এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • গরবিনী - পর্ব ৭

    Supriya Debroy লেখকের গ্রাহক হোন
    ৩১ অক্টোবর ২০২২ | ৩২৭ বার পঠিত
  • বিছানায় শুয়ে বকুল ভাবে, মায়ের লেখা পাতাগুলির থেকে অনেক ঘটনা জানলেও শুনেছিলো পুতুল কাকির থেকে তার জীবনের সবচেয়ে মর্মান্তিক দিনের কথা। বকুল যখনই নবারুণ ভট্টাচার্যর লেখা, ' ----- এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না / এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না / এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না / এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না। ----' কবিতাটি পড়ে - যেন আগুন লেগে যায় নিজের শরীরের রক্তে, আর তখনই মনে পড়ে যায় পুতুল কাকির, বাবার, মায়ের সবহারানোর কাহিনী।       

    (আট)

    ঢাকার সিদ্ধেশরীর বাড়িতে তালা লাগিয়ে কুসুম ও পুতুলের শ্বশুরমশাই'রা গুলবাগে চলে গিয়েছিলেন। ওখানে পৌঁছে কুসুমের মা দেখেন বাড়ি প্রায় ভস্মীভূত। আশেপাশের প্রায় সবকটি বাড়িরই অর্ধদগ্ধ  অবস্থা। কাউকেই আশেপাশে নজরে আসছে না। বাড়ির এই অবস্থা দেখে পুতুল মুখে শাড়ির আঁচল চাপা দিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে। তিনটি ঘর পেরিয়ে মাসুদ সাহেবের পাকা বাড়ি। সেখানে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, আশেপাশের সবাই ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। পাকবাহিনীর টার্গেট ছিল মানিকদের বাড়ি। বাড়িতে কাউকে না পেয়ে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং সেই আগুনে আশেপাশের কয়েকটি বাড়িও আংশিক পুড়ে যায়। ২৭ মার্চ কারফিউ শিথিল হলে সবাই মানিকদের পাড়া ছেড়ে চলে গেছে। মাসুদ সাহেবও তোড়জোড় করছেন ওনার বন্ধুর বাড়ি আগরতলাতে চলে যাওয়ার জন্য, দু'তিন দিনের মধ্যে বেরিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা। মাসুদ সাহেব কুসুমের খবর শুনে, কুসুমের মাকে বলেন ওনার বাড়িতে থেকে যেতে। কুসুমের মা জানান, ওনার এক ভাই নগরপাড়াতে থাকে। যদি ভাইকে না পায়, তাহলে মাসুদ সাহেবের বাড়িতে আসবেন।
    নগরপাড়া এলাকাতে কুসুমের মায়ের এক দূরসম্পর্কের ভাই, ভাইবৌ থাকে। সেখানে চলে যায় দুইজনে। কুসুমের মা একটু চিন্তায় ছিলেন, যদি গিয়ে দেখেন বাড়ি খালি। কারণ এই গন্ডগোলের সময় কে কোথায় আছে, কোথায় পালিয়ে গেছে, বেঁচে আছে কিনা - ঠাওর করা মুশকিল। ভাগ্যক্রমে ভাইকে পেয়ে যান। তবে ওরাও যাওয়ার প্রস্তুতিতে। দু'এক দিনের মধ্যে বেরিয়ে যাবে ভাইবৌয়ের বাপের বাড়ি নাড়াহাড়িপুরে। বনগাঁর কাছে। বেনাপোল সীমান্ত এলাকা থেকে আধা ঘন্টার রাস্তা।                                              
    একদিন পর কুসুমকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কুসুম কন্যাসহ মা এবং পুতুলের সাথে চলে আসেন কেরানীগঞ্জে।
    দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ কেটে যায়। মানিকের কোনো খবর নেই। মেয়ে সামলানো এবং হাজারো কাজের মধ্যেও কুসুমের মন মাঝে মাঝেই উতলা হয়ে যায় মানিকের জন্য। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর, মেয়ে বকুলকে ঘুম পাড়িয়ে - বোশেখ মাসের তপ্ত দুপুরে বারান্দার রোয়াকে বসে তাকিয়ে থাকেন রাস্তার দিকে, যতদূর চোখ যায়। পুতুলের বিষণ্ণ মুখ, ননদ রানীর কী হলো - আদৌ বেঁচে আছে কিনা, মানিক কেমন আছে - কোথায় আছে, সব কিলবিল করে মাথায় একসাথে ভিড় জমিয়ে জট পাকিয়ে দেয়। এরমধ্যে রতনদা মুক্তিযুদ্ধ বাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হয়েছে। প্রায় রোজই কিছু না কিছু গায়ের রক্ত উত্তপ্ত করে দেওয়ার মতন খবর আসে।
    কেরানীগঞ্জে এসেই কুসুম খবর পেয়েছিলো ওর স্কুল বান্ধবী নোলক রায়ের। বিয়ে হয়েছিল জিঞ্জিরাতে। ১ লা এপ্রিলের ঐ ভয়ানক রাতের পর, ২ রা এপ্রিল সকালে আর গোলাগুলির আওয়াজ না পেয়ে একটু স্বস্তির শ্বাস যেই নিতে শুরু করেছে, শুনতে পায় মানুষের আর্ত-চিৎকার। নোলক ছিল তখন রান্নাঘরে ওর জায়ের সাথে। নোলক কিছু বোঝার আগেই জা ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় পিছনের আগাছা-জঞ্জাল ভরা পুকুরে। নোলক একবার বলতে গিয়েছিল, শ্বশুর-শাশুড়ি'মা-ভাসুর-স্বামী সবাই ঘরে আছেন। গিয়ে ডেকে নিয়ে আসি। জা ওর মুখ চেপে ধরে। পুকুরের দিকে যেতে যেতেই শুনতে পায় ভারী বুটের আওয়াজ। দু'জনে পুকুরের আগাছা-জঞ্জালের মধ্যে জলে মুখ চুবিয়ে রেখেছিলো ঘন্টার পর ঘন্টা। পরে শুনেছিল, নয় ঘন্টা ধরে বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালিয়ে ছাত্রলিগ নেতাদের ধরার অজুহাতে জিঞ্জিরা গ্রামকে শ্মশানে পরিণত করে পাকবাহিনী। নোলক এবং ওর জা সবাইকে হারিয়ে চলে এসেছিলো কেরানীগঞ্জে নোলকদের বাপের বাড়িতে। ওর জা বরিশালের মেয়ে। নোলক এসেছিলো একদিন কুসুমের সাথে দেখা করতে। কুসুম খেয়াল করেছেন, পুতুলকে হাসপাতালে দেখার পর যেভাবে ওনার ভিতরটা ভেঙে-চুরে কেঁদে উঠেছিল - ওনার বাল্য প্রিয়বান্ধবী নোলকের বেশ দেখে এবার সেভাবে যেন নড়েচড়ে উঠলেন না। উনি কী তাহলে ধীরে ধীরে শক্ত পাষাণ হয়ে যাচ্ছেন ! মনের, হৃদয়ের কমনীয়তা উধাও হয়ে যাচ্ছে ! প্রায় রোজই কোনো না কোনো পরিচিত অথবা আত্মীয়স্বজনের কিছু না কিছু দুঃসংবাদ পাচ্ছেন। কিন্তু খেয়াল করছেন, মনের উদ্বিগ্নতা চিন্তা আস্তে আস্তে লোপ পাচ্ছে। ভিতরটা এখন একটা ধারালো ইস্পাতের ফলার মতো পরিণত হচ্ছে। এমনকি মানিকের জন্য মাঝে মাঝে মনটা উতলা হলেও, কারণ নিজের মেয়েকে এখনো একবার চোখের দেখা দেখলো না সে; সেরকমভাবে মনটা আর উদ্বিগ্ন হয় না। ভাবেন যা করছেন সেটা দেশের এবং সবার ভালোর এবং মুক্তির জন্য লড়ছেন। কুসুম আফসোসে ভুগছেন যে উনি কিছু করতে পারছেন না কারুর জন্য।  ( ক্রমশ )
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে প্রতিক্রিয়া দিন