এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • গরবিনী - পর্ব ১০

    Supriya Debroy লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৫ নভেম্বর ২০২২ | ২১৩ বার পঠিত
  • (এগারো)
    বকুল ঘরের ভিতর শুয়ে আছে। বাইরে বারান্দায় মোড়াতে বসে কুসুম চা খাচ্ছেন কমলার সাথে। এখনও অন্ধকার পুরোপুরি কাটেনি। পুব আকাশে মেঘের আড়াল থেকে উঁকি মারছে সূর্যের আবছা রক্তিম আভা। এখন প্রায়ই ঝড়-বৃষ্টি হয়। গতকাল রাতেও ঝিরঝির করে কয়েক দানা পড়েছে। ভোরের বাতাসেও একটা আদ্রতার মিশ্রণ। মানিকরা চলে গেছেন, প্রায় একমাস হয়ে গেল। এর মধ্যে লোক মারফৎ খবর পাঠিয়েছেন ত্রাণ শিবিরে, সবাই ঠিক আছেন। পুতুলের থেকেও খবর এসেছে। জানিয়েছে, রতন'দা এবার বাড়ি আসলে - ওকে নিয়ে চলে আসবে এখানে। রতন'দাও এখন আছেন আশুগঞ্জ, কসবা অঞ্চলে। মানিকের সাথে যোগাযোগ হয়েছে রতন'দার।     
    সন্ধ্যেবেলায় এই এতবড়ো বাড়িতে ফিরে কুসুমের প্রাণটা কেঁদে ওঠে। জনমানবহীন দু'টো ঘর খাঁ খাঁ করে, অন্ধকার যেন গিলে খেতে আসে। কিছুদিন আগেই বাড়িটা কী সুন্দর প্রাণবন্ত ছিল। কমলা আসে বেশ রাত করে। বয়স্কলোকদের রাত্রের খাওয়া-দাওয়া করিয়ে।
    কুসুম মাঝেমাঝেই ভাবেন, কয়েকমাসের মধ্যে প্রত্যেকটি মানুষের জীবনযাত্রার কত পরিবর্তন হয়ে গেল। চার-পাঁচ মাস আগেও যখন ঢাকা হাসপাতাল থেকে নিজেদের সিদ্ধেশ্বরীর বাড়িতে ফিরতেন, শ্বশুরমশাইকে দেখতে পেতেন রেডিও খুলে বসে আছেন। সারাদিনের শোনা খবর উগরে দিতেন কুসুমকে। খুড়শাশুড়িমা আর পুতুল রান্নাঘরে কিছু না কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। কুসুম আসতেই পুতুল দৌঁড়ে এসে কুসুমকে পাঠিয়ে দিত বাথরুমে, হাসপাতালের কাপড় ছাড়ার জন্য। নিয়ে আসত চিঁড়েভাজা কিংবা মুড়িমুড়কি চায়ের সাথে। সারাদিনের জমানো কথা একসাথে বলে যেত। কোনো দাড়ি কমা থাকতো না তার বাক্যে। দিদিভাইকে সব না শুনানো পর্যন্ত্য ও থামতে পারতো না। আর আজ কী অবস্থা পুতুলের! একটি প্রাণচঞ্চল ভোমরার ফুলে ফুলে ঘুরে গানের গুনগুনানি থেমে গেছে চিরকালের জন্য। মানিক আজও জানেন না তার বোন কোথায়, কী অবস্থায় আছে। সবার সবকিছু কেমন যেন ওলোটপালোট হয়ে গেল কয়েকমাসের মধ্যে। কিছু স্মৃতি, কিছু শোক বুদ্বুদের মতো ভেসে ওঠে মনের গহীনে। দুঃখের স্মৃতি-জাগানিয়া শোকগুলি মনের ভিতর ঘুরপাক খায়। কখনও মন গুমরে কেঁদে ওঠে। মনকে শূন্যতায় ভরিয়ে রাখে। 
    চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আবছা ভোরের আলোতে দেখতে পান কুসুম কয়েকজনকে ওনার বাড়ির দিকে অগ্রসর হতে। কেন জানেন না, কুসুমের বুকটা হঠাৎ কেঁপে ওঠে। ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয় ত্রাণ শিবিরের প্রধান জ্ঞান চক্রবর্তীর চেহারাটি, ওনার পিছনে মানিকের একজন সঙ্গী, রতন'দা এবং তার পিছনে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা সবুজ আর্মির কাপড়ের বেশে, কাঁধে একটি পলিথিনে মোড়া বস্তু। কুসুমের হাতের থেকে পড়ে যায় চায়ের কাপ। যা বোঝার উনি বুঝে গেছেন। পলিথিনে মোড়া শরীরটি যখন বাড়ির উঠোনে রাখা হয়, কুসুম দেখতে চান মানিকের মুখটি। জ্ঞান চক্রবর্তী না করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে যা শুনেছেন, পলিথিন সরানো উচিত হবে না। কিন্তু কুসুমের জেদাজেদিতে বাধ্য হন জ্ঞান চক্রবর্তী মুক্তিযোদ্ধাদের অনুরোধ করতে। জ্ঞান চক্রবর্তী অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন, কুসুমের কঠিন পাথরসম মুখের দিকে তাকিয়ে। চোখ যেন মরুভূমির মতো শুকনো, এক ফোটা জল নেই সেখানে। মানিকের দুই চোখ ওপড়ানো ক্ষতবিক্ষত মুখের দিকে তাকিয়েই জ্ঞান চক্রবর্তী নিজের মুখ ঘুরিয়ে নেন। নিজেকে সামলাতে পারেন না। দৌঁড়ে উঠোনের বাইরে চলে যান। পেটের নাড়িভুড়ি পাকিয়ে টক জল ক্রমাগত বেরিয়ে আসতে থাকে গলা দিয়ে। কুসুমকে জড়িয়ে কমলা হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে। নাড়াতে থাকে, ঝাঁকাতে থাকে কুসুমকে জোরে জোরে। কুসুম বসে আছেন মোড়ার উপর এক পাথরের মূর্তির মতন। কমলা কিছুতেই পারে না কুসুমকে কাঁদাতে।

    (বারো)

    বর্ষাস্নাত সকালে বকুল যখন গরিমসি করছে বিছানা থেকে উঠতে, হাজারবার কুসুমের ডাকা সত্বেও - তখনিই হঠাৎ কুসুম এসে জানান, দেখ কারা এসেছে। রতন মামা আর পুতুল কাকিকে দেখে তড়াক করে এক লাফে বিছানা থেকে উঠে পড়ে বকুল। বকুলের খুব প্রিয় এই রতন মামা আর পুতুল কাকি।  ওনারা বকুলের আসার খবর পেয়েই, হঠাৎ করে ঠিক করেন এখানে চলে আসার এবং গতকাল রাতে বেরিয়ে পড়েন। ঢাকা থেকে বাসে করে আখাউড়া বর্ডার, তারপর বর্ডার থেকে এন্ট্রি পাস বানিয়ে ৭ / ৮ ঘন্টা লেগে যায়। মামীর কথা জিজ্ঞেস করতে জানতে পারে মামীর শরীর ভালো নেই, তাই আসেননি। রতন মামার ছেলে খোকন রাজশাহীতে থাকে সপরিবারে, অধ্যাপক।
    রতন মামার বয়স সত্তর পেরিয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের অনেক কাহিনী রতন মামার থেকে বকুল শুনেছে এর আগে। গা শিউরে ওঠে। হাতের লোম খাড়া হয়ে যায়। মর্মান্তিক কাহিনীগুলি শুনতে শুনতে। গা ঘিনঘিন করে উঠত যখন কাহিনীগুলির মধ্যে এসে যেত নিরীহ নারীদের লাঞ্ছনা, নির্যাতনের কথা। ঢাকা ইউনিভার্সিটির রোকেয়া হলে মহিলা পড়ুয়াদের উপর নির্যাতনের ঘটনা শুনে গা গুলিয়ে উল্টি এসে যেত।
    কিন্তু রতন মামা সবসময় এড়িয়ে যেতেন বাবার কথা উঠলে। বাবার অনেক কথাই বকুল জানতে পেরেছে মায়ের লেখা হলুদবর্ণ কাগজগুলি থেকে। কিছু শুনেছে পুতুল কাকির থেকে। কিন্তু বাবার কী হয়েছিল ওনার শেষ যুদ্ধক্ষেত্র কসবা অথবা আশুগঞ্জ অঞ্চলে, সেটা রতন মামা কিছুতেই বলতে চান না। বারবার এড়িয়ে যান। এবার বকুল চেপে ধরেছে রতন মামাকে। বলতেই হবে। রতন মামা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলেন, 'ঠিক আছে বলবো। কিন্তু মাকে জানাতে পারবি না।'     ( ক্রমশ )

     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ মতামত দিন