এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • গরবিনী - পর্ব ৯

    Supriya Debroy লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৪ নভেম্বর ২০২২ | ২৩৬ বার পঠিত
  • ঝিনিকই প্রস্তাব দেয়, রাত্রিতে ওর বাপের বাড়ি চান্দিনাতে থেকে যেতে। চান্দিনা কুমিল্লা পৌঁছনোর একটু আগে। কুসুমেরও এটা ঠিক লাগে। বকুলকে কোলে নিয়ে আজ কোনোভাবেই সম্ভব নয় আগরতলা পৌঁছনোর। ঝিনিক ওর বাবার নামে একটি চিঠি লিখে কুসুমের হাতে দেয়। রোদের তেজ একটু কমলে কুসুমরা বেরিয়ে পরে। ঝিনিক বেরোনোর সময় কুসুমকে জড়িয়ে বলে, 'দিদিয়া, জানিনা কতদিন আমরা বেঁচে থাকবো। তবে যদি বেঁচে থাকি দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত, আমাদের আবার দেখা নিশ্চয়ই হবে।'
    রাতে ঝিনিকের বাপের বাড়ি থেকে, পরেরদিন সন্ধ্যেবেলায় পৌঁছান আগরতলাতে। এতদূর রাস্তা - কিছুটা ভ্যানরিক্সায়, তবে অধিকাংশটাই হেঁটে। মানিকের দেখা পান ন্যাপ পরিচালিত ত্রাণ শিবিরে। মানিক এই প্রথম প্রায় দেড় মাসের বকুল অর্থাৎ নিজের কন্যার মুখ দেখলেন। 
    (দশ)
    ত্রাণ শিবির থেকে অনতিদূরেই অবস্থিত একটি বাসস্থানে, মানিক নিয়ে আসেন কুসুম এবং বকুলকে। তিনটি শোওয়ার ঘর। একটি মানিক এবং কুসুমের জন্য রাখা হয়েছে। বাকি দুটি ঘরে মানিকের সঙ্গী সাত-আটজন থাকে। তক্তপোষ অথবা অন্য কোনো আসবাব চোখে পড়লো না কুসুমের। মেঝেতে এককোনায় গুটিয়ে রাখা আছে তোষক, বালিশ। রান্নাঘরে কয়েকটি বাসনপত্র কাজ চালাবার মতো। মিলেমিশে সবাই রান্না করে, জানতে পারেন কুসুম। কুসুম বুঝতে পারেন, ওনাকে নিজেই হাল ধরে ঘরটি বাসযোগ্য করে নিতে হবে। এর মধ্যে মানিক বিছানা মেঝেতে পেতে ফেলেছেন। অন্য ঘর থেকে একটি মাদুর এনে পেতে দেন ঘরের এক কোনায়। কুসুম মানিকের কোলে বকুলকে দিয়ে, রান্নাঘরে যান গরম জল করার জন্য। স্টোভে জলের গামলা বসিয়ে, ব্যাগ খুলে বের করেন বকুলের সামগ্রী, গা মোছার তোয়ালে এবং নিজের শাড়ি-ব্লাউস, গামছা, ইত্যাদি। মাদুরের উপর বকুলকে শুইয়ে গরম জল দিয়ে গা মুছিয়ে দেন বকুলের। পরিষ্কার একটি ইজের, টেপ জামা পরিয়ে বকুলকে মানিকের কোলে দিয়ে, নিজে বাথরুমে চলে যান স্নান করতে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখতে পান, বকুল দুই হাত-পা ছুড়ে বাবার কোলে করছে ফস্টিনস্টি - দু'পাটি ফোকলা মাড়ি বের করে। স্বস্তি পান এই ভেবে, বাবা-মেয়ের মধ্যে বেশ ভাব হয়ে গেছে।
    বকুলকে বুকের দুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছেন কুসুম। এরমধ্যে মানিক বেরিয়ে গেছেন, বলে যান আসছেন কিছুক্ষণের মধ্যে। নিয়ে আসেন একটি বাচ্চাদের খেলার ঝুনঝুনি, কয়েকটি প্লাস্টিকের পুতুল। হাতে একটা মাঝারি সাইজের পাউরুটির প্যাকেট। মানিক নিজেই রান্নাঘরে গিয়ে পাউরুটি সেঁকে, চা বানিয়ে নিয়ে আসেন দুই কাপ। চা খেয়ে কুসুমকে শুয়ে পড়তে বলেন। জানান রাত্রে ওনার সঙ্গীরা এসে খিঁচুড়ি বানাবে। বেশিরভাগ দিনই খিঁচুড়িই বানানো হয়। মাঝে মাঝে ডাল, ভাত অথবা মাংস বানানো হয়। মাছ বানাতে কেউ পারে না। মানিক জানান, ২৭ মার্চ যখন উনি নার্সিং হোমে এসেছিলেন, খবর পেয়েছিলেন যে ওনাদের সিদ্ধেশ্বরীর বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। উনি ইচ্ছে করেই কাউকে জানাননি।
    ধীরে ধীরে কুসুম মানিয়ে নেন নিজেকে। ক্যাম্পে যে শরণার্থী আসতেন, তাদের চিকিৎসা করার দায়িত্ব দেওয়া হয় কুসুমকে। কুসুম চাইছিলেন নিজেকে কিছুর সাথে ব্যস্ত রাখতে এবং প্রতক্ষ্য কিংবা পরোক্ষ ভাবে মুক্তিযুদ্ধের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে। এর মধ্যে বকুলকে অভ্যেস করিয়েছেন টিনের গুঁড়ো দুধ থেকে দুধ বানিয়ে খাওয়ানোর। ত্রাণ শিবিরে কমলা বলে একজন পরিচারিকা ছিল। সে বয়স্ক শরণার্থীদের ফাই-ফরমাশ খাটতো। কুসুম যখন কারুর চিকিৎসা করার জন্য ব্যস্ত থাকতেন, তখন বকুলকে কমলার কাছে রেখে দিতেন। এই ত্রাণ শিবিরে মুক্তিযুদ্ধাহতদের জন্য তখনও কোনো হাসপাতাল চালু করা সম্ভব হয়নি। তাদের ভর্তি করা হতো শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে। কুসুম নিজে থেকেই অগ্রসর হয়ে দায়িত্ব নেন, ঐ যুদ্ধাহতদের খোঁজখবর নেওয়ার বিভিন্ন হাসপাতাল পরিদর্শন করে। হাসপাতাল থেকে অনুমতি আদায় করেন ত্রাণ শিবিরের দায়িত্বে থাকা জ্ঞান চক্রবর্তী। কুসুমের সাথ দেন ত্রাণ শিবিরের আরো কয়েকজন মহিলা কর্মী। এতে চিকিৎসার সাথে সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধির সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
    দেখতে দেখতে দেড় মাস সময় কেটে যায়। মানিক এবং ওনার সঙ্গীরা এতদিন ব্যস্ত ছিলেন আখাউড়া সীমান্তে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ করা, আহতদের আগরতলা হাসপাতালে নিয়ে এসে ভর্তি করানো, শরণার্থীদের সীমান্ত পার করিয়ে ত্রাণ শিবিরে নিয়ে আসা, ইত্যাদি। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে মানিক এসে বলেন, ওনার উপর নির্দেশ এসেছে - সঙ্গীদের নিয়ে আশুগঞ্জ, কসবা অঞ্চলে যেতে। মুক্তিযুদ্ধের জন্য যে দশটি সেক্টর তৈরী করা হয়েছে, তার মধ্যে ঢাকা এবং কুমিল্লা অঞ্চল একটি সেক্টর। এই সেক্টরের অধীনে আখাউড়া, কসবা, আশুগঞ্জ একটি সাব-সেক্টর। মানিককে ওনার বাহিনী নিয়ে সাহায্য করতে হবে সাব-কমান্ডার লেফটেন্যান্ট ফারুক এবং লেফটেন্যান্ট হুমায়ুন কবিরকে। কুসুম জানতেন এই দিনটি একদিন আসবে, এবং প্রতীক্ষায় ছিলেন এই দিনটির জন্য। মানিক জানান, উনি ত্রাণ শিবিরের সাথে কথা বলে নিয়েছেন - পরিচারিকা কমলা কুসুমের সাথে রাত্রে থাকবে।       ( ক্রমশ )

    ঋণস্বীকার : ন্যাপ পরিচালিত ত্রাণ শিবির এবং ত্রাণ শিবিরের প্রধান জ্ঞান চক্রবর্তীর নাম ইন্টারনেট থেকে সংগৃহিত। লেফটেন্যান্ট ফারুক এবং লেফটেন্যান্ট হুমায়ুন’এর নামও ইন্টারনেট থেকে সংগৃহিত।
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন