এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • এক মিথ্যাবাদী মায়ের গল্প

    Swapan Chakraborty লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৬ মে ২০২৩ | ৩৩২ বার পঠিত
  • একটা দিনও যায়নি মোটে মায়ের জন্য কাঁদি,
    কারণ আমার মা ছিলেন ঘোর মিথ্যাবাদী।
    সচরাচর মায়েরা হন মিথ্যাচারী বটে,
    সব কষ্ট বুকে নিয়েও হাসেন অকপটে॥

    বাবা যেদিন চলে গেলেন এই পৃথিবী থেকে,
    সেদিন প্রথম মিথ্যা কথা শুনি মায়ের মুখে।
    মা বলতো - “বাবা আছেন দূর আকাশের মাঝে,
    লেখাপড়া করলে তাঁকে দেখবি সকাল সাঁঝে॥”

    পড়াশুনা করতাম খুব মন দিয়ে দুইবেলা,
    কোথায় বাবা-আকাশ মাঝে কেবল তারার মেলা।
    বুঝতাম সব মিথ্যে কথা-মা মিথ্যাবাদী,
    বলতাম না কিছুই তাঁরে-কষ্ট পান যদি ॥

    তখন থেকেই মিথ্যে বলায় মায়ের হাতে খড়ি,
    ধীরে ধীরে মায়ের মুখে মিথ্যা ভুরিভুরি।
    দিনের বেলা কারো বাড়ি রান্না করার কাজে,
    রাত্রি বেলা সেলাই মেশিন-কষ্ট মুখ বুজে॥

    চোখের কোণে কালি তবু ঠোঁটের কোণে হাসি,
    রুগ্ন মায়ের শরীর খারাপ-জ্বর সর্দি কাশি।
    তবুও তাঁর কাজের বিরাম ছিল না দিনে রাতে,
    তন্দ্রাঘেরা দু চোখ তাঁর-ছুঁচ ফুটে যায় হাতে॥

    আমি বলতাম - এত কাজ কার জন্যে মাগো ?
    শরীর খারাপ নিয়েও তুমি দিবারাত্রি জাগো ?
    “কি করবো , ঘুম আসে না , শোবো কিসের তরে ?”
    সাথে সাথেই মায়ের মুখে মিথ্যা ঝরে পড়ে॥

    আমার জন্যে নতুন পোশাক-মায়ের ছেঁড়া শাড়ি,
    অনুযোগের উত্তরে সেই মিথ্যা কথার ঝুড়ি।
    “তোর জামা সস্তা খুবই-তাই এনেছি কিনে,
    আমার শাড়ী কিনব দেখিস আসছে পূজোর ক্ষণে॥”

    কিন্তু পূজো আসে না হায় নিয়ে খুশীর ডালি,
    শাড়ীর মাঝে সেলাই করা-জামার মাঝে তালি।
    পাড়া পড়শী হাসত বুঝি মায়ের দশা দেখে,
    মা বলতো - “কি হয়েছে , আছি পরম সুখে॥”

    আসলে সব তাঁর ছিল মিথ্যা কথার ছল,
    হাসি মুখেই লুকিয়ে নিতেন আঁখির যতেক জল।
    স্কুল হতে আমায় নিতে রোজ দুপুরবেলা,
    আসতেন মা কড়া রোদে-গায়ের মাঝে জ্বালা॥

    তবুও মায়ের মুখের হাসি হতো না কভু  ম্লান, 
    বুঝতে আমি পারতাম ঠিক-সবটুকু তাঁর ভান।
    আমায় কোলে জড়িয়ে যখন দিতেন তিনি চুমা,
    মুখের মাঝে হাসিটি তাঁর-হিয়ায় কান্না জমা॥

    মাঝে মাঝেই আইসক্রীম দিতেন আমায় দামী,
    “তোমার ছাড়া খাব না আজ”- যবে বলতেম আমি,
    মলিন হেসে মা বলতেন - “আমার গলায় ব্যাথা,
    ঠান্ডা খাওয়া মানা আমার-শোনো খোকার কথা !”

    ওটা ছিল মায়ের আমার নিঠুর মিথ্যাচার,
    মিথ্যাবাদী মা আমার-সেটাই সত্যসার।
    এমন করেই বড় হলেম মায়ের আদর মেখে,
    মায়ের কথায় - “মানুষ হলেম লেখাপড়া শিখে॥”

    বড় চাকুরে হলেম আমি-বেতন কয়েক লক্ষ,
    বললেম মা - “আঁধার ঘরে এবার শুক্লপক্ষ।
    অনেক কষ্ট করলে মাগো-শরীর তোমার জীর্ণ,
    আমার জন্যে করলে তুমি আপন জীবন দীর্ণ॥”

    “তোর জন্যে খাটতে আমার বয়েই গেছে খোকা”,
    ভাবতো মা-তাঁর খোকন বুঝি আজও বোকা।
    “এবার একটা টুকটুকে বউ আনরে খোকা ঘরে,
    কাজের কাজ কর রে এখন বাজে কথাটি ছেড়ে॥”

    মায়ের ভাষায় টুকটুকে বউ-তাকেই পাশে নিয়ে,
    যেতে হল বড় শহরে চাকরী রাখার দায়ে।
    অফিস থেকেই পেলেম আমি ঝাঁ চকচক বাড়ি,
    সঙ্গে দুজন সহকারী আর মূল্যবান গাড়ি॥

    জায়ার মুখে হাসি তবু আমার চোখে জল,
    মা তখনও টালির ঘরে-ঠিকানা মফস্বল।
    নিয়ন বাতির আলোয় যখন আমার বাড়ি আলো,
    লোডশেডিং-এর অন্ধকারে মায়ের ঘর কালো॥

    ছুটে গেলেম মায়ের কাছে - “ শুনবো না আর কথা,
    থাকবে তুমি আমার কাছে-জুড়িয়ে যাবে ব্যাথা,”
    চল মাগো আমার কাছে-সেথায় বিশাল বাড়ী,
    এই ছোট্ট ঘরে থাকতে তোমার কষ্ট হচ্ছে ভারী॥

    মা বললেন - “এই তো বেশ খোলা মেলা হাওয়া,
    কেন আবার শুধুশুধু ভিড়ের মধ্যে যাওয়া ?”
    করি কেবল অনুনয়-ফেলি নয়ন জল,
    চালাক মায়ের মনে তখন অনেকরকম ছল॥

    “বদ্ধ ঘরে থাকলে আমার হাঁফ ধরে যায় বুকে,
    তার চেয়ে হেথায় আমি আছি অনেক সুখে।
    তোরা দুটি থাকিস ভাল-তাতেই আমি খুশী,
    আমার জন্যে ভাবিস না রে” - মায়ের মুখে হাসি॥

    ওটা ছিল আমার মায়ের মিথ্যা অভিনয়,
    বুঝেও আমি কিছুই সেদিন করতে নারি হায়।
    চাকরী সূত্রে এবার গেলাম ওয়াশিংটন ডি সি,
    বিশ্ব ব্যাংকে বিশাল পদ-খ্যাতি রাশি রাশি॥

    দায়িত্বশীল কাজে আমার ফুরসত নেই মোটে, 
    মায়ের খবর নেবার হায় সময় গেল ছেঁটে।
    মা ভীষণ অসুস্থ-খবর পেলেম শেষে, 
    ক্যানসারের আক্রমণে বিছানাতেই মিশে॥

    উড়ে গেলেম মায়ের সনে-বলি জোড়করে,
    “এবার তুমি না কোরো না-ক্ষমা কর মোরে।”
    পায়ে পড়ে বলি মাকে - “এবার ফিরাও মত,
    আমেরিকা চল মাগো- কি ই বা দূরের পথ ?”

    “একা একা হেথায় পড়ে কী সুখ তুমি পাও ?
    খোকন বলে একটিবার বুকে জড়িয়ে নাও।
    আমেরিকায় তোমার রোগ হবেই নিরাময়,
    কেন মাগো আমার সনে এমন নির্দয় !”

    “চোখ ছলছল মুখে হাসি বললে আমার মা - 
    বিমান চড়া বারণ আমার-তুই কি জানিস না ?
    তোর ওপর কখনো কি রাগ করেছি খোকা ?
    এত বড় হয়েও তুই রয়েই গেলি বোকা ॥”

    “আমার কিছু হয় নি তেমন ভাবছিসই অযথা”-
    ওটাই ছিল আমার মায়ের শেষ মিথ্যা কথা।
    ক’দিন পরেই চলে গেলেন নিঠুর মিথ্যাবাদী,
    মিথ্যুক সেই মায়ের জন্য আজো আমি কাঁদি। 

    দুখিনী মা আমার খুঁজে পান নি সুখের দিশা,
    তবুও কভু শুনি নি কোন অনুযোগের ভাষা।
    এমন মায়ের ছেলে হয়ে আজকে আমি ধন্য,
    দিবারাত্র কাঁদি আমি আমার মায়ের জন্য॥
    —————————————————————-
    ————————————————————-
    স্বপন চক্রবর্তী । 

    আমাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশের এক অজ্ঞাতনামা কবির একটি কবিতা পড়েছিলাম বছর পাঁচেক আগে। কবিতাটি মনে খুব দাগ কেটেছিল। তাই কবিতাটি ভুলতে পারিনি। সেই কবিতার ছায়া ও ভাব অবলম্বনে এক মা এবং তাঁর সন্তানের কল্পিত কাহিনীর উপর ভিত্তি করে এই পৃথিবীর সকল মায়েদের জন্য এক অপরূপ রূপরেখা অঙ্কনের চেষ্টা করলাম।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Sobuj Chatterjee | ২৬ মে ২০২৩ ১১:১৭520059
  • "God could not be every where ,and therefore he created the mothers"
                                -  Rudyard Kippling.
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন