এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • গরবিনী - ১২ এবং শেষ পর্ব 

    Supriya Debroy লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৮ নভেম্বর ২০২২ | ২৬৩ বার পঠিত
  • ‘আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না কী করে কুসুমের সামনে দাঁড়াবো। কী করে সামলাবো কুসুমকে যখন ও মানিক'দার মরদেহ দেখবে। কিন্তু কুসুম আমার কাজ সরল করে দেয়। সেদিন ওকে দেখে মনে হচ্ছিলো, ও যেন জানতোই এটা হবে। আমি কুসুমকে সেদিনের পর থেকে আজ পর্যন্ত্য এক বিন্দু চোখের জল ফেলতে দেখিনি। আমি সেইসময় কয়েকদিনের জন্য কুসুমের সাথে থাকবো বলে ভেবেছিলাম। কিন্তু একদিন পর ও আমাকে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। বলে, আমার প্রয়োজন অনেক বেশি রণাঙ্গনে - আগরতলাতে নয়। জানায়, তোর অন্নপ্রাশনের তারিখ ঠিক হলে খবর পাঠিয়ে দেবে, যেন দু'দিনের জন্য আসি। কয়েকদিন পর থেকে কুসুমও শুরু করেন ত্রাণ শিবিরে যাওয়া। কিন্তু বকুল, আমি বুঝতে পারি আমার বোনকে। কুসুম এতদিনের চাপা দহনে ভিতরে ভিতরে দগ্ধ হয়ে গেছে। ওর এবং পুতুলের পুরো সংসার আপনজন সব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে দুইটি বিষবাষ্পযুক্ত ফুৎকারে। ওর তখন ধ্যানজ্ঞান সব তোকে ঘিরে। মানিকের বংশের একমাত্র প্রদীপ। তাই নিজেকে শক্ত রেখেছে, ভাঙতে দেয়নি। বংশের একমাত্র সলতের আগুন যেন কখনও নিভে না যায়। সময় মানুষকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু কখনো কখনো পিছনে ফেলে আসা দিনগুলি বিক্ষত হৃদয় নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। কর্তব্যের খাতিরে এতদিন হয়তো স্মৃতিময় খাতার পাতাগুলো মনের উপর ছাপ ফেলতে পারেনি অথবা ফেলতে দেয়নি, আজ হয়তো হৃদয়ের গভীরে ঘুমিয়ে থাকা অতীতগুলো, আকাশ অন্ধকার করা মেঘগুলো এসে ভিড় করছে তোর মা কুসুমের মনের আকাশে। তোর পুতুল কাকি নিজেকে সামলে নিতে পেরেছে, কারণ ছিল আমাদের সাথে। কিন্তু তোর মা একা তোকে নিয়ে থেকে গেছে এখানে। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর আমরা অনেক বলা সত্বেও, কুসুম রাজি হয়নি কেরানীগঞ্জ ফেরত যেতে। এই ত্রাণ শিবির, এই আগরতলা - যেখানে তোরা তিনজন একসাথে কাটিয়েছিস প্রায় মাস দুয়েক - সেই জায়গা ছেড়ে যেতে চায়নি। আমি বুঝি, সেই স্বল্পসময়ের সুখের স্মৃতি এখানে ফেলে রেখে কুসুমের পক্ষে ফেরত যাওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু আজকাল আমি লক্ষ্য করেছি কুসুম বোধহয় মানসিকভাবে বৃদ্ধ হয়ে পড়ছে। তুই আরো ভালো বুঝতে পারবি। তোকেই এখন তোর মাকে কাঁদিয়ে হাসিয়ে যেমন করে হোক স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। আমার এবারের আসার একটা উপলক্ষ্য কিন্তু এটাই।' 
    বাবার কাহিনী শুনতে শুনতে বকুলের দৃষ্টি আশেপাশের গাছগুলির দিকে চলে যায়। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে গাছগুলির দিকে। সেই ছোটবয়স থেকেই বকুলের মনে হতো এই গাছগুলির নীচে এসে দাঁড়ালে, যেন বাবা বকুলের মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন - পৃথিবীর সমস্ত ঝড়-ঝঞ্ঝা আড়াল করে। ছোট্ট একটি শব্দ বাবা। বাবা মানে আদর, বাবা মানে আবদার, বাবা মানেই নীরব ভালোবাসা। বাবা যেন নীরবে বয়ে চলা একটি নদী। একজন নির্ভীক নাবিক। যে শত ঝড়, তুফানের মাঝেও জাহাজ বাঁচাতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেন না। বকুল উপলব্ধি করতে পারে, তার বাবা ছিলেন একজন নির্ভীক সৈনিক। যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন অনেক বাবার সাথেই একটি স্বাধীন দেশের যেখানে বকুলের মতো অসংখ্য ছেলে-মেয়েরা পাবে একটি নিজেদের মানচিত্র ও পতাকা। বকুল সত্যিই আজ গরবিনী তার বাবার জন্য, যিনি ছিলেন তিরিশ লক্ষ আত্মবলিদান শহীদদের মধ্যে একজন। অনেক অনেক গর্বিত আজ মায়ের জন্য যিনি সবকিছু হারিয়েও অটুট থেকেছেন তার লক্ষ্যে, দেশের জন্য তার আত্মত্যাগে - নীরবে, সবার অগোচরে।  
    রতন মামা উঠে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবিটা হাত দিয়ে ঝাড়ছেন, বকুলও উঠে দাঁড়িয়েছে। বেশ বেলা হয়ে গেছে, এবার মায়ের খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে যাবে। এর মধ্যে হয়তো দশবার পুতুল কাকিকে জিজ্ঞেস করা হয়ে গেছে - মামা, ভাগ্নি এই দু'জনে গেলো কোথায় এই সকালে ! বাড়ি অভিমুখে যাওয়ার পথে হঠাৎ বকুল শুনতে পায় মামার ভরাট গলায় মহাদেব সাহার 'আমি যখন মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি' কবিতাটি। মামা যে এতো ভালো কবিতা আবৃতি করেন, বকুলের জানা ছিল না।  
    “আমি যখন মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি তখন তেরোশত নদী / গেয়ে ওঠে আমার সোনার বাংলা,  / সহস্র পাখির কণ্ঠে জয় বাংলা ধ্বনিত হতে থাকে; 
    আমি যখন মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি তখন সাতই  মার্চ / জেগে ওঠে,  / শেখ মুজিব ঘোষণা করেন স্বাধীনতা। 
    আমি যখন মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি তখন পর্ণকুটিরে / জ্বলে ওঠে আলোকশিখা, / শহীদ জননীর প্রাণ গর্বে ভরে ওঠে, চোখের জল মুছে ফেলে, / তখন বাংলার সবুজ প্রান্তর শস্যে ভরে যায়, পদ্মায় চলে / ইলিশের ঝাঁক, / তখন লক্ষ লক্ষ রক্তগোলাপ ফুটে ওঠে বাগানে, আকাশে হয় নতুন সূর্যোদয়, / হৃদয়ে-হৃদয়ে জেগে ওঠে বাংলাদেশ, আমার সোনার বাংলা।“     (সমাপ্ত)
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন