এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • ধর্ম, মৌলবাদ ও আমাদের ভবিষ্যৎ : কিছু যুক্তিবাদী চর্চা

    Debasis Bhattacharya লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৫ ডিসেম্বর ২০২২ | ৪৭৫৮২ বার পঠিত | রেটিং ৪.৫ (২ জন)
  • ইসলাম সম্পর্কে আলাদা করে দু-চার কথা

    মৌলবাদ নিয়ে এই ধরনের একটা লেখায় যদি কেউ ঘোষণা করেন যে, এইবার ইসলাম নিয়ে আলাদা করে কিছু বলা হবে, তখন পাঠকের সে নিয়ে একটা প্রত্যাশা তৈরি হতে পারে। কাজেই, এখানে গোড়াতেই সে ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে বলে রাখা দরকার, না হলে পাঠক হয়ত বিভ্রান্ত ও ক্ষুব্ধ হবেন। সম্ভাব্য প্রত্যাশাটি এই রকম যে, মৌলবাদের স্বরূপ নিয়ে যখন চর্চা হচ্ছে, এবং তার মধ্যেই আলাদা করে ইসলাম নিয়ে চর্চার ঘোষণা হচ্ছে, তখন নিশ্চয়ই দেশে দেশে ইসলামীয় মৌলবাদের উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে ঐতিহাসিক বিবরণ পাওয়া যাবে এখানে, বিভিন্ন স্থান-কালে তার সাধারণ বৈশিষ্ট্য ও বিশেষ বিশেষ বৈচিত্র্যের উল্লেখ পাওয়া যাবে, এবং অন্যান্য ধর্মের মৌলবাদের সঙ্গে তার মিল ও অমিল এবং তার কার্যকারণ ইত্যাদি বিষয়ক অনুসন্ধান ও তার ফলাফলও পাওয়া যাবে। হ্যাঁ, এখানে তা করতে পারলে ভালই হত, কিন্তু তার উপায় নেই। সেটা করতে গেলে আগে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ধর্মের মৌলবাদের কার্যকলাপ নিয়ে একটা সুনির্দিষ্ট ও বিস্তারিত আলোচনা সেরে রাখতে হত, তবেই তার প্রেক্ষিতে ইসলামীয় মৌলবাদের বৈশিষ্ট্যগুলো স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠতে পারত। দুঃখের বিষয়, সে পরিসর এখানে ছিল না, এখানে তো এতক্ষণ মৌলবাদ নিয়ে শুধু কতকগুলো অতি সাধারণ কথাই বলেছি। বলে রাখা দরকার, এখানে আমি সরাসরি সেইসব নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করব না, যদিও যা আসলে বলব তার মধ্যে এ বিষয়ে আমার মতামত ও চিন্তাভাবনারও কিছু ইঙ্গিত হয়ত মিলবে। এখানে আমি মূলত কথা বলব ইসলাম ধর্ম ও সংশ্লিষ্ট মৌলবাদ প্রসঙ্গে আমাদের সমাজের মূলস্রোত ধ্যানধারণা নিয়ে, এবং তার ঠিক-বেঠিক নিয়েও। এ নিয়ে কথা বলব কারণ, আমার ধারণা, ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে যাঁরা ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লড়তে চান, তাঁদের এ বিষয়টি এড়িয়ে যাবার কোনও উপায় নেই।
     
    ওপরে বলেছি, যাঁরা ধার্মিক নন বরঞ্চ ‘ধর্ম’ জিনিসটার সমালোচক, তাঁদের মধ্যে ইসলাম নিয়ে দু রকমের ভাবনা বেশ পরিচিত। অনেকে মনে করেন, এই ‘মৌলবাদ’ সংক্রান্ত সমস্যাটা আসলে শুধুই ইসলামের সমস্যা, আর কারুরই নয় --- ধর্মের নামে ফতোয়াবাজি আর মারদাঙ্গা মূলত মুসলমানেরাই করছে। অন্যদের যদি আদৌ কিছু সমস্যা থেকেও থাকে, তো সেটা শুধু ইসলামি জঙ্গিপনার প্রতিক্রিয়া মাত্র। আবার, এ অবস্থানটি অন্য অনেকের দুশ্চিন্তারও কারণ। ইসলামি জঙ্গিপনার বিপদ স্বীকার করেও তাঁরা মনে করেন যে, এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে নির্দোষ ও নিরীহ আম মুসলমানের ঢালাও খলনায়কীকরণ হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ছড়ানো হচ্ছে ঘৃণা বিদ্বেষ ও হিংস্রতা। প্রথম ভাবনাটি ভুল, কেন তার কিছু ব্যাখ্যা নিচে আছে।
     
    আর ওই দ্বিতীয় প্রকারের যে দুশ্চিন্তা, আমি এবং আমার মত অনেকেই যার শরিক, তার এক প্রতিনিধি-স্থানীয় দৃষ্টান্ত আমার হাতে এসেছে কয়েকদিন আগে, আমার এক তরুণ বন্ধুর সাথে ফেসবুকীয় কথোপকথনে। তিনি কে, সেটা এখানে প্রাসঙ্গিক না, কিন্তু তিনি আমাকে যে সব প্রশ্ন করেছেন তা বোধহয় অতিশয় প্রাসঙ্গিক। এখানে সেগুলো হুবহু উদ্ধৃত করলে হয়ত আমাদের আলোচ্য প্রশ্নগুলোকে সুনির্দিষ্ট আকার দিতে সুবিধে হবে। অবশ্য, এখানে উদ্ধৃত প্রত্যেকটি প্রশ্নগুলোর সুনির্দিষ্ট ও নিষ্পত্তিমূলক উত্তর দেওয়া এ লেখার উদ্দেশ্য ততটা নয়, যতটা হল মূল প্রশ্নগুলোকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে সমস্যাটাকে আরেকটু স্পষ্ট করে তোলা। নিচে রইল সেই তরুণ বন্ধুর দুশ্চিন্তা-জারিত প্রশ্নগুলো।
     
    দাদা,

    একটা বিষয় একটু বিস্তারিত জানতে চাই আপনার কাছে। আপনি যদি সময় করে একটু ডিটেইলসে উত্তর দেন, খুব উপকৃত হই। অনেকদিনই এটা আপনাকে জিজ্ঞেস করব করব ভেবেছি, কিন্তু করা হয়নি, কারণ বিষয়টা একটু সেন্সেটিভ, আর প্রশ্নটা একটু বিস্তারে করতে হবে।

    ছোটবেলা থেকেই (ক্লাস ওয়ান থেকে) আমি দেখে এসছি, আমার পরিমণ্ডলে শুধুমাত্র ধর্মে মুসলিম হওয়ার জন্য মানুষকে সন্দেহের চোখে, বিদ্বেষের চোখে দেখা হয়। ক্রিকেটে পাকিস্তান জিতলে "কীরে, খুব আনন্দ বল!" বলে টন্ট কাটা হয়, কেবল নাম দেখে বাড়িভাড়া দিতে অস্বীকার করা হয়, এমনকি মুসলিম ছাত্র ক্লাসে ভাল রেজাল্ট করলেও "আশ্রম থেকে শেষে মুসলিম ফার্স্ট হবে" এরকম কথা খোদ টিচারের মুখেই শুনেছিআমি ঘটনাক্রমে মুসলিম পরিবারে জন্মাইনি, কিন্তু একদম ছোটবেলা থেকেই আমার মুসলিম বন্ধু বা প্রতিবেশীদের এভাবে সামাজিক হেট ক্যাম্পেনিং এর মুখে পড়াটা ভীষণ দুঃখজনক লাগে। এই খারাপ লাগাটা ক্লাস ওয়ান থেকেই শুরু হয়েছিল, তো তখন তো আমি ধর্ম ভাল না খারাপ, যুক্তিবাদ ভাল না খারাপ, এতকিছু তো বুঝতাম না।

    এখন মুসলিমবিদ্বেষকে যারা জাস্টিফাই করে, তাদের থেকে যে যুক্তিগুলো উঠে আসে, সেগুলো -

    ১) আর কোন ধর্মে আইসিস, তালিবান, বোকোহারামের মত সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আছে?

    ২) "ওরা" (মুসলিমরা) সংখ্যায় বাড়লেই ইসলামিক রাষ্ট্র চায়, সংখ্যায় কমলেই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র চায়।

    ৩) সব ধর্মে সংস্কার হয়েছে, কিন্তু "ওরা" এখনও মধ্যযুগেই পড়ে আছে।

    ৪) সব ধর্মেই বহুবিবাহ বন্ধ হয়েছে, কিন্তু "ওদের ধর্মে" বহুবিবাহ আজও জায়েজ, ওদের ধর্মে নারীর অবস্থা সবচাইতে খারাপ।

    ৫) "ওরা" নিজেদের বাঙালি মনে করে না, মননে চিন্তনে আরব, ওদের কাছে ধর্মই সব।

    ৬) ধর্মের নামে মানুষ হত্যা "ওদের ধর্মের মত কোন ধর্মই করেনি।"

    ৭) "ওদের" বাড়াবাড়ির জন্যই বিজেপির মত দলের সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ, হিন্দু মৌলবাদ ইসলামিক মৌলবাদের প্রতিক্রিয়ার ফসল।

    ইত্যাদি ইত্যাদি। আপাতত এই কটাই মনে পড়ছে।

    এখন আমার প্রশ্ন

    ১) মুসলিমবিদ্বেষীদের এই দাবিগুলো কি তথ্যগতভাবে সত্যি?

    ২) সত্যিই কি ইসলাম আর পাঁচটা ধর্মের থেকে ব্যতিক্রমী ভায়োলেন্ট? এখন তো যুক্তি, তথ্য, পরিসংখ্যানের বিভিন্ন মেথডলজি দিয়ে অনেক বিষয় কম্পারেটিভ স্টাডি করা যায়। "ইসলাম অন্য পাঁচটা ধর্মের থেকে ভায়োলেন্ট" - এই বিষয়টা কি যুক্তি, তথ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা যায়? মানে আমার প্রশ্ন, দাবিটার গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু?

    ৩) ধরে নিলাম, ইসলাম সবচাইতে ভায়োলেন্ট ধর্ম। কিন্তু তাতে করেই কি মুসলিমবিদ্বেষ জায়েজ হয়ে যায়?

    ৪) একজন নাস্তিক হিসাবে মুসলিম সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার হরণ করা হলে তার প্রতিবাদ করা কি অন্যায়?

    ৫) হিন্দু মৌলবাদ কি সত্যিই ইসলামিক মৌলবাদের প্রতিক্রিয়ার ফসল? ইসলামিক মৌলবাদ না থাকলে সত্যিই কি হিন্দু মৌলবাদ বলে কিছু থাকত না?

    ৬) আইসিস বা তালিবানের মত মুসলিম লিগ বা বর্তমানে মিমকে কি মৌলবাদী বলা যায়? নাকি "সাম্প্রদায়িক, কিন্তু মৌলবাদী নয়"-এমনটা বলা উচিত?

    আমার প্রশ্ন করার মূল কারণটা কিন্তু কোনভাবেই ইসলামকে ডিফেন্ড করা বা তার ভয়াবহতাকে লঘু করা নয়। আমিও ধর্মহীন সমাজের স্বপ্ন দেখি, সব ধর্মের মত ইসলামের অবসানও আশা করি।

    কিন্তু মধ্যবিত্ত শিক্ষিত স্তরে ইসলামের সমালোচনাটা যেভাবে হয়, তার টোনটা ঠিক যুক্তিবাদের নয়, টোনটা বিদ্বেষের। এখন রিলিজিয়াস ক্রিটিসিজমকে ঢাল করে বুঝে বা না বুঝে অনেক প্রগতিশীল মানুষও বিদ্বেষের টোন ব্যবহার করছেন। এটা খুব আশঙ্কার।

    এখন, এই প্রশ্নগুলোর প্রত্যেকটাকে আলাদা করে উত্তর দেবার চেষ্টা না করে বরং এ প্রসঙ্গে কতকগুলো সাধারণ কথা ভেবেচিন্তে দেখি। তাতে করে সমাধান না আসুক, অন্তত সমস্যাটার চেহারাটা আরেকটু স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠতে পারে কিনা, দেখা যাক। হতে পারে, ভাবতে গিয়ে হয়ত ওপরের দু-একটা প্রশ্ন শেষতক বাদই পড়ে গেল, বা উল্টোভাবে, যে প্রশ্ন এখানে নেই তেমন কিছু এসে কথার মধ্যে ঢুকে পড়ল।

    প্রথমেই বলা দরকার, অনেকে আধুনিক মৌলবাদী উত্থানকে মুসলমান জঙ্গি উত্থানের সঙ্গে এক করে দেখেন, যা মোটেই সঠিক নয়। বর্তমান পৃথিবীর প্রধান ধর্মীয় ধারাগুলোর সবকটির মধ্যেই মৌলবাদী উত্থান ঘটেছে, বিভিন্ন মাত্রা, ভঙ্গী ও ধরনে। আমেরিকায় খ্রিস্টান মৌলবাদীদের কথা আমরা জানি, জানি ইসরায়েলের ইহুদী মৌলবাদীদের কথা, জানি ভারতের হিন্দু মৌলবাদীদের কথা, এবং জানি এই ভারতেই আশির দশকে তেড়েফুঁড়ে ওঠা শিখ মৌলবাদীদের কথাও --- যাদের হাতে ভারতের এক প্রধানমন্ত্রী নিহত হয়েছিলেন। ‘অহিংসার ধর্ম’ বলে কথিত বৌদ্ধধর্মও এ প্রবণতার বাইরে নয় মোটেই। থাইল্যান্ড, বর্মা ও শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধ ধর্মের তরফেও জঙ্গি প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে। আজ অনেকেরই হয়ত আর মনে নেই, দুহাজার এক সালের কুখ্যাত ‘নাইন ইলেভেন’-এর ঘটনার আগে পর্যন্ত সবচেয়ে বড় ধর্মীয় নাশকতার ঘটনা বলে ধরা হত উনিশশো পঁচানব্বই সালের দুটি ঘটনাকে। তার একটি ঘটেছিল আমেরিকার ওকলাহোমা সিটি-র ‘ট্রেড সেন্টার’-এ, যাতে বিস্ফোরক-ভর্তি ট্রাক দিয়ে ওই ভবনটিতে ধাক্কা মেরে প্রায় দেড়শো লোকের প্রাণনাশ করা হয়েছিল, এবং সেটা ঘটিয়েছিল কতিপয় খ্রিস্টান মৌলবাদী। অন্যটি ঘটেছিল জাপানে, যেখানে পাতাল রেলের সুড়ঙ্গে বিষাক্ত সারিন গ্যাসের কৌটো ফাটিয়ে দেওয়া হয়, তাতে বিষাক্ত গ্যাসে সরাসরি যত না মারা যায় তার চেয়ে অনেক বেশি লোক মারা যায় এবং গুরুতরভাবে জখম হয় সুড়ঙ্গের ভেতরে আতঙ্কগ্রস্তদের দৌড়োদৌড়িতে পদপিষ্ট হয়ে --- এবং সেটা ঘটিয়েছিল কট্টরপন্থী বৌদ্ধদের একটি ক্ষুদ্র উপগোষ্ঠী। আমরা বৌদ্ধধর্মটা অন্তত অহিংস বলে জানতাম, তাই না? তার দু বছর আগে উনিশশো তিরানব্বই সালে ভারতে সংঘটিত কুখ্যাত ‘বম্বে বিস্ফোরণ’ অবশ্যই একটি বৃহৎ নাশকতা, এবং সেটা ঘটিয়েছিল মুসলমান জঙ্গিরাই। কিন্তু, মুসলমান মৌলবাদীদের বক্তব্য অনুযায়ী, সেটা ছিল তার এক বছর আগে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিক্রিয়া। বলা বাহুল্য, এই বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনাটিকেও আবার মুসলমানদের অত্যাচারের প্রতিক্রিয়া বলেই দেখানো হয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সেটা কোনও সাম্প্রতিক ‘অত্যাচার’-এর প্রতিক্রিয়া ছিল না। হিন্দু মৌলবাদীদের নিজেদের দাবি অনুযায়ীই, এটা নাকি মোগল সম্রাট বাবরের তরফে ঘটে যাওয়া পাঁচশ বছরের পুরোনো এক অন্যায়ের প্রতিকার মাত্র! এবং, এই বাবরি মসজিদের ধ্বংসও আবার এ দেশে ধর্মীয় নাশকতার প্রথম ঘটনা নয়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও নয়। এ দেশে আজ পর্যন্ত ধর্মীয় নাশকতার সবচেয়ে বড় ঘটনা বলে যদি কোনও বিশেষ ঘটনাকে ধরতেই হয়, তো সেটা সম্ভবত উনিশশো চুরাশি সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধিকে হত্যা করার ঘটনা। সেটা মুসলমানেরা ঘটায়নি, ঘটিয়েছিল শিখ মৌলবাদীরা।

    ধর্মের সমালোচনা যে আধুনিক পৃথিবীর অন্যতম প্রধান কাজ, তাতে সন্দেহ নেই। সমালোচনা মানে সব ধর্মেরই সমালোচনা, ইসলামেরও।  কিন্তু, ইসলাম ধর্মের সমালোচনায় একটি ভুল আমরা প্রায়শই করে থাকি। আমরা বলি, ইসলাম ধর্ম (এবং সেইহেতু ওই ধর্মাবলম্বীরাও) তো হিংস্র হবারই কথা, কারণ, ইসলামীয় ধর্মশাস্ত্রে হিংসার উপাদান খুব বেশি আছে। হয়ত সত্যিই আছে, কিন্তু যুক্তিটা তা সত্ত্বেও ভুল, এবং দুটো দিক থেকেই ভুল। কারণ, প্রথমত, সব ধর্মশাস্ত্রেই হিংসার উপাদান কমবেশি আছে। এবং দ্বিতীয়ত, যে ধর্মের শাস্ত্রে হিংসার উপাদান কিছু কম আছে সে ধর্মগোষ্ঠীর মানুষের আচরণে হিংসা কম থাকবেই --- এ প্রত্যাশার ভিত্তিটাও বোধহয় খুব পোক্ত নয়।
     
    হিংস্রতার বর্ণনা ও তার নৈতিক সমর্থন হিন্দু শাস্ত্রগুলোতে কোরানের চেয়ে কিছু কম নেই। কম নেই বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টেও, যদিও, হয়ত বা সত্যিই কিছু কম আছে নিউ টেস্টামেন্টে।  আবার, শাস্ত্রগ্রন্থে হিংস্রতার বর্ণনা কম থাকলেই যে ধার্মিকেরা কিছু কম হিংস্র হবেন, এমন নিশ্চয়তাও পাওয়া কঠিন। যুদ্ধলিপ্সা, হত্যা এবং হিংস্রতায় যিনি প্রবাদপ্রতিম, সেই চেঙ্গিস খান কিন্তু মোটেই মুসলমান ছিলেন না, 'খান' পদবী দেখে যা-ই মনে হোক।  খ্রিস্টানরা ষোড়শ-সপ্তদশ শতক জুড়ে আমেরিকাতে স্থানীয় অধিবাসীদের বিরুদ্ধে যেভাবে হত্যালীলা চালিয়েছে নিউ টেস্টামেন্টের যাবতীয় ক্ষমার বাণী সত্ত্বেও, তা ইতিহাসে বিরল। মধ্যযুগের শেষে এবং আধুনিক যুগের গোড়ায় 'ক্ষমাশীল' খ্রিস্টানদের ডাইনি পোড়ানোর হিড়িক দেখে আতঙ্কে শিউরে ওঠেন না, এমন কেউই কি আছেন এ যুগে? 'ইসলামিক স্টেট' তার ঘোষিত 'বিধর্মীদের' হত্যা করে হত্যার উদ্দেশ্যেই, বা প্রতিশোধের উদ্দেশ্যে, এবং সেটা সারা জগতের লোককে ডেকে দেখানোর জন্যেও বটে। দেখ হে, আমরা কত ভয়ঙ্কর, কত বড় বীর, এই রকম একটা ভাব। কিন্তু মধ্যযুগের খ্রিস্টানরা ডাইনি মারত ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা দিয়ে, এবং যন্ত্রণা দেওয়াটাই সেখানে মূল উদ্দেশ্য, যাতে অকথ্য অত্যাচার করে তার মুখ থেকে অন্য আরেক ‘ডাইনি’-র নাম বার করে আনা যায়। এই কাজটির জন্য তারা বিচিত্র ও বীভৎস সব কলা-কৌশল ও যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেছিল। কাজেই, বিশেষ একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় হিংস্রতার সঙ্গে তার শাস্ত্রীয় অনুমোদনের একটা সহজ সরল সম্পর্ক ধরে নেওয়াটা বোধহয় সব সময় খুব নিরাপদ নয়।

    মুসলমানদের হিংস্রতার মতই আরেকটি বাজে গল্প আছে মুসলমানদের জনসংখ্যাবৃদ্ধি নিয়ে। মুসলমানদের হুহু করে বংশবৃদ্ধি হচ্ছে, এবং দ্রুত তারা হিন্দুদেরকে ছাপিয়ে গিয়ে গোটা দেশটাকে দখল করে ফেলবে, এই মিথ্যে আতঙ্কটা হচ্ছে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রচারের অন্যতম প্রধান বিষয়বস্তু, বহু মানুষই যা সরলমনে বিশ্বাস করেন। এখানে বলে নেওয়া দরকার, মুসলিম জনসংখ্যা যে বাড়ছে এবং তার হার যে হিন্দুদের চেয়ে এখন পর্যন্ত কিছু বেশিই বটে, এটা কিন্তু মিথ্যে নয়। মিথ্যে হল এই প্রচারটা যে, এইভাবে বাড়তে বাড়তে হিন্দুদের চেয়ে তাদের সংখ্যা নাকি বেশি হয়ে যাবে, এবং তারাই দেশটাকে গ্রাস করে ফেলবে। আসলে ঘটনা হল, সব ধর্মের জনসংখ্যাই বাড়ছে, এবং সংখ্যালঘুদের জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার সব দেশেই সংখ্যাগুরুদের চেয়ে সামান্য একটু বেশি হয়, যদি সেখানে সংখ্যালঘু নিধন না চলে, এবং বিশেষত যদি সে সংখ্যালঘুরা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া হয়। জনসংখ্যাবৃদ্ধির আসল যোগটা ধর্মের সঙ্গে নয়, অর্থনীতির সঙ্গে। হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যেও গরিবদের জনসংখ্যাবৃদ্ধি যদি আলাদা করে হিসেব করা হয় তো দেখা যাবে যে তা সচ্ছল হিন্দুদের চেয়ে অনেক বেশি। সম্পন্নরা ভাল রোজগার করতে চায়, ভালভাবে থাকতে চায়, এবং সন্তানের জীবনযাপনও যাতে সে রকমই হয়, সে ব্যবস্থা করতে চায়। তারা জানে যে সেটা করতে গেলে সন্তানকে উচ্চমানের শিক্ষাদীক্ষা দেওয়া দরকার, তার পেছনে ভাল করে যত্ন ও খরচাপাতি করা দরকার, এবং সেটা করার ক্ষমতাও তাদের আছে। ছেলেপুলে বেশি হলে তা সম্ভব নয়, এবং তাতে করে বাচ্চার মায়ের স্বাস্থ্যের বারোটা বাজবে, মা ঘরের বাইরে গিয়ে পেশাগত কাজকর্ম করে অর্থ উপার্জনও করতে পারবে না। ফলে, তারা বেশি সন্তান একদমই চায় না। উল্টোদিকে, গরিবরা এত কথা জানেও না আর তাদের সে ক্ষমতাও নেই। ফলে তারা যত বেশি সম্ভব সন্তান চায়, সেটা মায়ের স্বাস্থ্যহানি ও মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে হলেও। গরিবরা জানে তাদের সন্তান দুধেভাতে থাকবে না, এবং শেষপর্যন্ত কোনও শ্রমসাধ্য কাজেই যোগ দেবে যাতে শিক্ষা বা 'স্কিল' সেভাবে লাগে না। ফলে, সন্তানের সংখ্যা বেশি হলে দুরবস্থা আর অযত্নের মধ্যেও হয়ত রোগভোগ মৃত্যু এড়িয়ে কেউ কেউ টিঁকে যাবে, আর পরিশ্রম করে পরিবারের আয় বাড়াতে পারবে, যৎসামান্য হলেও। অথচ এদেরই যখন অর্থনৈতিক উন্নতি হবে, তখন এরা মেয়েদেরকে পড়াশোনা শেখাতে চাইবে, ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সন্তানকে কেরানি-আমলা-ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-উকিল এইসব বানাতে চাইবে, ফলে স্বল্পসংখ্যক সন্তান চাইবে, এবং মায়ের জীবন ও স্বাস্থ্যকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করবে। একটু ভাল করে খোঁজখবর করলেই জানা যাবে, অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ঘটছে কিন্তু আসলে ঠিক তাইই, হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের ক্ষেত্রেই। এবং, মুসলমানরা পিছিয়ে আছে বলেই তাদের অগ্রগতিও দ্রুততর। তাদের জন্মহারের বৃদ্ধি কমছে কিছু বেশি দ্রুতলয়ে। এভাবে চললে আর দেড় দুই দশক পরেই হয়ত হিন্দু-মুসলমানের জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার সমান হয়ে যাবে, এবং মুসলমানদের ভারত দখলের কুৎসিত অশিক্ষিত গল্পতেও তখন আর কেউই পাত্তা দেবে না। ইতিহাসের স্বাভাবিক গতি এই দিকেই।
     
    এখানে 'অগ্রগতি' বলতে জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার কমিয়ে আনার কথা বুঝিয়েছি। মুসলমানদের ক্ষেত্রে এই কমিয়ে আনাটা হিন্দুদের চেয়ে বেশি হারে ঘটছে (বৃদ্ধির হার কমে যাওয়া মানে জনসংখ্যা কমে যাওয়া নয় কিন্তু, এ হার কমতে কমতে শূন্যের নিচে নামলে তবেই জনসংখ্যা কমতে শুরু করবে)। এই কমে আসাটা উন্নয়নের পরোক্ষ সূচক। এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিন বাদে যে হিন্দু-মুসলমানের জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার সমান হয়ে যাবে তাতে সন্দেহ নেই।  পিছিয়ে আছে বলেই অগ্রগতি বেশি তাড়াতাড়ি হচ্ছে --- এ কথাটা হয়ত অনেককে বিস্মিত করতে পারে, কিন্তু কথাটা বলার কারণ আছে। নিশ্চয়ই জানেন, ভারত চিন ব্রাজিলের মত একটু এগিয়ে থাকা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ইউরোপ আমেরিকার উন্নত দেশগুলোর থেকে বেশি। এর কারণ হচ্ছে, একবার উন্নত হয়ে গেলে একই গতিতে আরও আরও উন্নত হতে থাকাটা ক্রমশই আরও বেশি বেশি করে কঠিন হয়ে ওঠে, তাই উন্নয়নের প্রথম দিকে বৃদ্ধির যে গতি থাকে পরের দিকে আর তত গতি থাকে না। মুসলমানদের জনসংখ্যার ক্ষেত্রেও তাইই ঘটছে, এবং আরও ঘটবে (ও দুটোকে খুব নিখুঁতভাবে মেলানোর দরকার নেই, যদিও)।

    আমরা যারা এই বিষয়গুলোকে এইভাবে ভাবার চেষ্টা করি, তাদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আসে প্রায়শই, ফেসবুকে সে গর্জন রোজই শোনা যায়। এখন, এটা তো সত্যি কথাই যে, পশ্চিমবাংলার যুক্তিবাদীদের লেখালিখিতে, এবং যথারীতি আমার নিজের লেখাতেও, হিন্দু মৌলবাদের সমালোচনাই বেশি আসে, মুসলমান মৌলবাদের কথা বাস্তবিকই আসে অনেক কম। ঠিক এই অভিযোগটি সেক্যুলারদের প্রতি হিন্দু মৌলবাদীরা করে থাকেন নিয়মিতই (বস্তুত, প্রত্যেক ধর্মের মৌলবাদীরাই তাদের নিজস্ব গোষ্ঠী বা সমাজের সেক্যুলারদের প্রতি এই একই অভিযোগ করে থাকে)। কিন্তু একটু ভাবলে বুঝবেন, এটাই প্রত্যাশিত ও স্বাভাবিক। এবং, অন্যরকম কিছু হলেই বরং অত্যন্ত অস্বাভাবিক ও অসঙ্গত হত, এমন কি অন্যায়ও হত। কেন, তার একাধিক কারণ আছে। প্রথমত, এ দেশের রাষ্ট্র ও সমাজ যে মৌলবাদী হুমকিটির মুখোমুখি, সেটা তো হিন্দু মৌলবাদই, অন্য কোনও মৌলবাদ নয়। শিক্ষা-প্রশাসন-বিচারব্যবস্থার ধর্মীয়করণ, সংবিধানকে পাল্টে দেবার পরিকল্পনা, ভিন-ধর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন, ধর্মের জিগির তুলে তার আড়ালে সরকারি সম্পত্তি পাচার --- এ সব তো মুসলমানরা করছে না, হিন্দুত্ববাদীরাই করছে। অতএব, তাদের মুখোশ খোলাটাই এখানে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক। মুসলমান জঙ্গিরা নাশকতা ঘটালে তার মোকাবিলার জন্য পুলিশ-মিলিটারি আছে, কিন্তু নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসা মৌলবাদীদের রোখবার দায়িত্ব তো আর পুলিশ-মিলিটারি নেবে না, সেটা সাধারণ ভারতীয় নাগরিকের কাজ। আমি যে দেশে এবং যে ধর্মীয় সমাজের মধ্যে বাস করি, সেখানে যারা অন্ধত্ব ও হিংস্রতা ছড়াচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রকে বিনাশ করছে, তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোটাই তো আমার পক্ষে স্বাভাবিক, তাই না? বাংলাদেশি মুক্তমনারা যদি মুসলমান ধর্ম ছেড়ে হিন্দুদেরকে গালি দিতে থাকতেন, বা বার্ট্র্যান্ড রাসেল যদি 'হোয়াই আই অ্যাম নট আ ক্রিশ্চান' না লিখে 'হোয়াই আই অ্যাম নট আ হিন্দু' লিখে বসতেন, তাহলে যেমন উদ্ভট অসঙ্গত কাজ হত, এখানে আমরা হিন্দু ধর্ম ছেড়ে মুসলমান নিয়ে পড়লেও ঠিকই একই ব্যাপার হবে (যদিও বাংলাদেশি মুক্তমনারা ঠিক যা বলেন এবং যেভাবে বলেন, তার অনেক কিছুর সঙ্গেই আমার দ্বিমত আছে, তবে সেটা এখানে প্রাসঙ্গিক না)। দ্বিতীয়ত, আমরা পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগ মুক্তমনা যুক্তিবাদী নাস্তিকেরা হিন্দু সমাজে জন্মেছি বলেই সে সমাজ ও তার ধর্ম শাস্ত্র রীতিনীতি আচার বিচার এইসব অনেক বেশি জানি, ফলে সে ব্যাপারে আমাদের সমালোচনা অনেক বেশি নিরেট, নির্ভুল এবং অর্থবহ হয়, যা ভিনধর্মী সমাজে যারা জন্মেছে তারা পারবেনা। ঠিক একই কারণে, মুসলমান সমাজ ও ধর্ম সম্পর্কে মুসলমান সমাজে জন্মানো যুক্তিবাদীদের সমালোচনা অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য ও ফলপ্রসূ হয়। যদিও, এর মানে মোটেই এই নয় যে এক ধর্মে জন্মানো লোক অন্য ধর্মের সমালোচনা করতেই পারবেনা --- যে কোনও মানুষের যে কোনও ধর্মের সমালোচনা করার অধিকার আছে, এবং করা উচিত। তবে কিনা, নিজের সমাজের অন্ধত্ব অযুক্তি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথমে সোচ্চার হওয়াটা যে কোনও মানুষেরই ‘স্বাভাবিক’ অধিকার, কর্তব্যও বটে।
     
    আচ্ছা, তা সে যা-ই হোক, মোদ্দা কথাটা তাহলে কী দাঁড়াল --- মুসলমানেরা ধর্মান্ধতায় অন্যদের চেয়ে এগিয়ে, না পিছিয়ে? এসব ঠিকঠাক বলতে গেলে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে পৃথিবীজোড়া সমীক্ষার নির্ভরযোগ্য ফলাফল চাই, না হলে সবটাই চায়ের দোকানের আড্ডা হয়ে যাবে। আপাতত আছে কি সে সব, আমাদের হাতে? সুখের বিষয়, সে সব আছে। এই কিছুদিন মাত্র আগেও সেভাবে ছিল না, কিন্তু এই একুশ শতকে বেশ ভালভাবেই আছে। বেশ কয়েকটি বিখ্যাত সংস্থা এখন মানুষের জীবনের নানা দিক নিয়ে প্রামাণ্য সমীক্ষা করে থাকে, তার মধ্যে ধর্মবিশ্বাসও পড়ে। এইসব সমীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে বড় বড় বিশেষজ্ঞরা নানা গভীর গবেষণাও করে থাকেন, এবং তাতে তেমন চমকপ্রদ কোনও ফলাফল পাওয়া গেলে সারা পৃথিবীর গণমাধ্যমে সে নিয়ে আলোড়ন উঠে যায়। এই রকমই একটি সংস্থা হল ‘উইন গ্যালাপ’। তারা সারা পৃথিবী জুড়ে মানুষের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে এক বিখ্যাত সমীক্ষা চালিয়েছিল ২০১২ সালে, তাতে বিভিন্ন ধর্মগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মবিশ্বাসের প্রাবল্য, ধর্মবিশ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে আসা মানুষের সংখ্যা, এইসবের হিসেব ছিল। তাতে কি দেখা গেল? নিচে দেখে নিন ২০১২ সালের পৃথিবীজোড়া সমীক্ষার ফলাফল, সুন্দর করে সারণিতে সাজানো। এখানে পরিষ্কারভাবেই দেখা যাচ্ছে, নিজেকে বিশ্বাসী বলে দাবি করেন অথচ ধার্মিক বলে দাবি করেন না --- এমন মানুষের অনুপাত মুসলমানদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি। কারা কবে সমীক্ষাটি করেছে, এবং তা কোন নথিতে প্রকাশিত, সব তথ্যই পাবেন এখানে।
     
     
    এবার একটি ইসলামীয় দেশকে নিয়ে ভাবা যাক, যেখানে প্রায় সর্বাত্মক মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং ইসলামীয় রাষ্ট্র আছে। ধরুন, ইরান। এই  দেশটা সম্পর্কে আপনি কী জানেন? জানি, এ প্রশ্নের উত্তরে প্রায় সকলেই একই কথা বলবেন। ছিয়ানব্বই দশমিক পাঁচ শতাংশ (সরকারি সেন্সাসের তথ্য অনুযায়ী) মুসলমান অধ্যুষিত একটি ধর্মান্ধ দেশ, যার মধ্যে আবার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা শিয়া মুসলমানদের। কট্টর মৌলবাদীরা সেখানে দেশ চালায়, প্রশ্ন করলেই কোতল হতে হয়, মুক্তচিন্তা কল্পনাতীত। সম্প্রতি সেখানে হুলুস্থুলু ঘটে গিয়েছে, সে সব খবরাখবর আপনারা দেখেছেন। একটি মেয়েকে ইসলাম-সম্মত পোশাক না পরার অপরাধে সেখানে হত্যা করা হয়েছে, তাই নিয়ে প্রবল আন্দোলন হলে রাষ্ট্রের তরফে নেমে এসেছে দমন-পীড়ন, এবং সদ্য-সমাপ্ত ফুটবল বিশ্বকাপে সারা পৃথিবীর সামনে তার প্রতিবাদ করায় সে দেশের জাতীয় দলের এক খেলোয়াড়কে দেওয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। এখানে মৌলবাদের দাপটের ছবিটা একদমই স্পষ্ট, আবার গণমানুষের আপত্তিটাও খুব আবছা নয়।

    আসলে, এখানে ধর্মীয় রাষ্ট্রের দোর্দণ্ডপ্রতাপের তলাতেই লুকিয়ে আছে অন্য এক বাস্তবতা। নেদারল্যান্ডের একটি গবেষণা সংস্থা (GAMAAN), ইরানই যাদের অনুসন্ধানের বিষয়বস্তু, তারা ২০২০ সালে  ইরানে সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছে। সে সমীক্ষার ফলাফল যদি বিশ্বাস করতে হয়, তো সেখানে সাঁইত্রিশ শতাংশ মত লোক নিজেদের মুসলমান বলে দাবি করেন (শিয়া-সুন্নি মিলিয়ে), যাঁরা কোনও ধর্মীয় পরিচয় দিতে রাজি নন তাঁরা বাইশ শতাংশ, যাঁরা পরিষ্কারভাবে নিজেকে নাস্তিক-অজ্ঞাবাদী-মানবতাবাদী এইসব বলে পরিচয় দেন তাঁরা সব মিলিয়ে প্রায় সতেরো শতাংশ, যাঁরা নিজেকে শুধুই 'স্পিরিচুয়াল' বলেন তাঁরা প্রায় সাত শতাংশ, এবং বাকিরা আরও নানা বিচিত্র ধর্মের মানুষ। নিচের ছবি দুটোয় সমীক্ষার ফলাফল এক নজরে পাওয়া যাবে। হ্যাঁ বন্ধু, একুশ শতকে পৃথিবী বদলাচ্ছে, এবং হয়ত বিশ শতকের চেয়েও দ্রুত গতিতে! এবং, ইসলামীয় দেশগুলো কোনওভাবেই এ প্রবণতার বাইরে নয়। নিচে সে সমীক্ষার ফলাফল দেখুন, চিত্রাকারে।
     
     
    ধর্ম, ঈশ্বর, স্বর্গ, নরক, মৃত্যু-পরবর্তী জীবন, অবতার ইত্যাদি ধ্যানধারণা বিষয়ে ইরান-বাসীদের বিশ্বাস (বা অবিশ্বাস) ঠিক কী রকম, সে চিত্রও উঠে এসেছে সমীক্ষা থেকে। নিচে দেখুন।
     
     
     
    তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, মুসলমানদের ধর্মপ্রীতি নিয়ে আমাদের অধিকাংশের মধ্যে যেসব জনপ্রিয় ধ্যানধারণা আছে, তার সমর্থন এইসব সমীক্ষার ফলাফল থেকে মিলছে না মোটেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে ইঙ্গিত এখান থেকে আমরা পাচ্ছি, সেটা সামগ্রিক বৈশ্বিক প্রবণতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, নাকি একটা সম্পূর্ণ আলাদা উল্টোপাল্টা কিছু। সেটা বুঝতে গেলে বর্তমান শতকের বিগত কয়েকটি দশকে গোটা পৃথিবীর ধর্মবিশ্বাসের গতিপ্রকৃতি এক নজরে দেখে নেওয়া দরকার। এমনিতে সেটা একটু মুশকিল, কারণ, তার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংস্থার করা অনেকগুলো সমীক্ষা-কর্ম খুঁটিয়ে দেখে সেগুলোর প্রাসঙ্গিক ফলাফলটুকু বেছে নিয়ে তুলনা করতে হবে। সেইজন্যে, আমি যতটা পেরেছি সেগুলোকে সাজিয়ে একটা মাত্র সারণিতে নিয়ে এসেছি, তাতে পাঠিকের কিছু সুবিধে হবার কথা। সেটা নিচে দিলাম, দেখুন। সারণির কোন সংখ্যাটি কোন সংস্থার করা কবেকার সমীক্ষায় পাওয়া গেছে, সেটা ওখানেই দেওয়া আছে। প্রথম সংখ্যাটি অবশ্য কোনও সংস্থার তরফে দেওয়া নয়। এটি দিয়েছিলেন সমাজতত্ত্ববিদ ফিলিপ জুকারম্যান, তখন পর্যন্ত প্রাপ্য সমস্ত টুকরো টুকরো সমীক্ষার ফলাফল এক জায়গায় করে।
     
     
     
     
    এবার নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে, মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসের গতিপ্রকৃতি অন্য ধর্মাবলম্বীদের থেকে খুব বেশি আলাদা নয়। আসলে, এই একুশ শতকে দাঁড়িয়ে, সব ধর্মগোষ্ঠীর মধ্যেই ধর্মবিশ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে আসার যে প্রবণতা রয়েছে, মুসলমানরা কোনও মতেই সে প্রবণতার বাইরে নয় (অবশ্যই, এ হিসেব সামগ্রিক ও বৈশ্বিক, এবং অঞ্চল ও অন্যান্য পরিস্থিতি-ভেদে মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য আছে)।

    কেন এই জগৎজোড়া প্রবণতা? আমাদের স্বাভাবিক বুদ্ধি বলবে, সবই যুগের হাওয়া। মানে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং গণতন্ত্র-মানবতাবাদ-যুক্তিবাদ এইসবের প্রভাবই এর কারণ। কথাটা সত্যি, কিন্তু সমাজবিদেরা এর চেয়েও বড় কারণ আবিষ্কার করেছেন। তাঁরা আজ সুপ্রচুর তথ্য-যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন, মানব সমাজের উন্নতির সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক বিপ্রতীপ। দেশের মাথাপিছু আয় বাড়লে, সমাজকল্যাণে সরকার বেশি বেশি খরচা করলে, অর্থনৈতিক অসাম্য কমলে এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের হাল ভাল হলে ধর্মের রমরমা কমতে থাকে (এখানে আর বিস্তারে যাব না, যদিও আগে এ নিয়ে আলোচনা করেছি এবং পরেও করব)। সমাজ-বিকাশের এই সাধারণ নিয়ম মুসলমান সমাজের ওপরে প্রযোজ্য হবে না, এমনটা  ভেবে নেওয়ার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। ইরানে যা ঘটছে, সেটা সমাজ-বিকাশের এই সাধারণ নিয়মের চাপেই। নেটে একটু খোঁজাখুঁজি করলেই দেখতে পাবেন, ইরানের মাথাপিছু উৎপাদন ভারতের প্রায় আটগুণ, বাজেটের শতাংশ হিসেবে স্বাস্থ্যখাতে সরকারি খরচ প্রায় সাতগুণ এবং শিক্ষাখাতে তা দেড়গুণেরও বেশি, এবং নারী ও পুরুষ উভয়েরই আয়ু আমাদের থেকে ভাল (গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের দশা শোচনীয়, যদিও)। কাজেই, ইরানে মৌলবাদী রাজনীতি ও প্রশাসনের ওপর কেন গণ-অসন্তোষের চাপ আছে এবং পাকিস্তান আর আফগানিস্তানে কেন তা ততটা নেই --- এইটা বুঝতে পারা খুব কঠিন না।

    বলা প্রয়োজন, সমাজ-বিকাশজাত এই চাপের খেলা সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান উন্নত পশ্চিমী দেশগুলোতেও, বিশেষত এই একুশ শতকে। এই সেদিন পর্যন্ত আমেরিকা আর আয়ার্ল্যান্ডে ধর্মবিশ্বাসের প্রাবল্য ছিল অন্যান্য উন্নত দেশের চেয়ে অনেক বেশি। ধার্মিক সমাজবিদেরা তাই দেখিয়ে বলতেন, অর্থনৈতিক উন্নতি হলেই ধর্মের রমরমা কমবে, এটা হচ্ছে গিয়ে প্রগতিবাদীদের বানানো একটা মিথ্যে কথা। কিন্তু সময় যতই গড়াচ্ছে ততই বিষয়টা জলের মত স্বচ্ছ হয়ে আসছে, এবং আপত্তি তোলবার পরিসর হয়ে আসছে অতিশয় সঙ্কুচিত। মার্কিন সমাজে ধর্মবিশ্বাসের পরিবর্তনটা দেখতে পাবেন এক নজরেই, নিচের লেখচিত্রে। লক্ষ করে দেখুন, ১৯৫০ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত আমেরিকাতে যখন খ্রিস্টানরা এসে ঠেকেছে ৮৫ শতাংশ থেকে ৬৯-এ, এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা যখন মোটের ওপর একই আছে, তখন ধর্মহীনদের শতকরা অনুপাত গিয়ে ঠেকেছে শূন্য থেকে একুশে (অন্য কিছু সমীক্ষায় এটি প্রায় তিরিশ বলে দেখানো হয়েছে, যদিও)।
     
     
     
    আর, এই শতকের প্রথম দশকে আয়ার্ল্যান্ড-বাসীর ধর্মবিশ্বাসে যা ঘটেছে, সেটা দেখে নিন নিচের সারণিতে। আয়ার্ল্যান্ড হল গোঁড়া ক্যাথোলিক অধ্যুষিত একটি দেশ। একটা উন্নত পশ্চিমী দেশের পক্ষে অবিশ্বাস্যভাবে, এই সেদিন পর্যন্তও এই দেশটিতে গর্ভপাত নিষিদ্ধ ছিল, এবং গর্ভপাতের দরকার পড়লে আইরিশ নারীদেরকে পার্শ্ববর্তী ব্রিটেনে গিয়ে হাজির হতে হত। তারপর উন্নত আধুনিক অর্থনীতির সঙ্গে রক্ষণশীল ধর্ম-সংস্কৃতির দীর্ঘ সংঘর্ষের ফলাফল তখনই সারা বিশ্বের নজরে এল, যখন দু হাজার আঠেরো সালে গর্ভপাত আইনসিদ্ধ হয়ে গেল (আয়ার্ল্যান্ড নিয়ে আমার আলাদা একটি লেখা ‘গুরুচণ্ডালি’-তে পাবেন)।
     
     
    বলা বাহুল্য, মোটের ওপর এই একই ঘটনা ঘটবার কথা মুসলমান-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতেও, এবং ঘটছেও তাইই। বেশ কয়েকটি ধর্ম-শাসিত রক্ষণশীল দেশে কমছে কঠোর ধর্মীয় বাধানিষেধ, বাড়ছে ধর্মহীনতা, এবং সাধারণ্যে কমছে ধর্মের প্রতি আনুগত্য, যদিও অনেক ক্ষেত্রেই তা  এখনও স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান নয়। বিষয়টাকে যদি খুঁটিয়ে নজর করা হয়, তাহলে এমন অনেক কিছুই হয়ত জানা যাবে, যে ব্যাপারে আমরা আগে সচেতন ছিলাম না। যেমন, ইরান-ইরাক-আফগানিস্তান যেভাবে ধর্মনিরপেক্ষ থেকে ধর্মীয় রাষ্ট্র হয়ে গেল, এবং যেভাবে তুর্কি দেশটিতে ক্রমেই শক্ত হচ্ছে মৌলবাদের মুঠি আর টলমল করছে ধর্মনিরপেক্ষতার আসন, সে নিয়ে আমরা প্রায়শই দুশ্চিন্তিত হই। ঠিকই করি। কিন্তু, আমরা কখনই খেয়াল করে দেখিনা যে, এই ধরাধামে একান্নটি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মধ্যে একুশটিতে কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ সরকারই চলছে (সে ধর্মনিরপেক্ষতার দশা প্রায়শই আমাদের চেয়ে খুব একটা ভাল নয় যদিও, তবে সেটা তো অন্য চর্চা)। এবং, ধর্মনিরপেক্ষীকরণের প্রক্রিয়া এখনও চালু, সে তালিকায় এই সেদিনও যুক্ত হয়েছে সুদান।

    তবুও প্রশ্ন আসতেই পারে, এবং আসবেও, জানা কথা। ওপরে উদ্ধৃত আমার তরুণ বন্ধুর ভাষায়, সে প্রশ্নটা এ রকম --- “আর কোন ধর্মে আইসিস, তালিবান, বোকোহারামের মত সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আছে?”। সত্যিই তো, প্রশ্ন হতেই পারে। ওপরে ব্যাখ্যা করেছি (এবং পূর্ববর্তী পর্বগুলোতেও), মৌলবাদী উত্থান সব ধর্মেই হয়েছে, শুধু ইসলামে নয়। এবং, জঙ্গি ক্রিয়াকলাপও কম বেশি হয়েছে সব ধর্মের তরফেই। সেই সত্যে ভর করে আমি হয়ত তর্ক করতে পারতাম, অন্যান্য ধর্মের মৌলবাদের সঙ্গে ইসলামের তফাতটা তাহলে গুণগত নয়, নিছকই পরিমাণগত। এরা কম, ওরা কিছু বেশি, এটুকুই মাত্র। কিন্তু, এ তর্ক শেষতক দাঁড়াবে না। পাথরের নুড়ির সঙ্গে পাথরের টিলার গুণগত পার্থক্যকে স্রেফ পরিমাণের দোহাই দিয়ে নস্যাৎ করাটা বোধহয় খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ইসলামীয় জঙ্গিপনার নিবিড়তা, ঘনত্ব, প্রচণ্ডতা এবং আন্তর্জাতিকতা, এ সবকে নিছক কম-বেশির ব্যাপার বলে উড়িয়ে দেওয়া অসম্ভব। যদি বলি, মধ্যপ্রাচ্যে একাধিক আধুনিক রাষ্ট্র থেকে খামচে নিয়ে একটা গোটা এবং আনকোরা নতুন ধর্মীয় রাষ্ট্র বানিয়ে তোলা, অনেকগুলো দেশে ধর্মনিরপেক্ষ সরকার উল্টে দিয়ে মৌলবাদী রাজত্ব কায়েম করা, প্রায় সবকটি মহাদেশে বড়সড় নাশকতা চালানোর মত সংগঠন তৈরি করতে পারা --- এত সব শুধুই জঙ্গিপনার কম-বেশির ব্যাপার, তার মধ্যে আলাদা করে বলার মত গুরুত্বপূর্ণ গুণগত বৈশিষ্ট্য কিছুই নেই --- তাহলে অবশ্যই বোকামি হবে, বাস্তবকে অস্বীকার করার বোকামি। কাজেই, জঙ্গিপনার এই ভয়ঙ্কর নিবিড়তা আর ব্যাপকতাকে ইসলামীয় মৌলবাদের একটি স্বতন্ত্র গুণগত বৈশিষ্ট্য বলে স্বীকার করে নেওয়াই ভাল। কিন্তু মুশকিলটা হচ্ছে, সেটা মেনে নিলেও আসল সমস্যাটা রয়েই যায়। সব মুসলমানই তো আর মৌলবাদী জঙ্গি নন, তার এক অতি ক্ষুদ্র অংশই কেবল মৌলবাদী জঙ্গি। কাজেই, এই জঙ্গিপনাকে ইসলামীয় মৌলবাদের একটি স্বতন্ত্র গুণগত বৈশিষ্ট্য বলে মেনে নিলেও প্রশ্ন থাকে, ‘ইসলাম’ নামক ধর্মটির কোনও মৌল উপাদান থেকেই কি এই বৈশিষ্ট্যটি উৎসারিত হচ্ছে, নাকি, মুসলমান অধ্যুষিত সমাজ তথা রাষ্ট্রগুলোর  কোনও বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিই এ বৈশিষ্ট্যের নির্মাতা?
     
    কেউ কেউ এ প্রশ্নের উত্তর খুব দ্রুত দিয়ে ফেলতে ভালবাসেন। তাঁরা বলেন, এ বৈশিষ্ট্য অবশ্যই ‘ইসলাম’ নামক ধর্মটিরই মৌল উপাদান থেকে নিঃসৃত, কারণ, ইসলামীয় ধর্মশাস্ত্রে হিংসার অনুমোদন আছে। এ যুক্তিটি যে ভুল, সে আলোচনা ওপরে করেছি। কিন্তু কথা হচ্ছে, এ প্রশ্নের উত্তর তবে কীভাবে খোঁজা যায়? আজকের দিনে বিজ্ঞানে, বিশেষত সমাজবিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে, এ ধরনের প্রশ্নের সমাধানের জন্য যা করা হয় তাকে বলে ‘কন্ট্রোল্‌ড্‌ এক্সপেরিমেন্ট’। সমাজের ওপর তো আর পরীক্ষা চলবে না, অতএব সেখানে দরকার ‘কন্ট্রোল্‌ড্‌ অবজার্ভেশন’ বা সুনিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণ। অর্থাৎ, পুরোপুরি একই রকম করে তৈরি (বা সংগ্রহ) করে রাখা দুটি ক্ষেত্রের মধ্যে একটিতে একটি সুনির্দিষ্ট নির্ধারক উপাদান যোগ করে (বা একটি সুনির্দিষ্ট নির্ধারক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে), এবং অপরটিতে তা না করে, শুধুমাত্র প্রথম ক্ষেত্রটিতে কোনও এক নির্দিষ্ট প্রত্যাশিত ফলাফল এলো কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা, যাতে ওই নির্দিষ্ট উপাদানটির (বা প্রক্রিয়াটির) সঙ্গে ওই ফলাফলটির কার্যকারণ সম্পর্ক সন্দেহাতীতভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়। কোনও ওষুধের কার্যকারিতা প্রমাণের জন্য যেমন একই ধরনের দু দল রুগির মধ্যে একদলকে সে ওষুধ দিয়ে এবং অন্যদলকে তা না দিয়ে পরীক্ষা করা হয় যে দ্বিতীয় দলের তুলনায় প্রথম দলের কিছু বেশি উপকার হল কিনা, এও তেমনি। মনে করুন প্রশ্ন উঠল যে, মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামের যে মৌলবাদী উত্থান দেখা গেল, ইরাকের খনিজ তেল এবং আফগানিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থানগত সামরিক গুরুত্ব না থাকলেও কি তা ঘটতে পারত, শুধুমাত্র ইসলামীয় শাস্ত্র, সমাজ ও সংস্কৃতির একান্ত নিজস্ব আভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যের কারণেই? এ প্রশ্নের বিজ্ঞানসম্মত ও বস্তুনিষ্ঠ উত্তর বেরিয়ে আসতে পারে একমাত্র সেই ধরনের পদ্ধতিতেই, অর্থাৎ, ‘কন্ট্রোল্‌ড্‌ অবজার্ভেশন’ বা সুনিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। যেখানে ইসলামের প্রবল প্রভাব আছে অথচ কোনও বড়সড় অর্থনৈতিক বা সামরিক লাভালাভের পরিস্থিতি নেই, সে রকম সমস্ত জায়গাতেও কি মৌলবাদী জঙ্গিপনার উদ্ভব ঘটেছে? আবার, যেখানে ওই ধরনের পরিস্থিতি আছে অথচ ইসলাম নেই, সে রকম কোনও জায়গাতেই কি জঙ্গি আন্দোলনের উদ্ভব ঘটেনি? এই ধরনের অনুসন্ধান হয়ত আমাদেরকে এ ধরনের প্রশ্নের বস্তুনিষ্ঠ উত্তরের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ প্রসঙ্গে এ রকম গবেষণার কথা আমাদের জানা নেই।
     
    এই যে মুসলমান মৌলবাদের অস্তিত্বের কারণ হিসেবে ইসলামের আভ্যন্তরীণ কারণকে পুরোপুরিই দায়ী করা, ওপরের দুই অনুচ্ছেদে যার কথা বললাম, এর ঠিক উল্টো প্রবণতাটা হচ্ছে এর পেছনে ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ’ (বা আরও সাধারণভাবে ‘পশ্চিমী চক্রান্ত’) বা ওই জাতীয় ইসলাম-বহির্ভূত কোনও কিছুকে পুরোপুরি দায়ী করা (এবং সেইহেতু ইসলামীয় সমাজ ও সংস্কৃতির আভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যগুলোকে এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক বলে সাব্যস্ত করা)। মুসলিম মৌলবাদের উত্থানের পেছনে পাশ্চাত্য শক্তি, বিশেষত আমেরিকার ভুমিকা অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বের সাথেই আলোচনা করা উচিত। কিন্তু, বিশ শতকের পৃথিবীর ইতিহাসের সমস্ত ঘটনাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অঙ্গুলিহেলনে ঘটছে, চোখ বুজে এইটা বলে দিলে আপাতদৃষ্টিতে হয়ত তাকে নিন্দা করা হয়, কিন্তু আসলে শেষ বিচারে তার ক্ষমতাকে অনেকখানি বাড়িয়ে দেখা হয়। আমেরিকা (বা সাধারণভাবে ‘পশ্চিম’) মুসলমান দেশগুলোর আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল, শুধু এটুকু বললে প্রায় কিছুই বলা হয় না --- আসল প্রশ্ন হচ্ছে তারা তা পারল কী করে --- পৃথিবীর সব জায়গাতেই যে তারা যা চেয়েছে তাইই পেরেছে এমন তো আর নয়। মুসলমান সমাজ ও দেশগুলোর সুনির্দিষ্ট বিন্যাস ও ঐতিহাসিক পরিস্থিতি, বিকাশের সুনির্দিষ্ট অবস্থা, তাদের সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা, অন্তর্দ্বন্দ্ব, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সংশ্লিষ্ট সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তাদের তরফে নানা মতাদর্শ ও গোষ্ঠী-পরিচিতি নির্মাণের খেলা, এবং কখন ঠিক কোন তাড়নায় তারা কোন বৃহৎ শক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব বা শত্রুতার সম্পর্কে আবদ্ধ হচ্ছে, আর কোন বৃহৎ শক্তিই বা তাদেরকে সামলানো বা ব্যবহার করার জন্য ঠিক কী চাল চালছে --- এই সবের ভাল বিশ্লেষণ ছাড়া বিষয়টা ঠিকভাবে বোঝাই যাবে না। তাছাড়া, এই দেশগুলোতে 'সেক্যুলার' শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পরেও প্রায়শই শাসকরা স্বৈরাচারি এবং দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে কেন, এবং, কেনই বা মৌলবাদীরা বারবার তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জনগণের পাশে থাকার ভাণ করতে পারে, এটাও এ প্রসঙ্গে গভীরভাবে বোঝার বিষয়।  

    বলা বাহুল্য, এ সব প্রশ্নে যথার্থ ও যথেষ্ট বিশ্লেষণ এবং নিষ্পত্তিমূলক উত্তর এখনও আসেনি সমাজবিজ্ঞানীদের তরফ থেকে। যতদিন তা না আসে, ততদিন আমরা কী করতে পারি? ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে পারি, বিষয়টি সম্পর্কে ইতিমধ্যে যা জানা গেছে সে সব জানার চেষ্টা করতে পারি, যুক্তিসম্মত ও বস্তুনিষ্ঠ চিন্তার অভ্যাস করতে পারি …………… আর কিছু পারি কি?

    হ্যাঁ, পারি বোধহয়। মন থেকে অকারণ সন্দেহ ঘৃণা হিংসা বিদ্বেষ এইসব চিহ্নিত করে তা বর্জন করার অনুশীলনটা চালিয়ে যেতে পারি।

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৫ ডিসেম্বর ২০২২ | ৪৭৫৮২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • আধুনিকতার খোঁজে | 122.163.43.118 | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৩:৪২515646
  • &
    ভবিষ্যতের বাঞ্ছিত পৃথিবীটাও বিজ্ঞান আর যুক্তি দিয়েই গড়তে হবে। সন্দেহ নেই। কিন্তু কোন বিজ্ঞান আর কোন যুক্তি সেটাই প্রশ্ন। 
    যেহেতু ঘড়ির কাঁটাকে পেছনে ফেরানো যাবেনা। কিছুদিন আগে পর্যন্ত বিশ্বাস করতাম সময়ের কাঁটা নিজের এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের এগিয়ে নিয়ে চলেছে। এখন এই 'বিলিফ' থেকে বেরোনোর চেষ্টা করছি। অন্ততঃ প্রশ্ন করার সাহসটুকু অর্জন করার চেষ্টায় যাচ্ছি। সমাজের ঘড়ির কাঁটা সবসময়ে যে এগিয়ে চলবে এমনটা নাও হতে পারে। কখনো এগিয়ে কখনো পিছিয়ে এভাবেই চলে তা। অধ্যাপক তরুণ সান্যাল স্যার আজকের এগিয়ে চলার ব্যাপারটাকে বলতেন ব্যাকওয়ার্ড মার্চ। যায় হোক এটাও বিস্তারিত আলোচনা। দু লাইনে উপসংহার টানাটা মুশকিল। 
     
    আর 'সত্য' নিয়ে তো বিশাল আলোচনার স্কোপ আছে। আমি এখনই ঢুকতে চাই না। আমার যে কনক্লুডিং সিদ্ধান্ত কোনো আছে এমন না। এখনের জন্য শুধু এটুকু বলতে পারি , 'সত্য' অপরিবর্তনীয় কিছু নয়। আধুনিক বিজ্ঞান থেকেই উদাহরণ দেওয়া যাক। দেখুন নিউটনের আবিষ্কার একসময়ের 'সত্য' ছিল। আইনস্টাইন এসে তাকে প্রতিস্থাপিত করলেন। আইনস্টাইনের 'সত্য'টিই  আজকের দিনের 'সত্য'। তা হলে কি নিউটনেরটা 'সত্য' ছিল না?  আধুনিকতার খোঁজে 
     
  • Debasis Bhattacharya | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৪:২৭515647
  • তাতেও গিয়ে ঠিক ওই একই সমস্যা হবে। আমি জিজ্ঞেস করব --- 'সত্য অপরিবর্তনীয় নয়' এই কথাটা কি অপরিবর্তনীয় সত্য? 
     
    আপনি তার কী উত্তর দেবেন?
  • আধুনিকতার খোঁজে | 122.163.43.118 | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৫:০১515648
  • 'সত্য অপরিবর্তনীয় নয়' এই কথাটা কি অপরিবর্তনীয় সত্য? না তো। তাই তো সত্য অবিরাম পরিবর্তনীয়।  
  • dc | 27.62.112.230 | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৫:৪৭515649
  • কি ভুলভাল আলোচনা হচ্ছে রে বাবা :-( 
     
    "আর 'সত্য' নিয়ে তো বিশাল আলোচনার স্কোপ আছে। আমি এখনই ঢুকতে চাই না। আমার যে কনক্লুডিং সিদ্ধান্ত কোনো আছে এমন না। এখনের জন্য শুধু এটুকু বলতে পারি , 'সত্য' অপরিবর্তনীয় কিছু নয়। আধুনিক বিজ্ঞান থেকেই উদাহরণ দেওয়া যাক। দেখুন নিউটনের আবিষ্কার একসময়ের 'সত্য' ছিল। আইনস্টাইন এসে তাকে প্রতিস্থাপিত করলেন। আইনস্টাইনের 'সত্য'টিই  আজকের দিনের 'সত্য'। তা হলে কি নিউটনেরটা 'সত্য' ছিল না?"
     
    আধুনিকতার খোঁজে, ওপরের প্যারাটা একেবারে ভুল। নিউটন, আইনস্টাইন নিয়ে যদি লিখতেই হয় তো অনুরোধ করছি সঠিক জেনে লিখতে। গুরু নিকটি থেকে যেরকম অবিরাম খোরাক পোস্ট করা হয়, সেদিকে না গেলেই ভালো। 
  • Debasis Bhattacharya | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৫:৪৮515650
  • তার মানে, 'সত্য অপরিবর্তনীয় নয়' এই কথাটার পরিবর্তন হতেও পারে। তাইতো?
  • Debasis Bhattacharya | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৫:৫৭515651
  • ওপরের কথাটা 'আধুনিকতার খোঁজে'-কে বললাম। ইতিমধ্যে dc ঢুকে গিয়েছেন, দেখিনি। 
     
     
  • Debasis Bhattacharya | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৬:০১515652
  • dc,

    বিজ্ঞান-সত্য-যুক্তি এইসব নিয়ে আলোচনা এসে গেল, আপনাকে এক্সপেক্ট করেছিলাম, ওপরে বলেছি। স্বাগতম! আমিও মনে করি, নিউটন আর আইনস্টাইন নিয়ে 'আধুনিকতার খোঁজে' যা বললেন সেটা ভুল। তবে, সেটা  'খোরাক' আখ্যা পেতে পারে এমন ধরনের ভুল কিনা, আমি নিশ্চিত নই। সঠিক চর্চার অভাবে অনেকেই এ নিয়ে বিভ্রান্ত, আমি দেখেছি।
     
    এটা কেন ভুল, সেটা একটু বুঝিয়ে বলা যায় কি? আমিও শিখতে চাই।
  • dc | 27.62.112.230 | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৬:২৩515653
  • নানা ওটাকে খোরাক আখ্যা দিইনি। সেজন্যই তো বললাম গুরুর মতো খোরাক পোস্টের দিকে না যেতে :-)
     
    ওপরের প্যারাটায় দুধরনের ভুল চোখে পড়লো। এক, নেচার অফ ট্রুথ আর বিশেষত নেচার অফ ম্যাথাম্যাটিকাল ট্রুথ নিয়ে তিন হাজার বছর ধরে গবেষনা চলছে, তার নানা থিওরি, ফ্রেমওয়ার্ক ইত্যাদি আছে। নানা চমতকার বইও আছে। কাজেই "'সত্য' অপরিবর্তনীয় কিছু নয়" এরকম স্টেটমেন্টের কোন মানে হয়না। 
     
    দ্বিতীয়, আইনস্টাইন এর ট্রুথ নিউটনের ট্রুথ কে প্রতিস্থাপিত করে নি। আমি ধরে নিচ্ছি নিউটনের আবিষ্কার মানে আধুনিকতার খোঁজে গ্র‌্যাভিটির কথা বলেছেন। তাই যদি হয়, তো নিউটনের গ্র‌্যাভিটির সূত্রগুলি দিয়ে আজকের দিনেও ক্যালকুলেশান করা যায়, এগুলো ভুল হয়ে যায় নি। আইনস্টাইন ওগুলোকে এক্সটেন্ড করেছেন। নিউটনের গ্র‌্যাভিটি ছিল ক্লাসিকাল মেকানিক্সের অন্তর্গত, আইনস্টাইন সেটাকে রিলেভিসটিক ফ্রেমওয়ার্কে এক্সটেন্ড করেছেন।  আবার এই রিলেটিভিস্টিক ফ্রেমওয়ার্কেরও খামতি আছে, আমরা অপেক্ষা করছি কোয়ান্টাইজড গ্র‌্যাভিটির জন্য, যা কিনা আইনস্টাইনের থিওরিকে এক্সটেন্ড করবে। প্রতিস্থাপিত করবে না। 
  • dc | 27.62.112.230 | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৬:৩৭515654
  • নেচার অফ ট্রুথ নিয়েও আলোচনা করাই যায়, তাতে আপত্তি নেই :-)
     
    কিছুদিন আগে একজন লিখেছিলেন, কলোনিয়ালিজম, পোস্ট-মডার্নিজম ইত্যাদি নিয়ে বহু লেখালিখি হয়েছে, কাজেই নতুন করে চাকা আবিষ্কার না করলেও হয়। "ট্রুথ"বিষয় নিয়েও আমার একই মত। এ নিয়ে অনেক কাজ অলরেডি হয়েছে, বহু থিওরি আছে, ফিলোজফিকল ফ্রেমওয়ার্ক আছে। আগে সেসব নিয়ে কথা বলে নেওয়া যেতেই পারে। হঠাত করে নতুন কিছু সংযোজন করার আগে, যা অলরেডি কভার হয়েছে সেটা দেখে নিলে ভালো হয়। 
  • Debasis Bhattacharya | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৭:১৫515655
  • dc,
     
    অনেক ধন্যবাদ। নিউটন আর আইনস্টাইন নিয়ে যা বললেন, আমারও ঠিকঠাক লাগল। তবে, একটা খটকা আছে।
     
    অনেকে টমাস কুন-এর 'ইনকমেনসুরেবিলিটি'-র ধারণাকে টেনে এনে দাবি করেন, আইনস্টাইনের তত্ত্ব আসলে নাকি নিউটনীয় তত্ত্বের 'এক্সটেনশন' বা প্রসারণ নয়, একেবারে প্রতিস্থাপনই। তাঁরা বলেন, আপেক্ষিকতাবাদের গাণিতিক সূত্রটিই শুধু একটা বিশেষ ক্ষেত্র হিসেবে নিউটনীয় তত্ত্বে 'রিডিউসিব্‌ল্‌' বা পর্যবসনযোগ্য, তার আভ্যন্তরীণ ভৌত ধারণাগুলো নয়। আপেক্ষিকতাবাদের ক্ষেত্রে ভর, স্থান, কাল জাতীয় মূল ভৌত ধারণাগুলোই নাকি নিউটনীয় তত্ত্বের সমতুল্য ধারণাগুলোর থেকে আলাদা। আমি নিজে এই 'ইনকমেনসুরেবিলিটি'-র ধারণাটিকে গোলমেলে বলেই মনে করি, কিন্তু তবু আপনার তরফে আর্গুমেন্ট-টা বুঝতে আগ্রহী। 
     
    'ট্রুথ' নিয়ে আলোচনা ইতিমধ্যে যাইই হয়ে থাকুক, 'ট্রুথ'-এর অস্তিত্ব অস্বীকার করে বানানো যে কোনও বিবৃতিই যুক্তির অমোঘ জালে জড়িয়ে পড়ে। 'আধুনিকতার খোঁজে', অনুগ্রহ করে আমার ওপরের প্রশ্নটাতে ('সত্য অপরিবর্তনীয় নয়' এ কথাটা নিজে সত্য কিনা) একটু ধ্যান দেবেন। 
  • Debasis Bhattacharya | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৭:২৬515656
  • আরেকটা কথা। সব কিছু নিয়েই ইতিমধ্যে অনেক কথা হয়ে গেছে, কিন্তু সবাই তা জানেন না। এমন কি, 'অমুকটা জেনে নেওয়া দরকার' এইটুকু বুঝতেও কিছু অন্তত জানতে হয়, সেটাও অনেকে জানেন না। আর, সবাইয়ের পক্ষে সব কিছু জানাটাও এক অসম্ভব ব্যাপার (আমি তো প্রায় কিছুই জানিনা)। ফলত, আমি বা অন্য যে কেউই ভুল কিছু বলে ফেলতে পারেন, বোকার মত প্রশ্নও করে ফেলতে পারেন। তাই সবাইয়ের কাছে অনুরোধ, যদি আলোচ্য কোনও ব্যাপারে কারুর কিছু জানা থাকে, এবং আলোচনায় অংশগ্রহণকারী কারুর তা জানলে সুবিধে হত অথচ জানেন না এমনটা যদি মনে হয়, তো সেটা একটু সহজ করে জানিয়ে দেবেন প্লিজ, যদি সম্ভব হয়। 
     
    আলোচনায় আছি, তবে একটু আস্তে আস্তে ইন্টের‍্যাক্ট করব, জানিয়ে গেলাম। 
  • dc | 27.62.112.230 | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৭:৩৮515658
  • এইটা একটা ভালো পয়েন্ট। তাহলে প্রশ্ন হলো, সায়েন্টিফিক থিওরির দরকার কেন হয়? আমরা থিওরি বানাই কিছু অবসার্ভেশানকে ব্যাখ্যা করার জন্য, আর কিছু প্রেডিকশান করার জন্য। সায়েন্টিফিক থিওরি হতে গেলে অবশ্যই তাকে সায়েন্টিফিক মেথড অনুসরন করতে হবে, অর্থাত ফলসিফায়েবল হতে হবে। নিউটনের থিওরি অফ গ্র‌্যাভিটি এই সবকটা কন্ডিশানই মেনে চলে - এটা ফলসিফায়েবল, বেসড অন অবসার্ভেশান, আর এটা দিয়ে কিছু প্রেডিকশান করা যায়, সেই প্রেডিকশান ঠিক কিনা সেটা মেপে দেখা যায়। এগুলো নিউটনের সময়ে যেমন ছিল, আজকের দিনেও তাই। সেইজন্যই নিউটনের ফর্মুলার ​​​​​​​সেই ​​​​​​​গ্র‌্যাভিটেশনাল ​​​​​​​কনস্ট্যান্ট ​​​​​​​এখনও ​​​​​​​মাপা হয়, ​​​​​​​আর ​​​​​​​শুধু ​​​​​​​তাই না, ​​​​​​​এই গ্র‌্যাভিটেশনাল কনস্ট্যান্ট ​​​​​​​নিয়ে ​​​​​​​গত ​​​​​​​কয়েক ​​​​​​​দশকে ​​​​​​​এক ​​​​​​​বিশেষ ​​​​​​​গুরুত্বপূর্ণ ​​​​​​​বিতর্ক ​​​​​​​শুরু ​​​​​​​হয়েছে, যাকে ​​​​​​​বলা ​​​​​​​হয় ​​​​​​​ক্রাইসিস ​​​​​​​অফ ​​​​​​​কসমোলজি। 
     
    কিন্তু নিউটনের থিওরি অফ গ্র‌্যাভিটির একটা খামতি আছে - গ্র‌্যাভিটি ঠিক কি, সেটা এক্সপ্লেন করা নেই। আইনস্টাইন সেটা ব্যাখ্যা করেছিলেন এইভাবে, যে গ্র‌্যাভিটি হলো স্পেসটাইমের একটা ধর্ম। অর্থত কিনা গ্র‌্যাভিটি কেন আর কিভাবে কাজ করে, বা মেকামিজম অফ গ্র‌্যাভিটি, এটা থিওরি অফ জেনারাল রিলেটিভিটিতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তবে এই ব্যাখ্যাও অসম্পূর্ণ, কাজেই এখন কোয়ান্টাইজড গ্র‌্যাভিটির ফ্রেমওয়ার্ক বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।  
  • dc | 27.62.112.230 | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৭:৪৪515659
  • "আর, সবাইয়ের পক্ষে সব কিছু জানাটাও এক অসম্ভব ব্যাপার (আমি তো প্রায় কিছুই জানিনা)। ফলত, আমি বা অন্য যে কেউই ভুল কিছু বলে ফেলতে পারেন, বোকার মত প্রশ্নও করে ফেলতে পারেন।"
     
    এখানে একমত। আমি যেমন কলোনিয়ালিজমের প্রায় কিছুই জানিনা। তবে এটাও ঠিক, যেকোন ফিল্ডে অলরেডি কি কাজ হয়েছে সেটা অল্প একটু জেনে নিলে ভালো হয়। 
     
    বিটিডাব্লু, আমি কলোনিয়ালিজম ইত্যাদি নিয়ে আর কমেন্ট করিনি কারন আমার সত্যিই মনে হয়েছিল এসব নিয়ে বহু লেখালিখি হয়েছে, দেরিদা থেকে ফুকোদা আর ওপাড়ার নাড়ুদা, কাজেই এসব নিয়ে আমার আর মন্তব্য না করাই ভালো। তবে এটা একেবারেই আমার নিজস্ব মত, অন্য কেউ অন্যরকম ভাবতে পারেন :-)
  • dc | 27.62.112.230 | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৭:৫৭515660
  • আমার মনে হয় একটা কথা খেয়াল রাখলে সুবিধা হয় - সায়েন্টিফিক থিওরি হলো মডেল বানানোর প্রচেষ্টা, বা কোডিফায়েড নলেজ বানানোর প্রচেষ্টা। আমরা একটা থিওরি থেকে আরেকটা থিওরিতে যাই, তার মানে এই না যে "'সত্য' অপরিবর্তনীয় কিছু নয়"। তার মানে হলো একটা মডেল থেকে আরেকটা মডেলে যাওয়া, যা কিনা প্রাকৃতিক ঘটনার আরও বেশী ব্যাখ্যা দেয়। এই কোডিফিকেশান এর চেষ্টা মানুষ চিরকাল করে আসছে, এটা আমাদের নেচার (বিবর্তনবাদীরা বোধায় বলতে পারবেন আমাদের ব্রেন কেন ঠিক এইভাবেই তৈরি হয়েছে)। আগুনের ব্যবহার শেখার সময় থেকে লজ অফ থার্মোডায়নামিক্স, এনট্রোপি, ও সময়ের ধারনা - এই পুরোটাই হলো মডেল বানানোর প্রসেস। আবার দশ বছর ধরে চাষবাষের পদ্ধতি আবিষ্কার, নানা বীজ তৈরি করা, সেখান থেকে মেন্ডেল এর হাত ধরে আধুনিক জেনেটিক্স আর ক্লোনিং, এও হলো সেই একই মডেল বানানোর বা নলেজ কোডিফাই করার প্রসেস। আমরা চিরকাল এটাই করে আসছি।  
  • আধুনিকতার খোঁজে | 122.163.43.118 | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৮:০১515661
  • সবাইকেই বলছি। দেখুন অমি একেবাৰেই অশিক্ষিত তা শুরুতেই বলেছিলাম। যেখানে যাঁরা অংশগ্রহণ করছেন কোনো অংশেই দূর সন্দর্ভেও আমি তাদের সমকক্ষ নই। স্পেশালাইজড জ্ঞানের ক্ষেত্রে অসামান্য মানুষজন আছেন। তাঁদের থেকে শিখতে পারবো বলেই তো কিন্তু কিন্তু করেই এই আলোচনায় জুড়ে গিয়েছি। খোরাক-ও হয়ে যেতে পারি। তাতে আমার চাপ নেই। বা লজ্জাও নেই। না, সবটা জেনে তারপর এখানে মন্তব্য করতে এসেছি এমনটা একেবারেই নয়। সেটা ভেবেও দেখিনি যে আগেই সবটা শিখে নিতে হবে। ক্রমশ শিখছি এবং একই সঙ্গে নিজের জিজ্ঞাসাগুলোর উত্তর খুঁজছি। এবং সেটা অশিক্ষিত অংশের প্রতিনিধি হিসেবেই। তাই কিছুটা জানি যে আলোকিত অংশের থেকেই আমরা অশিক্ষিতরা শিখতে বাধ্য। (একটা ডিসক্লেমার : আমার পড়াশুনোর দৌড় উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত। তো নিজ গুনে ক্ষমাঘেন্না করে নেবেন।)     
     
    এবার ডিসি কে বলি - প্রতিস্থাপন না বলে যদি পরিবর্ধন-ও বলতাম তাতেও এসেন্সটা সম্ভবত পাল্টায় না। ব্যাপারটা শেষে গিয়ে এক ধরণের পরিবর্তন কেই সূচিত করে। আমি স্বল্পবুদ্ধি দিয়ে আপনার কথাতেও তাই বুঝেছি। কিন্তু তিনি কিভাবে সিদ্ধান্তে এলেন যে আমি বলেছি নিউটন ভুল হয়ে গিয়েছেন? আমি তো একটা প্রশ্ন করেছিলাম শুধু - নিউটনেরটা তা হলে 'সত্য' ছিল না? 
    আমি সত্যের প্রবহমানতার কথা বলছিলাম যেটা প্রকৃতি-পরিস্থিতি-সংস্কৃতি নিরপেক্ষ নয়। 
     
    আরেকটা কথা 'সত্য' শব্দটার বা বিষয়টার সংযোজন আমি এই থ্রেডে করিনি। আমি এই নিয়ে আমার একটা ছোট্ট মতামত দিয়েছিলাম মাত্র। (এবং এও বলেছিলাম আমি এই নিয়ে বেশি আলোচনায় এখন ঢুকতে চাই না।) তবে ভুলভাল আলোচনা হলে আপনারা তো আছেনই। একটু সময় সুযোগ করে গাইড করে দেবেন। :-) 
  • dc | 27.62.112.230 | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৮:১৫515662
  • আধুনিকতার খোঁজের পোস্ট পড়ে মনে হলো আপনাকে আঘাত করেছি । সেজন্য সত্যিই দুঃখিত, আর ক্ষমা চাইছি, (এখানে  আমরা একটু মজা করে বলি সরি চাইছি) যদিও কোনভাবেই আপনাকে ​​​​​​​খোরাক ​​​​​​​বলিনি। 
     
    " কিন্তু তিনি কিভাবে সিদ্ধান্তে এলেন যে আমি বলেছি নিউটন ভুল হয়ে গিয়েছেন? আমি তো একটা প্রশ্ন করেছিলাম শুধু - নিউটনেরটা তা হলে 'সত্য' ছিল না? "
     
    এখানটা ​​​​​​​পড়ে ​​​​​​​মনে ​​​​​​​হচ্ছে ​​​​​​​আমারই ​​​​​​​বুঝতে ​​​​​​​ভুল ​​​​​​​হয়েছিল, ​​​​​​​আবারও ​​​​​​​সরি ​​​​​​​চাইলাম :-)
     
    কাজের ​​​​​​​চাপে ​​​​​​​চিপ্টে ​​​​​​​গেছি ​​​​​​​বলে ​​​​​​​এই ​​​​​​​থ্রেডে ​​​​​​​পোস্ট ​​​​​​​করা ​​​​​​​হয় ​​​​​​​না, তবে মাঝে মাঝে কয়েকটা পোস্ট পড়ি। সেরকমই আপনার পোস্টটা পড়ে মনে হলো একটু লিখি। 
     
    আগের পোস্টের একটা ভুল সংশোধন করে দিঃ 
    আবার দশ *হাজার বছর ধরে চাষবাষের পদ্ধতি আবিষ্কার, নানা বীজ তৈরি করা, সেখান থেকে মেন্ডেল এর হাত ধরে আধুনিক জেনেটিক্স আর ক্লোনিং, এও হলো সেই একই মডেল বানানোর বা নলেজ কোডিফাই করার প্রসেস 
     
     
  • dc | 27.62.112.230 | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৮:১৮515663
  • আর ইয়ে, এখানে সবাই জানে যে অরণ্যদা হলো ইসলামোফোবিক আর আমি কাজের ফঁকে পানু দেখি, কাজেই আমাদের শিক্ষার লেভেল বুঝতেই পারছেন। কাজেই শিক্ষা অশিক্ষা নিয়ে এক্কেবারে ভাববেন না laugh 
  • আধুনিকতার খোঁজে | 122.163.43.118 | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৮:২২515664
  • ডিসি 
    একদম ভাববেন না। আলোচনায় তো এরকম হতেই পারে। আমরা বন্ধুরা তো মারামারিও করতাম। মাথা ফাটিয়ে বাড়ি যেতাম। পরের দিন আবার ভিসিআর ভাড়া করে একসঙ্গে বসে সিরোক্কো দেখতাম। -:)
  • dc | 27.62.112.230 | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৮:২৭515665
  • তাও বটে laugh
  • আধুনিকতার খোঁজে | 122.163.43.118 | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৮:৩১515666
  • দেবাশিসবাবু 
    'সত্য'নিয়ে শেষ কথা বলার মতো জায়গায় আমি নেই। তবে আমি তর্ক ছেড়ে একটা কথা বলতে পারি , আমি সত্যের প্রবহমানতায় বিশ্বাস করি। ধ্রুবত্বে নয়। 
  • guru | 146.196.47.52 | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৯:২৯515669
  • @ডিসি 
     
                আমিও এই আলোচনাতে আসার আগে অনেক কিছু জানতামনা | অনেক কিছু শিখে ঋদ্ধ হয়েছি বিশেষ করে দেবাশীষ বাবুর সঙ্গে আলোচনা করে | তা আমার পাঠানো খোরাকগুলো অন্ততঃ আপনার ভালো লেগেছে তাই আপনি সেগুলো মনে রেখেছেন এতদিন পরেও | শুনে ভালো লাগলো | heartsmileysurprise
  • Debasis Bhattacharya | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৯:৩১515670
  • সত্য নিয়ে শেষ কথা বলবার জায়গায় আমরা কেউই নেই, এবং খুব সম্ভবত কোনও কিছু নিয়েই শেষ কথা বলার জায়গায় কেউ নেই। আপনার অবস্থান আমি বুঝতে পেরেছি, কিন্তু, আমার প্রশ্নটা সম্ভবত আপনাকে বোঝাতে পারিনি। আপনি সত্যে বিশ্বাস করেন না, সত্যের অপরিবর্তনীয়তায় বিশ্বাস করেন না, সত্যের ধ্রুবত্বে বিশ্বাস করেন না --- এইসব বলে বিভিন্ন ভাবে একই কথা বলছেন না কি আসলে? 'ধ্রুবত্ব' বা 'অপরিবর্তনীয়তা' বাদ দিলে সত্যের আর থাকেটা কী? সত্য যদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন হয়ে যায়, তাহলে নিছক বিশ্বাস, মতামত, মনোভাব, অনুভূতি, বাসনা, প্রত্যাশা --- এইসব থেকে তাকে পৃথক করবেন কীভাবে?
     
    এবং, এখানে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারের দিকে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছিলাম। সত্যের ধ্রুবত্বকে অস্বীকার করলেই আপনি যুক্তির এক অমোঘ গণ্ডগোলে জড়িয়ে পড়বেন, যা থেকে বেরোবার রাস্তা নেই। কিন্তু, ওপরে আমার দেওয়া প্রশ্নটাকে ঠিকঠাক পারসু না করলে সেটা বুঝতে পারবেন না।
  • Debasis Bhattacharya | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৯:৩৩515671
  • আধুনিকতার খোঁজে,
     
    ওপরের মন্তব্যটি আপনার প্রতি। 
  • guru | 146.196.47.52 | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৯:৩৬515672
  • @আধুনিকতার খোঁজে
     
                                    " আমি সত্যের প্রবহমানতায় বিশ্বাস করি। ধ্রুবত্বে নয়। "
     
    একদম আমার মনের কথাটি আপনি ভাষাতে প্রকাশ করেছেন | অনেক অনেক ধন্যবাদ | আপনার সঙ্গে এই টইটাতে আলোচনা করেও অনেক কিছুই শিখেছি |
     
     আপনার আমাজানের উপরে লেখাটি এখন পড়ছি | সত্যি আপনার ভাষার উপরে দখল আকর্ষণীয় | নিজের অনুভবকে এতো সহজ সরল ভাষাতে ফুটিয়ে তোলা যেটা আমার মতো অনেকের মনের কথা কিন্তু যাকে ভাষাতে প্রকাশ করতে জানিনা এককথায় এক অনবদ্য প্রতিভা আপনার | অভিনন্দন | আরো কিছু লিখলে প্লিজ শেয়ার করবেন |
     
    আরেকটি প্রশ্ন | সত্যের এই প্রবহমানতা কি সমাজ অর্থনীতি রাজনীতি ইতিহাসের উপরে নির্ভর করে নাকি শুধুমাত্র সেই সত্যের মধ্যে অন্তর্নিহিত তত্ত্ব ও ক্ষমতার উপরে ? কি বলেন আপনি ?
  • guru | 146.196.47.52 | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৯:৪৪515673
  • @দেবাশীষ বাবু ,
     
                             আমি যেহেতু অনেক বিষয়ে এই টইতে আপনার কাছের থেকে শিখেছি এবং অনেক ক্ষেত্রেই আপনার বিরোধিতা করেই সেইজন্য আপনার কাছে কৃতজ্ঞ |
     
                              আধুনিকতার কাছে যে প্রশ্নটি করেছি সেটি আপনার কাছেও করছি | 
     
                             সত্যের এই প্রবহমানতা (বা ধ্রুবতা ) কি সমাজ অর্থনীতি রাজনীতি ইতিহাসের উপরে নির্ভর করে নাকি শুধুমাত্র সেই সত্যের মধ্যে অন্তর্নিহিত তত্ত্ব ও তার ব্যাপকতার ক্ষমতার উপরে ? কি বলেন আপনি ?
     
                            ডিসি কে এইসব প্রশ্ন (থুড়ি খোরাক ) করবার ধৃষ্টতা করবোনা | 
  • dc | 27.62.112.230 | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ২০:০৭515674
  • আগের পাতায় &\ এর দুয়েকটা পোস্ট পড়লাম, দেখছি আমি যা লিখেছি সেটা উনি আগেই লিখে দিয়েছেন। 
     
    " বিজ্ঞান তো পশ্চিমাদের না, পূর্বীদেরও না, বস্তুতঃ কারুরই না। এটা একটা পদ্ধতি, নিরন্তর অনুসন্ধান করে চলা ও ঝাড়াই বাছাই করে তাত্ত্বিক কাঠামো দাঁড় করাবার পদ্ধতি। তত্ত্বের সঙ্গে প্রেডিকশনগুলো না মিললে পুরনো তত্ত্বকে খারিজ করে নতুনভাবে নতুন তত্ত্ব আনার পদ্ধতি।"
     
    এক্কেবারে, এটাই হলো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির এসেন্স। আগুনের ব্যবহার করতে শেখা, চাকার ব্যবহার করতে শেখা, সেখান থেকে এনট্রোপি আর ইনফর্মেশান থিওরি; কৃষিকাজ আবিষ্কার, জেনেটিক্স এর নানা পদ্ধতি আবিষ্কার, এই সবই বিজ্ঞান। এই বিজ্ঞান মানুষের, পশ্চিমাদেরও না, পূর্বীদেরও না। 
     
    ""সত্য" জিনিসটা ইতিহাস, সংস্কৃতি, রাজনীতি ইত্যাদি নিরপেক্ষ। ত্রিভুজের তিনটি কোণের সমষ্টি ১৮০ ডিগ্রী-সেটা আমি মাপলেও, আপনি মাপলেও, বিল গেটস মাপলেও, বা অন্য কেউ মাপলেও। বা ধরুন সমকোণী ত্রিভুজের কেসটা। অতিভুজের বর্গ নিন। তারপরে দেখুন সেটা অন্য দুই বাহুর বর্গের যোগফলের সঙ্গে মিলছে কিনা। বিলাতে আমেরিকায় চীনে জাপানে আফ্রিকায় মঙ্গলে যেখানেই করুন না কেন, মিলে যাবে"
     
    এখানেও একমত, তবে একটু অ্যাড করবো। সায়েন্সে কনসেনসাস হলো এরকমঃ কিছু প্রপার্টিজ অফ নেচার আছে যা হলো ইউনিভার্সাল, ইমিউটেবল, কন্স্ট্যান্ট। এগুলোকে আমরা একটা বিশেষ ল্যাংগুয়েজ দিয়ে কিছুটা অনুভব করতে পারি, আর সেই ল্যাংগুয়েজটার নাম আমরা দিয়েছি ম্যাথামেটিক্স। ম্যাথামেটিকাল ট্রুথ বা প্রপার্টি পাল্টায় না, আমাদের জন্য যা সত্যি তা বিটেলগেউজের প্রাণিদের জন্যও সত্যি। এই ম্যাথামেটিকাল ট্রুথ গুলোর বহিঃপ্রকাশ হলো কিছু ফিজিকাল লজ, যেমন ইলেকট্রোম্যাগনেটিজম বা গ্র‌্যাভিটি। এসব নিয়ে নানান ইন্টারেস্টিং লিংক আছে, যেমন কিনা চট করে মনে পড়ছে ম্যাক্স টেগমার্ক এর একটা বই, আওয়ার ম্যাথামেটিকাল ইউনিভার্স। 
  • আধুনিকতার খোঁজে | 122.163.43.118 | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ২০:০৯515675
  • দেবাশীষদাবাবু ও গুরু 
    আমার মনে হয় আমার এভাবে বলা উচিত ছিল। ধ্রুবত্ব নিশ্চয় সত্যের অঙ্গাঙ্গী। কিন্তু আমার কাছে তা টেম্পোরাল। সেটা সময় ও অবস্থান ধরে সমাজ-সংস্কৃতি-প্রকৃতি-নান্দনিকতা অনুযায়ি প্রবাহিত হয় ও পরিবর্তিত-পরিবর্ধিত হাতে পারে এবং অবশ্যই ভিন্ন ভিন্ন দার্শনিক অক্ষ ধারণ করতে পারে। আমাদের প্রকৃতির মতোই সত্য-এর চলাচলটির একটি মূল বৈশিষ্ট্য হল তার ডাইভার্সিটি। যে কোনো সত্য লিনিয়ার ও ইউনিভার্সাল নয়। 
  • dc | 27.62.112.230 | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ২০:২৩515676
  • "এই ম্যাথামেটিকাল ট্রুথ গুলোর বহিঃপ্রকাশ হলো কিছু ফিজিকাল লজ, যেমন ইলেকট্রোম্যাগনেটিজম বা গ্র‌্যাভিটি" - এর  একটা উদাহরন হলো হিলবার্ট স্পেসেস, যা কিনা কোয়ান্টাম মেকানিক্স, ফ্লুইড ডায়নামিক্স, ইলেকট্রোম্যাগনেটিজম ইত্যাদি থিওরি বানাতে কাজে লেগেছে। আরেকটা উদাহরন হ্যামিল্টোনিয়ান অপারেটর।
     
    এবার যাই, সময় পেলে পরে লিখবো।   
  • Debasis Bhattacharya | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ২০:৫৩515677
  • guru,
     
    আপনি বার বার ঘোষণা করছেন যে আমার থেকে নাকি অনেক শিখছেন, কিন্তু বার বারই যে সিদ্ধান্তগুলো প্রকাশ করছেন সেগুলো সবই দেখছি আমার বিরুদ্ধে যাচ্ছে। 
     
    কী ঘোটচে বলুন্তো! ক্যাইস কিন্তু ক্রমেই ক্রিটিক্যাল হয়ে উঠছে!
  • গ্র‌্যাভিটি ও স্পেসটাইম | 136.226.80.119 | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ২০:৫৬515678
  • বহুদূর চলে আসা হয়েছে মূল থেকে, মনে হয়না কারোর তাতে আপত্তি আছে। হয়ত বর্তমান বিতর্কে অপ্রাসঙ্গিক, তবু ফুট  কেটে যাইঃ 
    "গ্র‌্যাভিটি হলো স্পেসটাইমের একটা ধর্ম" - তাই কি? 
    না, গ্র‌্যাভিটিই স্পেসটাইম? 
    এইটি অনুধাবন করতে পারা আইনস্টাইনে জিনিয়াসের এক প্রকাশ বলে শুনে থাকি! 
     
     
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন