এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • আমার বাবার বাড়ি

    Shakti kar bhowmik লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২০ আগস্ট ২০১৭ | ২২৪১ বার পঠিত
  • আমাদের যাদের বয়েস স্বাধীনতার বয়েসের পাশাপাশি তারা ছোটবেলায় প্রায়ই একটা অদ্ভুত প্রশ্নের মুখোমুখি হতাম, দেশ কই? উত্তরে যে দেশের নাম বলার রীতি ছিলো যেমন ঢাকা, কুমিল্লা, সিলেট, নোয়াখালী সব ছিলো ভারতের ম্যাপের বাইরে সবুজ এলাকায়। আবার সদ্যস্বাধীন দেশে আমরা খুব আবেগবিহ্বল গান শুনি -ভারত আমার ভারতবর্ষ স্বদেশ আমার স্বর্গ গো ..., স্বদেশের বাইরে দেশ? বন্ধুরা কেউ কেউ ছুটি ছাটায় পাসপোর্ট করে দেশে যায় - আমরা যাইনা কারণ বাবা জ্যেঠারা দেশভাগের আগেই দেশ ছেড়েছেন। দাদু ঠাকুমাও নেই। পাসপোর্টের ব্যাপার ঠিক বুঝি না তবে জানি ওটা না থাকলে বাবার দেশ ময়মনসিংহে যাওয়া যায় না। তা বলে কি আর গল্প শুনিনা। শুনি কতো যে গল্প। বাবা, মেজকাকু, বড় পিসি, ছোট ঠাকুরমা - এক এক জনের এক এক রকম গল্প। আর এক রকম গল্প ও শুনি, রান্নাপিসির ছেলে কি ছিদ্দিক চাচা আর বাজনাদার নাগারচি "চোরা পথে" বাধ্য হয়েই জীবিকার প্রয়োজনে মরিয়া হয়ে আসা যাওয়া করে। অপরাধ? কে জানে, রাতারাতি একটা দেশ টুকরো হয়ে গেলে এরাই বা কি করে।

    আমার দেশ এবং জন্মভূমি দুইই ভারত। এখানেই লেখাপড়া জীবিকা, সন্তানদের জন্ম সংসার যাপন। যতো সুখস্মৃতি এই দেশে। আজকের বেদনা বিথর রাতে এই আকাশেই মুক্তির আশ্বাস খুঁজি, ঝুরঝুর ঝরে যায় স্মরণশিশির।
    তবুও ওপার বাংলার পিতৃভূমির না দেখা অভিজ্ঞান মন ব্যাকুল করে। সে ব্যাকুলতা নস্টাল্জিয়া। এই শব্দের প্রতিশব্দ খুঁজি না। এই স্মৃতিঘের দুঃখ দেয় না। বরং রবীন্দ্রনাথকে মনে পড়ায় --বাজিল বুকে সুখের মতো ব্যাথা। আমরা ঘরহারা নই, ঘর ছাড়া। দেশভাগের আগেই যেহেতু বিকল্প বাসস্থান ছিলো তাই চিরকালের মতো দেশ ছাড়ার যন্ত্রণায় আমার বাবা কাতর ছিলেন না। দাঙ্গার কোন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও প্রতিবেশীদের রূঢ় ব্যাবহার পাননি। অষ্টগ্রাম তাঁর কাছে ছিলো - "স্বর্গপুরী বিশ্বশোভা সেইখানেতে গেছে চুরি "। বাবার বাড়ীর গল্পে বাবাকেই কাছে পাই। সেই দেশে না ভোলা গান আজকে আবার "জাগালো স্মৃতি নয়ন ছলছলিয়া বাদল শেষে করুণ হেসে যেন চামেলী কলিয়া"। না দুঃখের হাহুতাশ নয়, করুণ হেসে ভালো লাগার স্মৃতিস্রোতে "প্রাণের পদ্ম ভাসাইলাম "।

    বাবার কতো গল্প, রামজয় রায়ের দালান, মন্দিরতলা, পদ্মফুল উত্কীর্ণ মাসজিদ, হাজারী দীঘির জলের ওপর পুরু দামঘাস তার ওপর গরু মোষ চরতে পারতো। হাওরে কতো পদ্ম মাখনা পানিফল, বাবা বলতেন শিংড়া। খাদ্যমূল্য নাকি প্রচুর। ওই খেয়ে ওঁদের অমন সুস্বাস্থ্য আর উদ্যম। বাঘ সাপ কিচ্ছুকে ভয় পেতেন না। একবার দুষ্টুমি করে পণ্ডিত মশাইএর ফুল বাঁধা টিকি কেটে ফেলে দিয়ে তিনদিন হাওরে ডুব সাঁতার দিয়ে আর জলজ এবং বনজ ফল খেয়ে অভিভাবকদের প্রহার এড়িয়ে ছিলেন। জেলেদের হাত দিয়ে এক স্নেহময়ী ঠাকুমা সন্দেশ নাড়ু মোয়া পাঠিয়ে দিতেন, না হলে "কি খাইবাম? বাঁচবাম ক্যামনে?" শুনেছি অষ্টগ্রামে ভালো পনির তৈরী হোত। অষ্টগ্রাম সাধারণ পাঠাগারের ছাপমারা নবীন চন্দ্র সেনের গ্রন্থাবলীর ভগ্নাবশেষ এখনো আমার কাছে আছে। গর্ব করতেন ব্রিটিশ গেজেটে কতো বার কি কারণে অষ্টগ্রামএর উল্লেখ আছে। বাবার জন্মের আগে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমে এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে গৃহদেবতার মন্দিরের ভিত্তিতে ফাটল ধরে যায়, বাসুদেব স্থানান্তরিত হন পুরোহিতের দেবোত্তরে। আমরা জানিনা গৃহহীন ভক্তের গৃহহারা ভগবান আজ কোথায় আছেন। দিনে একবার দুটি বাতাসা ফুল চন্দন তুলসী পাতা তাঁর কপালে জুটছে কি না।

    কত গল্প শুনেছি, বটে ভুলেও গেছি। জীবনের সকাল দুপুরে মনে রাখার মতো অনেক গল্পের ভীড়ে চাপা পড়ে গেছিলো পুরোনো সেই দেশের গল্প। সেদিন ফেসবুকে একটি ফটোগ্রাফে হাওরদ্বীপ অষ্টগ্রাম দেখে সেই অচেনা দেশে শৈশব কৈশোর যৌবন কাটানো আমার বাবার কথা খুব বেশী করে মনে পড়লো। ছবিটি তোলা হয়েছে এতো সুন্দর দৃষ্টিকোন থেকে। গোলাকৃতি শ্যামল দ্বীপ সেই গ্রাম, তরুছায়া আর মেঘে মাখামাখি। জলের অপরূপ বীচিবিভঙ্গ তির তির করছে বাতাসে। অতল জলের সুদূর প্রসারী আহ্বান ।ওইখানে ছিলো দীর্ঘ কায়, আয়তচক্ষু, ঘন কালো চুল আর মায়াবী মন অসম সাহসী আর আনন্দউচ্ছল বাবা কাকাদের জন্মভূমি? ছবিটি কি হেলিকপ্টার থেকে তোলা? এরকম সামগ্রিক দৃশ্য তোলা তো সোজা নয়।
    *********************************************

    সে যুগের গল্পে আসতো জলের দেশে নববধূ নিয়ে বরযাত্রীরা। কালীকচ্ছ থেকে নৌকো করে আমার জেঠিমাকে নিয়ে এসে বধূবরণের পর দেখা গেলো তত্বের সামগ্রী সব শিল্পিত মিষ্টান্ন বৃষ্টি ভিজে একাকার। বাবার "ছুট ঠাউরদু" বললেন কেউ না আনলেও বাবা পকেটে করে ওনাকে দেখাবার জন্যে কিছু আনবেন। ঠাকুমার বিশ্বাস বৃথা হয়নি। বাড়ীর বালিকা বধূদের জন্য হাওর ঘিরে দেয়া হোত ইকরা বা নলখাগড়ার বেড়া দিয়ে। তাঁরা সাঁতার কাটতেন মাছও ধরতেন। বৌ হলে কি হয়, পোলাপান তো।

    বাড়ীতে একটি বংশাবলী ছিলো। হয়তো সবটা সত্য নয়, হয়তো অতিশয়োক্তি আছে আবার কিছু ইতিহাসের উপাদান এসব বইএ থাকেও। যতো দূর মনে পড়ে দত্তকুলপ্রদীপ অনন্ত দত্ত মহাশয় গৌড় অধিপতি লক্ষন সেনের সঙ্গে মতবিরোধের কারণে বৃদ্ধ পিতা অনঙ্গ, অন্য পরিজন এবং কামার কুমার ইত্যাদি বারো জাতি সঙ্গে নিয়ে গৌড় থেকে নৌপথে এসে অষ্টগ্রামে জমিদারী নেন। নবাবকে যুদ্ধের সময় বাইশটি নৌবহর দিয়ে সাহায্য করার শর্তে। তাই দত্তরায়রা বাইশ কোষার জমিদার। কার্জনের সুর্যাস্ত আইনে বোধহয় এই জমিদারি নিলাম হয়ে যায়। তথ্যের সত্য মিথ্যা প্রমাণ আমার অসাধ্য। দরকারই বা কি।

    জল জঙ্গল মাটি ,ফল ফুল প্রাণীর সমবেত অবস্থানে একটি ভূমিখণ্ড একজনের কাছে দেশ হয়ে ওঠে। দেশ কি শুধুই আবাস? পড়েছিলাম মরিশাস থেকে এক রাষ্ট্রপ্রধান ভারতের এক গণ্ডগ্রামে দেশ খুঁজতে এসেছিলেন। বহুকাল আগে তাঁর পূর্ব পুরুষকে কোন্ ব্যাবসায়ী চালান করে দিয়েছিলো আখের খেতের শ্রমিক হিসেবে - কতো যুগ পরে উত্তপুরুষ এসেছিলেন একবার শুধু পূর্বজদের জন্মভূমির ধুলো স্পর্শ করবেন বলে। বাবা গ্রামের চাষী গৃহস্থ, বাউল ফকির অন্ধ ভিখারী নিজের আত্মীয় বন্ধুর গল্প করতেন। টুকরো টুকরো আলাপচারী, ক্রমানুসারী নয় সবসময়। সেই আলাপচারীতে পদ্মবিল, আকাশের রামধনু আর খুব শখ করে নিজের প্রথম উপার্জনের নির্মাণ কাঠের দোতলা বাংলোটি আমদের মনে ছবি হয়ে ফুটে উঠতো। সেই আমাদের বালিকা পিসিরা যারা হাসি গানে সূচিশিল্পে আলপনা এঁকে যেকোন অনুষ্ঠানকে উঁচু তারে বেঁধে দিতেন, জীবনের ভবিষ্যৎ যন্ত্রণা তাঁদের সব নিপুণতাকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলো। সুন্দরী গুণবতী বোনেরা কেউ সুখী ছিলেন না। বাবার চির উচ্ছল প্রাণে তাঁরা দুঃখের দ্বীপের মতো ভেসেছিলেন। বিশেষত অকালমৃত পিঠোপিঠি বোন মায়া। তাঁর দেখা শোনা ফরমাশ খাটার জন্য চা বাগানের শ্রমিক বস্তি থেকে এসেছিলো ছমরী বুড়ি। মহেন্দ্র কিশোর, শচীন্দ্র কিশোর ও যতীন্দ্র কিশোর দত্ত রায় ঊনিশ শতকে চা বাগিচা ব্যবসায়ে বাঙালী পথিকৃতদের অন্যতম ছিলেন। সেই চা বাগানের সূত্র ধরে অষ্টগ্রাম দত্ত রায়দের অন্তঃপুরে ছমরী বুড়ির আগমন। ছমরী বুড়ির কি নাম ছিলো জানিনা। বিহারের মধুবনী জেলার কোন্ গ্রামের নিরক্ষর দরিদ্র দম্পতি গয়ার বিষ্ণুপাদপদ্মে একমাত্র কিশোর পুত্রের পিণ্ডদান সম্পন্ন করে ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত, শোকাতুর বসেছিল কোন্ কুয়োতলায়। সরল নিরক্ষর গ্রামীন দম্পতি পড়ে যায় আড়কাঠির খপ্পরে। চালান হয়ে যায় দুজন দু'জায়গায়। স্বামীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ছমরীকে ক্রীতদাসী হিসেবে চালান করা হয় দক্ষিন আফ্রিকার নাটালের হীরার খনিতে। দুচার বার হাতবদল হয়ে আসে আসামের চা বাগানে কুলি হিসেবে - সেখান থেকে সে আসে শিশুদের আয়া হিসেবে বাগান মালিকের অন্তঃপুরে। ছমরী বুড়ি যথার্থই ছিলো সর্বহারা। গৃহ পুত্র পরিজন এমনকি নিজের নামটি ও হারিয়ে গেছিলো। সেযুগে জাতপাত কণ্টকিত সমাজের অন্তঃপুরে তাঁর ঠাঁই পাওয়া সহজ ছিলো না। আবার বিধর্মী সংসর্গের প্রমাণ ছিলো তার ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজী বুলিতে। পিসিদের বলতো ফেরেশ্ ফুরুট খাও, চিয়ারফুল হইবে। আমার সুদর্শন মেজ্কাকু শৈশবে তার কোলে চড়ে দুর্দান্তপনা করতেন। বুড়ি বলতো কিলিন্ শু না পহিন্লে ইভিনিং ওয়াক্ হবো না। বৃদ্ধ বয়সে মেজ্কাকু ছমরী বুড়ির কথা হেসে হেসে বলতেন - চোখে জল এসে যেতো। বাড়ীতে দোর্দণ্ড প্রতাপ বিধবা বর্ষীয়সীরা তাকে সমবেদনায় সংসারের একজন করে নিয়েছিলেন। স্থানীয় সমাজ ব্যবস্থায় এই উদার অনুমোদনটুকু না থাকলে তাঁরা হয়তো ঐটুকু পারতেন না। বৃদ্ধার মৃত্যুর পর বাড়ীর ছেলেরা তাঁর শবানুগমন করেন।

    সেকালের গৃহিণীদের কথাও মনে পড়ে। দিন কেটে যেতো এতো বড় পরিবারের ঘরকন্নার কাজে। জলখাবার, "পাকঘর" সামলানো, ব্রত পার্বণের আয়োজনে। দুপুরে দিবানিদ্রা কি কড়ি খেলা, লেস বা উলবোনা, এমব্রয়ডারি করে। রাতে নাকি ঠাকুমা আর তার শাশুড়ি এক লন্ঠনের আলোয় বই পড়তেন। প্রপিতামহী কুঞ্জশ্রী দত্ত রায় অসুখে বিসুখে প্রজাদের চিকিত্সা করতেন। গাছ গাছড়া থেকে প্রাপ্তব্য সহজলভ্য ওষুধ। অনুপান দিতেন দুধ ঘি মধুর মতো কিছু। কেন? নইলে লোকে তুচ্ছ বলে অবহেলা করবে যে। লোকচরিত্র খুব বুঝতেন - নদীপথে ডাকাতের ঘাটেই রাতে নৌকো বাঁধতে বলতেন, ডাকাতি এড়ানোর জন্য। জমিদারদের পোষা ডাকাত দলও থাকতো, বাধ্য অনুগত - এখনও এমন শাসন ক্ষমতা বজায় রাখতে ক্রিমিন্যাল পাওয়ার সাহায্য করে।
    বাবার দূরসম্পর্কিত ধনদি - নাম শুনেছি অমলা, শিশুভবনে রবীন্দ্রনাথের জীবিতকালে কি কাজে যুক্ত ছিলেন। বাবার জন্ম সময়ে জোকার অর্থাত্ উলুধ্বণি শুনে ছুটে দেখতে এসেছিলেন, এসব গল্প করতেন। তাঁর কাছেই মনে হয় শুনেছিলাম এক অভিশাপের কাহিনী; বাবা এসব গল্প ছোটোদের শোনাতেন না। সে আরো দুতিন পুরুষ আগের কথা, সত্যি না হতে পারে, হতেও পারে। অন্দরের পুকুরে স্নান করতো বাড়ীর মেয়ে বৌ-রা। এক লম্পট বামুন ঝোপালো বরুণ গাছের আড়াল থেকে নজর করছিল। ধরা পড়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পায়নি অভিযুক্ত, শূলে চড়ানো হয়েছিলো। তিনদিন রোদে বৃষ্টিতে শূলবিদ্ধ ব্রাহ্মণ প্রতি মুহূর্তে অভিশাপ দিয়েছিলো এই বংশ ভিটে ছাড়া হবে। পিসি ফোকলা মুখে ফোঁপাতেন, ভগবান বদমাশ হইলেও বাউন ভালবাসে। ফলছে তো অভিশাপ। ভূতের গল্প, চোরের গল্প, মারপিটের গল্প ও গ্রামের বাতাসে ভেসে বেড়াতো। বাবা তাঁর স্বর্গপুরীর আখ্যান থেকে সেসব বাদ দিতেন।
    বাবার গল্প শেষ হোত এক সহজ কবিতায়। "আমাদের ছোট গ্রামে ছোট ছোট ঘর/ থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর।/ পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই..."
    হায়রে, এক প্রজন্ম পেরিয়েই আমরা ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই।

    অষ্টগ্রাম তার উদার দিগন্ত বিস্তারী প্রকৃতি ধানক্ষেত কাশবন আর হাওরের অকৃপণ ভালোবাসা দিয়ে ওখানকার মানুষদের মনগুলিকেও যেন সজীব, গতিবান আর সহৃদয় করে গড়ে দিয়েছিলো। যুগটি আজ থেকে অনেক আগের। জলবেষ্টিত দ্বীপের মতো এই গ্রামটিতে নিজের মতো একটা উদার সমন্বয়ী মানবিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিলো। অষ্টগ্রাম হয়ত কিছুটা বিচ্ছিন্নতার জন্যই স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পেরেছিলো। আলিমুদ্দি মিয়া, বাদল সরেন, নাগা পাহাড় থেকে পথ ভুলে চলে আসা ফেরিম পাগলা সবাইকে পরিবারে জায়গা দিতে কুঞ্জশ্রী ঠাকরুন বাধা পাননি। সম্প্রীতির অভাবের কথা আমার আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে কখনো শুনিনি। ব্রাহ্মপ্রভাবিত ময়মনসিংহে ঊনিশ শতাব্দীর রেনেসাঁর সময় থেকেই ব্রাহ্ম সমাজের মন্দির সভাগৃহ ছিলো বলে শুনেছি। পিতৃকুলে কেউ কেউ ব্রাহ্ম ছিলেন; প্রপিতামহ কৃষ্ণকিশোর দত্ত রায় নিরাকার ব্রহ্মের উপাসক ছিলেন না, কুলদেবতা বাসুদেব পূজিত হতেন। দোলের আমন্ত্রণ হিন্দু মুসলমানের সমবেত আনন্দের পঙক্তি ভোজনের সমারোহে খ্যাত ছিলো। বৈষ্ণব পরিবার, দুর্গা পূজা করতেন না কিন্তু বিজয়া এবং আগমনী গানের আসর হোত। মনসা পূজায় মুসলিম পরিবার থেকে কলা, দুধ, শশা, আখের এতো যোগান আসতো যে বিরাট উঠোনে জায়গা হোত না। কিন্তু আচার বিচারের ছুতমার্গ, জাতিভেদ একেবারেই অনুপস্থিত ছিলো। বাবার কাছে মহরমের সুদৃশ্য তাজিয়া আর মিছিলের গল্প শুনতাম। বাবার বন্ধু স্থানীয় তসীর আলী, কাকু বলে ডাকতাম, পড়তে দিয়েছিলেন মীর মোশারফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধু। হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষার পর বিষাদ সিন্ধুর কাহিনী কল্পনা করে কতো দুপুর কেটে গেছে। ঈদের দাওয়াতের যে রেওয়াজ গ্রামে ছিলো বাবা যখন দরং জেলার চারদুয়ারে থাকতেন তখনো দেখেছি ময়মনসিংহের প্রক্তন অধিবাসী আসামের মুসলিমরা সেটা বজায় রাখতেন। তাঁদের বাড়ী থেকে চমত্কার বড় বড় চালের পাতলা রুটি, সেমুই আর মন্ডা আসতো ঝুড়ি ভরা। একজন বড় পীর আসতেন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় প্রতিবছরই কিশোগঞ্জ থেকে।বাবাকেও খবর পাঠাতেন। এক দেশের মানুষ তো। তসীর আলী আদতে ছিলেন সিলেটের। মহাপ্রভুর পৈতৃক গ্রাম ঢাকাদক্ষিণ ছিলো তাঁর বাড়ী। বলতেন, 'বুঝলায়নি গো মাইয়নি' - মানে, বুঝলে মা, সারা পৌষমাস মহাপ্রভুর মন্দিরে মেথির জাউ মানে মেথির খিচুড়ি প্রসাদ হোত, সে প্রসাদ খেলে -'কু'নু হুরুতার সর্দি অইতো না' - মানে কোন বাচ্চার সর্দি হোত না। হিন্দু মুসলমান সব শিশুদের নাস্তা হোত মহাপ্রভুর বাল্যভোগের খিচুড়িতে। এসব গল্প শুনে বিশ্বাসই হয়না যে হিন্দু মুসলমান সাধরণ মানুষ ঝগড়া করে দেশটা ভাগ করেছে।

    দেশ টুকরো হয়ে গেছে স্বার্থের রাজনীতিতে। বাবা আর কাকু তসীর আলী সমস্বরে আক্ষেপ করতেন --"চুরা হগল"। মানে সবকটা চোর।
    সেই ক্ষোভ বোধহয় সেদিনের আপামর জনতার। বিশ্বাসঘাতক রাজনীতি।

    সে যাক্। দেশভাগ একটা বাস্তবতা। দুঃখের কথা কিন্তু ভালোবাসার কি অতীত হয়?
    আমাদের ছোট বেলায় কি আর এমন পড়ার চাপ ছিলো? প্রজেক্ট ছিলো না, হোম ওয়ার্ক আর এমনকি থাকতো। টিভি নেই সিরিযেল নেই সে সব কবেকার সন্ধ্যাবেলা। পায়ে হেঁটে গাব্রু, বেলসিরি কি জিয়াভরলির পাড়ে বুনো সূর্য্যমুখীর উজ্জ্বল কেয়ারী ঘেরা পথে তিন ভাইবোনে বেড়ানো, ফিরে এসে ভালো মন্দ জলখাবার খাওয়া। উনুনের পাশে মোড়া পেতে বাবা, আমরা তিনজন ভাই বোন খাওয়ার টেবিলে ঢুলছি। হেঁটেছি তো অনেক। মা কড়াই বসাচ্ছেন। যোগেনদা মুরগির ঠ্যাং চপার দিয়ে কেটে পেঁয়াজ আদার রসে ভেজাচ্ছে, পীরদিদি মুড়ির গুঁড়ো তৈরী রেখেছে, আজকে কাটলেট হবে। কায়রু বুড়ার কাজ সকালে। গরু চড়ানো। আজকে সন্ধ্যায় হাজির। পীরদিদি ডেকে এনেছে। কাটলেট হবে, খাবে না বুড়ো?
    তসীর আলীকে বাবা সমাদরে ডেকেছেন চা খেতে। ভুটিয়া কুকুর জ্যাক ধৈর্য ধরে অপেক্ষায়, যদি যোগেনদা কৃপা করে কিছু দেয়। বাবার মন চলে গেলো কিশোরগঞ্জে। ছিপনৌকো, নৌকা বাইচ, ভাটিয়ালী গানের পাথারে ভেসে বেড়ানো সুর। সারী গান, জারি গান। এতো দিন আগে শুনেছি কি করে মনে আছে জানিনা, গাজীর পট আর গাজীর গানের কথা, গাছের উপকারিতা, সমাজ রীতি।
    গাজীর গানে কলাগাছের মাহাত্ম্য বর্ণনা - আইনজল খাই বুগইল খাই, পাকনা কলা ছুলিয় খাই, খুল বিনা হয়না রে ভাই হিন্দুর ছরাধ। মুসলমান গাজীর গানে সিঁদুরের বর্ণনা এই রকম - দেবলোকে পরে সিন্দুর পায়ে দিয়া ছটা/ নরলোকে পরে সিন্দুর কপালে দিয়া ফোটা। এইসব গল্প শুনতে শুনতে আমাদের ঘুম কেটে যায় শীত কনকনে গরম কাটলেট। মজা ই মজা। পোস্টকার্ড কেটে তালপাতার সেপাই বানিয়ে ছায়াবাজী খেলা।
    কোনদিন সকালে বেড়াতে বেড়াতে শুনতাম শীতের ভোরে গ্রামের মেয়েদের মাঘমন্ডল ব্রত কি ঠুনকি মানকি নামের অচেনা দেবতার ব্রত যা শুধু অষ্টগ্রামের নিজস্ব। আৎকা পীরের পুজো, এই আকষ্মিক বিপদ আপদ থেকে অষ্টগ্রাম এর হিন্দু মুসলমানকে তিনি ই বাঁচান। তাঁর নাম কে আর জানে? বাবার বাড়ীর লোক ছাড়া?
    তা বলে রোজ কি আর কাটলেট হয়? আজকে মা বেসন দিয়ে কাঁকরোল ভাজছেন, গরম তেলে গোল করে কাটা বেসন মাখা ভাজা গুলো দেখাচ্ছে যেন ছোট ছোট সূর্য্যের মতো। ভাই বলে আজকে আমরা সূর্য্য ভাজা খাবো। অমনি বাবার মনে পড়ে ওঁরা শৈশবে খেতেন চোখ নখ ভাজা - মানে? মিষ্টি কুমড়োর খোসা কুচিয়ে কেটে ভেজে ওই সঙ্গে কুমড়োর বীচি ভাজা মিশিয়ে নিলে একটা হয় চোখের মতো একটা দেখায় নখের মতো ব্যস হোল চোখ নখ ভাজা। মা কুমিল্লার মেয়ে কোনদিন ময়মনসিং যাননি বলেন, কি নামের ছিরি। বাবা মাকে একটু খ্যাপান অবিভক্ত ভারতের ত্রিপুরা জেলার শুঁটকি মাছ প্রীতি নিয়ে। আচ্ছা, অষ্টগ্রামে কি শুঁটকি চলেনা? বাবাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি। তার পর সেওয়াই সন্দেশ, রকমারী নিরামিষ রান্না আর জলের দেশ মাছের কথা তো বলে শেষই হোত না, তবে আমার মনে হচ্ছে বরিশালের মানুষেরা যেমন ইলিশ মাছের গল্প করেন বাবা ইলিশ মাছ খেতে ভালবাসলেও অষ্টগ্রামে ইলিশ মাছ ধরা টরার গল্প শুনিনি, অষ্টগ্রামের হাওর বা নদীতে কি ইলিশ ধরা পড়ে না? অষ্টগ্রাম নিয়ে এই সব কতো স্মৃতি বাবার মনের মঞ্জুষাটি পূর্ণ করে রেখেছিলো। অষ্টগ্রাম নিয়ে কথা আমাকে আমার বাবার সান্নিধ্যে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। দুঃখে নয়, ভালো লাগায়।

    দিগন্ত বিস্তৃত স্রোতবান হাওরের কোলে এই বিশাল গ্রামটিতে জন্মেছিলেন বলেই বোধহয় আমার বাবা চিরকাল হেথা নয় হেথা নয় অন্যকোথা অন্যকোনখানে জীবনের নৌকো বেয়ে বেড়ালেন। আমাকে দিয়ে গেলেন সেই সুদূর পিয়াসার উত্তরাধিকার। মনে পড়ে ছোটবেলায় খাওয়ার টেবিলে বসে ঢুলছি রাতের বেলা, বাবা বলছেন - বাবারে খাও পেট ভইরা, তাড়াতাড়ি বড় হও। আমরা হিমালয় যাইমু। সান্দাকফু গিয়া পয়লা ক্যাম্প ... তেনজিং পারছইন আমরা পারতাম না?

    গল্পে শোনা অষ্টগ্রাম স্বপ্নে তার হাওর আর সবুজ আম জাম হিজল গাছের সুগন্ধী হিল্লোল পাঠায় পরিযায়ী আমাদের মগ্নচেতনায়। বাবা যেন এখনো ডাকেন হিমালয়ে এজন্মে নাই বা গেলাম একবার নৌকো ভাসিয়ে দিয়ে পৌঁছে যাই পদ্মলতায় ছাওয়া অথৈ হাওরে।

    বাবার শেষের দিনে বাবা বলেছিলেন, একবার যদি অষ্টগ্রাম বাড়ীতে গিয়ে দেখে আসতে পারতাম। হাওর ঘেরা অষ্টগ্রামের ছবি দেখে আমারও মনে হোল একবার। যদি বাবার বাড়ী যেতে পারতাম। নাইবা গেলাম বরফ চূড়োয়, হিমালয়।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২০ আগস্ট ২০১৭ | ২২৪১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • খাতাঞ্চি | 132.172.17.187 (*) | ২১ আগস্ট ২০১৭ ০৩:৪০60647
  • #
  • রোবু | 213.132.214.87 (*) | ২১ আগস্ট ২০১৭ ০৫:২৬60648
  • মায়াময়।
  • San | 37.60.40.152 (*) | ২১ আগস্ট ২০১৭ ০৫:৩৬60649
  • বড় ভালো লাগল -
  • শঙ্খ | 126.206.220.180 (*) | ২১ আগস্ট ২০১৭ ০৬:২৬60650
  • আহাহা... মনে ভরে গেলো
  • i | 147.157.8.253 (*) | ২১ আগস্ট ২০১৭ ১০:৪২60651
  • আপনার সকল লেখা ছায়া দেয়।

    বাবার বাড়ি নিয়ে একটি বিস্তারিত বড় লেখার অনুরোধ রইল।

    ছোটাই।
  • aranya | 172.118.16.5 (*) | ২১ আগস্ট ২০১৭ ১১:২১60652
  • অপূর্ব।
    শক্তি-র বিভিন্ন লেখা একত্র করে একটা চটি করলে হয়
  • arindam | 113.87.143.51 (*) | ২২ আগস্ট ২০১৭ ০২:০০60653
  • বহুদিন আগে একটা বই পড়েছিলাম 'জন্মের মাটি' শান্তা সেন। এই লেখা পড়তে পড়তে মনে এল। সত্যি অপূর্ব লেখা।
  • Du | 182.58.105.214 (*) | ২৪ আগস্ট ২০১৭ ০৮:৫৪60654
  • কি যে ভালো লাগলো কি বলবো একা একা হেসে কেঁদে অস্থির হলাম।এই হাওরের গল্প আমিও শুনেছি ছোটবেলায় আমার মায়েরা যখন সিলেট মৌলবীবাজারে তাঁদের দাদুর বাড়ি যেতেন।
    এতো গল্প আবার পড়বো।
  • hu | 83.58.28.165 (*) | ২৬ আগস্ট ২০১৭ ০২:৫৫60655
  • কি অপূর্ব লেখাটা!
  • কান্তি | 113.57.237.238 (*) | ২৬ আগস্ট ২০১৭ ০৩:১০60656
  • কি অনায়াসে যে এমন মায়াভরা লেখা লেখো। আমার ছেলে বেলার গল্প অন্যধারার।এখন ছুঁইয়ে যায় কিন্তু ধরা দেয়না। কিন্তু তোমার এই অনায়াস লেখা কি কোরে যেন কখন আমাকে ডেকে নেয়। আরো লেখো।
  • জারিফা | 127.194.195.215 (*) | ২৭ আগস্ট ২০১৭ ০৩:১১60657
  • অপূর্ব !
    যদিও আমার বন্ধুদের বাবা-ঠাকুরদাদের অধিকাংশই ওপার বাংলা থেকে আসা,তবুও এত গুছিয়ে সুন্দর করে কেউ কখনো স্মৃতিযাপন করেনি। বারে বারে পড়ার মত এ লেখা।
  • বিপ্লব রহমান | 342312.108.674523.222 (*) | ৩০ জুন ২০১৮ ০৬:৫৪60659
  • দেশ বিভাগের এই গোপন শেল পরানের গহিনে বিঁধে থাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।...

    এনালগ থেকে ডিজাটাল যুগে উত্তোরণের কালে ১৯৯৯ দালের দিকে যখন ঢাকা-কলকাতা পরীক্ষামূলক সরাসরি বাস সার্ভিস চালু হয়, এর প্রথম ট্রিপে সাংবাদিক টিমে আমিও ছিলাম।

    এপারে যশোর বেনাপোল সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা চিত্রিত শ্যামলী পরিবহনের এসি বাস যখন ধীর গতিতে ওপারে (সেখানেও যশোর রোড, যশোর জেলা, কি আয়রনি!) পেট্রাপোল পৌছায়, তখন বিস্ময়ে পুরো বাস যাত্রীরা হতবাক হয়ে পড়েন। শত শত গ্রামের মানুষ সব কাজ ফেলে পথ আটকে বসে আছেন বাসটিকে এক নজর দেখবেন বলে।

    সব বয়সী নারী-পুরুষ, ছেলেমেয়ে একেবারে হুলুস্থুল ব্যাপার। বাড়ির বউরা শাঁখ বাজাচ্ছেন, উলু ধ্বণী দিচ্ছেন, ঢাক বাজছে, স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা বাসটিকে গাদা ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন, অসংখ্য মানুষ ঘিরে ধরেছেন বাসটিকে, আরো দূরের যারা, তারাও কাছে আসার জন্য ঠেলাঠেলি করছেন!

    তখনই টিম লিডারকে বলে আমি বাস থেকে লাফিয়ে নামি, অলিম্পাস অটো এসেলার ক্যামেরায় এই সব টুকরো দৃশ্যের ছবি তুলতে থাকি। এখনো মনে আছে খালি পা, সাদা মলিন থান পরা এক বৃদ্ধা বাসটিকে ছুঁয়ে ঘোলাটে চোখে অঝোরে কাঁদছিলেন, আমি জানতে চেয়েছিলাম, ঠাকুমা কাঁদছেন কেন? ভীড় হট্টগোল ছাপিয়ে বুড়ির জাবাব শুনতে পাইনি। পরে বুড়ির মুখের কাছে কান পেতে শুনি, তিনি একটি কথাই বার বার বলছেন, বাংলাদ্যাশের বাস! আমাগো বাংলাদ্যাশের বাস!

    আর তখনই এক নিমিষে বুঝে যাই, এই বিশাল জনস্রোত আসলে দেশ বিভাগের শিকার এক জনগোষ্ঠী, যারা এখনো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ধারণ করেন ফেলে আসা দেশের মাটি!

    শক্তি দত্তরায়ের এই লেখাটি অনেকদিন মনে থাকবে! তার একটি লেখাগুলো গুরুর চটি সিরিজ থেকে প্রকাশের প্রস্তাবে জোর সমর্থন!

    অনেক শুভ কামনা!
  • বিপ্লব রহমান | 342312.108.674523.222 (*) | ৩০ জুন ২০১৮ ০৬:৫৪60658
  • দেশ বিভাগের এই গোপন শেল পরানের গহিনে বিঁধে থাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।...

    এনালগ থেকে ডিজাটাল যুগে উত্তোরণের কালে ১৯৯৯ দালের দিকে যখন ঢাকা-কলকাতা পরীক্ষামূলক সরাসরি বাস সার্ভিস চালু হয়, এর প্রথম ট্রিপে সাংবাদিক টিমে আমিও ছিলাম।

    এপারে যশোর বেনাপোল সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা চিত্রিত শ্যামলী পরিবহনের এসি বাস যখন ধীর গতিতে ওপারে (সেখানেও যশোর রোড, যশোর জেলা, কি আয়রনি!) পেট্রাপোল পৌছায়, তখন বিস্ময়ে পুরো বাস যাত্রীরা হতবাক হয়ে পড়েন। শত শত গ্রামের মানুষ সব কাজ ফেলে পথ আটকে বসে আছেন বাসটিকে এক নজর দেখবেন বলে।

    সব বয়সী নারী-পুরুষ, ছেলেমেয়ে একেবারে হুলুস্থুল ব্যাপার। বাড়ির বউরা শাঁখ বাজাচ্ছেন, উলু ধ্বণী দিচ্ছেন, ঢাক বাজছে, স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা বাসটিকে গাদা ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন, অসংখ্য মানুষ ঘিরে ধরেছেন বাসটিকে, আরো দূরের যারা, তারাও কাছে আসার জন্য ঠেলাঠেলি করছেন!

    তখনই টিম লিডারকে বলে আমি বাস থেকে লাফিয়ে নামি, অলিম্পাস অটো এসেলার ক্যামেরায় এই সব টুকরো দৃশ্যের ছবি তুলতে থাকি। এখনো মনে আছে খালি পা, সাদা মলিন থান পরা এক বৃদ্ধা বাসটিকে ছুঁয়ে ঘোলাটে চোখে অঝোরে কাঁদছিলেন, আমি জানতে চেয়েছিলাম, ঠাকুমা কাঁদছেন কেন? ভীড় হট্টগোল ছাপিয়ে বুড়ির জাবাব শুনতে পাইনি। পরে বুড়ির মুখের কাছে কান পেতে শুনি, তিনি একটি কথাই বার বার বলছেন, বাংলাদ্যাশের বাস! আমাগো বাংলাদ্যাশের বাস!

    আর তখনই এক নিমিষে বুঝে যাই, এই বিশাল জনস্রোত আসলে দেশ বিভাগের শিকার এক জনগোষ্ঠী, যারা এখনো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ধারণ করেন ফেলে আসা দেশের মাটি!

    শক্তি দত্তরায়ের এই লেখাটি অনেকদিন মনে থাকবে! তার একটি লেখাগুলো গুরুর চটি সিরিজ থেকে প্রকাশের প্রস্তাবে জোর সমর্থন!

    অনেক শুভ কামনা!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত প্রতিক্রিয়া দিন