এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • শৈশবের স্মৃতিমালা এবং তাহাদের কথা - পর্ব ২ 

    Supriya Debroy লেখকের গ্রাহক হোন
    ০২ ডিসেম্বর ২০২২ | ৩৭২ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • শীতকালে এই শিউলিগাছের তলায় নরম হলুদ রোদ পিঠে লাগিয়ে খেতাম 'গাছি'র পেরে আনা খেজুর গাছের রস কলসি থেকে গ্লাসে ভরে কাঁপতে  কাঁপতে, সাথ দিতেন কুট্টিপিসি-দিদি-ছোটকাকু-আরও অনেকে। পুকুরপাড়ে ছিল একটি কুলগাছ, জামরুল গাছ, নিমগাছ। কুলগাছটা আবার ওর কোমর বেঁকিয়ে নুয়ে পড়েছিল প্রায় পুকুরের উপর। ছোটকাকু আর পাড়ার কাকু-দাদারা মিলে স্নান করার সময়, বিছিয়ে দিত মাদুর জলের উপর। তারপর কয়েকজন মিলে ঝাঁকি গাছের উপর উঠে। টপাটপ করে পাকা কুলগুলো বর্ষণের ধারার মতো ভরিয়ে দিত মাদুরের প্রাঙ্গণ। পাড়ে দাঁড়িয়ে দুই হাত দিয়ে আনন্দের তালি আমার। কী সুন্দর ও মায়াময় একটা শৈশবকাল ছিল আমার ! 
    ঘাটলার তুলসীমঞ্চের ঠিক পিছনেই ছিল একটি পেয়ারা গাছ, বাবা লাগিয়েছিলেন। ভিতরটা ছিল লাল টুকটুকে, সবাই বলত কাশির পেয়ারা। আমবাগানের মধ্যে আরও কয়েকটি পেয়ারা গাছ ছিল। বসতবাড়ির বামদিকে ছড়িয়ে ছিল অসংখ্য জবাফুলের গাছ, আর তার পাশ দিয়েই শুরু আমাদের ধানের ক্ষেত। এছাড়া সারা বাগান জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল টগর ফুল, নয়নতারা, গাঁদা ফুলের গাছ। পুজোমণ্ডপের ডানদিকের ছোট্ট জমিতে দাদুভাই লাগাতেন বেগুন, ঢেড়শ, কাঁচা লংকা এবং আরও অনেক সবজির গাছ।
    আমাদের পুকুরে ছিল দুটো কালবোস মাছ, সবাই বলত ঠাম্মার পোষা। সিঁড়ির দ্বিতীয় ধাপে পায়ের পাতা ভিজিয়ে ঠাম্মা হাতে ভাত নিয়ে জলের উপর ধরে থাকতেন নীচু হয়ে। আর অবাক ব্যাপার, কোথা থেকে ঐ দুটো কালবোস মাছ সাঁতার কেটে ঠাম্মার পায়ের চারপাশে ঘুরে বেড়াত আর ভাতগুলো খেয়ে যেত হাত থেকে। দুর্গাপুজোর দশমীর দিন আমাদের মৎসমুখ করা হতো পুকুরের থেকে মাছ ধরে। আমাদের বাড়ির দুর্গাপুজো হয় বৈষ্ণব মতে। দশমীর দিন হয় নিরামিষ ভঙ্গ পুকুরের মাছ দিয়ে। সকাল থেকেই জেলেরা ধরতো মাছ জাল ফেলে, আর আমরা সব পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম জেলেদের মাছধরা উৎসব। কিন্তু ঠাম্মার মানা ছিল যেন কেউ এই কালবোসের জোড়াকে না ধরে। আমি অনেকটা বড় হয়ে গেছি তখন, জানতে পারি একবার অধিক বর্ষণের ফলে পুকুর ভেসে যায় - এরপর থেকে আর দেখতে পাওয়া যায়না ঐ জোড়াকে।
    এই সমস্ত ফল এবং ফুলের গাছ-গাছালিতে ঘেরা পুকুর এবং পুজোমন্ডপ সহ এই বসতবাড়িটি দাদুভাই একটি দূরদর্শিতার সাথে এতটাই সূক্ষ্মভাবে পরিকল্পনা করে বানিয়েছিলেন যে তার পরবর্তী প্রজন্মরা, আজকালের তথাকথিত খামারবাড়িতে থাকার মতো, তাদের ছুটি কাটাতে পারে এখানে এসে এবং বছরে অন্তত একবার একে অপরের সাথে দেখা করতে পারে দুর্গাপুজোর সময়। 
    ****
    আমার বড়পিসি, ডাকতাম পিসিমণি বলে। থাকতেন আমাদের বসতবাড়ির পিছনে, ধানক্ষেত পেরিয়ে। বসতবাড়ির পিছনে ছিল দিগন্তব্যাপী ধানের ক্ষেত, শুরু হয়েছিল আমাদের বাড়ির গা ঘেসে জবাফুলের ঝাড় পেরিয়ে। দুই ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে ছিল একটি পায়ে চলার রাস্তা, সামান্য একটু বেশি চওড়া আলপথের থেকে। বৃষ্টির সময় রাস্তাটি ডুবে যেত দুই ক্ষেতের প্রবহমান জলে। পৌঁছে যেতাম আমি পিসিমণির বাড়ি এক দৌঁড়ে দুই ক্ষেতের মাঝ দিয়ে, জল-কাঁদা পেরিয়ে। কাকুমণি চলে যেতেন অফিসে, ছোটকাকু-ফুলপিসি-কুট্টিপিসি কলেজ অথবা স্কুলে, দাদুভাই জমি-বাগানের নানা কাজে ব্যাস্ত বাইরে, ঠাম্মা ব্যাস্ত রান্না-ঘরের কাজ নিয়ে। আমি তখন একা কী করবো ! চলে যেতাম  পিসিমণির বাড়ি। অবশ্য ফুলপিসির দেওয়া পড়া এবং হাতের লেখা শেষ করে। ফুলপিসি তখন কলেজে পড়ত, আমার বর্ণপরিচয়ের  হাতেখড়ি ফুলপিসির কাছেই। বুলুদি একটু বড় আর দুলু আমার সমবয়সী। আমার খেলার আর গল্প-গুজবের সঙ্গী ছিল তারা। পিসিমণির বাড়িতেও ছিল একটা পুকুর, আকারে একটু ছোট আমাদের বাড়ির থেকে। আমি আমাদের পুকুরে স্নান করেই যেতাম পিসিমণির বাড়ি। কারণ পিসিমণির বাড়ির পুকুর বাঁধানো ছিল না, নারকেল গাছের গুঁড়ি দিয়ে সিঁড়ি বানানো হয়েছিল। একটু ভয় করতো ঐ পুকুরে নামতে। কারণ আমি তখন সাঁতার জানি না, সাঁতার শিখেছি আমি আমাদের পুকুরে বেশ অনেক পরে। রোববার স্কুল ছুটির দিন, আমার থেকে ৭ বছরের বড় দাদাভাই আমাকে নিয়ে মাছ ধরতো পুকুরে গামছা দিয়ে। আমি গামছার একদিক ধরে বসে থাকতাম নারকেল গাছের গুঁড়ির উপর আর দাদাভাই আরেক প্রান্ত গামছা ধরে থাকত একহাঁটু জলে নেমে। অনেক কসরৎ করে হয়ত পেতাম কয়েকটি চুনোপুঁটি অথবা কাঁকড়ার বাচ্চা। তাতেই কী আনন্দ আমাদের ! যুদ্ধ জয় করে এসেছি, এইভাবে গামছার উপর ধরা প্রাণীগুলোকে ফেলে দিতাম পিসিমণির রান্নাঘরের মেঝেতে। তারপর আমাদের আবদার, কাঁকড়ার অথবা পুঁটিমাছের ঝাল বানানোর। দারুন বানাতেন এটা পিসিমণি। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু খাওয়ার বিরাম নেই। বিকেলের আগে আর ফেরা হত না পিসিমণির বাড়ি থেকে।
    বাবা-মা আসতেন যখন বাবার ছুটি থাকত, পুজো-পার্বণে। মাকে সবসময়ের জন্য পেতাম না বলে, হয়তো আমি ছুঁটে ছুঁটে বারবার চলে যেতাম পিসিমণির বাড়ি, পিসিমণির স্নেহ-মমতা'তে ভাগ বসাতে অন্য ভাই-বোনদের সাথে।
    অনিমেষ থাকে তখন জলপাইগুড়িতে দাদুর সাথে। অনিমেষের মা-বাবা এসেছেন স্বর্গছেঁড়া থেকে, জলপাইগুড়ি বাড়ির গৃহপ্রবেশে। "একসময় একটু একলা পেয়ে মাধুরী ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, 'হ্যাঁ রে, আমার জন্য তোর মন কেমন করে না ?' আর সঙ্গে সঙ্গে অনি ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললো। ------ অনি মাধুরীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।" 'উত্তরাধিকার' উপন্যাসের এই অংশটি পড়ার সময় আমার মনে পড়ে যায়, আমার মাকে জড়িয়ে ধরে কোলের উপর মুখ গুঁজে কান্না - যখন মা দুর্গাপুজোর দশমীর দিন মুখে একগাদা সিঁদুর লাগিয়ে বসে থাকতেন লুকিয়ে রান্নাঘরের একপাশে সিঁড়ির ঘরের কোনায়, অন্ধকারে। আমি কী মায়ের অভাববোধ করতাম সেইসময় ? জানিনা, কারণ তখন দাদুভাই ছিলেন আমার একটা নির্ভরশীলতার জায়গা। একটা নিবিড় সম্পর্ক অনুভব করতাম ওনার সান্নিধ্যে। 
    ****
    দাদুভাই ওনার পিতা ‘শ্রী শিবচরণ দে’-এর নামানুসারে আমাদের বাড়ির নাম ‘শিবালয়’ রেখেছিলেন। যদিও আমাদের বাড়িটি ‘দারোগা বাড়ি’  নামে বেশি পরিচিত ছিল, যা এখনও একই নামে ডাকা হয়। আমার পরিচিতি আজও বারাসাতে দারোগাবাড়ির বড়নাতি নামে।    ( ক্রমশ )
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই প্রতিক্রিয়া দিন