এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • আরএসএস বিজেপিতে রবীন্দ্রনাথ (একটি হাস্যকৌতুক) -- আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা

    Partha Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১০ মে ২০২৩ | ৫১৬ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • শুনলাম, অমিত শাহ নাকি কলকাতা এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের জন্মদিবস উপলক্ষ্যে। শুনলাম, তিনি এ কথাও বলেছেন, ভারতের নতুন শিক্ষাব্যবস্থা তাঁরা নাকি গড়ে তুলেছেন রবীন্দ্রনাথের আদর্শ অনুসরণ করে।

    এর আগে ২০২১'এর বিধানসভা ভোটের সময়ে নরেন্দ্র মোদী বাংলায় এসে রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতা বলে গিয়েছিলেন। হ্যাঁ, গান বলে গিয়েছিলেন। অনেকটা বাংলা ভাষাতেই। রিসার্চ করে দেখা গেছে, হ্যাঁ, তিনি বাংলাই বলেছিলেন। অপ্রাকৃত বাংলা, যা প্রকৃত বাংলার একটি নতুন বিবর্তিত রূপ।

    ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, তুলসী চক্রবর্তী, রবি ঘোষ, অনুপকুমার, চিন্ময় রায়, হরিধন মুখোপাধ্যায় ইত্যাদি দিকপাল কৌতুক অভিনেতারা চলে যাবার পরে বাংলাতে হাসির উপাদান খুব কমে গেছে। বাঙালি হাসতে ভুলে গেছে। আমরা সব সময়ে রেগে আগুন তেলে বেগুন হয়ে আছি। চারদিকে তাকিয়ে দেখবেন। আগুন ছুটছে শুধু। এই জন্যেই আসলে বেয়াল্লিশ থেকে আটচল্লিশ -- আর কোনো কারণ নেই তার।
    আমাদের থেরাপি দরকার।

    এখন দিল্লি থেকে বিনাপয়সায় এরকম শ্রেষ্ঠ কমেডিয়ান পাঠানো হচ্ছে দেখে আমরা যারপরনাই আহ্লাদিত। সুদূর নিউ ইয়র্কে বসে আমি এমন হেসেছি যে দশ হাজার মাইল দূরে আমাদের সেই গোয়াবাগান পার্কে আর রামমোহন লাইব্রেরির পাশের গলিটায় যেখানে আরএসএস শাখা হতো, সেখানেও কান পাতলে আমার টেনিদার মতো বিশাল হাঁ করে হাসি শুনতে পাওয়া যাবে। 
    এমন হাসি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।

    *****

    বাজে কথা ছেড়ে কাজের কথায় আসি। আরএসএস বিজেপি এবিভিপিতে আমার প্রায় দু দশক হয়ে যাচ্ছে বাসি।

    আমার বাবা জিতেন্দ্রনাথ, আমি পার্থনাথ, আর রবীন্দ্রনাথ। না, এঁরা এক ফ্যামিলির ছিলেন না। বরং লতায় পাতায় খুঁজলে ঈশ্বরচন্দ্র আর বিভূতিভূষণ এই দুটো ফ্যামিলির সঙ্গে আমাদের বাঁড়ুজ্যে বংশের কিছু ঠিকানা খুঁজে পেলেও পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু চেষ্টাই কেউ তেমন করে করলো না। করলে ...

    আমাদের আরএসএস আর আজকের বিজেপির এক সময়ের বাবা জনসঙ্ঘতে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে ফ্যাসিস্ট এবং মুসলমান-বিদ্বেষী বলতে গেলে সবাই ছিল। সত্যি কথা বলতে, আজকে এতগুলো বছর পরে যখন পিছন ফিরে দেখি, তখন মনে হয়, আগেকার ক্ষমতায় স্বপ্নেও আসতে না পারা আরএসএস আর আজকের ভারতকে প্রায় হিন্দুরাষ্ট্র ঘোষণা করে ফেলার আরএসএস -- এই দুইয়ের মধ্যে আর কোনো মিল একেবারেই নেই যদিও, কিন্তু এই একটা ব্যাপারে কোনো পরিবর্তন হয়নি। আরএসএস'এর জন্মলগ্ন থেকেই তারা এক-এজেণ্ডা সংগঠন। সে এজেণ্ডা হলো, ভারত হিন্দুদের দেশ, এবং মুসলমানরা বহিরাগত, এবং শত্রু।

    যেহেতু আরএসএস'ই বিজেপির পিছনে আসল চালিকাশক্তি -- যা এবারে দেশে গিয়ে নানা জনসভায় এবং সাক্ষাৎকারে, মিটিঙে বলে এসেছি -- সুতরাং আরএসএস দর্শনই বিজেপির দর্শন। 

    ইন ফ্যাক্ট, কাল যদি আরএসএস নাগপুরের হেডকোয়ার্টার থেকে দিল্লিতে নির্দেশ পাঠায় প্রধানমন্ত্রী বদল হবে, বদল হবে।**

    কিন্তু মিডিয়া কখনো এসব কোকশাস্ত্র আমাদের বলবে না, কারণ কোকের ডলারের ওপর মিডিয়া খুব বেশি নির্ভরশীল। ওই গরমের দেশে স্যুট টাই পরিহিত মুখে ফেনা ওঠা লোকগুলো জানে, কোকের বিরুদ্ধে কথা বলা, আর গিলোটিনে মাথা গলিয়ে দেওয়া এখন একোই কথা।

    *****

    যাক গে, কী যেন বলছিলাম... ও হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ।

    আরএসএস'এর সেই ভালো ভালো লোকগুলো, যাদের নিয়ে আমি ভালো ভালো কথা লিখেছি বলে সিপিএম আর কমুনিষ্টিরা আমার গুষ্টির তুষ্টি করে ছেড়েছেন, তাঁরা ফ্যাসিস্ট হিটলার মুসোলিনির থেকে আদর্শ লিপি, বর্ণপরিচয়, ধারাপাত, আর শুভঙ্করী শিখেই হেডগেওয়ার, গোলওয়ালকার, সাভারকার, শ্যামাপ্রসাদ আর নাথুরাম গডসের আরএসএস জনসঙ্ঘ তৈরী করেছিলেন, আর জার্মানির ইহুদীদের গ্যাস চেম্বারে ইঁদুরের মতো ঢুকিয়ে দেওয়ার রাজনীতি সমর্থন করেছিলেন সোচ্চারে** -- বিশ্বাস না হয় তাঁদের লেখালেখি পড়ে নেবেন -- তাঁরা কেউই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কখনোই কোনো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন নি।
    বরং তাঁকে হিন্দুবিরোধী, লিবারাল, গান্ধী-নেহেরু-ঘেঁষা এলিট কবি বলে সোৎসাহে বর্জন করেছিলেন।

    তাঁরা বুঝতেন রবীন্দ্রনাথ রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে, উগ্র হিটলারি ব্র্যাণ্ডের জঙ্গী জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে, এবং ধর্মান্ধতা-বিজ্ঞানবিদ্বেষ-জাতিভেদপ্রথার বিরুদ্ধে এক প্রবল ইন্টেলেকচুয়াল শক্তি। তাঁরা একটু পড়াশোনা করতেন সেই সময়ে। আজকের মতো একেবারে আনপড় রাম নাওমী আদমী তাঁরা ছিলেন না।

    সেই আরএসএস স্থপতি রানাডে ঠেঙ্গাড়ি দেওরাস সুদর্শনরা জানতেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁদের ফ্যাসিস্ট আদর্শবাদের, এবং সামন্ততান্ত্রিক হিন্দুরাষ্ট্র ম্যাপের সবচেয়ে বড় এক দুর্ভেদ্য প্রাচীর। তাঁরা ভারতের কোণে কোণে -- ওই আমাদের গোয়াবাগান আর মানিকতলার শাখার মতোই নাগপুর বেনারস পুণে গৌহাটি চণ্ডীগড় এলাহাবাদ ভোপাল আহমেদাবাদ শাখাগুলোতে প্রতিদিন নিয়ম করে প্রচার করে এসেছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-জাতীয় ব্যক্তিত্বকে বর্জন করতে হবে।

    যেখানে রবীন্দ্রনাথ তেমন জনপ্রিয় নন, সেখানে ডাইরেক্টলি বর্জন করো।

    আর বাঙ্গাল-জ্যায়সা মুলুক মে, রবিন্দরনাথ কো হিন্দু পোয়েট বানা দো। তাঁর শিবাজী উৎসব, বন্দী বীর নিয়ে আবৃত্তি কম্পিটিশন করতে পারো। আমরা নিজেরাই করেছি। এবিভিপি থেকে আমরা আবৃত্তি প্রতিযোগিতা করেছিলাম, তার নির্বাচিত পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল যারা সবচেয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদী কবিতা আবৃত্তি করবে, তাদের। রচনা প্রতিযোগিতায় আমি ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছিলাম। আমার রচনার বিষয় ছিল, "পরম পূজনীয় ডঃ হেডগেওয়ার।" ঘটিকাহিনি নামক আমার একটা মোটা স্মৃতিকথা আছে, পড়ে নেবেন বাকীটা। 

    আমার বাবা জিতেন্দ্রনাথ আমাকে অনেকবার শেষ জীবনে আক্ষেপ করে বলেছেন, আরএসএসের নির্দেশে রবীন্দ্রনাথ বেনারসে উপস্থিত থাকার সময়ে তাঁরা সদলবলে তাঁকে বর্জন করেছিলেন, এবং অনেক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তাঁরা তাঁকে দেখতে যাননি। বাবা বেনারসেই থাকতেন। ওখানেই তাঁর সঙ্ঘময় জীবন শুরু। পাশেই এলাহাবাদে ছিলেন সতীর্থ বাজপেয়ী।

    [এক ধরনের ব্যতিক্রমও ছিল অবশ্য। আরএসএস জনসঙ্ঘের শীর্ষ নেতা নানাজী দেশমুখ আমার লেখা রবীন্দ্রনাথের অর্থনীতি হিন্দীতে অনুবাদ করিয়েছিলেন। যদিও সে লেখা একেবারেই আনপড় রাম নাওমী লেখাই ছিল। তার মধ্যে আবেগ ছিল ৯০%, আর রিসার্চ ও বিশ্লেষণ ছিল ১০। এখন পড়লে আবার সেই হরিধন কিংবা ভানু অভিজ্ঞতা হবে।]

    কিন্তু আমার নিজের বহুকালের অভিজ্ঞতা হলো এই। রবীন্দ্রনাথ আরএসএস জনসঙ্ঘ এবিভিপি বিশ্ব হিন্দুদের কাছে সম্পূর্ণ বর্জনীয় এক হিন্দুবিরোধী পশ্চিমের তোষামোদকারী মানুষ ছিলেন।

    বাংলার বিভিন্ন জায়গায় আমি ঘুরেছি। বাংলার আরএসএসে কোনোদিনও স্বদেশ পর্যায়ের বাইরে কোনো রবীন্দ্রসঙ্গীত আমি শুনিনি।

    ______________
    **(প্রতীকী অর্থে বললাম, না হলে আবার এই নিয়ে তুলকালাম বাধবে)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১০ মে ২০২৩ | ৫১৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন