এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • শৈশবের স্মৃতিমালা এবং তাহাদের কথা - পর্ব ১১

    Supriya Debroy লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৬ ডিসেম্বর ২০২২ | ২২২ বার পঠিত
  • এই প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে, প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর জন্য একটি কাঠের বিল্ট-ইন টেবিল এবং চেয়ার একসাথে থাকত এবং নিউটন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়ম ছিল একজন ছাত্র এবং একজন ছাত্রী পাশাপাশি বসবে। এটা লটারির মাধ্যমে ঠিক করা হত, কে কার সাথে বসবে। আমার ভাগ্যে পড়ল বাণী, ক্লাস মনিটর। আমার থেকে লম্বা ছিল বলে আমি বাণী-দি বলে ডাকতাম। পেয়ে গেলাম আরেকজন বকুল-দি। বকুল-দির মতন ফর্সা দেখতে ছিল না, গায়ের রঙ অনেকটাই চাপা। কিন্তু মুখশ্রী খুব সুন্দর, খুব হাসি-খুশি, ঝলমলে স্বভাবের। পড়াশোনায় অবশ্য খুব একটা ভালো ছিল না, কিন্তু স্কুলের সব খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিল। বাণী-দির সহায়তায় - আমি পতাকা উত্তোলন, মার্চপাস্ট, সরস্বতী পুজো, ইত্যাদিতে অংশ নিতে শুরু করি। বাণী-দি সর্বদা সরস্বতী পুজো আয়োজক দলের একজন সক্রিয় সদস্য ছিল এবং আমাকে মণ্ডপ সাজসজ্জা, ফুল সাজানোর কাজে নিয়োজিত করত।
    অর্ধ-বার্ষিক পরীক্ষায় যদিও আমি সর্বমোট সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছি, কিন্তু ড্রয়িং সাবজেক্টে পাশ মার্কস না পাওয়ার জন্য কোনও পজিশন পাই না। সেই সময় ড্রয়িং সাবজেক্টের মার্কস মোট মার্কসের সাথে যোগ না করা হলেও, পজিশন অর্জন করতে গেলে পাশ মার্কস পেতেই হবে। আমি ড্রইংয়ে খুব কাঁচা ছিলাম। সেই সময় থেকে দ্বিতীয় স্থানে থাকা মৃণাল আমার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয় এবং আমাকে প্রতিযোগী হিসাবে বিবেচনা করে। বার্ষিক পরীক্ষায় আমি ড্রইংয়ে মাত্র পনেরো নম্বর পেয়ে দ্বিতীয় এবং মৃণাল তৃতীয় হয়েছিল। যাইহোক, চতুর্থ শ্রেণীতে কয়েকদিন ক্লাস হওয়ার পর আমাকে 'সি' সেকশন থেকে অন্য সেকশন অর্থাৎ 'এ' সেকশনে স্থানান্তরিত করা হয় - কারণটি যদিও আমার জানা ছিল না। এবং 'এ' সেকশন থেকে 'সি' সেকশনে একজনকে স্থানান্তরিত করা হয়। বোধহয় ক্লাস টিচার আমার এবং মৃণালের মধ্যে একটা রেশারেশি অথবা সদ্ভাবের অভাব দেখতে পেয়েছিলেন।
    এবার চতুর্থ শ্রেণীর লটারি হয়ে গেছে, কে কার সাথে বসবে। নিয়ম অনুযায়ী আমার বসার কথা, স্থানান্তরিত ছাত্রটির জায়গায়। 'এ' সেকশনে আমার প্ৰথম দিনে, ক্লাস টিচার সবার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেন এবং আমার বসার জায়গাটি'তে গিয়ে বসার ইঙ্গিত করেন। পাশে দেখি বেশ সুন্দর দেখতে একটি মেয়ে বসে, কিন্তু প্ৰথম দর্শনেই কেন জানি না মনে হল মেয়েটি বোধহয় একটু দাম্ভিক। নাম পরিচয়ের সময়েই জানতে পেরেছি, ইন্দ্রাণী। বকুল-দি, কাজল এবং তারপর বাণী-দির সাথে মিশতে এবং বন্ধুত্বের যে স্বাচ্ছন্দ্য উপভোগ করেছি - বোধহয় এর সাথে সেটা হবে না। ইন্দ্রাণী গাড়িতে করে স্কুলে আসত। থাকত আইনস্টাইন এভিনিউ'তে। এমন কিছু দূরে নয়, ইচ্ছে করলেই হেঁটে আসা যায়। পরে জানতে পারি, এটা ওর বাবার অফিসের গাড়ি আর ওর বাবা ডিএসপির উচ্চ পদে কর্মরত। হয়ত সে কারণেই, সে তার আচরণে-কথাবার্তায় একটা দাম্ভিক ভাব দেখাত, অথবা অন্য সহপাঠীরা ভাবত ও দাম্ভিক। যাইহোক দেখলাম, অন্য সহপাঠীরা ওকে খুব একটা পছন্দ করে না। সবার মনোযোগ ওর প্রতি আকর্ষিত করার জন্য, স্কুলে এসেই শোনাত নানারকম বড়লোকি চাল দেওয়া কথা-বার্তা। কেউ কোনো মন্তব্য করত না। আমার ধীরে ধীরে মনে হতে থাকে, ইন্দ্রাণী আসলে সোজা-সরল। সম্ভ্রান্ত পরিবারে মানুষ হচ্ছে। এক মেয়ে, যা দরকার না চাইতেই পেয়ে যায়। তাই 'দেখানি' ভাবটা তো একটু হবেই। ও প্রচুর কথা বলতে ভালোবাসত। আমি যখন কিছু ক্লাসওয়ার্ক করতাম তখন কিছু না কিছু গল্প বলে আমাকে বিরক্ত করতে থাকত। আমার সেটা পছন্দ ছিল না, মাঝে মাঝে রেগে গিয়ে ধমক দিতাম। তখন চুপ করে যেত। আমার রাগ'কে বোধহয় একটু ভয় পেতো। দাদুভাই যেটা আমাকে বলতেন, আমার নাকি খুব রাগ। ছোটোছেলেদের এত রাগ থাকা ভালো নয়।
    কিন্তু দেখলাম, ক্লাসের অন্যান্য সহপাঠীদের থেকে খুব একটা পাত্তা না পেয়ে ইন্দ্রাণী ধীরে ধীরে আমার সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে শুরু করলো। যদিও আমাদের স্কুলে টিফিন দেওয়া হত, কিন্তু ইন্দ্রাণী সবসময় বাড়ি থেকে কিছু খাবার বা চকলেট নিয়ে আসত এবং আমার সাথে শেয়ার করত। ইংরেজি ক্লাসটিচার আমাদের ডিক্টেশন লেখা করাতেন।  এক-একদিন এক-একজনকে বলতেন ডিক্টেশন দিতে, আর বাকি সবাইরা সেটা শুনে লিখত। পরে উনি সবার খাতা চেক করতেন। উনি আমার ডিক্টেশন পড়া খুব পছন্দ করতেন এবং প্রায়ই আমাকে বলতেন ডিক্টেশন দিতে। আমি খেয়াল করতাম যখনই আমি ডিক্টেশন দিই, ইন্দ্রাণী হাঁ করে বড় বড় চোখ দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে – ফলস্বরূপ অর্ধেক শব্দ মিস করে যেত অথবা উল্টোপাল্টা লিখত। ইংরেজি টিচারের চোখে পড়ে এটা একদিন। জিজ্ঞেস করতে অবলীলায় উত্তর দেয়, 'সুপ্রিয় এত সুন্দর পড়ে, আমি লিখতে ভুলে যাই। কবে ওর মত করে এত সুন্দর পড়তে পারব !' টিচার ম্যাম এক ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেন, বলেন এরপর এরকম দেখলে বাড়িতে খবর পাঠাবেন।     
    যেহেতু আমরা স্কুলে ৫ / ৬  ঘন্টা পাশাপাশি বসে থাকতাম এবং সে সবসময় আমাকে তার বাড়ি, বাবা-মা, সে কী করেছিল গতকাল, ইত্যাদি সম্পর্কে কিছু না কিছু বলতেই থাকত। আমারও ধীরে ধীরে ওর গল্প শুনতে ভালো লাগতে শুরু করে এবং আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।
    একবার ইন্দ্রাণী তার জন্মদিনে, তার কয়েক জন সহপাঠীকে এবং আমাকে তার বাড়িতে সন্ধ্যায় স্ন্যাকসের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। খুব সম্ভব যতটা মনে পড়ে আমি হাতে করে সুকুমার রায়ের 'আবোল তাবোল' নিয়ে গিয়েছিলাম। বইটা আমার পড়া ছিল, একদম নতুন ছিল। বাবা ওটাকেই রঙিন কাগজ দিয়ে মুড়ে দিয়েছিলেন। আমি যখন অন্যদের সাথে তার বাড়িতে পৌঁছই, বাড়িটি দেখে  অবাক হয়ে যাই। একটি বিশাল বাংলো টাইপের বাড়ি যেখানে আলাদা সার্ভেন্ট কোয়ার্টার, গ্যারেজ, বিশাল ফুলের বাগান, ছোট্ট ছোট্ট ঘাসের সুন্দর সমান করে ছাটা লন। আমাদের বাড়িতেও সামনের উঠোনে কিছু ফুলের গাছ, টগর ফুলের গাছ, বাগানভুলিয়া ফুলের গাছ ছিল; কিন্তু ডানদিকের উঠোনের বেশির ভাগ জায়গাটাই ব্যবহার করা হত খাটিয়া পেতে বসে গল্প করার জন্য।    ( ক্রমশ )
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন