এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  বইপত্তর

  • গভীর নির্জন পথে

    Indrani
    বইপত্তর | ১৪ জুন ২০০৭ | ৪৭৭০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • d | 122.162.104.114 | ১৫ জুন ২০০৭ ১০:৫৭389788
  • না বলে পারলাম না .... ইন্দ্রাণী কি করে চালিয়ে যাবে? এই বইটি সম্পর্কে ওর বক্তব্য তো শেষ। এরপরে টানতে গেলে ইল্যাস্টিকের মতন টেনে লম্বা করতে হয়।

    অন্য বই নিয়ে বা ইন জেনেরাল এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করলে অসুবিধে কিছুই নেই অবশ্যই। তবে সেটায় আরো কয়েকজনেরও যোগ দেওয়া দরকার। তাছাড়া ওর হাতের কাছে সব বইপত্র আছে কিনা সেটাও একটা প্রশ্ন।

    এখানেই রঙ্গন, দীপ্তেনদা, কল্লোলদা, ইন্ডো, ইন্দ্রাণী সবাই মিলে অন্যান্য বইয়ের রেফারেন্স টেনে বা নিজস্ব অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা মনোজ্ঞ আলোচনা করতেই পারেন। অত্যন্ত উপভোগ্য আলোচনা হবে সেটা। কিন্তু এই একটি বই নিয়ে আর টেনে বাড়ানো সম্ভব নয় --- এটা আমার মত।
  • S | 61.95.167.91 | ১৫ জুন ২০০৭ ১১:১৪389789
  • একদম একমত। বইয়ের আলোচনাটা যে শেষ হয়ে গেছে, সেটা টোটালি চোখ এড়িয়ে গেছিল। পরিষ্কার লেখাই আছে বটে।
  • kallol | 192.77.110.18 | ১৫ জুন ২০০৭ ১৮:২০389790
  • তিনটে ঘটনা খুব দাগ কেটেছিলো।
    এই বাউল-ফকিরেরা অন্য জগতের মানুষ। এঁরা অনায়সে যা পারেন, তা আয়ত্ত করতে আমাদের সারাজীবন কেটে যায়। চেষ্টা করি........ এ জম্মে বাউল হওয়া যাবে না, সেটা সার বুঝে গেছি।

    ভালো লাগে না
    আমার আর ভালো লাগে না
    অর্থহীন এই জীবনযাপন ভালো লাগে না
    এই শহর এই বাড়ি গাড়ি
    সব সময়েই তাড়াতাড়ি
    সারাক্ষণই দোকানদারি ভালো লাগে না

    এখানে ঘাস ঢেকেছে কংক্রিটে
    আর আকাশ ঢাকা অ্যান্টেনাতে
    কিশোরবেলার স্বপ্নগুলো
    ঝুলছে কেবল টিভির তারে
    উঁচু উঁচু বাড়ির মাঝে লক্ষ টাকার কয়েদখানায়
    জোছ্‌না কোথায় হারিয়ে গেছে......
    তাই ভালো লাগে না

    হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে তালবাগিচার তেপান্তরে
    অশথতলায় পুকুরঘাটে, সর্ষেক্ষেতের হলুদ মাঠে
    ফিঙ্গে ডাকা দুপুরবেলায় বাউল গানের পিছু পিছু
    হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে.......

    যাওয়া হলো না
    আমার আর যাওয়া হলো না
    আমারও তো বাঁধন আছে
    শরীর জুড়ে বাঁধন আছে
    ছিঁড়তে গেলে সেই বাঁধনই
    বুকের ভিতর ভীষণ বাজে
    তাই যাওয়া হলো না
    আমার আর যাওয়া হলো না

    ভালো লাগে না, আমার আর ভালো লাগে না।

  • kallol | 192.77.110.18 | ১৫ জুন ২০০৭ ১৯:০৯389791
  • ১৯৭৭-৭৮ সাল।
    তখনও চাকরী-বাকরী করি না। টিউশনিতেই চলে। কালিঘাট-কেওড়াতলা-রাসবিহারী অঞ্চলে রাজনীতি করছি। আর তার সাথে চলছে গানের পিছু পিছু পথ চলা। কোথায় পঞ্চাদা কাকদ্বীপে ধ্রুপদী গানবাজনার আসর বসিয়েছে। দীপকদা (পন্ডিত রবিশংকরের ছাত্র, দীপক চৌধুরী) বাজাবে, চালাও পানসী...... কোথায় সতীমায়ের মেলায় ষষ্ঠী ক্ষ্যাপা গাইবে, চল পাগলা.......। তেমনই সুযোগ জুটে গেলো, বাঁকুড়ার সোনামুখীতে সনাতন গোঁসাইয়ের আখড়ায় যাবার। ও: সে এক সময়। সকাল-বিকাল মা গোঁসাইয়ের হাতের কুমড়োর তরকারী আর ভাত, আর সারা দিন সারা রাত গান। সে যেন গানের ঝর্ণায় স্নান করে শুদ্ধ হওয়া। রোজ ভোরে সনাতন আর তার প্রায় জনা কুড়ি শিষ্য শিষ্যা রাই জাগো রাই জাগো গাইতে গাইতে বের হয়। গোটা তিনেক গ্রাম গান গাইতে গাইতে ঘুরে যখন আখড়ায় ফেরে তখন বেশ কিছু কলাটা-মূলোটা জুটে গেছে। আমি গানের টানে ওদের সাথে বের হয়ে বড় অতান্তরে। এতো ভিক্ষে করা। আমার মার্ক্সিস্ট মন বিদ্রোহ করে। সনাতনকে গিয়ে ধরি। ভিক্ষে কর কেন? খেটে খাও না কেন? এমন সব প্রশ্ন। সে হাসে। বাললো
    - বলতো, পৃথিবীতে কত মানুষ আছে?
    - অনেক। হাজার হাজার কোটি কোটি।
    - তার মধ্যে কত মানুষ গান গায়?
    - তা তো জানি না
    - কত হবে, দুকোটি, তিন কোটি?
    - না হয় তাই। তো?
    - তার মধ্যে কত মানুষ এই তোর আমার মত গান গেয়ে বেড়ায়?
    - কত আর হবে, লাখ দুই কি তিন।
    - হ্যাঁ, এইবার ভাব পৃথিবীর এই হাজার হাজার কোটি কোটি মানুষের মাত্র লাখ কয়েকের তুই একজন। কেমন গর্ব হয় না?
    - তা তো হয়।
    - ব্যাস, তোর হয়ে গেলো। তোকে অহং-এ পেলো। তোর দ্বারা আর কিচ্ছু হবে না।
    - এই দ্যাখো। তুমি তো শালা মাথায় ঢোকালে। এখন কাটান কি?
    - ঐ তো। ভিক্ষে করবি। রোজ তিনজনের কাছে ভিক্ষে করবি। পয়সা চাইতে হবে না। চা খেতে চাইবি, সিগারেট, নিদেন দুটো বিস্কুট।
    - তাতে কি?
    - তাতে সবার কাছে মাথা নীচু করতে শিখবি। তোর অহং মরে যাবে।
    আমার মার্ক্সিস্ট মন লজ্জায় মিশে গেলো আখড়ার মাটিতে।
    আজও তার কথা মেনে চলি।
    অহং মরেছে কি না জানি না। তবে চেয়ে কোনোকিছু নিতে বড় শান্তি লাগে।
  • I | 172.214.97.241 | ১৫ জুন ২০০৭ ১৯:৫০389792
  • এই দু:খের দোসর মিলল না।
  • I | 172.214.97.241 | ১৫ জুন ২০০৭ ১৯:৫৯389793
  • লিয়াকত আলি। নকশাল আন্দোলন ফেরত। এখন বাউল জীবন-যাপন করেন, সাধন-সঙ্গিনী এক বাউলানী। এঁর কথা এবং এঁর লেখা সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত "বাংলার বাউল-ফকির ' বইতে আছে।
    কল্লোলদার লেখায় মনে পড়ে গেল।
    কেউ কেউ পারেন, হারিয়ে যেতে। আমি সে নই, আমি সে নই।
  • a | 155.201.35.50 | ১৫ জুন ২০০৭ ২০:০৭389794
  • ইন্দ্রাণী দি, অসাধারণ।
  • I | 172.214.97.241 | ১৫ জুন ২০০৭ ২০:১০389795
  • বাউলদের কাছ থেকে দেখিনি, কল্লোলদা যেমন দেখেছেন। তবে লেখাপত্তর পড়ে এবং স্বাভাবিক বুদ্ধিতে মনে হয়, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীর রোম্যান্স দিয়ে যেমন বুঝি, বাউলের আসল জগৎ পুরোপুরি তেমন নয়। হায়, সেখানেও "আছে লালসার দাঁত, লোভের বিকট জিহ্বা, প্রভূত্বের লোমশ আঙুল।'
    নারী সেখানে দশ হাতে ফেরে, না সকলেই নয়। বাউলপন্থার প্রথাবিরোধী যৌনতার এ এক অনাকাঙ্খিত কিন্তু স্বাভাবিক জাতক।

    লীনা চাকীর "বাউলের চরণদাসী' পড়লে কিছু আন্দাজ পাওয়া যায়।
  • kali | 160.36.241.76 | ১৫ জুন ২০০৭ ২০:১৩389796
  • খুব ভালো লাগছে এই আলোচনা। চলতে থাকুক।
  • kallol | 192.77.110.18 | ১৫ জুন ২০০৭ ২০:৫২389798
  • সবেরই ভালো-খারাপ আছে। লীনা চাকী যেমন দেখেছেন সেটা সত্যির একটা দিক। দরকারে সাধন সঙ্গীনী পাল্টানোর অধিকার সাধকের আছে। এর সুযোগ নিয়ে লালসামত্ত হয়ে একের পর এক নারী সঙ্গ যে সাধক(?) করে চলে, সে কি প্রকৃত সাধক? মানুষে চুরি করে বলে মানুষমাত্রেই চোর-একথা বলার মানে আছে কি? আমি বহু বহু সাধককে দেখেছি যাঁরা সাধন সঙ্গীনীকে তার প্রকৃত মর্য্যাদা দিয়ে থাকেন।
    আবার অন্য দিকও আছে। নারী এখানে শুধুই সাধন সঙ্গীনী, সাধনার অধিকার তার নেই। পুরুষতন্ত্র কাজ করে। গগন বলেন বটে নারীই গুরু, কিন্তু নারীর তো সাধনারই অধিকার নেই, সে গুরু হবে কি করে? এ যেন নারীকে মানস গুরুর আসনে বসিয়ে তার কাছ থেকে শিখে নেওয়া। অর্থাৎ নারীর শিক্ষাদানের যোগ্যতা নেই, কিন্তু তার থেকে শেখার আছে, তাই তাকে পরোক্ষ গুরুর আসনে বসিয়ে সাধক শিখে নেন যা ""তার'' ""শিক্ষণীয়''।
  • kallol | 192.77.110.18 | ১৫ জুন ২০০৭ ২১:২৮389799
  • ১৯৯১ সাল।
    কালাচাঁদের ক্যাসেট বের হয়েছে। উৎপল (পরে উৎপল ফকির নাম নেয়, যার সহধর্মিনী আজকের ""সহজ মা'') আর তার বন্ধুরা মিলে এই ক্যাসেটটা বার করে। সেবার বই মেলায়, হৈ হৈ করে আমরা কালাচাঁদের ক্যাসেট বিক্রি করছি। কালাদা নিজেও হাজির। মাঠে বসে গান চলছে ধুন্ধুমার। কালাদা গাইছে, আমি গাইছি, উৎপল গাইছে, এক ফাঁকে স্বপনও এসে গেয়ে গেলো। একদিন মনিদা (মহীনের ঘোড়াগুলির গৌতম) আর পবন এলো। সে এক হৈ হৈ রৈ রৈ কান্ড। লোকে ক্যাসেট কিনছে ভালই। একদিন মাঠে ওরকম গান চলছে। কালাদা গাইছে - মানুষকে যে ভালোবাসে/বড় ভালো ভাগ্য তার..... এমন সময় কয়েকজন ছেলে মেয়ের একটা দল গান শুনে কালাদাকে বললো - আপনার ক্যাসেট কাল কিনেছি, খুব ভালো লেগেছে....... কালাদা হাঁ হাঁ করে উঠে বললে
    - কার ক্যাছেট কিনছ?
    - কেন আপনার।
    - আমার আবার ক্যাছেট হৈলো কবে!
    - কেনো এই যে বিক্রি হচ্ছে ?
    - আরে ধুর সে অন্য কালাচাঁদ।
    - বলেন কি?
    - আর কি বলি, সেও এইসব গানই গায়।
    গোটা দলটা কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চলে গেলো।
    আমি বললাম - এটা কি হলো!!
    কালাদা বললে - অত আত্মপ্রশংসা শোনা পাপ।
    কালাদার পায়ের নখের যুগ্যিও যদি কখনো হতে পারি.......
  • I | 172.206.98.166 | ১৫ জুন ২০০৭ ২৩:১৭389800
  • কল্লোলদা, আরো শোনান।
  • kallol | 192.77.110.18 | ১৬ জুন ২০০৭ ১২:৪৪389801
  • ১৯৯৭ কি ৯৮ সাল।
    কাজ সেরে ফিরছি মীরগঞ্জ থেকে। মীরগঞ্জ হলো উত্তর বিহারের মফ:স্বল শহর। লালু-রাবড়ির বাড়ি গোপালগঞ্জের পাশেই। ট্রেন ধরতে হয় সিওয়ান থেকে। আগে লোকে সিওয়ান বলতে জানতো প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদের দেশ। এখন লোকে চেনে লালুর পোষা মাফিয়া সাহাবুদ্দিনের নির্বাচনী ক্ষেত্র হিসাবে।
    ট্রেনে উঠে দেখি কামরায় লোক থিকথিক করছে। কি ব্যাপার, না কোনো এক বাবা যাচ্ছেন। তার ভক্তবৃন্দ তাকে টাটা করতে এসেছে। ঠেলেঠুলে আমার সিটে পৌঁছে তো আক্কেল গুড়ুম। আমার উল্টোদিকের সিটে লম্বা হয়ে শুয়ে আছেন এক বৃদ্ধ, কালো আলখাল্লায় ঢাকা তার দেহযষ্টি অতিব শীর্ণকায়। ভাঙ্গা গালে উদাস করা বুক ঢাকা পাকা দাড়ি। মানানসই লম্বা সাদা চুল মাথার বালিশের ওপর ছড়িয়ে। দু হাত বুকের উপর ভাঁজ করা। এক হাতে তসবী মালা জপে চলেছেন। অন্য হাত মাঝে মাঝে ভক্তের উদ্দেশে বরাভয় মুদ্রায় উঠছে। আঁখি পল্লব নিমিলিত।
    ট্রেন ছাড়ার পর ভিড় কমলো। উনি আমার দিকে তাকালেন এবং বহু যুগের ওপার থেকে বলে উঠলেন - বেটা তকলিফ কে লিয়ে মওয়াফ করনা। ব্যস সব বিরক্তি, সব অসাচ্ছন্দ এক লহমায় কোথায় যে পালালো, আর আসানসোল পর্যন্ত তার তার পাত্তা পাওয় গেলো না।
    আমি কোনোমতে জবাব দিতে পেরেছিলাম - বেটা মান লিয়ে, ফির আপ বুজুর্গ হোকে মওয়াফি মাঙ্গকে শর্মিন্দা না করে।
    আমার ওরকম ভয়ানক ঊর্দু শুনেই হোক, বা ঐ ভাঙ্গা চোরা জবানের ভিতরের আন্তরিকতা ছুঁতে পেরেই হোক, মানুষটি উঠে বসে আমার মাথায় হাত রাখলেন, তারপর পরিস্কার বাংলায় বললেন - বড় ভালো ছেলে। আমি সম্মোহিত বললেও ঠিক বোঝানো যাবে না।
    জমে গেলো। ওনার নাম বাবা ভোলা শাহ। বার্ণপুরে ওনার ঠাকুর্দার মাজারে থাকেন। মাঝে মাঝে পূর্ব উত্তর প্রদেশ আর উত্তর বিহারে ভক্তদের ডাকে আসেন।
    প্রায় সারারাত জেগে প্রচুর তঙ্কÄকথা হলো। কপাল ঠুকে সাহস করে গান শোনালাম। বুড়ো তরর। বহুবার ওনাকে শুতে বললাম। সে খালি বলে গান গাও। অত রাতে অন্য যাত্রীদের অসুবিধা হবে ভেবে যতটা নীচু গলায় গাওয়া যায় গাইছিলাম। বুড়ো বলে - আরে বেটা আশে পাশে সব আমার লোক, গাও গলা ছেড়ে গাও। অমন করে গান আর কখনো গাইতে পরবো কি না জানিনা। গানে আর কথায় ভোর হলো। আসানসোল আসছে। বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন - দেখা হবে। আমি বললাম - কেমন করে। তুমি কলকাতায় যাবে কি? আমি কবে বার্ণপুর যেতে পারবো কি জানি। হাসলেন। তারপর আবার বুকে জড়িয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন - সামনা সামনি দেখা হলেই দেখা হয়? তুই আমার কথা ভাববি, আমি তোর কথা ভাববো - দেখা হয়ে যাবে।
    আজও এ পরবাসে, আমার সব বন্ধুর সাথে এভাবেই দেখা হয়, কথা বলি।
  • LCM | 24.4.0.122 | ১৬ জুন ২০০৭ ১৪:১৫389802
  • interesting সাধুবাবা তো !
  • S | 122.162.82.7 | ১৬ জুন ২০০৭ ১৬:৪৮389803
  • তিনটে গল্পই কল্লোলদা করেছিল আমার কাছে, দিল্লিতে প্রথম দেখা হবার দিনে। ট্রেড ফেয়ারের লাগামছাড়া ভিড়ে সেদিন পা কেটে রক্তারক্তি ব্যাপার। এগারো নম্বর প্যাভিলিয়নের ভিড়ের থেকে একটু দূরে বসে গানের সাথে সাথে এইসব স্মৃতিচারণ শুনেছিলাম। নিমেষে কোথায় হারিয়ে গেছিল চারপাশের আবহ।

    ভিক্ষে চাওয়ার দর্শনের সম্মোহন থেকে আমি এখনও বেরিয়ে আসতে পারি নি।
  • tim | 71.67.115.14 | ১৭ জুন ২০০৭ ০৮:৪৫389804
  • মন্ত্রমুগ্‌ধ বল্লেও কম বলা হয়। চলতে থাকুক।
  • dd | 202.122.20.242 | ১৭ জুন ২০০৭ ২১:২৬389805
  • কল্লোল

    তোমার নানান পথের বহু লোকের সাথে পরিচয় আর অভিজ্ঞতার কথা পড়ে খুব ভালো লাগছে।

    ইন্দোদার মতন আমারও আফসোষ হয়। নিতান্ত ছেলেমানুষ বয়সেই মুদ্রারাক্ষসের দাসত্ব স্বীকার করায় মধ্য পঞ্চাশে এসে দেখি পাওয়ার পয়েন্ট প্রেসেন্টেশনের বাইরের দুনিয়া আর চিনি না। ছ্যা:
  • r | 61.95.167.91 | ১৮ জুন ২০০৭ ১৪:০৪389806
  • লক্ষ্মণের গন্ডি নিয়ে দু একটা কথা কই। এটা "ভদ্রলোকের ভাষা" এবং এটা "অন্য রাস্তার ভাষা"- এই ধরনের দ্বিত্বপ্রয়োগ ইতিহাসের কাঠগড়ায় কি আদৌ দাঁড়ায়? প্রশ্নটা উঠেছিল লোকায়ত সাধনায় যৌনতার অনুষঙ্গ উপলক্ষ্যে। "আনন্দের জন্য যৌনতা" নিতান্তই "ভদ্রলোক" সংস্কৃতির দান। যেহেতু আমরা নিজেরা ভদ্রলোক, লোকায়ত সাধনার যৌনতা নিয়ে আমরা চিরকাল একটা "ভদ্রলোকী" ধারণা তৈরি করেছি। একদিকে উনিশ শতকের নবজাগরণের সময়ে প্রায় প্রত্যেকে লোকায়ত সাধনাকে খুব হীনচোখে দেখতেন এই যৌনতার অনুষঙ্গের জন্য। অন্যদিকে বিংশ শতকের শেষভাগে যৌনতা এবং আধ্যাত্মিকতার একধরনের সরস মিক্সচারের জন্য লোকায়ত সাধনা ফ্যাশন হয়ে উঠল। এরা একই পয়সার এ পিঠ ও পিঠ। লোকায়ত দর্শন কোনোদিনই "আনন্দের জন্য অবাধ যৌনতাকে" প্রশ্রয় দেয় নি। লোকায়ত জীবনযাত্রার আমাদের অচেনা যে যৌন আচার ব্যবহারের প্রসঙ্গ তা সব সময় এসেছে কৃষি উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে। সেখানে মূলে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় প্রসব এবং জন্ম, প্রক্রিয়াটা বড়ো কথা নয়। নিজের আনন্দের খাতিরে বিনা উৎপাদনে বীজনাশ খুব একটা কদর পাবে না তা বলাই বাহুল্য। কাজেই যদি কোনো বাউল সাধক যদি প্রবৃত্তিগত যৌনতার বিরুদ্ধে কথা বলেন, তাকে "ভদ্রলোকী সংস্কৃতির ছাপ" বলে ধরে নেওয়া ঠিক নয়। অযৌনতার ভদ্রলোকী সংস্কৃতিকে একটা সুষম ক্যাটেগরি হিসেবে দেখাটাও একটা ভুল। উনিশ শতকের প্রথমভাগের কলকাতার নাগরিক সংস্কৃতিতে প্রায় অবাধ যৌনতার প্রচলন দেখতে পাই। এর বিরুদ্ধে আঘাত আসে দুই দিক থেকে। একদিকে কেশবচন্দ্র- বঙ্কিমচন্দ্র এবং অন্যদিকে রামকৃষ্ণ। কেশব-বঙ্কিমের "যৌনতার" বিরোধিতা অবশ্যই ভিক্টোরিয়া ইংরাজিশিক্ষার ফল। কিন্তু কেশব-বঙ্কিমের বিরোধিতা এবং রামকৃষ্ণের কামিনী-কাঞ্চনত্যাগের সওয়ালকে একই বর্গে ফেলে দেওয়া ঠিক নয়। রামকৃষ্ণের অযৌনতার পাঠের পিছনে লুকিয়ে আছে গ্রামীণ কৃষিসভ্যতার বিভিন্ন উপসর্গ যেখানে কর্তাভজা এবং বাউলদের প্রভাব পরোক্ষ হলেও অস্পষ্ট নয়। যদিও রামকৃষ্ণ কর্তাভজাদের যৌনাচারকে কোনোদিন ভালোচোখে দেখেন নি এবং বলেছেন যে পায়খানার দোর দিয়ে ঘরে ঢোকা কেন, কিন্তু একই সাথে এ কথাও স্বীকার করেছেন যে ঐ পথ দিয়েও ইষ্টের কাছে পৌঁছনো সম্ভব। অবশ্যই উনিশ শতকের ব্রাহ্মভাবাপন্ন ভদ্রলোকদের কাছে রামকৃষ্ণ এই কথা বলতে পারেন নি যে তোমরাও কর্তাভজাদের পথ অনুসরণ করো। কারণ সর্বাঙ্গে "কামিনীকাঞ্চনের" নাগরিক খোলস এঁটে কেউ লোকায়ত বাউল কি তন্ত্রসাধনার পথে এগোলে মুখ্য হয়ে উঠবে যৌনাচার এবং কারণবারি, গভীর নির্জন পথের খোঁজ পাওয়া যাবে না। উনিশ শতকের কলকাতার তন্ত্রসাধনার ইতিহাসও এই বহিরঙ্গের উপকরণ নিয়ে মাতামাতির ইতিহাস। কাজেই দুই সমাজের পথ আলাদা হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। এইভাবেই গ্রাম কখনও শহরের সাথে কথা বলেছে, কখনও শহর গ্রামের সাথে। এই দুইয়ের মিলমিশে গড়ে উঠেছে আমাদের সমাজের যৌনতার বিভিন্ন আখ্যান।
  • kallol | 192.77.110.18 | ১৮ জুন ২০০৭ ১৪:১২389807
  • র - সাব্বাশ। ঠিকঠাক ধরেছো। আমারই ভুল। আসলে ইচ্ছেপূরনের ইচ্ছেটা বড় বেশী চাগার দেয় সময় সময়।

  • kallol | 192.77.110.18 | ১৮ জুন ২০০৭ ১৫:০৭389809
  • .
  • শিবাংশু | 127.197.239.170 | ১৬ জানুয়ারি ২০১৩ ১৮:৪৬389810
  • অমাবস্যায় চাঁদের উদয়

    ১.
    এই টইটির যখন সূত্রপাত হয়েছিলো, তখন আমার এই পাড়ায় গতায়াত ছিলোনা, তাই চোখেও পড়েনি। পাইদিদির সঙ্গে এ বিষয়ে আড্ডা হবার সময় তিনি আমাকে এর খোঁজ দেন এবং টইটি তুলেও দেন। এখন দেখছি ইন্দ্রাণী তাঁর নিজস্ব কুশলতায় মূল গ্রন্থটির উদ্ধৃতি সহকারে বেশ সুপরিসর একটি আলোচনা করেছেন। সঙ্গে কল্লোলদা এবং আরো কয়েকজনের প্রাসঙ্গিক যোগদানও রয়েছে। যে কোনও কারণেই হোক,আলোচনাটি দীর্ঘায়িত হয়নি। এক সাগরপারের বন্ধুর দাবি মেনে সম্প্রতি অতি সামান্য পরিসরে এ বিষয়ে দুচার অক্ষর লিখেছি। যেহেতু একটি বিশেষ বাউলগানের অন্তর্লীন অর্থকে ধরার জন্যই এই প্রয়াস, তাই কোনও সামগ্রিক সন্দর্ভ এখানে নেই। ধারাবাহিকতা রাখার জন্য পৃথক কোনও টইয়ের শরণ নিলুম না, কারণ এই টইতেই বন্ধুরা একটি উর্বর ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রেখেছেন। ইতোমধ্যে অন্য একটি টইতে সুনীল ও গৌতমের লালনকে নিয়ে ইন্দো ডাক্তার কিছু মনোরম লেখা আমাদের উপহার দিয়েছিলেন। সেই আলোচনায় আমিও যৎসামান্য যোগদান করেছিলুম। কিন্তু আমাদের মতো একান্ত বিচ্ছিন্ন শৌখিন কেরানিদের পক্ষে যোগ্য সততার সঙ্গে বাউল-ফকির সাধনার খেই ধরা অতি দুরূহ কর্ম, এটা স্বীকার করেই এগোনো ভালো। তবু যদি গুরুর আগ্রহী, মনস্ক ও ধীমান চন্ডালরা এই বিষয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ করার প্রয়াস করেন, তবে বাঙালির সামগ্রিক ইতরযানী মননবিশ্বের কিছু আপাতদুরূহ অধ্যায় স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে।

    বহু আগে ভারতবর্ষীয় উপাসকসম্প্রদায় পড়ার পর সুধীরদার এই বইটির প্রথম সংস্করন যখন চোখে পড়ে, তখন একটা অন্য ধরনের আত্ম আবিষ্কার হয়। তার পর সংযোগবশতঃ সুধীরদার সঙ্গে ব্যক্তিগতস্তরে আড্ডার সূত্রে কিছু আরো সন্ধানপ্রাপ্তি ঘটেছিলো, সেও বহুদিন হলো। আমার না-জানা জগতের বিশাল পরিসরের এককোণে পড়ে থাকা ধূলিধূসর যে আগ্রহের কুলুঙ্গি , তার মধ্যে এই বিষয়টিও তার ক্ষিন্ন অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে থেকেছে চিরকাল। আমাদের মতো জোড়াসাঁকো গোত্রের তৈলচিক্কণ শহুরে বঙ্গবালকদের জগতে সংখ্যাগুরু অ'হিন্দু' বা প্রান্তিক 'হিন্দু' বাঙালি জনগোষ্ঠীর দৈন্যপীড়িত, সমান্তরাল, অস্পষ্ট ইতরযাপন কোনও তাৎপর্য রাখেনা। ব্যক্তিগতভাবে স্বীকার করি ,পশ্চিমবঙ্গীয় ব্রাহ্মণ্যছাঁচ বাঙালি মধ্যবিত্তের স্ট্রাকচার্ড মননবিশ্বের একজন তৃপ্ত নাগরিক হিসেবে আমার কোনও অধিকারই নেই এই বিষয় নিয়ে কোনও মন্তব্য করার। কারণ আমার শারীর বা মানস অবস্থান প্রায় অন্য গ্রহে। বিষয়টি অতি বিপুল ও জটিল। বৃহত্তর পরিসীমার কয়েকটি প্রান্ত ছুঁতে গেলেও তা গভীর অভিনিবেশ দাবি করে।

    ২.
    গত অর্ধশতকে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রোতার কাছে 'বাউলগানে'র বেশ প্রিয়তা দেখা যাচ্ছে। এই প্রিয়তা তার আগেও ছিলো, কিন্তু শ্রোতাদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট ছিলো ভিন্ন। বাঙালি মধ্যবিত্তের অন্যান্য রুচিপরিবর্তনের অনুঘটক হিসেবে এই প্রবণতাটির পিছনেও ঠাকুরবাড়ির বড়ো ভূমিকা রয়েছে। মহর্ষির চতুর্থ ও ছোটো ছেলে মনস্বী, অভিজাত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হওয়া সত্ত্বেও শতাধিক বছর আগে এই ধারাটিকে যে স্বীকৃতি ও প্রশ্রয় দিয়েছিলেন, আজও তা এই ধারাটির নসিব হয়না। হয়তো এর পিছনে আচার্য ক্ষিতিমোহনেরও কিছু যোগদান ছিলো। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ বহুগানে বাউলাঙ্গের সুরযোজনা করেছিলেন এবং সেই গীতগুলির লোকপ্রিয়তার সূত্র ধরে সাধারন শ্রোতার মনে বাউলগানের একটা নির্দিষ্ট ছাঁচ তৈরি হয়ে গিয়েছিলো। সুশীল মধ্যবিত্তের স্বীকৃতি এইভাবে বাউলগানকে তাদের সাজানো গৃহকোণের গ্রামাফোনের অংশ করে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলো। ক্র্মশঃ পূর্ণদাস প্রমুখ সুকণ্ঠ গায়ক বিপণন সামগ্রী হিসেবে এই গানের একটি মোটামুটি নিবেদিত বাজারও তৈরি করতে পেরেছিলেন। যদিও পূর্ণদাসের পিতা নবনীদাস একজন খ্যাত ও স্বীকৃত 'বাউল' ছিলেন, কিন্তু তাঁদের সাধনা বৈষ্ণব মতের, নির্দিষ্ট বাউল-ফকির মতে নয়। তাঁদের ও আরো কয়েকজন মানুষের শ্রম ও গুনপনার দাক্ষিণ্যে শহুরে ও গ্রামীণ মধ্যবিত্তের রুচি চাহিদা অনুযায়ী একটা বিশেষ লোকসঙ্গীতের জঁর সৃষ্টি হলো, বাউলগান নামে।

    ৩.
    মনে রাখা দরকার 'বাউল' একটি বিশেষ সাধনপদ্ধতি, কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম নয়। সত্যি কথা বলতে এর অবস্থান প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। এই ধারাটি দেবতাভজন পদ্ধতি নয়, এক ধরনের মানবপূজন যাত্রা। আমার তন্ত্রবিষয়ক লেখাটি ( এখনও এই পাতায় আনতে পারিনি) যাঁরা দেখেছিলেন, হয়তো তাঁদের মনে থাকতে পারে, মহাযান বৌদ্ধধর্মের অবক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে বজ্রযান, সহজযান পন্থার যে প্রাদুর্ভাব ঘটেছিলো, সেই উৎস থেকে পরবর্তীকালে নানা ইতরযানী উপাসনাপদ্ধতি বিকশিত হয়। বাউলসাধন তার অন্যতম। আসলে এই ধারাটিকে মোটামুটিভাবে একযোগে বাউল-ফকিরসাধন বলা হয়ে থাকে। বাউল-ফকির সাধনপদ্ধতির আচরিত বিধি গুহ্য ও গোপ্য। এটি একান্তভাবেই ইতরযানী সমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত আচারবিধি, শহুরে ইংরিজিশিক্ষিত মেট্রোপলিটান মননের থেকে এর দূরত্ব সহস্র যোজন। আলোকপ্রাপ্ত মধ্যবিত্ত বর্গের রোম্যান্টিক মননের মিস্টিক প্রত্যাশার উপজীব্য হিসেবে বাউলগানের একটা আদর রয়েছে। কিন্তু মূল ঘটনা হলো বাউলগান, বাউলসাধনার একটা যোগাযোগ মাধ্যম। ব্রাহ্মণ্যধর্মে বৈদিক বা পৌরাণিক মন্ত্রউচ্চারণের যে তাৎপর্য, বাউলসাধনায় প্রকৃত বাউলগান সেই কাজটি করে থাকে। যেহেতু এই সব গান একটি নির্দিষ্ট সাধনপদ্ধতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তাই তাকে সেই পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিচ্যুত করে ফেললে তার অর্থ কিছু হৃদয়ঙ্গম হয়না। বৌদ্ধ চর্যাপদে যে সন্ধা ভাষার সন্ধান পাই, পরবর্তীকালের তন্ত্র ও অন্যান্য লোকধর্ম সাধনার মধ্যে সেই ভাষার প্রয়োগ বারবার দেখতে পাওয়া যায়। তাই পূর্বপশ্চাৎ না জেনে হঠাৎ বিচ্ছিন্নভাবে যদি আমরা কোনও একটি আসল বাউলগানের মর্মোদ্ধার করতে চাই, তবে নিরাশ হওয়া ছাড়া কিছু করার নেই। এই সন্ধাভাষা একান্তভাবে প্রতীকী ও জটিল নির্মাণ। এই ভাষায় শব্দার্থ ও মর্মার্থের কোনও মিল নেই।

    ৪.
    প্রতীক হিসেবে চাঁদ সারা পৃথিবীতে সর্বদেশে সর্বকালে একটা শক্তিশালী লোকপ্রিয় প্রতীক। আর্যাবর্তের অসংখ্য 'চন্দ্র'বংশীয় মনুষ্যপ্রজাতি থেকে সুদূর দক্ষিণ আমেরিকার মায়া, ইনকা, আজটেক সভ্যতা পর্যম্ত পৃথিবীর এই উপগ্রহটি মানুষের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে। আমাদের লোকায়ত জীবনে মানবদেহকে কেন্দ্র করে সম্পূর্ণ ভিন্নমাত্রার সমাজতত্ত্ব প্রচলিত রয়েছে। শুধু বাউলফকিরসাধন নয়, অন্যান্য ধারার সাহেবধনি, কর্তাভজা, সহজিয়া বৈষ্ণব ইত্যাদি নানা সম্প্রদায়ের মধ্যেও দেহতত্ত্বকেন্দ্রিক বিভিন্ন সমান্তরাল বিশ্বাস কাজ করে। এই দেহতত্ত্বের নানা আচারব্যবহার অপ্রকাশ্য, জটিল ও গুপ্ত। একে চন্দ্রসাধনা বলা হয়। একে মাটির কাজ বা রসরতির সাধনাও বলা হয়ে থাকে। সাধারণতঃ রস মানে মূত্র, রতি মানে শুক্র, রক্ত মানে রজ আর মাটি মানে মল। গানে প্রয়োগের সময় এই সব সংকেতকে আদ্যচন্দ্র, সরলচন্দ্র, গরলচন্দ্র বা রুহিনীচন্দ্র জাতীয় সুশীল শিষ্ট নামের আড়াল গ্রহণ করা হয়। এই চারচাঁদের সেবন বাউলফকিরসাধনার আবশ্যক অঙ্গ। এই সাধনা নারীনির্ভর। বাউলদের মতে নারী ও চাঁদ সমার্থক, কারণ চন্দ্রকলার মতো নারীরও উর্বরতার হ্রাসবৃদ্ধি হয়। আবার বাউলমতে এটাও মনে করা হয় পূর্ণিমার সময় পুরুষের উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। নারীর রজঃস্রাব সময়ের প্রতীক হচ্ছে অমাবস্যা। এই সময় বাঁকা নদীর বাঁকে অধরমানুষ মহামীন হয়ে খেলতে আসেন। অমাবস্যায় চাঁদের উদয় মানে, আকাশে যখন পূর্ণিমা পুরুষের ভিতর উর্বরতার জোয়ার আনে, তখন যদি নারীর অমাব্স্যা, অর্থাৎ রজঃস্রাবের সময় আসে তখনই সাধনার শ্রেষ্ঠ সময়।

    মদন শা ফকিরের যে গানটি নিয়ে প্রশ্নটি উঠেছিলো তার প্রামাণ্য পাঠটি এখানে দিই। এই পাঠটি সরোজকুমার রায়চৌধুরি ১৯৩৭ সালে নথিবদ্ধ করেছিলেন। যদিও বিভিন্ন বাউলের কাছে এর ভিন্ন ভিন্ন পাঠান্তর রয়েছে, কিন্তু মূল গঠনটি এক।

    ' চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে আমরা ভেবে করবো কী
    এ যে ঝি-এর পেটে মায়ের জন্ম তোমরা তারে বলো কী ।।
    ছ'মাসে কন্যার উৎপত্তি ন'মাসে সে গর্ভবতী
    ভাইরে, বারোমাসে তিনটি সন্তান কোনটি করবে ফকিরি ।।
    ঘর আছে তার দুয়ার নাই মানুষ আছে কথা নাই
    ভাইরে , কে জোগায় তার আহারাদি কে জোগায় সন্ধ্যায় বাতি ।।
    মদন শা ফকিরে বলে মায়ে ছুঁলে পুত্র মরে ভাইরে, এ কথার যে উত্তর করে সেই তো করবে ফকিরি ।।

    সূর্যের উপর চাঁদের ছায়া পড়লে গ্রহণ হয়। এই প্রতীকটি পুরুষের উর্বরতা বা কামনার ঘাটতির প্রসঙ্গ আনছে। আবার পূর্ণিমার দিনে পুরুষের উর্বরতা যখন সর্বাধিক, তখন চাঁদের উপর চাঁদের ছায়া পড়ছে ( এখানে একটি চাঁদ মানে নারী আর অপরটি পূর্ণিমার পুরুষ)। এর ফলে সৃষ্টি হলো অমাবস্যা, অর্থাৎ নারীর রজঃসাধনার চূড়ান্ত উর্বর সময়। এই সময়ের মিলনই বাউলমতে সর্বশ্রেষ্ঠ। মা, ঝি বা গর্ভস্থ সন্তান সবই আদি জননী বা প্রজয়িত্রী প্রকৃতির প্রতীক ( তন্ত্রেও এরকম উল্লেখ পাওয়া যায়)। বারোমাস মানে এখানে দ্বাদশ বছরে নারীর রজঃবিকাশ ও তিনটি সন্তান মানে তিনদিনের ঋতুকালের ত্রিধারা। সন্তানসম্ভবা হলে নারীর দশমীদ্বার বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু গর্ভস্থ প্রাণ কোথা থেকে তার প্রাণরস আহরণ করে? মাতৃস্থানের স্পর্শে ( আদি জননীর প্রতীক) পুরুষের শুক্রস্খলন হয়ে যে প্রাণের অপচয় হয় তার সংকেত হলো 'মা'কে ছুঁলে পুত্র মরে'। এই তত্ত্ব যে আত্মস্থ করতে পারে সেই ফকির হবার যোগ্য হতে পেরেছে।

    ৫.
    এ জাতীয় অতি সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যায় এবং অতি সীমাবদ্ধ প্রকরণে বাউলতত্ত্বের যে পরিচয় দেবার প্রয়াস পেলুম তা শুধু অসম্পূর্ণই নয়, বরং অনধিকার প্রবেশ বলা যায়। বিজ্ঞানসম্মত সত্যমিথ্যার সন্ধান না করে যেটা আমাদের কাছে মুখ্য হয়ে ওঠে তা এক বৃহৎ লোকায়ত সম্প্রদায়ের বিশ্বাসের স্তম্ভ। তার প্রকৃত সুলুকসন্ধান না জানলে বাউলগানের মর্ম কিছুই বোঝা যাবেনা। ঐ 'গোলেমালে গোলেমালে পীরিত' জাতীয় প্রহসন নিয়ে কালবিনাশ করা ছাড়া কোনও বিকল্প নেই।

    শিবাংশু
  • nina | 79.141.168.137 | ১৭ জানুয়ারি ২০১৩ ০১:৩০389811
  • চলুক চলুক----ব্ড় ভাল টই!
  • Lama | 127.194.227.213 | ১৭ জানুয়ারি ২০১৩ ০২:১৭389812
  • যাবার পথে কল্লোলদাকে শুভ জন্মদিন-
  • পুরানো কেউ | 2405:8100:8000:5ca1::cf8:b818 | ১৬ ডিসেম্বর ২০২০ ১৬:৫৫733374
  • তুলি এটা।

  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে মতামত দিন