কাক-চড়াই, পুকুর-জলা, শ্যাওলা-পানা, সবাইকে সামনে রেখে। বৃষ্টির মতো কবির সংলাপমালায় ভিজে যেতো স্নাতক বালকবালিকারা। তাদের দেখার চোখ, শোনার কান ধারালো হতো নিজের ছন্দে। শক্তি'র সেই 'বুড়ো' বোধ হয় এরকমই কিছু চাইতেন।

    শক্তি বলেছিলেন, কবিতা হবে দ্বিপ্রহরের রোদের মতো স্বচ্ছ । এই স্বচ্ছতাই হবে তার রহস্য । আধো অন্ধকার দিয়ে তাকে আবৃত রাখার প্রয়োজন নেই। যখন মনে হয় সব কিছু দেখা যাচ্ছে, সবই 'বোঝা' যাচ্ছে হয়তো ; এটা জরুরি নয়, সুন্দরের অন্তর্লীন রহস্যও উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছে প্রশ্নহীন। এই রকম কিছু ভাবতেন শক্তি। একটা ব্র্যান্ড তৈরি করতে চেয়েছিলেন নিজেকে নিয়ে ; যে অর্ধেক মানব, অর্ধেক কল্পনা। মদ্যপান তাঁর সমসাময়িক অনেকেই করতেন, বন্ধহীন । কিন্তু সেই পর্যায়ের, শিশুর কাঁধে ছুটন্ত মড়ার পালকি আর পরপারে বুড়োদের লম্বালম্বি বাসরঘরী নাচ, সামাজিকভাবে পরিবেশন করতে আর কাউকে দেখা যায়নি ।

    এখানটায় এসে রিমা বলে, তিনি আসলে কী ? স্বেচ্ছাচারী না পাগল না আয়াসকৃত উৎকেন্দ্রিক ? বলি,
    -দ্যাখ, তাঁর পদ্য লেখার শুরুটা কেমন ?
    তিনি লিখেছেন, রাত্তিরবেলা বাড়ি ফিরে হিসেব মিলিয়ে একটা সনেট খাড়া করি। পরের দিন সুনীলের বাসায় যাই। লেখাটা অতি সাধারণ, 'যম', ওর কাছ থেকে 'কবিতা'র ঠিকানা নিয়ে বুদ্ধদেবকে পাঠাই। উনি চিঠি দেন, সামান্য সংশোধন করে ছাপবেন। হাতে স্বর্গ পাই-কিংবা মনের মধ্যে কী যেন এক অবাস্তব হাওয়া বাড়তে থাকে। প্রায় দৌড়ে সুনীলের কাছে গিয়ে চিঠিটা দেখাই এবং দু'তিনটি টানা গদ্যে-লেখা 'সুবর্ণরেখার জন্ম' আর 'জরাসন্ধ'। সুবর্ণরেখা কৃত্তিবাসের জন্যে রেখে দিলে পরের ডাকেই 'জরাসন্ধ' বুদ্ধদেবের কাছে পাঠাই। পদ্য লেখার আকস্মিক জন্ম প্রকৃতপক্ষে সেদিনই। প্রেরণা না, কোনো সনির্বন্ধ ভালোবাসায় না-শুধুমাত্র চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি এসে এই সব পদ্য লেখা।

    যদি এটাই শুরু হয়, তবে সেখানে কোনও ব্যতিক্রম নেই, আর পাঁচটা তরুণ কবির গল্পের মতো-ই। কিন্তু ১৯৬২ সালের 'হে প্রেম...' থেকে তিনবছরের মধ্যে ১৯৬৫তে 'ধর্মে আছি...' , একই বইয়ের ভিতর পরপর 'হৃদয়পুর' আর 'আমি স্বেচ্ছাচারী' , সচেতন গণনা কিছু তো চোখে পড়েই। দৈবী তাগিদ থেকে দীর্ঘদিন স্বতঃস্ফূর্ত 'নষ্ট' হয়ে গেছেন, 'চ্যালেঞ্জ'টির পরোয়া করেননি। কিন্তু যখন প্রতিষ্ঠান তাঁকে পোশাকি পরিচয় দিতে এল, তিনি প্রথম দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। ভিতরের 'কবি'টি পূর্ণ সক্রিয়, কিন্তু আলখাল্লার ভার বড়ো বালাই । বহির্জীবন আর অন্তর্জীবনে যতোদিন ফাঁক রাখতেন না, ততোদিন কিম্বদন্তীর গরিমা তাঁকে অনুসরন করতো ছায়ার মতো । একদিন যখন সেই 'রহস্যময়' রোদ মাথার পিছনে, নিজের ছায়া পূর্বগামিনী , তিনি নিজস্ব মুদ্রা ভাঙাতে শুরু করলেন। তখনও তাঁর রাজত্বে কোনও চ্যালেঞ্জ নেই, কিন্তু সৃষ্টির পথ ক্রমশঃ ছলনাময়ী। টের পেয়েছিলেন, যশের ভিতর ক্রমিক অবরোহণ । শব্দের মোচড়ে ভাষা, ভাষার মোচড়ে করতালির প্রত্যাশা বাড়তে লাগলো। না পেলে বিষণ্ণ হয়ে পড়তেন । জীবৎকালেই খ্যাতির সমুৎসার, প্রকৃত কবি'কে পিছনে টানে, গতিরহিত করে দিতে চায়। কিন্তু তাঁর যাবতীয় গণিত-বিপ্রতীপ যাপন, পাঠকের কাছে শেষ পর্যন্ত প্রশ্রয় পেয়ে গেছে । আপ্রাণ স্ফূর্তিতে গড়ে তোলা কিম্বদন্তীর অপ্রকৃতিস্থ ভাবমূর্তির ত্রাস থেকেও 'পার' পেয়ে গেছেন পাঠকের প্রেমে।

    দিনের শেষে তিনি ''শক্তি চট্টোপাধ্যায়'',

    ",.... বস্তুর গ্রন্থনা থেকে বস্তুকেই মুক্তি পেতে হবে
    -একদিন ।
    তা না হলে সব ব্যর্থ-উদ্যোগ, উদ্যম,অভ্যর্থনা
    জীবনধারণ ব্যর্থ, ব্যর্থ সব কৃত্রিম প্রকৃতি
    কায়ক্লেশ, দুঃখ-সুখ, মনে পড়া স্বপ্নে ঘুমঘোরে
    বালকের দোলমঞ্চ, ভাঁটফুল, মর্নিং-ইস্কুল
    ব্যর্থ ক্ষয়রোগ আর রক্তের ভিতর তার খেলা-
    অমরতা নাম্নী ঐ নারীটির ভ্রূমধ্যে আমার
    চুম্বন দেবার কথা-দেবো না, দেবো না কোনোদিনও
    -এইভাবে
    বস্তুর গ্রন্থনা থেকে বস্তুকেই মুক্তি পেতে হবে ।।"
    ------------------------------
    ২১.

    সূর্য এখানে এভাবেই অস্ত যায় । প্রথম শাদা, থেকে নীলাভ ছায়। তার পর হলুদ, সোনালি, কমলা । তারপর হঠাৎ আকাশের স্মেল্টার থেকে উপচে গলন্ত লোহার মতো আগুন ছড়িয়ে যায় এপার ওপার সাতশো পাহাড়ের নীলিম দিগন্তে। কিমাশ্চর্যম... আমি যদি যুধিষ্ঠির হতুম নহুষ যক্ষের প্রশ্নের উত্তর হতো অন্যরকম। রোজই সারা পৃথিবী জুড়ে সূর্য ওঠে আর অস্ত যায়,কিন্তু পুরোনো হয়না কেন ? বারান্দায় বসে দেখি ঝুঁঝকো আঁধার নেমে আসছে, ঘাসজমি, লালমোরম, ঘোরানো পথের নক-টার্ন মিলিয়ে যাচ্ছে নিশ্চুপ । সবুজ অরণ্যের আভা গাঢ় হয়ে মিশে যাচ্ছে আবহের অন্ধকারে।
    -শিবাজিদা, তোমার একট কবিতা ছিলোনা, মোরান সাহেবের বাংলো...
    -আরে সে তো কোন পুরাকালে, কোথায় যেন বেরিয়েছিলো...
    -কালিমাটিতে..
    -আরে, তোর মনে আছে তো.. গজব হ্যাঁয়..
    -আমার এই ডাকবাংলাটা দেখে সেই কবিতাটা মনে আসছে...
    -তা চলবে, মোরান সাহেবের বাংলো'তে রবীন্দ্রনাথ কিছুদিন থেকেছিলেন, আর এখানে থাকতেন তাঁর চ্যালা বাবু শক্তি চট্টোপাধ্যায়....
    -দিনটা খুব শিগগির শেষ হয়ে গেলো...
    -তোর কবিতা 'বোঝা' কেমন হলো, শক্তি'র কবিতা ?

    কিছুক্ষণ নৈঃশব্দ্য,
    -দেরি হয়ে গেলো, অনেক দেরি....

    নিরুত্তর অন্ধকারে দূরে জ্বলছে নিভছে সারে সারে সম্বর কিংবা চিতল হরিণের সবুজ চোখের ঝিকিমিকি...

    জঙ্গলে রাত নেমে এলো ...


    ----------------------------------------------------
    (শেষ)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৪ জুলাই ২০১৪ | ২৪২৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • শিবাংশু | 127.201.153.214 (*) | ২৪ জুলাই ২০১৪ ০৪:৪৩74662
  • আমার দুই প্রিয় কবির একজন'কে জড়িয়ে বেশ কিছুদিন আগে একটা লেখা এসেছিলো, 'হরীতকী ফলের মতন'। সেই সময় কিছু বন্ধু আদেশ করেছিলেন, অপরজন'কেও জড়িয়ে কিছু লেখার । এই কবিকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতুম, বেশ কিছু স্মৃতিও রয়েছে। সেগুলিকে ব্যবস্থিত করে, তাঁর লেখা বিপুল অক্ষরমালার প্রতি আমার ভালোবাসা ও মুগ্ধতার এলোমেলো উপাখ্যান নথি করে রাখার সাম্প্রতিক ইচ্ছে থেকেই এই লেখা। এই কবি ও তাঁর কবিতা, বাংলা কবিতার একটি জরুরি অধ্যায় । যাঁদের অগাধ আস্থা আছে আজো পদ্যের প্রতি অথবা যাঁদের কাছে অহেতুক বলে মনে হয় এই সব রীতি বা সাধনা, সবার জন্যই এই লেখাটি কয়েকদিন ধরে ধারাবাহিকভাবে পত্রস্থ করছি এই পাতায়।
  • Ishani | 24.99.154.71 (*) | ২৪ জুলাই ২০১৪ ০৪:৫৮74663
  • "একটি জীবন পোড়ে , শুধুই পোড়ে
    আকাশ মেঘ বৃষ্টি এবং ঝড়
    ফুলছে নদী শীতল সর্বনাশে --
    পেয়েছে , যাকে পায়নি কোনোদিনও
    একটি জীবন পোড়ে , শুধুই পোড়ে
    আর যেন তার কাজ ছিল না কোনো....."

    সেই জীবনের গল্প ? চলুক.....
  • kiki | 127.194.77.25 (*) | ২৪ জুলাই ২০১৪ ০৬:১৫74664
  • ঃ)
  • সায়ন | 59.249.32.155 (*) | ২৫ জুলাই ২০১৪ ০৪:১৫74668
  • এক প্রিয় মানুষ এই শক্তি পাঠিয়েছিল আমাকে। বলেছিল, যানজটময় সন্ধ্যেগুলোয় বাড়ি ফেরার সময় সে প্রতিদিন শোনে এই কাব্যগাথা...

    সেই মানুষ, এবং শিবাংশুদা'কে অনেক অনেক ভালোবাসা :)
  • সিকি | 135.19.34.86 (*) | ২৫ জুলাই ২০১৪ ০৪:২৩74666
  • বসে আছি।
  • সিকি | 135.19.34.86 (*) | ২৫ জুলাই ২০১৪ ০৬:৪৪74667
  • নতুন আঙ্গিকে আরণ্যক পড়ছি মনে হচ্ছে। তুমুল ভালো লাগছে।
  • nina | 78.37.233.36 (*) | ২৫ জুলাই ২০১৪ ১২:৩৩74665
  • বাহ!
  • | 24.96.185.21 (*) | ২৬ জুলাই ২০১৪ ০৩:২৭74669
  • পড়ছি ....

    'ক্যালকেশিয়ান উচ্চিংড়ে' বেশ পছন্দ হল, ক্যালকেশিয়ানের সাথে জায়গামত চামচিকে, ফড়িং কিম্বা তেলাপোকা জুড়ে ব্যবহার করা যাবেখন।
  • sosen | 111.63.136.228 (*) | ২৬ জুলাই ২০১৪ ০৫:১১74670
  • বড় ভালো লাগলো।
  • Ranjan Roy | 132.168.64.155 (*) | ২৬ জুলাই ২০১৪ ০৭:২০74671
  • ছত্তিশগড়ে প্রচন্ড বৃষ্টি, কিন্তু ছোটনাগপুর মালভূমির কিছু অংশ এখানেও। শিবাংশুর লেখায় শব্দচয়ন, বাক্যবন্ধ নিয়ে আমার মাথায় খালি একটিই শব্দ আসে--অমোঘ।
    ভিজে যাচ্ছি ভেতরে ভেতরে।
  • nina | 78.37.233.36 (*) | ২৬ জুলাই ২০১৪ ১১:৫২74672
  • পুরনো শব্দের ঝাঁক, পুরনো ঝোলায় পোরা ট্রাম
    পুরনো বিকেল আর তোমার পুরনো ডাকনাম
    মনে যত পড়ে তত মন থেকে পড়ে যেতে চায়
    আমার নতুন কবিতায়-------
  • কল্লোল | 111.63.91.201 (*) | ২৭ জুলাই ২০১৪ ০৪:৪৩74673
  • স্তব্ধবাক।
  • sosen | 125.241.2.236 (*) | ২৭ জুলাই ২০১৪ ০৪:৫৬74674
  • পড়ছি--
  • Rit | 213.110.246.22 (*) | ২৭ জুলাই ২০১৪ ০৫:১৩74675
  • পড়ছি। সব না বুঝলেও।
  • kumu | 132.161.173.157 (*) | ২৭ জুলাই ২০১৪ ০৫:১৬74676
  • বার বার পড়ি।
  • Rit | 213.110.243.21 (*) | ২৭ জুলাই ২০১৪ ০৫:৩৪74677
  • তারপর?
  • Ishani | 125.241.39.224 (*) | ২৮ জুলাই ২০১৪ ০২:০৬74678
  • শক্তি বলেছিলেন , "ঝোলা কাঁধে বউ ছেলে নিয়ে সুখে থেকে কবিতা লেখা যায় না |'' কবিতা লিখতে হয় এক অবোধ্য তাগিদ থেকে, এক অন্ধকার সুড়ঙ্গে আলোর জন্য ওলটপালট খেতে খেতে | কবিতা "মায়াবী এই আলোয় ওড়ায় মায়া ভাঙার ফানুস |"

    " শুদ্ধসীমা থেকে যাত্রা কবিতার সর্বাঙ্গে , যেমন
    মধুর বিহ্বল পায়ে পিঁপড়ে পড়ে ছড়িয়ে সুধায় --
    বিষে ও নির্বিষে , আমি যাই , যেতে যেতে বাধা পাই
    আনন্দে পশ্চিমে চলি , টানে পূর্ব উৎকৃষ্ট ক্ষুধায় |"
  • Ranjan Roy | 24.97.75.209 (*) | ২৮ জুলাই ২০১৪ ১০:০৩74679
  • "কবিতা লিখতে হয় এক অবোধ্য তাগিদ থেকে, এক অন্ধকার সুড়ঙ্গে আলোর জন্য ওলটপালট খেতে খেতে" ।
    --- ঈশানী একটি বাক্যে ধরেছেন!
  • শিবাংশু | 127.197.235.169 (*) | ০৩ আগস্ট ২০১৪ ০৮:৩৩74680
  • একটা কৃত্য বাকি থেকে গিয়েছিলো,

    ঈশানী, কিকি, নিনা, সিকি, সায়ন, দ,সোনালি, কুমু, কল্লোল'দা, ঋত্বিক, রঞ্জন,

    সব্বাইকে লেখাটি পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ ।
    :-)
  • Ashraful Islam | 113.230.106.18 (*) | ০৫ আগস্ট ২০১৪ ১২:৫৭74681
  • বড্ড ভালো। পোস্ট টা নিজের কাছাকাছি রাখতে চাই বলে এখানে নিবন্ধন নিলাম। কিন্তু পোস্ট প্রিয়তে নেবার উপায় পাচ্ছিনা, কি মুশকিল।
  • কুশান | 561212.187.1256.138 (*) | ১৮ জানুয়ারি ২০১৯ ০৯:৩৯74682
  • দারুণ, দারুণ, দারুণ বললে কম বলা হয়। অসামান্য লেখা। এ লেখা লিখতে শ্রম ও মেধা দুইই প্রয়োজন।

    শক্তি আমার প্রিয় কবিদের অন্যতম। অনেক চেনা কবিতা পেলাম। কিছু নতুন।
  • Eman Bhasha | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৬:৪০523676
  • অপূর্ব।
    এক নিঃশ্বাসে শেষ করলাম।
    ভালো থাকবেন।
    জঙ্গলে রাত নেমে আসুক মধুজোছনায়
  • Samaresh Mukherjee | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৭:৩৮523679
  • শিবাংশুবাবু 
     
    আপনার এই লেখাটির মাধ্যমে‌ই জুন ২০১৯এ আমার গু৯র সাথে আলাপ। তখন আপনাকে কিছু জানা‌তে পারি নি। সেই আক্ষেপ গতকাল মিটিয়ে নিলাম, নীচের নিবেদনে। ভালো থাকবেন।
    সমরেশ
     
    https://www.guruchandali.com/comment.php?topic=28202
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন