এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • পীরেন স্নাল

    Muhammad Sadequzzaman Sharif লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০২ জানুয়ারি ২০১৯ | ৪৩৭২ বার পঠিত
  • আজকে ৩ জানুয়ারি। পীরেন স্নালের মৃত্যুবার্ষিকী। প্রশ্ন হচ্ছে পীরেন স্নাল কে? কোন দোষ নাই পীরেন স্নাল কে না চিনলে। কারন আমরা একটু বেভুলা জাতি আছি তা আমারা তো জানিই। পীরেন স্নালের কথা বলছি, আগে একটু দুইটা কথা বলে নেই।

    ধরুন আপনার বাড়ির উঠোনে কি হবে না হবে তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে আপনার বাড়ি থেকে কয়েকশ মাইল দূরে। পরিকল্পনায় আপনার বাড়ি ভেঙ্গে তেঁতুল গাছ লাগানর সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, কোন পাসে হয়ত বলা হচ্ছে নাটকের জন্য মঞ্চ বানাবে, কেউ হয়ত বলছে একটা উন্নত মানের বাথরুম কিন্তু রাখবেন দয়া করে! সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, আপনার ঘর, আপনার বাড়ি, আপনার জমি কিন্তু একবারের জন্য আপনার সাথে কেউ কথা বলল না বা বলা যে দরকার তাও চিন্তা করল না কেউ। পরিকল্পনা করে সোজা আপনার বাড়িতে হাজির লোকজন, বাড়ি ছাড়তে হবে, এখানে সরকারের উন্নয়ন হবে! খুব অবাস্তব, অতি কল্পনা হয়ে যাচ্ছে? কিসছু না, ২০০৪ সালে এমন কাজও করা হয়েছিল। শুধু ২০০৪ না, যাদের জমি নেওয়ার কথা বলছি তাদের কে কোন দিনই হিসেবে ধরে কোন কাজ করা হয়নি, জাস্ট ছুড়ে ফেলা হয়েছে বাড়ির উঠোন থেকে, কোন ওজর আপত্তি কাজে দেয়নি।

    ২০০০ সাল বন বিভাগ পরিকল্পনা করে মধুপুরে ইকো পার্ক বানানোর। বিশ্ব ব্যাংক থেকে আর এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক থেকে সবুজ বাতি পাওয়ার পরই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে টাঙ্গাইলের মধুপুরে যে শালবন আছে তাতে একটা ইকো পার্ক বানানো হবে। ১০ টা পিকনিক স্পট, ৬ টা ব্যারাক বানানো হবে। ব্যাপক কর্মযজ্ঞ, প্রচুর টাকা পয়সার মামলা, উৎসাহী লোকজনের অভাব নেই। ৪৭৮ বর্গ কিলোমিটার ব্যাপী শালবন পুরোটা ঘিরে ফেলে এই ‘ইকো’ পার্ক বানানো হবে। কিন্তু যারা কয়েকশ বছর ধরে সেখানে বাস করছে, দুই আড়াই হাজার মান্দি আদিবাসীদের কথা কেউ একবার ভাবল না। তাদের সাথে একবারের জন্যও আলোচনার বসার চিন্তা কেউ করে নাই।

    আদিবাসীরা তাদের গৃহহারা হওয়ার শঙ্কায় আন্দোলনে নামে।পীরেন স্নাল সেই আন্দোলনের নেতা। আন্দোলন তীব্র হয়, কোনমতেই শেকড় ছিঁড়তে রাজি না তারা। ২০০৪ সালের আজকের দিনে মানে ৩ জানুয়ারিতে বনরক্ষীরা গুলি ছুড়ে আদিবাসীদের লক্ষ করে। মারা যায় পীরেন স্নাল। নিজের ন্যায্য অধিকারর আদায়ে প্রাণ দেয় পীরেন স্নাল। বুকের রক্তে বলসালব্রিংয়ের মাটি লাল করে শহীদ হন জয়নাগাছা গ্রামের যুবক পীরেন। আহত হন উৎপল, রিডা, রহিলা, বিনমাংসা, পিছিলনের মতো আরও অনেকেই। শান্তিপূর্ণ মিছিলে এই অতর্কিত গুলি করে পীরেন স্নালের হত্যার বিচার আজো হয়নি।

    পীরেন স্নালের রক্তের বিনিময়ে তখন সরকার বাতিল করে ইকো পার্ক কার্যক্রম। কিন্তু ওই আন্দোলনের মামলায় জড়ান হয় কয়েক হাজার আদিবাসীকে। সেই মামলা চলে দিনের পর দিন। আদিবাসীরা নিজের ভিটে মাটির অধিকার নিবে কী মামলা সামলায়েই উঠতে পারে না। ২০০৭ সালের ১৮ এপ্রিল তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যৌথ বাহিনী চলেশ রিসিল কে ধরে নিয়ে যায়। ক্রসফায়ারে মারা যায় চলেশ রিসিল।মরেও রক্ষা পায় না রিসিল। মামলায় ‘গরহাজির’ থাকায় আদালত তাঁর বিরুদ্ধে সমন জারির মত কাণ্ডও করেছিল।!

    ইকো শব্দের অর্থ ভুলে খেয়ে ইকো পার্ক করার পরিকল্পনা করে সরকার। যে ইকো পার্কার জন্য মানুষকে তার বসত থেকে উচ্ছেদ করতে হয় তা আবার কেমন ইকো ব্যবস্থা? বিশ্ব ব্যাংকের টাকা পেলেই বোধহয় এমন পরিকল্পনা করা সম্ভব!
    উন্নয়নে নাম শুনলে এখন আদিবাসীরা আতঙ্কে আঁতকে উঠে। উন্নয়ন মানে যদি নিজের ভিটে মাটি ছাড়া হয় তাহলে আতঙ্কে আঁতকে না উঠে উপায় কী? শুধু মধুপুর না। সরকার উন্নয়ন করতে চেয়েছে জমি নিয়ে নেওয়া হয়েছে আদিবাসীদের কাছ থেকে।জাতীয় উদ্যান বানানোর সময় নেওয়া হয়েছে, সেখানকার আদিবাসীরা কোথায় গিয়ে হারিয়ে গেছে তা বোধহয় এখন আর কেউ বলতেও পারবে না। এভাবে ঠেলে ঠেলে তাদের কে আমাদের চোখের আড়ালে পাঠিয়ে দিয়েছি আমরা। আদিবাসীদের একটু আড়ালে, একটু দূরে, বন জঙ্গলের ফাঁকে, সমস্ত সুবিধা থেকে দূরে দেখতেই আমরা অভ্যস্ত। দেশের জন্য যুদ্ধ করেও তারা সঠিক সম্মান কোনদিন পায়নি বা আমরা দিইনি। সত্য হচ্ছে আমরা আদিবাসীদের সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি উদাসীন। একটা দুইটা নাম আমরা জানি, তা জানি তখন যখন একটা ঘটনা ঘটে তারপরে। এর আগে পরের ইতিহাস আর জানা হয় না আমাদের। দুই দিন খুব করে মনে করি আমরা যারা নিজেদের একটু সভ্য মনে করি, মনে করি আমরা খুব সাম্য পছন্দ করি, সবার সমান অধিকারে বিশ্বাস করি বলে মনে করি তারা। তারপর আমাদের ক্রিকেট এসে যায়, ঈদ এসে যায় আমরা বেমালুম ভুলে যাই তাদের কথা। আদিবাসীদের এই বিলাসিতার সুযোগ কই? দিনের পর দিন তারা বাস কর আতঙ্কে। আমরা কিছু নাম জানি, কল্পনা চাকমা, পীরেন স্নাল, চলেশ রিসিল বা আলফ্রেড সরেন। কিন্তু এদের হত্যার বিচার চেয়ে আন্দোলন করতে দেখা যায় শুধু আদিবাসীদেরই, আমরা তখন মনে প্রাণে বাঙ্গালী!

    পীরেন স্নাল কে নিয়ে আদিবাসী ব্যান্ড মাদলের অদ্ভুত সুন্দর একটা গান রয়েছে। রক্ত গরম করে দেওয়া এই গানেই সম্ভবত সমস্ত কথা বলে দিয়েছে তারা। গানের কথা গুলো নিচে থাকল। আর থাকল মৃত্যু দিবসে পীরেন স্নালের প্রতি শ্রদ্ধা। আমরা যারা জাদুঘরে আদিবাসী দেখতে চাই, যারা পিকনিকে গিয়ে আদিবাসী নারীদের দিকে অবাক দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থাকি, যারা হালকা দুষ্টামি কে নিজেদের অধিকার বলে মনে করি তাদের জন্য পীরেন স্নালের মত মানুষের মৃত্যু বার্ষিকীতে শ্রদ্ধা জানানো ছাড়া আর কি করতে পারি! অবশ্য আমাদের থেকে একটু উন্নত প্রাণী যারা তারা আরও একটু বেশি কিছু করেন। তারা তীব্র প্রতিবাদ জানান, ৩ জানুয়ারিতে প্রতিবাদ সমাবেশ করেন, কড়া ব্যক্তিতা দেন, তার পর নেমে আসেন আমাদের কাতারে, অর্থাৎ আমাদের মতই বেমালুম ভুলে হারিয়ে যান আমাদের মাঝে।প্রতিবাদী পীরেন স্নাল আমাদের মত বেহুঁশ মানুষদের জন্য বাঁচার রাস্তা, পীরেন স্নাল সমস্ত অসহায় অত্যাচারিত মানুষের জন্য প্রেরণা। পীরেন স্নাল নামটা শক্তি জুগিয়ে যাক সকল নিপীড়িতদের।

    পীরেন স্নাল
    কথা ও সুর - মাদল
    পাখির স্বভাব পাখির মত উড়বে বলে
    বন পাহাড়ে উড়ে ঘুরে গায়বে বলে
    লাল সে মাটির গন্ধ বুকে পুষবে বলে
    সবুজ মায়ার বাধন অটুট রাখবে বলে
    শাল বৃক্ষের মতন শিনা টান করে সে
    মানুষ হয়ে বাঁচতে পীরেন জান দিয়েছে।

    এই বন যে আমার মাগো আমি তারই ছেলে
    অবাধ চলন বলন আমার তারই কোলে
    এই বন যতদূর ঠিক তত দূর আমার বাড়ি
    এই মাটিতে পোতা আছে আমার নাড়ি
    সেই নাড়ি ধরে কারা যেন টান দিয়েছে
    তাই রুখতে পীরেন স্নাল জান দিয়েছে।

    তারা উন্নয়নের নামে দেখ দেয়াল তোলে
    তারকাটাতে ভিন্ন করে মা আর ছেলে
    এত দিনের জীবনবোধে হানলো কারা
    মায়ের ছেলে হোশ যদি রে রুখে দাঁড়া
    সেই প্রাণের ডাকে প্রাণ মেলাতে ছুটে গেছে
    দামাল ছেলের রক্তে মায়ের বুক ভেসেছে।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০২ জানুয়ারি ২০১৯ | ৪৩৭২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি প্রতিক্রিয়া দিন