এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • স্পেনের রাজনীতিতে নয়া মোড় পোডোমস

    souvik ghoshal লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৮ অক্টোবর ২০১৫ | ১৩৮৪ বার পঠিত
  • স্প্যানিশ ভাষায় পোডেমস শব্দটির অর্থ ‘আমরা পারি’। স্পেনের সাড়া জাগানো নতুন বামপন্থী দলটি এই নামেই আত্মপ্রকাশ করেছে এবং স্পেন তথা ইউরোপের রাজনীতিতে ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছে। তারা সামনে নিয়ে এসেছে কৃচ্ছসাধন নীতিমালা বিরোধী একগুচ্ছ কার্যক্রম এবং তা জনসাধারণের কাছে বিপুলভাবে সমাদৃত হয়েছে। গ্রীসে সিরিজার কাজকর্মকে, উত্থান ও বিকাশের সঙ্গে অনেকেই মিলিয়ে দেখতে চাইছেন পোডেমস এর উত্থানকে এবং এই তুলনার বাস্তব ভিত্তি রয়েছে। লাগামছাড়া জাতীয় ঋণের প্রেক্ষিতে নেমে আসা আর্থিক সঙ্কট মোকাবিলার নামে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া কৃচ্ছসাধন নীতিমালার বিরুদ্ধে গ্রীসের সিরিজার মত স্পেনের পোডেমসও উচ্চকন্ঠ এবং আর্থিক সঙ্কটের মোকাবিলায় তারাও ট্রাইকার (আই এম এফ, ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক) নিদানের বিপ্রতীপে বিকল্প আর্থিক নীতিমালাকে সামনে এনেছে।

    পোডেমসের জন্ম স্পেনে ২০১১ সালে শুরু হওয়া গণ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে। ২০০৮ থেকে স্পেন তীব্র আর্থিক সঙ্কটের মুখোমুখি হয়। তখন হোসে লুই রডরিগেজ জাপাতেরোর নেতৃত্বাধীন ‘পি এস ও ই’ রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন। প্রথমদিকে আর্থিক সঙ্কট মোকাবিলায় তারা কেইনসীয় নীতিমালাকে কিছুদূর পর্যন্ত অনুসরণ করে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর মধ্য দিয়ে আর্থিক সঙ্কটের মোকাবিলা করতে চেয়েছিল। কিন্তু ২০১০ সালের শেষদিক থেকে এক বিপরীত যাত্রা শুরু হয়। ট্রোইকার নিদান মেনে কৃচ্ছসাধন নীতিমালা গ্রহণ করা হয়। ব্যাপক সংখ্যক শ্রমিক কর্মচ্যূত হন এবং জনগণের ক্ষোভ বিক্ষোভ বাড়তে থাকে। ২০১১ সালে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে রডরিগেজ পদত্যাগ করেন এবং মারিয়ানো রাজয় এর নেতৃত্বাধীন দক্ষিণপন্থী ‘পিপি’ দলটি ক্ষমতায় আসে। দ্রুতই পেনশনের সুযোগ সুবিধায় নানাবিধ কাটছাট করা হয়। অবসরের বয়স ৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ করা হয়। কমিয়ে দেওয়া হয় সরকারী কর্মচারীদের মাইনে। স্বাস্থ্য বাজেটেও ব্যাপক কাটছাট করা হয়। শিশু এবং বয়স্কদের জন্য প্রচলিত নানাবিধ প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়া হয়। মজুরী দশ শতাংশ কমে যায়। বেকারত্মের হার ২৫ শতাংশে পৌঁছে যায়। ৫৫ লক্ষ বেকার কোনও বেকারভাতা ছাড়াই কোনও রকমে বাঁচতে বাধ্য হয়। যাদের কাজ আছে তারাও নানা সঙ্কটের মুখোমুখি হন। সিংহভাগ কাজই ঠিকা ধরণের প্রথায় রূপান্তরিত হয়।

    স্বাভাবিকভাবেই দেশজুড়ে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম হয়। ক্ষোভ বিক্ষোভ দমনের জন্য সরকার ‘প্রতিবাদ বিরোধী’ চরম অগণতান্ত্রিক আইন পাশ করে। প্রতিবাদ করলে শাস্তি হিসেবে বিরাট অঙ্কের জরিমানা ধার্য হয়। শ্রমিক ইউনিয়নগুলির ধর্মঘটের অধিকারের ওপর নেমে আসে আক্রমণ। অবশ্য আইনী ভ্রুকূটি দেখিয়ে গণ আন্দোলনকে দমিয়ে রাখা যায় নি। স্পেনের শ্রমিক শ্রেণি এবং ব্যাপক জনসমাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নেমে আসেন প্রতিবাদ প্রতিরোধে। একের পর এক ধর্মঘট সংগঠিত হয়। স্পেনের শহর জুড়ে প্রতিবাদী মিছিলে লক্ষ লক্ষ মানুষ সামিল হন।

    ২০১১ থেকে শুরু হওয়া এই আন্দোলনটি ১৫ মে থেকে শুরু হওয়ায় এর জনপ্রিয় নাম হয়ে গেছে ‘এম-১৫’। ক্রমশই এই আন্দোলন নতুন গতি পায়। যাদের মুনাফার অতি লোভ ও অনৈতিক কার্যকলাপ আর্থিক সঙ্কটের জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী সেই ব্যাঙ্কারদের বিরুদ্ধে শাস্তি মূলক ব্যবস্থার দাবি এই আন্দোলনে জোরালোভাবে ওঠে। অচিরেই অর্জিত হয় একদা আই এম এফ এবং পরে স্পেনের চতুর্থ বৃহৎ ব্যাঙ্ক ‘ব্যাঙ্কিয়া’র প্রাক্তন কর্ণধার রডরিগো র‍্যাডোর বিরুদ্ধে ফৌজদারী তদন্ত শুরুর নির্দেশ অর্জনের সাফল্য। উল্লেখযোগ্য রডরিগো ব্যাঙ্কের শীর্ষপদে থেকে বহু মানুষের সর্বণাশ করেছিলেন। যদিও এই আন্দোলন এই ধরণের শীর্ষস্থানীয়দের বিরুদ্ধেই শুধু নয়, গোটা ব্যবস্থাটারই বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে। কেন এই আন্দোলন তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রতিবাদীদের এক সংগঠক, বছর পঁচিশেক বয়সের স্টেফানি গুয়েরসো জানিয়েছেন, “ যেদিকে যাচ্ছিলাম, যা দেখছিলাম তা আমাদের ভালো লাগছিল না। আমরা অনুভব করছিলাম আমরা আমাদের গণতন্ত্র হারাচ্ছি, আমাদের দেশকে হারাচ্ছি, আমাদের জীবন ধারণের পথকে হারাচ্ছি। আমাদের একটাই স্লোগান, আমরা প্রকৃত গণতন্ত্র চাই”।

    আন্দোলন চলাকালীন স্পেনের প্রধানমন্ত্রীর পার্লামেন্ট ঘোষণা নিঃসন্দেহে বিক্ষোভের আগুনে ঘৃতাহুতি দেয়। সরকারের ঘোষিত ব্যয়সংকোচ কর্মসূচীতে ভ্যাট বাড়ানো থেকে শুরু করে ক্রিসমাসের বোনাস ছাঁটাই - কিছুই বাদ যায়নি। প্রধানমন্ত্রী জানান,পণ্য ও পরিষেবাতে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট তিন শতাংশ বাড়ানো হবে,ফলে স্পেনে ভ্যাটের নতুন হার হবে একুশ শতাংশ। অনেক সরকারি কর্মচারী আর বড়দিনের বোনাস পাবেন না,আর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেই সরকারি চাকুরেদের সংখ্যা বা বেতন ছাঁটাই করা হবে - কোনও কোনও ক্ষেত্রে তা হবে এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত। জনগণকে বলা হয় স্পেনের সঙ্কটাপন্ন ব্যাঙ্কগুলোকে সাহায্য করার জন্য ইউরোজোনের নেতারা এক মাসের মধ্যেই তিন হাজার কোটি ইউরো দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন - তার শর্ত হিসেবে স্পেনকে নতুন একগুচ্ছ ব্যয়সঙ্কোচনের প্রস্তাবে রাজি হতে হয়েছে। আর সেই শর্ত পূরণের তাগিদ থেকেই প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রাহয় পার্লামেন্টে এই সব নতুন পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করছেন।

    এই পর্বে আন্দোলনের শুরুতে নগরের কেন্দ্রস্থল পুয়ের্তো দেল সোল এ প্রথমে জমা হয়েছিলেন মাত্র জনা পঞ্চাশেক বিক্ষোভকারী। পুলিশ বলপ্রয়োগে তাদের হটিয়ে দিতে চায়। এতে আন্দোলন তীব্র হয়। দিন তিনেকের মধ্যেই স্পেনের অন্তত বারোটি শহরে হাজার হাজার মানুষের বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ২০১১ থেকে বিশ্বজোড়া অকুপাই আন্দোলনের অংশ হিসেবে স্পেনের এই আন্দোলন শুরু হলেও তা আমেরিকার মতো হঠাৎ গতি হারিয়ে ফেলেনি বরং নানা আকর্ষক পথে এগিয়ে চলেছে। বিভিন্ন কর্মী দলে বিভক্ত হয়ে নানা ইস্যু ভিত্তিক লড়াইয়ে তারা অংশগ্রহণ করছেন। রাজপথের আন্দোলনের সাথেই তারা মিলিয়ে নিয়েছেন আইনী লড়াইকেও। একটি দল বহু মানুষের সর্বণাশকারী রডরিগো র‍্যাগোর মত ব্যাঙ্কারের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি লড়াইয়ের পথে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। প্রায় জনা পঞ্চাশেক আইনজীবী এগিয়ে আসেন বিনা পারিশ্রমিকে মামলা লড়তে, মামলার অন্যান্য খরচ মেটানোর জন্য অজস্র মানুষের থেকে অল্প অল্প টাকা নিয়ে একদিনেই ওঠে পঁচিশ হাজার ডলার। মামলা শুরু হয়। আর ব্যয়সঙ্কোচ নীতির ফাঁস যত তীব্র অয়েছে, ততই বেড়েছে রাজপথে বিক্ষোভ। প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রোজার যখন পার্লামেন্টে আরো বেশি কৃচ্ছসাধন নীতির কথা ঘোষণা করছেন, বলছেন বিক্রয়কর বাড়ানো বা সরকারী কর্মচারীদের মজুরী কমানোর কথা, বেকারভাতার সময়সীমা কমিয়ে আনার কথা তখন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার খনি শ্রমিক এসে পৌঁছন মাদ্রিদে। তাদের স্লোগান ছিল ‘আমরা নিরানব্বই শতাংশ’। খনিশ্রমিকদের বক্তব্য,স্পেন সরকার যেহেতু কয়লাখনি সংস্থাগুলোকে দেওয়া ভর্তুকির প্রায় দুই তৃতীয়াংশই ছাঁটাই করছে - তার ফলে এই খাতে হাজার হাজার কর্মী চাকরি খোয়াবেন। শ্রমিকদের আন্দোলন বৃহত্তর জনসমাজের সমর্থনলাভে সক্ষম হয়। টোনি নামে প্রতিবাদকারী একজন খনিশ্রমিক বলেন তারা মাদ্রিদবাসীর কাছ থেকেও আশাতীত সমর্থন পেয়েছেন । “দারুণ সাড়াজাগানো সমাবেশ হয়েছে - দেখুন, কত মানুষ এসেছেন! কেউ কেউ বলে মাদ্রিদ না কি দক্ষিণপন্থীদের শহর - কিন্তু আমার তো তা মনে হয় না! এটা তো শ্রমজীবীদের শহর,সাচ্চা শহর। আমরা ভীষণই খুশি - গোটা পদযাত্রায় আমরা দেশের প্রতিটা গ্রামে যেরকম সাড়া পেয়েছি মাদ্রিদেও তার কোনও ব্যতিক্রম হয়নি ... সত্যিই এটা দারুণ ব্যাপার।”আগত খনি শ্রমিক ও মাদ্রিদের নাগরিকদের বিপুল অংশ ব্যয়সংকোচ নীতির বিরুদ্ধে মিছিল করে অগ্রসর হলে রবার বুলেট নিয়ে পুলিশ তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, অন্তত ছিয়াত্তর জন গুরূতর যখম হন। কিন্তু দমন নীতি অগ্রাহ্য করে আন্দোলন ক্রমশ আরো তীব্র হয়। বড় ধরনের বিক্ষোভ সমাবেশ করে সে দেশের প্রধান দু’টি ট্রেড ইউনিয়ন- ইউজিটি এবং সিসিওও। সংগঠন দু’টি এ বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করার জন্য শ্রমিক শ্রেণি ছাড়াও দেশের সব নাগরিকের প্রতি আহ্বান জানায়।

    গণ আন্দোলনের এই উত্তুঙ্গ বাতাবরণেই পোডেমস এর জন্ম ও বিকাশ। কৃচ্ছসাধন নীতিমালা বিরোধী গণ আন্দোলনকে তারা রাজনৈতিক ক্ষমতা বিন্যাস বদলের আন্দোলনে রূপান্তরের ডাক দেয়। স্পেনের প্রচলিত দ্বিদলীয় রাজনৈতিক আধিপত্য, যা দক্ষিণপন্থী পিপি ও সমাজগণতন্ত্রী পি এস ও ই- র মধ্যে বন্টিত ছিল, তা ভেঙে দেওয়ার কথা বলে। রাজনৈতিক ক্ষমতা বিন্যাসের পরিবর্তনের লক্ষ্যে তারা সুচিন্তিত কর্মসূচী জনগণের সামনে হাজির করে। ২০১১ সালে লাগু করা বাজেট নীতি সংক্রান্ত সংবিধানের ১৩৫ নং ধারাটি বাতিল করে ১২৮ নং ধারা যা রাষ্ট্রীয় বা ব্যক্তি মালিকানা নিরপেক্ষভাবে দেশের সমস্ত সম্পদ জনকল্যাণে ব্যবহারের কথা বলে –তার সর্বাত্মক ব্যবহারের পক্ষে পোডেমস উচ্চকিত প্রচার চালায়। পোডেমস এর বিকল্প প্রস্তাবগুলির মধ্যে -

    ১) সরকারী ও ব্যক্তিগত ঋণের জনগণ কৃত হিসাব নিকাশ

    ২) সাপ্তাহিক কাজের সময় ৩৫ ঘন্টায় কমিয়ে আনা

    ৩) অবসরের বয়সকে ষাট এ নামিয়ে আনা

    ৪) মুনাফার জন্য গৃহীত লে অফ বা কর্মবিরতিকে আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করা

    ৫) দেশজুড়ে একটি ন্যূনতম রোজগারের সীমা নিরধারণ করা

    ৬) ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের ওপর সংসদের নিয়ন্ত্রণ তৈরি করা

    ৭) বেসরকারী ক্রেডিট রেটিং এজেন্সীগুলিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা ইত্যাদি অত্যন্ত গুরূত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয় এবং এই কর্মসূচী অন্য প্রধান দুটি দলের থেকে তাদের স্বকীয় অবস্থানকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে ।

    ২০১৪ সালের জানুয়ারী মাসে নতুন দল হিসেবে পোডেমসের যাত্রা শুরু হয়েছিল এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মে মাসের নির্বাচনে রাজনীতির মঞ্চে নয়া আবির্ভূত এই শক্তি সাড়ে বারো লক্ষের বেশি ভোট পেয়ে সবাইকে চমকিত করে দেয়। অঙ্কের নিরিখে এটা প্রায় আট শতাংশ এবং এই নির্বাচনে তারা পাঁচটি আসনে বিজয়ী হয়।

    পোডেমস এর সাফল্যের পেছনে একটি গণ আন্দোলনকে রাজনৈতিক পালাবদল এ রূপান্তরের ডাক দেওয়া ও নির্দিষ্ট কর্মসূচী হাজির করা যদি একটি গুরূত্বপূর্ণ দিক হয়, তবে জোট রাজনীতি সংক্রান্ত নির্দিষ্ট অবস্থান অপর একটি গুরূত্বপূর্ণ বিষয়। কমিউনিস্ট পার্টি অব স্পেন (পি সি ই) এর নেতৃত্বাধীন স্পেনের বামপন্থীদের মঞ্চ ‘ইউনাইটেড লেফট’ এর সঙ্গে পোডোমস ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখে এবং একসময় এই মঞ্চের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত হওয়া উচিৎ কিনা তাই নিয়ে দলের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা হয়। শেষপর্যন্ত পোডেমস তার স্বকীয়তার দিকে গুরূত্ব আরোপ করেই নির্বাচনী রণকৌশল তৈরি করে। ‘ইউনাইটেড লেফট’ দের মঞ্চ যেহেতু নির্বাচনে পোডেমস এর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ‘পিপলস পার্টি’ (পিপি)র সাথে এক্সট্রেমাদুরাতে জোট বেঁধে প্রাদেশিক সরকার চালিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে ইউনাইটেড লেফটদের সঙ্গে আবার পোডেমস এর অপর প্রতিপক্ষ স্প্যানিশ সোশালিস্ট ওয়ার্কাস পার্টি (পি এস ও ই) র আন্দালুসিয়াতে প্রাদেশিক স্তরে জোট ছিল, তাই পোডেমস নিজেদের স্বকীয়তাকে তুলে ধরার জন্য ইউনাইটেড লেফটদের সঙ্গে নির্বাচনী দূরত্ব বজায় রাখে। কৃচ্ছসাধন নীতিমালার বিরুদ্ধে পূর্ণ জেহাদ ও ভিন্নমার্গী রাজনৈতিক দর্শনকে জনগণের সামনে আনার জন্য পোডেমস এর এই রণকৌশল সফল হয়। ২০১৫ সালের মিউনিসিপ্যাল ইলেকশনে পোডেমস সরাসরি অংশগ্রহণ না করে স্থানীয় আন্দোলন এর সংগঠক ও নেতৃবৃন্দকে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এরা নির্বাচনে ভালোরকম সাফল্যও অর্জন করে। ২০১৫ র শেষে স্পেনের সংসদীয় নির্বাচনে পোডেমস এর বিজয় সম্ভাবনা স্পেনের ভেতরে এবং আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে ফিনান্স ক্যাপিটাল এর রক্ষকেরা, ব্যাঙ্কিং এলিট, রুলিং এলিট এর সমন্বয় পোডেমস এর মত শক্তিকে ঠেকাতে তৎপর থাকবে তাদের সর্বশক্তি নিয়ে এবং কর্পোরেট মিডিয়াও তাদের কব্জায় থেকে তাদের হয়েই কাজ করবে। গণ আন্দোলনের শক্তি এবং রুলিং এলিট এর দ্বন্দ্বের স্পেনীয় সংস্করণ কীভাবে আত্মপ্রকাশ করে গোটা পৃথিবীর বাম গণতান্ত্রিক মহল সেই দিকে আগ্রহী দৃষ্টি রাখছেন।

    পুনশ্চ -

    পোডেমস এর সদস্যসংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে এবং তা দু লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। গোটা দেশের হাজার খানেক পার্টিকেন্দ্রে এই সদস্যরা ছড়িয়ে আছেন এবং পার্টিকেন্দ্রগুলি সংগঠনের উচ্চাবচ প্রচলিত কাঠামোর বদলে আনুভূমিক সমমর্যাদা নতুন ধরণের বামপন্থার মডেল হিসেবেও ব্যাপক চর্চিত হচ্ছে। পোডেমস নিঃসন্দেহে বামপন্থী মতাদর্শকে তুলে ধরে কিন্তু এই বামপন্থা সোভিয়েত ধাঁচের বামপন্থা থেকে ভিন্ন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পার্টি গঠন কাঠামোয় যেভাবে অঙ্গীভূত করে এক বিশিষ্ট পার্টি পরিচালন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে অভিনব ও আকর্ষক। পোডেমস গোটা স্পেন জুড়ে তৈরি করেছে অসংখ্য পার্টি কেন্দ্র। পার্টিকেন্দ্রগুলিতে বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্ক হয় এবং যে কেউ সেই বিতর্ক তুলতে পারেন, বিতর্কে অংশগ্রহণ করতে পারেন। প্রতিটি পার্টি কেন্দ্রে একজন করে সাংগঠনিক নেতৃত্ব থাকেন এবং এই পদটি নিয়ম করে বিভিন্ন জনের মধ্যে বন্টিত হয়। পার্টির অন্যতম মুখ ইগলেসিয়াস সহ অন্যান্যরা আছেন মাদ্রিদ পার্টি কেন্দ্রে। কিন্তু গোটা দেশের পার্টিকেন্দ্রগুলির মাদ্রিদ পার্টিকেন্দ্রের সঙ্গে কোনও অধীনতার সম্পর্ক নেই। বৈদ্যুতিন মাধ্যমকে ব্যবহার করে সাংগঠনিক নির্বাচন সম্পন্ন করা বা দ্রুত বিভিন্ন প্রস্তাবকে প্রযুক্তিগত সুবিধা ব্যবহার করে সমস্ত পার্টিকেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়া নতুন ধরণের গণতান্ত্রিক পার্টি পরিচালন ব্যবস্থাকে সম্ভবপর করে তুলেছে।

    সারা পৃথিবীতেই কমিউনিস্ট জমানার একদলীয় শাসন কাঠামোর ফলিত দিকটির নানা সমস্যা রাজনৈতিক আলাপ আলোচনার অন্যতম বিষয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব ইউরোপ এর কমিউনিস্ট জমানায় বহুদলীয় গণতন্ত্রের অভাব, কেন্দ্রীভূত সিদ্ধান্ত ইত্যাদি নিয়ে যে সব প্রশ্নের মুখোমুখি প্রায়ই হয়ে থাকেন বিভিন্ন ঘরানার বামপন্থীরা, বর্তমান জমানার চিন ও কিউবাকেও যার সঙ্গে জড়িয়ে নেওয়া হয় – তার মোকাবিলায় কি ধরণের গণতান্ত্রিক পার্টি/সংগঠন ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন তা নিয়ে সমগ্র বাম মহলেই পুনর্জাগরণের সম্ভাবনার এই সময়ে ব্যাপক চর্চা ও অনুশীলন প্রয়োজন। স্পেনের পোডেমস সেই নিরিখেও বিশেষ গুরূত্বপূর্ণ এবং আগামী দিনে এই নিয়ে স্বতন্ত্রভাবে বিস্তারিত আলাপ আলোচনা জরুরী।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৮ অক্টোবর ২০১৫ | ১৩৮৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | 127.194.23.44 (*) | ২৮ অক্টোবর ২০১৫ ০৪:২৭69902
  • দরকারি লেখা। ভালো লেখা।
    পোডেমস-এর সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি অফ স্পেন-এর পার্থক্যের দিকগুলো আরেকটু গভীরভাবে আলোচিত হলে ভাল হয়।
    আর আমার মনে হচ্ছে, ট্রটস্কিবাদী ও নৈরাজ্যবাদী ঘরানার অন্তত কিছুটা প্রভাব আছে পোডেমস-এ। ইগলেসিয়াস, ও তিনি ছাড়া অন্য পার্টিনেতাদের অতীত সম্পর্কে কিছু জানা গেলে কি বুঝতে খানিক সুবিধা হবে?
  • PM | 233.223.157.246 (*) | ২৮ অক্টোবর ২০১৫ ০৫:৫০69903
  • অরো সময় দরকার কোনো মতামত দেবর জন্য। বিরোধী থাকার সময় বহু কিছু দাবী করা যায়। ইম্প্লিমেন্ট কিভাবে হবে সেটাই প্রশ্ন।

    "আর্থিক সঙ্কটের মোকাবিলায় তারাও ট্রাইকার (আই এম এফ, ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক) নিদানের বিপ্রতীপে বিকল্প আর্থিক নীতিমালাকে সামনে এনেছে।"--------- এই বক্তব্যের সমর্থনে কোনো যুক্তি দেখলাম না পুরো নিবন্ধে।

    কৃচ্ছসাধন করবো না--খুব ভালো দাবী। কিন্তু বর্তমান লাইফস্টাইল বজায় রাখতে গেলে যে পয়সা লাগবে তার যোগার হবে কোথা থেকে তার হদিস পাওয়া গেলো না নিবন্ধে। এ ব্যাপারে জানতে চাই।

    উদাহরন স্বরূপ স্পেনের কয়লা খনি শ্রমীকদের মাইনে আন্তর্জাতিক মানের থেকে বেশী হওয়ার জন্য যদি দেশের কয়লা খনির কয়লার দাম ইন্দোনেশিয়া/আফ্রিকার কয়লার থেকে ৩০-৪০% বেশী হয় তাহলে শিল্প মালীকরা দেশের কয়লা কিনবে না, বাইরে থেকে আমদানী করবে। এই পরিস্থিতিতে কয়লা শ্রমীকদের মাইনে সরকারকে দিতে হবে কিন্তু কয়লা উৎপাদন বন্ধ থাকবে কারন বিক্রি হবে না। এক্ষেত্রে কোন অর্থানৈতীক সুত্রে ঐ কয়লাখনিগুলোকে করদাতাদের পয়সায় সরকার চালিয়ে যাবে?

    এই একই যুক্তিতে ব্রিটেনের প্রায় সব কয়লাখনি বন্ধ হয়ে গেছে। " টেকিং কোল টু নিউক্যাসেল" আজ আর হাস্য উদ্রেককারী প্রবাদ নয়, কেউ অবাকও হয় না আজ প্রবদের ঘটনা সত্যি হলে। ঐ অন্চলের স্টীল প্ল্যন্টকে কয়লা আমদানী করতে নিজে দেখেছি।

    এই রক্ত চোষা ব্যবস্থাকে পাল্টাতে হবে--কিন্তু সেটা যে এরকম তুরী মেরে হবে না তা নিশ্চিত। এর থেকে বেটার ব্যবস্থার প্রস্তাব করতে হবে যেটা মোটেও সহজ নয়।

    বিকল্প অর্থনীতি না হলে হয় বামপন্থার নমে মুসোলিনী/দিদি তৈরী হবে নয় "দাও ফিরে সে অরন্য" বলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চীৎকার করতে হবে।
  • ranjan roy | 24.97.57.156 (*) | ২৯ অক্টোবর ২০১৫ ০৫:২৯69904
  • এই প্রবন্ধটি ও পিএম এর চিন্তা আরও ইনফর্মড ডিবেটের দাবি করে। চলুক।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন