এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • পশ্চিমবঙ্গের সরকারী চিকিৎসাঃ পরিষেবা ঘোষণা ও বাস্তব

    Punyabrata Goon লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২০ এপ্রিল ২০১৫ | ১৩২৮ বার পঠিত
  • স্বাস্থ্য মানে কেবল চিকিৎসা-পরিষেবা নয়, কিন্তু এই আলোচনা পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসা-পরিষেবা, বিশেষত সরকারী চিকিৎসা পরিষেবাতেই সীমিত। তৃণমূল সরকারের তিন বছর পার হয়ে গেল, এই তিন বছরে চিকিৎসা-সংক্রান্ত অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার, অনেক ঘোষণা করেছে। তিন বছর পর ঘুরে দেখাই যায়—কি ছিল পদক্ষেপগুলো আর কতটাই বা সুফল পাচ্ছেন মানুষ। লিখছেন ডা পুণ্যব্রত গুণ।

    ২০১১-এ ৩৪ বছরের পুরোনো বামফ্রন্ট সরকারের পতনের পর নতুন তৃণমূল সরকার গঠনের পর থেকেই স্বাস্থ্য দপ্তরের পূর্ণমন্ত্রীর দায়িত্ব মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর হাতে, তাই সরকারী নীতি-নির্ধারণে স্বাস্থ্য যথেষ্ট গুরুত্ব পাবে, এমনটাই আশা করেছিলেন সাধারণ মানুষ।

    শুরুতে যাতায়াতের পথে সরকারী হাসপাতালে হঠাৎ করে ঢুকে পরে হাসপাতালের অব্যবস্থা দূর করার কিছু চেষ্টা করেন মুখ্যমন্ত্রী। তারপর আসে কতোগুলো নির্দেশ, কিছু কাজ।
    •২০১২-র ফেব্রুয়ারী মাসে সরকারী ডাক্তারদের জেনেরিক নামে ওষুধ লিখতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এর আগে ২০০২-এ মেডিকাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া-র কোড অফ এথিক্স-এ ডাক্তারদের জেনেরিক নামে ওষুধ লেখার কথা বলা হয়। ২০০৫-এ পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন সরকার সরকারী ডাক্তারদের জেনেরিক নামে প্রেসক্রাইব করার নির্দেশ দেন। তাতে কোন ফল হয়নি। এইবার প্রথম পর্যায়ে জেনেরিক প্রেসক্রিপশন শুরু করা হয় কলকাতা মেডিকাল কলেজ, আর জি কর মেডিকাল কলেজ ও ন্যাশানাল মেডিকাল কলেজে, তারপর অন্যান্য সরকারী হাসপাতালগুলোতে। কারা সরকারী নির্দেশ মানছেন না, তার ওপর কড়া নজরদারী চালানো হয়।

    •বিগত সরকার ও বর্তমান সরকার দুই-এরই মাথাব্যথার একটা বড় কারণ ছিল ও আছে—শিশুমৃত্যু, বিশেষত হাসপাতালে শিশু ও নবজাতকের মৃত্যু। নবজাতক ও শিশুমৃত্যুর হার কমানোর জন্য ডা ত্রিদিব বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এক উচ্চস্তরীয় টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়।

    •আরেকটা উচ্চস্তরীয় টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয় ডা সুব্রত মৈত্রের নেতৃত্বে। এঁদের কাজ দ্বিতীয় স্তরের হাসপাতাল অর্থাৎ জেলা ও মহকুমা হাসপাতাল, স্টেট জেনেরাল হাসপাতালগুলো পরিদর্শন করে উন্নয়নের জন্য সুপারিশ করা।

    •২০১১-র আগে অসুস্থ নবজাতকদের সঘন চিকিৎসার জন্য সিক নিওনেটাল কেয়ার ইউনিট (এস এন সি ইউ) ছিল ৬টা। এখন তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৪০টা, এ বছরের শেষে সেই সংখ্যা ৫০-এ পৌঁছনোর কথা।

    •এছাড়া বিভিন্ন সরকারী হাসপাতালে অসুস্থ নবজাতকদের স্থিতিশীল করার জন্য সিক নিওনেটাল স্টেবিলাইজিং ইউনিট স্থাপিত হয়েছে ১২৭টা। এ বছরের শেষে আরও ১৭৩টা ইউনিট স্থাপিত হওয়ার কথা।

    •১১ই ডিসেম্বর, ২০১২ থেকে আগস্ট, ২০১৩-র মধ্যে ৩৫টা সরকারী হাসপাতালে ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান স্থাপিত হয়েছে, যেগুলো থেকে রোগীরা ১৪২টা অত্যাবশ্যক ওষুধ ৪৮ থেকে ৬৭.২৫% কম দামে কিনতে পারেন। তাছাড়াও এসব দোকানে পাওয়া যায় অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টিতে ব্যবহার্য স্টেন্ট, পেস-মেকার, অস্থিচিকিৎসায় ব্যবহার্য ইমপ্ল্যান্ট, ইত্যাদি। আরও ৮৬টা সরকারী হাসপাতালে ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান স্থাপন করার পরিকল্পনা রয়েছে।

    •এর পাশাপাশি আছে ন্যায্য মূল্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা। ৮৪টা ব্লক প্রাইমারী স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও গ্রামীণ হাসপাতালে প্রয়োজনীয় প্যাথোলজিকাল পরীক্ষা ও এক্স-রের ব্যবস্থা হয়েছে পিপিপি মডেলে। ২২টা সিটি স্ক্যান মেশিন ও ৮টা এমআরআই মেশিন বসেছে। এগুলোর মধ্যে কিছু অবশ্য বামফ্রন্টের আমলেই চালু করা হয়েছিল।

    •যে সব হাসপাতালে ব্যবস্থা নেই, সে সব কিছু সরকারী হাসপাতালে ডিজিটাল এক্স-রে, সিটি স্ক্যান ও এমআরআই মেশিন বসানোর কথা চলছে। ডায়ালিসিস-এর ব্যবস্থা করা হবে। সরকার মেশিন কিনবে, পরিচালনা করবে বেসরকারী প্রতিষ্ঠান।

    •মেডিকাল কলেজের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৭, সিটের সংখ্যা ২২০০। পিপিপি মডেলে ৩ টে মেডিকাল কলেজ খোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

    •৭ টা স্বাস্থ্য জেলা হয়েছে—বিষ্ণুপুর, ঝাড়গ্রাম, নন্দীগ্রাম, ডায়মন্ড হারবার, আসানসোল, রামপুরহাট ও বসিরহাট।

    •রাজ্যের ফিনান্স কমিশনের চেয়ারম্যান ও মাল্টি-ডিসিপ্লিনারী গ্রুপ অন হেলথের সদস্য অধ্যাপক অভিরূপ সরকার জানিয়েছেন—পশ্চাৎপদ এলাকা উন্নয়নের তহবিল দিয়ে গ্রামাঞ্চলে ১৩টা মাল্টি-স্পেশালিটি হাসপাতাল স্থাপনের কাজ চলছে, আরও ২১টা স্থাপনের পরিকল্পনা।

    •জেলা হাসপাতাল ও মেডিকাল কলেজ হাসপাতালগুলোকে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বীমা যোজনার অন্তর্গত করা হয়েছে। ১৩টা জেলা হাসপাতাল, ৫টা মেডিকাল কলেজ ও ২টো মহকুমা হাসপাতালে এই পরিষেবা এখন পাওয়া যাচ্ছে।

    •২০১৪-র ৯ই জানুয়ারী জারী হওয়া এক সরকারী মেমোরান্ডামে বলা হয়েছে যে সরকারী হাসপাতালে আউটডোর ও ইন্ডোরের ফ্রি বেডগুলোতে বিনামূল্যে অত্যাবশ্যক ওষুধ সরবরাহ করা হবে। সরকারী ওষুধের তালিকায় জীবনদায়ী ওষুধের সংখ্যা ৪৮, অত্যাবশ্যক ক ৬৭, অত্যাবশ্যক খ ৬৮ এবং অত্যাবশ্যক গ ৫৬টা।

    •৩রা মার্চ, ২০১৪-এ জারী হওয়া এক আদেশে বলা হয়েছে এখন থেকে সরকারী হাসপাতালে ডাক্তারের লেখা ওষুধের পুরো কোর্স পাওয়া যাবে।

    কিন্তু বাস্তবটা ঠিক কি রকম?
    চিকিৎসাক্ষেত্রে সরকারে যে সাফল্যের কথা বললাম, তার অধিকাংশ তথ্য আমরা পেয়েছি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্যদপ্তরের প্রকাশনা ‘হেলথ অন দি মার্চ’ থেকে। কিন্তু বাস্তবে মানুষ কতটা কি পাচ্ছেন দেখা যাক।
    •গ্রাম ও শহরে স্বাস্থ্য পরিষেবায় বিরাট বৈষম্য। ২০১২-’১৩-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ থাকেন, সেখানে পাশকরা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের চিকিৎসক ১৩১১৭ জন, অথচ শহরাঞ্চলে ডাক্তারের সংখ্যা ৩৯৩৪৯ জন। আসলে কিন্তু গ্রামে আরও কমসংখ্যক ডাক্তারকে পাওয়া যায়, গ্রামের সরকারী হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাঁদের পোস্টিং তাঁদের অনেকেই সপ্তাহে ২-৩দিন গ্রামে থাকেন, বাকী দিন শহরে। গ্রামের হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা ১৬,৮৬২, শহরে ৯২,১০০ অর্থাৎ শহরে শয্যার সংখ্যা গ্রামের প্রায় ৫.৫ গুণ। গ্রামাঞ্চলে যে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা থাকেন তাঁরা আবার গ্রামীণ সমাজ-জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন। সরকার প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, গ্রামীণ হাসপাতাল, মহকুমা ও জেলা হাসপাতালে ডাক্তারদের ধরে রাখতে পারছেন না। গ্রামের মাল্টিস্পেশালিটি হাসপাতালের ডাক্তার কোথা থেকে পাওয়া যাবে—আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না।

    •জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশন একটা ইতিবাচক পদক্ষেপ হলেও অধিকাংশ ওষুধ জেনেরিক নামে পাওয়া যায় না। জেনেরিক প্রেসক্রিপশনে রোগী কোন ব্রান্ডের ওষুধ পাবেন তা নির্ভর করে ওষুধের দোকানীর ওপর, দোকানীর যে ব্র্যান্ডে লাভ বেশী সাধারণত সেই ব্র্যান্ড পান রোগী। সমস্ত প্রয়োজনীয় ওষুধ জেনেরিক নামে উৎপাদিত না হলে জেনেরিক প্রেসক্রিপশন-এর লাভ মানুষ পেতে পারেন না। রাজ্য সরকার বলতেই পারেন ওষুধ-শিল্প তো রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে নয়। কিন্তু রাজ্যের ড্রাগ কন্ট্রোল তো স্বাস্থ্য দপ্তরের নিয়ন্ত্রণে, ড্রাগ কন্ট্রোল তো ড্রাগ এন্ড কসমেটিকস আইন মেনে ব্র্যান্ড নামে ওষুধের লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ করতেই পারে। তাছাড়া কিছু রুগ্ন ওষুধ কারখানা সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে বহু বছর ধরে, সেগুলোতে তো জেনেরিক নামে অত্যাবশ্যক ওষুধ তৈরী করাই যায়।

    •শিশুমৃত্যু কমানোর জন্য এসএনসিইউ ভালো হাতিয়ার হতে পারে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেগুলোতে ডাক্তার ও নার্স বাড়ন্ত। কলকাতার বাইরে এক পুরোনো মেডিকাল কলেজের এসএনসিইউ-তে বেশ কয়েক মাস কাজ করেছেন এমন একজন ডাক্তারের কাছে জানা—সেখান থেকে কোনও অসুস্থ বাচ্চাকেই ফেরানো হয় না, ফলে এসএনসিইউ-তে বাচ্চার সংখ্যা হয় প্রায় ৭০, দেখার জন্য মেডিকাল অফিসার ২ জন, নার্স—মর্নিং ও ডে শিফটে ৩ জন, নাইট শিফটে ২ জন। নার্সদের ৯০% সময় যায় ২ ঘন্টা ছাড়া ছাড়া বাচ্চাদের খাওয়াতে। ওয়ার্মার চলে, কিন্তু তার দিকে খেয়াল রাখার সময় মেলে না—কোথাও হয়তো ওয়ার্মার বন্ধ হয়ে বাচ্চা ঠান্ডা হয়ে গেছে, কোথাও বেশী গরমে ফোস্কা...। কিছু কিছু ক্ষেত্রে শোনা যায় পরিকাঠামোও পর্যাপ্ত নয়।

    •ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান, ন্যায্য মূল্যের পরীক্ষা-নিরীক্ষা—প্যাথোলজি, রেডিওলজি, ডিজিটাল এক্স-রে, সিটি স্ক্যান, এমআরআই স্ক্যান এবং ন্যায্য মূল্যে ডায়ালিসিস পরিষেবা—এই সবগুলোই প্রাইভেট-পাব্লিক পার্টনারশিপ অর্থাৎ সরকারী পরিকাঠামো ব্যবহার করে স্বাস্থ্য-ব্যবসায়ীদের মুনাফা লোটা। নতুন করে ডিজিটাল এক্স-রে, সিটি স্ক্যান, এমআরআই স্ক্যান এবং ন্যায্য মূল্যে ডায়ালিসিস পরিষেবা শুরু করার যে পরিকল্পনা তাতো ভয়ংকর। সেখানে স্বাস্থ্য দপ্তর মেশিন বসাবে বিভিন্ন ফান্ড থেকে টাকা জোগাড় করে, ‘অপারেট আর ম্যানেজ’ করবে বেসরকারী মালিক। সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য যোজনা কমিশনের উচ্চ-স্তরীয় বিশেষজ্ঞ দলের সুপারিশ কিন্তু পিপিপি-র বিরুদ্ধে।

    •ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানগুলোর কিছু ইতিবাচক প্রভাব অবশ্যই স্বীকার করা উচিত—এইগুলোর চাপে পশ্চিমবঙ্গের ওষুধের দোকানিদের সংগঠন বিসিডিএ (বেঙ্গল কেমিস্ট এন্ড ড্রাগিস্টস’ এসোশিয়েসন) বাধ্য হয়েছে এমআরপি-র চেয়ে কমে ওষুধ বিক্রি করতে। অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টিতে ব্যবহার্য স্টেন্ট, হার্টব্লকে ব্যবহার্য পেস-মেকার-এর দাম প্রায় কুড়ি হাজার টাকা করে কমে গেছে, অসাধু ডাক্তারদের কমিশন খাওয়া কমেছে। কিন্তু ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানের বিরুদ্ধেও বলার আছে—যে ১৪২টা অত্যাবশ্যক ওষুধের কথা বলা হয়েছে, আসলে কিন্তু ওষুধের সংখ্যা ১৩৩টা, বাকী ৯টার পুনরাবৃত্তি আছে। এই ১৩৩টার মধ্যেও আবার একই ওষুধের বিভিন্ন রূপ আলাদা আলাদা তালিকাভুক্ত হয়েছে, ব্যাপারটা এরকম—অ্যামোক্সিসিলিন-এর ৫০০ মিলিগ্রাম ক্যাপসুল, ২৫০ মিলিগ্রাম ক্যাপসুল, ১২৫ মিলিগ্রাম বড়ি ও সিরাপ—মোট ৪ বার তালিকাভুক্ত হয়েছে অ্যামোক্সিসিলিন। তালিকা ভালো ভাবে বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি আসলে কাজের ওষুধের সংখ্যা ৯০টা। এই ৯০টা ওষুধের মধ্যে আবার ৬৮টাই কেবল ভারতের জাতীয় অত্যাবশ্যক ওষুধের তালিকাভুক্ত। জাতীয় তালিকায় ওষুধের সংখ্যা ৩৪৮টা। ছাড় দেওয়া হচ্ছে একেক দোকানে একেক রকম। কমদামের ব্র্যান্ডেড জেনেরিক না রেখে, দামী ব্র্যান্ডেড জেনেরিক রাখা হচ্ছে যাতে ছাড় দিয়েও বেশী লাভ করা যায়।

    •নতুন মেডিকাল কলেজের কিছু বেসরকারী। সরকারী মেডিকাল কলেজে সাড়ে ৪ বছর ডাক্তারী পড়তে খরচ হয় ৪০,৫০০ টাকা। বেসরকারী কলেজে জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিয়ে ভর্তি হলে প্রায় ৫ লাখ, কলেজের প্রবেশিকা দিয়ে ভর্তি হলে প্রায় ২২ লাখ, এনআরআই কোটায় ৫৫ লাখ—অর্থাৎ বেসরকারী মেডিকাল কলেজ স্থাপনের পেছনে মুনাফাই প্রধান উদ্দেশ্য। সরকারী মেডিকাল কলেজে সিট বাড়ানো হলেও লেকচার থিয়েটার, ল্যাবরেটরী, হস্টেল, শিক্ষক কোন কিছুই বাড়ানো হয় নি। নতুন সরকারী মেডিকাল কলেজ খোলা হয়েছে পরিকাঠামো না বানিয়েই। এবার সরকার পরিকল্পনা করছে পিপিপি মডেলে মেডিকাল কলেজ খোলার—কুচবিহার, নদীয়া জেলার ধুবুলিয়া, দক্ষিণ ২৪ পরগণার ভাঙ্গরে তিনটে মেডিকাল কলেজ খোলার জন্য ‘এক্সপ্রেসন অফ ইন্টারেস্ট’ (আগ্রহ-প্রকাশ) আহ্বান করা হয়েছে। বেশী টাকা দিয়ে যারা ডাক্তার হবে, তাদের সরকার কি কাজে লাগাবে?

    •মেডিকাল পাঠক্রমেও কোনও বড় রকম পরিবর্তন হয় নি। প্রান্তিক মানুষজনের স্বাস্থ্যসমস্যা সেখানে গুরুত্ব পায় না। যেমন ২০১২-র সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে মোট ২৩০৩৫ জন সাপের কামড় খান, মারা যান ৩২৮ জন। অথচ ডাক্তারদের সর্পদংশনে এভিএস চিকিৎসা শেখানো হয় না। পেশাগত রোগগুলো যথাযোগ্য স্থান পায় না পাঠক্রমে। এমন কি নতুন মেডিকাল গ্রাজুয়েটরা অনেকেই ডায়রিয়া বা সর্দিকাশির মতো সাধারণ রোগগুলোর চিকিৎসায় দক্ষ নন।

    •২০০৮-এর ১লা এপ্রিল থেকে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বীমা যোজনার মাধ্যমে গরীব মানুষের চিকিৎসার একটা চেষ্টা চলছে। কিন্তু অনেক গরীব মানুষই এখনও RSBY কার্ড পাননি। এই যোজনা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগও প্রচুর। কার্ড পুনর্নবীকরণের জন্য টাকা লাগে না, টাকা নেওয়া হচ্ছে। বীমায় যে সব প্যাকেজ আছে, সেই প্যাকেজে চিকিৎসা করে কার্ড থেকে টাকা কাটার পর অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হচ্ছে রোগীর কাছ থেকে। ছোট কোনও অপারেশন করে বড় অপারেশন দেখিয়ে বেশী টাকা নিচ্ছে বেসরকারী হাসপাতাল-নার্সিং হোম। কোনও কোনও জেলায় বীমার টাকা পেতে বেসরকারী হাসপাতাল-নার্সিং হোমের ডাক্তাররা প্রয়োজন ছাড়াই মহিলাদের হিস্টেরেক্টমি অপারেশন করে দিচ্ছেন। সরকারী হাসপাতালে RSBY কার্ডের সুবিধা পেতে গেলে সুপারিন্টেন্ডেন্টের অনুমতি নিতে হয়, অনুমতি-পত্রে সই করানোর জন্য দালাল আছে...।

    •সরকারী হাসপাতালে বিনামূল্যে অত্যাবশ্যক ওষুধ দেওয়ার ৯ই জানুয়ারী, ২০১৪-র মেমোরান্ডাম ও পুরো কোর্সের ওষুধ দেওয়ার ৩রা মার্চ, ২০১৪-র আদেশ সরকারী হাসপাতালে পৌঁছায় নি বলে নদীয়া ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বন্ধু-সংগঠনগুলো জানিয়েছে।

    •৯ই জানুয়ারীর মেমোরান্ডামে প্রামাণ্য চিকিৎসা বিধি (Standard Treatment Guidelines)-র কথা বলা হয়েছে। এমন বিধি তৈরী আছে কেবল প্রাথমিক স্তরের চিকিৎসার জন্য, তাও তা বহুল-প্রচারিত নয়।

    চিকিৎসা-পরিষেবার সমস্যাগুলো অনেক গভীরে, ছোটখাট সংস্কারে কিছু হওয়ার নয়। চাই সবার জন্য স্বাস্থ্য, রাষ্ট্র সমস্ত নাগরিকের স্বাস্থ্যরক্ষার দায়িত্ব নেবে এমন একটা ব্যবস্থা। সেখানে সমস্ত ডাক্তার হবেন রাষ্ট্রের নিযুক্ত, আপনার রোগ হলে কোন ডাক্তারের কাছে যাবেন তা হবে পূর্ব-নির্ধারিত, তিনি ওষুধ বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা লিখবেন প্রামাণ্য চিকিৎসা বিধি মেনে, কোন বিশেষজ্ঞের কাছে বা হাসপাতালে ভর্তির জন্য তিনি পাঠাবেন তাও পূর্ব-নির্ধারিত, কোনও ধাপেই আপনাকে পয়সা দিতে হবে না। কর থেকে সংগৃহীত অর্থে চলবে সমস্ত চিকিৎসা-পরিষেবা। অর্থাৎ স্বাস্থ্য-পরিষেবার রাষ্ট্রীয়করণ চাই।

    (জনস্বাস্থ্য ও সরকারী নীতি নিয়ে দু’দিনের এক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয় ১৭-১৮ই জুলাই, ২০১৪ সল্ট লেকে ইন্সটিটিউট অফ ডেভেলাপমেন্টাল স্টাডিজ কলকাতা-য়। দ্বিতীয় দিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা অবধি এক প্যানেল আলোচনা হয় একই বিষয়ে। বক্তাদের মধ্যে ছিলেন অর্থনীতিবিদ জাঁ দ্রেজ, পশ্চিমবঙ্গের পূর্বতন বিশেষ স্বাস্থ্য সচিব দিলীপ ঘোষ, নারী ও শিশুকল্যাণ বিভাগের প্রতিমন্ত্রী ডা শশী পাঁজা, রাজ্য অর্থ কমিশনের চেয়ারম্যান ও মাল্টিডিসিপ্লিনারী এক্সপার্ট গ্রুপ অন হেলথ-এর সদস্য অধ্যাপক অভিরূপ সরকার, ইন্সটিটিউট অফ হাইজিন এন্ড পাব্লিক হেলথ-এর স্বাস্থ্য-শিক্ষা বিভাগের প্রধান ডা মধুমিতা দোবে এবং ডা গুণ। তাঁর বক্তব্যের ঈষৎ বর্ধিত রূপ এই প্রবন্ধ।)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২০ এপ্রিল ২০১৫ | ১৩২৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Punyabrata Goon | 24.99.56.121 (*) | ২০ এপ্রিল ২০১৫ ০২:৫৭66236
  • ছত্তিশগড়ের আন্দোলন নিয়ে আমার পূর্ব-প্রতিশ্রুত লেখাগুলো লেখা হয়ে উঠছে না, স্বাস্থ্য আন্দোলনের কাজের চাপে। এবার পশ্চিমবঙ্গের সরকারী স্বাস্থ্যপরিষেবা নিয়ে স্বাস্থ্যের বৃত্তে পত্রিকায় প্রকাশিত আমার এক লেখা।
  • abantika | 122.79.37.61 (*) | ২৬ এপ্রিল ২০১৫ ১০:০৮66237
  • খুব জরুরি লেখা l ফেবু গুরুতে শেয়ার করব ?
  • pi | 233.176.11.49 (*) | ২৬ এপ্রিল ২০১৫ ১০:৪২66238
  • অবন্তিকা, আরমসে করো। গ্রুপে আগে একবার শেয়ার করেওছিলাম। অন্য পোস্টের নিচে চাপা পড়ে গেছে।
  • dc | 132.164.31.44 (*) | ২৬ এপ্রিল ২০১৫ ১১:১৩66239
  • লেখাটা পড়তে ভাল্লাগলো, এরকম পরিকাঠামো প্রতিটা রাজ্যে গড়ার জন্য আন্দোলন হওয়া উচিত। আর অন্তত বেসিক স্বাস্থ্য-পরিষেবার রাষ্ট্রীয়করণ অবশ্যই করা উচিত, অ্যাডভান্স্ড লেভেলে সরকারি আর বেসরকারি দুরকমই রাখা যেতে পারে।
  • পারমিতা | 127.194.31.5 (*) | ৩০ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৫০66240
  • সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে আরও ভাবা দরকার ।
  • দেবাশিস | 123.21.79.146 (*) | ০১ মে ২০১৫ ০৩:০৬66241
  • ্খুব তথ্যপূর্ণ লেখা

    ছোটখাট সংস্কারে কিছু হওয়ার নয়। চাই সবার জন্য স্বাস্থ্য, রাষ্ট্র সমস্ত নাগরিকের স্বাস্থ্যরক্ষার দায়িত্ব নেবে এমন একটা ব্যবস্থা। ঠিক !
  • dc | 132.164.204.216 (*) | ০১ মে ২০১৫ ০৪:৪১66242
  • সবার জন্য অন্তত বেসিক স্বাস্থ্য আর শিক্ষা - এই দুটো ন্যাশনাল থেকে প্রতিটা রাজ্য সরকারের প্রায়োরিটি হওয়া উচিত। এই দুটো বোধায় কিছুটা রিলেটেডও।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন