এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • বাৎসরিক লটারী

    Ritam Ghosal লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৩ এপ্রিল ২০১৭ | ১৭১০ বার পঠিত
  • মূল গল্প – শার্লি জ্যাকসন
    ভাবানুবাদ- ঋতম ঘোষাল

    "Absurdity is what I like most in life, and there's humor in struggling in ignorance. If you saw a man repeatedly running into a wall until he was a bloody pulp, after a while it would make you laugh because it becomes absurd."
    ----১----
    আমাদের উসুমপুর গ্রামে (মৌজা ভোজেরহাট, জেলা পশ্চিম ছাব্বিশ পরগণা) ২৭শে জুন তারিখটা আসে অন্যান্য বছরের মতই। কিছু কিছু গ্রামে এখন আর জুন মাসের শেষ শনিবারের প্রথাটা মানা হয় না, তবে এই ব্যাপারে আমরা, মানে উসুমপুর অধিবাসীবৃন্দ পরিচালিত পরিষদ বেশ গোঁড়া।বর্ষার সময় বলে মাঠঘাট স্যাঁতস্যাঁতে কাদামাখা, আলো নিভে এলে সবুজ মাঠে সাদা বকের উড়ে যাওয়া দেখতে দেখতে আস্তে আস্তে দু একটা করে লোক জমছিল ঠিক জামালের তেলেভাজার দোকান আর শশীদাদুর চায়ের দোকানের উল্টোদিকের ফাঁকা মাঠটায়।বছরের পর বছর এই মাঠেই হয়ে আসছে কিনা... এবং পাঠিকা/পাঠক নিশ্চয় খেয়াল করে থাকবেন প্রচলিত প্রথাকে আমরা মানে গ্রাম উসুমপুর , মৌজা ভোজেরহাট, জেলা পশ্চিম ছাব্বিশ পরগণা-র লোকেরা বেজায় পছন্দ করি।
    তা যা বলছিলাম, প্রথমেই এলো ইস্কুলের বাচ্চাগুলো।আগের হেডমাস্টারমশাই নিত্যবাবু আমাদের এই বাৎসরিক লটারির অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন,সেই তাঁর আমল থেকেই এই দিনটায় ফার্স্ট পিরিয়ডের পরে আর ক্লাস নেওয়া হয় না। প্রথা। সে যাক গে, আপনাকে যা বলছিলাম- ক্লাস সিক্সের দুলাল,সুলতান আর বেঁটে কাজল, সেভেনের অসিত(ন্যাপা) আর বড় চানু, এইটের তিনমূর্তি কার্তিক,সাইকেল জামাল আর শোভন পোদ্দার এলো সবার আগে।তার পিছনে বাকীরা। প্রাইমারী ইস্কুলের গেঁড়িগুলো জড়ো হয়েছিল মাঠের ধারে অর্জুন গাছটার তলায়। যথারীতি অর্জুন গাছের নিছু ডাল ধরে একচোট দুলে নিল সব কটা।বাঁদরগুলো তারপর পড়লো জড়ো হওয়া ইঁটের পাঁজা নিয়ে।অন্যের দিকে ইঁট ছোঁড়াছুড়ি খেলতে খেলতে প্রতিবারের মতোই ইঁটযুদ্ধের শেষটা হল চোখের জল আর মায়েদের কাছে নালিশে। চলুন, এতক্ষণ ধরে বকে বকে গলা শুকিয়ে গেল। শশীদাদুর দোকানে এক কাপ করে চা খেয়ে নিই।
    এবার দেখুন, আস্তে আস্তে পুরুষরা আসতে শুরু করেছে।নতুন লুঙ্গি, ধুতি, গামছা, জামা বা চ্যাংড়াদের চকরবকর টি শার্টে রঙিন হয়ে উঠেছে মাঠের প্যালেট।আপনি কাছে গেলে শুনতে পাবেন ভোট থেকে শুরু করে সারের দাম, মাজরা পোকা থেকে চিংড়ি চাষের হরেকরকম্বা আলাপ আলোচনায় আর মাঝে মাঝে আদিরসাত্মক মশকরায় মাঠ সরগরম হয়ে উঠছে আস্তে আস্তে। কি বললেন? আরেক কাপ? ঠিক আছে, হোক তবে। আরে, ঐ যে দেখুন মেয়ে বৌয়ের দল-ও এসে গেছে।নতুন শাড়ি পরেছে বেশিরভাগ ( কেউ কেউ গতবারেরটাই পরে এসেছে, এসব অবশ্য আমি নই, অমিয় ভালো নজর করতে পারে। পরে আলাপ করাবো’খন ), মুসলমান ঘরের মেয়েরা বোরখা ঢেকে এসেছে।ঐ দেখুন চ্যাংড়ার দল সাইকেল নিয়ে কেমন মেয়েদের দিকটাতেই বারবার চক্কর কাটছে। এসব চলবে,চলতেই থাকবে ...যতক্ষণ না সত্য জেঠু এসে হাজির হন। বছরের পর বছর এমনটাই দেখছি, বুঝলেন তো। এলেই তো আবার আমার ডাক পড়বে। নিন, উঠুন স্যার, শশীদাদুকে পয়সা দিন।
    ওই যে, সত্য জেঠূ এসে গেছেন। হাতে বরাবরের মতন কালো একটা বাক্স।জেঠুর গোল মুখ, ভাবলেশহীন চোখ, গালে দুদিনের না কামানো দাড়ি। লোকে বলে জেঠুর জীবনে শান্তি নেই। একে তো ছেলে পিলে নেই, তারওপর জেঠির-ও একটু মাথার গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে। শহরে নিয়ে গিয়ে কত ডাক্তার দেখানো হয়েছে, কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না শেষমেশ।সে আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগের কথা। আমার বাবা জেঠুর শাগরেদ ছিলেন। জেঠু যেখানে শিবু মণ্ডল সেখানে।নিজের ভাইয়ের মতো ভালবাসত বাবা জেঠুকে। বাবা মারা যাওয়ার পরে জেঠুর শাগরেদগিরি শুরু করলাম যখন আমি, তখনো গোঁফের রেখা ওঠেনি মশাই।পুজো, পার্বণ, পরব, মড়া পোড়ানো, শ্রাদ্ধ, বিয়ে বা এই বাৎসরিক লটারি- আমি ছাড়া জেঠু কোন কাজে হাত দেন না। হাজার হোক, গ্রামের মুরুব্বি বলে কথা। জেঠুর পিছন পিছন যিনি এসেছেন, উনি হলেন পোস্টমাস্টারবাবু সজনী পুরকাইত। সজনী বাবুর হাতে একখানা তেপায়া টুল। টুল আসতে দেখেই লোকজন এক পা এক পা করে পিছিয়ে বেশ ফুট দশেকের একটা হাফ সার্কেল করে দাঁড়ালো। সত্যজেঠু গলা ঝেড়ে মুখ খুললেন। “ভাইসব, এবারে একটু দেরী হয়ে গেল শুরু করতে। ” ঐ যে টুল আর বাক্স দেখছেন না, ওগুলোর কত বয়স হবে আন্দাজ করে বলুন তো? কি বললেন ৪০? হল না, ডাহা ফেল। ৫০? নাঃ। ৭০? ধুর মশাই, আপনি থামেন। আমাদের গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ হলেন ভূপেন নন্দী।আসছে মাঘে আটানব্বই হবে। উনিও জ্ঞান হওয়া ইস্তক ঐ কালো বাক্স আর টুল দেখে আসছেন।মাঝে একবার বদলানোর কথা হয়েছিল, বিশেষত কালো বাক্সের রং চটে যাওয়ার পরে, তবে হয়নি। বললাম না, আমরা উসুমপুরের লোকজন প্রথাকে বেজায় সম্মান করি।
    টুলের একটা পায়া একটু নড়বড় করে বটে, কিন্তু রাখাল ঘোষ আর জামাল রহমান আছে তো। বরাবর ওরা দুজন গিয়ে দুপাশ থেকে টুল টা শক্ত করে ধরে দাঁড়ায়।সত্য জেঠু হাতের একগাদা কাগজের টুকরো ভরা বাক্স ভাল করে ঝাঁকান।গ্রামের প্রতিটি পরিবার পিছু একটি করে কাগজ।।কাল রাত থেকে গ্রামের মাতব্বররা হিসেব করে কাগজ কেটেছেন।সারারাত সেই কাগজ ভর্তি বাক্স তালা বন্ধ হয়ে ছিল সত্যজেঠুর ধানভানার কলের দোতলার সিন্দুকে।বছরের এই এক দিন-ই অবশ্য। অন্যান্যদিন এই বাক্স কখনো সমিতির ঘরে, কখনো জামালের উঠোনের চালার নিচে, কখনো বা পোস্টমাস্টারবাবুর বাড়িতে পড়ে থাকে।
    এইবারে দেখবেন একটা লিস্টি বানানো হবে। উসুমপুর গ্রামের প্রত্যেকটা বাড়ি, প্রত্যেকটা পরিবার, প্রত্যেকটা বাড়ির কর্তাদের নাম লেখা থাকবে একটা লম্বা কাগজে।কাছে গেলে দেখবেন সজনীবাবুর মুক্তোর মতো হাতের লেখায় গোটা গোটা করে নাম লেখা।আগে শুনেছি একজন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে নামগুলো পড়তো, আর ভিড়ের মধ্যে ঘুরে ঘুরে যাচাই করে নেওয়া হতো সবাই হাজির আছে কিনা; কিন্তু এখন সত্য জেঠু একজায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকেন, উনি আর সজনী বাবু ভাগাভাগি করে কাগজের টুকরোগুলোকে আবার ঘেঁটে নেবেন।ওই দেখো, কে একটা মেয়েমানুষ যেন আবার ভিড় ঠেলে আগে যেতে চাইছে...ও হরি, এতো আমাদের ফটিক বিশ্বাসের বৌ শিউলি।
    শিউলির বাপ ছিল তারাপদ মন্ডল।বিখ্যাত কিপটে, বুঝলেন তো? শালা, মেয়ের বিয়েতে অবধি গাঁয়ের সবাইকে ডাকেনি। তবে ফটিকদা ছেলে ভাল।দুই ছেলে ওদের।শিউলি ফিসফিস করে দত্তকাকিমা কে বলল শুনতে পেলাম ‘আর বোলো না দিদি, ছোটটা এমন বাঁদর হয়েছে। সব জায়গায় যেতে দেরী করিয়ে দেয়...।’ দত্তকাকিমা খাঁউমাউ করে বলে উঠলেন ‘দেরী হয়নি বাছা। এখনো শুরুই হয়ে ওঠেনি।’ সেই শুনেই বোধহয় সজনীবাবু গলা টলা ঝেড়ে,কফ ফেলে বলতে শুরু করলেন ‘আচ্ছা, ইয়ে...তাহলে এবার আমরা আস্তে আস্তে শুরু করি। কি তাই তো দাদা?’ সত্যজেঠু নির্বাক চোখে মাথা নাড়লেন। হাতের বড় কাগজটা থেকে একে একে নাম পড়তে শুরু করবেন এবারে উনি- আর এক একটি করে কাগজের টুকরো তুলবেন সজনীবাবু।যে পরিবারের নাম পড়া হচ্ছে, তার কর্তা এগিয়ে এসে তুলে নেন কাগজ।এটাই প্রথা। এটাই চলে আসছে। চলবেও।
    পাশ থেকে কে এক ছোকরা বলে উঠলো ‘কি দরকার আর এইসব নিয়মকানুনের? অনেক তো হল। দিনকাল পালটে গেছে, এবার বোঝা দরকার।’ কে বলল দেখুন তো একটু ! চশমা পরা, বাঁয়ে টেরি কাটা কি? ও হল সুবীর গুছাইতের বড় ছেলে সুমন। কলকাতার কলেজে পড়তে যায়।শালা। দু পাতা পড়ে বড় হনুমান হয়ে উঠেছে আজকাল।ওই তো, ভূপেন নন্দী বলছেন- ‘তুমি এসবের কি বুঝবে হে ছোকরা? আমার বাপঠাকুদ্দার আমল থেকে দেখছি এটা। জানবে ‘আষাঢ়ে লটারি হলে পরে / সুখশান্তি আসে ঘরে’।তোমরা তো আর আজকাল দেশগাঁয়ের নিয়মকানুন মানো না। কবে দেখবো লটারি তুলেই দিয়েছো। যাক বাবা...আমি আর কে? আমার আর কি, এবারে দুগগা দুগগা বলে যাওয়ার দিকে পা বাড়িয়েছি।বলি ঠাকুর-দেবতা মানোটানো তো? নাকি সেসব-ও...? “
    ‘আচ্ছা, তাহলে এবার আমরা একএক করে নাম ধরে ডাকছি। পরিবারের কর্তারা এসে কাগজ নিয়ে যান। এই যে,বাগদীপাড়ার তোমরা... বুঝেছো তো ভাই ঠিকমতো। ‘
    ----২----
    ‘আদক-’ সত্যজেঠু হাঁকলেন।
    আদকবাড়ির বড় ছেলে সমু এসে কাগজ নিলো, মাথায় ঠেকালো, আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কি যেন বলে আবার ফিরে গেলোজটলার মধ্যে।
    ‘আঢ্য-’
    পঞ্চানন আঢ্যের ছেলে সুবল এসে কাগজ নিতে দাঁড়ালো।
    ‘কি ব্যাপার? তুমি কেন? বাবা কই?’ সজনীবাবু কাগজ হাতছাড়া করলেন না।
    ‘আসলে মাস্টারবাবু, বাবার গেঁটেবাতের ব্যাথাটা বড্ড বেড়েছে...কাল সন্ধে অবধি আসবে বলেই ঠিক ছিল, কিন্তু শেষরাতের দিকে ব্যাথাটা এমন বাড়লো যে...’
    ‘কি করবো দাদা?’
    ‘দিয়ে দাও।’
    ‘দত্ত-’
    ‘এই যে, দত্ত ডাকছে তো।’ দত্তমেসোকে ঝাঁকান মাসিমা।
    ‘অ্যাঁ! দত্ত? সেকী।’ কান থেকে খুলে পরা তার গুঁজতে গুঁজতে দত্তমেসো এগিয়ে যান। দুগগা দুগগা...অস্ফুটস্বরে বলে ওঠেন দত্তমাসিমা।একগাল হাসি নিয়ে ফিরে আসেন দত্তমেসো।ঠাকুর ... ।
    ‘মফিজুল হক-’
    বুড়ো মফিজুল হক এগিয়ে যান।ধীর পায়ে।মুখে একটুকরো সুপুরি পুরে বিবির দিকে তাকিয়ে অভয় দেন।
    ‘বিশ্বাস-’
    ফটিক বিশ্বাস এগিয়ে গেলো।শিউলিকে কাপড়ের খুঁট মুখে দিয়ে চিবোতে শুরু করবে করবে করছে, এমন সময় বুকফাটা আর্তনাদে ফেটে পড়ে ফটিক।
    ‘কপাল...কপাল আমার। ঠাকুর, বারবার কেন আমার সঙ্গেই? কেন? কেন? কেন?’ কাঁদতে কাঁদতে গোঙাতে গোঙাতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো ফটিক।হাত থেকে উড়ে গেল কাগজের টুকরো। কালো একটা দাগওয়ালা একটুকরো কাগজ।
    শিউলি ছুটে যেতে দত্তমাসিমা হাট বাড়িয়ে আটকালেন।এইসময়ে পরিবারের কর্তাকে বিরক্ত করতে নেই। প্রথা। বলছিলাম না, উসুমপুরের লোকজন প্রথাকে বড্ড...
    ‘এই যে আপনি। আপনি ওকে সময় দিলেন না পছন্দমতো কাগজ তোলার। আগে থেকে ঠিক করে রেখেছিলেন আপনি।ওকে ফাঁসালেন।’ গলা ফাটিয়ে সত্যজেঠুর দিকে তাকিয়ে চেঁচালো শিউলি। চেঁচাতে চেঁচাতে গলা ভেঙে যাবে এবার মেয়েটার। ‘আপনি এইভাবে আমার দাদুকেও ফাঁসিয়েছিলেন। কি ভেবেছেন আপনি? ভুলে গেছি আমরা?আমার ভালমানুষ স্বামীটাকে এইভাবে...’
    ‘আঃ। কি হচ্ছেটা কি? চুপ কর বলছি’ কান্না ভুলে ফটিক এবার ধমকে ওঠে।
    ‘শিউলি। এবার থাম মা। গাঁয়ের বড়দের ব্যবস্থা নিতে দে।ঠাকুর আছেন, সব তিনিই করছেন ’ দত্তমাসিমা পরিস্থিতি সামাল দিতে যান।
    ‘ফটিক উঠে এসো। বাড়িতে কজন আছো তোমরা? বৌমা আর দুই ছেলে। তাই তো?’ সজনীবাবুর গলা সবাইকে থামিয়ে দিলো।
    ‘মাস্টারবাবু, আমার দুই ননদ-ও রয়েছে।’
    ‘মা। শান্ত হও। বিবাহিত মেয়েরা স্বামীর গোত্রে পড়ে।ননদদের কথা আসছে কেন?’ সত্যজেঠুর উপস্থিতিতে সজনীবাবু কোনদিন এত বেশি কথা একটানা বলেন না।আজ বলছেন।
    ‘এটা ঠিক হচ্ছে না মাস্টারমশাই। ওকে সময় দেওয়া হয়নি অন্যদের মতো। আমি দেখেছি।’
    ‘তুই থামবি এবার। শালা মরেও শান্তি দেবে না এই মেয়েমানুষ।’ফটিক গর্জে ওঠে।
    এরপরের পুরো কাজটা সত্যজেঠুর তত্ত্বাবধানে হয়। সেরকমই হয়ে এসেছে এতকাল।
    ‘ফটিক মণ্ডল , এগিয়ে আয়। বাড়িতে চারজন সব মিলিয়ে। তাই তো?’
    ‘আজ্ঞে’।
    ‘ছেলে মেয়ে দুটোই?’
    ‘আজ্ঞে।’
    ‘বৌ পোয়াতি?’
    ‘না।’
    ‘চারজনে এগিয়ে আয়’।
    পায়ে পায়ে সত্যজেঠুর দিকে এগিয়ে যায় ফটিক, শিউলি আর ওদের দুই ছেলে নিতাই আর নিমাই।
    ‘সজনী, ওদের কাগজ দাও।’
    চারজনকে কাগজ দেওয়া হয়। আস্তে আস্তে গ্রামের লোকের ভিড়টা ছোট একটা গোল হয়ে এই চারজনকে ঘিরে ধরে।
    ‘আমি বললে কাগজটা খুলবি। বুঝেছিস? ফটিক ছেলেদের দেখ।’
    ‘নিমাই মণ্ডল-’
    সাত বছরের নিমাই কাগজের ভাঁজ খোলে।সাদা কাগজ। ফটিক কাগজ তুলে সবাইকে দেখায়। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে। গ্রামের লোকের সমবেত দীর্ঘশ্বাসকে উপেক্ষা করে সত্যজেঠু হাঁকতে থাকেন। ‘’নিতাই মণ্ডল-’
    নয় বছরের নিতাই ভাইয়ের মতোই কাগজ খোলে।কাগজ তুলে নিজেই সবাইকে দেখায়।সাদা। আবার দীর্ঘশ্বাস।
    ‘ফটিক মণ্ডল।’
    ফটিকের মুখ লাল,জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়ছে।কাগজ খুলতে গিয়ে হাত কেঁপে যায়। ডানহাতটা তুলে জনতাকে আশ্বস্ত করে সে। কাগজ দাগছোপহীন সাদা।
    ‘শিউলি মণ্ডল। তাহলে শিউলি মণ্ডল। তাই তো? ’
    শিউলির দিকে এগিয়ে গিয়ে জোর করে কাগজ কেড়ে নেয় ফটিক।কাগজটা একঝলক দেখে এগিয়ে দেয় সত্যজেঠুর দিকে। একঝলকেই বোঝা যায় সাদা কাগজে কালো একটা দাগ।

    ‘তাহলে এবছরের মতো শিউলি মণ্ডল। ভাইসব আগের বারের মতো তাড়াহুড়ো করবেন না কেউ। সবাই ধীরেসুস্থে পাথর তুলে নিন। আগেরবারের নিত্য বাউড়ির মতো বিশৃঙ্খলা যেন না হয়।অনেক সময় পাবেন। আস্তে আস্তে ইট পাথর তুলে নিন।’সজনী বাবু সবাইকে চেতাবনি দেন।
    ‘আমি বাপু পরের দিকে যাবো। তোমরা আগে সেরে নাও।’দুহাতে দুটো আধলা ইট তুলে নিলেন দত্তমাসিমা।
    ‘নিয়মকানুন সব ভুলেছো নাকি মাস্টার? নিমাইকে দাও সবার আগে। মনে রাখবে প্রথম আঘাতের অধিকার সর্বকনিষ্ঠের।’
    রাখাল ঘোষের শক্ত হাতে বাঁধা পড়া শিউলি চিৎকার করে যায় সত্যজেঠুর দিকে তাকিয়ে - ‘আপনি। আপনি ইচ্ছে করে এটা করলেন।’
    সত্যজেঠু কাগজে লিখছেন এক এক করে প্রতি বছরের লটারির ফল।
    শিউলি মণ্ডল, নিত্য বাউড়ি , হেমেন বিশ্বাস, বটতলার পাগলী,নিজামুল ফকির...
    সজনীবাবু সাতবছরের নিমাইয়ের হাতে একটা আধলা তুলে দেন। ‘ভালো করে থেঁতলে দাও দেখি বাপ। একদম মাথার মাঝখানে। পারবে তো? ’
    প্রথা। বলছিলাম না, উসুমপুরের লোকেরা প্রথাকে বড্ড মানে।
    ----------------------
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৩ এপ্রিল ২০১৭ | ১৭১০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • mahua | 120.227.83.105 (*) | ২৪ এপ্রিল ২০১৭ ০৯:১৭59463
  • ভয়ানক । আসলটার চেয়ে ও গা-ছমছমে হয়েছে।
  • শঙ্খ | 52.110.183.29 (*) | ২৪ এপ্রিল ২০১৭ ১২:২৬59464
  • বাবাগো
  • সিকি | 137.0.0.1 (*) | ২৫ এপ্রিল ২০১৭ ০৪:৪১59465
  • জিও।
  • dd | 137.0.0.1 (*) | ২৫ এপ্রিল ২০১৭ ০৫:০৭59466
  • খুব ভালো ভাবানুবাদ হয়েছে।
  • Pi | 57.29.213.1 (*) | ২৭ এপ্রিল ২০১৭ ০৩:৪১59467
  • সাম্ঘাতিক !
    আর ভাবানুবাদ খুবই ভাল হয়েছে , অনুবাদ অনুবাদ লেপ্টে থাকা গন্ধটা একেবারে নেই।
  • anag | 208.182.52.26 (*) | ২৮ এপ্রিল ২০১৭ ০৪:৪৬59468
  • মূল গল্পের নাম টা কেউ দিতে পারেন এখানে? ধন্যবাদ।

    ঋতম কে অনেক শাবাশ।
  • dc | 132.174.174.214 (*) | ২৮ এপ্রিল ২০১৭ ০৪:৫৫59469
  • The lottery

    অনুবাদ পড়তে ভালো লাগলো।
  • San | 113.245.14.101 (*) | ২৮ এপ্রিল ২০১৭ ০৯:১৮59470
  • ভাল লাগল।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে প্রতিক্রিয়া দিন