এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • কমলাদি

    Salil Biswas লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৪ জুলাই ২০১৪ | ১৩৪৩ বার পঠিত
  • এটি একটি পূর্ব-প্রকাশিত গল্প। ‘নবান্ন’ পত্রিকায়। সনতারিখ মনে নেই। এই মুহূর্তে দরকারও নেই। অবশ্য এটাকে শুধু ‘গল্প’ বললে ভুল হবে হয়ত। যা ঘটেছিল (বা বলা ভালো, যা ঘটেছিল ত্তার যতটা আমার মনে আছে) তাই লিখেছিলাম। মাঝে মাঝে ফাঁকফোকর ভরে দিয়েছিলাম কল্পনা থেকে। নামগুলো পাল্টে নিয়েছিলাম। তাছাড়া, ঘটনা যেমন ঘটে তেমন লিখে ফেললে কেমন যেন ম্যাড়মেড়ে লাগে। ঘটনা তো শিল্প মেনে ঘটে না। তাই রংগুলোকে একটু চড়িয়ে নিতে হয়, একটু সীবনশিল্পের আশ্রয় নিতে হয়। এখানেও তাই করা হয়েছে। তবে তেমন বেশি নয় সেই মিশ্রণের পরিমাণ। আর একটা কথা। আমি কিন্তু এই গল্পের মধ্যমণি নই। আসলে সব লিপিকারেরই অবচেতন প্রচেষ্টা থাকে নিজেকে ‘হিরো’ বানাবার। যদি তেমন হয়ে থাকে, বুঝে নেবেন।

    ‘স্যার, স্যার, আপনাকে ওরা কেটে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেবে বলেছে।’ ছেলেটা বেশ উত্তেজিত। সঙ্গে যে বাচ্চাটা দাঁড়িয়ে আছে তারও মুখেচোখে একটা কী হবে কী হবে ভাব।
    আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখান থেকে কেটে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেওয়া খুব সহজ। জলের উপরে ঝুলে থাকা পরিত্যক্ত এই কাঠের তক্তার সমাহারকে জেটি বললে অনেক বাড়িয়ে বলা হবে। রাস্তার দিকে মুখ করে জলের ধারে দাঁড়িয়ে আছি। পায়ের কাছে ফাঁক দিয়ে জল দেখা যাচ্ছে। বাঁদিকে অস্ত্র কারখানার চলটা-ওঠা দেওয়াল। তার সামনে ভাঙাচোরা ঘাটের পিছল সিঁড়ির নিচে এই পড়ে আসা বেলায় স্নান করছে এক বৃদ্ধ। আসে পাশে আর কেউ নেই। সামনের রাস্তায় এমনিতেই এই সময়ে লোক চলাচল থাকে না। আজ মেঘলা দিনে সকাল থেকে ঝিরঝিরে বৃষ্টির উপদ্রবে কেউ কোত্থাও নেই। রাস্তার ওপারে ডানদিকে একটু দূরে ঝুপড়িগুলোর ছেঁড়া-ফাটা পলিথিন আর তেরপলের আচ্ছাদন ভেতরকার সবসময়ের ক্লিষ্ট দৈন্য আর অপরিসর বেঁচে থাকাকে আরও স্যাঁতসেঁতে নোংরা করে তুলেছে। আর একটু ডানহাতে গুঁড়ি মেরে বসে থাকা গুদামটা থেকে কাঠ চেরাইয়ের তীক্ষ্ণ ধাতব শব্দ গঙ্গার ধূসর জলের ভাঁজে ভাঁজে কদাকার আঙুল বোলাচ্ছে।
    আমার পিঠ বেয়ে একটা শিরশিরে স্রোত নেমে গেল। যারা কথাটা বলেছে, তাদের আমি পরিচয়ে চিনি। গলা কেটে ফেলা তাদের কাছে খুব সহজ এবং নিশ্চিন্ত কাজ। তক্ষুনি ওখান থেকে পালানো বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কিন্তু পালানো যাচ্ছে না। দাঁড়িয়ে রইলাম আমি, সাহস থেকে, নাকি, নিজের কাছে, বন্ধুদের কাছে ভীতু প্রমাণিত হওয়ার ভয়ে, সেটা বলতে পারব না ঠিক। হয়ত, আমার সামাজিক পরিচিতির ঢাল আমাকে খানিকটা অভয় দিল। যদিও আমার ওই পরিচিতির এখানে খুব একটা ওজন নেই। এখানে, যেখানে মাত্র কয়েক বছর আগে নর্দমা দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হয়েছে অবলীলায়। তবুও।
    আধঘণ্টা আগে যখন এখানে এসে দাঁড়িয়েছি, তখন থেকেই গুদামের সামনে দাঁড়ানো লোকদু’টিকে দেখেছি। আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে কিছু বলাবলি করছিল ওরা, তাও দেখেছি। ওদেরই কথা বলছে বাচ্চা-দুটো, তা বুঝতে আমার একটুও অসুবিধা হল না।
    হাতের সিগারেটটা শেষ হয়ে এসেছে। সেটা জলে ফেলে মুখ তুলতেই দেখলাম, ছেলে-দুটোকে মাথায় মৃদু চড় মেরে চলে যেতে বলছেন দু’জন মহিলা। ওরা চলে যেতেই মহিলা দু’জন উঠে এলেন জেটির উপরে। রাস্তার ধার ঘেঁসে বসে পড়লেন আমার দিকে পিছন ফিরে। দু’এক মিনিটের মধ্যেই এলেন আরও দু’জন। তারপর আরও দু’জন। ওখানে কাছাকাছি বসে নিচু স্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগলেন তাঁরা। আর, সব শেষে আসা সপ্তমজন জেটিতে না উঠে রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে রইলেন, পথের দিকে তাকিয়ে। কমলাদি।
    এই সময়টা ঝুপড়ি-পট্টিতে কোনও পুরুষ থাকে না। মেয়েরাও থাকেন না অনেকে। কাগজ আর ন্যাকড়া কুড়োতে বেরোন অনেকেই ছেলে বা স্বামী বা বাবার মতই। থাকেন কেবল তাঁরা, যাঁরা পাইকপাড়া বা চিড়িয়া মোড় বা বরানগরে বাবুদের বাড়ি বাড়ি কাজে যান। এই মহিলারা তাঁদেরই কেউ কেউ।
    কোথাও কেউ নেই। দাঁড়িয়ে আছি আমি। ওঁরা বসে আছেন। কমলাদি বাইরে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে। স্থির নিস্পন্দ মিনিটগুলো তখন সময়ের সব হিসেবের অতীতে নিয়ে গেছে আমাদের ক’’জনের অস্তিত্বকে। যাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম আমি, তারা আসতে আরও কত দেরি করবে কে জানে।
    কতক্ষণ পরে জানি না, দেখলাম ওই দু’টি লোক ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে রাস্তাটা ধরে। সাধারণ চেহারা। সাধারণ পোশাক। জেটির সামনে এসে আমাদের দিকে তাকিয়ে দু’জনে যুগপৎ হাতের বিড়ি নেভাল পায়ে পিষে। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল আমার দিকে, মহিলাদের দিকে। তারপরে, একজন একটা কুৎসিত গালি দিল, আর হা হা করে হাসল অন্যজন। বসে থাকা মহিলারা এক বারও না তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা চালিয়ে গেলেন। কমলাদি একমনে নখ কেটে গেলেন দাঁত দিয়ে, অন্যদিকে তাকিয়ে। সশব্দে থুতু ফেলে উত্তরমুখে হাঁটা দিল লোকদু’টো। এত জন সাক্ষীর সামনে গলা কাটা বা নিদেনপক্ষে হাতপা ভেঙে দেওয়াও মুশকিল।
    আরও মিনিট পাঁচেক পরে কমলাদির ইশারায়, মহিলারা উঠে আবার মিলিয়ে গেলেন তাঁদের ওই খাপরা আর পলিথিন আর চটে ঘেরা বিশ্রী জগতে। কমলাদি উঠে এলেন আমার সামনে। ‘দাদারা এখনও এলেন না? দিদি আসবে তো?’
    আসারই তো কথা। কোনও কারণে দেরি হচ্ছে। হয়ত জল জমেছে পথে। হয়ত ট্রাফিক জ্যামে বাস চলছে না। কথা আছে, কমলাদির সঙ্গে বসে ঠিক করা হবে, কী করে এখানে মহিলাদের নিয়ে একটা হাতের কাজ শেখানোর উদ্যম শুরু করা যায়। স্কুলটা তো আছেই, সেখানে এই দুপুরে কাজের ফাঁকে যদি কিছু অর্থকরী কাজ শিখতে পারেন মহিলারা, স্কুল ঘরে বসে।

    মাঝখান থেকে গল্পটা বলতে শুরু করেছি। আগের কথা এবারে বলব। আসলে, বলার খুব একটা কিছু নেই। কমলাদির কাহিনীর মধ্যে তো তেমন কোনও নতুনত্ব নেই। নেহাতই একজন ঠিকে ঝি। কালো, দীর্ঘকায়, হাড় বার করা চেহারা। মুখে বয়সের নয়, অভাবের আর দুর্দশার অজস্র বলিরেখা। অন্য সবগুলোর মত যে ঝুপড়িটাতে কমলাদি থাকেন, তার, জানলার তো প্রশ্নই ওঠে না, কোনও দুয়ারও নেই। চটের একটা আড়াল সরিয়ে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হয় সেখানে। দিনের মধ্যে পাঁচ ছ’বার মাথা নিচু করতে করতে এখানকার হতশ্রী মানুষেরা যে হীনতায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন তার নির্মম ভার তাঁদের একটুও সোজা হতে দেয় না। যেদিন আমরা প্রথম আসি, ‘প্রগতি’র হাত ধরে, সেদিন থেকে আরম্ভ করে শেষদিন পর্যন্ত এখানকার কাউকে আমরা ‘বাবু’ বলা থেকে বিরত করতে পারিনি, দেখলেই নত হয়ে হাতজোড় করা বন্ধ করাতে পারিনি। সব সময়ে শুনে এসেছি, আমরা মহদাশয় মানুষ, শিক্ষাবিস্তারের মহৎ কাজ নিয়ে এসেছি দয়া করে। আমাদের কাছে ঋণের কি শেষ আছে!
    ‘প্রগতি’ একটি সমাজসেবী সংস্থা। কলকাতার বহু প্রান্তিক অঞ্চলে তাঁরা মানুষের উপকারে বিদেশী দয়াবানদের দানের টাকা কষ্ট করে ব্যয় করেন। এই ব্যয় বাবদ যা খরচ হয় তা তাঁরা ওই অর্থ থেকে নিয়ে নেন। এই সংস্থায় চাকরি করেন আদিত্য বাবু -- দিত্যদা। তাঁর উৎসাহে এখানে আমরা কয়েকজন এসেছিলাম স্কুল করতে। ‘প্রগতি’ চেয়েছিল একটা স্কুলঘর বানিয়ে দিতে এবং আমাদের মধ্যে যে দু’একজন কলেজের ছাত্র আছে, তাদের কিছু একটা মাসোয়ারা দিতে। আমরা রাজি হইনি। কলকাতায় আমাদের অন্য স্কুলগুলোর মত এখানেও চেয়েছিলাম, বসতির মানুষের নিজেদের চেষ্টাতেই গড়ে উঠুক কিছু একটা পড়াশোনার প্রাঙ্গণ। দাক্ষিণ্য প্রাপ্তিতে স্বীকৃত এখানকার পুরুষদের অত খাটার ইচ্ছে ছিল না। ‘প্রগতি’ যদি কাজটা করে দেয়, তাহলেই তো ভাল, মনে হয়েছিল তাঁদের। অনেক বুঝিয়েও কাজ হচ্ছিল না। একসময় যখন ক্লান্ত হয়ে আমরা হাল ছেড়ে দিচ্ছিলাম, তখনই দেখা মিলেছিল কমলাদির।
    সে সময়ে দিন দশেক প্রচণ্ড ম্যালেরিয়ায় শয্যাশায়ী ছিলেন কমলাদি। তাই প্রতিদিনের সন্ধ্যাবেলার আলোচনাচক্রে তাঁকে দেখা যায়নি। জর থেকে উঠে পাইকপাড়ায় বিকেলের ঠিকে কাজ সেরে ফেরার সময়ে আমাদের মিটিঙে প্রথম আসেন কমলাদি। প্রথম দিন কিচ্ছু বলেননি। কিন্তু, পরের দিন, আমরা যখন পুরুষদের এক বাক্যে রাজি হতে দেখে আনন্দ পাচ্ছি নিজেদের অন্যকে ‘কনভিন্‌স’ করার ক্ষমতায়, তখন জানলাম সারাটা দিন কমলাদি কেমন করে বুঝিয়ে আমাদের কথা শুনতে সকলকে রাজি করিয়েছেন। অবশ্য, কেবল বুঝিয়েছেন বললে সবটা বলা হবে না, কমলাদির কাংস্য-বিনিন্দিত কণ্ঠ এবং বাছাই করা শব্দের প্রবল ব্যবহারও সকলকে রাজি হতে সাহায্য করেছে।
    তার পরে খুব দ্রুত, স্কুল তৈরির কাজ এগিয়েছে। বসতির মেয়েপুরুষ একযোগে ক’দিনের মধ্যেই ঝুপড়িপট্টির একধারে একটা বাড়ির পাঁচিল ঘেঁষে বানিয়ে ফেলেছে একটা ছোট্ট স্কুলঘর, যে ঘর এই বসতির যে কোনও বাসিন্দার ঘরের তুলনায় রাজপ্রাসাদের সামিল। সেই প্রথম জেনেছিলাম, কলকাতায় পোড়া ফাটা বাঁশ আর ফেলে দেওয়া ছেঁড়া ত্রিপলের একটা রমরমা কারবার আছে। এক সন্ধ্যাবেলা ছোট্ট অনুষ্ঠান করে স্কুল চালুও হয়ে গেছে।
    একথা বলতেই হবে, এই স্কুল তৈরির কাজে ‘প্রগতি’ সাহায্য করেছে -- দিত্যদার ব্যক্তিগত উৎসাহে। এই স্কুলটাও অবশ্যই ‘প্রগতি’র কাজের খতিয়ানে ঢুকে গিয়ে বিদেশে তার শক্তির উৎসকে আরও উদার করবে, কিন্তু সে নিয়ে বেশি ছুৎমার্গ আমরা আর করলাম না। স্কুল চালু হয়ে গেল।
    এখান থেকেই গোলমাল শুরু হল। স্কুল চালু হওয়ার সন্ধ্যেতেই দু’একজন লোক আমাদের প্রচেষ্টার ভূয়সী প্রশংসার সঙ্গে সঙ্গে জমির মালিকের হয়ে যেচে-পড়ে ওকালতি শুরু করেছিল। তখনই জেনেছিলাম, কাঠের গুদামের মালিকের নজর রয়েছে গঙ্গার ধারের এই মূল্যবান ভূখণ্ডটির উপরে। ঝুপড়ি উৎখাত করার চেষ্টা সে করছে অনেকদিন থেকে। স্কুল তৈরি হলে জমির উপরে কার কীভাবে অধিকার জন্মাবে তা নিয়ে এবারে শুরু হয়েছে রেষারেষি। অবশ্য ওই জমির প্রকৃত মালিক কে, তা আমরা জানতামও না, খোঁজও করিনি সে বিষয়ে। আমরা সব সময়েই চেষ্টা করতাম, এই ধরনের বিবাদে না জড়াতে, কেননা এসবের নিষ্পত্তি করার ক্ষমতা আমাদের ছিল না। ইচ্ছে না থাকলেও অবশ্য অনেক সময় আমাদের জড়িয়ে পড়তে হতই।
    যাই হোক, এসব আমাদের গল্পের বিষয় নয়। অবশ্য, বিষয় নয় এই অজুহাতে হয়ত সমস্যা একটু পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি। এরকম তো আমরা করেই থাকি।

    ‘দাদারা এখনও এলেন না? দিদি আসবে তো?’
    কমলাদির প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আবার একটা সিগারেট ধরালাম। আমার হাত পা তখনও কাঁপছে। এই কয়েকজন মহিলার সাহস এবং একজনের প্রত্যুৎপন্নমতিতে আমি বড় একটা বিপদের হাত থেকে বাঁচলাম, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
    কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে কমলাদি কোনও মন্তব্য করলেন না। আমিও চুপ করেই রইলাম। বৃষ্টি সমানে পড়েই যাচ্ছিল। আরও অনেকক্ষণ ওখানে বসে থাকলাম বন্ধুদের অপেক্ষায়। যখন প্রায় সাড়ে চারটে বাজে, কমলাদির কাজে যাবার সময় হয়ে গেছে, রাস্তায় দুটো একটা করে লোক জন দেখা দিচ্ছে, বৃষ্টিটা থামতে চলেছে, আমি চলে এলাম ওখান থেকে। যে পথ ধরে হেঁটে এসে বিটি রোডে উঠতে হবে, সেখানে অনায়াসেই ওই লোক-দুটো ওত পেতে থাকতে পারে। কিন্তু কিছু তো করার নেই। নিরুপায় লোককে সাহসী হতেই হয়। চিড়িয়ার মোড়ে পৌঁছে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

    স্কুল চলতে শুরু করার কয়েকদিনের মধ্যেই ‘প্রগতি’র সঙ্গে আমাদের দ্বিমত শুরু হয়ে গেল। ওরা একজন দিদিমণিকে আমাদের ‘সাহায্য’ করতে পাঠিয়ে দিল। নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে আসা সেই মেয়েটি অত্যন্ত ভাল, কিন্তু পড়ানোর ধ্যানধারণা তার একেবারেই স্বতন্ত্র। আমরা তথাকথিত স্কুলের পড়া পড়াবো না, সে ক্লাস ওয়ান ক্লাস টু ভাগ করে ফেলল এসেই। যে বাচ্চারা স্কুলে আদৌ যায় না, তাদের মধ্যে এই বিভেদ আনার প্রয়োজন নেই, আমাদের একথাকে সে বুঝলই না, অথবা, আমলই দিল না। এই ব্যাপারে কমলাদি মেয়েটির পক্ষ নিলেন। তাঁর বক্তব্য, ক্লাস না থাকলে আবার স্কুল কী? আমরা আমাদের কথা সাধ্যমত বোঝালাম, কিন্তু কোনও লাভ হল না। স্কুল শুরু হল সাবেকী নিয়ম মেনেই। আর এক বার দেখলাম আমরা, এই বসতিতে কমলাদির কথাই শেষ অবধি থাকবে। পুরুষরা এবিষয়ে যথেষ্ট উদাসীন। তাঁদের কাউকেই স্কুলের ব্যাপারে খুব বেশি মাথা ঘামাতে দেখিনি। অবশ্য এও হতে পারে যে কমলাদির কথার উপরে তাঁদের যথেষ্ট আস্থা ছিল।
    মেয়েটি পড়াতে আসত সকালে দু’ঘণ্টার জন্য। আমরা যেতাম বিকেলে। পড়াতাম আমাদের মত করে, নিজস্ব কিছু চিন্তাভাবনা আর পদ্ধতি অনুযায়ী। পদ্ধতিগুলো তখন তখন বেশ উপযোগী মনে হত। সত্যি সেগুলো কতটা সফল হতে পারত সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার মত যথেষ্ট সময় ধরে আমরা পদ্ধতিগুলো প্রয়োগ করতে পারিনি।
    এভাবে চলল কিছুদিন। মাঝে মাঝে কাঠের গুদামের মালিক টুকটাক হামলা করেছে। দু’একটা বাচ্চাকে কেউ অহেতুক চড়চাপড় দিয়েছে। কে যেন এসে স্কুলের একটা দেওয়াল ফুটো করে দিয়ে গেছে। এরকম হওয়াই স্বাভাবিক, একথা ধরে নিয়েই স্কুল চলছে।
    কয়েক দিন পরে অন্য একটা সমস্যা একটু ঘোরালো হয়ে পড়ল। আমার বাড়ি কাছে বলে, এই স্কুলটাতে আমিই বেশি যেতাম। সেই সূত্রে সমস্যা হলে সেটা আমারই নজরে আসত আগে।
    গুদামের মালিক স্কুল চলার সময়ে একদিন এসে আমাকে সোজা বলল স্কুল বন্ধ করতে হবে, আপনারা এখানে এসে আমাদের জায়গা দখল করছেন, এসব চলবে না। আমি সবিনয়ে তাকে জানালাম, স্কুল এখানে চলবে, তার আপত্তি আমরা শুনব না। স্কুল বন্ধ করতে বলার সে কেউ নয়। জমি তো তার নয়। বেশ খানিকটা শাসিয়ে লোকটা সেদিন চলে গেল। স্কুল, বলা বাহুল্য, বন্ধ হল না। বসতির লোকেরা গুদামের মালিককে যথেষ্ট ভয় পায়, কিন্তু এই ব্যাপারে, যে কোনও কারণেই হোক, তারা ওর ভয় দেখানোকে পাত্তা দিচ্ছিল না। সম্ভবত, ‘প্রগতি’র বিভিন্ন যোগাযোগের শক্তিতে তাদের আস্থা ছিল।
    একদিন স্কুলে যেতেই রাধা, বসুমতী, ছোটন, শিখা, নারাণেরা সমস্বরে বলে উঠল, তারা প্রত্যেকে একটা করে বই পেয়েছে। সকলে খুব উত্তেজিত। বইটা দেখলাম। একটা বাংলা বর্ণপরিচয়ের বই। বেশ অনেক রঙিন ছবিতে ভর্তি। আমার বেশ ভালই লাগল। কে দিয়েছে? দিত্য কাকু। অর্থাৎ, ‘প্রগতি’। ঠিকই আছে।
    পড়াতে শুরু করেছি। আমি ওদের ইংরেজি বর্ণপরিচয় শেখাই, মুখস্থ করিয়ে নয়, আমার মত করে। একটি মেয়ে, নাম জানি না, এসে আমাকে বলল, কমলাদি ডাকছেন। তখনও কমলাদিকে আমি বিশেষ চিনি না। লোক জনের মাঝখানে সামান্য কথা হয়েছে। জোরালো ব্যক্তিত্ব, এর চাইতে বেশি কিছু জানি না।
    উঠে গেলাম। কয়েকটা ঝুপড়ি পেরিয়ে কমলাদির ঘর। বসতির মাঝামাঝি জায়গায়। অনেকটা নিচু হয়ে ভেতরে ঢুকলাম। ফুট কুড়ি বর্গ একটা আস্তানা। এক কোনায় কয়েকটা বাসন, কিসের তৈরি বলা মুশকিল, একটা তোবড়ানো অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি। দেওয়ালে ছেঁড়া পুরনো ক্যালেন্ডার টাঙিয়ে তারই মধ্যে ঘর সাজানোর চেষ্টা আছে। লক্ষ্য করার বিষয়, কোনও ঠাকুরদেবতার ছবি নেই, একটা সমুদ্রের ছবি, একটা সূর্যাস্তের। মাটিতে একটা চট পাতা, তারই এক পাশে কমলাদি একটা ছেঁড়া কাপড়ে নিজেকে মুড়ি দিয়ে বসে আছেন। অন্য পাশে, আমার জন্যেই বোধহয়, এক টুকরো খবরের কাগজ বিছনো। সেখানে বসলাম আমি।
    খুব স্বচ্ছন্দ বোধ করছিলাম, এমন কথা বললে ভুল হবে। এমন বসতিতে আসা আমার প্রথম নয়, তবু গা শিরশির করছিল একটু, মনে পড়ছিল রুমালে মুখ ঢেকে নির্বাচনী প্রচারে আসা এক পার্টি নেতার কথা। চা খেতে বলেছিল তাঁকে স্থানীয় কর্মীরা। তিনি বলেছিলেন, চা খাওয়া ঠিক হবে না, এখানে ঘরে ঘরে টিবি।
    ‘জ্বরটা আবার আসছে, দাদা। তাই আপনাকে আসতে বললাম।’ একটা ওই বর্ণপরিচয়ের বই এগিয়ে ধরলেন আমার দিকে কমলাদি। ‘দেখুন তো, এই পাতায় কিসের ছাপ এটা। পড়তে পারি না তো।’
    স্কুলঘরে বসে খেয়ালই করিনি, এখানে কুপির আলোয় স্পষ্ট দেখলাম, একটা রাবার স্ট্যাম্প মারা রয়েছে বইয়ের নামের পাতাতেই। ইংরেজিতে লেখা, ‘এই বইগুলো চার্চের প্রদেয় অর্থে পথ-শিশুদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণের জন্যে দেওয়া হল।’
    জিজ্ঞাসু চোখে তাকালাম কমলাদির দিকে। কী হয়েছে? ঠিকই তো আছে।
    ‘ওখানে কি বইটার দাম লেখা আছে?’
    ‘না, এখানে লেখা আছে, এগুলো ফ্রি বিলি হবে।’
    ‘তাই? ঠিকই ধরেছিলাম তাহলে।’
    ‘কী ঠিক ধরেছিলেন?’
    ‘ওরা তো প্রত্যেকটা বই আমাদের কাছে এক টাকা করে বিক্রি করেছে। বলেছে স্কুলে পড়তে হলে সবাইকে নিতেই হবে। নইলে স্কুলে যেতে দেওয়া হবে না। আপনারাও নাকি আর পড়াবেন না।’
    ‘কে বলেছে একথা?’
    ‘দিদিমণি।’
    আমি হতবাক হয়ে গেলাম। এখানে যাঁরা বাস করেন, তাঁদের কাছে একটা টাকার মূল্য কতটা তা আমরা অনুমানই করতে পারব না। তাঁদের বাধ্য করা হয়েছে, মিথ্যে কথা বলে, একটা জিনিষ কিনতে, যেটা নাকি তাদের বিনা পয়সায় পাবার কথা।
    ‘আমি তখনই বুঝেছিলাম। দিদিমণির দোষ নেই, উনি তো চাকরি করেন। দিত্যদাও কী করবেন। ওঁকেও তো চাকরিই করতে হয়। ওরা এরকমই করে।’
    আগে যে জানতাম না এমন নয়, কিন্তু এখন চোখে খোঁচা খেয়ে জানলাম, কী ধরনের তঞ্চকতা চলে এই মানুষদের সঙ্গে। ওই ‘‘ওরা’’ অর্থাৎ, এই ধরনের দলেরা, কী করে না করে। ‘প্রগতি’র কাজের প্রমাণ দিতে কেমন করে এখান থেকে মাঝে মাঝেই এই বসতির মানুষদের যেতে হয় কলকাতার এখানে ওখানে, কাজ ফেলে, হেঁটে, দূরে দূরে। যেতেই হয়, নইলে, ঠারেঠোরে ভয় দেখানো থাকে, সাহায্য বন্ধ হয়ে যাবে।
    ‘আপনি বলবেন না, আমি বলেছি। ওরা ক্ষেপে যাবে আমার উপরে, আর কিছু দেবে না।’
    বলব না, আশ্বাস দিই।
    ‘তবে ওরা ঠিক জানতে পারবে। আমাকে ওরা দু'চক্ষে দেখতে পারে না। খালি ঝগড়া করি তো।’
    কমলাদির কথার মধ্যে, কণ্ঠস্বরে একই সঙ্গে দৃঢ়তা এবং সহায় হারানোর ভীতি মিশে ছিল। থাকারই কথা। বৃদ্ধ অশক্ত স্বামী, তিনটি বিভিন্ন বয়সের সন্তান নিয়ে দু’তিনটি ঠিকে কাজের মাইনে সম্বল করে দিনগুজরান কতটা কঠিন, তা বুঝতে একটুও অসুবিধা ছিল না। অথচ, শোষণের এই নতুন, গোপন আর চূড়ান্ত অন্যায় চেহারা মেনে নিতেও পারছিলেন না তিনি। গোটা বসতির অন্য সমস্ত মানুষ ধরেই নিয়েছে, কিছু পেতে হলে কিছু তো দিতেই হবে, আর যার কিছু নেই, তার অত গুমোর দেখালে চলে না, আমাদের কপালে যা লেখা আছে তা তো বদলাবে না। কমলাদি অন্য রকম ভেবে এসেছেন বরাবর। এই সাহসের চিহ্ন কমলাদির চোখের ভাষায় শরীরের ভাষায় স্পষ্ট হত। তাই বোধহয় গোটা বসতির উপরে তাঁর একটা কর্তৃত্বের জায়গা তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

    তার পর দিনই চেপে ধরেছিলাম দিদিমণিকে। কিন্তু বইগুলোর ব্যাপারে মেয়েটি প্রায় কিছুই জানে না। বস্তুত, ও আমারই মত খেয়াল করে দেখেইনি, কী লেখা আছে প্রথম পাতায়। ব্যাপারটা বুঝে ও চুপ করে গেল। কিন্তু ওর তো কিছু করার নেই। সেদিনই দেখা করলাম দিত্যদার সঙ্গে। দিত্যদা অবশ্য ব্যাপারটা জানেন ভাল করেই। নানা ভাবে কাজটাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছিলেন উনি। অনেক দেওয়া হয় ওখানকার মানুষদের, নানা রকম সাহায্য করা হয়, বিপদেআপদে ওদের পাশে তো ‘প্রগতি’ই দাঁড়ায়, সুতরাং ওই একটা টাকা কি আর এমন বড় কথা। কথাটা যে কী, তা দিত্যদা বুঝতে পারছিলেন ঠিকই। কথা বলতে বলতে আমার চোখের দিকে তাকাতে পারছিলেন না উনি। ওঁরও একই অবস্থা, কী করবেন। হাত পা বাঁধা।
    কথা বলতে হবে ‘প্রগতি’র মাথাদের সঙ্গে। যে বন্ধুর মাধ্যমে ওদের সঙ্গে আমাদের প্রাথমিক যোগাযোগ, তাকে বললাম। কিন্তু তিন চারদিন চেষ্টা করেও সে আলোচনা করা গেল না। মাথারা দিল্লী গেছেন কোনও বিরাট কাজে। প্রায়ই যান ওরা।
    আপনারা এত ভাবছেন কেন এ নিয়ে? দিত্যদা জানতে চান। সব মিলিয়ে ক’টাই বা টাকা নিয়েছে ‘প্রগতি’? ঠিকই। ক’টাই বা টাকা! কিন্তু সেটা বড় কথা নয়, একটা হলেই বা নেবে কেন? প্রশ্নটা নীতির নয় কি? আসলে কী জানেন, টাকা দিয়ে কিছু কিনলে, সে বস্তুটির প্রতি মমত্ব জন্মায়। এটা আরেকটা বাজে কথা। দেখিনি কি আমরা অন্যত্র, ছেলেমেয়েরা কি গভীর মমতায় বই আর খাতা নিয়ে পড়ার চেষ্টা করে? তারা, ওই ছোট ছোট বাচ্চাগুলো, দামের কথা মনেই রাখে না, অন্তত এই ব্যাপারে। আপনারা বড্ড বেশি আদর্শ পরিস্থিতির কথা ভাবেন, মানুষের উপকার করতে হলে বাস্তবকে উপেক্ষা করলে চলে না। কোনটা বাস্তব দিত্যদা? লক্ষ লক্ষ টাকা অন্যের কাছ থেকে আদায় করে তার ছিটেফোঁটা বিতরণ করে এই গরিব মানুষগুলোকে ব্যবহার করাটার বাস্তবতাটাকে যে আপনারা সযত্নে ভুলে থাকছেন, তার কী হবে?
    রেগে ওঠেন দিত্যদা। আপনারা কি আমাকে দায়ী করছেন? না, কিন্তু আপনি তো প্রতিবাদ করতে পারেন। এই ব্যবস্থা মানেন আপনি? চুপ করে থাকেন মানুষটি। কথাটা বলেই বুঝি, অন্যায় হল। আমাদের তো বোঝা উচিত ওঁর অবস্থা। চুপ করে থাকতেই হবে ওঁকে।
    আর আমরা? আমরাই বা কী করতে পারি? থামাতে পারি কি গরিব মানুষগুলোর এই লাগাতার অপমান? পারি না। বড় জোর এই বসতি ছেড়ে চলে যেতে পারি, বন্ধ করে দিতে পারি স্কুলটা।
    শেষ অবধি ঠিক হয়, তাই করব আমরা। এই ধরনের কাজের সঙ্গে প্রকারান্তরে আমরাও তো জড়িয়ে পড়ছি। সেই জড়িয়ে পড়ার সমস্যা আবার।

    সেটাও একটা ঝিরঝিরে বর্ষার বিকেল। এবারেও দায়িত্ব পড়েছে আমার উপরেই। কাছে থাকি তো। এবারেও কমলাদির ঘরে। এবারে আর গা শিরশির করছে না।
    ‘আমরা চলে যাচ্ছি, কমলাদি।’
    ‘চলে যাচ্ছেন? কোথায়?’
    ‘আমরা আর এই স্কুলে পড়াবো না। এদের সঙ্গে থাকলে এদের এই সমস্ত অন্যায়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে হবে। নীতিগতভাবে সেটা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।’
    চুপ করে তাকিয়ে থাকেন কমলাদি। অনেকক্ষণ পরে বলেন, ‘চলে যাবেন আপনারা? আমাদের ছেড়ে? এইটুকু সইতে পারবেন না?’
    চুপ করে থাকি।
    ‘অবশ্য আপনারা আপনাদের নীতি তো ধরে রাখবেনই। আমাদের কথা আমাদের, আপনাদের কথা আপনাদের।’
    তারপরে শক্ত হয়ে ওঠে মুখ। ‘না, আপনারা যাবেন না। আমি দেখছি। ফেরত দিয়ে দেব বই, টাকা ফেরত দিতে বলব ওদের।’
    চুপ করেই থাকি। বাইরে বৃষ্টি পড়েই যায়। ঘরের ভিতরে অন্ধকার ক্রমশ বাড়ে। কুপির আলো জালানোর সময় হয়নি এখনো। এটুকু অন্ধকারে আলো জালিয়ে বিলাসিতা করার সামর্থ্য নেই এই বসতির মানুষদের। কমলাদির মুখ দেখতে পাই না। আমাদের চোখ এতটা কম আলোয় দেখতে অভ্যস্ত নয়। আমার মুখ দেখতে কমলাদির অসুবিধা হচ্ছিল কিনা জানি না।
    তারপরে কমলাদি বসতির অন্যদের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করলেন। প্রস্তাব শুনে সোজাসুজি না বলে দিল সবাই। পাগল নাকি? এর জন্যে ‘প্রগতি’র সঙ্গে ঝগড়া! ওরা আমাদের জন্যে এত করে! আর ওদের লাভ করার কথা বলছ, সে কে না করে? না, না। আমরা এর মধ্যে নেই। কিছুতেই রাজি করাতে পারলেন না কমলাদি। সকলে এক বাক্যে না করে দিল। অসম্ভব।

    সেদিন স্কুল বন্ধ হওয়ার পরে, বেশ রাত্রে, গেলাম আমরা কমলাদির কাছে। আজকে ঘরে নয়, গঙ্গার ঘাটেই বসা। বিশ্রী গুমোট গরম পড়েছে। আকাশে অপরিচ্ছন্ন ছড়ানো ছেটানো মেঘ। সেগুলোতে প্রতিফলিত শহরের আলো, বেশ খানিকটা দূরের বড় রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট, আর কাছেই ভাসমান দুটো নৌকোর লণ্ঠন অন্ধকার খানিকটা কমিয়েছে মাত্র।
    চুপ করে থাকলেন কমলাদি বেশ কয়েক মিনিট। তারপর ভাবলেশহীন গলায় বললেন, ‘পারলাম না ওদের রাজি করাতে।’ একটা গাল দিয়ে বললেন, ‘যত ---!’ তারপরে, আমার হাতটা ধরলেন, ‘রাগ করবেন না, দাদা, ওদের দোষ নেই! কথায় বলে না, আপনি বাঁচলে বাপের নাম! যেটুকু পাওয়া যায় তা ওরা ছাড়তে পারে না, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বাঁচতে তো হবে। ওরা লোক খারাপ নয় দাদা।’
    তা তো আমরা জানি, জানি খুব ভাল করেই।
    ‘তবে আমি ছাড়ছি না। আমি বই ফেরত দেব না, টাকা ফেরত চাইব। ও বই তো আমাদের হকের জিনিস।’
    ‘ওরা কিন্তু আপনাকে সব কিছু থেকে বাদ দিয়ে দেবে।’
    ‘দিক। তবুও আমি ছাড়ব না। এমনিতেই তো মরে আছি, আর কী বা এমন হবে।’
    ছাড়লেন না কমলাদি। পরদিনই দিত্যদাকে বললেন, টাকা ফেরত দিতে হবে। দিত্যদা টাকা ফেরত দেবার কেউ নন। বললেন, অফিসে বলবেন, দেবে কি দেবে না সেটা তারা ঠিক করবে। আমাদের বলে পাঠালেন, আপনাদের জন্যে একটা পরিবার বিপদে পড়তে চলেছে, আপনাদের ভাল লাগছে?
    কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না ওঁরা, অশিক্ষিত, দরিদ্র, অসুস্থ এই নারীর আত্মসম্মানের অধিকারের কথা, কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না, এই ঘাড়হেঁট মানুষগুলোর মধ্যে একজন কেউ আছে যে অন্যের প্ররোচনা ছাড়াই নিজের অধিকারের কথা তুলতে পারে। সেটা বোঝা বা মেনে নেওয়া হয়ত মুশকিলও। তাতে তো নিজেদের সন্তর্পণে গড়া জগতটাই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে পারে।
    আমরাই বা কী করব? ঠিক করতে পারছিলাম না।

    কিন্তু শেষ অবধি আমাদের দোটানার অবসান ঘটল অন্যদিক থেকে। স্কুল ছেড়ে চলে আসতেই হল আমাদের। এই সম্ভাবনা অবশ্য অপ্রত্যাশিত ছিল না। যারা আমার গলা কাটবে বলেছিল, তারা সমস্যা সমাধানের অন্য আরও সহজ রাস্তা নিল।
    একদিন দুপুরে যখন কেউ বসতিতে নেই, গুদামের মালিকের লোকজন এসে স্কুলের ঘরটাতে আগুন লাগিয়ে দিল। বাঁশ, ত্রিপল আর চাটাই আর পলিথিনের ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যেতে বেশি সময় লাগল না। মেয়েরা আর শিশুরা প্রায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে বাধ্য হল, তাদের অনেক কষ্টে তৈরি স্কুলঘর মাটিতে মিশে গেল ছাই হয়ে।
    একমাত্র কমলাদি বাধা দেবার চেষ্টা করেছিলেন। বসতির অন্য মহিলারা তাঁকে টেনে সরিয়ে নিয়ে না এলে ওই গুণ্ডার দল হয়ত তাঁকে মেরেই ফেলত। মাথায় বেশ বড় একটা আঘাত নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে গালিগালাজ করার বেশি কিছু কমলাদি করতে পারলেন না। পুরুষরা কেউ ছিল না। থাকলেও যে খুব লাভ হত তা নয়। লোকগুলো যথেষ্ট আটঘাট বেঁধেই এসেছিল। কয়েকজন মহিলা প্রায় ছুটে গিয়ে থানায় খবর দিয়েছিলেন। কিন্তু কাশীপুর থানা ওখান থেকে অনেক দূর, আর তাছাড়া কোথায় কোন ঝুপড়ি-পট্টিতে ঘর জালিয়ে দিচ্ছে কারা, তা নিয়ে পুলিশের কোনও মাথাব্যথা ছিল না। কেউ মারা যায়নি বা গুরুতর আহত হয়নি শুনে, পুলিশ একবার দেখতেও আসেনি কী হয়েছে।
    সেদিন আমাদের পড়াতে যাওয়া ছিল না। ফলে কী হয়েছে তা আমরা জানতে পারিনি। অনেক রাত্রে দিত্যদা আমাকে খবর পাঠিয়েছিলেন। পরদিন সকালে আমি গেলাম দেখতে। দূর থেকেই দেখতে পেলাম, পোড়া বাঁশ আর ছাইয়ের গাদা। ঝুপড়ির বাইরে বিশেষ কেউ নেই। একটা ভয়ের হাওয়া ছেয়ে আছে সব জায়গাটা। আমাকে দেখে গুদাম মালিকের সেই দু’জন লোক একটু মুচকি হাসল। কিছু বলল না। কাজ হাসিল হয়ে গেছে। শুকনো ঝামেলায় তাদের কোনও আগ্রহ নেই।
    ঘরে কমলাদি শুয়ে আছেন। মাথায় একটা নোংরা ব্যান্ডেজ। মুখের দু’একটা জায়গায় কালশিটে। আমাকে দেখে উঠে বসতে গেলেন। পারলেন না। চোখ দিয়ে জল পড়ছিল।
    ‘আপনাদের স্কুল ছেড়ে না যেতে বলেছিলাম, দাদা। আর বলব না। চলে যান আপনারা। ওরা এবারে আপনাদের সত্যি সত্যি মারবে। আমরা কি আর রোজ কিছু করতে পারব? আর, যদি রাস্তাঘাটে কিছু করে? না, দাদা, আপনারা আর আসবেন না।’
    চুপ করে থাকি আমি। তারপর বলি, ‘আপনার মাথায় তো বেশ চোট লেগেছে। ডাক্তারের কাছে যাবেন? নিয়ে যাব আপনাকে?’
    ম্লান হাসেন কমলাদি। ‘দরকার হবে না। ওইটুকু কেটে গেছে, সেরে যাবে নিজেই। অন্য কোথাও স্কুল করুন আপনারা। এখানে কিছু করতে পারবেন না। কাল রাত্রে এসে ওরা বলে গেছে, এবারে শুধু স্কুল জ্বালিয়েছে, এর পরে পুরো বস্তি জালিয়ে দেবে।’ গলা বুজে আসে কমলাদির। ‘কোথায় যাব তখন কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে?’

    যখন ফিরছি সেদিন, বেশ রোদ উঠেছে। গঙ্গায় এখন জোয়ার। স্নান করছে ঘাট-ভর্তি লোক। ভাঙা জেটিটাতে কয়েকজন লোক বসে তাস খেলছে। কাঠ চেরাইয়ের তীক্ষ্ণ ধাতব শব্দ আজ বেশ তেরিয়া। রাস্তা দিয়ে যে সব লোক হাঁটছে, তারা পোড়া স্কুল-ঘরটার দিকে তাকিয়েও দেখছে না। কোনও খবরই নয় ওটা। এসব বস্তিফস্তিতে ওরকম কত কী হয়! সকলেই ব্যস্ত, কী হবে এসব ফালতু ঝামেলার কথা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে।
    গল্প শেষ। পাঠক কি একটু হতাশ বোধ করছেন? তেমন কোনও ঘটনা তো ঘটল না, কোনও চমকও পাওয়া গেল না। আগেই বলেছিলাম, তেমন কিছু বলার নেই। কিসের গল্প এটা? ঠিক বলতে পারব না।
    আমরা আর যাইনি ওখানে। অনেক পরে খবর নিয়েছিলাম, ঝুপড়িগুলো এখনও ওখানে আছে। কোনও স্কুল আছে কিনা, তা জানা যায়নি। শুনলাম, ‘প্রগতি’ এখনও ওখানে তাদের কাজ অব্যাহত রেখেছে। গুদামের মালিকের সঙ্গে তাদের কোনও বিরোধের কথা শোনা যায়নি। কমলাদি এখনও ওখানে থাকেন কিনা, সেকথা কেউ বলতে পারেনি। আমি কখনো কখনো ভেবেছি, নিজে গিয়ে খোঁজ নেব। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। এত কাজ থাকে, এত সমস্যা!
    প্রায়ই আমার মনে পড়ে ওই এক অতি সামান্য, অতি-চেনা নারীর আত্মসম্মানের জন্যে কয়েকদিনের লড়াইয়ের কাহিনী। নারীবাদের কথা জানতেন না কমলাদি। নারীর শক্তি-স্থাপনের ইতিহাসে তিনি অপাংক্তেয়। লোকসভায় মেয়েদের জন্যে আসন সংরক্ষণ প্রসঙ্গে তাঁর কোনও মতামত ছিল না। লোকসভা জিনিসটা কী, তাই তিনি সম্ভবত জানতেন না। তিনি শুধু একথা জানতেন, তাঁর যা প্রাপ্য তা তিনি পান না, তা নিয়েও তাকে যখন ঠকানো হয়, কোনও সভাই তাঁকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসে না।
    আমার কথা, আমাদের কথা, কমলাদি কতটা মনে রেখেছেন জানি না। আমি এখনও হতাশার মুহূর্তে মনে করার চেষ্টা করি কমলাদিকে। অক্ষমতার বেদনায় ম্লান এই চরাচর-ব্যাপী অস্তিত্বে কোথায় যেন একটা স্বস্তি বোধ করি।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৪ জুলাই ২০১৪ | ১৩৪৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | 24.96.166.220 (*) | ২৫ জুলাই ২০১৪ ০২:৫৭74654
  • এমনই হয়।
  • Abhyu | 141.220.183.161 (*) | ২৫ জুলাই ২০১৪ ০৩:১৭74655
  • ভালো লেখা। দুঃখের কথা এই যে এটা গল্প না, বাস্তব।
  • Ranjan Roy | 132.168.64.155 (*) | ২৬ জুলাই ২০১৪ ০৬:৪৬74656
  • সলিল,
    কিছুই করা যাবে না। তবু লিখুন, যাতে আমরা চমকে উঠে খেয়াল করি যে ঈশ্বরের দুনিয়ায় সব কিছু ঠিকঠাক চলছে না। তাতে হয়্ত-- কখনো-- কিছু
  • san | 52.104.27.185 (*) | ২৭ জুলাই ২০১৪ ০২:১৮74658
  • ভাল লেখা।
  • salil | 192.66.15.190 (*) | ২৭ জুলাই ২০১৪ ১২:০৮74657
  • হবে না, পারব না, বলব, নাকি বলব নাও পারতে পারি। আমি কাজটা তো পারব ভেবেই শুরু করেছি। দেখি না। আর, বলে তো আমি যাবই। চোখে তো আঙুল দিতেই হবে।
  • Ranjan Roy | 24.97.75.209 (*) | ২৮ জুলাই ২০১৪ ০৮:১৫74659
  • সলিল,
    ঠিক বলেছেন।
  • i | 147.157.8.253 (*) | ৩১ জুলাই ২০১৪ ১২:২২74660
  • এ লেখাখানি ভালো লাগা / মন্দ লাগার ঊর্দ্ধে।কোথাও তো ধরা রইল কমলাদির কথা। এরকম লেখা আরও লিখুন। শ্রদ্ধা জানবেন।
  • de | 69.185.236.51 (*) | ০১ আগস্ট ২০১৪ ০৫:২৩74661
  • কমলাদিরা আরো আসুন এরকম লেখাপত্তরে!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন