এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • অন্য হিরোসিমা, অন্য নাগাসাকি

    dd লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ৩০ জানুয়ারি ২০১৬ | ৬৯১ বার পঠিত
  • ১৯৪৫,ফেব্রুয়ারী মাস –

    যুদ্ধ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ফেব্রুয়ারী মাস।আর তিন মাস পরেই ইওরোপে যুদ্ধের পালা সাংগ হবে। যা কিছু উৎসাহ আর উদ্দীপনা, তা শুধু ঐ রাশানদের মধ্যেই। তারা লড়াই করে ছিনিয়ে নেবে বার্লিন। রক্তঋণ শোধ করবে। স্বজন হারানোর শ্মশানে শেষ লড়াইটা তাদেরই।

    তুলনায় মিত্রপক্ষের সেনাদের একটু ঢিলে ঢালা ভাব। তারা জানেন বার্লিন দখল তাদের লক্ষ্য নয়। ওটা রাশানরাই করবে। কিছু কিছু যায়গায় জার্মান সেনাদের মরনপণ লড়াই দেখে তারা খুবই অবাক। কী করতে এরা এখনো লড়ে যাচ্ছেন ?

    তবে হিটলার যেরকম আশা করেছিলেন আর নির্দেশও দিয়েছিলেন যে শহরে শহরে স্তালিনগ্রাদের মতন দুর্গ গড়ে উঠবে আর সাধারন নাগরিকেরাও লড়াই করবে - সে রকম হোলো কই? দু একটা শহরে - বিক্ষিপ্ত ভাবে কিছু অসামরিক প্রতিরোধ হয়েছিলো, ছোট্টো শহর ম্যাগডেকন , বা সেই বাঁশী বাদক খ্যাত হ্যামলিন - এরকম অল্প কয়েকটা শহরেই যা অসামরিক লোকেদের প্রতিরোধ হয়েছিলো। এ ছাড়া লড়াইটা ছিলো দুই দলের সেনানীদের মধ্যেই। পার্টীসান লড়াই জার্মানীতে ঘটে নি।

    জানুয়ারী মাসের শেষে ,এলবার্ট স্পীয়র তো বলেই দিলেন হিটলারকে যে বিদ্ধ্বস্ত জার্মানীতে আর যুদ্ধ রসদের একটানা যোগান সম্ভব নয় । "এ যুদ্ধ আমরা হেরে গেছি।" । আর পুর্ব জার্মানীতে ফ্রাংকফুর্টের কাছে ওডের নদীর কাছে পৌঁছে গেছেন রাশান সেনারা,৮ ফেবুয়ারী ওডের নদী পার হয়ে মার্শাল কোনেভের সেনারা ,বলতে গেলে, হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়েছে জার্মানীর ভিতরে। আর বার্লিনের মুখোমুখী, পোল্যান্ডের একের পর এক শহর দখল করে নিচ্ছে লাল ফৌজ।

    যুদ্ধের ফলাফল নিয়ে আর কোনো চিন্তা নেই। স্তালিন,রুজভেল্ট আর চার্চিল একসাথে ইয়ালটায় মিটিং করছেন - যুদ্ধের পরের ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে।জার্মানীকে কয় টুকরো করা হবে? ফ্রান্সকে যদিও এই বৈঠকে আমন্ত্রন করা হয় নি, তা হোক। জার্মানীর এক টুকরো ফ্রান্সকেও দেওয়া হবে সাব্যস্ত হয়েছে। এই সব নিয়েও নানান ড্রাফ্ট পরিকল্পনা করা হয়েছে। সেটা ১৩ই ফেব্রুয়ারী।

    জার্মানীর সর্ত্তহীন আত্মসমর্পনের আর মাত্র এগারো সপ্তাহ বাকী।

    সেদিন রাতের ড্রেসডেন
    ********************************
    এলবে নদীর ধারে ড্রেসডেনের বিশেষ চিন্তা নেই। জার্মানীর অন্যান্য শহরে বোমা পড়লেও এই সুন্দর শহরটি অক্ষত রয়েছে। সবাই জানে অক্সফোর্ডে যেমন নাৎসীরা বিমান হামলা চালায় নি, ড্রেসডেনকেও রেহাই দিয়েছে মিত্রপক্ষ। কী আছেই বা এই শহরে? অল্প কিছু কারখানা আছে যা জর্মানীর ট্যাংক ও বিমানে কিছু যন্ত্রাংশ যোগান দেয়।সামরিক দিক দিয়ে তেমন পাতে দেওয়ার মতন কিছু নয়। ছবির মতন সুন্দর এই শহরের নাম ডাক খুব তার বারোক ও রোকোকো স্থাপত্যের জন্য।আর আছে প্রচুর মিউজিয়াম, আর্ট গ্যালেরী। ড্রেসডেনকে কেউ বলত "জুয়েল বক্স" কেউ বলতো "জার্মানীর ফ্লোরেন্স "।

    গুজবও ছিলো যে যুদ্ধের পর এটাই হবে বিজয়ী মিত্র পক্ষের রাজধানী তাই মিত্রপক্ষও এটাকে ঘাঁটাতে চায় নি। সারা পুর্ব জার্মানী থেকে রিফিউজীরা দলে দলে আশ্রয় নিয়েছেন এই শহরে। তাছাড়া সারা জার্মানীতে এটাও তখন অন্যতম "হাঁসপাতাল নগরী" । বহু,বহু আহত মানুষেরা এখানে হাজির হয়েছেন চিকিৎসার জন্য।

    শত্রু বিমানের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা ,বলতে গেলে,কিছুই নেই। অনেক ঐতিহাসিকেরা বলেন ড্রেসডেনে এমন কি বিমান বিদ্ধ্বংসী কামানও মজুত ছিলো না, যদিও নতুন গবেষণায় দেখা যায় অল্প কিছু কামান ছিলো ড্রেসডেনে। যুদ্ধের শুরুতে ড্রেসডেনে, যা কিছু বিমান বিদ্ধ্বংসী কামান ছিলো, সেগুলোর প্রায় সব গুলো` অন্যান্য শহরে সড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো।তবে পেপার ম্যাশের তৈরী কিছু কামান সাজিয়ে রাখা হয়েছিলো শত্রুপক্ষকে ভয় দেখাতে ! অন্যান্য শহরে যেরকম স্টীল আর কংক্রীটের বাংকার ছিলো সেরকম ছিলো না ড্রেসডেনে একটিও।এক মাস আগেই একবার আর মাস ছয়েক আগে ,আর একবার ড্রেসডেনের রেইলওয়ে ইয়ার্ডে মিত্রপক্ষেরা বিমান হামলা চালিয়েছিলো, বোমাও পড়েছিলো - কিন্তু সে খুবই ছোটো মাপের রেইড ছিলো। শহরে কোনো বোমা পড়ে নি।

    ইংলন্ডের কনিঙ্গসবি শহরের RAFএয়ার বেসে বোমারু বিমানের বৈমানিকদের ব্রীফিং শুরু হলো। কিন্তু ড্রেসডেন কেনো? বৈমানিকেরা জানতে চান।একে তো ঐ শহরে হানা দেবার মতন কিছুই নেই তায় আবার সেটা ইংলন্ডের বোমারু বিমানের একেবারে রেঞ্জের শেষ সীমায়। কর্ত্তারা বোঝালেন, আরে,সোভিয়েত সেনাদের সাহায্যের জন্যই আমাদের যেতে হবে। কিন্তু সোভিয়েত সেনারা তো ড্রেসডেনের একেবার দোরগোড়াতেই ঘাঁটি গেঁড়ে বসে আছে -ড্রেসডেন থেকে মাত্র ৪৫ মাইল দুরেই পৌঁছে গেছে তারা - তাদেরও বোমারু বিমানের কোনো অভাব নেই। তবে? কিছু মিথ্যে কথা বলে জবাবদিহি করলেন কর্ত্তারা। পরে কিছু ডকুমেন্ট ঘেঁটে দেখা যায়,যে এটাও বলা হয়েছিলো যে কিছুদিন পরেই লাল ফৌজ যখন ড্রেসডেনে দখল নিতে ঢুকবে তখন তারা মিত্র পক্ষের বিদ্ধ্বংসী ক্ষমতা দেখে ঘাবড়ে যাবে - এটাও একটা কারন হিসেবে বোঝানো হয়েছিলো

    ঠিক হল রাত দশটা নাগাদ প্রথম ঝাঁকের বোমারু বিমান আক্রমন করবে। তার ঘন্টা তিনেক পর দ্বিতীয় ঝাঁকের বিমান। আর তার পরের দিন সকাল বেলা আমেরিকান বোমারু আর ফাইটার বিমান হামলা চালাবে।

    সন্ধ্যাবেলা, সাড়ে পাঁচটায় আটটা মসকুইটো বিমান উড়ান শুরু করলো ইংলন্ডের এয়ার বেস থেকে। তাদের কাজ হবে ড্রেসডেনে পৌঁছে "মার্কার" বোমা ফেলে পিছু পিছু আসা বোমারু বিমানদের জানান দেওয়া ঠিক কোথায় বোমা ফেলতে হবে। প্রথম ঝাঁকেই থাকবে প্রায় আড়াইশো ল্যাংকাস্টার ভারী বোমারু বিমান।

    শুরু হল বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ - অপারেশন থান্ডার ক্ল্যাপ।

    একেবারে শেষ মুহুর্ত্তে , রাত দশটায় সাইরেন বাজলেও, ড্রেসডেন শহরের লোকে বিশেষ ঘাবড়ায় নি। ও রকম ফলস অ্যালার্ম আরো হয়েছিলো কয়েকবার, তারা নিশ্চিন্তই ছিলেন।
    চিন্তা ছিলো ব্রিটীশ বিমান বাহিনীরও। দারুন সংঘবদ্ধ ভাবে পুরো ব্যাপারটা সারতে হবে। একেবারে কয়েক মিনিটের এদিক ওদিক হলেই পুরো মিশনটা বিফল হতে পারে।
    প্রথমেই পথপ্রদর্শক বিমানেরা এসে প্যারাচুটে করে ফ্লেয়ার ভাসিয়ে দেবে। আলোয় ভরে যাবে টার্গেট এরিয়া। তারপরে আটটি মসকুইটো বিমান, তারা হাজার পাউন্ডের "টারগেট ইন্ডিকেটর" বোমা ফেলবে মূল লক্ষ্যস্থান স্টেডিয়ামের উপর। বোমা বললে অবশ্য ভুল বলা হয়। কেনো না এই গুলির একমাত্র কাজ মাটীতে পড়ে উজ্জ্বল আলো'র তুবড়ী জ্বালিয়ে রাখা।

    মাস্টার বম্বার স্মিথ সাহেব আরেকটি মসকুইটো বিমানে আকাশে চক্কার কাটছেন। তিনি সেই লাল রঙের ইন্ডিকেটর বম্বের নির্দেশ দেখতে পেয়েই রেডিও মারফত খবর পাঠালেন বোমারু বিমানদের। ঠিক ঠাক ইন্ডিকেটর জ্বলছে - সেটাকেই নিশানা করে বোমা ফেলে এসো।আর এই পুরো ঘটনাই ঘটার জন্য সময় বরাদ্দ কুরি থেকে বাইশ মিনিট।
    বিমানের ঝাঁক থেকে বৃষ্টির মতন বোমা পড়তে লাগলো ড্রেসডেনে শহরে। মাস্টার বম্বার রেডিওতে জানালেন "দ্যাট ইজ গুড বম্বিং"।

    অগ্নি ঝঞ্ঝা
    ****************************
    ফায়ার স্টর্ম? এটা একেবারে আনকোরা নতুন ঘটনা। সঠিক ইন্ধন ও শুষ্ক আবহাওয়া থাকলেই সেটা সম্ভব। ব্যাপারটা হচ্ছে কোনো কোনো শহরে,কখনো দেখা গেছিলো যে একটানা বোমার আঘাতে অকেকগুলি আগুন জ্বলে ওঠে, তার পর দমকা হাওয়ায় সেই আগুন অনেকগুলি একসাথে হয়ে একটাই খুব বড় আগুন হয়ে ওঠে।দারুন ঝড়ের বেগে, হাওয়া টেনে নেয় সেই বিশাল দাবানল।ধারে কাছে মানুষজন থাকলে, সেই আগুনের পেটে ছিনিয়ে টেনে নেয় তাকে, এমনি সেই হাওয়ার জোর। আর হু হু করে কমিয়ে দেয় অক্সিজেনের মাত্রা। যতোক্ষন একটুও দাহ্য বস্তু ও থাকে এই আগুনের আওতায়, ততক্ষন এই ভয়ানক আগুন জ্বলতেই থাকে প্রচন্ড ঝোড়ো হাওয়ার সাথে।

    এর বছর দুয়েক আগে হামবুর্গ শহরে এরকম এক ফায়ার স্টর্মে প্রায় ৪৬ হাজার মানুষ মারা যায়।কাসেল আর ডামস্টার্ট শহরেও এই অদ্ভুত ব্যাপারটা ঘটে। কিন্তু ধরুন বার্লিন শহরে এর অনেকগুন বোমা ফেললেও কিন্তু এই ফায়ারস্টর্ম ঘটেনি, কেনো না,বার্লিন শহরের রাস্তাগুলি খুব চওড়া - বাড়ীগুলিও খুব ঘেঁষাঘেষি নয় - তাই বিচ্ছিন ভাবে আগুন জ্বললেও একটিই আগুনের দৈত্য কখনো হয় নি।

    হ্যাঁ, বোমা ফেলারও ব্যাকরণ আছে বৈ কি। ইঁট,পাথর,সিমেন্টের বাড়ীতে চট করে তো আগুন লাগে না। তার জন্য চাই প্রথম ধাক্কায় হাই এক্ষপ্লোসিভ "ব্লক বাস্টার" বোমা।দুই টন "কুকি" বম, বা সাড়ে তিন টন বা আরো ভারী ,প্রায় সাড়ে পাঁচ টন ওজনের এই অতিকায় বোমায় বড় বড় বাড়ীর ছাদ,দেওয়াল একেবারে গুঁড়িয়ে যাবে। আর তার সাথে ভেঙে যাবে জলের পাইপ। ছাদ উড়ে গেলে "এয়ার ফ্লো “ হবে অবারিত - আগুন ছড়িয়ে যাবে সহজেই।তখন বাড়ীর ভিতরের কাঠ,কাপড় এইসব দাহ্য বস্তুর উপরে ফেলতে হবে ইন্সেন্ডিয়ারী বা আগুনে বোমা। নাপাম, ফসফরাস। সেগুলি ওজনে খুব ছোটো, ১৪ কেজি থেকে দুই কেজিরও কম।
    প্রথম ঝাঁকের ২৫৪টি বোমারু বিমান থেকে সেই হিসেবে দশ মিনিটের মধ্যেই হু হু করে পাঁচশো টন হাই এক্ষপ্লোসিভ আর প্রায় দুই লক্ষ আগুনে বোমা ফেলা হলো।ব্যাস। দশটা বাইশ মিনিটের মধ্যেই আবার,ইংলন্ডের বাড়ীর পথে ফিরে গেলো সফল বোমারুর ঝাঁক।

    দ্বিতীয় দফার বোমারু বিমানেরা এলো আরো ঘন্টা তিনেক পরে। নীচে তখন আগুনের বন্যা। আর কোনো ইন্ডিকেটরের প্রয়োজন নেই। মাস্টার বম্বার বললেন , কোনো টারগেটই আর ভালো করে চেনা যাচ্ছে না। ঐ আগুনের চারপাশ দিয়েই বোমা ফেলে যাও। সারা ড্রেসডেন শহরকে সতর্ক করবার মতন আর সাইরেন বাজাবার অবস্থাও ছিলো না তখন।

    এক আগুন দানব তখন ড্রেসডেনকে গ্রাস করেছে। বিশাল কালো ধোঁয়ার কুন্ডুলী আকাশ ছেয়ে ফেলেছে।উপর আকাশে পোড়া মাংসের গন্ধ পেয়েছিলেন পরের ঝাঁকের বৈমানিকেরাও। মাটীতে তখন দাউ দাউ জ্বলছে আগুন।মুহুর্ত্তের মধ্যে ঝলসে দিচ্ছে যা আছে তার গহ্বরে।শুষে নিচ্ছে অক্সিজেন। "মনে হচ্ছে রাত নয়, যেনো দিনের বেলায় এসেছি" বললেন এক বোমারু। চারিদিকে গনগনে আগুনের মাখে এক যায়গায় একটু ফাঁকা। সেটি শহরের মধ্যে একটি বড় পার্ক - গ্রসার গার্টেন, তার মাঝে একটি বড় দিঘী। প্রচুর রেফিউজী সেই পার্কেই খোলা আকাশের নীচে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন। দ্বিতীয় ঝাঁকের বোমারুরা আর কোনো টার্গেট না পেয়ে সেই পার্কেও যথেচ্চ বোমা ফেলে এলেন। আগুন ও উত্তাপের হাত থেকে বাঁচতে অনেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন গ্রসার গার্টেনের সেই লেকে। কিন্তু আগুনের হাত থেকে রক্ষা পেলেও বহু মানুষ সেই লেকের গভীর জলে ডুবে প্রান হারান।

    রাস্তার অ্যাসফাল্ট পুড়ে সেও এক মরণফাঁদ। পা রাখলেই সেই তরল মৃত্যু গ্রাস করছে। ”burning rivers of bubbling and hissing tar”।আগুনের তাপমান তখন ১৫০০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। কাঠ,পাথর - কিছুই রেহাই পায় না,আর মানুষ তো কোন ছাড়। প্রচন্ড তাপে পুর্ণ বয়ষ্ক মানুষের দেহ কুঁকড়ে একটা বাচ্ছার মতন হয়ে গেছিলো আর শিশুদের তো খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছিলো না। কোথাও আগুন এমনই ভয়ংকর, এমনই তার তেজ, যে চোখের সামনে মানুষের দেহ পুড়ে ছাই হয়ে শুধু কিছুটা তরল পদার্থে পরিনত হয়েছিলো।

    কোথাও বা সেলারের মধ্যে আর দেহাবশেষও ছিলো না, মানুষের দেহ গলে মেঝেতে কয়েক ইঞ্চি পুরু চর্বির কার্পেট হয়েছিলো। আর ছিলো সারা শহর জুড়ে দুর্গন্ধ। ছাই আর ধোঁয়া। গুঁড়িয়ে যাওয়া ইমারতের ধুলো। ইঁট,পাথর। মানুষের,পশুর টুকরো টাকরা ছিন্ন ভিন্ন দেহ।আর ভয়ানক তাপ। যেখানে আগুন জ্বলছে না,সেখানেও গন গন করছে চারদিক।আর হাওয়ার ক্রুদ্ধ গর্জন।

    সেই আগুন জ্বলেছিলো সাতদিন ধরে।উদ্ধার কাজে এসে দেখা গেছিলো সেলারের মধ্যে বা ট্রেনের ভিতর বসে অজস্র মানুষের এক অদ্ভুত মৃত্যু। অক্সিজেনের অভাবে হঠাৎই হার্টফেল করে মারা গেছেন সেই সব মানুষেরা। মনে হচ্ছিলো এক যাদু কাঠির ছোঁয়ায় হঠাৎ ফ্রীজ করে গেছে একটি নিমেষ। যে যেখানে যেমন ভাবে ছিলেন সে ভাবেই শুয়ে বা বসে প্রান হারিয়েছেন তারা।

    কিন্তু সে তো পরের ঘটনা। আর কী ঘটলো পরের সকালে? তখনো আগুনে জ্বলে খাক হয়ে যাচ্ছে শহর। প্রচন্ড হাওয়ার জন্য সেই বিশাল দাহের কাছে যাওয়া মানেই মৃত্যু। হাতে হাত ধরে মানুষ পার হচ্ছে সেই আগুনের সীমানা। অসাবধানে হাত ছাড়া হলেই প্রচন্ড হাওয়ার টানে নিমেষে উড়ে চলে যাচ্ছে সেই লেলিহান অগ্নিগহ্বরে। প্রচন্ড হাওয়ার টানে উড়িয়ে নিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের ঘুর্ণিতে। চিরিয়াখানার জন্তুরাও রক্ষা পায় নি। কয়েকদিন পরে দেখা গেছিলো এক দৃশ্য। এক গাছের উপরের ডালে লটকে আছে এক লেপার্ডের দেহ আর তার উপরেই দুই নগ্না নারীর দেহ। জানি না, সালভাদর দালিও কি ভাবতে পারতেন এরকম সুররিয়ালিস্টিক দৃশ্য?

    আকাশে দাপালো বুনো ঘোড়ার দল
    ********************************************
    আর সকালে বেলাতেই হাজির আরেকদল বিমানের ঝাঁক। এইবারে আমেরিকানদের পালা। তারা বোমারু বিমানের সাথে করে নিয়ে এসেছেন তাদের ফাইটার বিমান "মুসটাং"। বুনো ঘোড়া।তারা খুব নীচু দিয়ে উড়ে গেলো আর শহরের ভীত ছুটে যাওয়া মানুষের উপর চালিয়ে গেলো মেশিনগানের গুলি। "স্ট্রেফিং"। শয়ে শয়ে মানুষ মরলো গুলি ও কামানের গোলায়। শহরের বুকে গুলিবিদ্ধ হল একটি জিরাফও। আগের দিনের রাতে চিড়িয়াখানা থেকে পালিয়ে বেঁচেছিলো এই জিরাফটি।
    এইবারে হিসেব নিকেশ। কতো লোক মারা গেলেন এই হামলায়? হিসেব ছিলো পঁচিশ হাজার থেকে আড়াই লাখ। জার্মানেরা খুবই নিপুন রেকর্ড কীপার ছিলেন কিন্তু এই ড্রেসডেন শহরে সেটি সম্ভব হয় নি। কেনো না বন্যার স্রোতের মতন চারিদিক থেকে রিফিউজীরা এসে পৌঁছেছিলেন। তিন লাখ তো বটেই, হয়তো তারো বেশী।

    এই নিয়ে বিতর্ক এমনই চলেছিলো যে এই হালে মানে ২০১০ সালে, ড্রেসডেন শহরে এক "কমিশন" বসানো হয়- যাদের মতে মৃতের সংখ্যা ২৩ থেকে ২৫ হাজার।

    আরেকটি হিসেব এইরকম - ড্রেসডেন কত্তৃপক্ষের এপ্রিল মাসের এক খতিয়ানে লেখা হয়েছিলো ২২হাজার মৃত্যুর কথা। আর প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ "নিখোঁজ" হন, যাদের মধ্যে দশ হাজারকে খুঁজে পাওয়া গেছিলো।পরে ধ্বংশস্তুপ সড়ানোর সময় ,১৯৬৬ সাল পর্যন্ত্য , আরো হাজার দুয়েক মানুষের দেহাবশেষ পাওয়া যায়। সে হিসেবে ৩৫ হাজার।আর যে রেইলওয়ে ইয়ার্ডের জন্য ড্রেসডেন আক্রমনের এতো বাহানা, তাতে বোমা পড়লেও সেটি আবার সচল হয়ে ওঠে কয়েক দিনের মধ্যেই।
    বহু লোকে,যার মধ্যে নামকরা সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক, প্রত্যক্ষদর্শী - এরাও আছেন,তারা কিন্তু মৃতের সংখ্যাকে এক লাখ বা তারও বেশীই ধরেন।

    টোকিও - আরেক আগুনে পোড়া শহর।
    *********************************************
    এই ড্রেসডেন বম্বিংএর পর এক মাসও যায় নি, টোকিওতে ৯ মার্চের রাতে হল আরেক বিশাল বিমান হানা। এইবারে এটি একটি ১০০% আমেরিকান পালা। এর আগে আমেরিকান অতিকায় বোমারু বিমান বি ২৯,প্রায় কুরি হাজার ফিট উপর থেকে বোমা ফেলতো। সেটা বিমানের পক্ষে খুবই নিরাপদ উচ্চতা। অতো উঁচুতে বিমান বিধ্বংসী কামানের গোলা খুব একটা কার্যকরী হয় না; এমন কী অল্প যে কয়টা জাপানী জিরো ফাইটার তখনো অবশিষ্ট ছিলো সেগুলো'ও ঐ উচ্চতায় বি-২৯'র মোকাবেলা করতে পারতো না।কিন্তু অসুবিধেও ছিলো, ঠিক যায়গায় বোমা ফেলা প্রায় অসম্ভব হয়ে যাচ্ছিলো। কেননা জাপানে হাওয়ার গতি খুব বেশী আর ঐ উচ্চতা থেকে সঠিক ভাবে লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করাটা তখনকার দিনের টেকনলজিতে সম্ভব হত না।

    জানেনই তো, এই বি-২৯, মানে বিশালবপুর দুরপাল্লার বোমারু বিমন ছিলো বিশ্বযুদ্ধের সব থেকে ব্যায় বহুল প্রজেক্ট। তিন বিলিয়ন ডলার খরচা করে এই বিমানটিকে "ফীল্ডে" নামানো হয়েছিলো। তুলনা করুন,ম্যানহাটান প্রজেক্ট - যেখানে খরচা হয়েছিলো সাকুল্লে দুই বিলিয়ন মাত্র। তো বি-২৯'র সমস্যা ছিলো অন্তহীন।তাও খুবই চাপ ছিলো এই বিমানটির যথোপযুক্ত ব্যবহারের জন্য।

    আর আমেরিকান লাইন অফ কম্যান্ড ছিলো অনেক ঢিলে ঢালা। ব্রিটেইনে যেরকম বম্বার কম্যান্ডের সর্বাধিনায়ক আর্থার হ্যারিসকে সব সময়েই চার্চিলের অনুমতি নিতে হত ,সে টোকেন হলেও,আমেরিকান দের ক্ষেত্রে কিন্তু ব্যাপারটা ছিলো পুরোটাই কম্যান্ডার লেমে (LeMay)'র হাতে। দারুন লড়াকু এই কম্যান্ডার নিজেই ঠিক করতেন জাপানের কোথায় কীভাবে বোমা ফেলা হবে। লেমে দায়িত্ব নেবার আগে এই বি-২৯ বোমারুরা ঠিক যায়গায় বোমা ফেলতো মাত্র ৫% ক্ষেত্রে।

    লেমে তাই সিদ্ধান্ত নিলেন টোকিওতে আর ঐ কুরি হাজার ফীট উচ্চতার থেকে নয়, অনেক নীচে উড়ে বোমা ফেলা হবে ৬০০০ ফীট উচ্চতা থেকে। বৈমানিকেরা তো আতংকে অস্থির। এতো প্রায় সুইসাইড অ্যাটাক। কিন্তু লেমে অনড় থাকলেন।
    এর আগে আমেরিকান সরকার এমাইটির কিছু অধ্যাপক, বড়ো কোম্পানীর নানান প্রযুক্তিবিদ ও বিমানবাহিনী - এই তিন দলের এক কমিটি করে দেখেছিলেন ঠিক কী ভাবে বোমা বর্ষনে জাপানে সব থেকে বেশী ক্ষতি হতে পারে। সেই মতন একেবারে জাপানে বাড়ী যেরকম হয়, কাঠ ও বাঁশ দিয়ে অনেকগুলি ডামি বাড়ী বানিয়ে ফেলা হল Utahতে।তার উপর নানা ধরনের বোমা ফেলে তারা নিশ্চিত হলেন ঠিক কী ধরনের বোমা সব থেকে ফলপ্রসূ হবে। সেই কমিটির নাম ছিলো "Joint Incendiary committee"। কমিটির নাম শুনেই তো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে , যে এই কমিটির উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো ঢাক ঢাক গুড় গুড় ছিলো না। এই বি২৯ নিয়ে এমনই ঢক্কানিনাদ চলেছিলো যে সবাই ভাবতেন এসে গেছে আমাদের ম্যাজিক অস্ত্র।এতো খরচা,এতো বিজ্ঞাপন - ব্যবহার করে তো দেখাতেই হবে।

    সেই মতন তৈরী হয়েছিলো ই ৪৬ ক্লাস্টার বোমা। বলতে পারেন, এটা একটি বড়ো বাক্স যার মধ্যে থাকতো ৩৮টি নাপাম মানে জেলীড পেট্রোলিয়াম বোমা। মাঝ আকাশেই বাক্স থেকে এই ছোটো(প্রায় আড়াই কেজি) নাপাম বোমাগুলো ছড়িয়ে পড়তো আর মাটীতে আছড়ে পড়ে তিন বা পাঁচ সেকেন্ড পরে এতে আগুন লেগে যেতো। জল ঢেলেও পরিত্রান ছিলো না ।

    জেনে রাখুন ২০০৮ সাল থেকে পৃথিবীর প্রায় সব দেশই এই ক্লাস্টার বোমা ব্যান করে দিয়েছে। আরো তথ্য এই যে শুধু আমেরিকাই নয় ,সমান্তরাল ভাবে জর্মানীও, প্রায় একই সময়ে, ক্লাস্টার বোমার প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছিলো এবং বিভিন্ন রণক্ষেত্রে ব্যবহারও করেছিলো।
    আর কিছু এম ৪৭ আগুনে বোমাও ছিলো। এগুলো একটু ভারী। ধরুন প্রায় ৪২ কেজি ওজনে। প্রায় কাগজের মত পাতলা মেটাল শীটের আস্তরন। ভিতরে ঠাসা থাকে রবার আর পেট্রোলের মিশ্রন কিংবা জেলড পেট্রোলিয়াম আর সাদা ফসফরাস। শুধু আগুন ছড়িয়ে দেওয়াই এর কাজ।

    টোকিওতে - সেই রাতে
    “A fine night for murder/winging through the night”
    *****************************************
    সন্ধ্যাবেলায়,সাড়ে পাঁচটা থেকে শুরু করে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত্য, দফায় দফায় বি২৯'এর ঝাঁক উড়ে চল্লো টোকিয়োর দিকে। রাত একটায় প্রথম দলটি পৌঁছে গেলো আর তারপর প্রায় সম্পুর্ণ বিনা বাধায় একটানা বোমা ফেলে গেলো ঘন্টা তিনেক ধরে। তা প্রায় পাঁচ লক্ষ ছোটো বড় আগুনে বোমা ফেলা হয়েছিলো - যেনো শ্রাবনের ধারা।
    পরের দিকে বিমানদের জন্য আর লক্ষ্য স্থির করার দরকার ছিলো না। টোকিওর কাছাকাছি পৌঁছেই এক বৈমানিক দেখেন "দেখি দিগন্তে একটা আলোর আভা। মনে হচ্ছিলো বোধয় সুর্য্যোদয় হবে"।আর টোকিও শহরের উপরে পৌঁছে এক বৈমানিক জানালেন।"নীচে দেখলাম পুরো শহরটাই দাউ দাউ করে জ্বলছে। ভয়ানক গরম হাওয়ার আপড্রাফট আর তার সাথে কালো ধোঁয়ার কুন্ডলী। মানুষ পোড়ার গন্ধ।“
    অল্প যা কিছু বি২৯ খোয়া গেছিলো সেগুলো শত্রু আক্রমনে নয়, বরং এই উত্তপ্ত হাওয়ার ঝটকায়।

    ভারী ব্লক বাস্টার বোমার দরকার নেই। টোকিওর প্রায় সব বাড়ীই তো কাঠের। তার উপর টিনের বা মাটীর টাইলের ছাদ।আগুনটুকু শুধু লাগিয়ে দিলেই হোলো - হু হু করে সে আগুন ছড়িয়ে পড়বে সবখানে,সবখানে,সব খানে।

    প্রত্যক্ষদর্শী জানাচ্ছেন তারা পালাতে শুরু করলেন দিশাহারা হয়ে। কোন দিকে যাবেন? পুরো শহরটাই তো এক জতুগৃহ। কোন রাস্তায় গেলে পাবেন নিরাপদ আস্তানা। সর্বত্রই আগুন,উত্তাপ। পথে ঘাটে ঝলসে যাওয়া মানুষের দেহ। কোথাও অর্ধমৃত মানুষের চিৎকার আর গোঙানি।এতো ধোঁয়ার আস্তরণ যে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে আর তার সাথে ঝোড়ো হাওয়া। নাকা নদীতে পৌঁছে দেখেন আগুনের হল্কা সেখানেও আর প্রচন্ড উত্তাপ। নদীতে ভেসে আছে শয়ে শয়ে শবদেহ। কাছই একটা দিঘী। সেই খানে মৃতদেগের স্তুপ সড়িয়ে আশ্রয় নেয় মানুষ। উড়ে উড়ে আসে জ্বলন্ত বাড়ী ঘরের টুকরো টাকরা।

    কিছু পরে, কতক্ষন পরে বিমানের আওয়াজ ক্রমশঃ কমে আসে। বেঁচে থাকা মানুষেরা দু একজন করে উঠে আসেন, খুঁজতে চেষ্টা করেন তাদের বাড়ী ঘর। পথে মৃতদেহগুলি তখনো জ্বলছে।

    তবে ড্রেসডেনের মতন আগুন কিন্তু ছয় সাতদিন জ্বলে নি। সমস্ত্য দাহ্য বস্ত্তু "হজম" করে নিয়ে আগুন কিছু পরেই থেমে যায়। পরে দিন সকালে কোথাও কোথাও ধোঁয়ার চাদর সড়িয়ে দেখা যাচ্ছিলো ঝকঝক নীল আকাশ।টোকিও শহরের প্রায় ষোলো বর্গমাইল এলাকা পুরো ধ্বংশ হয়। এক লক্ষের ও উপর বেশী মানুষ মারা যায়। আহতের সংখ্যা গুনতির বাইরে।প্রায় দশ লক্ষ মানুষ ঘর ছাড়া।
    তবে টোকিওর এরকম দশা দেখে পথে নেমেছিলেন সম্রাট হিরোহিতো। নিজে পায়ে হেঁটে দেখেছিলেন নগরীর হাল।এতোদিন পর্যন্ত্য তিনি যুদ্ধের সব সিদ্ধান্ত থেকেই নিরাপদ দূরত্বে থাকতেন।কিন্তু এর পর থেকেই তিনি আর নির্লিপ্ত থাকেন নি।

    তার পরে
    *******************************
    বিশ্বযুদ্ধ যেদিন আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয়, মানে ১৯৩৯ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর, যখন জার্মানী পোল্যান্ডকে আক্রমন করে,সেই দিনেই ওয়ারশ শহরে বিমান হানা দিয়ে দিয়ে বহু অসামরিক লোককে ঘায়েল করে নাৎসী বিমান। তাই শহরে বোমা বা রকেট ফেলাটা এই বিশ্বযুদ্ধের একটা দস্তুরই ছিলো।
    তবুও, ঐ যুদ্ধের হিস্টিরিয়ার মধ্যেও কিন্তু ড্রেসডেনের আগুন ঝড় নিয়ে তুমূল সমালোচনা শুরু হয়। যে ব্রিটীশেরা ভি ১,ভি২ রকেটের নির্বিচার আক্রমন ও প্রায় ছয় মাস ধরে একটানা জার্মান বোমারুর ব্লিৎসের শিকার ছিলেন, তারাও কিন্তু প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন।

    চার্চিলও দমকে যান। উনি বল্লেন “The destruction of Dresden remains a serious query against the conduct of Allied bombing”। আর “the moment has come when the question of bombing of German cities simply for the sake of increasing the terror, though under other pretexts, should be reviewed.”

    কিন্তু এই বিমান হানার হোতা আর্থার হ্যারিস কিন্তু আগাগোড়াই অনুতাপহীন ছিলেন। বললেন "যদি একটিও ব্রিটীশ সেনার জীবন বাঁচানো যায় ,তাহলে এরকম বোমাবর্ষণ চলবেই।"আমেরিকান বিমান বাহিনীর ইরা একার বলেছিলেন - এ আর নতুন কথা কী। সব দেশই শত্রুপক্ষের শহরের উপর বোমা ফেলে। কোনোদিন জার্মানরা ফেলে, কখনো রাশিয়া আর কোনোদিন আমরা। কিন্তু বেশীর ভাগ লোকই, এমন কি, এই ধরনের বোমার শিকার ব্রিটেইনেও, ড্রেসডেনের ধ্বংশের সমর্থক বিশেষ মেলে নি।

    ড্রেসডেন মিত্রপক্ষের একটা ক্ষত হয়ে থাকবে চিরকাল। হ্যারিস নাকি জনান্তিকে ওনার অধঃস্তনদের বলেছিলেন যুদ্ধ চলাকালীন "এই যুদ্ধ যদি আমরা হারি তবে আমি কিন্তু যুদ্ধ অপরাধী হিসেবেই গন্য হব।" নিউরেমবার্গ ট্রায়ালের সময়ই বহু দেশের সিভিলিয়ান সমাজ থেকে দাবী উঠেছিলো "ড্রেসডেন বম্বিং,"কে যুদ্ধ অপরাধ বলে গন্য করা হোক।

    যুদ্ধের শেষে, মিত্রপক্ষের তাবড় সব মিলিটারী নেতারা নানান পুরষ্কার আর খেতাব পেলেও আর্থার হ্যারিসকে সেই সন্মানের লিস্ট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল।

    ৭০ বছর পার হয়ে এলেও ড্রেসডেন শহরকে জ্বালিয়ে দেওয়া নিয়ে এখনো মিছিল হয়,স্মরণসভা হয়।

    যুদ্ধের শেষ পাঁচ মাসেই আমেরিকা একটানা বোমা ফেলেছিলো জাপানে। আমেরিকান এয়ার ফোর্সের তথ্য অনুযায়ী তাদের হানাদারীতে নিহত হয়েছিলো তিন লক্ষের বেশী মানুষ।আর চার লক্ষ আহত,প্রায় ৯২ লক্ষ মানুষ গৃহহীন। আর্থার হ্যারিসের মতন লেমেও আদৌ অনুতপ্ত ছিলেন না। উনি বলেছিলেন 'মৃত্যু কিছু নতুন ঘটনা নয়। আর যুদ্ধে মৃত্যু তো নয়ই।" গর্ব করে বলেছিলেন "We scorched and boiled and baked to death more people in Tokyo on that night than went up in vapor in Hiroshima and Nagasaki combined"

    হিরোসিমা শান্তিবাদীদের মূল ফোকাস হয়ে যাওয়ায় টোকিও চিরকালের দুয়োরানি হয়েই থেকে গেলো। হিরোসিমা বা নাগাসাকির তুলনায় বেশী,অনেক বেশী হতাহত হলেও টোকিওর জন্য কেউ মিছিল করেন না, মোমবাতি জ্বালায় না। একটি নাকি ছোটো মনুমেন্ট রয়েছে টোকিও'র কোনো এক অখ্যাত যায়গায়। খুবই সাদামাটা।ব্যাস।জাপানও আর চায় না পুরোনো ঘা খোঁচাতে। কবরখানার ও তো মৃত্যু হয়।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ৩০ জানুয়ারি ২০১৬ | ৬৯১ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    চম - dd
    আরও পড়ুন
    ও শানওয়ালা - dd
    আরও পড়ুন
    দ্রোণ পর্ব - dd
    আরও পড়ুন
    কর্ণসংহার - dd
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • dd | 116.51.30.210 (*) | ৩০ জানুয়ারি ২০১৬ ০৬:৪৫58222
  • এই লেখাটার একটা প্রেক্ষিত আছে।

    বছর দশেক আগে বাংলা লাইভে ড্রেসডেন বম্বিং'এর উপরে লিখেছিলাম। কাপি তো আর রাখি নি। আর সে লেখাও আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।

    সেটাই আবার নতুন করে লিখলাম। দু একজনের ,যাদের হয়তো একটু মনে আছে, মনে হতে পারে "আগে যেনো কোথায় পড়েছি"। তাই।
  • ranjan roy | 24.99.72.39 (*) | ৩০ জানুয়ারি ২০১৬ ০৬:৫৮58223
  • ডিডি,
    টুপি খুললাম; এত বড় ঘটনার কিছুই জানতাম না।ঃ(((
  • | 24.96.165.134 (*) | ৩১ জানুয়ারি ২০১৬ ০২:১৬58227
  • এইটা দুর্দান্ত হয়েছে।

    BL এ ড্রেসডেনটা আরো ছোট ছিল। আর টোকিও বমিং নিয়ে আমি কিস্যু জানতাম না। মানে সত্যিই হ্বিরোশিমা নাগাসাকির আড়ালে চলে গেছে।
  • sosen | 184.64.4.97 (*) | ৩১ জানুয়ারি ২০১৬ ০৪:১২58228




  • বস্টনে যে অপরূপ গ্লাস ফ্লাওয়ার মিউজিয়াম আছে তার আরো বড়ো প্রতিরূপ ছিল ড্রেসডেনে-শিল্পী রুডল্ফ ওখানেই কাজ করতেন। সব ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল বলে শুনেছি।
  • রোবু | 233.29.204.178 (*) | ৩১ জানুয়ারি ২০১৬ ০৪:৩১58229
  • আচ্ছা, ডিডিদা, কিছু মনে করবেন্না, এইটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সিরিজের আপনার সেরা লেখা বলে আমার মনে হচ্ছে।
  • kc | 198.71.220.93 (*) | ৩১ জানুয়ারি ২০১৬ ০৫:০০58230
  • ডিডিদার এই লেখাটা দুরন্ত হয়েছে। সবথেকে ভাল লাগে তথ্যগুলোকে যাস্ট একের পর এক বলে যাওয়া। নিজের অ্যাফিলিয়েশন, নিজের ভিউ পারতপক্ষে একেবারেই প্রকাশ না করা। এককথায় টোটাল।
  • Tim | 108.228.61.183 (*) | ৩১ জানুয়ারি ২০১৬ ০৫:১৪58231
  • ডিডিদার বিশ্বযুদ্ধ বিষয়ক লেখাগুলো ফিরে ফিরে পড়ি। এই লেখাটা খুবই নাড়া দেওয়া
  • de | 24.97.162.123 (*) | ৩১ জানুয়ারি ২০১৬ ০৫:৫০58232
  • ড্রেসডেনে বেশ কয়েকদিন থাকতে হয়েছিলো একবার - শহরটাকে কিভাবে রিকনস্ট্রাক্ট করা হয়েছে জাস্ট ভাবা যায় না! প্রায় সমস্ত মিউজিয়াম আর মেমোরিয়ালগুলোতে পাশাপাশি ছবি রাখা আছে বম্বিং পরবর্তী এবং বর্তমান অবস্থার!

    এতো সুন্দর শহর কমই আছে -
  • avi | 113.252.164.21 (*) | ৩১ জানুয়ারি ২০১৬ ০৮:৪৬58224
  • খুব ভালো লাগলো। আমরা যারা বালার যুগে জন্মাইনি, তাদের জন্য এরকম আরো কিছু নেই? এই লেখাগুলো সারাদিন পড়ে যাওয়া যায়।
  • ranjan roy | 24.99.101.143 (*) | ৩১ জানুয়ারি ২০১৬ ০৯:৩৩58225
  • ডিডি,
    মনে পড়ছে একটা রাশিয়ান ফিল্ম ভিলাইয়ে বাবার রাশিয়ন কলিগের সৌজন্যে দেখেছিলাম যাতে ড্রেসডেনে আমেরিকান বম্বিং এ বিখ্যাত কিছু পেইন্টিং নষ্ট হওয়ার গল্প ছিল। তখন ভালো বুঝিনি।
  • PM | 233.223.159.253 (*) | ৩১ জানুয়ারি ২০১৬ ০৯:৩৭58226
  • ডিডি দা, দুর্ধর্ষ। আপনার সোনর কলম হোক। পড়ে গায়ে কাঁটা দিচ্চিলো।

    অমিও দৃস্দেন জানাতাম না সেভাবে। টোকিও-ও যে এমন ভয়ন্কর ছিলো সেটাও জানতাম না।

    জাপানের এতো দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানো কে সেলাম। ওদের কাজ কতোটা শক্ত ছিলো , তা আপনার লেখা পড়ে আরো বুঝলাম
  • E না C | 24.139.223.172 (*) | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৭:১৮58233
  • অনবদ্য লেখা।
  • avi | 113.24.84.48 (*) | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৯:৪৯58234
  • লেখার স্টাইলটা অনেকটা শীরারের মত। অহংবর্জিত নির্লেপ কথকতা। পরপর তথ্য, ঠাসবুনন। অথচ একঘেয়েমির জায়গা নেই।
  • lcm | 83.162.22.190 (*) | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:১০58235
  • নাজুক। নাজুক।
    প্রোপাগান্ডাহীন বিশ্বযুদ্ধগপ্পো - ডিডিদা তো বাংলায় এক জঁরা তৈরী করলেন
  • Hassan | 55.64.137.30 (*) | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৭:৪৯58236
  • Its nice blog
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। চটপট মতামত দিন