এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • ঋত্বিকচরিত অথবা মিশন মুদ্রারাক্ষস

    শিবাংশু লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১২ জুন ২০১৬ | ৮৬৩ বার পঠিত
  • ".... Film is not made, film is built. আমি চিত্রপরিচালক নই, আমি চিত্রস্রষ্টা। চিত্র সৃষ্টি করে একজন-সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন চিত্র সৃষ্টি করে, তাঁরা (নিছক) চিত্রপরিচালক নন।" (ঋত্বিক ঘটক)
    ----------------------
    তিনি যতোদিন বেঁচে ছিলেন, ততোদিন ব্যক্তি ঋত্বিক বিতর্কের কেন্দ্রে থাকলেও স্রষ্টা ঋত্বিক সেভাবে আগ্রহীদের উপযুক্ত মনস্কতা আকর্ষণ করেননি। ঋত্বিককে কেন্দ্র করে মনস্তত্ত্ব, নন্দনতত্ত্ব, চিত্রনির্মাণ ইত্যাদি নানা বিষয়ের উদ্দীপক চর্চা শুরু হয়েছে একটু ধীরে। কিন্তু যখন তা শুরু হয়েছে, তখন থেকে তা ক্রমশঃ বেড়ে চলেছে। সত্যি কথা বলতে কি তাঁর যা Body of work, অনুপাতগতভাবে দেখতে গেলে তার থেকে হয়তো অনেক বেশিই লেখা হয়ে গেছে। তাই তাঁকে নিয়ে কিছু লিখতে বসা বেশ বিপদের। তিনি ওভাররেটেড না আন্ডাররেটেড সে প্রশ্নটিও এখনও 'প্রশ্ন'ই থেকে গেছে। হয়তো তার একটা কারণ তিনি নিজে। নিজস্ব দাবিমতো তিনি 'সরলতর' হতে চেয়েছেন প্রতিটি ছবিতে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ঋত্বিক-এনিগমা বেড়েই চলেছে নিত্যদিন। সৃষ্টি ও যাপনে তাঁর সতত কিছু প্রমাণ করার তাড়না ছিলো। প্রকটতর হয়ে ওঠার উসকানি ছিলো। সেই সব দুর্বলতাগুলি হয়তো যথার্থ 'শিল্পীসুলভ' নয়, কিন্তু তাকে জয় করার কোনও সচেতন উদ্যমও তাঁর মধ্যে আমরা দেখিনি। স্বোপার্জিত মুদ্রাদোষের প্রতি তিনি আত্মসমর্পণ করে গেছেন। তার থেকে তিনি বেরিয়ে আসতে চাননি। তার অনিবার্য অভিঘাত গুলি দিনে দিনে প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে মানুষের মনে । যেমন সবাই যখন বলে 'কোমলগান্ধারে'র মধ্যেই আমরা তাঁর সৃষ্টির শিখর দেখতে পাই, তিনি নিজে কিন্তু 'সুবর্ণরেখা'র পক্ষে লড়ে যা'ন। কিন্তু যাবতীয় স্ববিরোধ সত্ত্বেও একজন প্রকৃত শিল্পী হিসেবে তিনি যথাসময়ে মানুষের মনোজগতের গভীরে পৌঁছে যান, নিছক শিল্পের নিয়মে। অথচ নিজের মুদ্রাদোষে আলাদা হবার বিপর্যয় থেকে কখনও মুক্তি চান'নি।
    ------------------------------
    সেকালে বিশাখদত্ত একটি অঙ্গুরীয় মুদ্রার প্রতীককে কেন্দ্রে রেখে তাঁর চিরায়ত নাটকটির মাধ্যমে আমাদের নাট্যশাস্ত্রের গতিপ্রকৃতি বদলে দিয়েছিলেন। মুদ্রাই মন্ত্রী না মন্ত্রীর মুদ্রা, রাক্ষস শেষ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারেননি। প্রকৃত প্রস্তাবে শিল্পবিচারে মুদ্রার ছাপ থেকেই আমরা শিল্পীকে চেনার প্রয়াস পাই। ঋত্বিক ঘটকও কোনও ব্যতিক্রম ন'ন। তাঁরও কিছু প্রকট মুদ্রালক্ষণ রয়েছে। এটা সর্বজানিত। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তাঁকে সেদেশের সরকার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য। উড়োজাহাজে যাবার সময় তিনি আকাশ থেকে পদ্মানদী দেখে ভাববিহ্বল হয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দেন। সহযাত্রী সত্যজিৎ তাঁকে সম্বৃত করেন। কিন্তু সেদেশে পৌঁছে সেখানের তৎকালীন ভূমিগত বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করে তিনি অচিরেই প্রথমে নিরাশ ও পরে মোহমুক্ত হবার প্রয়াস করেন। কিন্তু কখনও হতে পারেননি। তাঁর তক্ষশীলা ও মগধ পরস্পর ঘেঁটে গিয়েছিলো। চিরকালের মতো। তিনি কার মুদ্রা বহন করেন, শেষ পর্যন্ত ঠাহর করে উঠতে পারেননি। আমাদের জন্য সেটাই প্রাপ্তি। ট্রিলজি'র ছবিগুলি সম্বন্ধে তিনি মন্তব্য করেছিলেন , "-----------যোগসূত্র এই তিনটার মধ্যে একই মাত্র। সেটা হচ্ছে দুই বাংলার মিলন। দুইডা বাংলারে আমি মিলাইতে চাইছি। দুইডারে আমি ভালোবাসি হেইডা কমু গিয়া মিঞা, এবং আমি আজীবন কইয়া যামু, যখন মৃত্যু পর্যন্ত আমি কইয়া যামু। আমি পরোয়াই (করিনা ), আমার পয়সার পরোয়াই (নাই)। I can fight that out. ঋত্বিক ঘটক can do that out here and in Dhaka. আমারে কে মারব লাথি, মারুক গা যাক। বইয়া গ্যাছে গিয়া।"
    এই ছবিগুলি তাঁর কীর্তির মাইলফলক, তারা কোনও না কোনও ভাবে ছিন্নমূল, মাতৃবিযুক্ত সন্তানের বিষাদবেদনায় ধূসর। যে দেশ তিনি ছেড়ে এসেছিলেন তাকে কখনই মৃণ্ময় ভেবে সান্ত্বনা পাননি, তা চিরকাল অত্যন্ত প্রকটভাবে তাঁর কাছে চিণ্ময় হয়ে থেকে গেছে। তাঁর 'দেশ'মাতৃকার সঙ্গে তাঁর নাড়ি সম্ভবত পঞ্চাশ বছর ধরেই কেউ ছিন্ন করতে পারেনি। তিনি যতোদূরে যেতে চেয়েছেন ততো বেশি নাড়িতে টান লেগেছে এবং তিনি ব্যথাকাতর হয়ে পড়েছেন। তাঁর ব্যক্তিজীবন, শিল্পীজীবন, রাজনীতি, উৎকেন্দ্রিকতা, কেউই তাঁকে এই বেদনা থেকে মুক্ত করার উপযুক্ত শুশ্রূষা দিতে পারেনি।
    ----------------------------------------
    আবার অন্যদিকও আছে। এই তিনটি ছবি নিয়ে নিছক আবেগের ঊর্ধে গিয়ে তাঁর বিশ্লেষণটিও প্রনিধানে রাখা প্রয়োজন।
    "'মেঘে ঢাকা তারা' was complete my....in my subconcious affair. 'কোমল গান্ধার' was a very concious affair. আমার এই মহিলার সঙ্গে বিবাহ ব্যাপারটা তার সঙ্গে প্রচণ্ড ভাবে জড়িত। আর 'সুবর্ণরেখা' is a very serious work. ওখানে খাটতে হয়েছে, হ্যাঁ, মানসিকভাবে.... a work behind. দৈহিকভাবে খাটার ব্যাপার নয়, মানসিকভাবে প্রচণ্ড খাটতে হয়েছে এবং এটাকে আমাকে দাঁড় করাতে হয়েছে। কদ্দূর দাঁড়িয়েছে সে আমি জানিনা, কিন্তু মিঞা কথা হইত্যাছে, যে খাটছি আমি।" অথচ এ কথাও বারবার বলছেন, ".... বাংলার ভাগটাকে আমি কিছুতেই গ্রহণ করতে পারিনি। আজও পারিনা। আর ঐ তিনটে ছবিতে( মেঘে ঢাকা তারা, কোমলগান্ধার, সুবর্ণরেখা) আমি ও-কথাই বলতে চেয়েছি। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও হয়ে গেলো একটা 'trilogy'.
    এই মুদ্রাদোষটি থেকে তিনি সচেতন বা অবচেতনে কখনও রেহাই পেতে চাননি। তাই আমৃত্যু সেটি তাঁর হৃদয়লগ্ন হয়ে থেকে গিয়েছিলো। একজন শিল্পীর ক্ষেত্রে একে 'সীমাবদ্ধতা'র চিহ্ন হিসেবে গণ্য করা যায়। যদিও ঋত্বিক আজীবন দেশভাগের যন্ত্রনা থেকে সৃজনশীলতার ক্যাথার্সিস খুঁজেছেন। সেটি সত্যজিৎও স্বীকার করেছিলেন।
    --------------------------------------------
    ".... Film is not made, film is built. “ঋত্বিক এই উক্তিটি ধার করেছিলেন আইজেনস্টাইনের থেকে। তিনি যে সত্যজিতের মতো হলিউডি মডেলে বিশ্বাস করেননা এবং তাঁর রচনার সঙ্গে রুশ ক্ল্যাসিক ছবিগুলি মেলে তা স্বয়ং সত্যজিৎই বলে গেছেন, তাই তা জজেও মানে। তাঁর ছবি করার উৎস এবং অনুপ্রেরণা হিসেবে ঋত্বিক বলেছিলেন, ".... আইজেনস্টাইন না-থাকলে আমরা কাজ-কম্মর 'ক'ও শিখতাম না। উনি আমাদের বাবা। আমাদের পিতা। তাঁর লেখা, তাঁর thesis এবং তাঁর ছবি-এগুলো ছোটবেলায় আমাদেরকে পাগল করেছিল। এবং তখন ওগুলো আসত না। বহু কষ্টে লুকিয়ে-লুকিয়ে নিয়ে আসা হত। এই আইজেনস্টাইন... সত্যজিৎ রায়কেও আপনারা জিজ্ঞেস করতে পারেন, he will admit, that, he is the father of us." এর পরে তিনি নাম নিয়েছিলেন পুডোভকিন, কোজিনেৎসভ বা তারকোভস্কির। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর ভিতরের অ্যানার্কিস্ট মুগ্ধ হয়েছিলো আরেকজনের প্রভাবে। অবাক হবার মতো কিছু নেই যদি তাঁর কাছে বুনুয়েল শ্রেষ্ঠতার শিরোপা দখল করে নেন। যে স্ফুর্তির সঙ্গে তিনি বুনুয়েলের শিল্পকে বরণ করে নিয়েছিলেন, তাঁর থেকে এর জুড়ি আমরা আর পাইনি।
    "আমার মতে বর্তমান চিত্র-পরিচালকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছেন লুইস বুনুয়েল। তাঁর চার-পাঁচটি ছবি আমি দেখেছি। ছবিগুলি আমাকে একেবারে পাগল করে দিয়েছে। বুনুয়েল-এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিশৃঙ্খলা এবং তার মধ্যে দিয়ে আমাদের একটা ছন্দে পৌঁছে দেওয়া। তিনি আমাদের মতো সাধারণ পরিচালকদের ভঙ্গিতে গুছিয়ে শট তোলেন না বা গুছিয়ে গল্প সাজান না। মনে হবে যেন তিনি পরম অবহেলায় ছবি তুলেছেন অথচ প্রায়শ এক-একটি মারাত্মক মূহুর্তে তিনি আমাদের নিয়ে যান যা রীতিমতো স্তম্ভিত করে দেয়।
    ...... ওঁর থেকে বড় ছবির শিল্পী আমার মতে কেউ নেই বর্তমানে।"
    --------------------------------------
    স্ববিরোধের অন্য নাম ঋত্বিক। হয়তো সেটা বিরোধিতাই নয়। দ্বান্দ্বিকতা ও ভারতীয় ঐতিহ্যমুখী ব্যক্তিমানসের বিবর্তনে ইতিহাস, ঐতিহ্য বা মিথস্ক্রিয়ার ভূমিকা, ব্যক্তি তথা সমষ্টির সৃজনশীলতার প্রক্রিয়ায় তার প্রতিফলন এবং এ প্রসঙ্গে ইয়ুং সাহেবের তত্ত্ব অনায়াসে মিলেমিশে গেছে। তিনি নির্দ্বিধায় স্বীকার করছেন, "... ইয়ুং-এর সঙ্গে মার্ক্স-এর কোন বিরোধ নেই, দু'জনে দুই জগৎ নিয়ে কারবার করেছেন। দুটো প্রচণ্ডভাবে পরিপূরক। আমার ছবিতে ইয়ুং-এর যে-ব্যাপারটা প্রচণ্ডভাবে আসে, সেটা হলো ঐ mother complex. আমাকে আমার এক বন্ধু বলেছিলো, তোকে মায়ে খেয়েছে। আমার সব ছবিতে ঐ মা এসে পড়ে- তা মায়ে খেয়েছে কেন? এই 'যুক্তি তক্কো' ছবির entire ছৌ নাচটার raison d'etre হচ্ছে মা - mother complex. এখানে ঐ মেয়েটাকে, শাঁওলিকে তার সঙ্গে equate করো, জ্ঞানেশ বলছে নাচো, তোমরা নাচো, তোমরা না নাচলে কিছু হবে না। এটা সম্পূর্ণ Jungian, তিতাস'-এ ছেলেটা স্বপ্ন দেখে মা-কে ভগবতী রূপে, এই mother complex একটা basic point." উত্তর আধুনিক পরিপ্রেক্ষিত ও ভারতীয় শিল্পবোধের নিরিখে এই উক্তির ব্যাখ্যা আজকের গুণগ্রাহীর বিচারে অনেক সহজবোধ্য হয়ে গেছে। তিনি বহুবার ওয়াজেদ আলি সাহেবের 'ট্র্যাডিশন' বিষয়ক অতি পরিচিত পরিভাষাটি উল্লেখ করেছেন তাঁর আলাপচারিতায়। বছর পঞ্চাশেক আগে যা নিশ্চিতভাবেই স্ববিরোধের সূচক ছিলো, কিন্তু আজ স্বপ্রতিষ্ঠ।
    -------------------------------------
    আইজেনস্টাইন বা বুনুয়েল, অনুপ্রেরণা হিসেবে তিনি যাকেই গ্রহণ করুন না কেন, 'আবেগপ্রবণতা'র 'পিছুটান' তাঁকে সতত আচ্ছন্ন করে রাখতো। বস্তুত তাঁর রচনার বিরুদ্ধে আমাদের যে প্রধান অভিযোগ, সেটাও তো তাই। আবেগের বশে মেলোড্রামার আধিক্য। এ প্রসঙ্গে তিনি নিজে কী বলেন একবার দেখে নেওয়া যাক।
    " .... আসলে ছবি করার সময় অন্য কোন শক্তি ঢোকে। তার প্রথমে থাকে আবেগ, আবেগই চালিত করে। সমস্ত ব্যাপারটা আবেগ থেকে আসে। যার আছে, তার আছে , যার নেই, তার নেই। এ হল ভেতর থেকে উৎসারিত। যে কোন শিল্পকর্ম সম্পর্কে এ কথা খাটে। লোকে গ্রহণ করুক অথবা না করুক। যে-দিন থেকে দর্শকরা screen ছিঁড়ে দিল, সেদিন থেকে চুল পাকতে শুরু হল।"
    অতএব ঋত্বিক সচেতনভাবেই আবেগকে চালিকা শক্তি হিসেবে স্বীকার করে নিচ্ছেন। আমরা যারা সিনেমার মূল্যায়ণে য়ুরোপীয় নন্দনতত্ত্বের ধ্যানধারণার প্রতি অধিক বিশ্বস্ত, তাদের মন্ত্র, আবেগ ভৃত্য হিসেবে উত্তম হলেও প্রভু হিসেবে তার ভূমিকা নৈব নৈব চ। আবেগের বন্ধহীন প্রকাশ মানে মেলোড্রামার 'স্থূলতা'। পরিভাষা হিসেবে 'মেলোড্রামা' শব্দটির মূল ঊনিশ শতকের ফরাসি গীতিনাট্য, মূলত অপেরার পরিবেশনার সঙ্গে জড়িত। যেহেতু প্রসেনিয়াম থিয়েটার বা ছায়াছবি দুইই আমাদের ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার, তাই এই শব্দটিকে আমরা 'অতি'নাটকের আখ্যা দিতে ব্যবহার করি। এই 'অতি' নাটকের উপাদান কী কী হতে পারে?
    ১। সমাপতনের ঘনঘটার প্রতি অধিক নির্ভরতা।
    ২। যেকোন মানুষী সংবেদ প্রকাশ করার সময় মন্দ্রসপ্তকের প্রতি ভরসা না রেখে তারসপ্তকের প্রতি অধিক বিশ্বস্ত হয়ে পড়া।
    ৩। নীতিকথা প্রতিষ্ঠা করার অদম্য উৎসাহে পরিবেশনার সূক্ষ্মতর দিকগুলির প্রতি উদাসিন থাকা।
    এই লক্ষণগুলি পরিহার করার প্রতি অতিরিক্ত মনোনিবেশ করার প্রয়োজনীয়তা আমরা পশ্চিম থেকে শিখেছি। যেহেতু সিনেমা একটি সম্পূর্ণ পশ্চিমী মাধ্যম, তাই দীর্ঘদিন আমরা বিশ্বাস করেছি যে পশ্চিমের তৈরি করা ( বিশেষত হলিউডের) 'ভালো সিনেমা'র মডেলটিই আমাদের অনুসরন করা উচিৎ। ঋত্বিক এই মডেলটির প্রামাণ্যতা অনেকাংশেই স্বীকার করেননি, তাই মারি সিটনকে তিনি প্রভাবিত করতে পারেন না।
    ---------------------------------------
    একটা কথা ঋত্বিক বারবার বলতেন।
    " Content প্রথমে আসে। রবীন্দ্রনাথ একটা কথা বলে গিয়েছিলেন যে আগে সত্যনিষ্ঠ হতে হয়, তার পর সৌন্দর্যনিষ্ঠ। কথাগুলোর মানে আপনারা ভালোভাবে বুঝে দেখবেন। Form-টা কিছু না, ওটা আকার মাত্র।"
    এই শর্তটির অনুপালন সব চেয়ে অধিক নিষ্ঠায় করা হয় এপিক শিল্পে। 'এপিক' শব্দটি ঋত্বিকের লেখায় বহুবার এসেছে। আমাদের দেশে যাবতীয় সৃজনশীল সৃষ্টির মূল উৎস দুটি। রামায়ণ ও মহাভারত। 'মেলোড্রামা' নামক শব্দটি সৃষ্টি হবার বহু হাজার বছর আগেই আমাদের শিল্প ও নন্দনশাস্ত্রে এই তথাকথিত 'মেলোড্রামা'র লক্ষণগুলি খুবই প্রকট। যেকোনও 'এপিক' শিল্পে আমরা এই 'অতি'বাদের প্রতি নির্ভরতা অতি প্রকটভাবে পাই। এই 'অতি'বাদের লক্ষণগুলি উপরে লিখেছি। সত্যনিষ্ঠাকে সবার উপরে স্থান দিতে গেলে যাবতীয় শিল্পনির্মাণের ভিত্তি হবে নৈতিকতার দৃঢ় মাটি। শিল্পকে 'লোকশিক্ষে'র প্রধান বাহন করতেই এপিকের প্রয়োজন সব চেয়ে বেশি অনুভূত হয়। তাই স্বাভাবিক ভাবেই য়ুরোপে গ্রিক যুগ থেকে রনেশাঁস যুগের শেষ পর্যন্ত এবং আমাদের দেশে পুরাণযুগ থেকে ইংরেজ আসা পর্যন্ত, যেকোনও শিল্প সৃষ্টির অন্তসলিল উদ্দেশ্য ছিলো, রামকৃষ্ণ পরমহংসের ভাষায় 'লোকশিক্ষে'। শুধু 'শিল্প' সৃষ্টির জন্যেই শিল্প সৃষ্টি এই ধারণাটিকে আমাদের দেশে কখনও মূলস্রোতে আসতে দেওয়া হয়নি। Art for art's sake আমাদের দেশে চিরকালই অজানা ব্যাপার। যেকোনও শিল্পপ্রচেষ্টার প্রত্যক্ষ উদ্দেশ্য থেকেছে বৃহত্তর মানবসমাজের কাছে কোনও কল্যাণকর বার্তা পৌঁছে দেওয়া। এ জন্যই আমাদের দেশে ব্যক্তির জীবনে সমষ্টির ভূমিকা এতো প্রকট। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ নামক ধারণাটি আমাদের কাছে স্বার্থপর অসামাজিকতার নামান্তর ছিলো। ঋত্বিকের পূর্ববঙ্গীয় শিকড় ও বামপন্থার জল তাঁকে এপিক ভারতীয়ত্ব, অর্থাৎ ব্যক্তিমানসের রূপায়ণে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মিথস্ক্রিয়ার অমোঘ ভূমিকার প্রতি চিরকাল বিশ্বস্ত রেখেছে। ভারতশিল্পের মূল্যায়ণ, ফ্রয়েড সাহেবের সরলরৈখিক, ব্যক্তিভিত্তিক, একমুখী বিশ্লেষণ থেকে করা সমীচীন নয়। তাই ইয়ুংসাহেবের ব্যাখ্যা আমাদের এপিক মূল্যবোধের অনেক কাছাকাছি এবং ঋত্বিকের কাজে আমরা এর পরিচয় পাই। শুধু চরিত্র রূপায়ণের ক্ষেত্রেই নয়, যাবতীয় অন্যতর ট্রিটমেন্টের ক্ষেত্রেও ঋত্বিক হয়তো য়ুরোপীয় ও মার্কিন মানদন্ডে অতিরিক্ত উচ্চকিত ছিলেন। যদিও সত্যজিৎ এই সব মানদন্ডের প্রতি চিরকাল বিশ্বস্ত রয়ে গিয়েছিলেন। 'অপুর সংসার' শেষ করার সময় তিনি বিভূতিভূষণের 'ভারতীয় পাঁচালি'র মতে সমে ফিরে আসার প্রক্রিয়াটিকে গ্রহণ করেননি। তাকে য়ুরোপীয় যুক্তিপরম্পরায় সরলরেখায় অগ্রসর পথে এগিয়ে দিয়েছিলেন। এই নিয়ে ঋত্বিক তো আপত্তি করবেনই।
    ----------------------------------------------
    আইজেনস্টাইনের শিষ্য হিসেবে ঋত্বিক alienation from the narratives-এ আস্থা রাখেন। তাঁর নীতিবোধ, যা কেতাবি শিল্পবোধের থেকে অনেক প্রখর, সেখানে তিনি আপোসে বিশ্বাস করেননা। তাঁর মতে, " আমি শিল্পী হিসেবে involvement'এ বিশ্বাস করি। আমি বিশ্বাস করি যে চারপাশের মানুষের জীবনের সাথে নাড়ির যোগ রেখে ছবি করতে হয়। তা না-হলে ছবি করার কোন মানে হয় না .... তাই আমি বিশ্বাস করি, প্রতিটি শিল্পীর কর্তব্য এবং প্রয়োজন এই involvement। সেই সাথে audience-কে alienate করব . .....আমি প্রতি মূহুর্তে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে বোঝাবো it is not an imaginary story, বা আমি আপনাকে শস্তা আনন্দ দিতে আসিনি। প্রতি মূহুর্তে আপনাকে hammer করে বোঝাবো যে যা দেখছেন তা একটা কল্পিত ঘটনা, কিন্তু এর মধ্যে দিয়ে যেটা বোঝাতে চাইছি আমার সেই thesis-টা বুঝুন, সেটা সম্পূর্ণ সত্যি। সেটার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করানোর জন্যই আমি আপনাকে alienate করব প্রতি মূহুর্তে।"
    যখন শিল্পী বলছেন যে তিনি দর্শককে 'ধাক্কা' দিতে চাইছেন বা hammer করতে চাইছেন, তার মানে তিনি তাদের আখ্যানের আরামদায়ী গৃহকোণ থেকে বার করে রোদজলবৃষ্টিঝড়ের নিষ্ঠুর নিসর্গের মধ্যে ফেলে দিতে চাইছেন। তিনি এটা বোঝাতে চাইছেন এই বিপর্যয় বা বিড়ম্বনা একটি গল্পের চরিত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না, এ তোমার পাপ, এ আমার পাপ। তুমি হল থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজেকে এই দায়িত্ব থেকে মুক্ত করতে পারোনা। আমাদের দেশের যে নীতিশাস্ত্র, সেখানে এই তাড়নাটিকে শাশ্বত স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এমন কি এক জীবনে এই পাপ থেকে মুক্ত হতে না পারলে 'পরজন্মে' তোমাকে এটা বহন করে বেড়াতে হবে। অঙ্ক মেলাবার জন্য 'পরজন্ম' বা 'জন্মান্তর' নামক এক্স ফ্যাক্টরকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এই পাপ আসলে কী? একজন সামাজিক মানুষ হিসেবে তুমি যখন এক জন্মে তোমার প্রতি সমাজসংসারের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছোনা, তখন তোমাকে আরও জন্ম নিতে হবে এই প্রত্যাশা পূরণের জন্য। বুদ্ধজাতকের গল্পের কথা ভাবুন, পরে যেটাকে সনাতন ধর্মেও স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে গীতা, ভাগবতে। সেখানে আমরা দেখি সমাপতনের কী চূড়ান্ত ঘনঘটা। কেউ যদি অন্যায় ভাবে একটি মৃগবধ করে তবে 'পরজন্মে' তাকে মৃগ হয়ে জন্মগ্রহণ করে নিহত হতে হবে। এই চক্রবৎ পরিবর্তন্তে বা সেই বিমল মিত্রের উপমায় 'যমুনাকি তীর' বার বার ফিরে ফিরে আসবে এটাই ভারতীয় নীতিশাস্ত্রের ঐতিহ্য । ভারতীয় নন্দনশাস্ত্র তৈরিই হয়েছিলো এই নীতিশাস্ত্রকে 'ধাক্কা' মেরে বা hammer করে মানুষের মনে স্থাপন করার জন্য। এই ধাক্কা মেরে ইম্প্যাক্ট তৈরি করাই তো 'মেলোড্রামা'র উদ্দেশ্য, যা আমরা বারম্বার বিভিন্ন এপিকের মধ্যে পাই । ঋত্বিক তো সেই কাজই করেছেন। ব্যক্তির ক্ষয়রোগ ব্যক্তিতে সীমাবদ্ধ থাকছে না , তা সমগ্র সমাজের ক্ষয়রোগের অংশ। দর্শকও তার থেকে অব্যাহতি পাবে না। নীতিশাস্ত্র তো এই কথাই বলে। এই রোগের জীবাণু দ্যাবাপৃথিবীতে একভাবে প্রভাবী হয়ে রয়েছে ।
    ----------------------------------------
    তাঁর সঙ্গে ছবি করার ক্র্যাফট বা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে তিনি বলেন, "পদ্ধতি-টদ্ধতি বুঝিনা মশাই, আমার কাছে আজও প্রমথেশ বড়ুয়া ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ চিত্রপরিচালক।" এই উক্তির যাথার্থ্য প্রমাণ করতে তিনি অবশ্যই অনেক উদাহরণ দেবেন। এই জায়গাটিতেই ঋত্বিক তাঁর সমকালীন আরেক প্রত্যক্ষভাবে চিহ্নিত 'রাজনীতি সচেতন' স্রষ্টার থেকে আলাদা হয়ে যান। মৃণাল সেন কখনও এভাবে তাঁর মুগ্ধতা জানানোর প্রয়াস করবেন না।
    শিল্প ও রাজনীতির, পড়ুন সমাজতন্ত্রের, পারস্পরিক টানাপড়েন বিষয়ে তাঁর মতামত চিরকালই পি সি জোশির লাইন মেনে চলেছে। তাই নির্দ্বিধায় তিনি বলে ফেলেন, "রাজনীতি সম্পর্কিত হওয়া মানে, শিল্পী-টিল্পি নয়, যে-কোন মানুষকে এই সমাজে, এই শ্রেণীসমাজে, রাজনীতি সম্বন্ধে সম্পৃক্ত হয়ে থাকতে হয়। এটা শিল্পী শুধু নয়, সব্বায়েরই হওয়া উচিত। তবে তাই বলে slogan mongering শিল্পীর কাজ নয়। এই cheap slogan দিয়ে শিল্পী হয় না, শিল্পীকে কাজ করতে হয় মানুষের গভীরে। রাজনীতিকরা কাজ করে ওপরতলায়-মানে চেঁচামেচি, হট্টগোল, cheap slogan, একটা short slogan, এই সব। শিল্পী এইগুলো করলে, আমি মনে করি, সেটা শিল্প আর থাকেনা।"
    -------------------------------
    ইশকুলের পড়ার বইয়ে আমাদের শেখানো হয়, মানুষ সামাজিক প্রাণী। এই 'সমাজ'টা যে প্রকৃতপক্ষে কী, সে বিষয়ে কিন্তু বিশদ কিছু ব্যাখ্যা সে পর্যায়ে অধরাই থেকে যায়। এই তোতাপর্বের সীমানা পেরোলেই মানুষ অনুভব করতে শুরু করে তার রাজনৈতিক অস্তির নিয়ত রক্তক্ষরণের বেদনা। একজন বিবেকী মানুষ কোন ভাবেই তখন 'আমি পলিটিকস করিনা' গোছের শান্তিকল্যাণে আশ্রয় নিতে পারেনা। সাধারণ মানুষই যা পারেনা, শিল্পী কীকরে পারবে? তার অনুভূতি, সংবেদনা, বিস্ময়বোধ অনেক বেশি প্রখর। স্বাভাবিকভাবেই স্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান না থাকলে সে অসহায়। এমনিতেই সে সৃষ্টিশীলতার দোলাচলে পর্যুদস্ত, তার উপর যদি বাস্তব মাটির খুঁটিটাও নড়বড়ে হয়ে যায়, তবে তো সূর্যাস্তের অপেক্ষা করা ছাড়া তার আর কোনো গতি নেই। সঠিকভাবে পারিপার্শ্বিক ও সমাজসংসারের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করতে পারলেই শিল্পী তার টার্গেট গ্রাহক সঙ্ঘটিকে খুঁজে নিতে পারে। ঋত্বিকের সৃজনশীলতার শিকড় তাঁর সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে ছিলো। এই সময়ের ধর্ম ও তাঁর শিল্পের চরিত্রকে ব্যাখ্যা করা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন,
    " এখন আমরা কীসের মধ্যে দিয়ে pass করছি? Neo-colonialism, absolutely neo-colonialism. এটা আমি ছবিতে বলিনি। এ কথাগুলো বলতে গেলে আমার ছবি রাজনীতি হয়ে দাঁড়াত, ছবি হত না। আমি in human terms ব্যাপারটা ছবিতে বলার চেষ্টা করেছি।" 'তিতাস' করার সময় তাই তাঁর কাছে অদ্বৈত মল্লবর্মণকে অধিক গ্রহণীয় মনে হয়েছিলো। যদিও প্রথম থেকেই তাঁর মনে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনার ভিত্তিতে ছবি করার আকাঙ্খা ছিলো প্রখরভাবে। কিন্তু মানিক'কে তাঁর খুব 'তীক্ষ্ণ' মনে হতো। সেলুলয়েডে ধরার পক্ষে বড্ডো জটিল।
    -----------------------------------
    শিল্পীদের সময়ের প্রহরী বলা হয়। তাঁরা ভবিষ্যত সময়ের রূপরেখা বহু আগেই অনুভব করতে পারেন। শিল্পীর ইনসটিংক্ট তাঁকে নিজের সময়ের আগে এগিয়ে দেয়। ঋত্বিকের অনুভবে বেশ কয়েক দশক আগেই তাঁর স্বদেশভূমির রাজনৈতিক অবস্থার ভবিষ্যদ্বাণী আমাদের চমকে দেয়। অবহেলিত, বহুনিন্দিত এই ধীমান মাতাল এবং 'পাগল' যে কথাগুলি বলে গিয়েছেন, যেন ডেলফির দৈববাণীর মতো তা আজ আমাদের কাছে বাস্তব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
    "....এখন আমার নিজের ধারণা দুটো রাস্তা পরিষ্কার- হয় straight Fascism, আর নইলে Leninist পথে কোন কিছু। তোমরা যদি ১৯২৯ থেকে '৩৩ সালের জার্মানির দিকে তাকিয়ে দেখো তো দেখবে যে, এই যে এখানে ১৫-১৬ বছর থেকে ২০-২৫ বছরের ছেলেরা বাঁদরামি করে বেড়াচ্ছে, এটা যেন তারই প্রতিরূপ। এরাই SS, এরাই Gestapo এই lumpen-দের থেকেই তৈরি হচ্ছে ভীষণভাবে। গোটা সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে চুরমার হয়ে-দুটো পথ খোলা- হয় Leninist পদ্ধতিতে নিয়ে যাবার একটা ব্যাপার আছে, নইলে clean Fascism হবে। এবং আমার ধারণা within 3,4 or 5 years এটা হবে- হয় এদিকে, নয় ও-দিকে। এ চলতে পারেনা। ছবিতে এ বলার অবকাশ নেই, কেননা আমি জানি এ দেশে leadership বলে কোন পদার্থ নেই।"
    --------------------------------------
    বিশাখদত্তের দ্বিধা ঋত্বিক জীবৎকালে কাটিয়ে উঠতে পারেননি। দর্শক হিসেবে আমরা বঞ্চিত হয়েছি তাঁর কাছে।

    (সৌজন্যেঃ কালিমাটি অনলাইন)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১২ জুন ২০১৬ | ৮৬৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Anindya Sengupta | 55.249.166.97 (*) | ১২ জুন ২০১৬ ০৬:৩২55352
  • বড় ভালো লেখা। বাংলায় auteur criticism হয়না (auteur, অর্থাৎ ঋত্বিক যাকে চিত্রস্রষ্টা বলেছেন। এই লেখায় তার প্রথম পদক্ষেপটি আছে - অর্থাৎ ঋত্বিকের উক্তি পরপর সাজিয়ে একটি কাঠামো তৈরি করা। কিনহু ইনফারেন্স বা সিদ্ধান্ত বা পাঠের সাথে সহমত নই (বিশেষ করে সত্যজিৎ সম্পর্কিত), কিন্তু তা উহ্য রাখাই ভালো। এই লেখা ঋত্বিক নিয়ে একটি অন্যতম ভালো লেখা। ধন্যবাদ, শেয়ার করলাম।
  • ranjan roy | 132.162.161.160 (*) | ১২ জুন ২০১৬ ০৯:৪৭55353
  • ১। অনেক দিক থেকেই লেখাটি মূল্যবান, অন্ততঃ আমার কাছে। অমন দু'কথায় মেলোড্রামা বা বাংলা অতিনাটকীয়তার সংজ্ঞা বেঁধে দেওয়া ও নন্দনতত্ত্বের দুই সমান্তরাল ধারার ---ভারতীয়( নাকি প্রাচ্যদেশীয়?) ও ইউরোপীয়-- প্রস্থানবিন্দু সুস্প্ষ্ট ভাবে দেখিয়ে দেওয়ার মুন্সীয়ানা!
    ২। চমকে দিয়েছে এই জানা কিন্তু অবহেলিত লাইনটার পাঠের সময় অভিঘাত--একটা কথা ঋত্বিক বারবার বলতেন।
    " Content প্রথমে আসে। রবীন্দ্রনাথ একটা কথা বলে গিয়েছিলেন যে আগে সত্যনিষ্ঠ হতে হয়, তার পর সৌন্দর্যনিষ্ঠ। কথাগুলোর মানে আপনারা ভালোভাবে বুঝে দেখবেন। Form-টা কিছু না, ওটা আকার মাত্র।"
    ৩। বামপন্থী গোঁড়ামির আবহাওয়ায় বড় হওয়ার দিনে ফ্রয়েড পাঠের পর ইয়ুং পরার আগ্রহ হয় নি। এবার পড়ব।
  • কল্লোল | 116.216.143.24 (*) | ১৪ জুন ২০১৬ ০৪:২২55354
  • আমরা যারা এখন ৬০এর ওপাড়ে তাদের কাছে ঋত্বিক চিরকাল একটা ঘটমান বর্তমান। রাগী বয়সে রায়-ঘটক গোছের বালখিল্যতাকে বিপ্লবী কর্তব্য বলে মনে করেছি। এখন অতটা মনে হয় না। তবু, ফুরায় না তাকে পাওয়া...............
    আমি মনে করি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ ও নকশাল আন্দোলন বাঙ্গালীর মূল্যবোধকে যে ভাবে পাল্টেছে, তেমনভাবে অন্য কোন কিছু তাকে প্রভাবিত করেনি। ফলে কোন বাঙ্গালী শিল্পী যদি দেশভাগকে নিয়ে চিন্তাগতভাবে ডুবে থাকেন, তাকে খুব দোষ হয়তো দেওয়া যায় না।
    কিন্তু এখানেই ঋত্বিকের দর্শক হিসাবে, ঋত্বিকপাগল হিসাবে কিছু অনুযোগ থেকে যায়।
    আমার ধারনা একমাত্র ঋত্বিকই পারতেন মহাভারত চিত্রায়িত করতে। উনি ভাবেনই নি। অন্ততঃ, ভেবেছেন যে তার কোন প্রমান নাই। অনেকে হয়তো ওনার "সুযোগ" পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন। অর্থাৎ, কোন প্রযোজক কি পেতেন উনি? একশবার ছেড়ে হাজারবার পেতেন। উত্তমকুমার, বিশ্বজিত, সুচিত্রা, মাধবী, শক্তি সামন্ত এরা প্রযোজক ধরে আনতেন, অনেকে নিজেরাই রাজি ছিলেন। ঋত্বিক সেসব হেলায় ফেলে দিয়েছেন, শুধু শুধুমাত্র, নেশাতুর প্রচন্ডতায়। এক ও একমাত্র ঋত্বিকই পারতেন আধুনিক সময়ের বিচ্ছিন্নতা নিয়ে কাজ করতে, যা হয়তো বাংলার নিজস্ব মর্ডান টাইমস হয়ে থাকতো।
    হয়তো ঋত্বিকই আমাদের দিতে পারতেন তেমন সব চলচ্চিত্র যা দেখে আমরা "মুগ্ধ" হতে পারতাম না, যা দেখে আমরা হয়তো বমি করে ফেলতাম। সুবর্ণরেখা সেদিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছিলো।
    এগুলো হতে পারে নি। তবে, যা হয়ছে, তাইই বা এক জীবনে কজন হওয়াতে পারে?
  • শিবাংশু | 127.197.66.33 (*) | ১৪ জুন ২০১৬ ০৫:৫২55359
  • রঞ্জন, কল্লোলদা,
    বিভিন্ন মঞ্চে এই লেখাটি ভাগ করে নেবার সূত্রে একটা ব্যাপার আমার কাছে স্পষ্ট হলো, যেটা তোমাদের বক্তব্যের সঙ্গে সমান্তরাল। আমাদের প্রজন্ম ও পরের প্রজন্মের মধ্যে ঋত্বিক নিয়ে ধারণা বা আবেগ এখন একেবারে আলাদা হয়ে গেছে। ঋত্বিকের প্রধান চালিকাশক্তি দেশভাগ থেকে নক্শাল পর্ব পর্যন্ত বাঙালির যাপন, আবেগ ও মূল্যবোধের ওলটপালট জনিত সংস্কৃতির সামগ্রিক টেকটোনিক শিফট। এই আবেগটি সত্তর-আশি দশকে জাত বাঙালির কাছে অচেনা। উপরন্তু ঋত্বিকের যত্নলালিত উৎকেন্দ্রিক সমর্পণ আমাদের প্রজন্ম যে চোখে দেখে, নতুন প্রজন্ম তা দেখেনা।
    --------------------
    ঋত্বিক বিমল রায়'কে গুরু মানেন। প্রমথেশ বড়ুয়ার একান্ত গুণমুগ্ধ। অর্থাৎ মেথড সিনেমার প্রতি আনুগত্য নিয়ে প্রকাশ্যে সরব। কিন্তু স্বভাবে ক্ল্যাসিসিস্ট। এপিক সেন্টিমেন্টের প্রতি 'বলিপ্রদত্ত'। এই 'বলিপ্রদত্ত' শব্দটি সচেতনভাবে ব্যবহার করছি। কারণ যাঁরা ঋত্বিককে বলি দিতে চা'ন, তাঁরা এই সেন্টিমেন্টটিকে মেলোড্রামা নাম দিয়ে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। রাহী মাসুম রজা বা মনোহরশ্যাম জোশি একটা সময়ের ফসল, যার সূত্রপাত হয়েছিলো ঋত্বিক ও উল্লেখিত পথিকৃৎদের দৌলতে।
    --------------------------------------
    "কিন্তু এখানেই ঋত্বিকের দর্শক হিসাবে, ঋত্বিকপাগল হিসাবে কিছু অনুযোগ থেকে যায়।"

    আমার লেখাটির উদ্দেশ্য ঋত্বিকের থেকে আমাদের এই 'না পাওয়ার' ক্লেশটি সন্ধান করা। আমরা একান্তভাবে বিশ্বাস করি ঋত্বিক 'চাইলে' আমাদের অনেক কিছু দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি কেন 'চাইলেন' না, তা নিয়েই আমরা ভেবে যাচ্ছি। আমার মনে হয়েছে তাঁর স্বেচ্ছাবৃত 'মুদ্রাদোষ'গুলি তাঁর মানসিক গৃহিনীপনাকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিলো। তিনি তো নিজের শর্তে জীবন কাটিয়ে দিলেন। ক্ষতি হলো আমাদের।
  • Ekak | 53.224.129.63 (*) | ১৪ জুন ২০১৬ ০৬:২৭55360
  • " কারণ যাঁরা ঋত্বিককে বলি দিতে চা'ন, তাঁরা এই সেন্টিমেন্টটিকে মেলোড্রামা নাম দিয়ে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। "

    একটু সরলীকরণ মনে হচ্ছে , কিছু যদি মনে না করেন :) মেলোড্রামা একটা সাকসেসফুল জনরা ছিল একসময় । মিউসিক -ডায়ালগ সবকিছুতেই হাইটেনদ ইমোশন দেখানো এবং লার্জার দ্যান লাইফ করে প্রকাশ করার প্রবণতা যে ড্রামা ফিল্মের মধ্যে ছিল সেগুলো মেলোড্রামা । এখন সময়ের গতিতে মেলোড্রামা শব্দটা একটা নেগেটিভ কনোটেশন পেয়ে গ্যাছে তার পেছনে অনেক কারণ আছে । কিন্তু আলাদা করে ঋত্তিক কে ডোবাতে চেয়ে মেলোড্রামা বলে গাল দেওয়া হচ্ছে এরকম বললে একচুয়ালি ওনাকেই অস্বীকার করা হয় । ফিল্ম গুলো মেলোড্রামা জনরা তে বিলং করে এ তো ঘটনা । কত মেলোড্রামা ফিল্ম অস্কার পেয়েছে, কত সফল মেলোড্রামা পরিচালক আছেন । আধুনিক প্রজন্মের অনেকে ওই জনরা তে মজা পায়না সেটা দর্শক রুচির বিবর্তন। এখন কার সফল ফিল্ম দাঁড়িয়ে থাকে মেলোড্রামা কে নিয়ে সুক্ষ ব্যঙ্গের ওপর , যেটা করে অনুরাগ কাশ্যপ সফল । চূড়ান্ত মেলোড্রামা, কিন্তু সেটা আনাই হচ্ছে দেখানোর জন্যে যে দেখো তুমি ভেতরে কত ভালনারেবল। এটা এই সময়ের আধুনিকতা । এটাও ভবিষ্যতের আধুনিকতা হবার দম রাখে কিনা আমরা জানিনা ।

    আমার ব্যক্তিগত ভাবে ঋত্বিক এর সিনেমা সেরকম ভালো লাগেনা কারণ উনি ভায়োলেন্স কে এড়িয়ে গিয়ে পেইন ট্রানসেন্ড করেন । তিক্ততা কে এড়িয়ে গিয়ে হতাশা । এতে হয় কী , ওই সময়টার সরাসরি ভুক্তভোগী না হলে ,হাতে পেন্সিল ছাড়া কিছু থাকেনা । কেমন যেন "সেইসময়ের ফিল্ম " হয়েই থেকে যায় । যাই হোক , এই প্যারাগ্রাফ টা ব্যক্তিগত।
  • dd | 116.51.28.124 (*) | ১৪ জুন ২০১৬ ০৬:৫৯55355
  • কল্লোল, খুব ভালো মূল্যায়ন করেছো
  • Arpan | 24.195.234.78 (*) | ১৪ জুন ২০১৬ ০৭:২০55361
  • শিবাংশুদা ঠিকই লিখেছেন। মেলোড্রামার আধিক্য দেখলে ডন কিহোতে মনে পড়ে খালি। ঃ)
  • Ekak | 53.224.129.63 (*) | ১৪ জুন ২০১৬ ০৭:৩৩55362
  • হ্যা , আর মুশকিল হলো ঋত্তিকের কিহোতের পাশাপাশি কোনো সাংকো প্যানজা নেই যে ইমোশন-কাসল এর কাছা ধরে টান দেবে মাঝে মাঝে । ইনি সামহাউ ওই রিস্ক টা নেন নি ।
  • ranjan roy | 132.162.161.160 (*) | ১৪ জুন ২০১৬ ১০:৩৩55356
  • কল্লোল,
    "আমার ধারনা একমাত্র ঋত্বিকই পারতেন মহাভারত চিত্রায়িত করতে।উনি ভাবেনই নি। অন্ততঃ, ভেবেছেন যে তার কোন প্রমান নাই।"

    তোর এই লাইনটি নিয়ে একটি কথাঃ
    ৬০ এর দশকের তরুণ বামপন্থী সিনেমা বানানোর স্বপ্ন দেখা মুম্বাই গিয়ে কৃচ্ছসাধন করা অনেকের মধ্যে ছিলেন মনোহর শ্যাম জোশী ও রাহী মাসুম রজা। এঁরা আজীবন ঋত্বিকের ফ্যান ছিলেন।
    মনোহর শ্যাম জোশী পরে দূরদর্শনের সফলতম সোপ অপেরার স্ক্রিপ্ট রাইটার হলেন (হমলোগ, বুনিয়াদ, মুঙ্গেরীলাল কী হসীন স্বপ্নেঁ ইত্যাদি), তাতেও গুরুর মেলোড্রামার ছাপ, এর আগে সত্তরের দশকে লেখা উপন্যাস "কুরু কুরু স্বাহা" তে উনি ঋত্বিককে রথীজিৎ ভট্টাচার্য নামে এঁকেছেন।
    তাতে উল্লেখ আছে--দাদা সবসময় বিরাটের স্বপ্ন দেখতেন। পেটি ক্যারেক্টার ওনার পছন্দ নয়। উনি মহাভারত নিয়ে সিনেমা বানানোর কথা ভাবেন।
  • কল্লোল | 125.242.155.101 (*) | ১৪ জুন ২০১৬ ১১:৪২55357
  • হ্য়্ত কাকতালীয়। এদের মধ্যে দ্বিতীয়জন দূরদর্শন মহাভারতের চিত্রনাট্যকার - রাহী মাসুম রজা।
    মজা হলো, উনি একজন অসামান্য ঔপন্যাসিক। আধাগাঁও নামে ওনার উপন্যাসটি ভারতীয় ভাষায় লেখা উপন্যাসগুলির মাইল ফলকের একটি। এটি লেখা এক অদ্ভুত আঞ্চলিক ভাষায় - ভোজপুরী ঊর্দ্দুতে। ভারত সরকারের যে অনুবাদ সংস্থাটি আছে, সম্ভবতঃ ভারতীয় ভাষা পরিষদ, তারা একই নামে বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছে। আগ্রহীরা সংগ্রহ করতে পারেন। অনুবাদ বেশ ভালো।
    ওঃ, ঋত্বিক যদি এটিও সিনেমা করার কথা ভাবতেন!!!
  • ranjan roy | 132.162.161.160 (*) | ১৪ জুন ২০১৬ ১২:২০55358
  • ডিট্টো!
  • ranjan roy | 24.98.213.146 (*) | ১৫ জুন ২০১৬ ০১:২৪55363
  • বাক আপ একক!
    একটা দিক সুন্দরভাবে তুলে ধরেছ, আলোচনা চলুক। মনে হয় শিবাংশু এমনই বহুমাত্রিক আলোচনা চাইছেন।
  • এলেবেলে | 11.39.38.114 (*) | ১৫ জুন ২০১৬ ০৬:০৪55364
  • আচ্ছা এই যে ঋত্বিক ‘আমার লেনিন’ করছেন আবার তার দু’বছরের মাথায় ‘ইন্দিরা গান্ধী’, অথচ অনেক ছবি/ডক্যুমেন্টারি অসমাপ্ত থেকে যাচ্ছে — এটা কেন ? ‘কত অজানারে’র কাজ তো মাত্র একদিনের বাকি ছিল তবু শেষ হলনা কেন ? মৃত্যুর পর হলে মুক্তি পেল ‘নাগরিক’ এবং ‘যুক্তি তক্কো...’ তাও মাত্র এক আর দু’সপ্তাহের বুকিং জুটল কেন ? ‘নাগরিক’ প্রায় ২৫ বছর ক্যানবন্দি থাকল অথচ কলকাতার লেখক-শিল্পীরা সে ব্যাপারে উদ্যোগী হলেননা কেন ?

    ঋত্বিক অনুরাগী হিসেবে এগুলোও বড্ড জানতে ইচ্ছে করে । কেউ জানাবেন ?

    গুরুজনদের আলোচনায় হঠাৎ এভাবে ঢুকে পড়ে ছন্দপতন ঘটানোর জন্য আগাম মাফ চাইছি ।
  • Anindya Sengupta | 113.215.225.107 (*) | ১৫ জুন ২০১৬ ০৭:১৫55365
  • সামান্য একটু জ্ঞানদান আর কি - আমরা যারা চলচ্চিত্রবিদ্যা পড়ি - আমাদের কাছে মেলোড্রামা মোটেও সাধারণ ব্যবহারের মত derogatory নয়। অনেক কথা কাটিয়ে বলা যায় - মেলোড্রামা একটি জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক ধরণ (mode of address বলি আমরা) - যেখানে অতিরিক্ততা ও অযৌক্তিক একটু বিশেষ ভাবে ব্যবহৃত হয়। টেক্সটের শারিরীকতা বলে যদি কিছু থাকে - আলো, অভিনয়, সঙ্গীত, নাটকীয়তা - এইসবের অতিরিক্ত ব্যবহার নাটকের বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে একধরণের অর্থের দিকে ইঙ্গিত করা হয় যা সোজাসুজি টেক্সট বলতে পারছেনা। টেক্সট বলতে ছবি, নাটক, উপন্যাস অনেক কিছুই হতে পারে।
    ঋত্বিক এটা বিশেষভাবে মেলোড্রামা ব্যবহার করতেন - যেখানে ওই অতিরিক্ত অর্থ এমন একটা ইতিহাসের দিকে ইঙ্গিত করে যে ইতিহাস সবাই অস্বীকার করছে, বা ভারতবর্ষের অফিসিয়াল ইতিহাস অস্বীকার করছে - যথা, ১৯৪৭ স্বাধীনতার বর্ষ নয়, দেশভাগের বর্ষ। ঋত্বিক বলছেন সেটা একইসাথে স্বাধীনতা ও দেশভাগের বর্ষ হতে পারেনা - একটার ন্যারেটিভ বেছে নিলে অন্যটার ন্যারেটিভ বেছে নেওয়া যায়না। অতএব একটা ইতিহাস অন্য ইতিহাসকে অবদমিত করছে।
    এই অবদমিত ইতিহাসের দিকেই মেলোড্রামাটিক মুহুর্তগুলো ইঙ্গিত করবে - কিন্তু আলবাত সোজাসাপ্টা ভাবে নয় (সুবোধ্য হলে প্রোজেক্টটাই ফেল করে), বরং অতিরিক্ত ট্রমা, যন্ত্রণা ইত্যাদি দিয়ে।
    অর্থাৎ মেলোড্রামা একটা 'হিস্টেরিক' টেক্সট তৈরি করে - এই ব্যাপারটা ঋত্বিকের তত্ত্বের সাথে যেত ভালো।
    এটা আমার মত করে বোঝা। আমার মতে ঋত্বিক ভারতীয় সিনেমার সবচেয়ে তাত্ত্বিক ফিল্মমেকার। কিন্তু সেটা বোঝা সহজ নয়। ওর ছবি থেকে যে অবধারিত আবেগের অভিঘাত হয় সেটা থেকেই ওই তত্ত্বটা বুঝতে চেষ্টা করতে হয়।
  • শিবাংশু | 127.214.68.238 (*) | ১৬ জুন ২০১৬ ০৩:৪৩55366
  • একক, অর্পণ, অনিন্দ্য,

    হিন্দিতে বলে "সময় বলবান হোতা হ্যাঁয়।" এক প্রজন্মের মধ্যে নান্দনিক মাপদণ্ডগুলো নতুন করে লেখা হয়ে যায়। যে সময়কালের মধ্যে ঋত্বিকের সৃজনপর্ব, যার সীমা আমি ধরেছি, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৭, তার মধ্যে বঙ্গীয়যাপনে কয়েকটি গুরুতর পালাবদল ঘটে গিয়েছে। দেশভাগ, দুর্ভিক্ষ,নকশাল বিপর্যয়, মানু রায়ের সরকার, জরুরি অবস্থা। বাংলার ইতিহাসে এতোগুলো অপহ্নব এতো নিকট অন্তরালে কখনও আসেনি। তার সঙ্গে ছিলো ওপার বাংলায় বঙ্গবন্ধুর হননপর্ব। বাঙালির মানসিক জীবনে মেরুপ্রমাণ পরিবর্তন এসে যায়। বাঙালির শিল্পের নান্দনিক অগ্রাধিকার বা পরিভাষার মধ্যেও এসে যায় আমূল বদল। সে বিশদে এখানে যাচ্ছিনা। তবে আমার লেখায় 'মেলোড্রামা' শব্দটির অর্থ বা তাৎপর্য নিয়ে যা লিখেছি তা স্পষ্ট বলেই মনে হয়। 'মেলোড্রামা' একটি য়ুরোপীয় ধারণা, আমাদের দেশে কখনও ছিলোনা। গিরিশচন্দ্র ও অর্ধেন্দুশেখরের নাটকের উপস্থাপনা প্রসঙ্গে যে সব লেখালেখি আমরা পড়েছি, প্রসেনিয়ম থিয়েটারের শুরু থেকেই এইসব পার্থক্য আমাদের চোখে পড়ে। আমাদের যাবতীয় রসশাস্ত্রে নৈতিকতার স্পেসটি খুব বড়ো। নৈতিকতা একটি অপ্রাকৃত, কৃত্রিম মানবিক প্রয়োগ। প্রাকৃতিক অনিবার্যতার থেকে তার শক্তি অনেক কম। যেহেতু আমাদের সভ্যতায় মানুষের সামাজিক বন্ধন ও দায়বদ্ধতার ভূমিকা পাশ্চাত্যের থেকে অনেক বেশি, তাই নৈতিকতার প্রয়োজনীয়তাও আমাদের জন্য অধিক জরুরি। এ বিষয়ে যে কথা অনিন্দ্য লিখেছেন, আমি একমত । নৈতিকতার ভালনারেবিলিটি মনে রেখেই আমাদের দেশে এপিক সৃষ্টিগুলি রচিত হয়েছিলো। যেহেতু অনেক প্রয়াস নিয়ে মানুষের মনে নৈতিকতার বীজ বপন করতে হয়, আমাদের ঐতিহ্যে যাবতীয় লোকপ্রিয় তথা সেরিব্রাল শিল্পমাধ্যমকে সেই কাজে ক্রমাগত লাগিয়ে আসা হয়েছে। তার উচ্চকিত স্বর আজকের ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী জনমানসে যদি 'মেলোড্রামা' বলে প্রতীত হয় তবে তাকে কালের ধর্ম হিসেবে হয়তো ব্যাখ্যা করা যায়, কিন্তু অসম্মান করা যায়না।
    --------------------
    আজকের মানুষ একা, নিতান্ত একলা। তার নান্দনিক বোধও ব্যক্তিগত। ক্ল্যাসিসিস্ট তথা এপিক শিল্পকলার কোরাস তার কাছে শব্দদূষণ বোধ হতেও পারে। কিন্তু ঋত্বিক এবং মহাভারতকে একসঙ্গে উচ্চারণ করার পিছনে এই প্রক্রিয়াটিই কাজ করে। এই প্রজন্মের দর্শকের কাছে তিনি হয়তো রেফারেন্স মাত্র। কিন্তু প্রজন্মবিশেষের নির্দিষ্ট সময়্কালীন বিশ্লেষণের পালা পেরোবার পর আবার এপিকের কাছে ফিরে আসতে হয়। এই সত্যটি ঋত্বিক প্রমাণ করতে পারতেন। কিন্তু নিজের মুদ্রাদোষে তিনি সাফল্য থেকে নিজেকে বঞ্চনা করে গেলেন। আমরা গরিব থেকে গেলুম।
  • ঈশান | 202.43.65.245 (*) | ১৬ জুন ২০১৬ ০৫:১৩55367
  • প্রশ্নটা ঠিক মেলোড্রামা নিয়ে নয়। মেলোড্রামা একটি শৈল্পিক টেকনিক, বহু জায়গায় তার ব্যবহার আছে। আমরা দেশীয় যাত্রার কথা ভাবতে পারি। মানে যাত্রাপালা। সেখানে মেলোড্রামা হাজার হাজার দর্শককে ছুঁয়ে যায়। আমি ব্যক্তিগতভাবে গ্রামের ছেলে। দর্শকদের যাত্রা দেখে চোখের জল ফেলা স্বচক্ষে দেখেছি। পপুলার সিনেমাতেও মেলোড্রামার ব্যবহার আছে। 'গুরুদক্ষিণা' তে নায়কের উপর অত্যাচার (তাপস পাল ছিলেন সেই ভূমিকায়) দেখে অশ্রুমোচন, এবং বিবেকের ভূমিকায় নামা অ্যাংরি ইয়ংম্যানের ডায়ালগে হাততালি, সেও স্বচক্ষে দেখা। সেই ভূমিকায় মনে হয় রঞ্জিত মল্লিক ছিলেন। অনেক পরে কিছু তথাকথিত সমান্তরাল সিনেমায়ও প্রবল মেলোড্রামা দেখে নিজে, যাকে বলে টরেটম হয়ে গেছি। লার্স ভন ত্রারের কথা তো ভুলতে পারিনা। ডগভিলের একখানি স্টেজের উপরে সেই তীব্র প্রতিশোধ্হ, হাঁ করে দেখেছি। বা, ড্যান্সার ইন দা ডার্কের ফাঁসির দৃশ্যে, অবিকল আনপড় গুরুদক্ষিণার দর্শকের মতোই চোখে জল এসে গিয়েছিল। খুব সাম্প্রতিককালে হলিউডি সিনেমার মধ্যে দেখলাম, 'অগাস্ট, ওসেজ কাউন্টি'। কী মেলো কী মেলো, এবং, আহা মেরিল স্ট্রিপ। ফুলফর্মের জুলিয়া রবার্টসকেও সাধারণ মনে হচ্ছিল।

    অতএব, মেলোড্রামা কেন, এটা পয়েন্ট না। মেলোড্রামা কীভাবে সেটাই পয়েন্ট। আগেও গুরুতে লিখেছিলাম একবার। ঋত্ত্বিক একাধিকবার খুব সোচ্চারে জানিয়েছেন ফিল্ম কেন করছেন। বহু মানুষের কাছে পৌঁছতে চান, 'উন্নততর' শিল্পমাধ্যম বলে ইত্যাদি। অধিক কার্যকরী বা 'উন্নত' কিছু বেরোলে লাথি মেরে চলে যাবেন-টাবেনও বলেছিলেন। সেসবে আবেগের বাড়াবাড়ি থাকতে পারে, কিন্তু তিনি আপামর মানুষের কাছে পৌঁছতে চেয়েছিলেন, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর নন্দনতত্ত্বও ওই একই অভিমুখে ধাবিত। মেলোড্রামা, আদি মাতা, গণ অবচেতনা, ইয়ুং সবই সেই নন্দনতত্ত্বের অংহ। হিন্দি সিনেমার একটি ডায়লগ পরবর্তীতে খুব জনপ্রিয় হয়। 'মেরে পাস মা হ্যায়', যে ডায়লগে আমরা দেখতে পাই, তুমুল মেলো এবং মা কে নিয়ে সেন্টিমেন্টের আধিক্য। ঋত্ত্বিক এই জায়গাটা ধরতে চেয়েছিলেন, মেলো এবং 'আদি মাতা' মারফত। (অবশ্যই এই প্রতিতুলনাটা আমার, ঋত্ত্বিক কোথাও বলে যাননি)। মেলো থাকবে, 'মা' থাকবে, আপামর দর্শক উলুতপুলুত হবে আবেগে, এবং তিনি নিজের বক্তব্যটা বলবেন। 'প্যরালাল' কোনো শিল্পমাধ্যমের হোতা হবেন, এরকম কোনো চিন্তা সম্ভবত তাঁর দূর কল্পনাতেও ছিলনা।

    বলতে দ্বিধা নেই, এই জায়গাতে ঋত্ত্বিক অনন্য। তাঁর সমসাময়িক এবং বন্ধু সিনেমানির্মাতারাও অনেকেই এইরকম করে ভেবেছিলেন আন্দাজ করা যায়। মৃণাল সেনের প্রথম কয়েকটি (বোধহয় তিনটি সিনেমায়) তাঁর পরবর্তীকালের বহু আলোচিত 'দুর্বোধ্যত'র ইঙ্গিতমাত্র নেই। 'নীল আকাশের নীচে', সম্ভবত খুবই ভলো হিট করেছিল। সত্যজিতের পথের পাঁচালি রিলিজ করেছিল সাধারণ হলে, দর্শক হুড়মুড়িয়ে দেখেছিল। এগুলো খুবই স্বাভাবিক ছিল, কারণ 'প্যারালাল' বর্গটাই তখন তৈরি হয়নি। তাই এঁরা সকলেই পাতি পাবলিকের মনোরঞ্জন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পাবলিকের কাছে কীভাবে পৌঁছবেন তার কোনো ম্যানিফেস্টো বা গাইডলাইন বানাননি ভাবেনও নি। পরবর্তীতে হিন্দি সিনেমা তাই ওই স্পেসটা অনায়াসে দখল করে, সেটা, আরও অনেক কারণের সঙ্গে এই ফিল্মনির্মাতাদের ব্যর্থতাও মনে করি। কিন্তু সেটা অন্য প্রসঙ্গ। ঋত্বিক অনন্য, কারণ, তিনি সিনেমাকে পাবলিকের কাছে নিয়ে যাবার কথা ভেবেছিলেন। সেই লক্ষ্যে কাজ করেছিলেন। লেখালিখি করেছিলেন, থিয়োরাইজেশন করেছিলেন। বাকিদের মতো ঝপ করে 'প্যারলাল' এর খোপে ঢুকে পড়েননি। সেই জন্যই ওই মেলোর ব্যবহার, পরীক্ষা-নিরীক্ষা।

    এবংএই অনন্যতার কৃতিত্ব যেমন তাঁর সম্পূর্ণভাবেই প্রাপ্য, একই সঙ্গে এটাও উল্লেখ্য, যে, তাঁ এক্সপেরিমেন্টে তিনি সাফল্য পাননি। 'মেরে পাস মা হ্যায়' জনমানসকে যেভাবে ছুঁয়েছে, ঋত্বিকের মেলোড্রামাগুলি তার ধারেকাছেও পৌঁছতে পারেনি। একমত্র যুক্তি-তক্কো-গপ্পের টার্গেট অডিয়েন্স সম্ভবত আলাদা ছিল, কিন্তু তাঁর বাকি সব রিলিজ হওয়া সিনেমায় কোনো বোদ্ধাদের বা তথাকথিতভাবে দীক্ষিতদের টার্গেট করা হয়নি, লক্ষ্যবস্তু ছিল, সাধারণ দর্শক। এবং সেখানে ঋত্বিক চূড়ান্ত ব্যর্থ। ফলে তাঁর তত্ত্ব বা তার প্রয়োগ, বা দুটোতেই গোলমাল ছিল, এ নিয়ে সন্দেহের খুব বেশি অবকাশ নেই, যেমন সন্দেহের অবকাশ নেই তাঁর প্যাশন নিয়ে, উদ্যম ও ক্ষমতা নিয়ে। একমাত্র কোমল গান্ধারের 'দাদা আমি বাঁচতে চাই' কিছুটা অনুরণন তৈরি করতে পেরেছিল জনমানসে, বাকি কোনো কিছুই পারেনি। ঋত্ত্বিক সারাজীবন লড়ে গেছেন মানুষের কাছে পৌঁছনোর জন্য, সারাজীবন যুদ্ধ করে গেছেন, কিন্তু পাবলিক তাঁকে রিজেক্ট করেই গেছে করেই গেছে। ডন কিহোতেকে যদি একটি ট্র্যাজেডি হিসেবে পড়ি, তাহলে ঋত্ত্বিকের সঙ্গে তাঁর সাযুজ্য কিছু আপতিক নয়।

    বলাবাহুল্য, ঋত্ত্বিকের কোনো সাংকো পাঞ্জা ছিলনা। এখনও নেই। ঋত্ত্বিককে আজও যখন পাঠ করা হয়, তখনও তাঁর আমজনতার কাছে পোঁছনোর আকুতিটাকে বাদ দিয়েই পাঠ করা হয়। কারণ, সেটা করতে গেলেই ব্যর্থতার প্রসঙ্গটা চলে আসবে। বস্তুত আমজনতার কাছে পোঁছনো যে শিল্পের একটা অ্যাজেন্ডা হতে পারে, এটাই আপাতত হিসেব থেকে বাদ। ফলে ঋত্ত্বিকও শেষ বিচারে পুজোর ঠাকুর হয়েই থাকেন। প্রবল ক্ষমতাধন এক একক ও ক্ষতবিক্ষত যোদ্ধা হিসেবেই পূজিত হন। যেমন হন মহাভারতের কর্ণ। কিন্তু তাঁর নন্দনতত্ত্বের অভিমুখটি আলোচনার বাইরে থেকে যায়। মানুষের কাছে পৌঁছনোর আকুতি এবং তজ্জনিত ব্যর্থতাটুকু চাপা পড়ে যায় প্যারালালত্বের ধূপধুনোয়। তাঁর, আজও কোনো সাংকো পাঞ্জা নেই।
  • Rit | 213.110.242.8 (*) | ১৬ জুন ২০১৬ ০৫:২৭55368
  • অপূর্ব লাগছে পড়তে। চলুক চলুক। ঈশানদার পয়েন্টটা নিয়েও হোক।
  • ranjan roy | 24.98.209.127 (*) | ১৬ জুন ২০১৬ ০৬:০৩55369
  • ঈশানের কথা প্রসঙ্গে দুটো কথাঃ
    ১) সম্ভবতঃ মনোহরশ্যাম যোশীই শুনিয়েছেন যে দাদা বলতেন-- আমার সিনেমার ক্র্যাফটের সমস্ত পাঠ ওই তোমরা যাকে বি-কেলাস সিনেমা বল তার থেকে শেখা।
    ২) আর সিনেমার জনরঞ্জনী মন্ত্র তাঁর জানা ছিল। তাই মুম্বাইয়া ফিল্মের বাজারে সবাই জানত যে দাদা যদি কারও স্ক্রিপ্ট একটু মেজে ঘষে দেন, তাহলে সেটা হিট হবেই। যদিও উনি এই কাজ পয়সার বিনিময়ে করতে চাইতেন না। ভাগিয়ে দিতেন। সফল পরিচালকদের উনি ব্যঙ্গ করতেন। হেরে যাওয়াদের জন্যে তাঁর ছিল অপরিসীম কারুণ্য ও ভালবাসা।
    ওর মটো যেন আমি রব নিষ্ফলের হতাশের দলে।
    ২) ওঁর দুটো ফিল্ম বোধহয় জনসমাদর পেয়েছিল।
    "মেঘে ঢাকা তারা" ( দাদা, আমি বাঁচতে চাই) আর সুবর্ণরেখা।
    ৩) একটা ট্রিভিয়া। ৫০ এর দশকের প্রদীপকুমার বৈজন্তী অভিনীত হেমন্তের সংগীতে মোহিত সুপারহিট ফিলিমের নাম "নাগিন" ( মন ডোলে রে)। তবে তার স্ক্রিপ্ট রাইটারের নাম পর্দায় দেখেছি 'বিজন ভট্টাচার্য'-- ঋত্বিকের ঘনিষ্ট সুহৃদ।

    আমার মনে হয় ঋত্বিকমানসের ক্ষমতা ও তাচ্ছিল্য, সাফল্যের স্বপ্ন দেখা ও অগোছালো হেলাফেলা ভাব যা একসময়ে ওঁকে বারকয়েক মেন্টাল হসপিটালে যেতে বাধ্য করেছিল এবং ৬০ এর দশকের শেষে পদ্মশ্রী বিবাদ ও গান্ধীজিকে শূকরশাবক বলা -- এর খোঁজে আমাদের ওঁর সিনেমার স্টাইল বা শৈলীর দ্বন্দ্ব ছাড়াও আমাদের যেতে হবে তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির নান্দনিক বিষয়ে গুরুঠাকুরগিরি (কোমলগান্ধার ?) ও পিসি যোশীকে তাঁর লেখা চিঠিতে যা খানিকটা প্রকাশিত।
    এছাড়া ওঁর দুটি নাটক-- 'সাঁকো' ও 'জ্বালা' এ ব্যাপারে খানিকটা আলো ফেলতে পারে।
  • ঈশান | 214.54.36.245 (*) | ১৬ জুন ২০১৬ ০৬:১৬55370
  • এ বাবা। আমি মেঘে ঢাকা তারা কে কোমল গান্ধার লিখেছি। সরি সরি।
  • শিবাংশু | 127.214.68.238 (*) | ১৬ জুন ২০১৬ ০৬:২২55371
  • ঈশানের সঙ্গে একমত। 'মেলো' একটি কার্যকরী প্রয়োগকৌশল। অবশ্যই ব্যবহারের উপর নির্ভরশীল। তবে সাহেবরা যেমন বলেন, 'উত্তম ভৃত্য, নিকৃষ্ট প্রভু।' এটাও মানি, ঋত্বিক 'মেলো'কে সামলাতে পারেননি। "মেরে পাস মাঁ হ্যাঁয়" টাইপ সামলানোর বাণিজ্যিক অনুশাসন, হয় তাঁর আয়ত্ব ছিলোনা, নয় তিনি তাকে এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন। কিন্তু দর্শকের কাছে পৌঁছোনোর আকাঙ্খা তাঁর চিরকাল জাগরূক ছিলো। সত্যি কথা বলতে কি সাংকো পাঞ্জা তৈরি করতেও যে পরিমাণ পরিসর লাগে, তাও তিনি অবহেলা করে গেছেন।
    -------------------
    তবে যখনই ঋত্বিকপ্রসঙ্গ ওঠে, 'মেলো'র বাড়াবাড়ির অভিযোগ পিছন পিছন আসে। আমার মনে হয় সেটা মেলো টেকনিকের দোষ নয়, ঋত্বিকের নিজের দোলাচল সমস্যা। আজ আমরা যখন আলোচনা করতে বসি, ঋত্বিক যা হইয়াছিলেন, তা নিয়ে কম কথাই হয়। তিনি যা হইতে পারিতেন, সেটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। আমি এই ট্র্যাজেডিটির সন্ধান করতে চেয়েছিলুম। মনে হলো, ঋত্বিক ধীরে ধীরে নিজস্ব অহমজনিত মুদ্রাদোষের আবেগে কাতর হয়ে পড়েছিলেন। শিল্পের অনুশাসনের সঙ্গে ট্রেড অফে তাঁর তুমুল আবেগ হেরে গিয়েছিলো। এখানেই ঋত্বিকের প্রতিকৃতির উপর কর্ণের রথের চাকার প্রতিবিম্বটি সুপারইম্পোজ হয়ে যায়।
    -----------------------------
    এসব তাবৎ প্রসঙ্গ সত্ত্বেও আমাদের শিল্প ইতিহাসে ঋত্বিক একটা অনন্য পর্যায়। তবে মনে রাখতে হবে, তাঁকে 'পুজোর ঠাকুর' করতে চাওয়া একটি বিপর্যয়মাত্র। আর কিছু করতে না পারি, এই অসম্মান থেকে তাঁকে দূরে রাখার চেষ্টাটি যেন জারি থাকে।
  • Anindya Sengupta | 154.48.224.72 (*) | ১৬ জুন ২০১৬ ০৭:০৮55372
  • মেলোড্রামা অবধারিত ছিল - শিবাংশু '৪৭ থেকে '৭৭-এর যে ইতিহাসটার কথা বলছেন সেটাকে নিয়ে মেলোড্রামা ছাড়া আর কিছু হতে পারেনা - অর্থাৎ আমি যেভাবে বুঝছি - অতিরিক্ত আবেগ যা অব্যক্ত ইতিহাসের কথা বলবে। রাজনৈতিক ছবি দুইভাবে আসতে পারে - বাস্তববাদী যুক্তি দিয়ে এবং মেলোড্রামা দিয়ে। আমাদের এখানে এই দুটি পন্থাই অধুনা বিপর্যস্ত বলে রাজনৈতিক ছবি নেই বলেই মনে করি (কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সের ছবি প্রচূর আছে)।
    'দীওয়ার'-এ যেভাবে ব্রাত্য পিতা ট্রেনে ফিরে আসেন এবং মারা যান - তার সাথে 'সূবর্ণরেখা'-র মিল আছে দেখেছেন নিশ্চয়ই, অভিরামের মা'য়ের দৃশ্যে - অর্থাৎ এই পপুলার ফর্মটিই ঋত্বিক কাজে লাগাচ্ছিলেন; তিনি জানতেন মেলোড্রামায় কি হয়, মেলোড্রামা কি পারে।
    ওনার ব্যর্থতা - জানি না। ব্যর্থ বলে তো মনে হয়না। এমনকি আমার বাড়াবাড়িও মনে হয়না, সেটা যদি ফর্মের অন্তর্গত হয় বাড়াবাড়ি হবে কি করে? আমার এক বন্ধু ডিসার্টেশন করেছিলেন যেখান থেকে বোঝা যাচ্ছিলো যে ওনার সম্পাদনা ইত্যাদির 'ভুল'গুলোও ডিজাইনের অংশ।
    'মেঘে ঢাকা তারা' হিট হয়েছিল, কিন্তু ভুল কারণে মনে হয় (সেটা এখানে বিশদে বলা যাবে না)। 'কোমল গান্ধার'-এর অসাফল্য আমার একটু অদ্ভূত লাগে। আর 'সূবর্ণরেখা'-র মত নিষ্ঠুর ছবি তো দুটো হয়না। ওটায় হিট হতই না, যে কারণে 'অপরাজিত' বক্স অফিসে ব্যর্থ হয়েছিল।
    ডন কিহোতে না, আমার মনে হয় উনি ল্যাজারাস ছিলেন :)
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত মতামত দিন